#স্বর্ণাভ সুখানুভূতি।
#দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ। পর্ব-৩৫ (শেষাংশ)
#আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা।
‘আমার মেয়েটা খুব আহ্লাদী, তাই না?’ আগ্রহী গলায় জানতে চাইলেন ফারুকী।
জাওয়াদ ঘাড় ঘুরিয়ে শ্বশুরের উৎসুকভাব পরখ করল। তারপর বলল,
‘ একবারেই না। ‘
ফারুকী ভ্রু কুঁচকালেন। এমনটা কিভাবে হয়! বিয়ের পর জাওয়াদের সাথে তার দুইবার দেখা হয়েছে। দু’বারই মুশরাফার ব্যাপারে ওর মনোভাব, ওদের কথোপকথন দেখে তিনি বেশ আন্দাজ করেছিলেন মুশরাফা জাওয়াদের কাছে খুব আহ্লাদ করে, জাওয়াদ ও আহ্লাদে আশকারা দেয়। ছোটো ছোটো বিষয়গুলো ছেলেটা যেভাবে মূল্যায়ন করে, যত্ন করে, প্রসন্নতা ভাসে তাতে তো এমনটাই মনে হয়। অথচ ছেলেটা বলছে, মুশরাফা একবারেই আহ্লাদী না। সমীকরণ মিলল না ফারুকীর। তিনি প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকালন। জামাতাকে উলটো প্রশ্ন করতে পারলেন না। মেয়ে-মেয়েজামাইয়ের ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে শ্বশুরের প্রশ্ন অশোভন দেখায়। মনের প্রশ্ন মনে চেপে রাখলেন তিনি। তার না বলাতেও জাওয়াদ প্রশ্ন বুঝতে পারল। নিজ থেকেই উত্তর দিল,
‘ বাবা কিংবা ভাইয়ের আদরের দুলালীরা আহ্লাদী হয়। ছোটোবেলা থেকে মামা-মামী ছাড়া আহ্লাদ করবার মতো কাউকেই পায়নি রাফা। বাবা ভাইয়ের কাছে যতটা নির্দ্বিধায় শখ আহ্লাদ প্রকাশ করা যায়, মামার কাছে ততটা যায় না। রাফার জীবনটা তো বেঁচে থাকার, টিকে থাকার লড়াই করতে করতেই পেরিয়ে গেছে। ওসবের মাঝে শখ আহ্লাদ গুলোও সরে গেছে। আশা গুলো অপূর্ণ থাকতে থাকতে মেয়েটা আশা করা ছেড়ে দিয়েছে। এখন কারো কাছে কোন আশা রাখেনা, আমার কাছে ও না। ভাগের আহ্লাদ তো দূরে থাক, ওর প্রয়োজনীয় জিনিসও চেয়ে নেয় না। সেধে দিতে হয়। ‘
জাওয়াদের কথায় মনে হলো, সে চাইছে মুশরাফা তার কাছে আহ্লাদী হোক, কুড়ি কুড়ি জিনিস চাক, আবদার করুক। মুশরাফা আহ্লাদী হলে সে বেশ খুশি হতো, সে আশকারা দিতে প্রস্তুত। অথচ মুশরাফা আহ্লাদ করে না, এতেই বেজায় আফসোস জাওয়াদের। ওর আফসোসের মাঝে কিসের একটা তীর ছিল, যা বিদ্ধ হলো ফারুকীর বুকে। সেই তীর যেন অপূর্ণতার, অবহেলার, মেয়ের প্রতি দায়িত্বহীনতার। তাকে মনে করিয়ে দিল, মেয়েটার জীবন থেকে সব সুখ কিভাবে কেড়ে নিয়েছেন তারা! তারিফ,সাফার পিছনে মাসে লাখ টাকা খরচ হতো, কত আবদার তাদের! তিনি নির্দ্বিধায় পূরণ করতেন। এখনো জায়ফার পেছনে অনেক টাকা খরচ হয়। হুটহাট জায়ফা এসে বলে, ড্যাড আমার এটা লাগবে ওটা লাগবে, আজ ফ্রেন্ডদের সাথে খেতে যাব, কাল প্রোগ্রাম আছে, শপিং করতে হবে টাকা দাও। ড্যাড, তুমি ফরেন থেকে আসবার সময়, আমার জন্য এই জিনিস নিয়ে এসো। গাদা গাদা জিনিসের লিস্ট ধরিয়ে দেয়। ফারুকী মেয়ের আহ্লাদ ও হেসে পূরণ করেন। না চাইতেও কত জিনিস হাজির করেন। অথচ রাফার বেলায় ছিল তার উলটো। তার মনে পড়ে না, শেষ কবে রাফা তার কাছে আবদার করেছে, রাফার জন্য তিনি ফরেন থেকে জিনিস এনেছেন, কটা টাকা হাতে দিয়ে বলেছে, তোর হাত খরচ। এমন মুহুর্ত নেই তার জীবনে। অনুতপ্ত হলেন তিনি। মুখ মলিন হলো তার। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মেয়েটার সাথে খুব অন্যায় হয়ে গেছে। এর ক্ষতিপূরণ কি দিতে পারবেন তিনি? স্বামীকে এত ভালোবাসা সত্ত্বেও স্বামীর কাছে আবদার করে না, সেখানে তার কাছে করবে? করবে না বোধহয়। এই অপূর্ণতা নিয়েই জীবন পার করতে হবে। তীব্র কষ্ট অনুভব হলো তার। কষ্ট ভরা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ফারুকীর অনুতপ্ততা সেই দীর্ঘশ্বাসে টের পেল জাওয়াদ।
মনের কষ্ট প্রকাশ করলেন না ফারুকী। ধীরে বললেন,
‘ তাহলে কেমন রাফা? আমার তো মনে হয়, রাফা ভীষণ ডিসেন্ট, ইনোসেন্ট আর কুল পার্সোনালিটির মানুষ। ওর সম্পর্কে বলো। আমার তো ওর সম্পর্কে কিছুই জানা হলো না, দেখা হলো না। ‘ ব্যর্থ শ্বাস ফেললেন ফারুকী।
মেয়ের প্রতি বাবার আগ্রহ দেখে ভালো লাগল জাওয়াদের। সে স্মিত হাসল। মনে মনে বলল , ‘ রাফা শান্ত, ভদ্র! হাউ ফানি! মেয়েটা অসম্ভব রকমের চতুর, চঞ্চল, পাজি। শ্বশুরের মুখে মুশরাফাকে শান্ত উপাধি পেতে দেখে হাসি পেল জাওয়াদের। হেসে ফেলল সে। ফারুকী ভ্রু কুঁচকালেন, ‘হাসছ কেন?’
জাওয়াদ হাসি থামাল। কৈফিয়ত দেবার মতো করে বলল, ‘হ্যাঁ, রাফা ভীষণ শান্ত আর ভদ্র। ‘
বাকি কথাটা মনে মনে সম্পন্ন করল, ‘ আমি ছাড়া সবার কাছে। ‘
পরপররেই নিজ থেকে বলল, ‘ভীষণ বুঝদার আর স্ট্রং পার্সোনালিটির চমৎকার মানুষ, রাফা। ‘
স্ত্রীর প্রশংসা করতে গিয়ে জাওয়াদের চেহারায় ঝিলিক দিয়ে উঠল। ফারুকী তা পরখ করে হাসলেন। জাওয়াদের কাধ চাপড়ে বললেন,
‘ খুব সুখী হও তোমরা। আমার মেয়েটার খেয়াল রেখো সবসময়। আগে তো রাফার বাবা ছিল না। এখন রাফার বাবা আছে। কোন সমস্যা হলে নির্দ্বিধায় আমাকে জানাবে। আমি সবসময় তোমাদের সাথে আছি।’
জাওয়াদের এবার সত্যিই মনে হলো ফারুকী সত্যিকারভাবে রাফার বাবা। বাবা বাবাজনক আচরণ করছেন তিনি। রাফার এবার সত্যিই একজন বাবা হয়েছে। যিনি মেয়ের ঢাল হতে চাইছেন। জাওয়াদ খুশি হলো। ভাবল, মুশরাফা কেমন খুশি হবে? খুশিতে পাগল হয়ে যাবে মেয়েটা। জাওয়াদ প্রসন্ন হাসল।
হাঁটতে হাঁটতে লন অবধি এসে গেছে ওরা। জাওয়াদের গাড়ি সামনেই। জাওয়াদ গাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতে গিয়ে থেমে গেল। পিছু ফিরে চাইল শ্বশুরের পানে। বিদায় নিতে বলল,
‘আসছি।’
ফারুকী খেয়াল করলেন জাওয়াদ ওকে কিছু সম্বোধন করছে না। ভাববাচ্য ব্যবহার করছে বেশি। তিনি স্নেহের সুরে বললেন,
‘রাফা আমার বাবা বলে ডাকতো। তুমি ও আমাকে বাবা ডেকো। ‘
শ্বাশুড়ির ওই কান্নামাখা ক্ষমা যতটা না ওর হৃদয় ছুঁয়েছে তার চেয়ে বেশি হৃদয় ছুঁয়েছে শ্বশুরের স্নেহময় আচরণে। জাওয়াদ খুশি হলেও প্রকাশ করল না। বলল,
‘ রাফার উছিলায় আপনার সাথে আমার পরিচয়। ওর সাথে আপনাদের সম্পর্ক ঠিক হলে এই পরিচয় এগিয়ে যাবে, নয়তো এখানেই থেকে যাবে।’
লাল রঙের একটা ইঙ্গিত পেলেন ফারুকী! মনে আতঙ্ক বিরাজ করল। রাফাকে কি পেয়েও হারাবেন তারা? মেয়েটাকে কাছে পাওয়া হবে না? ছেলেটা কি দিবে না? আতঙ্কে বুক কাঁপল। খানিকক্ষণ কথা বলতে পারলেন না। তাকে ভীষণ অসহায় দেখাল। নিজেকে সামলিয়ে বললেন,
‘ আঞ্জুমান ভিলায় তুমি ইনভাইটেড। জামাই আদর নিতে কবে যাবে জানিও। আমি তোমার উত্তরের অপেক্ষায় থাকব। আর একটু আগে জানিও, জামাই প্রথমবার যাবে। প্রস্তুতি নিতে হবে।’
ফারুকী একবারও রাফার ব্যাপারটা এগিয়ে নেয়ার কথা বললেন না। বললেন না, মেয়েটাকে দেখা করাও, ফেরত দাও। কেবল বললেন, তুমি জামাই আদর নিতে আসো। এইদিকটা ভালো লাগল জাওয়াদের। জাওয়াদ সে কথার উত্তর দিল না। গাড়িতে উঠে বসল। স্টেয়ারিং ও হাত দিয়ে আবার চাইল শ্বশুর দিকে। ফারুকী তখনো গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। কী যেন বললেন! জাওয়াদ প্রশ্ন নিয়ে চাইল। ফারুকী স্নেহের সুরে বললেন,
‘ আমার মেয়েটার খেয়াল রেখো। মন পুড়ছে খুব, আমি তো দেখতে পারছি না। তুমি দেখে রেখো। কেমন?’
হাজার আকুতি আক্ষেপ ঝরে গেল ফারুকীর স্বর থেকে। জাওয়াদ মাথা নাড়াল কেবল। বলল, ‘এবার আসছি। ‘
____
ঘড়ির কাটায় তখন রাত ন’টা। সন্ধ্যেবেলা মামার বাসা থেকে বেরিয়ে অনিকের সাথে আড্ডায় বসেছিল। কথার তালে সময়জ্ঞান ভুলে গেছে জাওয়াদ। কলিংবেল বাজাবার পর চিন্তিত মুখে দরজা খুলল মুশরাফা। আসার সময় আইসক্রিম নিয়ে এসেছে জাওয়াদ। প্যাকেটটা মুশরাফার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘আসসালামু আলাইকুম! ‘
মুশরাফা উদাস চোখে চেয়ে প্যাকেট হাতে নিল। জবাব দিল, ‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম। ‘
স্ত্রীর চেহারা পড়ে নিয়ে জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকাল, ‘কী খবর মিসেস? সব ঠিকঠাক? ‘
মুশরাফা মলিন চোখে চাইল। অভিমানী স্বরে বলল, ‘এতক্ষণে মনে পড়ছে আমাকে? সেই সন্ধ্যা থেকে আপনাকে কতগুলো কল করেছি, কোন উত্তর নেই।’
জাওয়াদের চিন্তা প্রকট হলো। মুশরাফা এই টোনে কথা বলেনা তার সাথে। জাওয়াদের সুবিধা অসুবিধা বুঝে সে, ওকে যথেষ্ট স্পেস দেয়। আজ সব নীতি ভাঙল কেন! জাওয়াদ লক লক করে বলল,
‘ স্যরি! আসোলে মামাদের বাসায় ভাইয়ার সাথে আড্ডায় বসেছি, তারপর বের হয়ে অনিকের সাথে বসেছি। সাইলেন্ট করে ফোন যে পকেটে রেখেছি আর হাতে তুলে দেখিনি। কোন সমস্যা হয়েছে, রাফা? ‘
মুশরাফা বলল না। নাক ফুলাল কেবল। জাওয়াদ কাছে এসে আলতো সুরে বলল, ‘কী হয়েছে বলো আমায়? ‘
মুশরাফা খানিকক্ষণ চুপ রইল। তারপর অস্থির স্বর ভেসে এলো,
‘ বাচ্চাটা না খুব কান্না করছে।’
বিড়ালের কথা জাওয়াদের মাথা থেকে সরে গেছে একবারে। সে ভ্রু কুঁচকাল। তার বাসায় বাচ্চা কোথা থেকে এলো! তাদের কি বাচ্চা হয়েছে? সে দ্বিধা নিয়ে বলল,
‘ আমাদের বাচ্চা চলে এসেছে পৃথিবীতে! আমি কি ভুলে গেছি!’
মুশরাফা কপট রাগ নিয়ে তাকাল, ‘আমি মিলোর কথা বলতেছি!’
জাওয়াদ আবার ভ্রু কুঁচকাল,
‘এই মিলোটা কে?’
‘আমার বাচ্চা বিড়াল। ‘ মিনমিনে সুরে বলল মুশরাফা।
জাওয়াদ খানিকক্ষণ অবাক হয়ে রইল। আকস্মিক শব্দ করে হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে বলল, ‘তুমি বিড়ালের কথা বলছো! আমি ভেবেছি, আমাদের বাচ্চার কথা বলছো। যাবার সময় তোমাকে ঠিকঠাক দেখে গেলাম, এই টুকু সময়ে বাচ্চা জন্ম দিয়ে কান্নাও শুনে গেলে। তারপর আমাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছো। আরও কী কী ভেবেছি আমি। ‘
মুশরাফা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘ ঠাট্টা করবেন না। বাচ্চাটা সেই কখন থেকে কান্না করছে। আপনি ভেটে গিয়ে কারণ জেনে আসবেন।’
ভাবখানা এমন যেন ওদের সন্তান কান্না করছে।জাওয়াদের কৌতুক থামল না, ‘মিলো কান্না করছে, তার নাম রেখেছো অথচ জিলাপি দাওনি বলে। আমি কি জিলাপি নিয়ে আসব?’
জাওয়াদের ওমন ঠাট্টায় মুশরাফার মনোক্ষুণ্ণ হলো। নাক ফুলিয়ে বলল, ‘
হাদিসে এসেছে। সাহাবীগণ রাসূল (সা;) কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! চতুষ্পদ জন্তুর প্রতি দয়া প্রদর্শনেও কি আমাদের সওয়াব হবে?’ তখন রাসূল (সাঃ) বললেন, ‘‘প্রত্যেক জীবের প্রতি দয়া প্রদর্শনে নেকী রয়েছে।’’
আজ আপনি জীবের প্রতি দয়া দেখালে কেয়ামতের দিন আল্লাহ আপনার প্রতি দয়া দেখাবেন। একদম ঠাট্টা করবেন না। ওদের বাচ্চার মতো পোষার জন্য আনা হয়েছে। ওরা এখন আমার বাচ্চা। আপনি ওদের হেলা করলে আমি ভীষণ কষ্ট পাব।’
জাওয়াদ হাসি থামাল। চোখ মুখে গম্ভীরতা আনল। ধীরে বলল, ‘ আমি মজা করছিলাম। আমার মনে হচ্ছে নতুন জায়গায় মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছে। তাই কাঁদছে কিংবা মায়ের জন্য কাঁদছে। আর আমি এখনি ভেটে যোগাযোগ করব। চলবে?’
মুশরাফা কিয়ৎক্ষণ উত্তর দিল না। তারপর বলল,
‘আপনি কি ওদের মন থেকে গ্রহন করেন নি?’
‘গ্রহন না করলে ওরা এখানে থাকতো?’ প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্ন করল জাওয়াদ। মুশরাফা বলল, ‘ আমার শখ ভেবে নিজের অপছন্দ ঢাকা দেন নি তো?’
জাওয়াদ ঠাট্টার স্থলে বলল, ‘আমার অপছন্দ হলে কী করবে? ফেলে দিয়ে আসবে?’
মুশরাফা একরাশ আতঙ্ক নিয়ে তাকাল। জাওয়াদের অপছন্দ হলে বাসায় রাখা যাবে না। অল্প সময়েই বাচ্চা গুলোর প্রতি মায়া জন্মে গেছে। এখন ফেরত কিংবা ফেলে দেবার কথা ভাবতেই বুক কাঁপছে। স্ত্রীর আতঙ্কগ্রস্ত মুখ দেখে আবার হেসে ফেলল জাওয়াদ,
‘মজা করছিলাম। বিড়াল কোনকালেই অপছন্দ ছিল না আমার।’
মুশরাফা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। চমকিত চোখে বলল, ‘সত্যি!’
জাওয়াদ এসে ওর গাল টেনে বলল, ‘ হ্যাঁ। আমি খুশিমনে নিজেকে বিড়ালবাবা হিসেবে গ্রহন করেছি। আমার যা আয় তাতে আমাদের দুজনের ভালোভাবে সংসার চলে যায়। ওদের ও হয়ে যাবে। আমি তো বেশি সময় দিতে পারব না। তুমি সময় দিও। যা লাগবে বলবে, আমি এনে দিব। কোন কিছুর কমতি যেন না থাকে। ‘
জাওয়াদ সেই ক্ষণেই ভেটে ফোন দিয়ে বিড়ালের অবস্থা জানিয়ে পরামর্শ চাইল। তারা জানাল, নতুন জায়গায় মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছে। তা ছাড়া নিউবর্ণ বেবি। মা সবসময় উষ্ণতা দিয়ে রেখেছিল। এখন উষ্ণতা না থাকা তারা টের পেয়েছে মা নেই, মায়ের জন্য কাঁদছে। বুকের উপর নিয়ে গায়ে হাত বুলাতে বলেছে। এতে উষ্ণতা পেলে ভাববে মায়ের কাছে আছে। কান্না থামাবে।
জাওয়াদ স্পিকারে দিয়ে মুশরাফাকে শুনাল। ফোন রাখবার পর মুশরাফা চমৎকার হাসল। উৎফুল্ল স্বরে বলল, ‘আল্লাহ, আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিবেন।’
জাওয়াদ স্মিত হাসল। আকস্মিক স্ত্রীর গালে আলতো হাত দিয়ে বলল,
‘ আমাদের যখন সন্তান হবে তখন আমরা ওকে সর্বোচ্চ দিয়ে ভালোবাসব, আদর্শ ভাবে গড়ে তুলব। যত ব্যস্ততা থাকুন, ওর জন্য সময় বের করব। ওর ব্যাপার আমি রুড হলে তুমি নরম হয়ে আগলে নিবে, আর তুমি রুড হলে আমি আগলে নিব। সে যেমনই হোক দিনশেষে ওকে আগলে নিব। আমি চাইনা কোন একটা সময় আমাদের মনে হোক আমরা ব্যর্থ। ওদের কাছে কিংবা কারো কাছে নত হতে না লাগুক। কেমন? ‘
জাওয়াদ আকস্মিক উদাস হয়ে গেল। ওর চোখে শুধু ভরা মজলিসে লায়লার নত মুখ ভাসছে। সন্তানের সামনে মায়েদের সবসময় সম্মানিত হতে হয়, অপমানিত নয়। তারিফের সামনে লায়লা যখন ওর কাছে হাতজোড় করে ক্ষমা চাইছিল, তখন ভীষণ খারাপ লেগেছে জাওয়াদের। নিজের মায়ের কথা মনে পড়েছিল, তার মা যদি তার সামনে কারো কাছে ওমন নত হয় তবে তার কাছে কেমন লাগবে? ওর উদাস চাহনি আর গম্ভীর কথা শুনে মুশরাফা ভ্রু কুঁচকাল,
‘ ঠিক আছে। কিন্তু হঠাৎ এমন কথা কেন বললেন?’
তৎক্ষনাৎ নিজেকে সামলে নিল জাওয়াদ। সন্ধেবেলা ঘটে যাওয়া ওমন কান্ড বুঝতে দিল না। স্বামীর কাছে মা ছোটো হয়েছেন শুনলে মুশরাফা কষ্ট পাবে। জাওয়াদ প্রসন্ন হাসল। বলল,
‘ এমনিই বিড়ালের ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতেই মাথায় এলো। বাচ্চা দুটো এখন আমাদের দায়িত্ব। ওদের আমরা সন্তানের মতো আদর দিয়ে বড়ো করব। বিড়ালবাবা হয়ে গেছি। কদিন বাদে মানব সন্তানের বাবা হবো। কত দায়িত্ব! তাই আগে থেকে পরিকল্পনা করতেছি, আমাদের সন্তান কিভাবে মানুষ করব। ‘
অতি কৌশলে কথা কাটল জাওয়াদ। ওর কথার ভঙিতে মুশরাফার কাছে ব্যাপারটা সন্দেহভাজন ঠেকল না। এমনিতেই ইদানীং জাওয়াদ বাচ্চার প্রসঙ্গ টানে কথায় কথায়। কত পরিকল্পনা তার! এগুলো হয়তো তারই অংশ। এই ভেবে গ্রাহ্য করল না মুশরাফা। ও জাওয়াদের দিকে তাকিয়ে সন্তুষ্টির হাসি দিল। বলল,
‘মানব সন্তানের চ্যাপ্টার এলে পড়া যাবে, আপাতত বিড়ালের চ্যাপ্টার পড়ি?’
জাওয়াদ স্মিত হেসে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াল। ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে দেখল মুশরাফা বিড়াল বাচ্চা কোলে নিয়ে বসে আছে। আলতো হাতে হাত বুলাচ্ছে। বাচ্চার কান্না থেকে গেছে। মুশরাফার চেহারায় মাতৃত্বের আভা। কী অনন্যচিত্তে আগলে রেখেছে! জাওয়াদ প্রসন্ন গলায় বলল,
‘কান্না থেমেছে?’
মুশরাফা চোখ তুলে চাইল একবার। তারপর বিড়ালের গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে স্বস্তিভরা স্বরে বলল,
‘আলহামদুলিল্লাহ। থেমেছে। আমার ভীষণ খারাপ লাগছিল এতক্ষণ ।’
‘ওদের কান্না দেখে?’
মুশরাফা আনমনে বলল,
‘ হ্যাঁ। মাতৃত্ব বিষয়ক ব্যাপারগুলো আমাকে খুব কষ্ট দেয়। বাচ্চাগুলো অল্প বয়সেই মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত। ঠিক আমার…
বলতে গিয়ে থেমে গেল মুশরাফা। মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে। এমন আফসোস সে সচারাচর কারো কাছে করে না। জাওয়াদের কাছে ও না। থেমে গিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সবটা বুঝে নিয়ে জাওয়াদ আজ রাগল না, মন খারাপ ও করল না। হাসল কেবল। ধীরেই বলল,
‘ আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। আল্লাহ বলেছেন, দুঃখের পর সুখ আছে। বিড়াল দুটো মাকে হারিয়েছে তোমার মতো পা পাবে বলেই। তোমার মতো মা পাওয়া কত ভাগ্যের ব্যাপার বলো তো! কেউ তো পেল না। আমার বাচ্চাগুলো এখনো তোমাকে মা হিসেবে পেল না। দুঃখের পরে সুখ আসে। বিড়ালদের এসেছে, তোমার ও আসবে। ‘
মুশরাফা শান্ত হলো। কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বলল, ‘সব কিছুতে বাচ্চাদের টানেন কেন! আমার লজ্জা লাগে!’
জাওয়াদ আবার হাসল। তড়িৎ সামনে এসে দাঁড়াল। ওর চিবুক তুলে কৌতুকের সুরে বলল, ‘ ওমা তুমি লজ্জা পাচ্ছো! দেখি দেখি!’
‘ ধ্যাৎ! ‘ মুশরাফা স্বলজ্জ হেসে মাথা নামিয়ে ফেলল
জাওয়াদ হেসেই গেল, ‘ হবু বাবা হিসেবে বাচ্চাদের বিয়ে চর্চা করা আমার প্রধান কর্তব্য। যাক গে, বাচ্চাদের মায়ের মন ভালো হয়েছে?’
‘ কাউকে কাঁদতে দেখলে আমার খারাপ লাগে। কান্না থেমেছে। শান্তি লাগছে।’ শান্ত স্বরে বলল মুশরাফা।
জাওয়াদ বিড়বিড় করে বলল, ‘ভাগ্যিস তুমি আজ আমার সাথে যাওনি। তোমার মায়ের ওমন কান্না দেখে না জানি কী করতে! ঘটনা শুরু হবার আগেই শেষ হয়ে যেত। আল্লাহ জানে পরে কী হবে! আমার এই বছরটা তোমাদের কান্না দেখতে দেখতে পার হবে । ‘
জাওয়াদ প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে প্রেম নিয়ে বলল,
‘ শুধু বিড়ালের চ্যাপ্টার পড়লে হবে? বিড়ালবাবার চ্যাপ্টার পড়তে হবে না? ‘
মুশরাফা চোখ তুলে চাইল। ওর চোখে মুখে অজস্র প্রেমের রেখা। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে ওঠে দাঁড়াল। বিড়াল কোলে নিয়েই জাওয়াদের একবারে কাছেপাশে দাঁড়াল। তারপর দৈবাৎ জাওয়াদের অধরে অধর ছুঁয়ে দিয়ে ঘোর নিয়ে তাকাল। মোহ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
‘ইউ আর মাই ফেভারিট চ্যাপ্টার। আই লাভ রিডিং ইউ। আপনাকে পড়তে ভালোবাসি। এই চ্যাপ্টার পড়া কখনোই শেষ হবে না, আজীবন প্রেম নিয়ে পড়ে যাব।’
__
দিন তিনেক পরের কথা। ভরদুপুর তখন। জাওয়াদ অফিসে ডেস্কটপের পর্দায় মগ্ন। মুশরাফা খুন্তি হাতে রান্নায় মগ্ন। সেই ক্ষণে জাওয়াদের কাছে ফোন এলো তারিফের। কানে তুলতেই দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে জানাল,
‘ মম হার্ট অ্যাটাক করেছেন। কারণটা বললাম না হয়। হসপিটালাইজড এখন। অবস্থা খুব একটা ভালো না। আমি তোমাকে আসার জন্য বিনীত অনুরোধ করব না। শুধু বলব, তোমার যদি ইচ্ছে হয়, তবে মুশিকে নিয়ে এসো।’
তারিফের স্বরে অভিমানের ছোঁয়া। মম কষ্ট দিয়েছেন, কিছু প্রায়শ্চিত্ত ও কম করেন নি। বিগত দিনগুলোতে ভীষণ কষ্টের সাথে কাটিয়েছেন। মেয়ের জন্য পাগলপারা হয়ে গেছেন। ভরা মজলিসে হাঁটুর বয়সী ছেলের কাছে মাফ চেয়েছেন, করজোড়ে নিবেদন করেছেন। তবুও ছেলেটার মন গলছে না। এ নিয়ে ভগ্নিপতির প্রতি বেজায় নারাজ তারিফ।
জাওয়াদ ফোন রেখে দ্বিধায় পড়ল। নিবেদনের অধ্যায় কি এখানেই সমাপ্তি টানবে? না কি আরও বাড়িয়ে নিবে। কিন্তু একটা মানুষ মৃত্যুশয্যায় আছে, তার উপর রাগ করা তো সাঝে না। মা যেমনই হোক, মুশরাফার এখন মায়ের পাশে থাকা উচিত। জামাতা হিসেবে তার কর্তব্য মুশরাফাকে মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়া। তবে কি এটাই মা-মেয়ের মিলনলগ্ন?
চলবে…
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা