নিবেদন। পর্ব- ৩৫ (প্রথমাংশ)

#নিবেদন। পর্ব- ৩৫ (প্রথমাংশ)
#আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা।

বসার ঘরে চায়ের কাপে চারপুরুষের আলাপ জমেছে। অন্যদিকে খেয়াল নেই। আকস্মিক ঝড়ের বেগে বসার ঘরে ঢুকলেন লায়লা। রুগ্ন, বিধ্বস্ত, উদ্ভ্রান্ত চেহারা তার। ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে কাপটা সবে সেন্টার টেবিলে রাখতেছিল জাওয়াদ। শ্বাশুড়ির অপ্রত্যাশিত আগমনে ভ্রু কুঁচকে চাইল। কয়েকটা প্রশ্ন চলছে মনে। স্ত্রীর সাথে শ্বাশুড়ির করা আচরণ মনে পড়ল। চোখে ভাসল মুশরাফার গায়ে অজস্র আঘাতের চিহ্ন। তৎক্ষনাৎ চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। চোখ ফিরিয়ে ঠিক হয়ে বসল। নির্বিকার দেখাল তাকে। নিজেকে ব্যস্ত দেখাতে চায়ের কাপটা আবার তুলে নিল হাতে। সেই ক্ষণে লায়লা উচ্চৈঃস্বরে ‘জাওয়াদ’ ডেকে তেড়ে এলেন ওর দিকে। লায়লার ভাবভঙ্গি আক্রমণাত্মক ঠেকল জাওয়াদের। উনি কি হামলা করবেন! কে জানে!
এই মুহুর্তে তার জীবনের সবচেয়ে অপছন্দ আর ঘৃণার মানুষ লায়লা। জাওয়াদের মনে অনেক ক্ষোভ জমা। আজ যদি লায়লা কিছু বলে তবে ছেড়ে কথা সেও বলবে না। মুশরাফার গায়ের দাগ দেখলে প্রতিবারই রক্ত গরম হয়ে যায় ওর। মনে হয় লায়লাকে কটা কথা শুনিয়ে দিতে পারলে জীবন ধন্য হতো। পূর্বাকার জাওয়াদের নীতি ভর করে। পরিবর্তিত জাওয়াদ তখন হারিয়ে যায় রাগত জাওয়াদের কাছে।
ক্রোধের শ্বাস ফেলল জাওয়াদ। ততক্ষণে লায়লা এসে দাঁড়িয়েছেন জাওয়াদ বসা সোফার সামনে। জাওয়াদ নড়েচড়ে বসল। চায়ের কাপে চুমুক দিল। তারপর প্রশ্নবিদ্ধ চোখে চাইল তারিফের দিকে। সেই চাহনি যেন কতগুলো হুরিয়ারি বার্তা ছুঁড়ল তারিফের দিকে। এর বিপরীতে তারিফ হাসল। অবেলায় শ্যালকের হাসি দেখে জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকাল। সেকেন্ড কয়েক যেতেই হাসির অর্থ বুঝল। তারপর বিস্ময়ে ভ্রু নাড়াল।

ততক্ষণে গল্পের আসর গল্প হারিয়ে নিরবতায় রূপ নিয়েছে। সবাই নিশ্চুপ বসে আছে। নিরবতা ভাঙলেন লায়লা। অস্বাভাবিক স্বরে বললেন,
‘ আ..আমার মেয়েটা কেমন আছে? ‘

করুণ, অসহায় স্বরে জিজ্ঞেস করলেন লায়লা। কী আকুতি তার স্বরে! জাওয়াদ চোখ তুলে চাইল শ্বাশুড়ির পানে। হাসপাতালে দেখা দাম্ভিক লায়লা এবং আজকের লায়লার মাঝে আকাশ পাতাল ব্যবধান। চোখে তেজ নেই, কথায় রাগ নেই, চলনে অহংকার কিংবা আভিজাত্য নেই। চিন্তিত চোখের রেখা, ভাঙা গাল, ঠোঁটের কোণে হাতাশার ছায়া, সুখের লেশমাত্র নেই। বিধ্বস্ত চালচলন। স্বরে আকুতি, চোখে অনুতাপ। রুগ্নতার চাপ স্পষ্ট। তাকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি জীবনের সবচেয়ে কঠিন মুহুর্তে দিয়ে যাচ্ছে। হতাশায় উন্মাদ হয়ে গেছেন। কী করুণ চোখে তাকিয়ে আছে জাওয়াদের পানে! এতসবের পেছনকার কারণ কি রাফা! জাওয়াদের বিস্ময় বাড়ল। এত তাড়াতাড়ি শ্বাশুড়ির বোধদয় হবে অকল্পনীয় ছিল ওর। জাওয়াদ চায়ের কাপ টেবিলে রেখে নিশ্চুপ বসল। শ্বাশুড়ির কথার উত্তর দিল না। তাকাল ও না। শ্বাশুড়ির প্রতি কোন প্রকার আগ্রহ না দেখিয়ে নির্বিকার হয়ে মেঝেতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল।

লায়লা জামাতার অনাগ্রহ টের পেলেও বিশেষ প্রাধান্য দিলেন না। এই ক্ষণ অনাগ্রহ গ্রাহ্য করবার নয়, এই ক্ষণ মেয়েকে ফিরে পাবার। লায়লা কাতর স্বরে নিবেদন করলেন,
‘ আমার মেয়েটাকে একটাবার আমাকে দেখাবে? একটাবার আমার কাছে নিয়ে আসবে?’

ইচ্ছেটা উচ্চৈঃস্বরে কটুকথা শোনাবার হলেও জাওয়াদ স্বর উঁচু করল না। জাওয়াদ চোখ তুলে চাইল শ্বাশুড়ির পানে। উঠে দাঁড়িয়ে শান্ত স্বরে বলল,
‘ কেন? আবার মা/রবেন?’

জামাতার শান্ত স্বরে ওমন অতীত নিংড়ানো কথা শুনে অনুতাপে বুক পুড়ল লায়লার। নিজের কৃতকর্ম চোখে ভাসল। বিগত সময়ে মেয়ের সাথে কথা অন্যায়ে আওড়িয়ে শান্তি বিচ্ছুরণ হয়েছে তার। নাওয়া, খাওয়া, ঘুম সব উবে গেছে। সারাদিন বুক পুড়েছে, অনুতাপে জ্বলেছেন, কেঁদেছেন ডুকরে। আত্মহত্যার চিন্তা এনেছেন মাথায়। অতিরিক্ত চিন্তায় অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে বিছানা নিয়েছেন দু’দুবার। তিনি আর আগের লায়লা নেই। লায়লার চোখে ভাসল মেয়ের নিষ্পাপ মুখ, পরপরেই তাকে মারবার দৃশ্য। অনুতাপে বুক পুড়ল, চোখ ভাসল জলে। তিনি নিজেকে আটকাতে পারলেন না। ডুকরে উঠলেন। অনুতপ্ত স্বরে সরল স্বীকারোক্তি দিলেন,
‘ আই এম স্যরি! আমার মেয়েটার সাথে আমি খুব অন্যায় করে ফেলেছি। সামান্য কারণে দিনের পর দিন আঘাত করেছি, মে/রেছি। আই এম স্যরি। আমি ভুলেই গেছিলাম ও আমার মেয়ে। ‘

বলতে বলতে শব্দযোগে কেঁদে উঠলেন। উত্তেজিত হয়ে গেলেন তিনি। অনুতাপে কপাল চাপড়ালেন। বললেন, ‘বিশ্বাস করো, আমি আর কখনো ওকে মা/রব না। আমি ওর মা না? ওকে মা/রব কিভাবে? ‘
নিজের উত্তর নিজেই দিলেন। নিজের হাত তুলে বললেন,
‘এই হাতে কত মে/রেছি ওকে। কিভাবে পেরেছি আমি? সব শেষ করে দিলাম আমি। আমার মেয়ের জীবন শেষ করে দিলাম। ওকে হারিয়ে ফেললাম। কী করলাম আমি!’

কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়লেন সোফায়। মুখ ডেকে চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন। তার আর্তনাদে ঘর কেঁপে উঠল। নাজমুল সাহেব, ফরিদা দৌড়ে এল বসার ঘরে। ফরিদা হতভম্ব হয়ে দেখল কঠোর লায়লার কোমল রূপ। ফারুকীর করুণ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছেন। কিছুই বলছেন না তিনি, কেবল খানিক পরপর দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন। সেই শ্বাসে যেন মেয়ের জন্য একরাশ মায়া, অনুতাপ, আক্ষেপ ঝরে পড়ছে। তারিফ মায়ের অবস্থা দেখল, ভয় হলো তার। স্ট্রেস নিলে মম হার্ট অ্যাটাক করে ফেলবেন, ডাক্তার চিন্তিত হতে বারণ করেছেন। সবাইকে বলেছেন, খেয়াল রাখতে।

তারিফ গিয়ে জাওয়াদের পাশে দাঁড়াল। জাওয়াদ কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শ্বাশুড়ির। ওমন আচরণ দেখে হতভম্ব হয়ে গেছে সে। জাওয়াদ শ্বাশুড়ির চোখে স্পষ্ট অনুতাপ দেখেছে, দেখেছে মেয়ের জন্য প্রগাঢ় মায়া। এই ক্ষণে তার সামনে যে সে ফোনে কথা বলা সেই অহংকারী লায়লা নয়, এখন তার সামনে আছে সে একজন মা, রাফার মা। এই ব্যাপারটা হজম করে উঠতে পারছে না আর। তারিফ ধীরে ডাকল,
‘জাওয়াদ!’

ভাবনাচ্যুত হলো জাওয়াদের। ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল শ্যালকের পানে। প্রশ্নবোধক চাহনি তার। তারিফ বলল,
‘মম তার ভুল বুঝতে পেরেছেন। বিগত এক মাস যাবত সাফার করছেন। নিজের কাজের কথা ভেবে ট্রমায় আছেন। আমার মনে হয়, এবার মমকে মুশির কাছে যেতে দেয়া উচিত তোমার।’

ফারুকীর সাথে দেখা করবার মাস খানেক পেরিয়ে গেছে। জাওয়াদ অনড়। তারিফ ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। বাসায় কী হচ্ছে ঘূর্ণাক্ষরেও টের পায়নি। গতকাল তারিফের বন্ধ ফোন খুলবার পরপরেই মায়ের খবর পেয়ে ছুটে এসেছে। ছেলেকে কাছে পেয়ে মেয়েকে কাছে আনার আবদার করেছে, ছেলেকে ধরেছে কেঁদেছেন অনেকক্ষণ। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, আমি আমার মেয়ের জীবন শেষ করেছি, কিভাবে পারলাম আমি? আমার মেয়েটাকে এত কষ্ট দিয়েছি! আমার মেয়েটা আমার কাছে নেই, আমি ওকে হারিয়েছি। ওকে এনে দে না বাবা!

তারিফ বিস্মিত হয়ে মায়ের কান্ড দেখে গিয়েছে। লায়লা দাম্ভিক ধরণের মানুষ। সর্বদা আত্ম অহংকার নিয়ে চলেন। বুঝ হবার পর সেভাবে তাকে কাঁদতে দেখেনি তারিফ। সে সবসময় জানতো তার কঠিন মানুষ। কিন্তু সেই ক্ষণে তার ধারণা বদলে গেল। মা নরম মনের মানুষ, মা কাঁদেন। তাও কি না নিজের সবচেয়ে অপছন্দের মেয়ের জন্য! রাফার জন্য কাঁদছে মম! অবশেষে সে সফল। বিজয়ী হাসি ফুটল তারিফের ঠোঁটে। পুরো একদিন মাকে পর্যবেক্ষণ করল, মা আসোলেই অনুতপ্ত না কি। মাকে কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করবার পর বুঝতে পারল মা আসোলেই অনুতপ্ত, মুশরাফাকে কাছে চাইছেন। নিবেদন করবার অবস্থায় আছে। মায়ের অবস্থান বুঝে আজ সকালেই হুট করে মামার সাথে আলাপ করল। দুপুরেই মা বাবা নিয়ে এলো। তারপর জাওয়াদকে ডাকল।

তারিফের কথার প্রতিত্তোরে জাওয়াদ চাপা শ্বাস ফেলল কেবল। তাকে ভীষণ দ্বিধান্বিত দেখাল। মনে এখনো লায়লার জন্য ক্ষমা উদয় হচ্ছে না। মন বলছে, প্রিয়জন থেকে ও না থাকার যে কষ্ট লায়লা এখন অনুভব করছেন, সেই কষ্ট রাফা অনুভব করেছে দীর্ঘ বারোবছর যাবত। কত আকুতি করেছে সে তো ক্ষমা পায়নি, কাছে পায়নি কাউকে। তাহলে লায়লার মাত্র দেড় দুইমাসের অনুতাপ কি ক্ষমাযোগ্য! সে তো ভুলতেই পারছেনা, ক্ষমা করবে কিভাবে! লায়লার জন্য মনে জমানো রাগ ক্ষোভ সরছেই না। এই কান্না তার হৃদয় ছুঁতে পারছেনা। কেবলই মনে হচ্ছে, এখনি চোখ মুছে তাকে অপমান করবে।

জাওয়াদের ভাবনার মাঝে চোখ মুছলেন লায়লা। উঠে দাঁড়ালেন জাওয়াদের মুখোমুখি। নাক টেনে নিজেকে স্বাভাবিক করবার চেষ্টা করলেন। জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকাল। তার মনে হলো, তার ভাবনার সাথে মিলে যাচ্ছে। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে কারও কাছে নত না হওয়া অহংকারী লায়লা জাওয়াদের কাছে নত হলেন।
করজোড়ে নিবেদন করলেন,
‘ আমি আমার কাজের জন্য লজ্জিত। আমি তোমার কাছে হাতজোড় করে ক্ষমা চাইছি, আমাকে ক্ষমা করো। আমার মেয়েটাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও। আমি ওর কাছে মাফ চাইব। একটা টোকাও লাগতে দিব না। এবার আমি ওর মা হবো। প্লিজ, আমার মেয়েটাকে আমার ফিরিয়ে দাও! আমার কাছে এনে দাও, একটাবার মা ডাক শোনার সুযোগ দাও! প্লিজ!’

পরাজিত শূন্যের মতো ঠেকল লায়লাকে। যে যুদ্ধে হেরে বিপক্ষ দলের নেতার কাছে হার বরণ করেছে। লায়লার চোখ বেয়ে অনর্গল অশ্রু বয়ে যাচ্ছে। নিজের তীলে তীলে গড়া দম্ভ, অহং সব ঝরে পড়ছে সেই জলে। কী করুণ, কাতর, অসহায় দেখাচ্ছে তাকে!

নাজমুল সাহেবের চোখ কৌটো থেকে বেরুবার উপক্রম। তার বোন হাত জোর করে ক্ষমা চাইছে! এটা তার চেনা সেই লায়লা! বিশ্বাস হচ্ছে না। এক রাফাই সব অদেখা দৃশ্যপট সবার সামনে নিয়ে আসছে।

জাওয়াদ নিষ্প্রভ চোখে চেয়ে রইল। তার দৃষ্টি শ্বাশুড়ির নিবেদিত হাতজোড়ায়। সে তো চাইছিল, শ্বাশুড়ি তার কাছে নিবেদন করুক, তারপর মেয়ে চেয়ে নিক। মেয়ের কাছে নিবেদন করে মেয়েকে আপন করবার সু্যোগ পাক। এই কি তবে সেইক্ষণ! বোধহয়। জাওয়াদের চোখে বিস্ময়, সেদিন তারিফের ভাইয়ের রূপ দেখবার পর আজ দেখছে লায়লার সদ্য জন্ম নেয়া মায়ের রূপ। ভরা মজলিসে মায়ের বয়সী একজন মহিলা ওর সামনে হাত জোড় করে ক্ষমা চাইছে , ব্যাপারটা অস্বস্তিজনক লাগল জাওয়াদের। মনে ক্ষোভ আছে, কিছু কোথাও একটা ভদ্রতা ও আছে। সেই ভদ্রতা থেকে বলল,
‘ আপনি শান্ত হন। এ নিয়ে পরে কথা বলা যাবে। ‘

লায়লাকে শান্ত হতে বললেও লায়লা শান্ত হলেন না। বরং অশান্ত হয়ে পড়লেন। উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। খপ করে জাওয়াদের হাত দুটো মুঠোয় নিলেন। আকুতি নিয়ে বললেন,
‘আমার মেয়েটাকে আমার কাছে এনে দাও না! আগে যা হয়েছে, আর ওমন হবে না। আমি ওকে কোন কষ্ট দিব না। তুমি যেমন চাইবে ওমন হবে। সাফা যেমন আমার বাসায় থাকে, রাফাও তেমন স্বাধীন থাকবে। ওর ড্রেসাপ নিয়ে আমি কোন অভিযোগ কোন কথা শুনাব না। ও যেমন চলে তেমন চলবে। আমি কিছু বলব না। এবার আমি ওর মা হবো। আমার একটাবার মা হবার সুযোগ দাও। তুমি কথা দাও, আমাকে মেয়েকে আমার কাছে এনে দিবে? কথা দাও?’

জাওয়াদের মন তখনো কিছুটা দ্বিধায় আছে। সব ভুলে একবারে ‘মা’ ডাকবার মতো অনুভূতি হয়নি। লায়লার সামনে রাফাকে দাঁড় করাবার কথা ভাবলে এখনো বুক কাঁপছে। দৃশ্যটা কিছুতেই গ্রহন করতে পারছেনা। কিসের একটা জড়তা, একটা ভয় কাজ করছে। সহজ হতে পারছে না সে। জাওয়াদ নিশ্চুপ রইল। লায়লা আবার ডুকরে উঠলেন। কান্নাভেজা স্বরে নিবেদন করলেন,
‘আই বেগ ইউ! বাবা, আমার মেয়েটাকে ফিরিয়ে দাও! আমি আমার মেয়েকে ফেরত চাই, আর কিচ্ছু না। দাও না আমার রাফাকে আমার কাছে ফিরিয়ে? ওর কাছে মাফ চেয়ে, ওকে বুকে না টানতে পারলে আমি মরেও শান্তি পাব না। আমি অন্যায় করেছি, তুমি আমাকে শাস্তি দাও, পুলিশে দাও, রিমান্ডে পাঠাও, যা ইচ্ছে করো। আমি মাথা পেতে নিব। তুমি যদি বলো আমি তোমার আর রাফার পা ধরেও ক্ষমা চাইব। আমি যা করেছি তা শাস্তিযোগ্য। কিন্তু সব কিছুর বিনিময়ে তুমি আমার মেয়েটাকে আমার কাছে এনে দাও, একটাবারের জন্য। আমি একবার ওকে ছুঁয়ে দেখব, বুকে টেনে নিব। আমার ছোট্টো রাফাকে ছুঁয়ে দেখিনা কতকাল! একটাবার ওর মুখে ‘মা’ ডাক শুনব। কতকাল কেউ আমাকে মা ডাকে না। আমি ওই ডাকটাকে খুব মিস করি, আমার মেয়েটাকে খুব মিস করি। আমার খুব কষ্ট হয়। আমার বুকটা খালি খালি লাগে, দমবন্ধ লাগে। বাবা, আমার রাফাকে এনে দাও না!’

দাম্ভিক মানুষদের পা ধরে ক্ষমা চাইতে হয়না, তারা যদি ক্ষমা চাইবার কথা মুখে তুলেন, তাতেই পা ধরবার কাজ হয়ে যায়। যার কাছে অহং সব, নত হওয়া যার নীতিবিরুদ্ধ তিনি যখন সব ভুলে হাত জোড় করেন, বারবার ক্ষমা চান, পা ধরতে উদ্যত হন তবে বুঝতে হবে তিনি অনুতাপের উর্ধ্বে চলে গেছেন
। যেখান থাকলে তিনি তার জীবনকালের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ ইগো বিসর্জন দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন না। তার কাছে তার অহং থেকে দামী অহং বিসর্জন দেবার পেছনকার কারণটা, ব্যাক্তিটা। এর চেয়ে বড়ো শাস্তি হয়না, ক্ষমার ধরণ ও হয়না। এই বিষয়টা লায়লার জীবনে মুশরাফার গুরুত্ব কতখানি এবার বুঝিয়ে দিল জাওয়াদকে। শেষ দিকের নিবেদন জাওয়াদের হৃদয় ছুঁলো। রাগের মাত্রা কমে গেল। কিন্তু সে আশ্বাস দিতে পারল না। একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে তার সময় লাগবে। হুটহাট নিজে মানতে পারবে না। মুশরাফাকে মানানোর ও একটা ব্যাপার আছে। জাওয়াদ চাইল এখান শ্বাশুড়ির সামনে থেকে সরে যেতে, পরে ভেবে চিনতে কিছু একটা জানাবে।

জাওয়াদ শ্বাশুড়িকে মিথ্যা আশ্বাস দিল না। সরে যাবার প্রস্তুতি নিল। অপরদিকে লায়লা উত্তেজিত হয়ে গেল। তারিফ এগিয়ে এলো মায়ের দিকে। মাকে সোফায় বসিয়ে বলল,
‘মম, তুমি শান্ত হও! ডাক্তার তোমাকে স্ট্রেস নিতে মানা করেছে। ‘

লায়লা ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ওকে বলনা! আমার রাফাকে এনে দিতে!’
তারিফ মাকে সান্ত্বনা দিল, ‘ মুশি আসবে। তুমি শান্ত হও। আমি কথা বলব ওর সাথে। ‘

নাজমুল সাহেব এসে দাঁড়ালেন জাওয়াদের কাছে। ধীর স্বরে বললেন, ‘লায়লা ছোটো বেলা থেকেই অহংকারী স্বভাবের ছিল। কারো কাছে ছোটো হতো না। হাজার অপরাধ করবার পরও ওকে ছোটো হতে দেখিনি কখনো। এই প্রথম ও কারো কাছে এতটা নত হচ্ছে, ছোটো হচ্ছে। এমন একটা মানুষ কতটা অনুতপ্ত হলে নিজের অহংকার ভুলে অন্যের কাছে ছোটো হতে পারে! রাফা লায়লার কাছে ওর ইগো থেকেও বেশি মূল্যবান। লায়লা এবার সত্যিই রাফার মা হবে। তুমি ক্ষমা করে দাও আমার বোনটাকে। আর কষ্ট দিও না! ‘

নাজমুল সাহেব এই প্রথম বোনের পক্ষ হয়ে জাওয়াদের কাছে সুপারিশ করছে। কদিন আগেও তার কাছে বোনের বদনাম করেছে, কড়া গলায় বলেছে, লায়লার সাথে রাফার যোগাযোগ করার দরকার নেই। একদম দিবে না। অথচ আজ সেই তিনিই লায়লার কাছে রাফাকে যেতে দেবার অনুরোধ করছেন। লায়লা বদলে যাবার সাথে সাথে সবার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হয়ে গেছে। জাওয়াদ মামা শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে ধীর স্বরে বলল,
‘ এমন হুট করে আমি কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছিনা। আমি এখনো ইনসিকিউর ফিল করছি। কোনভাবেই মেনে নিতে কিংবা স্বাভাবিক হতে পারছিনা। সময় লাগবে আমার। কয়েকদিন সময় দিন। আমি ভেবেচিন্তে কিছু একটা জানাব।’

নাজমুল সাহেবকে হতাশ দেখাল না। জাওয়াদের মনের ভাব তার অজানা নয়। এক নিমিষেই মনের সব কালো মেঘ সরানো অসম্ভব, সময়টা ওর প্রাপ্য। তিনি বললেন, ‘ দ্রুত জানিও। লায়লার অবস্থা সুবিধার না। এত মানুষ চাপ নিলে ভালো মন্দ কিছু একটা হয়ে যাবে। সেটা কারও জন্য ভালো হবে না।’

জাওয়াদ সায় জানিয়ে বলল, ‘আমি আসছি, তবে!’

বলে কদম বাড়াল সামনে। পায়ে পায়ে এগিয়ে সদর গেট পেরুলো। লায়লা ব্যর্থ শ্বাস ফেলে আর্তনাদ করে উঠলেন। তারিফ, ফরিদা হতাশ চোখে অসাড় দাঁড়িয়ে রইল। লায়লার কখনোই কি রাফাকে পাবেন না? জীবন্ত সন্তান হারানোর কষ্ট নিয়ে ধুকে ধুকে বাঁচতে হবে তাকে! হয়তো বা। জাওয়াদের জেদ তাদের কারো অজানা নয়।
ফারুকী স্থির চোখে ওর যাওয়া দেখলেন। আকস্মিক পিছু ডাকলেন,
‘জাওয়াদ!’

জাওয়াদ তখন চৌকাঠ পেরিয়ে গেছে। সে থামল, পিছু ফিরে এক নজর চাইল। ডাকটা শ্বশুরের পক্ষ থেকে এসেছে বুঝতে পেরে মনে মনে বলল,
‘ প্লিজ, আপনি এসে আবার হাত পা ধরে কাঁদবেন না! এই দৃশ্য আমি নিতে পারছিনা। ‘
অথচ সে এমনটাই চাইছিল।

ফারুকী পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে দাঁড়ালেন চৌকাঠের বাইরে, জামাতার পাশে। এতক্ষণ যাবত তিনি নিশ্চুপ ঘটনা পর্যবেক্ষণ করছিলেন। রা করেন নি। এই পর্যায়ে এসে মুখ খুললেন। গম্ভীরমুখে বললেন,

‘দেখো যা হয়েছে তা ঠিক হয়নি। বাবা মা হিসেবে আমাদের দায়িত্ব আমরা অবহেলা করেছি। কষ্ট দিয়েছি মেয়েটাকে। ওকে বুঝার দরকার ছিল বুঝিনি। ওর সাথে অন্যায় হয়ে গেছে সত্যিই। বাবা মা হিসেবে আমরা ব্যর্থ। এটা খুব তিক্ত একটা অধ্যায় আমার জীবনের। ‘

থামলেন ফারুকী। জাওয়াদ শ্বশুরের দিকে তীর্যক চোখে চাইল। অনুতাপ খুঁজল বুঝি! শ্বশুরের মনে অনুতাপ আছে? নাকি শুধু মুখেই! ওর ওমন চাহনি দেখে নিয়ে ফারুকী আবার বলা শুরু করলেন,
‘ এই অধ্যায় ঝুলিয়ে রাখলে তো কোন সমাধান হবে না। কষ্ট ছাড়া কোন লাভ হবে না। একটা মানুষ যতই সুখে থাকুক মা বাবার অভাব তাকে ভুগাবেই। সেইদিক থেকে রাফাও অসুখী, মেয়েটা কষ্ট পাচ্ছে। এদিকে সন্তানের অভাবটা আমরা ও টের পাচ্ছি খুব। ইতঃপূর্বে ঘটনা নিয়ে কোন গ্লানি না থাকলেও এই পর্যায়ে এসে লায়লা এবং সাফা তাদের ভুল বুঝতে পেরেছে। কষ্টটা কমবেশি সবাই অনুভব করছে। একটা অভাব কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে আমাদের সবাইকে। শান্তিতে কিন্তু কেউ নেই। আমার মনে হয়, কষ্ট না বাড়িয়ে ব্যাপারটা এখনই সমাধান করা উচিত। আমরা ইগো দেখাতে গিয়ে রাফা এতকাল কষ্ট পেয়েছে। এখন তুমি ইগো বজায় রাখতে গিয়ে সবাই কষ্ট পাচ্ছে। অহং ভুলে যাও, সহজ ভাবে দেখো। আমার মেয়েটাকে একদিন মিট করাও। বসে কথা বলি, আলাপের মাধ্যমে এই ব্যাপারটা ক্লিয়ার করি। ‘

ফারুকী বিজ্ঞলোকের মতো জামাতাকে বুঝাচ্ছেন। শ্বশুরের বিজ্ঞকথার সবটা ভালো লাগলেও শেষ দিকে কথার ভাবটা ভালো লাগল না। ‘মিট করাও, ব্যাপারটা ক্লিয়ার করি। ‘ যেন সামান্য ভুলবুঝাবুঝি ছিল। মুশরাফা তাকে ভুল বুঝছে, তিনি ব্যাপার ক্লিয়ার করবেন! স্বরে অনুতাপ নেই কেন তার! কেমন কাটকাট কথা বলছেন! জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকাল। অসন্তোষ গলায় বলল,
‘ক্লিয়ার করবেন! ওয়াজ ইট আ স্লাইট মিসান্ডারেস্টেন্ডিং?’

জামাতার ওমন ভাবভঙ্গিমায় চেহারা নরম হলো ফারুকীর। শান্ত স্বরে বলল,
‘ না, এটা এক তরফা অন্যায় ছিল। এখন তুমি কি চাইছো, আমি আঞ্জুমানের মতো কাঁদি? ক্ষমা চাই তোমার কাছে?’

ফারুকীর স্বরে কৌতুকের রেশ টের পেল জাওয়াদ। উনি কি ঠাট্টা করছেন? জাওয়াদ ক্ষোভে নাকের ডগা ফুলাল। ফারুকী গম্ভীরমুখে বললেন,
‘ আমি কিন্তু তোমার কাছে ক্ষমা চাইব না। কারণ আমি তোমার সাথে অন্যায় করিনি। আমার কালো অধ্যায় যেহেতু রাফাকে নিয়ে, যা বলার ওকেই বলব। আমি তোমাকে ক্ষমাবাক্য শুনাব না। তোমার কাছে অনুতপ্ত নই আমি।’

এই ক্ষণে ফারুকীর আচরণ আবার রুক্ষ ঠেকল জাওয়াদের। ওর চোয়ালে রাগের আভা দেখা গেল। রাগ দেখিয়ে বলল,
‘ আমি কখনোই আপনাদের একসেপ্ট করব না। ‘

রাগবার মতো একটা কথা। ফারুকীর রেগে যাবার কথা থাকলেও তিনি রাগলেন না। বরং হেসে ফেললেন। ছেলেটা রাগে নাক ফুলাচ্ছে কিভাবে? হাসি পাচ্ছে তার। আপন আপন লাগছে। তিনি হেসে বললেন,
‘আমার মেয়ে একসেপ্ট করলে, তুমি একসেপ্ট না করে যাবে কোথায়?’

জাওয়াদ দৃঢ় স্বরে বলল,
‘ আমি না চাইলে রাফা আপনাদের একসেপ্ট করা তো দূরের কথা, আপনাদের দিকে মুখ তুলেও চাইবেনা। আর আমি তো আপনাদের ত্রিসীমানায় ও যাব না।’

ফারুকী ও দৃঢ় স্বরে বললেন, ‘ তুমি গিয়ে তোমার বাবা, মা,ভাই বোন সবাই যাবে। আমি নিব। তুমি যদি যেতে না চাও, তুলে নিব। তখন একসেপ্ট না করে যাবে কোথায়? আর একটা কথা আজ থেকে মনে রাখবে, আমার বাড়ির জামাই তুমি, ত্রিসীমানায় নয়, পুরো সীমানায় ঘুরে বেড়াবে। তুমি চাইলে ঘরজামাই ও থাকতে পারবে। আমি সব ব্যবস্থা করে দিব। কোন সমস্যা হবে না। কবে আসবে?’

ফারুকী আবার ঠাট্টা করছেন! জাওয়াদ বিস্মিত চোখে চাইল। এই লোকটাকে সে বুঝতে পারছেনা। মতিগতি সুবিধার না। মেয়েকে পাবার জন্য ওকে বশ করতে চাইছেন। আবার কী বলছেন, ঘরজামাই হিসেবে যেতে! পাগল নাকি! জাওয়াদ রাগ নিয়ে চাইল। তারপর বলল,
‘ রাফা কখনো মেনে নিলেও আমি আপনাদের নেবে নিব না। যাব না আপনার ত্রিসীমানায়। কথাটা মনে রাখবেন।’

বলে সিড়ি বাইতে লাগল। ফারুকী আবার হাসলেন। তার পেছনে হাজার লোক ঘুরে, অথচ আজ ছেলে বয়সী তার জামাতা তাকে ঘুরাচ্ছে। বদলানো সময় বোধহয় একেই বলে। জামাতাকে অনুসরণ করে নামতে লাগলেন। জাওয়াদ মিড়লে এসেতেই ফারুকী এসে পাশে দাঁড়ালেন। জাওয়াদের কাধে আলতো হাত রাখলেন। ধীর স্বরে বললেন,

‘তুমি যদি ভেবে থাকো, আমি শুধু মাত্র আমার মেয়েকে পাবার জন্য তোমাকে মেনে নেবার ভান করছি, তবে তোমার ভাবনা ভুল। দেখো, আগে আমাদের সম্পর্কগুলো ভিন্ন ছিল। রাফার প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন থাকায় ওর জীবনের কোনকিছু আমাদের কাছে গ্রহনযোগ্য ছিল না। ফলস্বরূপ, তোমাদের বিয়েতে আমি উপস্থিত থেকেও ছিলাম না। এখন আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে। এখন একটা কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, রাফা আমার মেয়ে। সে যেমনই হোক, আমার সন্তান। তার জীবনের সব মানুষ আমার আপন। তুমি আমার মেয়ের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ। আমার মেয়ের হাসবেন্ড। রাফা যেমন আমাদের কাছে একসেপ্টবল, তবুও একসেপ্টবল। তুমি আমার জামাতা, আমাদের জীবনের একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ, আমার পরিবারের একজন সদস্য। রাফা মানলে ও তুমি যদি আমাদের না মানো, আমাদের পরিবারে শামিল না হও তবে আমার পরিবারটা অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। আমি মন থেকেই চাই তুমি আমার পরিবারে শামিল হও। তোমাকে নিয়েই আমি পরিবার সম্পূর্ণ করতে চাই। অতীতে যা হয়েছে ভুলে যাও। রাফার ব্যাপারে ওর সাথে বসে সমাধান করে ফেলব আমরা। আমার মেয়েটা আমাদের খুব ভালোবাসে। ঠিক ক্ষমা করে মেনে নিবে। তুমি আর বাঁধা দিও না। ওই ব্যাপারটা আমাদের বাবা-মেয়েকে, মা-মেয়েকে সমাধান করতে দাও। তুমি বরং দিনক্ষণ ঠিক করো, কবে জামাই আদর নিতে যাবে আঞ্জুমান ভিলায়?’

লম্বা কথা বলে থামলেন ফারুকী। জাওয়াদ মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনে গেল। খানিক আগে শ্বশুরের প্রতি জন্মানো বিরক্তখানা নিমিষেই ধুয়ে গেছে। শ্বশুর মশাই এই ক্ষণে তাকে কতখানি সম্মানিত করেছে সে পরিমাপ করতে পারবে না। এতকাল শ্বশুরবাড়িমুখো না হওয়া জামাইকে তার সদস্যপদ ফিরিয়ে দিয়েছেন। একটা চাপা আনন্দ অনুভব করল। শ্বশুরপক্ষ থেকে পাওয়া প্রথম এত সম্মান তার ভাগ্যে জুটল। খুশিতে গদগদ হলো জাওয়াদের ভেতরখানা। তবে প্রকাশ করল না। গম্ভীরমুখে দাঁড়িয়ে রইল। ফারুকী কাধ চাপড়ালেন। স্নেহের গলায় বললেন,
‘ শুনো বাবা, অতীত ধরে বসে থাকলে কষ্ট বৈ কিছু পাবে না। সব ভুলে যাও। বিয়ের এতগুলো মাস পেরিয়ে গেছে। অথচ তোমার জামাই আদর হয়নি, রাফার নাইওর ও হয়নি। তোমার দাওয়াত আঞ্জুমান ভিলায়। আমি বেয়াই বেয়ানকেও দাওয়াত দিয়ে আসব। সেভাবে আলাপ হলো না বেয়াই বেয়ানের সাথে। আলাপটাও হয়ে যাবে। তোমার বাসার ঠিকানা দিও।’

জাওয়াদ শ্বশুরের পরিবর্তিত রূপ দেখে বিস্মিত, মুগ্ধ। এই প্রথম ওর মনে হলো ফারুকী সত্যিই রাফার বাবা। বাবাজনক আচরণ করছেন। জাওয়াদ এবার আর কঠিন হতে পারল না। নরম হলো। শান্ত স্বরে বলল,
‘ কিছুটা সময় দরকার আমার। হুটহাট ব্যাপার গ্রহন করতে পারছি না।’

ফারুকী অমায়িক হেসে বললেন, ‘টেক ইউর টাইম। তবে সময় শেষে কিন্তু আমার পরিবারে চাই তোমাকে। আর না হয় একটা কাজ করি, তোমাদের বিয়ে তো আমরা দিই নি, ভাইয়া দিয়েছেন। তারিফের সাথে তোমাদের আবার বিয়ে দিই। বাবা হিসেবে মেয়ের বিয়ে নিয়ে কিছু আশা ছিল, সেগুলো পূরণ হয়ে যাবে। কন্যা সম্প্রদানটা এবার মন থেকে করার সুযোগ পাব। আর তোমাকেও সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে পারব। কী বলো?’

ফারুকী জামাতার দিকে আগ্রহী চোখে চাইলেন। পরামর্শ চাইলেন তার। জাওয়াদ অপ্রত্যাশিত স্নেহ, সম্মান, প্রস্তাবের ভারে নুয়ে পড়ছে। তৎক্ষনাৎ উত্তর দিতে পারল না । খানিক বাদে বলল, ‘ রাফার ভিড়ভাট্টা পছন্দ না। তা ছাড়া এই অনুষ্ঠানে ওর পর্দায় ব্যাঘাত ঘটবে। ও অস্বস্তিবোধ করবে। এসবের প্রয়োজন নেই। ‘

জাওয়াদের নিষেধের কারণ শুনে দুঃখ পাবার বদলে হাসলেন ফারুকী। ছেলেটা কত ভাবে তার মেয়ের জন্য! ফারুকী বললেন, ‘তাহলে জাস্ট ফ্যামিলি গেট টুগেদার রাখব। তোমাকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিব। সিদ্দিকী বংশের জামাই তুমি, চেনা লাগবে তো সবার! ‘

জাওয়াদ বিড়বিড় করল, ‘ এতদিন পরিচয় নেই, সম্মান নেই, খোঁজ নেই। আজ একবারে এত সম্মান দিলে সম্মানের ভারে আমি জ্ঞান হারাব। ‘

সে কথাটা এড়িয়ে গেল। সাফার কথা স্মরণে এলো। চোয়াল শক্ত হলো ওর। ওই মহিলা তো এখনো দমেনি। তারও ক্ষমা চাইতে হবে রাফার কাছে। জাওয়াদ শ্বশুরকে স্মরণ করিয়ে দিল,
‘আপনার বড়ো মেয়ে রাফার সাথে খুব অন্যায় করেছে। ‘

ইঙ্গিত ধরতে পারলেন ফারুকী। হাসলেন আবার। বললেন, ‘ ওর হাসবেন্ড একটু সিক, তাই আসতে পারেনি। সময় করে তোমাদের সাথে দেখা করবে ও। আগের সব অধ্যায় মুছে তবেই রাফাকে তার ঘরে তুলব। ‘

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here