স্বর্ণাভ সুখানুভূতি। #দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ। পর্ব-২৭ (প্রথমাংশ)

#স্বর্ণাভ সুখানুভূতি।
#দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ। পর্ব-২৭ (প্রথমাংশ)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

উৎসবমুখর ইদ বিকেল। মানব মেতেছে উল্লাসে, প্রকৃতি সেজেছে সেই আমেজে। পাঞ্জাবি পরিহিত যুবক দলের হৈ-হুল্লোড়ী আড্ডায় মুখরিত রাস্তাঘাট, নতুন শাড়ি পরিহিত নারীদলের হাসির সুরে বাজছে নুপুরের মতন। কেউ ঘুরতে বেরিয়েছে, কেউবা আবার ঘুরাঘুরি শেষে নীড়ে ফিরছে।

এক মাস সিয়াম সাধনার পর উপহার স্বরূপ ইদ আসে মু’মিন মুসলমানের ঝুলিতে। উপহার সিয়াম পালন কারীদের জন্য হলেও পালন করে সবাই। হাজার মানুষের দুয়ারে রোজা না এলেও ইদ আসে ঘটা করে। অভিজাত এলাকায় বাড়ি সাজানো হয়, পার্টি রাখা হয়, সাউন্ড বক্সে গান, গানের তালে চলে নাচ। জমকালো আয়োজনে ইদ পালিত হয়। এখানে ইদ মানে রোজার বিনিময়ে অর্জিত উপহার গ্রহণ নয়, এখানে ইদ মানে দু’হাত ভর্তি শপিং, ঘুরাঘুরি, পার্টি। আঞ্জুমান ভিলায় ও এর ব্যতিক্রম নয়। ইদের সাজে সেজেছে বাড়ি। কোথাও ফুল, কোথাও বাতি। প্রতিবার উচ্ছ্বাসে মাতে বাড়ির প্রতিটা সদস্য। সকাল হতেই নতুন জামা পরবার তাড়া, সালামি নিয়ে কাড়াকাড়ি, বিকেল হতেই তৈরি হয়ে পার্টিতে যাওয়া। কিন্তু এবার কিসের যেন বিষাদে সব এলোমেলো হয়ে গিয়েছে।

বাড়ির কর্তীর মুখে হাসির রেশ নেই। নেই পরনে ইদের দামী পোশাক, লাখ টাকার শাড়িটা পড়ে আছে কাভার্ডে। বের করে ছুঁয়ে দেখা হয়নি। হাতে ফোন, চোখে চিন্তা। বাড়ির একমাত্র ছেলের হদিস নেই সপ্তাহ খানেক। বাড়ি ফিরে না, ফোন বন্ধ, ফ্ল্যাটে তালা ঝুলানো। বন্ধু বান্ধব কেউ জানে সে কোথায় আছে, কেমন আছে। পুত্রশোকে কাতর লায়লা। ইদের আমেজ বাড়িতে লাগলেও তার মন ছুঁতে পারেনি। সকাল থেকেই অপেক্ষায় বসেছেন ছেলের। এই বুঝি এলো ছেলেটা! কিন্তু ছেলের দেখা নেই। সাফা শ্বশুর বাড়িতে। জায়ফা বান্ধবীদের সাথে বেরিয়েছে সেই সকালে। স্বামী ফারুক সিদ্দিকী ইদের নামাজ পড়তে বেরিয়ে আর ফিরেন নি। এই পুরো বাড়িতে একলা পড়ে গেছেন তিনি। তারও ক্লাবে যাবার কথা ছিল, মহিলা মহলের আজ নানান প্রোগ্রাম আছে। কিন্তু বিষাদ রেখায় যাবার ইচ্ছেটি হয়নি। চিন্তার শ্বাস ফেলে আবার ডায়াল করলেন ছেলের নাম্বারে। সেই ক্ষণে কলিংবেল বেজে উঠল। আদরের ছেলেটা এলো বুঝি! খুশিতে আটখানা হয়ে এক প্রকার দৌড়ে গেলেন দরজার দিকে। দরজা খুলে দেখলেন, ছেলে নয় মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাসিমুখ আবার মলিন হলো। জায়ফা মাকে দরজা খুলতে দেখে চমকাল,
‘ তুমি ক্লাবে যাওনি, মম?’
‘না।’ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন লায়লা।

জায়ফা ভ্রু কুঁচকে মাকে পরখ করল। তারপর বলল, ‘হোয়াট হ্যাপেন্ড মম? আর ইউ ওর‍্যিড এবাউট সামথিং?’
‘নাথিং।’ মলিন সুরে বললেন লায়লা। জায়ফা সোল্ডার ব্যাগ হাতে নিয়ে আশ্বাসের সুরে বলল, ‘ ডোন্ট ওর‍্যি মম, ভাইয়া আজ ফিরবে।’

‘কথা হয়েছে তোর সাথে?’ উৎসুক দেখাল লায়লাকে। জায়ফা ধীরে বলল, ‘ না, আমি গেস করে বলছি। ইদ না আজ। ভাইয়া না ফিরে পারবে না।’

লায়লা হতাশার নিঃশ্বাস ফেললেন। মলিন মনে আবার অপেক্ষায় বসলেন। গোধূলি লগ্নে কলিংবেল বাজল। লায়লা আবার চমকালেন। আগ্রহী চোখে তাকালেন দরজার দিকে, পরপরেই দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলেন। দরজা খুলতেই এবার কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে পাওয়া গেল। লায়লা কিয়ৎক্ষণ স্থির চোখে তাকিয়ে রইলেন। আকস্মিক কাতর স্বরে বললেন,
‘ তারিফ! আর ইউ অলরাইট? এতদিন কোথায় ছিলি তুই? তোর ফ্ল্যাটে তালা দেয়া, ফোন দিলে ফোন ধরিস না। কী হয়েছে তোর? এমন ইদে ও কোথায় উধাও ছিলি? এই এক সপ্তাহ আমার কিভাবে কেটেছে, তোর কোন ধারণা আছে? ‘

আলতো হাতে ছেলের মুখে হাত বুলিয়ে মায়ের উদ্বেগ প্রকাশ করলেন লায়লা। তারিফের ভাবাবেগ দেখা গেল না। না সে হাসল, আর না সে রাগল। মায়ের আহ্লাদে গা ও ভাসাল না। কেবল ধীর স্বরে বলল, ‘আমার জন্য তোমার চিন্তা হয়, মম?’

‘ এ কেমন কথা! অবশ্যই চিন্তা হয়। সন্তানের জন্য তো সব মায়েরই চিন্তা হয়। ‘তড়িৎ উত্তর দিলেন লায়লা।

তারিফ স্থির চোখে তাকাল মায়ের চোখে। তারপর শীতল স্বরে বলল, ‘ মুশি ও তো তোমার সন্তান। তবে ওর জন্য তোমার চিন্তা হয়না কেন, মম?’

আকস্মিক ছেলের মুখে মেয়ের কথা শুনে ভীষণ চমকালেন লায়লা। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলেন। চোখ ভাসল অবিশ্বাসে। হতবাক চোখে চেয়ে রইলেন কিয়ৎক্ষণ। তারিফের মুখ থেকে এই ক্ষণে মেঝো মেয়ের কথা শোনাটা অকল্পনীয় ছিল। ‘মুশরাফা’র অধ্যায় আসতেই এ যাবত তার চোয়ালে বয়ে চলা উদ্বিগ্নতা সরে গেল, গম্ভীরতায় ভরাট হলো। তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে অনিচ্ছুক, তা প্রমাণ করতে গম্ভীরমুখে বললেন,
‘ গত সাতদিন তুমি বাসায় ফিরোনি কেন? কোথায় ছিলে? কী হয়েছিল তোমার? ফোন বন্ধ ছিল কেন? আমি যোগাযোগ করতে গিয়ে বারবারই ব্যর্থ হয়েছি।’

তারিফ যেন সংকল্প করেছে আজকের দিনটা তার আদরের বোনের। আজ শুধু বোনের অধ্যায় পড়বে, পড়াবে। সে মায়ের কথার উত্তর না দিয়ে গম্ভীর সুরে বলল,
‘ মুশিটাও কিন্তু সাতমাস বাড়ি ফিরেনি। কতগুলো দিন, কতগুলো মাস পেরিয়ে গেছে। মেয়েটা ফোন হাতে বসে ছিল মাসের পর মাস, যদি তুমি একটু চেষ্টা করতে, যোগাযোগ করতে সফল হতে। তবে কেন করো নি মম? সন্তানের জন্য যদি সব মায়ের চিন্তা হয়, তবে তোমার কেন হয়না? তুমি কি ওর মা নও? না কি ভুলে গেছো?’

লায়লা আঞ্জুমান স্তব্ধ হয়ে গেলেন। ছেলের কথাগুলো যেন সোজা গিয়ে মাতৃত্বে লেগেছে। তার আদরের ছেলে তার মাতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলল! তাও ওই জ/ঙ্গ/লি মেয়ের জন্য! ওকে নিয়ে তো ইতঃপূর্বে কথা বলেনি তারিফ, তবে আজ কেন কথা বলছে। তাও এমন একটা ইদের দিন! লায়লা আঞ্জুমানের চোয়ালে রাগের আভা দেখা গেল। গম্ভীরমুখে বললেন,
‘ তোমার সাথে ওই মেয়ের দেখা হয়েছে?’

তারিফের গায়ে ইদের পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবি টেনে ডিভানে বসল। ক্লান্তির শ্বাস ফেলে ভ্রু কুঁচকাল,
‘ ওই মেয়ে কে?’
লায়লা উত্তর দিলেন না। সম্পর্কে ফাটল ধরবার পর থেকে তো নামটাও নেয়া হয়নি। তারিফ অভিযোগের সুরে বলল,
‘ ওই মেয়েটা তোমার সন্তান। হাউ ডু ইউ ফরগেট ইট, মম? হাউ?’
থেমে বলল, ‘ফারদার ‘ওই মেয়ে’ সম্বোধন করবে না। শুনতে ভালো লাগে না।’

লায়লা আঞ্জুমান সেসব কানে তুললেন না। রাগত স্বরে বললেন, ‘ তোমার সাথে ওর দেখা হয়েছিল?’

তারিফ স্মিত হাসল। হেসেই বলল, ‘হ্যাঁ। কত বড়ো হয়ে গেছে আমার ছোট্টো বোনটা! এটুকুনি দেখেছিলাম, কত বড়ো হয়ে গেছে এখন! আমার ছোট্টো মুশির না কি বিয়ে ও হয়ে গেছে, আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না মম! মনে হচ্ছে এই তো কদিন আগে ও তো আমার কাছে চকলেটের বায়নায় ঠোঁট ফুলাল। ‘

লায়লা তীক্ষ্ম চোখে তাকালেন ছেলের দিকে, ‘হাউ ক্যান ইউ ডু ইট?’
তারিফ দৃঢ় স্বরে বলল, ‘আই থিংক ইউ শুড ঠু।’

সেই ক্ষণে জায়ফা বেরিয়ে এলো রুম থেকে। ভাইকে দেখে উৎফুল্ল স্বরে বলল, ‘ইদ মোবারক ভাইয়া। কোথায় ছিলে এতদিন? আমি তোমাকে ভীষণ মিস করছিলাম।’

বোনের দিকে তাকিয়ে হাসল তারিফ। মুশরাফার পরে জায়ফার বাস তার হৃদয়ের কাছে। আদরের ছোট্টো বোন। জায়ফা কাছে আসতেই এক হাতে আগলে নিল। হেসে বলল, ‘ইদ মোবারক। ইদ কেমন কাটল?’

ভাইয়ের কাছে আসতেই কিশোরী জায়ফার আহ্লাদ লাই পেল। উৎফুল্ল স্বরে বলল, ‘এবারের ইদ খুব খারাপ কেটেছে। আপিরা নেই কেউ। তুমি নেই বলে মম ও মন খারাপ করে বসে ছিল। পাপা সকালে বেরিয়ে গেছে আর ফিরেনি। বাসায় পায়েশ ও হয়নি। সব কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেছে। ভালো লাগছিল না বলে বেরিয়ে গেছি বান্ধবীদের সাথে। আই মিসড ইউ সো মাচ, ভাইয়া?’
তারিফ স্নেহের হাত বুলাল ছোট্টো বোনের মাথায়, ‘আই অলসো মিসড ইউ। তা পায়েশ রান্না হয়নি কেন?’

জায়ফা মুখ ফসকে বলে দিল, ‘ প্রতিবার পায়েশ আপি করে, এবার তো আপি নেই তাই পায়েশ ও হয়নি। শেফ সকালে আসেনি। রান্না ও হয়নি।’

তারিফ আকস্মিক জিজ্ঞেস করল, ‘ মুশিকে মনে পড়ে না, তোর?’

বোনটাকে ড্রেসাপের দিক থেকে বেমানান ছিল কেবল, নয়তো তাকে খুব আদর করতো, সে অস্বীকার করতে পারে না জায়ফা। সে উদাস সুরে বলল, ‘আজ মনে পড়ছিল। ‘
থেমে বলল, ‘আজ কোথায় ছিলে তুমি?’

তারিফ পকেট থেকে ফোন বের করল। আজ সকালে বোনের বাসায় সুন্দর মুহুর্তখানা ফোনে ক্যাপচার করেছিল। সেই ছবিটা পর্দায় আনল, ফোনটা ধরল বোনের সামনে। কিছুই বলল না। জায়ফা ভ্রু কুঁচকে চাইল এক পলক। প্রথমে চিনতে পারল না। খানিক বাদেই বিস্ময়ে ভ্রু উঁচু হলো,
‘ ইজ ইট আপি! ‘ মুশরাফাকে কখনো এত সাজতে দেখেনি সে।
‘ইয়াহ।’
জায়ফা বিস্ময়ের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছিল যেন। ‘আপি বিয়ের পর চেঞ্জ হয়ে গেছে। আগে তো কখনো সাজতো না। কী কিউট লাগছে! আমার বিশ্বাস হচ্ছে না এটা যে আপি! তুমি আপিকে কোথায় পেলে? তুমি না আপিকে হেইট করতে।’

শেষ কথাটার উত্তর দিল না তারিফ, ‘আজ আমরা সারাদিন একসাথে ছিলাম। মামার বাসায় লাঞ্চ করছি, সেখানে থেকেই ফিরছি এখন।’

জায়ফা খানিক চুপ হলো। আকস্মিক বলল, ‘ পরেরবার আমাকে নিয়ে যাবে। আমি আপির সাথে মিট করব।’

দূরত্বই বোধহয় বোনের প্রতি ভালোবাসা জাগিয়েছে জায়ফার মনে। সে উৎফুল্ল হয়ে মাকে বলল, ‘মম দেখো!’

লায়লা আঞ্জুমানের চোখে কৌতুহল। কিছু কিছু মায়া এমন যে তা হাজার ঘৃণা ভেদ করে বেরিয়ে আসতে চায়। তিনি আগ্রহী হয়ে বললেন, ‘দেখি!’

জায়ফা ফোনটা মায়ের দিকে নিতে গেল। তারিফ নিয়ে নিল। ছবিটা ঝুম করল। ছবিতে মুশরাফার হাতের দাগ দেখা যাচ্ছে। সেই জায়গায়ে ফোকাস করে মায়ের সামনে ধরে বলল, ‘ এটা দেখো তুমি। ‘

তৎক্ষনাৎ টাহর করতে পারলেন না লায়লা। ভ্রু কুঁচকালেন, ‘হোয়াট ইজ দিস?’
তারিফ ঝুম কিঞ্চিৎ ঝুম আউট করল। এবার পুরো হাত স্পষ্ট দেখা গেল, মারের দাগ ও স্পষ্ট এলো পর্দায়। সে দিকে ইশারা করে তারিফ বলল,
‘ এটা হলো সেই চিহ্ন, যা নিয়ে মুশি বাড়ি ছেড়েছিল। এ যাবত কালে পরিবারের পক্ষ থেকে পাওয়া অর্জন, স্মৃতি। যা নিয়ে সে পথ চলছে। দিস ইজ দ্যা থিংক, শী গট ফ্রম হার ফ্যামিলি ইনস্টেড অব লাভ(এটা সেই জিনিস, যা সে পরিবারের কাছ থেকে ভালোবাসার পরিবর্তে পেয়েছে)’

ছেলের কথার তীর কোনদিকে গিয়ে বিদ্ধ হয়েছে তা ধরতে সময় লাগল না লায়লার। বুঝতেই তার চোখের ভাষা বদলাতে লাগল খানিক পর পর। প্রথম বিস্ময়, তার আগ্রহ, তারপর হতাশা। কিসের যেন এক করুণতা মিশেছিল সেই চাহনিতে। স্থির চোখে তাকিয়ে রইলেন মেয়ের হাতের দিকে। তারপর চোখ সরালেন। কেবল তিনিই টের পেলেন দেখবার সময় তার বুকের কাঁপন ধরাটা। তারিফ বলল,
‘আমি না হয় মাতাল ছিলাম, সেন্সে ছিলাম না। তুমি তো সম্পূর্ণ সেন্সে ছিলে, তবে তুমি মুশির সাথে এটা কিভাবে করলে, মম? মুশি উপর তোমরা যতটা অ/ত্যা/চারের করেছিলে, এতটা তো মা/ র্ডা/ র কেসে আসামীর উপর ও করা হয় না। তুমি মা হয়ে কিভাবে পারলে? হাউ ক্যান ইউ ডু দ্যাট, মম? কিভাবে এতটা কঠোর হয়ে গিয়েছিলে?’

তারিফের স্বরে রাগ, অভিযোগ, অধিকার, ক্ষোভ সব ঝরছে যেন। চোখ লাল হয়ে গেছে। নাকের ডগা ফুলে উঠছে। ভেতরকার ঝড় যেন বেরিয়ে আসছে। ভাইয়া অগ্নিরূপ দেখে জায়ফা ভয় পেয়ে দূরে সরে গেল। ভয় পেলেন লায়লা ও। ছেলেটা উগ্রস্বভাবের হলেও মাকে ভীষণ সমিহ করতো, ভালোবাসতো। মায়ের সাথে কখনোই রুড হতো না। সেই ছেলে প্রথমবার মায়ের সাথে ধমকে কথা বলছে! ছেলের রাগ দেখে লায়লার মনে হলো তার জায়গায় অন্যকেউ হলে ছেলেটা তাকে এখানেই খু//ন করতো। কী ভয়ানক লাগছে ছেলেটাকে! ছেলে থেকে চোখ সরালেন। ফোনে চোখ ফেললেন। খানিক দেখলেন হাতটাকে। মুখখানা দেখবার ইচ্ছেটা হুট করেই হলো। ভাবলেন ছেলে টের পাবে না, এক পলক দেখবেন কেবল। স্ক্রিনে ডাউন স্ক্রল করতে নিলেন। সেইক্ষণেই তারিফ ফোনটা চো মেরে নিয়ে নিল। গম্ভীরকণ্ঠে বলল,
‘তুমি কেবল হাতটাই দেখতে পারবে। যতদিন না তুমি মাতৃত্বের সংজ্ঞা ঠিকভাবে রপ্ত করতে না পারো ততদিন আমার বোনের মুখ দেখতে পারবে না। ইট’স ইউর পানিশমেন্ট। ‘

লায়লা শূন্য চোখে চাইলেন ছেলের পানে। ওদের কথার মাঝে ফারুক সিদ্দিকী বাড়ি ফিরলেন। দরজা খোলাই ছিল। কেউ টের পেল না তার আসার। হলরুমে ছেলের উপস্থিতি টের পেতেই প্রসন্ন হাসলেন। বলল,
‘হোয়াট’স আপ মাই সান? আমি জানতাম তুমি আজ ফিরবে। হলিডে কেমন কাটল?’

তারিফ চোখ তুলে বাবার দিকে চাইল এক পলক। আশানুরূপ কোন উত্তর দিল না। বসে রইল গম্ভীরভঙ্গিমায়। ফারুক সাহেব ভ্রু কুঁচকালেন। ছেলের আচরণ সন্দেহজনক ঠেকল তার, সাথে পরিবেশ ও। তিনি ডিভানের দিকে এগিয়ে বললেন,
‘ হোয়াট আর ইউ টকিং এবাউট?’

তারিফ শান্ত স্বরে বলল, ‘ উই আর টকিং এবাউট মুশরাফা সিদ্দিকী।’

ফারুক সাহেব বসতে ধরেছিলেন সবে। ছেলের কথা শুনে থেমে গেলেন। ঘাড় ঘুরিয়ে ছেলের পানে চাইলেন এক পলক। তারপর চোখ ফিরিয়ে বসলেন। গম্ভীরমুখে বললেন, ‘ ইদের আনন্দ নষ্ট করো না, অন্য কথা বলো।’

‘ ‘বাবা’ ডাক বন্ধ হয়ে যাওয়াটা আঘাত করেনি তোমাকে? একটু শূন্যতা ফিল হয়নি, পাপা?’ তারিফ বলল বাবার উদ্দেশ্যে।

বাকি তিন সন্তান ‘মম, পাপা’ সম্বোধন করলেও মুশরাফা ছোটোবেলা থেকে ‘মা, বাবা’ ডেকেই বড়ো হয়েছে। ফারুক সাহেব উদাস হলেন। কী যেন ভাবলেন। উত্তর দিলেন না। তারিফ বোনের আঘাতের চিহ্ন বাবাকে দেখিয়ে বলল,
‘ক্যান ইউ ইমাজিন পাপা, এই বাড়িতে কত কষ্টে ছিল মেয়েটা! আমার ছোট্টো মুশিটা, যে একটা সময় সবার প্রাণ ছিল। তাকে কিভাবে সবাই এত পর করে দিলাম? ‘

আঘাতের চিহ্ন বয়ে নেয়া হাতটা দেখে না চাইতেও বুক কাঁপল ফারুক সাহেবের। কী নির্মমতার চিহ্ন আঁকা এই হাতে। এত পাষাণ হয়ে গিয়েছিলেন তারা! তারিফ বলল, ‘ কী দোষ ছিল মেয়েটার? মম, কিসের জন্য মেয়েটাকে দিনের পর দিন এতটা কষ্ট দিলে? একটু ও হাত কাঁপল না তোমার?’

লায়লা নিশ্চল বসে ছিলেন। চোখের দৃষ্টি শূন্য। আনমনে বললেন, ‘ ওর চলাফেরা ঠিক ছিল না।’

তারিফ দৃঢ় স্বরে বলল, ‘ ড্রাগ এডিক্ট ছিলাম আমি। ড্রাগ নিয়ে পড়ে থাকতাম এদিক ওদিক। ঠিক তো আমার চলাফেরা ও ছিল না। ও তো সামান্য ড্রেসাপ ভিন্ন নিয়েছিল। ওর থেকে তো আমার কাজ খারাপ ছিল। আমাকে তো কখনো এভাবে মা/ রো নি। আমার ড্রাগ এডিক্টেড হওয়া যদি স্বাভাবিক হয় তবে ওর ইসলামিক ড্রেসাপ ও স্বাভাবিক হওয়ার কথা।’

ফারুক সাহেব গম্ভীরমুখে বললেন, ‘ ওর এই চালচলনে সমাজে টিকে থাকা দায় হয়ে গিয়েছিল। আমাদের এই সমাজে ওকে নিয়ে চলা যায় না।’

তারিফ তাচ্ছিল্যের হাসি দিল, ‘মানুষ প্রতিবন্ধী সন্তানকে নিয়ে চলতে দু’বার ভাবে না, অথচ তোমরা সামান্য ড্রেসাপের জন্য একটা সন্তানকে তাজ্য করেছো! বাবা মায়ের ডেফিনিশন জানো?’

ফারুক সাহেব গম্ভীর হলেন। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, ‘ আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।’

কদম বাড়াতেই তারিফ বলল, ‘ বাবা মাহীনতায় তোমাদের মেয়ে ধুকে ম/রছে, পাপা। ভীষণ কষ্টে আছে মুশি। আজ আমাকে দেখে ওর কান্না থামছিলোই না। এত কিছুর পর ও মুশি তোমাদের ভীষণ ভালোবাসে। তোমরা কি ওকে একটু ও ভালোবাসতে না, মম পাপা? তোমাদের সন্তান কষ্টে আছে, তোমাদের একটু ও মায়া লাগছে না? ‘

ফারুক সাহেব থেমে গেলেন আকস্মিক। চাপা শ্বাস ফেললেন। বুকটা আকস্মিক ভারি হয়ে গেছে। কদম বাড়াতে পারলেন না তিনি। লায়লা বললেন,
‘ যার সাথে বিয়ে হয়েছে, ওই ছেলেও তো সুবিধার না। সেদিন সাফার সাথে কী বিহেভ করল!’

তারিফ বলল, ‘ মৌ’এর সাথে বেরুনোর পর একটা ছেলে ওকে বাজে কমেন্ট পাস করেছিল, আমি ওই ছেলেটাকে পি/টি/য়ে হাসপাতালে পাঠিয়েছিলাম। সে ক্ষেত্রে জাওয়াদ আমার থেকে ভালো। জাস্ট দুটো কথাতেই ছেড়ে দিয়েছে। ওকে যতদূর চিনলাম। আমাদের সাইটেরই। মর্ডান ম্যান্টালিটির। সে মুশিকে আগলে রাখে। ঢাল হতে গিয়েই কঠোর হয়, মুশির সাথে ওর সম্পর্ক ভালোই। আমি জাওয়াদকে দেখে এতটুকু বুঝতে পেরেছি, ছেলেটা মুশিকে ভীষণ সম্মান করে, তার ড্রেসাপকে সম্মান করে। যা আমরা এত বছরেও পারিনি। জাওয়াদ প্যাম্পার হার এজ আ কুইন। বাইরের একটা ছেলে ওর মূল্য বুঝল অথচ আমরা বুঝলাম না। ‘

থামল তারিফ। তারপর বলল,
‘মুশি ভীষণ সুখে আছে, কিন্তু পরিবারহীনতা কোথাও ওকে ভীষণ কষ্ট দিচ্ছে। ও ভালো নেই. মা, বাবার অভাব ওকে কাতর করছে। জাওয়াদ জানাল মুশি প্রায়ই কান্না করে তোমাদের মনে করে। আজ সকালে পায়েশ প্রসঙ্গে তুলে ভীষণ মন খারাপ করেছিল, আজ পায়েশ বাটি সামনে না পেয়ে ওর কথা মনে পড়েনি তোমাদের? কখনো তোমাদের মনে পড়ে না? ওর ছবি ভাসে না তোমাদের চোখে?’

লায়লা, ফারুক দুজনের চোখে কাতরতা দেখা গেল এই ক্ষণে। কিন্তু কেউ প্রকাশ করলেন না। নিশ্চুপ রইলেন। এমন ভান করলেন যেন তারা ইহকালেও স্মরণে বসেন না। অথচ কেউ টের পেল না তাদের হৃদয়কম্পন। দুজনের চোখে ভাসল মুশরাফার ছোটোবেলার ছবি। ফ্লাপি ফ্লকের পুতুলকন্যার মুখশ্রী। বড়োবেলার স্মৃতি কেবল বিষাদ ছিল, সুন্দর স্মৃতি কেবল শৈশবেই ছিল। আধো স্বরে ‘মা, বাবা ‘ ডাক কানে ভাসল। ঝঙ্কার তুলল। ফারুক সাহেব ঘাড় ঘুরিয়ে স্ত্রীর পানে চাইলেন এক পলক। তাকালেন লায়লাও। চোখে চোখে কী কথা হলো কে জানে। কাতরতা বাড়ল সেই চাহনিতে। ফারুক সাহেব নিজ ঘরে চলে গেলেন। ভাবনায় বসলেন লায়লাও। স্মৃতি আওড়ালেন, মমতা ঘেটে দেখলেন অবশিষ্ট আছে কি না।

তবে কি ভাবনার ইতিবৃত্ত এখান থেকেই শুরু?

চলবে…

আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here