অসম পর্ব ২৬,২৭ শেষ

অসম
পর্ব ২৬,২৭ শেষ
তানিয়া রহমান
২৬

তুহিন ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিজের রুমে বসে বারবার ঘড়ি দেখছে।আজ সারাদিন কাজের অনেক প্রেসার ছিল, চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে ভাবলো এক মগ কফি হলে মন্দ হতো না। মেডিকেল অফিসার মেহবুব এসে বলল- স্যার এখনো বাসায় যাননি
তুহিন চোখ বন্ধ করেই বলল- জুনায়েদ স্যার ও টি রেডি করতে বলল,ইমারজেন্সি অপারেশন, মেহবুব!
– জ্বি স্যার
– তুমি কি আমাকে এক মগ কফি খাওয়াতে পার?
– জ্বি স্যার,নিয়ে আসছি
– বাইরে এত শোরগোল কেন?
– শিল্পপতির ওয়াইফ মারাত্মক এক্সিডেন্ট করেছে স্যার তাই জার্নালিস্টদের ভিড়
– আজকালকার চ্যানেলগুলোরও খেয়ে দেয়ে কাজ নাই, দেশে কি নিউজের অভাব পরছে যত্তসব
– স্যার আমি তাহলে কফি নিয়ে আসছি
– চিনি ছাড়া এনো
মেহবুব বেরিয়ে যাবার পর ডঃ জুনায়েদের ফোন এল,তুহিন ফোন রিসিভ করে বলল – বলুন স্যার
– ও টি রুমে চলে আস
– ওকে!

ও টি রুমে ঢোকার সময় তুহিনের সাথে নেশালের চোখাচোখি হলো,একমিনিটের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে তুহিন দ্রুত ও টি রুমে ঢুকে বেডের সামনে এসে দাড়ালো, নিতুর পুরো শরীর রক্তে মাখামাখি, মাথা ফেটে একাকার, কি বিভৎস্য ভাবে মুখের একটা পাশ থেতলে গেছে, তুহিনের গা গুলিয়ে এলো।ডঃ জুনায়েদকে তুহিন বলল – স্যার আমি অপারেশনে থাকতে পারবো না, স্যরি!
– হুয়াই
– মিসেস নিতু আমার ফ্রেন্ড স্যার,আমি এসব নিতে পারছি না
– ওকে! সেজানকে কল কর, কুইক

তুহিন বাইরে এসে চেয়ারে বসে পরলো, নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে পকেট থেকে ফোন বের করে অনুপমকে কল করলো
– তুই কোথায়
– কেন
– কোথায় আছিস
– আমার ফ্ল্যাটে
– ডি এম সিতে চলে আয়
– পারবো না, নিতু আসবে, জানিসইতো আজ আমাদের বাসর
– নিতু আমার এখানে আছে
অনুপম রেগে গিয়ে বলল- ও তোর ওখানে কি করছে, তিনঘন্টা ধরে ওয়েট করছি, ফোনও বন্ধ
– আয় তারপর বলছি

প্রচন্ড জ্যাম ঠেলে অনুপম রাত দশটায় ডি এম সিতে এসে পৌঁছালো।তুহিনকে কল করে জিজ্ঞেস করল – কোথায় আছিস
– এক নাম্বার বিল্ডিং এর দোতলায়, দ্বিধা নিয়ে বলল – ও টি রুমের সামনে
অনুপম দ্রুত হেটে দোতলায় উঠে এল,ও টি রুমের সামনে নেশাল আর হিমিকে দেখে থমকে গেল,এদিক ওদিক খুঁজে তুহিনকে পেল কর্ণারের সারির চেয়ারটায়।কাছে গিয়ে বলল- ও কোথায়
তীক্ষ্ণ চোখে তুহিনকে দেখে আবার বলল – ওর কি কিছু হয়েছে
– বোস বলছি
– ধৈর্য ধরতে পারছি না
তুহিন মুখ ঘুরিয়ে বলল- নিতু কাঁচপুর ব্রিজের কাছে এক্সিডেন্ট করেছে।
– হোয়াট! চুলগুলো দু’হাতে টেনে ধরে চেচিয়ে বলল – কুত্তার বাচ্চা ইমতিয়াজ কই আমি ওকে খুন করে ফেলবো
– নিতু নিজে ড্রাইভ করছিল
– ওহ্ মাই গড! দু’হাতে মুখ ঘসে বলল- কত নাম্বার কেবিন
– ও টি চলছে
অনুপম স্তব্ধ হয়ে গেল, দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে বলল – এ আমি কি করলাম, কেন নিজে পিক আপ করলাম না।তারপর মনে হলো” নিতু কাঁচপুর ব্রিজের কাছে কি করছিল ওরতো আমার কাছে আসার কথা, ” নেশালের দিকে তাকালো, দ্রুত হেটে নেশালের কাছে গিয়ে বলল- ও কোথায় যাচ্ছিল
নেশাল চুপ করে রইল
-আমি বলেছিলাম ওকে কষ্ট না দিতে,ভালবেসেছ কখনো কাউকে, বাসনিতো,তুমি কিভাবে বুঝবে আমার বুকের ভিতর কি হচ্ছে?
অনুপমের ক্রোধ দেখে হিমি বলল – আমি সব বলছি
অনুপম একটা হাত তুলে হিমিকে থামিয়ে দিল, সজোরে নেশালের নাক বরাবর ঘুসি দিয়ে বলল – সাতটা দিন ওয়েট করতে বলেছিলাম।
নেশালের নাক দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে পরলো, শোয়েব আর তুহিন দৌড়ে এসে অনুপমকে সরিয়ে নিল।তুহিন শোয়েবকে বলল- ফাস্ট এইড লাগবে, নেশালকে নিয়ে বাপাশের রুমে চলে যান ওখানে ইমারজেন্সি ডক্টর পাবেন।
হিমি পুরো ব্যাপারটায় হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল, তুহিন হিমিকে বলল- স্যরি
অনুপম তুহিনকে জরিয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো কাঁদতে কাঁদতে বারবার বলতে লাগলো- আই কান্ট লিভ উইথাউট হার

চলবে

অসম
পর্ব ২৭ শেষ
তানিয়া রহমান

টানা দুই ঘন্টা অপারেশনের পর ডাঃজুনায়েদ ও টি রুম থেকে বেরিয়ে এল।অনুপম দ্রুত পায়ে ডাঃজুনায়েদের সামনে গিয়ে হাত বারিয়ে বলল – আমি ডাঃ অনুপম চৌধুরী
ডাঃ জুনায়েদ হ্যান্ডশেক করে বলল – পরিচিত হয়ে ভালো লাগলো
– প্যাসেন্ট কেমন আছে
– সেন্স না ফেরা পর্যন্ত বলা যাচ্ছে না, বাই দ্যা ওয়ে আপনি প্যাসেন্টের কে হন
নেশাল শোয়েবের দিকে তাকিয়ে বলল – কন্ট্রোল দেম
শোয়েব জুনায়েদের সামনে এগিয়ে গিয়ে বলল- এস এস গ্রুপ থেকে আপনাকে অনেক ধন্যবাদ স্যার,ভীষণ টায়ার্ড দেখাচ্ছে আপনাকে, আপনি যদি কিছু মনে না করেন আমাদের লোক আপনাকে বাসায় পৌঁছে দিবে
– আমি সত্যি সত্যিই টায়ার্ড, বাট আমার সঙ্গে গাড়ী আছে

জুনায়েদ চলে যাবার পর শোয়েব অনুপমের সামনে এসে স্মিথ হাসলো, হাগ করার ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে কানের কাছে ফিসফিস করে বলল – চারদিকে জার্নালিস্ট ওঁৎ পেতে আছে, ম্যামের কোন অসম্মান চাচ্ছি না
অনুপমও সুযোগটা লুফে নিল,শোয়েবের মতোই ফিসফিস করে বলল – দেখা করার ব্যবস্থা করুন তা না হলে ঝামেলা পাকাবো,
অনুপম ভালো করেই জানে নেশাল না চাইলে নিতুর সঙ্গে দেখা করা সম্ভব নয়,কাঁটা দিয়েই কাঁটা তুলতে হবে।
– ওকে!
অবজারভেশন রুমের দিকে পা বাড়ালো শোয়েব, মিনিট দশ পর ফিরে এসে অনুপমের পাশে দাঁড়িয়ে স্বর নামিয়ে বলল- ম্যামকে এখন না দেখাই আপনার জন্য ভাল হবে, সহ্য করতে পারবেন না
অনুপম দৃঢ় কন্ঠে বলল – সে আমি বুঝবো

অবজারভেশন রুমের মাঝের সারির তিন নাম্বার বেডে নিতু শুয়ে আছে। পুরো মাথা আর গালের একটা পাশ ব্যান্ডেজ। ডান হাতে স্যালাইন চলছে, ফর্সা হাতগুলোতে মেহেদীর রঙ তখনো উজ্জ্বল।
কিছু সময় অপলক দৃষ্টিতে নিতুর দিকে তাকিয়ে থেকে অনুপম নিতুর ডান হাত টেনে গালের সাথে চেপে ধরে বিড়বিড় করে বলল – স্যরি,তোমাকে আর কখনো একা ছাড়বো না,নিতুর হাতের তালুতে নাক ঘষে বলল-এই দেখ নাকে খাদ দিচ্ছি, কথা বল,প্লিজ! আমার বুকের ভিতর কি যে হচ্ছে! নিতু তুমি কি বুঝতে পারছো? হাত খামচে দিয়ে অভিযোগ কর তবুও চুপ করে থেকো না, কিছু সময় চুপ করে থেকে আবার বলল –
আমাদের বাসর সাজিয়েছি, তুমি বোউ সাজবে না? অনুপমের ইচ্ছে করছে নিতুকে জরিয়ে নিতে, গালের সাথে গাল মিলিয়ে আদর করতে।কারো পায়ের আওয়াজ পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে তাকালো,সিস্টার বলল- স্যার অনেকক্ষন হলো,যদি এবার
অনুপম কথা শেষ করতে দিল না, জলভরা চোখে তাকিয়ে বলল – আর পাঁচ মিনিট
– বাকি রুগীদের সমস্যা হচ্ছে
অনুপম নিতুর গালে হাতে চুমু খেল তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।
অবজারভেশন রুমের বাইরে এসে অনুপম আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না, দু’হাতে মাথা চেপে দেয়ালে ঠেসে ধরে শব্দ করে কান্না করে উঠলো।

সেকেন্ডের কাঁটায় পাহাড় বেঁধে সময় গড়াচ্ছে, তুহিন আর অনুপম পাশাপাশি বসে আছে, অদূরে নেশাল। পিনপতন নিরবতা ভেঙ্গে অনুপম বলল – দুদিন পার হয়ে গিয়েছে অথচ এখনো ও সেন্সলেস,আমার কি ইচ্ছে করছে জানিস নেশালকে খুন করে ফেলি
– বাজে কথা বাদ দে
– সত্যি বলছি, নেশাল যদি নিতুর ছেলে না হতো আমি ওকে শেষ করে দিতাম
– চল্ কফি খেয়ে আশি
– নিতু ছাড়া আমি কারো সঙ্গে কফি খাই না
– স্যরি, পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে তুহিন একটা সিগারেট মুখে গুঁজে দিয়ে অনুপমের দিকে বাকী প্যাকেটটা এগিয়ে দিল
অনুপম সিগারেটের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে ছুড়ে ফেলে দিয়ে বলল – তুই জানিস না নিতু নিকোটিনের গন্ধ সহ্য করতে পারে না
– শান্ত হ, প্লিজ
অনুপম তুহিনের দিকে তাকিয়ে চোখ মুছে বলল- ওর কিছু হলে বাঁচব নারে,মরে যাব দোস্ত, একদম মরে যাব।
তুহিন অনুপমকে দু’হাতে আগলে ধরলো।

আজ আষাঢ় মাসের এক তারিখ। দশ বছর আগে এমনই এক মধ্য দুপুরে নিতুর সঙ্গে অনুপমের প্রথম কথা হয়।অবজারভেশন রুমের সামনে থেকে অনুপমকে এক সেকেন্ডের জন্যও নড়ানো যাচ্ছে না। অনুপম দুহাত কোলের মধ্যে ফেলে তুহিনকে বলল- আজ কত তারিখ বলতো
তুহিন অনুপমের দিকে তাকালো
অনুপম ম্লান হেসে বলল – আজকের দিনে ওর সঙ্গে আমার প্রথম কথা হয়,কত কি ভেবে রেখেছিলাম দুজন আজকের দিনটা সেলিব্রশন করার জন্য অথচ দেখ আমাকে স্বপ্ন দেখিয়ে ও নিশ্চিন্তে শুয়ে আছে
তুহিন অনুপমের একটা হাত চেপে ধরলো
অনুপম আবার বলল – কখনো ভাবিনি ওকে পাব, আমিতো ভেবেছিলাম ব্যাংককেই আমার জীবন পার হয়ে যাবে, পেলামই যদি তবে কেন হারাতে বসেছি বলতে পারিস
– চল্ ক্যান্টিনে যাই কিছু একটা খাবি
– ইচ্ছে করছে না
– সব ঠিক হয়ে যাবে, ধৈর্য্য ধর্
– পরপারে ও নিশ্চয় আমারই হবে তাই না! ওতো আমার বিয়ে করা বোউ, আর কেউ ওকে আমার কাছ থেকে সরিয়ে দিতে পারবে না
– কেন এমন বলছিস, নিতু সুস্থ হয়ে যাবে
– তোর কি মনে হয় আমি ঘাস খেয়ে ডাক্তারী পাস করেছি

বিকেল চারটা
ইয়াং লেডি ডক্টর বেরিয়ে এল অবজারভেশন রুম থেকে, অনুপম আর তুহিন দুজনেই তাকালো ডক্টরের দিকে, অনুপমের গা শিউরে উঠলো অজানা ভয়ে, সত্যি যদি দোতরার তার এক সুরে না বেঁধে ছিড়ে যায়।
ডক্টর বলল- মিসেস নিতুর পরিবারের কেউ আছেন
নেশাল উঠে দাঁড়াল, এই ইয়াং লেডি ডক্টর কি বলছে তা অনুপমের কানে পৌঁছালো না কিন্তু সে অনুভব করলো তার বুকের বা পাশটা প্রচন্ড ব্যাথা করছে, অনুপম হাত দিয়ে খামচে ধরলো বা পশটা।
তুহিন পিছনে ফিরে দেখলো অনুপমের বলিষ্ঠ দেহটা লুটিয়ে পড়ছে মেঝেতে।

আজ পঞ্চম দিন
নিতু আর অনুপমকে পৃথিবী বিদায় জানিয়েছে।
অভিনব আর রত্নাকে নিয়ে তুহিন অনুপমের ফ্ল্যাটে এসেছে। দরজার উপর ব্রাসেলসের নেমপ্লেটটা জ্বলজ্বল করছে। মি. এন্ড মিসেস অনুপম চৌধুরী।
লিভিং রুমে ঢুকে তীব্র পঁচা খাবারের গন্ধ পেল।তিনজনই নাকে কাপড় চেপে ডাইনিং এ এল।ক্যান্ডেলের আলো নিভে গেছে বহু আগে, বাহারি খাবারে ফাংগাস পরেছে, দুটো প্লেট টেবিলের উপর আজও শোভাবর্ধনের জন্য চক্ চক্ করছে।
তুহিন রিসিপশনে ফোন করে বলল ” একজন ক্লিনার পাঠাতে, ফ্ল্যাট ক্লিন করতে হবে।
বেডরুমের নব খুলে ভিতরে ঢুকে তিনজনই অবাক হয়ে গেল।
পুরো বেড অলকানন্দা দিয়ে সাজানো, বেশির ভাগ ফুলই পঁচে গিয়েছে, দেয়ালের একপাশে শোভা পাচ্ছে তুহিনের তোলা অনুপম আর নিতুর প্রথম কাপল ফটো।তার নিচে বড় বড় দুটো ক্যান্ডেল নিভু নিভু করে জ্বলছে।
তুহিন জানালা থেকে ভারী পর্দা সরিয়ে দিল।থালার মতো একটি চাঁদ উঠেছে, হাজার তারার বিচ্ছুরণ হচ্ছে। জোসনার আলো ঝিলের পানিতে ঢেউ খেলে যাচ্ছে।
আকাশের দিকে তাকিয়ে তুহিন বলল – ভালো থাকিস তুই তোর নিতুকে নিয়ে।

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here