শিউলিবেলা,পর্বঃ ২,৩

শিউলিবেলা,পর্বঃ ২,৩
খাদিজা আরুশি আরু
পর্বঃ ২

তাদের দু’বোনের জন্মলগ্ন এক হলে কি হবে, ব্যক্তি হিসেবে দু’জন দু’মেরুর… অরিত্রী মনে মনে ভাবলো, আজ বোন এলে ঠিক ঠিক কিছু কড়া কথা শুনিয়ে দেবে সে। এ মেয়েটার জন্য শান্তিতে একটা রাত ঘুমোতে পারে না অরিত্রী, অপেক্ষা করে বসে থাকতে হয় তাকেও। আজকাল তো আবার মাঝে মাঝে নেশাও করে, মাঝরাতে বাবা-মা কে লুকিয়ে তো তখন তাকেই সবটা সামলাতে হয়।

ঘরের দরজায় টোকা দিতেই আতিকুর রহমান মুচকি হেসে হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকলেন অরিত্রীকে। ও কাছে যেতেই ওর একটা হাত দু’হাতে আঁকড়ে ধরে বললেন,

-“অতসীটা তোর মতো সাধারণ হলো না কোনো রে অরিত্রী? মেয়েটার এতো গুণ কেনো হলো?”

বাবার কথায় ভীষণ হাসি পাচ্ছিলো অরিত্রীর, অতসীকে নিয়ে আক্ষেপ করতে গিয়েও তিনি তার গুণের সুনাম করতে ভুললেন না। তবে মনে মনে খারাপও লাগলো, যখন বাবা-মা অতসীর সুনাম করেন, তার মেধা এবং মননের প্রশংসা করেন তখন অরিত্রীর মনে হয় তার কোনো গুণ নেই, সে অতি সাধারণ। তাকে নিয়ে গর্ব করার কিছু নেই… ঠিক সে মুহূর্তে তার মনে কিছু করার ইচ্ছে জাগে, এমন কিছু যা করলে তার বাবা-মা গর্ব করে বলবে, “আমাদের অরিত্রীর মতো সোনার টুকরো মেয়েই হয় না!” কবে বলবেন তারা এ কথা, কবে, কবে, কবে…

ওরা দু’বোন জমজ হলেও বাবা-মা দু’জনেরই ছোটবেলা থেকে অতসীর প্রতি দুর্বলতা বেশি। তবে অনেক ভেবে এই বেশি ভালোবাসার পেছনে একটা কট্টর যুক্তি দাঁড় করিয়েছে অরিত্রী। একবার গ্রামে বেড়াতে যাবার পর খেলার সময় অতসী পা পিছলে বাড়ির পেছনের পুকুরটায় পড়ে যায়। যতোক্ষণে ওকে পানি থেকে তোলা হলো ততোক্ষণে ওর অবস্থা গুরুতর, মুমূর্ষু অবস্থ… পরিচিত সবাই ধরে নিলো ওকে আর বাঁচানো যাবে না। কিন্তু সে যাত্রায় সৃষ্টিকর্তার কৃপায় ও বেঁচে গেলো। এরপর থেকে বাবা-মা ওকে চোখের আড়াল হতে দিতো না, ও একবার কিছু চাইলে মুখ ফুটে দ্বিতীয়বার চাইতে হতো না।

ওদের দু’জনের জন্মক্ষণে পাঁচ মিনিটের তফাত কিন্তু জন্মলগ্ন এক, চেহারা এক, তাই জন্ম থেকে বেশি-কম ভালোবাসার কোনো কারন অরিত্রী পায় নি। তার ধারনা তারা অতসীকে হারাতে হারাতে আবার পেয়েছে বলেই তার প্রতি তাদের আলাদা আকর্ষণ সৃষ্টি হয়েছে। এ আকর্ষণ মৃতপ্রায় সন্তানকে ফিরে পাবার মাধ্যমে সৃষ্টি… বাবা-মাকে অরিত্রী কখনোই অতসীকে অতিরিক্ত ভালোবাসার জন্য দোষারোপ করে নি, আজও করে না। যে সন্তানকে তারা প্রায় হারাতে বসেছিলো সে সন্তানের জন্য আলাদা টান থাকাটা কি অস্বাভাবিক কিছু? তবুও মানব মন তো, কষ্ট হতো, আজও হয়। তার শিশুসুলভ মনটা অতসীর মতো বাবা-মায়ের কাছ থেকে একটু বেশি মনোযোগ পেতে চায়। একটা সময় ছিলো, যখন অরিত্রীর মনে হতো, সেদিন দূর্ঘটনাটা অতসীর সঙ্গে না ঘটে তার সঙ্গে ঘটলে হয়তো ভালো হতো। আপনজনের অতিরিক্ত ভালোবাসা কে’ই বা পেতে না চায়! সময় কেটে গেছে, শিশুসুলভ মন পরিপক্ক হয়েছে, তবুও থেকে থেকে অরিত্রীর মনে হয়, যদি বাবা-মায়ের তার জন্য গর্ব হয় এমন কিছু করতে পারতো! বাবার ডাকে ভাবনায় ছেদ ঘটলো অরিত্রীর, আতিকুর রহমান হালকা কেশে গলা পরিষ্কার করে বললেন,

-“তোর মা সম্ভবত অমিতের ঘরে আছে, একটু ডেকে দে তো।”

বাবার চেহারাটা বড্ড বেশি শুকনো মনে হলো অরিত্রীর, মানুষটাকে কি ভেতর ভেতর কোনো রোগে ধরলো! অথচ এ শুকনো মুখেও বরাবরের মতো ঠোঁটের কোণে হাসি লেপ্টে আছে। অরিত্রীর মন চাইছিলো না এ রুগ্ন মানুষটার পাশ ছেড়ে উঠতে তবুও পিতৃআদেশ পালনে উঠে দাঁড়ালো। অমিতের ঘরে গিয়ে দেখলো, মা ওকে পড়াচ্ছেন। অরিত্রী বুঝে না, এতো বড় ছেলেটার পাশে বসে না থাকলে সে পড়তে পারে না কেনো! অরিত্রীকে দেখে মা বললেন,

-“তুই এসেছিস, যাক ভালো হলো। অমিতটাকে একটু পড়া তো। আমি তোর বাবার বুকে-পিঠে রসুন আর সরিষার তেল গরম করে মালিশ করে দেই। আজকাল যখন তখন বৃষ্টি হচ্ছে। এমন সময় অসুস্থ হলে তো অতসীটাকে সমস্যায় পড়তে হবে। কাল তো বললো, আজকাল অনেক কাজের চাপ। বাড়ি ফিরতেই কষ্ট হয়ে যায়। এতো কাজের ফাঁকে হাসপাতালে দৌঁড়াতে হলে তো মেয়েটা বিছানায় পড়বে।”

অরিত্রী বেশ বিরক্ত হলো, অতসীকে নিয়ে মায়ের বাড়াবাড়িটা চোখে পড়ার মতো। তবুও নিজেকে সংযত রেখে, ঠোঁটের কোনে মেকি হাসি ফুটিয়ে তুলে বললো,

-“আপুকে করতে হবে কেনো মা? ও ওর কাজ করুক না। তেমন কোনো প্রয়োজন হলে আমি আর অমিত সবটা সামলে নেব।”

মায়ের মুখটা মলিন হলো, নিরাশ ভঙ্গিতে বললেন,

-“তুই আর কি’ই বা করবি? ওইতো স্কুলে চাকরি করে ক’টা টাকা বেতন পাস, বিপদে-আপদে তো অতসীটাকেই দু’হাতে টাকা ঢালতে হয়। তোর বাবার পেনশনে আর কতোই বা পায়… কতো করে বললাম, ব্যাংকের চাকরিটা কর। কিন্তু না, তোকে তো সমাজ সেবার ভুতে ধরেছে। এমন বোকা হলে সমাজে টিকে থাকবি কি করে আল্লাহ মাবুদ জানেন। হায় খোদা, এ মেয়েকে বুদ্ধি দাও।”

বিলাপ করতে করতে মিনতি রহমান বেরিয়ে গেলেন, অমিত অরিত্রীর দিকে তাকিয়ে বিরক্তিতে মুখ বাঁকিয়ে বললো,

-“ছোটপু, কেমন লাগে বলতো? বড়পুর টাকায় চলি আমরা? বাড়িটা তো আমাদেরই, তাও দাদুর বানানো। বাড়ি ভাড়া লাগে না, বাজার খরচ আর আমার পড়ার খরচ তো বাবার পেনশনেই হয়ে যায়, তোর খরচ তো তুইই চালাস। আপুর টাকা তো খুব প্রয়োজন ছাড়া লাগেও না। মানে, আমাদের চাইতে হয় না কখনো। আপুই আমাদের জন্য খরচ করে। তবুও মা তোর সঙ্গে এমন করেন কেনো? কি হয় একটা বড় চাকরি না করলে? তুই জানিস, সেদিন আমার বন্ধু রাকিব বলছিলো, ওর মা নাকি তোর অনেক সুনাম করেছে। তুই নাকি খুব ভালো পড়াস, ওর ছোটভাই তো তোর ছাত্র। জানিস আমার বোন ভালো শিক্ষক, এ কথা ভেবে তখন আমার কতো গর্ব হচ্ছিলো?”

একটু থেমে দম নিলো অমিত, তারপর আবার বললো,

-“এতো টাকা দিয়ে কি হবে? মায়ের এতো কিসের আক্ষেপ বুঝি না। আমার আর এসব ভালো লাগে না, মনে হয় বনবাসে চলে যাই।”

ভাইয়ের কথা শুনে মুচকি হাসলো অরিত্রী, তারপর বললো,

-“এভাবে বলতে হয় না ভাই… মা তো আমার খারাপ চায় না। মা হয়তো ভাবেন যে, আপু এতো বড় বড় লোকজনের সঙ্গে উঠাবসা করছে, যদি আমাদের ভুলে যায়! তাই ওর সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে চলার জন্য আমাকে বড় চাকরি করতে বলে। কিন্তু কি করবো বল, আমার যে এ চাকরিটা বড্ড প্রিয়…”

অমিত মুখ গোমরা করে বললো,

-“মা সবসময় বড়পুর টাকার গর্ব করে, একসময় আমিও অনেক টাকা উপার্জন করবো, তখন তুই আমাকে নিয়ে গর্ব করবি?”

মুচকি হেসে হ্যাঁসূচক মাথা নাড়ায় অরিত্রী। অমিত আবার বলে,

-” জানিস, এখানে বসে বসে কি বলছিলো মা?বলছিলো বড়পুর কেনা ফ্লাটটায় উঠলেই তো বাবার এতো চিন্তা করতে হয় না। গরিবী এলাকাতে থাকে বলেইতো আপুর ফেরা নিয়ে বাবার এতো দুশ্চিন্তা করতে হচ্ছে। রাত করে ফেরা নাকি অতো বড় ব্যাপার না, এ বাড়িটাই নাকি সব সমস্যার মূল। বাবা নাকি বেকার বাড়াবাড়ি করছে। তুই বল, এসবের কোনো মানে হয়? আমরা কেনো আপুর সুবিধার জন্য এ বাড়িটা ছাড়বো? এ বাড়িটায় আমাদের সবার কতো স্মৃতি!”

শেষ কথাগুলো বলার সময় অমিতের চোখ ছলছল করছিলো, ছেলেটা বাইরে থেকে যতোই নিজেকে শক্ত দেখানোর চেষ্টা করুক না কেনো, অরিত্রী জানে তার ভাইটার মন কতো নরম। সে অমিতের চুলগুলো হাত দিয়ে আঁচড়াতে আঁচড়াতে বললো,

-“আসলে আপু হলো মায়ের প্রিয় সন্তান। লোকমুখে কতো সুনাম ওর দেখিস না? আমি আর তুই তো খুব সাধারণ, আমাদের নিয়ে তো গর্ব করার কিছু নেই। তাই মা ওকে নিয়ে একটু বেশি মাতামাতি করে। স্বাভাবিকভাবেই মানুষ তো তার সবচেয়ে দামী জিনিসটাই অন্যকে দেখাতে পছন্দ করে বল, কমদামী জিনিসগুলো তো চার দেয়ালের আড়ালেই থেকে যায় তাই না?”

অমিতকে এক পলকে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে অরিত্রী আবার বললো,

-“আরেকটু সহজভাবে বলি, তুই যখন কোনো অনুষ্ঠানে যাস তখন তুই কি করিস? তোর সবচেয়ে ভালো জামাটা বের করে ইস্ত্রী করে তারপর পরে যাস। শুধু তুই না, সব মানুষই এমনটা করে। মায়ের ব্যাপারটাও তেমন, আমাদের তিন ভাই-বোনের মধ্যে আপু সবচেয়ে বেশি সফল। তাই মা আপুকে নিয়ে সবসময় কথা বলেন, গর্ব করেন, মাতামাতি করেন। এটা স্বাভাবিক ব্যাপার, এতে মন খারাপ করার কিছু নেই, বুঝলি?”

অমিত কি বুঝলো কে জানে, অরিত্রীকে জড়িয়ে ধরে বললো,

-“কিন্তু আমার কাছে তুই সেরা ছোটপু, তুই আমার বেস্ট আপু। দেখ, বড়পু আমাকে অনেক কিছু কিনে দেয় ঠিক কিন্তু তোর মতো চুল আঁচড়ে দেয়? কলেজে যাবার সময় শার্টের পকেটে ভাড়া গুঁজে দেয়? রাত জেগে পড়ার সময় আমার পাশে বসে থাকে? আমার মাথা ব্যাথা করবে বলে চা করে দেয়? আমার কখন কি লাগবে তার খেয়াল রাখে? আমার অসুখ হলে একটু পরপর দেখতে আসে? এসবের কিছুই বড়পু করে না, তুই করিস।”

একটু থামে অমিত, তারপর আবার বলে,

-“কে কি ভাবে জানি না, তবে আমার জন্য তুই সেরা… ছোটবেলা থেকেই দেখছি আমার জন্য যে কাজটা মায়ের করা উচিত ছিলো, অনেক সময় তাও তুই করেছিস। বড়পুর মতো হয়তো অনেক গুণ নেই তোর, অনেক টাকা উপার্জনও করিস না, তবে তোর মাঝে যে মমতা আছে তা বড়পুর মধ্যে নেই। আমি হলপ করে বলতে পারি তোর মতো করে বড় আপু কখনো আমায় ভালোবাসে নি, বাবা-মাকে ভালোবাসে নি, আর কখনো ভালোবাসতে পারবেও না…”

অমিতটা বরাবরই অরিত্রীর জন্য পাগল, অরিত্রী আর অতসী যখন কলেজে পড়তো তখন মিনতি রহমানের কোল আলো করে অমিতের জন্ম হয়। অতসী তখন সবে কয়েকটা কোম্পানির বিজ্ঞাপনের জন্য ফটোশুটের অফার পেয়েছে, সে দিনরাত নিজের ক্যারিয়ার গড়ায় ব্যস্ত। আর অরিত্রী, সারাদিন পড়াশুনা আর ছোট্ট অমিতকে নিয়ে কেটে যেতো তার দিন। সেদিনের সেই ছোট্ট বাবুটা এখন এইচ.এস.সি. পরিক্ষার্থী, ভাবা যায়! অরিত্রী ভাবে, সময় কতো দ্রুত বয়ে যায়… এখনো ভাবলে মনে হয়, এইতো কিছুদিন আগে অমিত তার হাত ধরে হাঁটতে শিখছে, আদো আদো বুলিতে তাকে আপ…পু বলে ডাকছে। আহা, কতো মধুর ছিলো সময়টা… আল্লাহ তাকে অমিতের রূপে এতো সুন্দর একজন মানুষ উপহার দিয়েছেন যার জন্য সে সৃষ্টিকর্তার নিকট চিরকৃতজ্ঞ। অরিত্রীর চোখের কোণে নোনা জলরা ভিড় জমায়, চোখের জল লুকাতে জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়ায় সে। আহা, তার ভাইটা তাকে কতো বোঝে, কতো ভালোবাসে! মনে মনে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে, তার ভাইটা যেনো জীবনে মানুষের মতো মানুষ হয়।

চলবে…

শিউলিবেলা
খাদিজা আরুশি আরু
পর্বঃ ৩


খাবার টেবিলে সবাইকে গম্ভীরভাবে খেতে দেখে ভীষণ বিরক্ত হলো ঈশান। সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে কয়েকবার কেশে গলা পরিষ্কার করে বললো,

-“বুঝলে দাদু, তোমার আদরের নাতি পিথিউশা তো কেলেঙ্কারী কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছে। যেনো তেনো মেয়ে নয়, সরাসরি সুপার মডেলের প্রেমে পড়েছে। বুঝতে পারছো? ওই ছোট, ছোট, কাটা কাটা জামা পরা মডেল। ভাবো একবার…”

কথাটা বলেই পিথিউশার দিকে তাকিয়ে চোখ মারলো ঈশান। ঈশানের কথা শুনে তাদের দাদু মহসীনুল হকের গলায় ভাত আটকে গেলো, পিথিউশা পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিতেই উনি শান্ত অথচ গম্ভীর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালেন। সঙ্গে সঙ্গে অন্যদিকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো পিথিউশা, বিড়বিড় করে বললো, “বাপরে, কি ভয়ানক।” সবার দৃষ্টি তখনো পিথিউশার চেহারায় স্থির, যেনো এ মুহূর্তে তার চেহারা পড়ার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ এ ধরণীতে নেই। সে ভ্রুঁ কুঁচকে অগ্নীদৃষ্টিতে তাকালো ঈশানের দিকে, দেখে মনে হলো পারলে এখনি ভষ্ম করে দেবে তাকে। পিথিউশার অগ্নীদৃষ্টিকে উপেক্ষা করে ঈশান আবার বললো,

-“বুঝলে মা, এ যাত্রায় তোমাদের মেয়ে দেখার ঝামেলা কমে গেলো। তোমরা বরং আমার জন্য…”

আরজু হক মুচকি হাসলেন, তার ছেলের পাগলামী দেখে আজকাল আর বিরক্ত লাগে না। এ ছেলেটা এতো বিয়ে পাগল… এ পর্যায়ে এসে তাদের বাবা মঈনুল হক কথা বললেন। গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,

-“তোমার বউ এসে কি খাবে? চাকরি বাকরি তো করবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছো, এখন কি বেকার অবস্থায় বিয়ে করে বংশের পরম্পরাও ভাঙ্গতে চাচ্ছো? মনে রেখো, বেকার ছেলে আর তার বউকে ঘরে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াবো এতো ভালো বাবা আমি নই। যার বউ তাকেই খাওয়াতে হবে…”

ঈশান মুখের খাবারটা কোনোমতে গিলে বোকার মতো বললো,

-“ভাত খাবে বাবা, আমার বউ ভাত খাবে। আমি তো কোনো বিদেশী বিয়ে করবো না… তুমি টাকা না দিলে কি হবে? ভাইয়ার টাকায় খাবে আমার বউ।”

ঈশানকে যে চাকরির জন্য চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে তার মোটা মাথায় তা ঢুকে নি ততোক্ষণেও। তার বোকামি দেখে দাদু অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন, কোনো মতে হাসি থামিয়ে বললেন,

-“বউ খাওয়ানোর মুরোদ নেই, সে করবে বিয়ে। তোর মতো ছন্নছাড়াকে কে বিয়ে করবে রে ছোট নাতি?”

এতোক্ষণে বাবার কথার মর্মার্থ উদ্ধার করতে পারলো ঈশান, মলিন মুখে বললো,

-“এ বাড়িতে সবার জন্য ভাত আছে, কেবল আমার বউয়ের জন্য নেই…”

খাবার প্লেটটা দূরে ঠেলে দিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো সে। কাঁদো কাঁদো মুখ করে বললো,

-“খাবো না আমি এ বাড়ির খাবার, যতোদিন নিজে উপার্জন না করছি ততোদিন আমি অন্নস্পর্শ করবো না। যে বাড়ির ভাতে আমার বউয়ের অধিকার নেই সে বাড়ির ভাত আমার গলা দিয়ে নামবে কি করে! সারাদিন শুধু চাকরি, চাকরি, চাকরি… চাকরি না করে তো মরে যাচ্ছি না।”

কথাটা বলেই নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো ঈশান, দু-তিন কদম এগোতেই পিছন ফিরে তাকালো। যখন দেখলো কেউ তার কথাকে গুরুত্ব না দিয়ে চুপচাপ খাওয়ায় মনোযোগ দিয়েছে তখন নিজেই এসে নিজের আধখাওয়া প্লেটটার সামনে বসে পড়লো। বিড়বিড় করে বললো,

-“যে এখনো এ বাড়িতে আসে নি, যার খোঁজ এখন অবধি জানি না তার জন্য অভুক্ত থাকতে যাবো কেনো, আমি কি অতো বোকা নাকি!”

খাবার টেবিলে আরেক দফা হাসির দমকা বইলো, ঈশানটা পারেও বাবা। ওর মতো মানুষ কোনো পরিবারে থাকলে আলাদাভাবে বিনোদনের প্রয়োজন পড়ে না।

ক্যামেরার লেন্স মুছতে গিয়ে পিথিউশার হঠাৎ নিজেকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গর্দভ মনে হলো। তখন অতশীকে দেখে এভাবে দৌঁড়ে যাবার কি ছিলো? আর গেলোই যখন তখন ক্যামেরাটা গাড়ীতে কেনো ফেলে গেলো! অদ্ভুত, একজন প্রফেশনাল ফটো জার্নালিস্ট হয়ে সে এরূপ দৃশ্য ক্যামেরা বন্দি করতে পারলো না! বড্ড বেশি আফসোস হলো পিথিউশার, সঙ্গে নিজের প্রতি রাগও। কয়েক ঘন্টার মাঝে নিজ ব্যক্তিত্বের এ তুমুল পরিবর্তনে অবাক হলো পিথিউশা, বিড়বিড় করে বললো, “আল্লাহ, আমাকে ধৈর্য্য দাও।”

দরজায় কড়া নড়ার শব্দ হলো, একবার, দু’বার, তৃতীয়বারের সময় দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলেন মহসীনুল হক। পিথিউশা ওনাকে দেখেই দাঁড়িয়ে গেলো, এগিয়ে গিয়ে ওনার হাত ধরে বিছানায় বসালো। মহসীনুল হক হালকা কেশে পিথিউশাকে ইশারায় বসতে বললেন। পিথিউশা তার পাশে না বসে পায়ের সামনে বসে পড়লো, কাঁপা কাঁপা হাতে উনি পিথিউশার কোঁকড়া চুলগুলোতে হাত রাখলেন, হাত বুলিয়ে আলতো করে ছুঁয়ে দিলেন ওর চোখ, কপাল, নাক, গাল। তারপর স্বাভাবিক অথচ বড্ড গম্ভীরস্বরে বললেন,

-“তুমি সত্যি একটা মডেলের প্রেমে পড়েছো পিথিউশা?”

পিথিউশা বরাবরই স্পষ্টভাষী, অথচ এ মুহূর্তে তার গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। নিজের মাঝে কেমন আড়ষ্টতা কাজ করছে, বুকের বাঁ পাশে হৃদস্পন্দন ঘোড়ার বেগে ছুটছে… পিথিউশা হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো, এ মানুষটার সামনে আর দু’দন্ড বসে থাকলে নিশ্চিত পিথিউশার পরিবর্তন তার দৃষ্টিগোচর হয়ে যাবে। জানলার সামনে দাঁড়িয়ে বাইরে দৃষ্টি স্থীর করলো পিথিউশা, বিড়বিড় করে বললো, “প্রেম! প্রথম দেখায় প্রেম হয়! এ প্রেম কি স্থায়ী? নাকি কেবলই ক্ষণিকের ভ্রম?” পিথিউশাকে বিড়বিড় করতে দেখে দাদু বললেন,

-“পিথিউশা, তুমি বরাবরই আমার প্রিয়। তোমাকে আমি ধৈর্য্য ধরে ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে শিখিয়েছি। তুমি বাস্তবতা বোঝো, মানুষ চেনো। আশা করি তুমি কোনো মোহে জড়াবে না। নিজেকে সময় দাও, নিজের জন্য যা উত্তম তা চিহ্নিত করো। তারপর চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নাও।”

এ পর্যায়ে পিথিউশার ফর্সা মুখটায় রক্তিম আভা দেখা দিলো, জানলার বাহিরে দৃষ্টি স্থীর রেখেই বললো,

-“আপনি কিছু ভাববেন না দাদু। আসলে ঈশান ছেলেমানুষ, তাই তিলকে তাল বানিয়ে দিয়েছে। প্রেম ট্রেম কিছু না, ক্ষণিকের ভালোলাগা বলতে পারেন।”

কথাটা বলে হাসার চেষ্টা করলো পিথিউশা, তার হঠাৎ মনে হলো এ হাসিটা প্রাকৃতিক নয়, জোরপূর্বক… মহসীনুল হক এগিয়ে এসে পিথিউশার কাঁধ চাপড়ে বললেন,

-“মাঝে মাঝে ক্ষণিকের ভালোলাগা সারা জীবনের পথচলার ভিত্তি হয় পিথিউশা। অনেক তো কাজ করলে, এবার নিজেকে নিয়ে, নিজের ভবিষ্যত নিয়ে ভাবো। আমি তো সারাজীবন থাকবো না, তবে মৃত্যুর আগে তোমাকে সঠিক হাতে তুলে দিতে চাই। এমন কাউকে চাই, যে বাকি জীবনটা তোমাকে ভালোবেসে নিজের সঙ্গে বেঁধে রাখবে…”

পিথিউশা কিছু বলতে পারে না, কেবল অপলক এই বৃদ্ধ মানুষটার দিকে তাকিয়ে থাকে। মানুষটা তাকে কি ভীষণ ভালোবাসে! যে ভালোবাসায় কোনো খাদ নেই, স্বার্থ নেই, আছে কেবল সীমাহীন স্নেহ, ভালোবাসা… সত্যি কি কেউ এ মানুষটার মতো করে তাকে ভালোবাসতে পারবে? তার যত্ন করতে পারবে? মুচকি হাসে পিথিউশা, আকাশপানে তাকিয়ে তারা গুনতে গুনতে ভাবে, তার ভাগ্যটা নেহাত মন্দ নয়, এতো ভালো পরিবার ক’জনেরই বা হয়! হয়তো দাদুর কথা মতো সে’ও পেয়ে যাবে এমন কাউকে যে তাকে ভালোবাসার বন্ধনে বেঁধে ফেলবে আজীবনের জন্য।


অমিতের ডাকে লাফ দিয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠলো অরিত্রী, কোনোমতে নিজেকে সামলে জিজ্ঞেস করলো,

-“কি রে, মাঝ রাতে ডাকছিস কেনো?”
-“তুই আজ এতো জলদি শুয়ে পড়লি কেনো ছোটপু?”

আজ একটু দ্রুতই ঘুমিয়ে পড়েছিলো অরিত্রী, প্রচন্ড মাথা ধরেছে তার। এক হাতে মাথা চেপে ধরে বললো,

-“মাথা ধরেছে রে ভাই, তুই হঠাৎ ডাকলি কেনো? কিছু লাগবে তোর?”

অমিত গলার স্বর খাদে নামিয়ে বললো,

-“বড়পু আজকেও ড্রিংক করেছে, একটা দামী গাড়ীতে চড়ে বাড়ি ফিরেছে। গাড়ীর ড্রাইভার বড়পুকে বাড়ির গেইটের সামনে নামিয়ে দিয়ে গেছে। আমি একা বয়ে আনতে পারছি না, তাই তোকে…”

অমিতকে আর বলতে হলো না কিছু, অরিত্রী বুঝে গেছে সবটা। বিছানা থেকে নেমে চুলটা হাতখোপা করতে করতে বললো,

-“মা বা বাবাকে কিছু বলার প্রয়োজন নেই। এমনিতেই বাবার শরীরটা ভালো না, এসব জানলে আরো শরীর খারাপ করবে। চুপচাপ ঘরে এনে শুইয়ে দিলে সকালে দেখবি ঠিক হয়ে যাবে।”

অমিত মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানালো, দুই ভাই-বোন মিলে অতসীকে তার ঘরে নিয়ে শুইয়ে দিলো। ঘর থেকে বের হতে গিয়েও ফিরে এলো অরিত্রী। অতসী নেশার ঘোরে তখন থেকে কি যেনো বিড়বিড় করে যাচ্ছে, বুঝার জন্য অতসীর মুখের কাছে কান নামিয়ে আনলো অরিত্রী। তবে কিছু বুঝতে পারলো না, কেবল অতসীর চোখের কোন বেয়ে পড়া নোনাজলে তার হাত ভিজে গেলো। কি ভেবে আর নিজের ঘরে ফিরে গেলো না অরিত্রী, অতসীর শিয়রে বসে বাকি রাতটা কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলো।

ঘুম থেকে জেগে অরিত্রীকে নিজের মাথার কাছে বসে থাকতে দেখে মুচকি হাসে অতসী। সবাই তাকে বড় বললেও সে জানে, কিছু দিক দিয়ে অরিত্রী তার থেকে অনেক বেশি পরিপক্ক। এই যেমন আপনজনের যত্ন করার ব্যাপারে… অতসী কখনোই কারো যত্ন করতে পারে না, উল্টো অধৈর্য্য হয়ে পড়ে।

অতসীর মাথার কাছে বসে থাকতে থাকতে এক সময় চোখের পাতায় ঘুম ভর করেছিলো অরিত্রীর। অতসী উঠে অরিত্রীর গাল টেনে দেয়াতে ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো, মুচকি হেসে বললো,

-“শুভ সকাল, আপু।”

অতসী ঠাট্টা করে বললো,

-“সকাল আর শুভ হলো কই, সেই তো তোর মুখ দেখে ঘুম ভাঙ্গলো। এখন সারাদিন কাজ ফেলে না সমাজসেবা করতে হয়…!”

চেয়ারের ওপরে পড়ে থাকা তোয়ালেটা অতসীর দিকে এগিয়ে দিয়ে অরিত্রী বললো,

-“তা আর মন্দ কি? অনেক অনেক পূণ্য কামাবে আর অসহায়দের দোয়া পাবে। জানো তো, গরীবের দোয়া দ্রুত কবুল হয়।”
-“তুই যে এতো এতো দোয়া পাচ্ছিস সেখান থেকে কিঞ্চিত ভাগ আমাকে দিস, তবেই চলবে।”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here