শিউলিবেলা,পর্বঃ ১৪,১৫

শিউলিবেলা,পর্বঃ ১৪,১৫
খাদিজা আরুশি আরু
পর্বঃ ১৪

অরিত্রী কাঁদছে, এ মুহূর্তে পিথিউশার নিজেকে মাঝ সমুদ্রে পথ হারানো নাবিক মনে হচ্ছে। তার ভীষণ ইচ্ছে করছে অরিত্রীকে বুকে জড়িয়ে ধরে সান্তনা দিতে, বলতে, “আপনাকে অন্য কেউ ভালোবাসুক বা না বাসুক, আমি সারাজীবন আপনাকে ভালোবাসবো। আমার মনে কেবল আপনি রাজত্ব করবেন…” কিন্তু কিছুই বলা হলো না। অরিত্রী আবার প্রশ্ন করলো,

-“আমার দ্বিতীয় প্রেম কে শুনবেন? শুনবেন তার নামটা, যাকে মন উজাড় করে ভালোবাসা সত্ত্বেও ভালোবাসি বলতে পারছি না…”

বুকে হাজার মোন ওজনের পাথর চাপা দিয়ে পিথিউশা বহু কষ্টে বললো,

-“শুনবো।”
-“আমি যাকে ভালোবাসি, যে মানুষটা আমার বড়বোনের প্রেমে অন্ধ সে মানুষটা হলো আ…”

কথা শেষ করতে পারলো না অরিত্রী, তার আগেই মোবাইল বেজে উঠলো। মোবাইলের স্ক্রিনে অমিতের নাম দেখে থমকে গেল অরিত্রী, বুকের মধ্যে প্রথম যে চিন্তাটা এলো, “এসময় অমিতের ফোন! বাবার কিছু হয় নি তো?” কাঁপা হাতে ফোনটা রিসিভ করলো অরিত্রী। ফোনের ওপাশ থেকে অমিত কি বললো তা শুনতে পায় নি পিথিউশা, তবে অরিত্রীর ফ্যাকাশে চেহারা বলে দিচ্ছে, ওপাশের ব্যক্তিটি কোনো দুঃসংবাদই দিয়েছে। যন্ত্রমানবের ন্যায় উঠে দাঁড়ালো অরিত্রী, পিথিউশার চোখে চোখ রেখে গম্ভীরস্বরে বললো,

-“আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে, দয়া করে আপনি আমার সঙ্গে যেতে চাইবেন না। যদি কখনো সুযোগ হয় আমি আপনাকে সবটা বলবো, তবে এ মুহূর্তে আমার খুব কাছের মানুষের আমাকে ভীষণ প্রয়োজন।”

অরিত্রী দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যায়, পিথিউশাও কথা বাড়ায় না। ছাদের কার্ণিশ ঘেষে দাঁড়ায় সে, নিরব দর্শকের মতো অরিত্রীর চলে যাওয়া দেখে… তার কেনো যেনো মনে হচ্ছে, আজ যে মানুষটা অর্ধেক কথা বলে চলে গেলো, সে মানুষটা না ফেরার জন্য যাচ্ছে। সে আর কোনোদিনও ফিরবে না। ধীরে ধীরে পিথিউশার চোখ জ্বালা করতে লাগলো, চোখের কার্ণিশ বেয়ে দু’ফোটা নোনাজল গড়িয়ে পড়লো। “পুরুষ মানুষদের কাঁদতে নেই” নিজেকেই নিজে প্রবোদ দেয় পিথিউশা। অথচ সে জানে, আজকের না পাওয়া তার জীবনের সমস্ত না পাওয়াকে ছাপিয়ে গেছে… নিজেকে বড্ড বেশি একা মনে হয় পিথিউশার। মনে মনে সৃষ্টিকর্তার নিকট অভিযোগ জানায়, একজন একান্ত নিজের মানুষ পাবার অধিকারও কি তার নেই?

১৯
মুহূর্তেই ঘটনার পরিক্রমা ঘুরে যেতে পারে, কথাটার মাহাত্ম্য আজ খুব করে অনুভব করছে অরিত্রী। কতো ভেবে আজ সাহস করে পিথিউশাকে সবটা বলতে চেয়েছিলো, অথচ দিনের শেষটা হলো এক দুঃসংবাদ শুনে। সেট এ কাজ করার সময় উপর থেকে কাঁচ পড়ে গুরুতরভাবে আহত হয়েছে অতসী। সবচেয়ে ভয়ানক খবরটা অরিত্রী শুনেছে হাসপাতালে এসে। অতসীর শরীরের তেমন ক্ষতি না হলেও মুখের বেশ খানিকটা অংশ কেটে গেছে। ডাক্তারটা ইমিডিয়েট অপারেশন করেছে ঠিকই কিন্তু সুস্থ হয়ে যাবার পর দাগ থেকে যাবে বলে জানিয়েছেন। জ্ঞান ফেরার পর থেকে অতসী থম ধরে বসে আছে, কারো সঙ্গে কথা বলছে না। অরিত্রী সামনে যেতেই চিৎকার করে উঠলো, তারপর হাতের কাছে যা পাচ্ছিলো তা ছুঁড়তে ছুঁড়তে বলছিলো,

-“কেনো এসেছিস? মজা দেখতে? সবাই বলে আমি তোর থেকে সুন্দর, দেখ… আমার সৌন্দর্য্য আর নেই। আমার ক্যারিয়ার, আমার স্বপ্ন সব শেষ… কে কাজ দিবে আমাকে, বল, কে দিবে?”

অতসী পাগলপ্রায়, আজ তার আচরণে অরিত্রীর একটুও মন খারাপ হলো না। বোনের কাছে গিয়ে তাকে জাপটে ধরলো, মুহূর্তেই অতসীর সব রাগ গলে জল হয়ে গেলো। অঝর ধারায় কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতেই বসে পড়লো সে, অরিত্রীকে বললো,

-“তুই আমাকে ঘৃণা করিস তাই না? আমি কখনো তোর ক্ষতি চাই নি বিশ্বাস কর। নিজের বোনের ক্ষতি কেউ চায়? আমার শক্ত খোলসটা দেখে ঘৃণা করে গেলি? একটু ভেতরটা দেখলি না?”

অরিত্রীর কান্নার দমকে কথা আটকে আটকে আসছে, খুব কষ্টে ঠোঁট নাড়িয়ে সে বললো,

-“আমি তোরে ঘৃণা করি না আপু, আমার অভিমান হয়েছিলো। তোকে ঘৃণা করার প্রশ্নই আসে না। আমি তোকে ভীষণ ভালোবাসি আপু, বিশ্বাস কর…”

অতসী আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হলো, ও ঘুমিয়ে গেলে অরিত্রী কেবিনের বাহিরে বাবা-মায়ের কাছে গেলো। কিছুটা দূরে হাসপাতালের কার্নিশ ঘেষে অমিত দাঁড়িয়ে, অরিত্রীকে কেবিন থেকে বের হতে দেখে এগিয়ে এলে সে। অরিত্রী জানতো, বাবা-মা সন্তানের স্বার্থের জন্য সব করতে পারে। অরিত্রী কাছে আসতেই মিনতি রহমান বললেন,

-“অতসীর যে অবস্থা, ও তো চাইলেও আর ক্যামেরার সামনে যেতে পারবে না। ওর ক্যারিয়ার এখানেই শেষ… এ মুহূর্তে ওর যে জিনিসটা প্রয়োজন তা হলো মেন্টাল সাপোর্ট। আর এ মেন্টাল সাপোর্ট দিতে পারে কেবল একান্ত নিজের মানুষ। অরিত্রী, কিছু মনে করিস না। আমার কথাগুলো তোর কাছে স্বার্থপরের মতো মনে হতে পারে তাও বলছি। পিথিউশা অতসীকে ভালোবাসে, যদি তুই এখনো ওকে সত্যটা না বলে থাকিস তবে আর কোনোদিনও বলিস না মা। ওকে সেদিন যতোটুকু দেখেছি তাতে মনে হয়েছে, ছেলেটা ভীষণ ভালো। তাই আমরা চাই ছেলেটা জানুক, ও যাকে ভালোবাসে সে বরাবরই অতসী। অরিত্রী নামের কাউকে ও কোনোদিন না চিনুক। ও জানুক, ওর ভালোবাসার মানুষ আজ বিপদে আছে, অসহনীয় যন্ত্রনা সহ্য করছে। সারাজীবনের জন্য ও অতসীর ঢাল হয়ে পাশে থাকুক।”

অরিত্রী যেনো কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে, তার দৃষ্টিশূণ্য, মুখশ্রী ফ্যাকাশে। অমিত কিছু বলতে যাচ্ছিলো, তার আগেই আতিকুর রহমান বললেন,

-“সবসময় আমি অতসীর গুণের প্রশংসা করেছি, কোনো প্রয়োজনে সবার আগে ওকে বলেছি। আজ প্রথমবারের মতো অতসীর জন্য তোর কাছে কিছু চাইছি মা। তুই অতসীর সুখটুকু ওকে ভিক্ষে দে। তোর তো শারিরীক কোনো ত্রুটি নেই, শিক্ষাগত যোগ্যতাও আছে, তোকে আমরা চাইলেই ভালো ঘরে বিয়ে দিতে পারবো। অতসীর তো সব শেষ হয়ে গেছে। ওর একটা নিরাপদ ঘর পাবার সুযোগ আছে, সে সুযোগটা জেদ করে কেড়ে নিস না। পিথিউশাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা ভুলে যা অরিত্রী।”

বাবা-মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে ভুলে গেছে অরিত্রী। নিজেকে এতোটা অসহায় কোনোদিন বোধ হয় নি তার। বরাবরই তার বাবা-মা অতসী অন্তঃপ্রাণ, আজ সে বাবা-মা তার কাছে কিছু চেয়েছে, এ মানুষ দুটোকে ফেরানোর সাধ্য কি তার আছে! বাবা-মায়ের পায়ের সামনে বসে ছিলো সে, এবার সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালো, গম্ভীর অথচ শান্তস্বরে বললো,

-“আমি আমার আর আপুর দুজন ব্যক্তি হবার কথা পিথিউশাকে জানাতে পারি নি। তবে আমার বিশ্বাস আমার অস্তিত্ব টের পেলে পিথিউশা কখনোই আপুকে বিয়ে করবে না। তবুও আমি চেষ্টা করবো, পিথিউশা যেন আমার কথা না জানে, উনি যেন ধরে নেন আমি আর অতসী একই মানুষ।”

কথাটা বলে দ্রুত পায়ে হাসপাতালের বাহিরে চলে যায় অরিত্রী, পেছন পেছন ছুটে অমিত। ফুটপাতে বসে কাঁদছে অরিত্রী, অমিত পাশে গিয়ে বসতেই বললো,

-“একটা সাহায্য করবি ভাই?”
-“ছোটপু, তুই এ কাজটা করিস না। আমি তো, জানি তুই ভাইয়াটাকে কতো পছন্দ করিস।”

অরিত্রী তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,

-“শুনিস নি? আমার পছন্দের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ আপুর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা। আর তা পিথিউশার মতো মাটির মানুষের সান্নিধ্যেই সম্ভব।”
-“আর তুই?”
-“জানি না…”

চোখের জল মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে অরিত্রী, অমিতের হাতে নিজের ফোনটা ধরিয়ে দিয়ে বলে,

-“পিথিউশাকে ফোন করবি তুই, বলবি অতসী আপুর এক্সিডেন্ট হয়েছে। আপু হাসপাতালে… আমি দেখতে চাই, আপুর অসুস্থতার কথা শুনে উনি কিভাবে রিয়েক্ট করেন। আমি আপুর কাছে যাচ্ছি, আপুকে ছোট করে সব বুঝিয়ে বলতে হবে। আপু যেন কখনো আমার কথা ওনার সামনে না বলে তা’ও বলে দিতে হবে।”

কেবিনের ভেতর অতসীর সঙ্গে মিনতি রহমানকে দেখে অরিত্রী ম্লান হাসলো, অরিত্রীকে দেখে মিনতি রহমান বললেন,

-“আমি অতসীকে সবটা বুঝিয়ে দিয়েছি, ওর পিথিউশাকে বিয়ে করতে কোনো আপত্তি নেই। তবে একটা ঝামেলা আছে…”

অরিত্রীর মা সবসময়ই বাস্তববুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ, বিপদে মাথা ঠান্ডা রেখে সিদ্ধান্ত নিতে জানেন। তাই হয়তো অতসীকেও নিজের মতো বুঝিয়ে দিয়েছেন সবটা। অরিত্রী নির্বিকার ভঙিতে প্রশ্ন করলো,

-“কি ঝামেলা?”

চলবে…

শিউলিবেলা
খাদিজা আরুশি আরু
পর্বঃ ১৫

-“তোকে এ শহর ছাড়তে হবে। তুই পিথিউশার সামনে গেলে ও কখনোই অতসীকে বিয়ে করতে আগ্রহ দেখাবে না। কিছুক্ষণ আগে আমি তোর নানা-নানুর সঙ্গে কথা বলেছি, অতসীর বিয়ে পাকা হলেই তুই নানাবাড়ি চলে যাবি। তোর নানা সেখানকার হাইস্কুলে তোর চাকরির ব্যবস্থাও করে দেবেন। তারপর ওখানেই কাউকে দেখে-শুনে বিয়ে করে থিতু হবি। এদিকে তোর আসার প্রয়োজন নেই…”

কয়েক ঘন্টায় মা এতোসব ব্যবস্থা করে ফেললো! ভেবে পাচ্ছে না অরিত্রী, তার কি অবাক হওয়া উচিত? নাকি নিজের দুর্ভাগ্যের জন্য কান্না করা উচিত? নিরবে বের হয়ে গেলো সে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করে বললো, “এ শহরে আমার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে।”

২০
হাসপাতালের করিডোর দিয়ে দ্রুত পায়ে পিথিউশাকে উদভ্রান্তের মতো ছুটে আসতে দেখে আড়ালে দাঁড়ালো অরিত্রী। পিথিউশা অতসীর কেবিনে ঢুকতেই বেরিয়ে এলেন মিনতি রহমান। অতসীর একটা হাত নিজের হাতে নিয়ে পিথিউশা বললো,

-“একদম ভয় পাবেন না অতসী, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আছি তো…”

অতসীর ঠিক কি বলা উচিত সে বুঝতে পারছে না, এ মানুষটাকে সে কোনো একটা পার্টিতে একদিন দেখেছিলো। কিন্তু ক্লিয়ারলি কিছু মনে করতে পারছে না… মা বলেছে, এ মানুষটা তাকে বাড়িতে ফুল আর চিঠি পাঠিয়েছে। অরিত্রীর কাছে অবশ্য আগেও এ জাতীয় কিছু একটা শুনেছিলো সে, তবে আশ্রমের ব্যাপারটা আজই মায়ের মুখে প্রথম শুনলো। এ মুহূর্তে পিথিউশার দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকে ভরসা করতে ইচ্ছে করছে, মা বলেছে, অরিত্রীকে অতসী ভেবেই মনের কথা ব্যক্ত করেছে পিথিউশা। অতসী আলতো হাতে পিথিউশাকে জড়িয়ে ধরলো, তার বুকে মাথা রেখে হয়তো পিথিউশার ভালোবাসাকে পরখ করার চেষ্টা করলো। দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে সবটা দেখছিলো অরিত্রী, অতসীকে পিথিউশার বাহুডোরে দেখে নিরবে সরে এলো সে। দূর থেকে দেখলো, পিথিউশা মিনতি রহমান আর আতিকুর রহমানের সঙ্গে কোনো প্রসঙ্গে কথা বলছে। তারপর বিদায় জানিয়ে চলে গেলো… পিথিউশার প্রস্থানের পরই অরিত্রী মা-বাবার কাছে এগিয়ে যায়, অরিত্রীকে দেখে মিনতি রহমান বলেন,

-“পিথিউশা বলেছে, আগামী শুক্রবার ওর পরিবারের সবাইকে নিয়ে আমাদের বাসায় আসবে। বাগদানের কাজ সম্পন্ন করে বিয়ের দিন তারিখও পাকা করে যাবেন ওনারা…”

অরিত্রী মা-বাবার চেহারার আনন্দটা উপলব্ধি করতে পারছে কিন্তু উপভোগ করতে পারলো না। কি করে পারবে, সে যে তাদের খুশি করতে গিয়ে নিজের শেষ স্বপ্নটাও বিসর্জন দিয়েছে। মিনতি রহমান আবার বললেন,

-“তুই তাহলে বাসায় গিয়ে ব্যাগপত্র গুছিয়ে ফেল, কাল সকাল সকাল রওয়ানা দিয়ে দে। এ মুহূর্তে তোর এ শহরে থাকাটাও রিস্ক…”

অরিত্রী কিছু বললো না, নিরবে বেরিয়ে গেলো। বাড়ি গিয়ে লম্বা সময় নিয়ে গোসল করলো, ব্যাগ গুছালো। কাউকে কিছু না জানিয়ে রাতেই বেরিয়ে পড়লো নানাবাড়ির উদ্দেশ্যে। যাবার আগে স্কুলে রেজিগনেশন লেটার মেইল করে দিতেও ভুললো না। অমিতকে বাসস্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিছুটা অবাক হলো অরিত্রী, এগিয়ে এসে অরিত্রীর ব্যাগটা নিলো অমিত। শান্তস্বরে বললো,

-“তুই কাজটা ঠিক করছিস না ছোটপু। তোদের দুজনের অস্তিত্বের কথা জানার অধিকার পিথিউশা ভাইয়ার আছে। তোর কি মনে হয়, তুই চলে গেলেই সব সমাধান হয়ে যাবে? না আপু, মায়ের কথা শুনে বড়পু ভাবছে পিথিউশা ভাইয়া তাকে ভালোবাসে। অথচ কথাটা সম্পূর্ণভাবে সত্যি না। পিথিউশা ভাইয়া যে মানুষটাকে চিনেছে, যে মানুষটা তাকে কাছ থেকে দেখেছে সে বড়পু নয়। এখন কিংবা বিয়ের পর, একটা সময় পিথিউশা ভাইয়া পার্থক্যটা টের পাবে। তখন বড়পু বা ভাইয়া কেউই সুখী হবে না। তোর ত্যাগটারও কোনো গুরুত্ব থাকবে না, কারন যে ত্যাগের ফলে দুজন মানুষক আমরণ একটা সম্পর্কে বাঁধা পড়ে যায় সে ত্যাগ মূলত ভিত্তিহীন। মা-বাবা মিলে তোদের তিনজনের জীবন নষ্ট করছে, আর তাতে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করছিস তুই। ভিকটিম তুই না, ভিকটিম বড়পু আর পিথিউশা ভাইয়া। বড়পু সম্পূর্ণ সত্য জানে না আর ভাইয়া কিছুই জানে না।”

বাস চলে এসেছে, যাত্রীরা একে একে নিজেদের সিট খুঁজে নিচ্ছে। অরিত্রী অমিতের কথার প্রত্যুত্তরে কিছুই বলে না, কেবল ধীর পায়ে বাসের দিকে এগিয়ে যায়। কিছুদূর গিয়ে আবার ফিরে আসে, অমিতকে জড়িয়ে ধরে বলে,

-“মা-বাবার খেয়াল রাখিস, নিজে ভালো থাকিস। আপু যা জানে না তা আপুকে জানতে দিস না। পিথিউশাকে সত্যটা জানানোর প্রয়োজন নেই, ওনার ভাগ্যে থাকলে উনি নিশ্চয়ই একদিন সবটা জানবেন… আসছি।”

অমিত কিছু বলে না, অরিত্রী চলে যাচ্ছে। তার ছোটপু চলে যাচ্ছে… দূর থেকে দাঁড়িয়ে সে দৃশ্য নিরুপায়ের মতো দেখছে অমিত। মনে মনে চাইছে তার ছোটপু না যাক, আবার বড়পুর কথা ভেবে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। এমনটা কেনো হলো তার দু’বোনের সঙ্গে? সে ভাই হয়ে বোনদের জন্য কিছু করতে পারলো না কেনো? বিধাতা তাকে আজ এতোটা নিরুুপায় না করলেই কি পারতেন না!

২১
বহুদিন যাবত ঈশানের কোনো খোঁজ নেই দেখে কিছুটা অবাক হলো অতসী। তবে কি তার এক্সিডেন্টের কথা জেনে গেছে? মুখে দাগওয়ালা মেয়েকে নিজের ভাইয়ের বউ হিসেবে চায় না সে? হাজার প্রশ্ন অতসীর মাথায় গিজগিজ করছে, থাকতে না পেরে কল করলো নিজেই। দু’বার রিং হতেই ফোন রিসিভ করলো ঈশান, বললো,

-“কেমন আছেন ভাবী? বিয়ে করবেন না, করবেন না করে শেষমেশ আমার ভাইয়ের গলায়ই ঝুলে পড়লেন?”

কিছুটা অবাক হয়ে অতসী জিজ্ঞেস করলো,

-“আপনার ভাই?”
-“হুম, আমার ভাই। পিথিউশা হক… অভিনন্দন ভাবী। আপনাদের এংগেজমেন্টের দিন দেখা হচ্ছে।”

কথাটা বলেই কল কেটে দিলো ঈশান, স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলো অতসী। শেষমেশ কিনা ঈশানের ভাইয়ের সঙ্গেই তার গাট বেঁধে দিলো বিধাতা!

বাগদানের দিন অতসীকে পিথিউশার পাশে দেখে ঈশানের বুকের বা পাশে কিছু একটা সূঁচের মতো বিঁধছিলো। তাই ছাদে চুপচাপ চলে গিয়েছিলো সে… এক কানে ইয়ারফোন গুঁজে গান শুনছিলো ঈশান, সিঁড়িতে কারো পায়ের শব্দ শুনে একটু আড়ালে চলে গেলো সে। বড় ভাইয়ের বিয়ের দিন ছোট ভাইয়ের দূরে-দূরে থাকা নিশ্চয়ই অন্যরা ভালো চোখে দেখবে না। পিথিউশা আর অতসীকে দেখে আবারও বিষন্নতা এসে গ্রাস করলো ঈশানকে। অতসী পিথিউশাকে জড়িয়ে ধরেছে, পিথিউশার বুকে মুখ ঘষছে অনবরত। আজ সম্ভবত পূর্ণিমা, চাঁদের আলোয় দুজনকে দেখে যে কেউ রাজযোটক বলে মন্তব্য করতে ভুলবে না। কিন্তু ঈশানের অবচেতন মন এ দৃশ্য দেখে বিদ্রোহ করতে চাইছে, তার কিছু ভালো লাগছে না। বিনা শব্দে নিচে চলে গেলো ঈশান, এখানে আর এক মুহূর্ত থাকলে দম বন্ধ হয়ে যাবে তার। এতো মন পুঁড়ছে কেনো আজ?

অতসীকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালো পিথিউশা, অতসী আবারও এসে তাকে জড়িয়ে ধরলো। এবার অতসী একটা গুরুতর কাজ করলো, পিথিউশার পাঞ্জাবীর কলার ধরে তার পায়ের পাতায় দাঁড়ালো। পিথিউশাকে কাছে টেনে চুমু খেতে চাইলো… তড়িৎবেগে অতসীকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিলো পিথিউশা। তার দৃষ্টিতে অবিশ্বাসের ছায়া। পিথিউশা খুব কষ্টে গলা দিয়ে শব্দ বের করে বললো,

-“আপনাকে আজ এতো অচেনা লাগছে কেনো অতসী? আপনার মধ্যকার সংকোচ, লজ্জা, আড়ষ্টতা কিছুই পরিলক্ষিত হচ্ছে না। মনে হচ্ছে সম্পূর্ণ নতুন একজন মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমি। যে পুরুষের হাত আজ অবধি ধরলেন না, আজ তাকে চুমু দিতে যাচ্ছিলেন!”

ঘটনার আকষ্মিকতায় অতসী একদম চুপ হয়ে গেছে, তার হাত-পা কাঁপছে। হঠাৎ উচ্চশব্দে হাসতে শুরু করলো অতসী, হাসতে হাসতে কেঁদে ফেললো। ছাদের এক কোনে গুটিশুটি হয়ে বসে বললো,

-“অমিত ঠিক বলেছিলো, আপনি অরিত্রীকে ভালোবাসেন। আমাকে না…”

পিথিউশা পৃথিবী যেনো থমকে গেলো, অরিত্রী! অতসী, অরিত্রী দুজনেই কি এক মানুষ নয়? অতসী আবার বললো,

-“অরিত্রী আমার ছোট বোন, আমরা জমজ। দুজনে দেখতে একই হলেও অরিত্রী খুব সাধারণ জীবন যাপন করতো। আপনি এ বাড়িতে যে চিঠি আর শিউলি ফুল পাঠিয়েছিলেন তা অরিত্রী রাখতো, আমি না। আশ্রমেও আপনি অরিত্রীকে দেখেছিলেন, আমাকে না। আমার সঙ্গে আপনার মাত্র একবার দেখা হয়েছিলো, বৈশাখীর জন্মদিনের পার্টিতে… আপনি যাকে অতসী ভেবে ভালোবেসেছিলেন সে আসলে আমার ছোটবোন অরিত্রী ছিলো।”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here