মধ্যাহ্নে_মাস্টারমশাই (২য় খন্ড),১৫,১৬

#মধ্যাহ্নে_মাস্টারমশাই (২য় খন্ড),১৫,১৬
#মম_সাহা
পর্বঃ পনেরো

শুভ্র রাঙা মেঘ ভেসে যাচ্ছে আকাশ পথে। তাদের নির্দিষ্ট কোনো গন্তব্য নেই। যখন যেখানে ঠাঁই মেলে তখন সেখানেই থেকে যায়। তিস্তা’র জীবনে আজকে একটা নতুন ভোর,নতুন সকাল আর নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করার দিন।

গতকাল রাতে দাদী বারবার বলেছে তার নাকি সতীত্ব কেড়ে নিয়েছে, তাকে আটকে রাখা জানোয়ার গুলো। সে শত চেষ্টা করেও দাদীকে বুঝাতে পারে নি যে, তার সাথে খারাপ কিছুই হয় নি৷ দাদী ভেবেছে,সে হয়তো খারাপ জিনিসটা বুঝে না তাই তার সাথে যে খারাপ হয়েছে তা বুঝতে পারছে না।

কত রকমের নোংরা প্রশ্ন করেছে দাদী। তিস্তা শেষমেশ কেঁদে দিয়েছে ক্লান্ত হয়ে। তার সাথে কোনো নোংরামি হয়নি,অথচ দাদী মানতেই চাইছে না!

তনয়া বেগম তখন বুজেছিলো মেয়ের মনোভাব। শাশুড়ীকে তখন সে’ই এসব প্রশ্ন করতে বারণ করে। ছুটন্ত তিস্তা সামন্য মূর্ছে যায়। কী হচ্ছে তার সাথে! এসবের সাথে কোনো কালেই সে পরিচিত না। বাড়ির মানুষই তাকে বিশ্বাস করছে না। বাহিরের মানুষের সাথে কীভাবে লড়বে সে!

সকাল হতে না হতেই তিস্তা উঠে হাতমুখ ধুয়ে, স্নান করে নেয়। রোজকার মতন বাড়ির উঠানে এসে চুল শুকােচ্ছিলো। তনয়া বেগম তখন বাড়ির উঠোন ঝাড়ু দিচ্ছে। সকাল সকাল মেয়েকে স্নান করতে দেখে অবাক কণ্ঠে বললো,
-‘তুমি এত সকালে স্নান করলে যে!’

তিস্তা চুল মুছায় মনোনিবেশ করে বললো,
-‘এই রবিবার থেকে তো আমাদের মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু,আম্মা। পড়াশোনাও তো করতে হবে। তাই,বকুলগো বাড়িতে যাবো,কোনো পড়া দাগিয়ে দিছে না কিনা সেটা দেখে আসবো।’

তনয়া বেগমের হাতে থাকা ঝাড়ুটা পড়ে গেলো। মেয়েটা যদি এখন বাহিরে যায়, গ্রামবাসীর প্রতিক্রিয়া কেমন হবে! ওর দাদী’ই তো মানতে চাইছে না মেয়েটার মুখের কথা, গ্রামবাসী মানবে?

মানুষ বরাবরই অদ্ভুত প্রাণী। অন্য কারো খারাপটা শুনতে তারা মনে মনে পৈচাশিক আনন্দ পায়। ভালোটা যেনো মানতেই পারে না। খারাপটা শুনে আফসোস করার মতন মজার কাজ হাতছাড়া করতে চায় না তারা।

তনয়া বেগম মেয়েকে “না” করার আগেই মেয়ে ছুট লাগালো বকুলদের বাড়ি। তনয়া বেগমের ভয় হচ্ছে,মেয়েটা এখনও দুরন্তপনা করছে। কিন্তু হয়তো আর বেশিক্ষণ পারবে না এই দুরন্তপনা দেখাতে।

___

‘বকুল,ও বকুল, কোথায় তুই? একটু বাহিরে আয় তো।’

এমন চার-পাঁচ বার ডাকার পরও বকুল নামের মেয়েটি বাহিরে এলো না। আশ্চর্য! বকুল তো এক ডাকেই সদা হাজির থাকতো, তবে আজ কোনো আসছে না? এত জোড়ে ডাকার পরও ওরা ডাক শুনছে না কেনো?

তিস্তা বিরক্ত হলো। সেই কতক্ষণ যাবত ডেকে যাচ্ছে মেয়েটাকে, কিন্তু মেয়েটার কোনো খোঁজখবরই নেই?

তিস্তা আরেকবার ডাকার জন্য প্রস্তুতি নিতেই ঘর থেকে হুড়মুড় করে বেরিয়ে এলো বকুলের মা। তিস্তাকে দেখে তিনি যেনো সাত আসমান থেকে পড়লো। অবাক নয়নে, তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললো,
-‘এই, এই মেয়ে,তুই এ শরীর নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়েছিস কেনো? যা, যা তাড়াতাড়ি বাড়ি। গ্রামের ছেলেমানুষ বা অন্য কেউ দেখলে কী হবে! ছিহ্! যা বাড়ি যা।’

বকুলের মায়ের কথায় অবাক হলো তিস্তা। তাকে দেখলে কী এমন হবে, ভেবে পাচ্ছে না সে। বিষ্মিত কণ্ঠেই তিস্তা বললো,
-‘জেঠিমা,কী হবে আমায় দেখলে? এভাবে বলছো কেনো?’

বকুলের মা আরেকটু এগিয়ে এলেন তিস্তার দিকে। গলা ছেড়ে ভীষণ নাক মুখ কুঁচকে বললেন,
-‘কিরে,তোর কী লজ্জা শরম নেই? আবার জিজ্ঞেস করছিস কী হবে তোকে দেখলে! তোর বাড়ির মানুষের কী আক্কেল জ্ঞান নেই? তুই নাহয় কিছু বুজিস না, তারা তো বুঝে। কীভাবে একা ছাড়লো তোকে?’

তিস্তা যেনো অবাকের উপর অবাক হচ্ছে। বকুলের মায়ের কথার ধরণের সাথে কাল রাতের দাদীর কথার ধরণের মিল পাচ্ছে সে। তবে কী বকুলের মাও ভাবছে, তার সতীত্ব নেই?

তিস্তার অবুঝ মাথায় বকুলের মায়ের অহেতুক আচরণের কারণটা বোধগম্য হলো। সে ব্যাতিব্যস্ত কণ্ঠে বকুলের মায়ের ভুল ধারণাটা ভাঙাতে বললো,
-‘না না জেঠিমা, তুমি বোধহয় ভুল ভাবছো। আমার সাথে ওরা কিছু করে নি। কোনো নোংরামি করে নি, বিশ্বাস করো।’

তিস্তার এহেন কথায় বকুলের মায়ের মনোভাব আরও গাঢ়ো হলো। মেয়েটা কী এখানে শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে এলো? ধূর,এ মেয়ের সাথে কথা বলতেও রুচিতে বাঁধছে। না, না, বকুলকে ওর সাথে মিশতে দেওয়া যাবে না।

ভদ্র মহিলা তিস্তার থেকে মুখ ফিরিয়ে ঘরে যেতে যেতে বললো,
-‘তোর সাথে কী হয়েছে না হয়েছে তা আমার ভালো করেই জানা। একদম বকুলের ধারে কাছে ঘেষবি না। ভ্রমরী তারপর আরেকটা মেয়ে, কী জেনো নাম খানা? ওদের তুলে নিয়ে মেরেই ফেললো, আর তুই বলছিস তোকে কিছু করেনি। আমরা কী এতই অবুঝ? যা দেখি,তোর বাড়ি যা। তোর সাথে মিশলে আমার মেয়েটার আর ভালো সম্বন্ধ পাবো না। আর কয়েকদিনের মাঝেই বিয়ে দিয়ে দিবো ওরে। বিয়ের সময় হয়ে গেলে মেয়েছেলে ঘরে রাখাও এখন যন্ত্রণা। পরে পাপ হয়ে যাবে। যা,বাড়ি যা। আমার মেয়ের সাথে আর কোনোদিনও দেখা করবি না। যা।’

তিস্তা হতবাক! চেনা মানুষের,চেনা ব্যবহার, আজ যেনো বড্ড অচেনা। তার মুখের কথা কেউ বিশ্বাসই করছে না? দোষ না করেও আজ সে কেনো কাঠগড়ায় দাঁড়াচ্ছে! কিসের শাস্তি পাওয়া শুরু হলো তবে!

তিস্তার বুকে চাঁপা ব্যাথা অনুভব হয়। এই জেঠিমা’ই তো কত আদর করে মাঝে মাঝে তাকে খাইয়ে দিয়েছিলো! এই জেঠিমা’ই তো কত আদর করে গাছের কাচা আম মাখিয়ে দিয়ে ছিলো! তবে আজ তার বিরাট পরিবর্তন কেনো?

তবে কী সেই আধাঁর ঘরের পাঁচদিন, তিস্তার পুরো জীবনটাকে আধাঁর করে দিবে!

তিস্তার হাঁটার শক্তি যেনো লোপ পায়। বকুল,বকুলও কী তবে আর তিস্তার সাথে খেলবে না?

যেই উচ্ছ্বাস নিয়ে ছুটে এসেছিলো তিস্তা,সে উচ্ছ্বাস হঠাৎ করেই বিষন্নতায় রূপ লাভ করলো। মিইয়ে গেলো তার ফুটন্ত চঞ্চলতা। ধীর পায়ে সে বকুলদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। এখন তার লজ্জা লাগছে, ভীষণ লজ্জা৷ সে কী নোংরা মুখ সবাইকে ঢেং ঢেং করে দেখাতে বেরিয়েছে! রাস্তার সবাই তবে তার দিকে তাকিয়ে আছে কেনো?

সবার অদ্ভুত চোখের দৃষ্টি দেখে মিইয়ে যায়, তিস্তা। চোখ মুখ খিঁচে ছুট লাগায় বাড়ির উদ্দেশ্যে। সবাই কেমন বদলে গেলো, পাঁচ দিনের বিবর্তনে! তাকে দেখে সবাই কানাকানি করে কী যেনো বলে। সে কী এতটাই নোংরা হয়ে গেলো?

পাহাড় সমান অবিশ্বাস্য কাহিনী কুড়িয়ে বাড়ির দিকে ছুটে যাচ্ছে তিস্তা। এখন সত্যিই মনে হচ্ছে,তার বাহিরে বের হওয়াটাই ভুল ছিলো।

___

বাড়ির উঠোনে পা রাখতেই থমকে যায় তিস্তা। এতদিন পর তাদের বাড়িতে কাকে দেখছে সে! তার আপা এসেছে!

কত দিন পর আপা এলো। আপাকে দেখে তিস্তার মন খারাপের আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেলো। পথ থেকে যে বিষাদ কুড়িয়ে এনেছিলো তা জেনো পথেই হারালো। বাহিরে মানুষ যা-ই বলুক, তার বাড়ির মানুষ তো তাকেই বিশ্বাস করে, ভালোবাসে।

এক আকাশ আনন্দ নিয়ে যখন তিস্তা তার আপার দিকে পা বাড়ায়,তখন ভেসে আসে আপার কিছু তিক্ত কথা। আপা ঘৃণিত মাখা কণ্ঠে বলছে,
-‘দেখেছো তো,আম্মা,তোমার এত অবুঝ মেয়ের শেষমেশ কী হলো! ও ই হয়তো কিছু ইশারা করেছে,তাই ওরে তুলে নিয়ে গেছে। কই,আমরা যে এত বড় হোলাম,আমাদের সাথে তো কেউ কিছু করলো না। তোমার মেয়ের বেলায় সব ব্যাটাছেলে খারাপ! সেদিন আমার স্বামীর উপরও কেমন আঙ্গুল তুলছিলা। এবার দেখো কে খারাপ।’

নিজের বড় মেয়ের এমন লাগামহীন কথায় ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকায় তনয়া বেগম। হুংকার ছেড়ে বলে,
-‘কে খারাপ তা ভালো করেই বুঝা যাচ্ছে। তুই এমন হবি জানলে, জন্মের পরই তোকে মেরে ফেলতাম। যাকে ছোটবেলা থেকে বড় করলি, মানুষ করলি,তাকে এসব বলতে লজ্জা করে না তোর? এ শিক্ষা পেলি? স্বামীর জন্য অন্ধই হয়ে গেছিস।’

আম্মার চেয়েও আপা দ্বিগুণ চেঁচিয়ে বললো,
-‘আমি অন্ধ হয়েছি না তোমরা? ঐ মেয়েকে এখনো কীভাবে বাঁচিয়ে রাখছো মানুষের কথা থেকে? নোংরা মেয়ে তোমার। একদম ঠিক হয়েছে ওর সাথে।’

তিস্তা যেনো ভাষা হারিয়ে ফেললো এসব শুনে। তারই আপন বোন,তাকে এসব বলছে! এসবও শোনার ছিলো? এতক্ষণ পথের মানুষের কথায় সে মূর্ছে গিয়েছিলো, আর এখন ক্ষত বিক্ষত হয়েছে। সে নোংরা মেয়ে! দুলাভাই ভালো,আর সে নোংরা! আপা কীভাবে বললো এসব?

তবে,আজ মেয়ে বলেই কী এত ঝঞ্জাট? মেয়ে হয়ে জন্মানোটা কী ছিলো অভিশাপ!

#চলবে

#মধ্যাহ্নে_মাস্টারমশাই (২য় খন্ড)
#মম_সাহা

পর্বঃ ষোলো

সপ্তাহ প্রায় মাঝের দিকে। এইতো আজ মঙ্গলবার। আর দু’দিন পর ঘরোয়া ভাবে হবে প্লাবনের বিয়ে। তারপর,তারপর প্লাবন আর তিস্তার দূরত্ব হবে ঐ মহাকাশের চেয়েও দূর পরিমাণ। কিন্তু মনের দূরত্ব! সেটা তো হবে না আদৌও।

প্লাবন কেবল পুতুলের ন্যায় হয়ে আছে। মাঝে মাঝে কিছু করার না থাকলে,চুপ থাকতে হয়। চুপ থেকে দেখে যেতে হয় ভাগ্যের খেলা। প্লাবনও আজ সে মন্ত্রে পথ চলছে। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস অব্দি তিস্তাকে নিজের করে পাওয়ার প্রার্থনা বুকে পুষে রেখে নাহয়, মরার আগে আরেকবার মরবে। যে মৃত্যু টা হবে বিয়ে নামক শব্দে,সম্পর্কে।

___

বিষাদিনী’র হাতে সেই গোপন মানুষের ছবিখানা, যাকে সে লুকিয়ে রেখেছে সবার আড়ালে, হৃদয় মাঝে।

রাজকীয় বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রিয় মানুষটিকে নিয়ে ভাবনা বিলাস করতে ব্যস্ত সে। ছবিখানায় খুব যত্নে হাত বুলিয়ে যায়। নিরন্তর চেয়ে থাকে সুপুরুষটির দিকে। চোখের পলক পড়ে না, শ্বাসও যেনো থেমে থাকে। মানুষটাই এমন! তাকে দেখেই যেনো পাড় করা যাবে জনম জনম। কিন্তু কী দুর্ভাগ্য, হায়! এ জনম’ই তো মানুষটা তার না৷ ভীষণ আফসোসের সমুদ্রে ডুবিয়ে মানুষটা আজ অন্য কারো।

বিষাদিনী অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকায় ছবিটির দিকে। যেনো মনে হচ্ছে মানুষটা তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। শুকিয়ে যাওয়া পাতা পায়ে পিষে গেলে যে মড়মড় শব্দখানা হয়,ঠিক তেমন শব্দে বিষাদিনী হাতে থাকা চুড়িখানা ভেঙে ফেললো। হাতেও সামান্য আঁচ লাগলো,ক্ষত হলো সেই ভাঙার জন্য। হোক ক্ষত। এর চেয়ে কত বড় ক্ষত পুষে রেখে, যত্নে বড় করছে হৃদয় মাঝে।

হৃদয় আঙিনার প্রেম নামক কলিটা হঠাৎ মূর্ছে গেলো। শুকিয়ে গেলো তার ডালপালা। বিষাদিনী প্রেমোফুলের এমন দশা দেখে তাচ্ছিল্য হাসে৷ নিদারুণ কষ্ট মাখা কণ্ঠে বলে,
-‘আপনার জন্য তৈরী হওয়া ভালোবাসাটা কখন যে আমার আফসোসে পরিণতি হলো, তা টেরই পেলাম না। আহা,আপনাকে না পেয়ে আমার হৃদয় মাঝে সে কী আর্তনাদ! মাঝে মাঝে ভীষণ করুণা হয় এই মৃত হৃদয়টা’র জন্য। সেধে সেধে ভালোবাসতে গিয়ে, কত যন্ত্রণা’ই না পেলো শেষমেশ।

আমার ভালোবাসা আমায় সুখের থেকে বিষাদ’ই বেশি দিয়েছি। আমার ভালোবাসা আজন্ম আফসোস হয়েই রইলো। আপনাকে ভালোবেসে কী নিষ্ঠুর ভাবেই না মেরে ফেললাম আমি,আমার প্রেম পায়রাকে।

আমার লিখে যেতে ইচ্ছে হয়, এক মহাকাব্য। যেখানে সাবধান বাণী হিসেবে থাকবে,”ভালোবাসা বারণ।” আমি চাই না, আমার মতন কেউ পুড়ুক। ভীষণ কষ্ট হয় যে।’

একটি বিষন্ন কন্যার আকুতি ভরা কণ্ঠের বিচ্ছেদের গল্প কেউ শুনে না। কেবল ছবির ভেতর থাকা মানুষটা নিরলস তাকিয়ে রয়। তবুও শান্তি, মানুষটা রক্তে-মাংসে না হোক তবুও তো আছে!

ছোট্ট শ্বাস ফেলে বিষাদিনী বাড়ির গেটের দিকে তাকাতেই একটু অবাক হয়। তার বাবা কোথায় যেনো বের হয়ে যাচ্ছে। এ আর নতুন কী! আজ এখানে,কাল ওখানে,এমন করেই নিজের পৈচাশিক সুখ খুঁজে নিচ্ছে সে।

নিজের ঘরখানায় আরেকজন মানুষের উপস্থিতি টের পায় বিষাদিনী। তাৎক্ষনাৎ এক মুহূর্ত ব্যয় না করেই ছবিটা লুকিয়ে ফেলে তার আঁচলে। কিছু মানুষ, কিছু ব্যাথা,কিছু বিষন্নতা গোপনে থাক। একান্তই নিজের থাকুক।

নিজের ছোট বোনকে এ সময়ে এখানে দেখে অবাক হলো সে। কণ্ঠে অবাকের রেশ ধরে রেখেই বললো,
-‘আরে বিলাসিনী যে! এখানে কেনো? কিছু প্রয়োজন বুঝি?’

আপুর প্রশ্নে ঠোঁট এলিয়ে হাসলো বিলাসিনী। কয়েক পা এগিয়ে এসে বড় বোনের মাথার গুছানো চুল গুলো গুছাতে গুছাতে বললো,
-‘তুমি সত্যিই চলে যাবে, আপুনি? থেকে গেলে হয় না?’

চুপ করে যায় বিষাদিনী। এই জীবনে কেবল এ মেয়েটাই তাকে থেকে যেতে বলেছে বলেই,সে থেকে গেছে। নাহয় কবেই এই পাপ মহল থেকে পালিয়ে যেতো।

বিষাদিনী কিছুক্ষণ মৌন থেকে বলে,
-‘থেকে গিয়ে কী হবে বিলাসিনী? আমার থেকে যাওয়াতে আদৌও কিছু আসে যায়?’

নব কিশোরী বিলাসিনী, উত্তর দেয় না। কী উত্তরই দিবে? সত্যিই আপুর থেকে যাওয়াতে কারোই কিছু আসে যায় না। তবুও ক্ষীণ স্বরে বললো,
-‘আমার যে বড্ড একা একা লাগবে। তুমি ছাড়া আমার থাকতে যে ভালো লাগে না আপুনি। মনে হয় কথা গুলো জমে জমে পেট ফুলে যাচ্ছে। তোমার অভাবে কথা
গুলো প্রকাশ করতে না পেরে বোধহয় মরেই যাবো।’

-‘কিছুই হবে না তোমার। আস্তে আস্তে অভ্যাস হয়ে যাবে, আমি বিহীন থাকার। একা থাকার অভ্যাস করো বিলাসিনী। এ পৃথিবীতে সব মানুষই তোমাকে কিছু মুহূর্তের জন্য আনন্দ দিবে,পাশে থাকবে। কিন্তু শেষ অব্দি জীবনের পথ পাড় করতে হয় একাই। মনে রেখো,সবাই থেকে যাওয়ার জন্য আসে না।’

বিলাসিনী ছোট হলেও খুব বুদ্ধিমতী। বিষাদিনী’র থেকে হাতে গুণে গুণে সাত-আট বছরের ছোট হবে। কিন্তু সব কিছু সে দ্রুত বুঝে যায়।

দু বোন যখন নিরবতায় আচ্ছন্ন, তখন বিষাদিনী’র হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে। দ্রুত বোনকে জিজ্ঞেস করে,
-‘তুমি যে ছেলেটাকে পছন্দ করতে তার কী খবর? জানিয়েছো সে কথা খানা? পত্র না দিবে বলেছিলে?’

-‘সে-ই আমাকে পত্র দিয়েছে, আপুনি।’

বিষাদিনী অবাক হয় বোনের সাধারণ কথায়। অন্যান্য সময় হলে বোন অতি উৎকণ্ঠায়, আনন্দে লাফালাফি করতো। তবে আজ এত নিশ্চুপ কেনো?

বোনের বয়স সবে পনেরো। কিন্তু সে একজনকে ভীষণ পছন্দ করে। ছেলেও খারাপ না। তাদের এলাকারই বড় বাড়ির ছেলে। পড়াশোনা জানা। বোন যখন সে ছেলের কথা বলতো, বিষাদিনী তখন খেয়াল করতো বোনের চকচক করা চোখ খানা।

তবে আজ সে চোখে উচ্ছ্বাস নেই। এত বড় খুশির খবরও বোনের উচ্ছ্বাস নেই কেনো?

অবাক কণ্ঠে বিষাদিনী বললো,
-‘চিঠি দিয়েছে! কবে? তুমি আমায় বললে না যে? আর তুমি নিশ্চয় ভীষণ খুশি?’

-‘বলি নি, কারণ এটা বলার মতন কিছু না। ভালোবাসা বলে কিছু নেই আপুনি। ভালোবাসলে পুড়তে হবে। সবাই পুড়ার ক্ষমতা নিয়ে আসে না। তুমি নাহয় নিজেকে সামলে নিতে পারছো অপূর্ণতায়, আমি পারবো না। ছেলে জাতটাই ভরসা নেই আমার। ভালোবাসলে যদি-লুকিয়ে কাঁদতে হয়,ছোট বাক্সে যত্ন করে ছবি আগলে রাখতে হয়, সে ছবিতে নিজের সুখ খুঁজে নিতে হয়, তবে এ ভালোবাসার প্রয়োজন নেই আপুনি।’

বিষাদিনী যেনো চমকের উপর চমক খায়। তবে কী তার বিষণ্ণতা কেউ বুঝলো!

__

আর কয়েকদিন পরই শুরু হবে তিস্তাদের মাধ্যমিক পরীক্ষা। কিন্তু তিস্তার কোনো হেলদোল নেই। গ্রামের লোক সাথে তার আপুর ও দাদীর পরিবর্তনে যেনো সে স্তম্ভিত।

মধুসখী’র রাজকীয় ঘাটে বসে আছে সে। দৃষ্টি তার মধুসখী’র জলে নিবদ্ধ। কী সুন্দর জল! দেখলেই শরীর জুড়িয়ে যায়। কিন্তু তিস্তার আজ জুড়াচ্ছে না। সে বার বার ভাবছে,হাজার বার ভাবছে, কী হচ্ছে তার সাথে? কেউ-ই তো তাকে বিশ্বাস করছে না, মাস্টারমশাই! সে বিশ্বাস করবে তো?

তিস্তার ভিতর থেকে কান্নারা ছিটকে আসছে। কিন্তু সে কাঁদবে না। সে জানে,মাস্টারমশাই তাকে কখনোই অবিশ্বাস করবে না। কিন্তু সমাজ? বাঁচতে দিবে!

তিস্তা মধুসখী’র জল স্পর্শ করে দারুণ একটা প্রতিজ্ঞা করলো। যদি মাস্টারমশাইও মুখ ফিরিয়ে নেয় তার থেকে, তবে সে এই মধুসখীতেই প্রাণ বিসর্জন দিবে। কিন্তু মাস্টারমশাই না আসা অব্দি সে বাঁচবে,লড়াই করে টিকে থাকবে। তার যে বাঁচার অনেক সখ।

‘এই এই আমাদের তিস্তা নদী না?’

গম্ভীর পুরুষালী কণ্ঠে ফিরে তাকালো তিস্তা। সামান্য চমকে উঠে দাঁড়ালো। বিষ্মিত কণ্ঠে বললো,
-‘হরপ্রসাদ দাদা! কবে এলে শহর থেকে?’

হরপ্রসাদ ঘাটের দুইটা সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে এলো। সরল সোজা মানুষটা তিস্তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
-‘ভালে আছিস,তিস্তা?’

তিস্তার হুট করেই কান্না এলো। গ্রামের মানুষ বা তার পরিবারের কেউ এখনো অব্দি এ প্রশ্নটা করে নি। সে ভালো আছে কি না এটার চেয়েও চাঞ্চল্যকর ঘটনা যে তাদের কাছে আছে।

হরপ্রসাদ সামান্য বিচলিত হলো। তড়িঘড়ি করে তিস্তার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বললো,
-‘কাঁদছিস কেনো বোকা মেয়ে?’
-‘তুমি আমায় দেখে হাসাহাসি করো নি হরপ্রসাদ দাদা। জানো,সবাই না আমার সাথে কেমন করে। কীভাবে যেনো তাকায়। আমার আপাও আমাকে অনেক খারাপ কথা বলেছে।’

হরপ্রসাদ তিস্তার মাথায় স্নেহের হাত বুলায়। অভিমানী মেয়ের সব অভিযোগ ঢেলে দেয় হরপ্রসাদের কাছে। তার এই একা মধুসখী’র ঘাটে,হরপ্রসাদ এর সাথে থাকতে ভয় করছে না বরং ভরসা মিলছে। কী অদ্ভুত তাই না! নিজের বোন জামাই ঘরের মানুষ হয়েও কেমন নরপিচাশ। আর হরপ্রসাদ কেউ নাহয়েও কত আপন।

তিস্তার কান্নার গতি যখন একটু কমলো,হরপ্রসাদ শান্ত স্বরে তখন বললো,
-‘জানিস তিস্তা, মাস্টারমশাই এর সাথে আমার দেখা হয়েছিলো শহরে কয়েকদিন আগে।’

তিস্তার ঝিমিয়ে আসা কান্নাটা পুরোপুরি থেমে গেলো। নিস্তব্ধ হলো পরিবেশ। উত্তেজিত কণ্ঠে সে বললো,
-‘সত্যি! মাস্টারমশাই কেমন আছে গো? কবে ফিরবে গ্রামে? আমার যে আর ভালো লাগে না। আমার কথা জিজ্ঞেস করে নি মাস্টারমশাই? নিশ্চয় অনেক জিজ্ঞেস করেছে তাই না?’

ছোট্ট মেয়েটার উৎফুল্লতা নষ্ট করতে মন চায় না হরপ্রসাদ এর। তবুও সত্যি জানাতে হবে। তাই খুবই ক্ষীণ স্বরে বললো,
-‘এই সপ্তাহের পরেই হয়তো ফিরবো। আর,তোর কথা জিজ্ঞেস করে নি উনি।’

তিস্তার রগরগে উৎফুল্লতা শান্ত হয়ে গেলো। তার কথা মাস্টারমশাই জিজ্ঞেস করে নি? এটাও সম্ভব!

নিজের অশান্ত মনকে স্বান্তনা দেওয়ার জন্য তিস্তা নরম কণ্ঠে হরপ্রসাদকে বললো,
-‘হয়তো চাচী’র প্রতি চিন্তার জন্য বলার সুযোগ পায় নি। যাক, মাস্টারমশাই তাড়াতাড়ি ফিরবো সেটাই অনেক।’

-‘মাস্টারমশাই কিন্তু একা ফিরবো না, তিস্তা।’

হরপ্রসাদ এর বাক্য টুকু বোধগম্য হলো না তিস্তার। মাস্টারমশাই একা ফিরবেন না মানে? ছোট্ট মস্তিষ্কের তখনো বোধগম্য হয় না কথাটুকু। অবুঝ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,
-‘একা না ফিরলে কার সাথে ফিরবো? শহর থেকে কেউ সাথে আসবো তাই না?’

হরপ্রসাদ চুপ থাকে। তার কণ্ঠনালী কাঁপছে। মেয়েটা কীভাবে সহ্য করবে কথা খানা? তবুও বলা উচিত। এখন থেকেই শক্ত হোক মেয়েটা।

নিজেকে ধাতস্থ করে হরপ্রসাদ সিঁড়ির কোণা থেকে উঠে দাঁড়ালো। যাওয়ার পথে পা বাড়িয়ে বললো,
-‘এই শুক্রবারই মাস্টারমশাই এর বিয়া। অনেক সুন্দর শহরের মাইয়ার সাথে। দেখতেও যেনো সাক্ষাৎ লক্ষী। হয়তো একবারে বউ নিয়াই ফিরবো। তুই সামলা নিজেরে তিস্তা। ভাগ্য তোরে অনেক ঘুরাইবো। তোর মাস্টারমশাই আর তোর নাই রে।’

হরপ্রসাদ দাঁড়ালো না আর এক মুহূর্ত। খুব তাড়াতাড়ি চলে গেলো জায়গা থেকে। সে হয়তো মেয়েটার ভেঙে যাওয়া টা সহ্য করতে পারবে না। তাই চলে গেছে।

হরপ্রসাদ এর কথাটা যেনো বিনা মেঘে বজ্রপাত এর মতন লাগলো। কতটা সময় লাগলো কথাটা বুঝার জন্যই। কিন্তু কথাটা যখন মস্তিষ্কের নিউরণ অব্দি পৌঁছালো তখন যেনো শরীর অসাড় হয়ে এলো। শ্বাসও কেমন বন্ধ হওয়ার উপক্রম।

মাস্টারমশাই বিয়ে করবে? আর দু’দিন পরই বিয়ে! মাস্টারমশাই আর তার না? মাস্টারমশাই বেইমানি করলো?

না না, মাস্টারমশাই কখনোই তিস্তাকে কষ্ট দিতে পারে না। কিন্তু হরপ্রসাদ’দা ও তো মিথ্যা বলবে না। শহুরে মেয়ের সাথ পেয়ে মাস্টারমশাই গ্রামের ছুটন্ত তিস্তাকে ভুলেই গেলো?

নতুন বউয়ের সাথে মাস্টারমশাইকে সহ্য কীভাবে করবে তিস্তা? তবে কী মধুসখী’র কোলেই বিসর্জিত হতে হবে তিস্তাকে?

হঠাৎ তিস্তার মাথা ঝিমঝিম করে উঠলো। একটু আগে করা প্রতিজ্ঞার কথা মনে পড়লো। সে তো মাস্টারমশাই এর জন্য বাঁচবে ভেবেছিলো। কিন্তু মৃত্যুর পথ তো মাস্টারমশাই দেখিয়ে দিলো। তবে কী আর মাস্টারমশাই কে দেখা হবে না?

তিস্তা এক পা একপা করে মধুসখী’র কোলে এগিয়ে গেলো। কাল হয়তো মধুসখী’র কোলে ভেসে উঠবে গ্রামের চঞ্চল মেয়েটার দেহ। কেউ হয়তো জানবে না, মেয়েটা ভালোবেসে মরেছে। কেউ জানবে না,সপ্তদশী’র সবটা জুড়েই বিচরণ করা মানুষটার কথা। একটা মেয়ে তুমুল বাঁচার সখ নিয়ে মৃত্যুকে বরণ করেছে, এ কথা সবার অজানাই থাকবে।

আচ্ছা, মাস্টারমশাই তিস্তার মৃত্যুর কথা শুনে কাঁদবে তো? নাকি নতুন বউ এর সৌন্দর্যে মত্ত রবে?

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here