মধ্যাহ্নে_মাস্টারমশাই (২য় খন্ড),১৭,১৮

#মধ্যাহ্নে_মাস্টারমশাই (২য় খন্ড),১৭,১৮
#মম_সাহা
পর্বঃ সতেরো

‘এই চিঠিটা তুই সত্যিই মাস্টারমশাই এর বাড়ি থেকে পেয়েছিস, বকুল?’

ঘর্মাক্ত মুখ খানা আরেকবার ওড়না দিয়ে মুছে বকুল উপর নিচ মাথা নাড়ালো। জোরে জোরে শ্বাস ফেলে হাঁপিয়ে উঠা কণ্ঠে বললো,
-‘হ্যাঁ রে বাবা,হ্যাঁ। মাস্টারমশাই এর পড়ার ঘরেই পেয়েছি।’

তিস্তা ছোট্ট চিরকুটটার গুটি গুটি অক্ষর গুলো আরও কয়েকবার পড়লো। চিরকুটটা’র লেখা গুলো কেমন একটা ঘেঁটে গেছে। হয়তো ভীষণ যত্নে লিখা চিরকুটখানা অযত্নে পড়ে ছিলো। ইশ,সে আগে কোনো দেখলো না? তবে লেখাগুলো ঘেঁটে গিয়েও মাস্টারমশাই এর আকুতি গুলোর ক্ষমতা একচুল পরিমাণও কমাতে পারে নি। বরং তা ভীষণ ভাবে ফুটে উঠেছে।

তিস্তা হাতের ভাঁজে থাকা চিরকুট টা আবারও পড়লো। এ নিয়ে কয়েক মিনিটের মাঝেই গুণে গুণে সাতবার পড়া হয়ে গেছে। প্রতিবারই সে প্রশ্ন করেছে এটা মাস্টারমশাই এর বাড়িতে সত্যিই পেয়েছে কিনা। আর বকুল প্রতিবারই বিরক্ত না হয়ে উত্তর দিয়ে গেছে।

কিন্তু এবার তিস্তা আর একই প্রশ্ন করলো না। বরং তার কৌতূহল অন্য দিকে গেলো। সে কপালে তিনটা ভাঁজ ফেলে বললো,
-‘কিন্তু তুই হঠাৎ মাস্টারমশাই এর বাড়ি গেলি কেনো? আর আমি তো সেদিন গিয়েছিলাম,তখন তো দেখলাম সব ঘর আটকানো। কেবল সদর দরজায় তালা দেয় নি। অবশ্য মাস্টারমশাই’র বাড়িতে কেউ চুরি,ডাকাতি করবেও না। পড়ার ঘরও বুঝি খোলা ছিলো? ইশ, আরেকটু ভালো করে দেখলেই হতো। সেদিনই পেয়ে যেতাম মন বশ করার ওষুধ।’

কথাটা বলেই চিরকুট খানায় আবার চোখ বুলালো তিস্তা। চেঁপে ধরলো নিজের সিক্ত শরীরের বক্ষ মাঝে। হৃদয়ে এখন আর তেমন জ্বালা পোড়া করছে না। কেবল শীতল অনুভব হচ্ছে।

বকুল বান্ধবী’র এমন কান্ড-কারখানা দেখে মিটমিট করে হাসলো। বান্ধবীর ঠান্ডায় ফ্যাকাসে হওয়া মুখটায় সযত্নে হাত বুলিয়ে বললো,
-‘শুনিস নি? মাস্টারমশাই’র বিয়ের খবর ছড়িয়ে পড়েছে গ্রামে। হরপ্রসাদ দাদা বলেছে। গ্রামের সবাই তো বেজায় খুশি। তাদের গ্রামে শহুরে বউ আসবে। আর এতদিনের অযত্নে নিশ্চয় মাস্টারমশাই এর বাড়ির উঠোনে শুকনো পাতার ভীড় জমিয়েছে। ধূলো পড়েছে দরজা-জানলায়। পিঁড়েটারও মাটি ক্ষয়েছে। নতুন করে আবার লেপে দিতে হবে ভালো মাটি দিয়ে। তাই সবার ভাবনা দেখে আমার মা-ই উৎফুল্ল হয়ে বললো আমিই সবটা পরিষ্কার করবো। আমি গেলাম পরিষ্কার করতে। তখন গিয়ে দেখি মাস্টারমশাই এর টেবিলের পাশে সমতল জায়গা টাই এ চিরকুট খানা। সব দরজা জানালা বন্ধ ছিলো বিধায় উড়ে যায় নি কোথাও।’

তিস্তা স্বস্তি পেলো। মাঝে মাঝে হিমশীতল বাতাস এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে তাকে। সে কিছুটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। মধুসখী’র টলমলে পানি ছুঁয়ে করা প্রতিজ্ঞা টা সে রাখতে পারে নি। ঐ যে,বাঁচার লোভ। আর সাঁতার জানা মানুষ কী কখনো নদীতে ডুবে মরতে পারে? তাও স্ব-ইচ্ছায়? তাই তিস্তাও পারে নি। তন্মধ্যেই, বকুল চিরকুট নিয়ে নদীর পাড়ে হাজির হয়।

তিস্তা টলমলে চোখে, শীতল কণ্ঠে বললো,
-‘তুই আমার সাথে কখনো কথা বলবি আমি ভাবি নি রে। আমি তো নষ্ট মেয়ে। নষ্ট মেয়েদের সাথে কথা বললে তুইও তো নষ্ট হয়ে যাবি। তাই না, বকুল?’

বকুল ভিজে শরীরে থাকা তিস্তাকে জড়িয়ে ধরলো। মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
-‘তুই তো নষ্ট না। নিজেকে এসব কেনো বলিস? তুই সব থেকে পবিত্র। একদম সদ্য ভোর কিংবা ফুটন্ত ফুলের মতন। আমার মা নিজেই জানে না তার আচরণের মানে। তাই তোর সাথে এমন আচরণ করেছে। সৃষ্টিকর্তার এমন সৃষ্টি কখনো নষ্ট হতে পারে?’

তিস্তা’র যেনো মনের ভেতর গড়া নিজের প্রতি ঘৃণার কার্তুজ ভেঙে গুড়িয়ে গেলো। কেটে গেলো দুই বান্ধবী’র নিরব কিছুটা সময়। প্রকৃতির বুকে আধাঁর করা সন্ধ্যা নামলো। তারা বাড়ির পথে রওনা হলো। তিস্তা পুরো ভেজা জামাটা এখন শুকিয়ে গেছে প্রায়।

বকুল তিস্তাকে তার বাড়ি অব্দি পৌঁছে দিলো। বাড়িতে প্রবেশ করার ঠিক আগ মুহূর্তে হঠাৎ বকুল ক্ষীণ স্বরে ডেকে উঠলো,
-‘তিস্তা।’

তিস্তা ফিরে তাকালো। প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
-‘বল?’

-‘মৃত্যু কী এতই সোজা? তোর বাবার এখনো তো সংসারে উপার্জন করার ক্ষমতা নেই। কেবল,নিজের কথা ভাবলে হবে? স্বার্থপর তো তুই ছিলি না। তবে আজ কেনো? ভালোবাসার জন্য? আমি যতদূর জানি,ভালোবাসা উদার করতে শেখায়। নিঃস্বার্থ ভাবে বাঁচায়। তবে তোর ভালোবাসা উল্টো শেখালো যে? নাকি ভুল শিখলি সব?’

তিস্তা চুপ থাকে। বকুল বুজে ফেলেছে তবে! আশেপাশে তখন ঝিঁঝিঁ পোঁকার ডাক শোনা যাচ্ছে। তিস্তা অর্ধ ভেজা ওড়নাটা জড়িয়ে নিয়ে মুচকি হেসে বললো,
-‘কই আর স্বার্থপর হলাম? ভালোবাসার কৃতিত্বে মরে গিয়েও তো বাঁচার আশা কুড়িয়ে আনলাম। সেটা দেখলি না?’

বকুল হাসে। সে আজ একটা মৃত হৃদয়ের মেয়েকে আবার বাঁচাতে পেরেছে বলে খুশি হয়। তিস্তার মাঝে সে নিজের স্বপ্ন পূরণ করার ইচ্ছে পোষণ করে। কঠোর বাস্তবতার কাছে তো,তার স্বপ্ন হেরে গেলো। অনেক পড়াশোনা করা যে আর হলো না। এই মেয়েটা অনেক পড়ুক। ভীষণ বড় কিছু হোক। ওর কলঙ্ক যেনো মুছে নেয় সাফল্য।

তিস্তা বিদায় নিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেলো। বকুল সরু রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গান ধরলো। কি ভীষণ মিষ্টি সে সুর। নিরব প্রকৃতি আরও নিরব হলো। সময় করলো মধুময়। বকুল মিহি স্বরে তখনো গেয়ে যাচ্ছে,

“প্রণয়ের শিখা আবার প্রাণে দিলো আশা
তুমি আমার প্রিয় বিষাদ,নীল ভালোবাসা,,

আমি হারায়ে খুঁজেছি পথ
নিরলস নিরন্তর,
তবুও নির্বাসিত প্রেম দিয়েছে
মরীচিকার বালুচর।

প্রণয়ের শিখা আবার প্রাণে দিলো আশা
তুমি আমার প্রিয় বিষাদ,নীল ভালোবাসা।”
~মম
___

আগামীকাল বিয়ে,কিন্তু বিয়ে বাড়ি হিসেবে কোনো জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন নেই বিষাদিনীদের বাড়িতে। তবে একটা ভিন্ন জিনিস আছে। আজ রাতে বিষাদিনী একা ঘুমায় নি। তার সাথে আজ বিলাসিনীও আছে।

বারান্দা থেকে একটা বিদেশী ফুলের ঘ্রাণ ভেসে আসছে। কিছু মাস আগেই বাবা আনিয়েছিলেন। বাবা তাকে সবই দিয়েছে, কিন্তু যেটা দেওয়ার সবচেয়ে বেশি দরকার ছিলো সেটা দেয় নি।

আকাশে বিশাল গোল চকচকে চাঁদ উঠেছে। বারান্দা তখন জোৎস্না বিলাস করতে ব্যস্ত। বারান্দায় জোৎস্নার আলো তে স্নান করছে নীল বিষাদে আচ্ছাদিত যুবতী।

চোখের কোণ থেকে টপটপ ধারায় অশ্রু ঝড়ে পড়ছে তার। ইশ,বিষাদ এত কষ্টের কেনো? ভালোবাসা অশ্রু ছাড়া আর কিছু দিলোই না তাকে। আহা! ভাগ্য তার বেলাতেই এত নিষ্ঠুর কেনো?

গলা ছেড়ে গান এলো তার। আরেকবার সে গেয়ে নিবে বিষাদমাখা সুরে। অপূর্ণতার তিক্ততা থেকে সে নিজেকে মুক্তি দিবে খুব শীগ্রই। এইতো,কাল হতে ভাগ্য না, সে রটবে নতুন এক উপন্যাস। যেখানে বিষাদিনীর কেবল বিষাদ না, অনুভূতির অন্যান্য বস্তু গুলোই থাকবে।

কণ্ঠে সুর এলো। গানের প্রথম লাইন গুলো সে গাইলো না বরং বেছে বেছে রবীন্দ্র সংগীতের মাঝের লাইনের বিষাদ। বেছে নিয়ে গলা ছেড়ে গাইলো,

“তুমি সুখো যদি নাহি পাও,
যাও সুখেরও সন্ধানে যাও
আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয়ও মাঝে,
আরও কিছু নাহি চাই গো…”

-‘এত উদারতা তোমায় কী দিলো আপুই? তাকে সুখের সন্ধানে পাঠাতে গিয়ে সারাজীবন অশ্রু বিসর্জনের পথ টুকু যে বেছে নিলে। কান্না বুঝি তোমার এত প্রিয়? জানো আপুই,আজ আমার মনে হয় – কারো সুখ কারো অশ্রু হয়ে ঝড়ে। এমন বিষাদ অশ্রু না আসুক। কিছু মানুষ সুখী না হোক।’

বিষাদিনীর ধ্যান ভাঙলো। সামন্য চমকে উঠলো। বিলাসিনী কথা গুলো বলেছে? ঘুমায় নি মেয়েটা এখনো? সে তো উঠে আসার সময় দেখে এসেছিলো মেয়েটা গভীর ঘুমে। তবে! মেয়েটা অভিনয় করছিলো?

বড় বোনকে চুপ থাকতে দেখে এগিয়ে গেলো বিলাসিনী। অসহায় কণ্ঠে বললো,
-‘কে সে দূর্ভাগা? যে এত বেশি ভালোবাসা পায়ে ঠেললো?’
-‘সে আমার বিষাদের আকাশ। লুকিয়ে রাখা অশ্রু। তারে আমি প্রকাশ করি কেমনে?’
-‘তাহলে বিয়েটা কেনো করছো? বিষাদ হৃদয়ে পুষে,কাউকে আবার নতুন করে ভালোবাসা যায়? তবে ঠকাচ্ছো কেনো তাকে?’

-‘আমি তো দিবানিশি অপ্রাপ্তির দহনে পুঁড়ি। তাই সবাইকেই তার আঁচ দিতে চাচ্ছি।’

বিলাসিনী কি উত্তর দিবে ভেবে পায় না। তার বোন তো স্বার্থপর না। তবে আজ কেনো? ভালোবাসার অপ্রাপ্তি বুঝি বদলে দেয় মানুষকে?

দুই বোনের নিরবতার মাঝে বাড়ির বড় লোহার গেট টা খোলার শব্দ হলো। বাড়িতে গাড়ি প্রবেশ করলো। দু বোনই দৃষ্টি দিলো সেখানে। মিনিট খানেক পেরুতেই গাড়ি থেকে বাবা নেমে এলো।

কোনো রকম ঢুলতে ঢুলতে বাড়ির ভেতর ঢুকলো। কাল যার মেয়ে বিয়ে, আজ সে মধ্য রজনীতে নেশা করে বাড়ি ফিরছে। এমন বাবার মেয়ে, কতই বা ভালো থাকবে? গাড়ির শব্দ বন্ধ হলো। আবার সব চুপ। গাড়ির সামনের লাইট টা বন্ধ হতেই আবার প্রাকৃতিক আলোয় আলোকিত হলো রাস্তা। চাঁদনী রাত তো। নিরব চারপাশ।

বিষাদিনীর ভিষণ দরকারী কথা মনে পড়লো। বোনকে যদি আর বলা না হয়? এখনেই বলে ফেলা উচিত।

যেমন ভাবনা তেমন কাজ। বোনের হাতটা টেনে সামনে দাঁড় করালো। চুল গুলো কানের পিছে গুঁজে দিয়ে বললো,
-‘ভালো থেকো। জীবন একটাই। একটা জীবন খারাপ থেকে কাটাবে কেনো? ভালো থাকতে হবে তোমায়। নিজের ভালো থাকার দায়িত্ব কারো উপর দিবে না। নিজেকে নিজে ভালো রাখবে। বাবা-মা কি করছে,না করছে তা না দেখে ভালো থাকবে। বেঁচে থাকার জন্য ভালো থাকার প্রয়োজন। বিষাদ নিয়ে বেঁচে থাকা যায় না। মৃত মনের মানুষ বেঁচে থেকেও লাশ।’

কথা শেষ করেই ঘরে চলে যায় বিষাদিনী। চোখে তার অশ্রুকণা ছিলো। এ রাত তাকে যন্ত্রণা দেয় কেবল। ভালোবাসা এত তিক্ত কেনো?

____

আজ তিস্তাদের বাড়ির উঠানেও চাঁদের আলো পড়েছে। চাঁদের আলোয় মাস্টারমশাই এর ঘেটে যাওয়া লেখা গুলোকে স্পষ্ট করছে। সাথে প্রশান্তি দিচ্ছে তিস্তার মনে। ভালোবাসা এত মিষ্টি কেনো?

কী অদ্ভুত তাই না? একই রাত, একই শব্দ দু’জনকে দু’রকমের অনুভূতি দিচ্ছে। এমন ভাবেই তো মানুষ বেঁচে থাকে। কেউবা সুখে,কেউবা বিষাদ নিয়ে বুকে।
___

আজ গ্রামে বাজার বসবে। পুরো সপ্তাহের শুক্রবারই বেচাকেনা দারুণ চলে। তিস্তা সকাল বেলা উঠেই স্নান করে তৈরী হলো।

তনয়া বেগম মেয়েকে তৈরী হতে দেখে অবাক কন্ঠে বললো,
-‘কোথায় যাচ্ছো তুমি এত সকালে?’

তিস্তা ঝরঝরে ফকফকে উত্তর দিলো,
-‘আজ তো হাট বসবে। দোকানটা খুললে একটু বিক্রি ভালো হবে। তাই হাঁটে যাচ্ছি।’

তনয়া বেগম কিছুক্ষণ থ বনে রইলো। পেছন থেকে লতিকা বেগমের ভীষণ ঘৃণিত কণ্ঠে বলা কথা ভেসে এলো,
-‘ছেঃ মুখ পুড়িয়ে শান্তি মেলে নি? তোর মতন নোংরা মেয়ে দেখি নি। এত জ্বালা তোর? নোংরা মেয়েছেলেদের দলে নাম লেখা।’

তিস্তা থমকে যায়। এসব দাদী বলছে? হঠাৎ শরীরটা ঘিনঘিন করে উঠলো তার। মানুষ গুলো তাকে ভালো থাকতে দিবে না?

#চলবে

#মধ্যাহ্নে_মাস্টারমশাই (২য় খন্ড)
#মম_সাহা

পর্বঃ আঠারো

হাঁটে অন্যান্য দিনের তুলনায় আজ দ্বিগুণ মানুষ। “কন্যার সুখ” ভান্ডারের সামনে উপচে পড়া ভীড়। কারণ দোকানে বসে আছে সাদা রঙের থ্রি-পিস পড়া তিস্তা। হাতে তার মাধ্যমিকের ‘সাহিত্য কণিকা’ বই। বাংলা বলেই জানি যাকে। খুব মনযোগ দিয়ে পড়ছে বইটা। তার দোকানের সামনে যে অগণিত মানুষের ঢেউ, সেটা যেনো সে দেখেও দেখছে না।

মানুষ গুলো কী আর ভালো কাজে ভীড় জমিয়েছে? তারা তো কৌতূহল মিটানোর জন্য ভীড় জমিয়েছে। এদের দেখেও কী লাভ? ক্যাশ বাক্সে কী আর লক্ষী আসবে?

গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে তিস্তার লজ্জাহীন কাজের কথা। মানুষ তো অর্ধেকই আসছে কথা সত্যি কিনা সেটা যাচাই করে চক্ষু স্বার্থক করতে।

আর তো ভালো লাগে না। এত ভীড় করার কোনো মানে আছে? এগুলার কী খেয়ে কাজকর্ম নেই? নাকি তিস্তাকে এর আগে কখনো দেখে নি? আজব!

তিস্তার ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙলো। বইটা বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালো। ভীড়ের মাঝে তখন মানুষের কানাকানি চলছে। কেউবা বাজারের পন্যের মতন তিস্তাকে ক্রয় করা যায় কিনা সেই ছক কষতে ব্যস্ত।

হাতের বইটা শব্দ করে ক্যাশবাক্সের উপর রেখে উচ্চস্বরে বললো,
-‘কী সমস্যা আপনাদের? কী চাই এখানে? কিছু লাগলে নেন, নাহয় পথ ছাড়ুন।’

এবার যেনো মানুষ গুলো কথা বলার সুযোগ পেলো। বিশ্রী হেসে কয়েকজন বললো,
-‘এ দোকানে তোরেই খালি ভাল্লাগছে। তোরেই কিনতে চাই। ভরা বজারে, এ ব্যবসা করতে নামছোছ নাকি?’

তিস্তা ক্ষাণিকটা থমকে যায় কিন্তু দমে যায় না। সে তো তৈরী হয়েই এসেছে এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য। বাড়িতে যেভাবে ঘরের মানুষের সাথেই লড়ে আসলো, বাহিরে পারবে না?

দাদীর কুৎসিত কথা দাদীকেই ফিরিয়ে দিয়েছে। মাও আজ এই প্রথম দাদীর সাথে উচ্চস্বরে কথা বলেছে। দাদী চুপ হয়েছে। এখন চুপ হওয়ার পালা এদের।

তিস্তা একটু আগের কথাটা একদম গায়ে মাখে নি ভাব করে বললো,
-‘ওমা! মানুষ বুঝি বিক্রি করা যায়? তবে নাহয় তোমার ঘরের মা, বোন,বউ,মেয়েকেই আগে বিক্রি করো।’

ভীষণ সমাগম চুপ হয়ে যায়। কিছু মানুষ তো তাজ্জব বনে যায় তিস্তার হাবভাব দেখে। এ মেয়েটার এখনো এত তেজ?

যে লোকটা তিস্তাকে খারাপ কথা বলেছে সে-ই আবার তেড়ে এসে বললো,
-‘এই, এই, তোর মতন আমার ঘরের মাইয়া,বউ বেহায়া নাকি? না,বাজারের মেয়েছেলে? নষ্ট মেয়ে মানুষ। আবার আমার বাড়ির মেয়েছেলের সাথে নিজের তুলনা দেস? তোর কাছ থেইকা কেউ কিছু কিনবো না। মাইয়া মানুষ হইয়া গঞ্জের হাঁটে বহস আবার এত কথা।’

রীতিমতো মানুষ আরও বেশি জড়ো হয়ে গেলো। তিস্তা কণ্ঠে তেজ রেখে বললো,
-‘চাচা,মানুষ কথাটা তো সবার জন্যই প্রযোজ্য। ছেলে মেয়ে সবাই মানুষ। কিন্তু আমাদের সমাজ মানুষ শব্দটি কেবল ছেলেদের জন্যই ব্যবহার করে। আর মানুষ শব্দটির আগে খুব সন্তর্পণে “মেয়ে” নামক শব্দটি যোগ করে মানুষ নামক জাত থেকে আলাদা করে দেয় নারী জাতটাকে। কেবল “মেয়ে” নামক বিশেষণটি যোগ করে নারীদের চরম দুর্বল জাত হিসেবে প্রকাশ করে।

যদি আলাদা করতেই হয় তবে,পুরুষ জাতদের মানুষ শব্দটির আগে “ছেলে” বিশেষণটি কেনো যোগ করা হয় না?

তবে,মানুষ কী শুধুই পুরুষরা? নারী কেবল এক অসহায় জাত হয়েই থাকবে? নারীরা কখনো ঝলমলে চকচকে “মানুষ” হতে পারবে না? নারীরা কেবল মেয়ে মানুষ হয়েই থাকবে? বিশেষণটির এমন সৎ ব্যবহার বুঝি আমাদের সমাজের চেয়ে ভালো কেউ করতেই পারবে না।

আজ মেয়ে বলেই আমি সবটা সহ্য করার পরও দোষীর কাঠগড়ায়। ঘরে খাবার নেই চাচা, আজ পরিবারের মানুষের মুখে খাবার তুলে দিতে চেয়েছি মেয়ে হয়ে,সেটাই কী অপরাধ?

আমায় কিনবেন, চাচা? আপনার মেয়ের বয়সীই তো আমি। আমাকে এসব বলার আগে ওর কথা মাথায় এলো না? আমাদের মাঝে তো তফাত নেই।

নাকি আপনার ঘরের মেয়েরাই কেবল মেয়ে। আর,আমরা কোনো পণ্য?’

একদম চুপ পুরো জনসমুদ্রের ঢেউ। নিরব কথার বিস্ফোরণ যে সবার গহীনে কতটা স্পর্শ করেছে তা এ বিস্ফোরণ না দেখলে বুঝা’ই যেতো।

ভীড় ঠেলে নেপাল ঠাকুর তিস্তাদের দোকানের সামনে এলো। ভীষণ মমতাময় কণ্ঠে বললো,
-‘তিস্তা, আমারে আধা কেজি চিঁড়া দেও। সাথে এক খন্ড গুড়ও দিও।’

তিস্তার চোখে উপচে পড়া জল গুলো তিস্তা ঝড়তে দেয় নি। হাসিমুখে সে নেপাল ঠাকুরকে চিঁড়ে,গুড় দিলো। তার বিনিময়ে নেপাল ঠাকুর মূল্য পরিশোধ করলো।

আর কেউ দাঁড়ালো না দোকানের সামনে ভীড় করে। যে যার মতন নিজের গন্তব্যে পা বাড়ালো। নেপাল ঠাকুর প্রাণ ভরে তিস্তাকে আশীর্বাদ করলো। এই তিস্তা কী কেবল তিস্তা?

এ তিস্তার মাঝে আছে তার চঞ্চল ভ্রমরী,সব বাবা-মায়ের কন্যা।

নেপাল ঠাকুর যেতেই তিস্তা ছোট্ট শ্বাস ফেলে টুলটাতে বসে পড়লো। মনে পড়লো সকালের কথা। দাদী তাকে যখন বললো সে নোংরা মেয়ে ছেলের খাতায় যেনো নাম লেখায়,তখন তিস্তা হিংস্র বাঘিনীর ন্যায় ক্ষ্যাপে গেলো।

চোখ গুলো ঘৃণায় লাল হয়ে গেলো। একদলা থুতু উঠোনের মাঝে ফেলে বলেছিলো,
-‘তোমার কথার ধরণে আমার ঘৃণা হচ্ছে দাদী। তুমিও তো মেয়ে। নিজের নাতনীকে এমন কথা বলতে বিবেকে বাঁধলো না?’

দাদীও দ্বিগুণ রেগে গেলো। তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে বললো,
-‘তোর লগে কথা কইতে আবার বিবেক কিসের? ডুইবা মরতে পারোস নাই? নিলর্জ মেয়ে।’

এমন এক কথা দু কথায় দাদীর ভাষা শৈলী খারাপ হলো। অবশেষে দিক না পেয়ে তনয়া বেগম মেয়ের হয়ে কথা বলেন।

সকালের কথা ভাবতেই তিস্তার শরীরে আবার ঘিনঘিন ভাবটা জেগে উঠলো। কিছুক্ষণ মৌন থাকতেই মনে পড়লো আরও দরকারী একটা কথা। আজ তো মাস্টারমশাই এর বিয়ে। মানুষটা আর তার আছে তো?

___
‘বিয়েটা আমি করবো না, মা।’

কিছুক্ষণ পর যে ছেলের বিয়ে, সে ছেলের মুখে এমন কথা শুনেও আশ্চর্য হয় না আশালতা। মুখে আগের ন্যায় গাম্ভীর্যতা জড়িয়ে রেখেই বললো,
-‘এখানে তোমার অনুভূতির দাম আমি দিতে পারছি না।’
-‘কেনো,মা? আজ আমার চেয়েও আপনার জেদ বড় হলো?’

ছেলের প্রশ্নে ক্ষাণিকটা ব্যাথিত হলো আশালতা, কিন্তু প্রকাশ করলেন না বরং ক্ষীণ স্বরে বললেন,
-‘আমার জেদ না এটা। ধরতে পারো শেষ ইচ্ছে।’
-‘আপনার শেষ ইচ্ছে, আপনার ছেলের জীবনটা শেষ করতে পারে। তা জানেন তো?’

-‘কাউকে বাঁচাতে মাঝে মাঝে নিজে শেষ হলে ক্ষতি কী?’

মায়ের প্রশ্নে অবাক হলো প্লাবন। মা তো বেশ ছেলে ভক্ত। তবে আজ ছেলের শেষ হওয়াটাও মায়ের শরীরে লাগছে না?

ভাগ্য কী তবে, অন্য রকম খেলা খেলবে?

___

বিষাদিনী খুব যত্নে নিজের ব্যাগটা গুছিয়ে নিলো। এ বাড়িতে আজই তো তার শেষ দিন। এরপর সে চলবে সুখের ঠিকানায়। বিলাসিনী টা ভালো থাকতে পারবে তো?

অবশ্য বিলাসিনী খুব বুদ্ধিমান। সে নিজের ভালো থাকা খুঁজে নিবে। সবাই কী আর বিষাদিনীর মতন বিষাদ প্রেমী হয়?

___

গতকাল বিকেল অব্দি বাজারে ছিলো তিস্তা। বেচাকেনা খারাপ হয় নি। অনেকেই তার থেকে নিজেদের প্রয়োজনীয় জিনিস কিনেছে।

সন্ধ্যের পর ক্লান্ত হয়ে বাড়ি এসে ঘুমিয়ে গিয়েছিলো।

এখন ভোর। চারপাশে সদ্য আলো ফুটেছে। তিস্তা তখন বেঘোর ঘুমে।

তনয়া বেগম বাহির থেকে ছুটে এলেন। তিস্তাকে ধাক্কা দিয়ে ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে বললেন,
-‘তিস্তা,তাড়াতাড়ি উঠো। গ্রামে যে এক নতুন ঘটনা ঘটেছে।’

হঠাৎ ধাক্কায় ধড়ফড়িয়ে উঠে তিস্তা। ঘুমিয়ে থাকা মস্তিষ্কের বোধগম্য হয় না মায়ের আচরণ। ভীত কণ্ঠে সে বললো,
-‘কী হয়েছে,আম্মা?’

তনয়া বেগম শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের কোণের অশ্রু মুছলেন। অসহায় কণ্ঠে বললেন,
-‘তোমার মাস্টারমশাই যে গ্রামে আসছে। সাথে তার নতুন বউ।’

তিস্তা কিছুটা সময় নেয় কথাটা বোঝার জন্য। কথাটা মস্তিষ্ক অব্দি যেতেই বিদ্যুৎ খেলে যায় তার শরীরে। কেবল কানে আর মস্তিষ্কে একটা কথায় বাজছে, “মাস্টারমশাই গ্রামে ফিরেছে নতুন বউ নিয়ে।”

তিস্তা চুপ রয়। মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে বললো,
-‘তবে কী সব,
ছিলো মিছে কলরব?’

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here