মধ্যাহ্নে_মাস্টারমশাই (২য় খন্ড),২৫,২৬

#মধ্যাহ্নে_মাস্টারমশাই (২য় খন্ড),২৫,২৬
#মম_সাহা
পর্বঃ পঁচিশ

“কিগো,তিস্তা রানী’র যে বড্ড মন বেজার? পরীক্ষা কী অনেক খারাপ হলো?”

বিষাদিনী’র কথায় ধ্যান ভাঙে তিস্তা’র। মুচকি হেসে মাথা ডানে বামে ঘুরিয়ে বলে,
“নাহ্,পরীক্ষা তো মন খারাপ করার মতন হয় নি। পরীক্ষা অনেক ভালো হয়েছে।”

“তবে যে আজ বড্ড চুপচাপ?”

“তেমন কিছু না। তোমরা আড্ডা দেও। আমি তো শুনছি। মাস্টারমশাই এলে কিন্তু আর আড্ডা দিতে পারবে না।”

তিস্তা’র কথায় সবাই আবার আড্ডাতে মনযোগী হলো। মেতে উঠলো নতুন উন্মাদনায়। তবে এটাকে আড্ডা বলা যায় না। বিষাদিনী কথার ছলে যা-ই বলে, সবটা থেকেই বাংলা’র ঐতিহ্য বা সংস্কৃতি সম্পর্কে। কিছু না কিছু জানাই যায়।

সময়টা তখন পানসে,ক্লান্ত বিকেল। পাখিরা ফিরে এসেছে তার নীড়ে। সূর্য সারাদিন তার উত্তপ্ততা ছড়িয়ে এখন বাড়ি ফিরছে। চারপাশের আবহাওয়া টা থম মারা। যেন ঝড় হবে খুব।

তিস্তা’র মনেও চলছে উথাল-পাথাল ঝড়। বিবেকের তাড়নায় আর মনের পীড়ায় সে দিক ভ্রষ্ট। বিবেকের কথা শুনলে হৃদয়ের অভ্যন্তরে হবে র’ক্ত ক্ষরণ। আবার যদি হৃদয়ের কথা শুনে তবে বিবেকের কাছে হবে সবচেয়ে ঘৃণীয় মানুষ। কী করবে সে?

তিস্তা নিজের বই খাতা গুলো গুটিয়ে নিলো। উঠে দাঁড়ালো নিবিড় ভাবে। তিস্তার আকষ্মিক উঠে দাঁড়ানোতে আলোচনায় ভাঁটা পড়লো। কঙ্কণা অবাক কণ্ঠে বললো,
“কিরে, কোথায় যাচ্ছিস? মাস্টারমশাই পড়ানো শুরুই করলো না, আর তুই চলে যাচ্ছিস!”

তিস্তা উত্তর দিলো না। এর আগেই বাহিরের ঘর থেকে আশালতা বেগমের কণ্ঠ ভেসে এলো। সে কর্কশ গলায় বললো,
“আজ বোধহয় পড়াইবো না, বাবু। তারে একটু ঐ গ্রামের বাজারে পাঠিয়েছে। বিষাদিনী’র জন্য ভালো শাড়ি আনতে। কাল তো গ্রামে অনুষ্ঠান আছে, মধুসখী’র ঘাটে মেলা। আর তাছাড়া কয়দিন পর বউ হইবো,তখন তো কিনতেই হবে। তাই আগে আগে কিনে অভ্যাস করুক।”

আশালতা’র কথা থামলো। চুপ হয়ে গেলো আড্ডার আসর। নিজের মাঝে হাজার খানেক ভাবনা মাটিচাপা দিয়ে বিষাদিনী’র দিকে ধ্যান দিলো তিস্তা। মেয়েটা খুব সুন্দর। প্রাপ্তবয়স্ক আর খুব স্বাধীন চেতনার মেয়ে। এমন একটা মেয়েকে ফেরানো মাস্টারমশাই এর জীবনে সবচেয়ে বড় বোকামি ছাড়া আর কিছুই হবে না।

তিস্তা দাঁড়ালো না আর। বের হয়ে গেলো বিনা বাক্যে। পেছন থেকে কয়েকবার ডাকলো সবাই কিন্তু কোনো আশানুরূপ ফল পেলো না। তিস্তা সদর দরজা থেকে বের হয়ে যাওয়ার পরই একজনের মুখে দারুণ হাসির ঝিলিক দেখা দিলো।

_

প্রতি জৈষ্ঠ্যমাসে মধুসখী’র কোল ঘেষে দারুণ উৎসব উদযাপিত হয়। শোনা যায়, জমিদারের বিবাহ বার্ষিকী নাকি অনেক যুগ যাবত উদযাপিত হয়ে আসছে। জমিদার ভালোবাসা আর নিজের সম্পর্কের প্রতি ছিলেন খুব যত্নশীল আর শৌখিন। তিনিই সবসময় জৈষ্ঠ্য মাসের পঁচিশ তারিখ বড় করে একটি উৎসব উদযাপন করতেন। গ্রামের সব মানুষকে খাওয়াতেন, মেলা বসতো এখানে। সবাই ভরপুর আনন্দ করতো। তার স্ত্রী’র মুখের হাসিটা’ই ছিলো জমিদারের জন্য স্বর্গ। তাই এত আয়োজন। কালের গহব্বরে হারিয়ে গেছেন জমিদার ও তার শৌখিন সম্পর্ক। কিন্তু রয়ে গেছে সেই ধারাবাহিকতা।

তিস্তা মধুসখী’র সামনে দিয়ে হেঁটে আসছে। মন তার এখন আগের চেয়ে ভালো। কি সুন্দর রঙিন কাপড় দিয়ে সাজানো হচ্ছে নদীর আশপাশ। কি সুন্দর লাগছে! সজীব মধুসখী’র সাথে সাজটা যেন দারুণ মানিয়েছে। আগে এ অনুষ্ঠান হলেও মধুসখী তখন ছিলো মৃ’ত। দারুণ অনুষ্ঠান হলেও এমন সজীবতা এতদিন দেখা যায় নি। ভাবনার মাঝেই তিস্তাকে কেউ ডেকে উঠলো,

“এই তিস্তা, না পড়ে কোথায় যাচ্ছিস? আমি চলে এসেছি তো।”

তিস্তার মুগ্ধতা কেটে যায়। বহুল পরিচিত কণ্ঠে ধ্যান ভাঙে। অতি পরিচিত ভাবে ছলাৎ করে উঠে হৃদপিণ্ডটা। তিস্তার চিত্ত জানে এ ডাকের মানুষটা কে। তিস্তা নিজেকে ধাতস্থ করে। কঠিন হতে হবে তাকে। অনেক কঠিন। যতটা কঠিন হলে প্রিয় মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিবে, ঠিক ততটা কঠিন।

তিস্তা’কে চুপ থাকতে দেখে প্লাবন এগিয়ে এলো। হতাশ কণ্ঠে বললো,
“ফিরে যাচ্ছিস যে? আমি চলে এসেছি তো। চল এবার।”

“নাহ্, যাবো না। আপনি তো নাকি আজ আর পড়াবেন না। নতুন হবু বউয়ের জন্য শখ করে শাড়ি কিনতে গিয়েছেন।”

তিস্তার কাঠ কাঠ জবাবে সামান্য হকচকিয়ে যায় প্লাবন। আশেপাশে মানুষজনের দৃষ্টি অনুসরণ করে, কণ্ঠ সামান্য খাদে নামিয়ে বললো,
“কে বলেছে পড়াবো না? তোদের তো এখন পরীক্ষা চলছে। এখন না পড়ালে কখন পড়াবো?”

তিস্তা উত্তর দেয় না। থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকে। প্লাবন সামান্য নরম হয়। অসহায় কণ্ঠে বলে,
“এমন করছিস কেনো? আমি কী কোনো ভুল করেছি?”

প্রশ্নের পরিবর্তে কোনো উত্তর মিলে না। তিস্তা যেন কথা না বলার শপথ নিয়েছে। প্লাবণ কতক্ষন চুপ থেকে নিজের হাতে থাকা একটা প্যাকেট তিস্তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,

“তোমার ভীষণ অভিমানের পানসে রাগ হাওয়ায় মিলিয়ে যাক,স্রোতস্বিনী। আমরা আবারও উচ্ছ্বাসের সাথে উড়ে বেড়াবো, এই গ্রামের আনাচে-কানাচে। আর হ্যাঁ, আমি হবু বউয়ের জন্যই শাড়ি কিনতে গিয়েছিলাম। তুমিই তো আমার সবটার অধিকারীনি।”

তিস্তা থেমে যায়। কঠিন রাগের পাহাড় সামান্য গলে যায়। নিবিড় হয় রাগের তেজ। মাস্টারের আকুতি মাখা চাহুনির জন্য নিতে হয় যত্নের উপহার খানা। প্যাকেট টা হাতে নিয়েই গটগট পায়ে চলে যায় বাড়ির উদ্দেশ্যে। এখানে আর থাকা যাবে না। যে প্রেমিকের জন্য গ্রীষ্মের কঠিন উত্তাপ সাজিয়ে রাখা,তাকে কোমল গলে যাওয়া প্রেম দেওয়া যাবে না। বিবেকের কাছে ছোট কখনোই সে হবে না।

_

“বাহ্ তিস্তা! ডুমুর রাঙের শাড়িটা তো তোমায় বেশ মানিয়েছে! কখন কিনেছো?”

বিষাদিনী’র প্রশ্নে সামান্য হোঁচট খায় তিস্তা। আমতা-আমতা করে বলে,
“কাল কিনেছি। আজকে মেলা উপলক্ষে আরকি কেনা হলো।”

বকুল শব্দ করে হেসে উঠলো। ঠাট্টার স্বরে বললো,
“মনে হচ্ছে বিবাহ বার্ষিকী টা জমিদারের না। তোর।”

আরেকদফা লজ্জা পেলো তিস্তা। কোনোরকমে লজ্জা পাশে রেখে বললো,
“জমিদারের মতন এমন পা’গ’ল প্রেমিক পেলে নাহয় এ কথা টা মানা যেতো।”

এবার তিস্তার কথায় সায় জানালো বিষাদিনী। মধুসখী’র ঘাটে চার কন্যা বেশ রমরমা আড্ডা দিচ্ছে। কথার প্রেক্ষিতে কথা বাড়ে।

বিষাদিনী হঠাৎ বলে উঠলো,
“জমিদার আসলেই পা’গ’ল প্রেমিক ছিলো। নাহয় নিজের কষ্ট এভাবে কমাতেন?”

তিস্তা, বকুল আর কঙ্কণা অবাক হয় বিষাদিনীর কথায়। অবাক কণ্ঠে বলে,
“নিজের কষ্ঠ কীভাবে কমাতেন?”

“আচ্ছা, সেটা পড়ে বলবো।আগে বলো, তোমাদের কী মনে হয়? জমিদার তার স্ত্রীকে কতটুকু ভালোবাসতেন?”

“আকাশের চেয়েও বেশি পরিমাণ। হিসেব করা সম্ভব না।

তিন কিশোরীর ঝটপট উত্তর। তাদের উত্তর শুনে বিষাদিনী বেশ উচ্চ স্বরে হেসে উঠে। প্রায় কতক্ষন হেসে ক্লান্ত হয়ে অবশেষে বললো,
“যদি আমি বলি,জমিদারের বউ নিজে পড়ে গিয়ে মা’রা যায় নি। তাকে মে’রে ফেলা হয়েছে। তখন তোমাদের অনুভূতি কেমন হবে!”

#চলবে

#মধ্যাহ্নে_মাস্টারমশাই (২য় খন্ড)
#মম_সাহা

পর্বঃ ছাব্বিশ

“বিয়ে করবেন আমায়, বিষাদিনী?”

বিষাদিনী ক্ষাণিকটা চমকালো,থমকালো। ভীড়ের মাঝে ভুল শুনেছে ভেবে কপাল কুঁচকালো। বিস্ফোরিত কণ্ঠে বললো,
“জ্বি? বুঝি নি। কী বলেছেন?”

মাহিন আবার সামান্য শ্বাস নিলো। তাকে উত্তেজিত দেখাচ্ছে। সামান্য ঘামছে। উত্তেজনায় নাকি অতিরিক্ত চিন্তায় তা বুঝা যাচ্ছে না। বিষাদিনী উত্তরের আশায় নিষ্পলক চেয়ে রইলো। কিছুটা সময় দু’জনের মাঝে নিরব ভাবে অতিবাহিত হলো। মাহিন সঞ্চয় করলো নতুন উদ্যম। আবার বললো,
“বিয়ে করবেন আমায়?”

এবারের প্রশ্ন বিষাদিনী’র কান হতে মস্তিষ্ক অব্দি পৌঁছাতে পেরেছে। এবার আর হকচকিয়ে যায় নি সে। বরং স্বাভাবিক রইলো। তারা দাঁড়িয়ে আছে মধুসখী’র ঘাটের ঠিক পেছনের বটগাছটার দিকে। এখানে মানুষজন কম। মাহিন হঠাৎ তাকে ডাক দিয়ে এখানে এনেছিলো জরুরী তলবে। কিন্তু জরুরী কথা টা যে এটা হবে, বিষাদিনী বুঝে নি।

বিষাদিনীকে চুপ থাকতে দেখে মাহিন অধৈর্য হয়ে গেলো। উৎকণ্ঠা নিয়ে চেয়ে রইলো বিষাদিনী’র পানে। বিষাদিনী ক্ষাণিক সময় নিলো। ধাতস্থ করলো নিজেকে। পরক্ষণেই প্রশ্নের তীর ছুঁড়ে মারলো,

“বিয়ে করবেন আমাকে? কিন্তু কেনো?”

“আমি জানিনা। সেদিন আপনাকে মধ্যাহ্নে দেখার পর আমার আর কিছু দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে না। আপনি বিহীন সবটাই রঙহীন মনে হয়। এ কয়েকটা দিন কেবল আপনার চিন্তায় মগ্ন থেকেছি। আপনাকে আমার চাই।”

“কিন্তু আপনাকে আমার চাই না।”

বিষাদিনী কঠোর জবাবে থম মেরে যায় মাহিন। অসহায় কণ্ঠে বলে,
“কেনো? আমার অপরাধ কী?”

“আপনি আমাকে অনেক আগে থেকেই তো চিনতেন। তখন আমার জন্য আপনার কোনো অনুভূতি সৃষ্টি হলো না অথচ এখন এক দেখাতেই বিয়ে করতে ইচ্ছে হচ্ছে, ব্যাপারটা কেমন ঘোলাটে না?”

মাহিন চুপ করে থাকে। আসলেই তো! তার হঠাৎ এমন লাগছে কেনো? কিছুদিন আগ অব্দি যা স্বাভাবিক ছিলো আজ তা অন্যরকম লাগছে কেনো!

মাহিনের উত্তর না পেয়ে বাঁকা হাসে বিষাদিনী। ফিসফিসিয়ে বলে,
“তিস্তা তবে রুচি থেকে উঠে গেছে, ডাক্তার সাহেব?”

মাহিন এবার কিছুটা অপ্রস্তুত হলো। ঘাবড়ালো সামান্য। বিষাদিনী আর কিছু বললো না। বাঁকা আর রহস্যময় হাসি দিয়ে স্থান ত্যাগ করলো। এ গ্রামে ঘটা সকল রহস্যের সমাধান খুব শীগ্রই হবে।


তিস্তা’র আর মন বসছে মেলার মাঝে। বিষাদিনী আপা কী বলে গেলো? জমিদারের অর্ধাঙ্গিনী’র মৃত্যু টা স্বাভাবিক না! তবে কী তাকে মে’রে ফেলা হয়েছে? জমিদারের এত প্রিয় মানুষটাকে কেউ মেরে ফেলবে আর জমিদার বুঝবেও না, এটা ভীষণ অদ্ভুত ঠেকছে তিস্তা’র কাছে। তিস্তার ভাবনার মাঝেই পেছন থেকে পরিচিত ডাক ভেসে এলো,

“তিস্তা?”

তিস্তা সাথে সাথেই ফিরে তাকালো। চোখে মুখে বিন্দু পরিমাণের উচ্ছ্বাস নেই। দৃষ্টি তার নিষ্প্রাণ। মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে বললো,
“বলুন, মাস্টারমশাই?”

“তুই আমার সাথে কথা কেনো বলছিস না?”

কী উত্তর দিবে মাস্টারমশাই’র প্রশ্নে! উত্তর দেওয়ার পথ যে বন্ধ। তবুও নিজেকে কঠোর করে বললো,
“এই যে কথা বলছি।”
“কথা ঘুরাচ্ছিস?”
“উদ্ভট প্রশ্ন করলে, কথা ঘুরাতেই হয়।”
“তুই নিজেও জানিস,আমি উদ্ভট প্রশ্ন করছি না। তাহলে কথা কেনো ঘুরাচ্ছিস? আমার সাথে কথা বলতে কেউ না করেছে?”

তিস্তার বুক কেঁপে উঠলো। মাস্টারমশাই কিছু আঁচ করতে পারলো না তো? কণ্ঠনালীর মাঝে শব্দ কণিকারা আটকে গেলো। তন্মধ্যেই পেছন থেকে বিষাদিনী বলে উঠলো,
“আপনার সাথে তিস্তা’র কিসের কথা,প্লাবন দা? দু’দিন পর আপনি আমার হবেন। পর মানুষের সাথে কিসের কথা?”

আবার,আবার তিস্তা ভেতর ভেতর ভেঙে গেলো। মাস্টারমশাইকে সে কখনোই পর মানুষ ভাবতে পারবে না। তাহলে কেনো এখন ভাবতে হচ্ছে! সম্পর্কের সমীকরণ এত গড়মিল হয় কেনো?

প্লাবন কিছু বলার জন্য উদ্যোত হতেই পেছন থেকে হৈচৈ ভেসে এলো। ওরা তিনজনই দ্রুত পিছে তাকালো। তাকিয়ে ক্ষানিকটা চমকে গেলো। বকুলের মা বকুলের হাত ধরে টানছে আর কি যেন বলছে। দূর থেকে কথা অস্পষ্ট।

তৎক্ষনাৎ বিষাদিনী ছুট লাগালো। পিছে পিছে ছুটে গেলো প্লাবন আর তিস্তা।

বকুলের কাছাকাছি আসতেই বকুলের বিরক্ত ভরা কণ্ঠ ভেসে এলো। সে বেশ চেঁচিয়েই বলছে,
“আমি যাবো না বাড়ি। তোমরা আমাকে জোড় করে বিয়ে দিয়ে দিবে আমি জানি। আমি পড়াশোনা করতে চাই। আমি বড় মানুষ হতে চাই। দয়া করো মা।”

বকুলের কথার বিপরীতে তার মা বলে উঠলো,
“আমরা তোকে বিয়ে দিবো না, মা। চলে আয় আমাদের কাছে। তুই ছাড়া বাড়ি যে আমার শূণ্য। তুই যতটুকু ইচ্ছা পড়বি। আমরা আর আটকাবো না।”

“না মা, আমি যাবো না। আমি বিষাদিনী আপা’র কাছেই থাকবো।”

বকুল কোনোমতে মায়ের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বিষাদিনী’র দিকে ছুটে গেলো। বিষাদিনী আগলে নিলো বকুলকে। বকুলের মা আবার বকুলের কাছে আসতে নিলেই বিষাদিনী থামিয়ে দেয় তাকে। বেশ শান্ত স্বরে শুধায়,
“আপনি কী ওরে সাথে নিতে চান?”

বকুলের মায়ের তৎক্ষনাৎ উত্তর,
“হ,আমার মাইয়ারে আমি নিয়া যাবো।”

“তাহলে জোর করে নিতে পারবেন না। যদি আপনার মেয়ে আপনার সাথে যেতে চায়,তবেই নিবেন। কেমন?”

বকুলের মা চুপ করে থাকে। তারপর উদাসীন কণ্ঠে বলে,
“ও তো আমাদের সাথে যেতে চায় না।”

“সেটা তাহলে মা হিসেবে আপনার ব্যর্থতা। আপনার সন্তান এখন আপনার কাছেই নিরাপদ বোধ করছে না। বুঝুন এবার। যেখানে বাবা-মা হবে নিরাপদ আশ্রয়স্থল, সেখানে ভয়ের কারণ হচ্ছে বাবা-মা। ওদের বয়সটা টিনেজার বয়স বলা হয়। মানে বয়ঃসন্ধিকাল। এ সময় ওদের আবেগ,অনুভূতি কাজ করে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। তখন ওদের প্রয়োজন কোমল আচরণ। রুক্ষতা কখনোই টিনেজাররা মানতে পারে না। অনেকসময় তারা মানতে পারে না বলে নিজেদের মে’রে ফেলে। ওদেরকে ওদের মতন সময় দিন, সুযোগ দিন। ও যখন নিজেই আপনাদের অভাব বুঝবে তখন আর জোর করার প্রয়োজন হবে না। ও নিজ ইচ্ছায় আপনার কাছে যাবে। আর তো দুটো পরীক্ষা। দুটো দিন। তারপর আর বাঁধা নেই।”

বকুলের মা যেন শান্ত হলো,ক্ষান্ত হলো। আর জোর করলো না বরং টলমল অশ্রু চোখে নিয়ে রাজ্যের আকুতি মাখা কণ্ঠে বললো,
“ফিরে আসিছ, মা। তোর আশায় পথ চেয়ে থাকবো।”

বকুলের হঠাৎ কি যেন হলো। সে দাঁড়ালো না আর বিষাদিনীর সাথে। হুড়মুড় করে চলে গেলো মায়ের কাছে। বকুলের এই আচরণে কারো মনে কোনো দ্বিধা রইলো না। বিষাদিনী হাসলো। এই তো,সমাজের বদল শুরু হলো। নারীরাও এখন অধিকার পাবে সমান। একটু জেদ,সাহস,ধৈর্য থাকলেই নারীরা উচ্চস্বরে বলতে পারবে,”আমরা নারী,আমরাই সব পারি।”

“মেলা থেকে কী আনলি,উড়নচন্ডী?”

অনেক গুলো দিন,অনেক গুলো প্রহর পর এই নামটায় কেউ ডাকলো তিস্তাকে। তিস্তা ভীষণ খুশি হলো। ব্যাগ থেকে আপার জন্য কেনা কয়েক ডজন রেশমি চুরি এগিয়ে দিয়ে বললো,
“এই যে আপা,এত গুলা চুড়ি আনছি তোমার জন্য।”

আহ্লাদী হাসিমুখে চুড়ি গুলো হাতে নিলো। দু মুঠো চুড়ি হাতে পড়ে উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে বললো,
“দারুণ মানিয়েছে তো।”

তিস্তা বোনের আদল খানায় নিরলস চেয়ে রইলো। ছোট্ট শ্বাস ফেলে বললো,
“জানো আপা,বিষাদিনী আপা কি বলেছে!”

আহ্লাদী চুড়ি গুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে বললো,
“কী বলেছে ঐ শহুরে আপা?”
“তোমার আর জমিদারের মাঝে নাকি কোনো পার্থক্য নেই। তুমিও দুলাভাইকে অনেক ভালোবাসতে আর জমিদারও মধুসখী মানে নিজের স্ত্রী’কে অনেক ভালোবাসতো। জমিদারের স্ত্রী’র মৃত্যু নাকি স্বাভাবিক না। তবে কী দুলাভাই এর মৃত্যুও স্বাভাবিক না, আপা?”

আহ্লাদী’র হাসি থেমে যায়। সাথে সাথে ঘাম ছুটে শরীর থেকে। চারপাশ হাতরে নানান শব্দ খুঁজেও উত্তর দিতে পারে না সে। কী উত্তর দিলে বিশ্বাসযোগ্য হবে, ভেবে পায় না সে।

এখন প্রায় মধ্যরাত। বকুল তো ওদের বাড়িতেই চলে গেছে। কেবল কঙ্কণা শুয়ে আছে বিষাদিনী’র সাথে। শুয়ে আছে বললে ভুল হবে। ঘুমিয়ে আছে বলা যায়। বিষাদিনীর শরীরে প্লাবনের আনা টিয়ে রঙের শাড়িটা এখনো জড়ানো। হাতে লাল চুড়ি রিনঝিন শব্দ তুলছে।

চুড়ি গুলো হাতে রেখেই একটা কাগজ বের করলো টেবিলের ভেতর থেকে। গোটা গোটা অক্ষরে আধাঁর কালো রঙের দোয়াতের সাহায্যে লিখলো,
“আজ মনের রঙ খুইয়ে, তোমায় দিলাম বসন্ত,
তুমি বুঝলে না প্রিয়,আমার সকাল সন্ধ্যা তোমাতেই আসক্ত”

আবার ছিঁড়ে ফেললো কাগজটা। হাতের মাঝে মুঠো করে ধরে, মুচড়ে ফেলে দিলো জানালার বাহিরে। আজ আকাশে চাঁদ নেই। ঝড় হবে সম্ভবত। মাস্টারমশাই এর বাড়ির পিছে পাতা ভর্তি পুকুরটার দিকে তাকিয়ে আনমনেই সে বলে উঠলো,
“তোমার সময় হয়েছে মানুষ। পাতার পুকুরে লাশ হয়ে ভাসার। খুব শীগ্রই তুমি ভাসবে।”

আঁধার মাঝে পৈচাশিক হাসি দিয়ে কণ্ঠে গান করলো বিষাদিনী,

“কত প্রণয়, হারায় আঁধারে,,
যেমন করে শুকনো পাতা নির্বিঘ্নে ঝড়ে পড়ে,
কেউ বুঝে না রে,
কেউ খোঁজে না রে,,
কত প্রেম হারায় আঁধারে।

নিশি রাইতে হারায় চোখের পানি,
কেউ জানেনা কেবল আমি জানি,
আঁধার যে কত দামি,
কেউ বুঝে না রে
কেউ খুঁজে না রে,
কত প্রণয় হারায় আঁধারে।
মম

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here