#প্রেম_ফাল্গুন
#পর্ব_৩৫
#নিশাত_জাহান_নিশি
মাঝখানে কেটে গেলো দীর্ঘ ৪ বছর! দিন, সপ্তাহ, মাস, বছর কিছুরই হিসেব রাখা হয় নি লিলি এবং ববির! খরস্রোতা নদীর মতো সময় ও বয়ে গেছে উর্ধ্বগতিতে, কোনো বাঁধা, বিপত্তি বা পিছুটান ছাড়াই। সেই উত্তাল ঢেউয়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ববি এবং লিলির জীবনের প্রায় অনেক গুলো বছরই নির্দ্বিধায় অতিবাহিত হয়ে গেছে। তাদের বুঝা,পড়া, ভালো লাগা, ভালোবাসা, ছাড় দেওয়া, ত্যাগ করা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। একে অপরের প্রয়োজনের তুলনায় পরিপূরক হয়ে উঠেছে। একজন অন্যজনকে ছাড়া নিষ্প্রাণ, নিথর, নিরাগ এবং অসম্পূর্ণ।
লিলি এখন অনার্স ২য় বর্ষে পড়ছে। এইচ.এস.সি পরীক্ষায় গোল্ডেন A+ প্রাপ্ত হয়ে সে দুর্দান্ত পয়েন্ট নিয়ে সাভার ভার্সিটিতে একাউন্টিং ডিপার্টমেন্টে অধ্যয়নরত। ববি মাস্টার্স কমপ্লিট করে প্রায় এক বছর হলো সাভারের একটা সুনামধন্য প্রাইভেট ব্যাংকে ম্যানেজার পদে নিয়োজিত আছে। বেকারত্বের কালচক্র থেকে বেরিয়ে এসে সে নতুন উদ্দমে মাথা উঁচু করে বাঁচতে শুরু করেছে। তার এই এচিভমেন্টে খায়রুল আহমেদ থেকে শুরু করে বাড়ির প্রতিটা সদস্য ভীষন উৎফুল্লিত। সাহেরা খাতুন তো ছেলের এই অর্জনে চোখের জল ভাসিয়ে কেঁদেছিলেন। ছেলেকে বুকে পুড়ে নেওয়ার উপক্রম হয়েছিলো উনার। ওদিকে লিলির অবস্থা তো বিশ্লেষন ক্ষমতার বাইরে চলে গিয়েছিলো। বরকে জড়িয়ে ধরে সে “এক মরা কান্দন” কেঁদেছিলো! কেউ না দেখুক, অন্তত লিলি চোখের সামনে সবটা পর্যবেক্ষণ করেছিলো ববি এই জবটার জন্য ঠিক কতোটা খেঁটেছিলো, কতো রাত জেগে চোখের নিচটা ফ্যাকাসে করে, নাওয়া-খাওয়া ভুলে ইন্টারভিউর প্রিপারেশন নিয়েছিলো!
আয়রা ৭ মাসের অন্তর্সত্তা৷ আলট্রাসনো রিপোর্ট অনুযায়ী আয়রার পুএ সন্তান হবে। তাইমুম বাবা হওয়ার খুশিতে ভীষণ আত্নহারা। বিয়ের এক বছরের মাথায় এসে আয়রা মন থেকে তাইমুমকে মেনে নিয়েছিলো। তাইমুমের একনিষ্ঠ ভালোবাসায় সে নিজে ও সায় দিতে বাধ্য হয়েছিলো। যার ফলস্বরূপ দু এক মাস পরেই হয়তো তাদের কোল জুড়ে এক তাজা প্রাণের আবির্ভাব ঘটবে। সেই শুভ ক্ষনের অপেক্ষাতেই আছে দুজন! ববির প্রতি আয়রার সমস্ত অনুভূতি এখন মৃতপ্রায় হয়ে গেছে। ববিকে নিয়ে এখন কোনো অনুভূতিই খুঁজে পায় না আয়রা। তার সমস্ত অনুভূতি জুড়ে এখন শুধু তাইমুমের বিচরণ, একান্ত তাইমুমের বিচরণ! সংসার জীবনে আয়রা ভীষণ খুশি এবং সুখি। শ্বশুড়, শ্বাশুড়ী, এবং তাইমুমকে নিয়ে খুব জমিয়ে সংসার করছে সে!
এই তো কিছুদিন হলো আফনান কাতার ব্যাক করেছে। ১ বছরের সদ্যজাত মেয়ে শিশুটিকে দেশে রেখে কর্মের টানে তাকে দূর দেশে পাড়ি জমাতে হয়েছে। মেয়েকে ছেড়ে যেতে তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছিলো, বুকটা নিগূঢ় যন্ত্রনায় ফেঁটে আসছিলো। মেয়ের হাসি মাখা মুখটা তার দু চোখে ভাসছিলো, এক প্রকার ফেবিকলের মতোন টানছিলো। আফনানকে বিদায় দিতে মেহের ও খুব কাঁদছিলো৷ পরিবারের আহাজারি দেখে আফনান সিদ্ধান্ত নিয়েছে, জাস্ট দু বছর সে বাইরে কাজ করবে। অতঃপর দেশে ফিরে জমানো পুঁজি দিয়ে শপিং কমপ্লেক্সে বৃহৎ একটা কাপড়ের দোকান নিয়ে বসবে। পরিবারের সাথে নিজ দেশে স্থায়ী হওয়ার পরিকল্পনা করবে!
হেমার ছেলের আনুমানিক সাড়ে তিন বৎসর চলছে। ছেলের নাম রাখা হয়েছে, “আদিল।” সারা বাড়ি মাথায় করে রাখে এই আদিল ছেলেটা। মেহেরের মেয়ে “মেঘলাকে” নিয়ে সারাক্ষণ সে খেলায় মশগুল থাকে, মেঘলাকে অজস্রবার কোলে নেওয়ার চেষ্টা করে, হাজারটা দুষ্টুমি করে মেঘলাকে ভীষণ ক্ষেপাতে ব্যস্ত থাকে। ১ বছরের গলুমলু মেঘলা ও কাজিনের দুষ্টুমিতে সায় দিয়ে খিলখিলিয়ে হাসে, কাজিনের চুল ধরে টানে, নখ দিয়ে আঁচড় কেটে দেয়, মাঝে মধ্যে আমার বমি করে ভাইকে ভাসিয়ে ও দেয়। দুষ্টু আদিল শুধু তার ছোট্ট বোনটাকে ভালোই বাসে না বরং খুব হিংসে ও করে। পরিবারের সবাই যখন দুষ্টু, মিষ্টি মেঘলাকে খুব মাথায় করে রাখে, আদরে আট খানা করে রাখে, ঠিক তখনই আদিলের বড্ড হিংসে হয়!
হেমা এখনো মন থেকে লিলিকে মেনে নিতে পারে নি। সুযোগ পেলেই লিলির বিরুদ্ধে বিভিন্ন ভাবে সাহেরা খাতুনের কান ভাঙ্গায়। সাহেরা খাতুন কোনো বারই হেমার কথা কানে নেন নি৷ প্রতিবারই এই সেই বলে কাটিয়ে গেছেন, নয়তো হেমাকে ভুলত্রুটি বুজিয়ে ধমকে দিয়েছেন। আজকাল লিলিকে একাগ্র ভাবে সাপোর্ট করাই যেনো উনার মেইন প্রায়োরিটি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
লিলির বা-মা-বোন এই নিয়ে তিনবার লিলির শ্বশুড় বাড়িতে এসে ঘুড়ে গেছেন। খায়রুল আহমেদ বাদে বাড়ির সবাই লিলির পরিবারকে যখেষ্ট সম্মান এবং যত্ন আত্তি করেছেন। সাহেরা খাতুন তো তাদের মাথায় করে রেখেছিলেন, প্রতিবারই তাদের সাথে পরম আত্নীয়ের মতো নম্র, ভদ্র আচরণ করেছিলেন। লিলির শ্বশুড় বাড়ির আদর, আপ্যায়নে, ব্যবহারে খুব সন্তুষ্ট লিলির বাবা-মা-বোন। যদি ও উনারা অনেকবার লিলির শ্বশুড় বাড়ির সবাইকে নড়াইল যাওয়ার জন্য রিকুয়েস্ট করেছিলেন, খায়রুল আহমেদের ঘোর আপত্তিতে কারো এই পর্যন্ত নড়াইল যাওয়া হয়ে উঠে নি। যার কারণে লিলি খুব আপসেট। ভেতরে ভেতরে ভীষণ কষ্ট পায় সে। মুখ খুলে কাউকে প্রকাশ করতে পারে না সেই কষ্ট। এমনকি ববিকে ও না!
বেশ কয়েক দিন যাবত সাহেরা খাতুন একটা বিশেষ কারণে ভীষণ দুশ্চিন্তা গ্রস্থ হয়ে আছেন। ঝিম মেরে, মনমরা হয়ে থাকছেন। লিলি বিষয়টা আঁচ করতে পেরে সন্ধ্যায় ব্লাক কফি করে সাহেরা খাতুনের রুমে প্রবেশ করল। সাহেরা খাতুন বেডের কার্ণিশে মাথা ঠেকিঁয়ে, চোখ জোড়া বুজে, হাঁটু জোড়া গুজে দুর্বার চিত্তে বসে আছেন। মুখে উনার চরম রুক্ষতার ছাপ। পাশাপাশি ভীষণ চিন্তাগ্রস্থ এবং ডিস্টার্বড দেখাচ্ছে উনাকে। লিলি পেরেশান হয়ে কফির মগটা হাতে নিয়ে সাহেরা খাতুনের পাশে বসল। রুমে দ্বিতীয় কারো উপস্থিতি যেনো উনার কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছে না। উনার পাশে যে কেউ বসে আছে সে দিকে ও উনার কোনো নজর নেই। চোখ জোড়া উদ্বিগ্নতা নিয়ে লিলি ব্যতিব্যস্ত স্বরে বলল,,
“আম্মু শুনছেন?”
সাহেরা খাতুন ফট করে চোখ জোড়া খুলে লিলির দিকে তাকালেন। দীর্ঘ একটা শ্বাস ছেড়ে ম্লান হেসে বললেন,,
“শুনছি। বলো?”
লিলি শুকনো কন্ঠে বলল,,
“আপনার কি হয়েছে আম্মু?”
সাহেরা খাতুন চোখ জোড়া বিস্ময় নিয়ে বললেন,,
“কই? কিছু না তো!”
সাহেরা খাতুনের দিকে খানিক ঝুঁকে লিলি সন্দেহ প্রবণ হয়ে বলল,,
“কিছু তো একটা হয়েছে আম্মু। যা আপনি প্রকাশ করতে চাইছেন না! বলুন না আম্মু? কি হয়েছে আপনার?”
“কিছু না লিলি। তুমি অযথা ব্যস্ত হচ্ছ!”
সাহেরা খাতুনের কথায় কর্ণপাত না করে লিলি পুনরায় বলল,,
“আপনার শরীর ঠিক আছে তো আম্মু? মানে শরীরের কোথাও কোনো অস্বস্তি হচ্ছে না তো?”
“শরীর সম্পূর্ণ ঠিক আছে লিলি। বললাম তো, তুমি অযথা ব্যস্ত হচ্ছ!”
লিলি কৌতুহল ভরা চোখে বলল,,
“আমার কোনো কাজে আপনি কষ্ট পান নি তো আম্মু? প্লিজ যাই হোক খোলসা করে বলুন। আমার ভীষণ টেনশান হচ্ছে আম্মু। আমি জানি, ইদানিং আমি আপনার প্রতি একটু বেশিই অমনযোগী হয়ে উঠছি। ভার্সিটির ক্লাস, এক্সাম, পড়াশোনো এসব নিয়ে একটু বেশিই ব্যস্ত থাকছি। হয়তো আপনার উপর বিশেষভাবে নজর রাখতে পারছি না, সেবা যত্নে ও বেশ গাফলতি হচ্ছে। সেই গাফলতি থেকে যদি আপনার মনে আমাকে নিয়ে কোনো দুঃখের আবির্ভাব হয়, খারাপ লাগা সৃষ্টি হয়, প্লিজ আমাকে শেয়ার করুন আম্মু। কথা দিচ্ছি, তৎক্ষনাৎ আমি আমার ভুল গুলো শুধরে নিবো। পরবর্তীতে এ জাতীয় ভুল করতে যথেষ্ট সতর্ক থাকব!”
সাহেরা খাতুন চোখে, মুখে সরল ভাব ফুটিয়ে সাবলীল কন্ঠে বলে উঠলেন,,
“আমি একটা নাতি, নাতনী চাই লিলি। পারবে? নিজের এম্বিশানের সাথে কম্প্রোমাইজ করতে?”
সঙ্গে সঙ্গে লিলি মাথা নিচু করে ফেলল। সাহেরা খাতুন বিদ্রুপের হাসি হেসে বললেন,,
“জানি পারবে না!”
লিলি চোখ তুলে সাহেরা খাতুনের দিকে চেয়ে মিহি স্বরে বলল,,
“পারব আম্মু! চেষ্টা করব, খুব শীঘ্রই আপনাকে নাতি-নাতনীর মুখ দেখাতে!”
সাহেরা খাতুন কান্না মুখে ও হেসে দিলেন। চোখের কোণে জল নিয়ে উনি লিলির চোখে নিজেকে আবদ্ধ করে অপার সম্ভাবনা নিয়ে বললেন,,
“সত্যি পারবে তুমি?”
লিলি জোর পূর্বক হেসে মাথা নাঁড়িয়ে হ্যাঁ বুঝালো। সাহেরা খাতুন লিলির ডান হাতটা চেঁপে ধরে মৃদ্যু হেসে বললেন,,
“এরপর থেকে আমি আর একা থাকব না, সারাক্ষণ হৈ-হুল্লোড়ে মেতে থাকব, নাতি/ নাতনীর সাথে হাসি ঠাট্টায় মশগুল থাকব, সারা বাড়িময় টইটই করে ঘুড়ে বেড়াব, একাকিত্ব আর গ্রাস করবে না আমায়। সব’চে সুখের ব্যাপার কি জানো? তাদের মুখ থেকে আমি “দাদু” ডাকটা শুনতে পারব। তোমাকে বুঝাতে পারব না লিলি, আমার কতোটা খুশি হচ্ছে! কতোটা আনন্দ হচ্ছে। তোমার উপর কতোটা দো’আ আসছে।”
লিলি মৃদ্যু হাসল। তন্মধ্যে জিনিয়া আহমেদ ও কফির মগ হাতে নিয়ে রুমে প্রবেশ করলেন। লিলির সম্মুখীন হয়ে উনি মুচকি হেসে বললেন,,
“নাতি, নাতনীর অপেক্ষায় আছি কিন্তু। খুব দ্রুত একটা ভালো খবর শুনতে চাই।”
লিলি মাথা নাঁড়ালো। জিনিয়া আহমেদ লিলির পাশে বসে শান্ত স্বরে লিলিকে বুঝিয়ে বললেন,,
“দেখো লিলি, বাচ্চা নিলেই যে পড়া যাবে না, নিজের এম্বিশান পূরণ করা যাবে না, স্বপ্ন, ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা পূরণ করা যাবে না, এমনটা কিন্তু না। মেয়ে হয়ে জন্মেছ তুমি, উভয় দিকেই তোমার সমান নজর রাখতে হবে। যেমন মন দিয়ে পড়াশোনো করতে হবে, তেমনি গোটা একটা সংসার ও সামলাতে হবে, বাচ্চা কাচ্চা ও মানুষ করতে হবে, একটা সংসারকে একসূএে বেঁধে রাখার বিভিন্ন ফর্মুলা ও জানা থাকতে হবে। জানো? কতো লক্ষ লক্ষ মেয়ে সন্তান পেটে বাচ্চা নিয়ে অর্নাস, মাস্টার্সের মতো বড় বড় ফাইনাল এক্সাম গুলো অনায়াসে দিচ্ছে? শুধু তাই নয়, অনেকে তো বড় বড় পোস্টে চাকরী ও করছে। দেশ এখন পিছিয়ে নেই লিলি, আর নারী জাতিরা ও পিছিয়ে নেই। সমস্ত প্রতিবন্ধকতা পাড় করে তারা নিজেদের উপর পূর্ণ আস্থা রেখে, জ্ঞান খাঁটিয়ে সমাজ বলো, গোটা দেশ বলো সমস্ত জায়গায় নিজেদের আধিপাত্য বিস্তার করে রেখেছে। তোমাকে ও সেই আধিপাত্যের সম্মুখীন হতে হবে লিলি। সংসার, স্বপ্ন, সন্তান এই তিনটিকেই তোমার একসঙ্গে হাসিল করতে হবে!”
লিলি দৃঢ় কন্ঠে বলল,,
“আমি চেষ্টা করব মামানী। সব দিক সামলে রাখতে!
,
,
রাত ১১ টা। ববি মাএ অফিস থেকে ফিরেছে। কাঁধের ব্যাগটা আর কাঁধে থাকতে চাইছে না তার। কাঁধ থেকে নুইয়ে পড়তে চাইছে। ক্লান্তি ভর করেছে তার সমস্ত শরীরে। মিইয়ে আসা শরীর নিয়ে ববি কলিং বেল চাপতেই লিলি ফটাফট পড়ার টেবিল ছেড়ে উঠে দ্রুত পায়ে হেঁটে সদর দরজার খিলটা খুলে দিলো। ববি ম্লান হেসে লিলির দিকে তাকাতেই লিলি হম্বিতম্বি হয়ে ববির কাঁধ থেকে অফিসের ব্যাগটা হাতে নিয়ে শুড়শুড়িয়ে বেড রুমে চলে এলো। ববি ভ্রু কুঁচকে লিলির যাওয়ার পথে তাকিয়ে বলল,,
“এর আবার কি হলো?”
সদর দরজাটা আটকে ববি গলার টাইটা খুলতে খুলতে বেড রুমে প্রবেশ করল। লিলি এতক্ষনে আলামারিতে অফিসের ব্যাগটা সযত্নে গুছিয়ে রেখে দিলো। লিলির দিকে অগ্রসর হয়ে ববি প্যান্টের পকেটে দু হাত গুজে জিগ্যাসু স্বরে বলল,,
“কি হয়েছে তোমার? এতো আপসেট দেখাচ্ছে কেনো?”
লিলি প্রসঙ্গ পাল্টে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে বলল,,
“আজ ও বাইরে থেকে ডিনার করে এসেছেন?”
লিলির দিকে ক্রমশ এগিয়ে এসে ববি ভ্রু উঁচিয়ে রূঢ় স্বরে বলল,,
“প্রসঙ্গ পাল্টাচ্ছ? গম্ভাট ভেবেছ আমাকে?”
“উফফ না। প্রসঙ্গ পাল্টাব কেনো? ক্ষিদে পেয়েছে তাই আস্ক করলাম!”
ববি সন্দিহান দৃষ্টিতে বলল,,
“সিউর?”
“হুম। সিউর!”
“ওকে, ডিনার সার্ভ করো। আমি আসছি।”
গাঁ থেকে ফরমাল শার্টটা খুলে ববি ওয়াশরুমে প্রবেশ করল। লিলি ডাইনিং টেবিলে খাবার সার্ভ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
,
,
রাত ১২ টা। ববি এবং লিলি ডিনার কমপ্লিট করে সবে মাএ বেড রুমে প্রবেশ করল। ববি ক্লান্তিমাখা শরীর নিয়েই লিলির প্রতিটা ম্যাথ, থিউরি চেইক করছিলো। ম্যানেজমেন্ট একাউন্টিংয়ের কয়েকটা ম্যাথে ভুল ধরতে পেরে ববি লিলিকে আগামীকাল ভুল গুলো কারেক্ট করতে বলল। চূড়ান্তভাবে ক্লান্ত হয়ে ববি এবার গাঁয়ের টি-শার্টটা খুলে বিছানায় উবুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। রুমের দরজা আটকে লিলি ববির ঠিক ডান পাশটায় বসে পড়ল। লিলির দিকে এক চোখে তাকিয়ে ববি শক্ত কন্ঠে বলল,,
“কি হলো? লাইট অফ না করে হঠাৎ আমার পাশে বসলে কেনো?”
লিলি মাথা নিচু করে ম্লান স্বরে বলল,,
“খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা আছে আপনার সাথে!”
ববি কৌতুহলী হয়ে শোয়া থেকে উঠে লিলির মুখোমুখি বসে বলল,,
“কি কথা?”
ববির দিকে মায়ার্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে লিলি ম্লান স্বরে বলল,,
“আগে বলুন রাখবেন তো?”
ববি ক্ষিপ্ত স্বরে বলল,,
“কি কথা আগে বলো?”
লিলি ফট করে বলে উঠল,,
“আমি “মা” হতে চাই ববি।”
ববি অল্প সময় নিস্তব্ধ থেকে হঠাৎ লিলিকে ঝাপটে ধরে আনন্দিত স্বরে বলল,,
“এতো গুলো বছর লাগলো কথাটা বলতে, হুম? জানো? সেই কবে থেকে ওয়েট করছিলাম, কবে তোমার মুখ থেকে এই কাঙ্ক্ষিত সংলাপটা শুনব।”
লিলি মৃদ্যু হেসে বলল,,
“আমি খুব শীঘ্রই মা হতে চাই ববি। আর কোনো পিল খেতে পারব না আমি প্লিজ। সমস্ত পিল আমি ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলেছি।”
ভীষণ উত্তেজিত হয়ে ববি লিলিকে ছেড়ে বাঁকা হেসে লিলির ঠোঁটের দিকে অগ্রসর হয়ে বলল,,
“আর কোনো পিল খেতে হবে না ওকে? বাবা তো এবার আমি হয়েই ছাড়ব।”
লিলি হুট করে ববির ঠোঁটে ডান হাতের তর্জনী আঙ্গুলটা প্রেস করে কাঁপা স্বরে বলল,,
“লাইটটা অফ করে আসি?”
ববি বিরক্তি নিয়ে বলল,,
“উফফ যাও।”
লিলি হাসি চেঁপে বসা থেকে উঠে রুমের লাইটটা অফ করে ববির পাশে শুয়ে পড়ল। ববি অতি উত্তেজিত হয়ে লিলির ঠোঁট জোড়া তীব্র ভাবে আঁকড়ে ধরল। চূড়ান্তভাবে লিলিকে নিজের করে নেওয়ার আসক্তিতে মত্ত হয়ে উঠল। ববির সমস্ত রোমান্টিকে অত্যাচারে সায় জানিয়ে লিলি নিজে ও ববিতে আসক্ত হয়ে উঠল। ববির সমস্ত শরীরে ছোট ছোট বাইটে ভরিয়ে দিলো।
,
,
পরের দিন।
সকাল ৮ টা। প্রকৃতির রানী বর্ষার আবির্ভাবে বর্ষণের বারিধারা বয়ে চলছে সর্বএ। ভোর হতেই টিপ টিপ বৃষ্টিতে শহরের প্রতিটা আনাচ কানাচ, রাস্তাঘাট, নদী, নালা, গর্ত, জলাশয়, পানিতে টুইটম্বুর হয়ে গেছে। সকাল ৭ টার পর পর থেকেই টিপ টিপ বৃষ্টিরা, ঝুম বৃষ্টিতে পরিণত হয়েছে। বৃষ্টির স্নিগ্ধতায় শহরের প্রতিটা ব্যস্ত মানুষ ব্যস্ততা ভুলে নিশ্চিন্তে ঘুমের ঘোরে তলিয়ে আছে। আরাম ভেঙ্গে কেউই তাদের কর্মস্থলে যেতে চাইছে না। ব্যাপক অলসতা কাজ করছে। ববি ও তার অন্যথায় না। লিলিকে বুকে নিয়ে সে বর্ষা ঋতুর উষ্ণ আবেশে গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। ববির উষ্ণ শরীরের আদ্রতা পেয়ে লিলি ও ঘুম ভেঙ্গে উঠতে চাইছে না। দেহ, মন সোঁপে আছে ববিতে।
সকাল ৯ টা বাজতেই বালিশের তলা থেকে ববির ফোনের রিং টোন বেজে উঠল। চট জলদি ঘুম ভেঙ্গে উঠে ববি এবং লিলি দুজনই দুজনের দিকে চোখ মেলে তাকালো। আরামের ঘুম নিমিষেই হারাম হয়ে গেলো দুজনের। বিরক্তি নিয়ে ববি কপাল কুঁচকে বালিশের তলা থেকে ফোনটা হাতে নিতেই স্ক্রীণে অফিসের ল্যান্ডলাইনের নাম্বারটা ভেসে উঠল। মুখে মন খারাপের ছাপ ফুটিয়ে ববি লিলির দিকে তাকিয়ে ঘুম জড়ানো স্বরে বলল,,
“অফিস থেকে কল৷ যেতে হবে এক্ষনি।”
লিলি নাকে কেঁদে ববির বুকের পাজরে মাথা ঠেঁকিয়ে অস্ফুটে স্বরে বলল,,
“সবসময় আপনার শুধু কাজ আর কাজ। এতো স্নিগ্ধ, মধুর, রোমাঞ্চে ভরা বৃষ্টিস্নাত দিনটা ও আপনার সাথে কাটাতে পারব না। চরম বিরক্তিকর!”
লিলির ঘাঁড়ে ছোট ছোট চুমুতে ভরিয়ে দিয়ে ববি গম্ভীর স্বরে বলল,,
“এই লিলি, ডোন্ট বি স্যাড প্লিজ। আমার ও কি ইচ্ছে হয় বলো? এতো রোমাঞ্চকর একটা মধুর সময়কে পায়ে ঠেলে কাঁধে অফিসের ব্যাগ ঝুলিয়ে কর্মস্থলে যেতে?”
লিলি মুখ ফুলিয়ে ববির থেকে নিজেকে ছাড়ানোর জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়তেই ববি লিলির থুতনীতে ছোট বাইট বসিয়ে বলল,,
“বি স্মাইল প্লিজ!”
লিলি জোরপূর্বক হেসে কটমট চোখে বলল,,
“ঠিক আছে?”
ববি ঠোঁট উল্টে বলল,,
“কিচ্ছু ঠিক নেই!”
ববির অদ্ভুত মুখভঙ্গি দেখে লিলি উচ্চস্বরে হেসে ববির নাক টেনে বলল,,
“ঢং না? ঢং শিখে গেছেন?”
লিলির কোঁমড়ে আঙ্গুল দিয়ে স্লাইস করে ববি ঘোর লাগা স্বরে বলল,,
“৪ বছর সংসার করছি আমার বালিকা বধূর সাথে। ঢং তো একটু আধটু শিখতেই হবে।”
লিলি খুব ধস্তাধস্তি করে ববির থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে শাড়িটা কোনো রকমে গাঁয়ে পেঁচিয়ে ওয়াশরুমে প্রবেশ করল। ববি শোয়া থেকে উঠে বেডের কার্ণিশে পিঠ ঠেঁকিয়ে ঘোলা চোখে ফোনে স্ক্রলিং করছে। ফোনের ইমেইলে ব্যাংক সম্পর্কিত কিছু ইম্পর্ট্যান্ট ডকুমেন্টস নিয়ে রিসার্চ করছে। প্রায় আধ ঘন্টার মধ্যে লিলি ওয়াশরুম থেকে প্রস্থান নিয়ে ভেজা চুলে ব্যালকনীতে দাঁড়ালো। চারিদিকে প্রবল বর্ষণ হচ্ছে। গাছ, পালা, বৃক্ষ রাজি, দূর দূরান্তের ছোট ছোট টিন দ্বারা তৈরী ঘরের ছাউনি গুলো ও প্রবল বাতাসে উড়ছে। ছিটকে আসা বৃষ্টির ফোঁটায় ব্যালকনীতে ঠিকভাবে দাঁড়ানো যাচ্ছে না পর্যন্ত৷ সর্বাঙ্গ বৃষ্টির ফোঁটায় ভিজে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে যেনো বৃষ্টি ফোঁটা গুলোকে বৈরী বাতাসরা খুব তাড়া করছে। নিজেকে বাঁচানোর জন্য,বৃষ্টির ফোঁটারা হুমড়ি খেয়ে প্রাণপনে দৌঁড়চ্ছে। যার ফলে তারা এদিক সেদিক ছিটকে পড়ছে।
লিলি ব্যতিব্যস্ত হয়ে রুমে প্রবেশ করে ববিকে উদ্দেশ্য করে বলল,,
“ববি শুনছেন? বাইরে প্রচুর ঝড়, বৃষ্টি হচ্ছে। এই প্রাকৃতিক দুর্যোগে অফিসে যাবেন কিভাবে?”
ববি ভাবশূণ্য হয়ে বলল,,
“কিছু করার নেই, যেতেই হবে!”
“তাই বলে এই জলোচ্ছ্বাস দিয়ে?”
“গাড়ি আছে তো লিলি। ডোন্ট ওরি!”
ববির কাছে তেড়ে এসে লিলি শক্ত কন্ঠে বলল,,
“না আমি চিন্তামুক্ত হতে পারছি না। আপনাকে আজ কোথাও যেতে হবে না। আম্মু শুনলে ও মানা করবেন। আকস্মিক বিপদের তো হাত পা নেই তাই না? কেনো বুঝতে চাইছেন না বলুন তো?”
লিলির স্নিগ্ধ রূপে সম্মোহিত হয়ে ববি চোখ বুজে নাক টেনে লিলির ভেজা চুলের ঘ্রান নিয়ে মাতাল স্বরে বলল,,
“তোমাকে ছেড়ে যেতে আমারো মন চাচ্ছে কই বলো? তবু ও যেতে হবে লিলি। জব ইজ জব। কোনো এক্সকিউজ নয়!”
রাগান্বিত হয়ে লিলি হুড়মুড়িয়ে ববির পাশ থেকে উঠে সোজা রুম থেকে প্রস্থান নিলো। লিলির যাওয়ার পথে তাকিয়ে ববি করুন স্বরে বলল,,
“স্যরি লিলি। তোমার মন খারাপের জায়গাটা আমি বুঝতে পারছি। তবে কিছু করার নেই আসলে। যে কোনো ক্রমে আমাকে যেতেই হবে।”
,
,
ব্রেকফাস্ট কমপ্লিট করে ববি তাড়াহুড়ো করে অফিসের ফরমাল গেট আপ নিয়েই উচ্চ স্বরে লিলিকে ডেকে বলল,,
“লিলি? একটু রুমে এসো।”
ডাইনিং টেবিলে বসে লিলি ফ্রুটস কাটছিলো। ববির গলার শব্দ পেয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে লিলি বেড রুমে প্রবেশ করল। লিলিকে দেখা মাএই ববি বাঁকা হেসে লিলিকে হেচকা টান দিয়ে বুকের পাজরের সাথে মিশিয়ে নিলো। লিলি অভিমানী স্বরে বলল,,
“রাতে কখন ফিরবেন?”
“১০/১১ টায়।”
“আজ একটা বিশেষ দিন আছে ভুলে গেছেন?”
“উহু, ভুলি নি। ভুলার প্রশ্নই আসছে না।”
লিলি চোখ তুলে জিগ্যাসু দৃষ্টিতে ববির দিকে চেয়ে বলল,,
“বলুন তো আজ কি?”
“আজকের এই দিনে আমি আমার “পুতুল বউকে” প্রথম বারের মতো দেখিছিলাম! কি স্নিগ্ধ, সুন্দর লাগছিলো দেখতে তাকে! ঐ সময়ের প্রতিটা কথা মনে পড়লে এখনো আমার খুব ইচ্ছে হয় জানো সেই চার বছর আগে আবারো ফিরে যেতে। নতুন রূপে আমাদের ভালোবাসাটাকে আবারো আবিষ্কার করতে!”
লিলি প্রস্ফুটিত স্বরে বলল,,,
“শুধু আবেগ মাখা কথা বললেই হবে না কিন্তু। আমার গিফটস চাই, গিফটস।”
ববি মৃদ্যু হেসে বলল,,
“কি লাগবে বলো?”
“কদম ফুল!”
ববি ভাবুক ভঙ্গি নিয়ে বলল,,
“উমমম, চেষ্টা করব। যদি ও সচারচর ফ্লাওয়ার শপ গুলোতে কদম ফুল পাওয়া যায় না!”
“আমি জানি না, যে কোনো মূল্যেই হোক আপনি কদম গুচ্ছ নিয়েই বাড়ি ফিরবেন। আমি খোঁপায় জড়াব!”
লিলির কপালে দীর্ঘ চুমো খেয়ে ববি শান্ত স্বরে বলল,,
“ডোন্ট ওরি! কদম গুচ্ছ নিয়েই বাড়ি ফিরব। সাবধানে থেকো তুমি। আর শোনো? ম্যানেজমেন্ট এক্যাউন্টিংয়ের শেষ অধ্যায়টা আজ রাতে এসে ধরব। প্রিপারেশন নিয়ে রাখবে কিন্তু। তার সাথে আম্মুর ও খেয়াল রেখো।”
“ওকে। সাবধানে যাবেন আপনি। রাস্তাঘাট যেহেতু পিচ্ছিল গাড়ির স্পিড একটু কমিয়ে দেন ড্রাইভ করবেন। যদি ও এখন ঝড়, বৃষ্টি অনেকটাই কমে গেছে। তবু ও সাবধানে যাবেন।”
হ্যাঁ সূচক সম্মতি জানিয়ে ববি প্রস্থান নিলো। সাহেরা খাতুনের থেকে বিদায় নিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে ববি রওনা হয়ে গেলো।
#চলবে….?