প্রেম_ফাল্গুন #পর্ব_৩৩,৩৪

#প্রেম_ফাল্গুন
#পর্ব_৩৩,৩৪
#নিশাত_জাহান_নিশি

“এতোকিছু বুঝতে হবে না আপনার। ঘুমিয়ে পড়ুন আপনি।”

ববি অল্প সময় মৌণ থেকে পেছন থেকে লিলিকে ডেকে বলল,,

“কিছু প্রয়োজন হলে কাইন্ডলি বলো। কোনো হিজিটেড ফিল করবে না প্লিজ!”

লিলি ওয়াশরুমের খিল আটকে মিহি স্বরে বলল,,

“কিছু লাগবে না। আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন।”

গাঁয়ের শার্টটা খুলে ববি হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে উবুড় হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। মিনিট দশেক বাদে লিলি ওয়াশরুমের খিল খুলে পেটে হাত দিয়ে কুঁজো হয়ে রুমে প্রবেশ করল। ব্যাথায় সে জঘন্যভাবে কোঁকাচ্ছে। লিলির দিকে জিগ্যাসু দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ববি অস্থির স্বরে বলল,,

“মেডিসিন লাগবে?”

লিলি ঠোঁট কামড়ে চোখ দুটো ঝিম খিঁচে বন্ধ করে ববির পাশ ফিরে শুয়ে মর্মান্তিক স্বরে বলল,,

“কিচ্ছু লাগবে না। চুপ করে ঘুমিয়ে পড়ুন আপনি।”

মুখে গম্ভীর ছাপ ফুটিয়ে ববি আলতো হাতে লিলির চুলে বিলি কেটে অধৈর্য্য স্বরে বলল,,

“ব্যাথা হচ্ছে তো লিলি! দেখেই বুঝা যাচ্ছে এই ব্যাথাটা খুব অসহনীয়!”

“উফফ, এতো কথা বলছেন কেনো আপনি? চুপ করে শুয়ে থাকতে পারছেন না?”

ববি চোয়াল শক্ত করে বলল,,

“ওকে ফাইন। সাডেন মাঝ রাতে ঘুম থেকে উঠে যদি ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে চিৎকার করো না তখন বুঝবে ববি কতোটা ভয়ঙ্কর।”

হাঁটুর সাথে মাথা একএ করে লিলি গোল আকৃতির হয়ে শুয়ে আছে। ব্যাথায় সে অপ্রতিরোধ্য স্বরে গোঙ্গাচ্ছে। ববি ব্যতিব্যস্ত হয়ে অনবরত লিলির চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। ব্যাথায় অধৈর্য্য হয়ে লিলি চোখের জল ছেড়ে ননস্টপ কাঁদছে। লিলির কান্নার শব্দ ববির কান অব্দি পৌঁছচ্ছে না বলে ববি এখনো যথেষ্ট শান্ত এবং স্থির হয়ে আছে৷ কোনো রকম রিয়েক্ট করছে না। কেবল সামান্য একটু টেনশানে আছে। লিলি মুখ বুজে কাঁদতে কাঁদতে এক পর্যায়ে ঘুমিয়ে পড়ল। লিলির মোচঁড়া মোচড়ির কোনো আঁচ না পেয়ে ববি চোখ তুলে লিলির দিকে তাকালো। লিলির চোখের কার্ণিশ বেয়ে শুকনো নোনা জলের ধারা স্পষ্ট পরিলক্ষিত হচ্ছে। ববি কপাল কুঁচকে কিছুক্ষণ লিলির ঘুমন্ত মুখপানে চেয়ে থেকে লিলির চোখে, মুখে অসংখ্য চুমো খেয়ে লিলিকে সোজা করে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে ধরে নিশ্চিন্তে চোখ জোড়া বুজে নিলো। ঘুমানোর চেষ্টায় লিপ্ত থাকতেই এক পর্যায়ে ববির চোখে ও অবাধ্য ঘুমেরা হানা দিলো।

,

,

১ মাস পর।
আজ আয়রার বিয়ে। গতকাল রাতেই ববি তার পরিবার নিয়ে হেমার শ্বশুড়বাড়িতে উঠেছে। মেহেন্দি এবং হলুদের অনুষ্ঠান একদিনেই সম্পন্ন হয়েছে। বিয়ের দিন সকাল থেকেই বাড়িতে বিভিন্ন কাজ কর্মের রোল পড়ে গেছে। গেস্টদের খাওয়া, দাওয়া,আদর, আপ্যায়ন, ক্যাটেরিংয়ের কাজ, স্টেইজ সাজানোর কাজ, গোটা বাড়িটা সাজানোর কাজ হরদম লেগেই রয়েছে। মোট ৪০০ জন লোকের ইনভিটিশান আছে বিয়েতে। বরযাএী সহ ৫০০/৫৫০ জন তো হবেই। এতো বিপুল কাজের মাঝে ও ববি লিলিকে বিভিন্ন ভাবে উত্ত্যক্ত করে চলছে। কিছুক্ষণ পর পর অযথা লিলিকে ডেকে রোমান্সের বারোটা থেকে তেরোটা বাজিয়ে দিচ্ছে। ঐদিকে, সদ্য বিয়ে করা আফনান এবং মেহের নিজেদের মধ্যে পার্সেনাল টাইম টুকু স্পেন্ড করার স্পেসেফিক সময়টুকু পাচ্ছে না। উফফ বলাই হয় নি “এই তো ১৫ দিন হলো আফনান এবং মেহেরের বিয়ের।” ঐ রকম জাকজমকভাবে বিয়েটা হয় নি তাদের। শুধু কাজী ডেকে এনে খুব সাদা মাটাভাবে বিয়েটা পড়ানো হয়েছে। সাথে অবশ্য রেজিষ্ট্রি ম্যারেজ ও হয়েছে। টানা ১৫ দিন না খেয়ে, না পড়ে, না নেয়ে, বদ্ধ রুমে বন্দি থেকে, বিভিন্ন অন্বেষণের মাধ্যমে আফনান এবং মেহের তাদের দু পরিবারকে খুব কষ্টে ম্যানেজ করিয়েছে। দুজন দুজনকে ছাড়া বাঁচবে ডিরেক্টলি ঘোষণা করে দিয়েছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা যে বজ্র কন্ঠে দেওয়া হয়েছিলো ঠিক সে কন্ঠেই তারা মৃত্যুর ঘোষণা দিয়েছিলো। এই মর্মান্তিক ঘোষণাকে তুচ্ছ জ্ঞান করার ক্ষমতা কোনো পরিবারেরই ছিলো না। পরিশেষে বাধ্য হয়ে দু পরিবারের সবাই তাদের সম্পর্কটা মানতে বাধ্য হয়েছিলো এবং বিয়ে পড়াতে ও সম্মত হয়েছিলো। এই বিষয়গুলোতে অবশ্য ববি খুব সাহায্য করেছে তাদের দুজনকেই!

আফনানের হাতে মাএ দেড় মাস সময় আছে। দেড় মাস পরেই আফনান কাতার ব্যাক করবে, নিজের কর্মস্থলে ফিরে যাবে। মেহের অবশ্য বায়না ধরে বসে আছে আফনানের সাথে সে ও কাতার যাবে। ওখানেই দুজন সেটেল্ডড হয়ে যাবে, যতো দ্রুত সম্ভব পাসপোর্ট এবং ভিসা রেডি করতে। মেহেরের বায়নাকে প্রশয় দিয়ে আফনান আশ্বস্ত স্বরে বলেছে, কাতার যাওয়ার ১ বছরের মাথাতেই আফনান ট্রাই করবে মেহেরকে কাতার নিয়ে যাওয়ার ভিসা এবং পাসপোর্ট তৈরি করতে। বলা যায় না, এর মধ্যে যদি মেহেরের ভাবনা, চিন্তা পাল্টে যায়! আফনানের পরিবার নিয়েই দেশে থাকতে চায়! তাই মূলত আফনান এক বছর সময় নিচ্ছে।

আয়রা খুব স্বাভাবিকভাবেই তাইমুমকে মেনে নিয়েছে। প্রেম হয়েছে দুজনের মাঝেই। আয়রার মনে শুধু প্রেম প্রবণতা থাকলে ও তাইমুমের মনে শতভাগ আসক্তিভরা ভালোবাসা ছিলো। ববির কাছ থেকে আয়রা যতোটা ভালোবাসা এক্সপেক্ট করত ঠিক ততোটা ভালোবাসাতেই তাইমুম আয়রাকে ডুবিয়ে রেখেছে। যা আয়রা বুঝে ও সর্বক্ষণ না বুঝার ভান করে থাকছে। ববিকে মন থেকে ভুলে যাওয়াটা আয়রার পক্ষে আদৌ সম্ভব হয়ে উঠছে না। চোখের সামনে ববির বিচরন দেখলেই আয়রার মন উতলা, উদগ্রীব হয়ে উঠে। ববিকে দুহাত বাড়িয়ে ছুঁতে ইচ্ছে করে। পরক্ষণে আবার মনে পড়ে যায়, “তাকে ছোঁয়া বারণ। তাকে ছোঁয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করা ও অন্যায়!” তবু ও আয়রা নিজের মনের সাথে সর্বক্ষণ কম্প্রোমাইজ করেই চলছে। তাইমুমকে দিয়েই সেই কম্প্রোমাইজের জায়গাটা ষোলো আনায় পূরণ করতে চাইছে।

সকাল ১০ টা বাজতেই আয়রাকে নিয়ে লিলি, মেহের এবং হেমা পার্লারে যাওয়ার জন্য ছুকছুক করছে। লিলি আজ পণ করে রেখেছে ববি হাজার বারল করলে ও সে আজ পার্লারে যাবেই যাবে। ভারী সাজের চাকচিক্যতায় নিজেকে আজ রাঙ্গাবেই রাঙ্গাবে। আয়রার বিয়ের জন্য ববির থেকে তিন তিনটে শাড়ি জোর করে আদায় করেছে লিলি। সাথে ম্যাচিং করা গা ভর্তি অরনামেন্টস। শাড়ির টাকা ববি নিজের কোচিংয়ের টাকা থেকে এরেন্জ্ঞ করলে ও অরনামেন্টসের জন্য খায়রুল আহমেদের ক্যাশ থেকে টাকা নিতে হয়েছে। অবশ্য ববির মুখ খুলে কিছু প্রকাশ করতে হয় নি। খায়রুল আহমেদ নিজ উদ্যোগেই ববির হাতে ১০ হাজার টাকা ধরিয়ে দিয়েছিলেন। লিলির অরনামেন্টস, কসমেটিকস, সাহেরা খাতুনের নতুন কাপড়, জুতো এবং ববির যাবতীয় ড্রেস আপ যা কেনার আছে!

মেহেন্দি রাঙ্গা হাতে আয়রা ড্রেসিং টেবিলের সামনে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বসে আছে। বাকিদের জন্য ওয়েট করছে সে। তাকে এক্ষনি পার্লারে নিয়ে যাওয়া হবে। তন্মধ্যেই আয়রার ফোনের রিং টোন বেজে উঠল। বেডের উপর পড়ে থাকা ফোনের স্ক্রীণে উঁকি দিতেই তাইমুমের নামের সাথে ফোন নাম্বারটা ও ভেসে উঠল। কলটাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে আয়রা একই ধ্যানে নিজের ম্লান হয়ে আসা প্রতিবিম্বের দিকে তাকালো। ননস্টপ ফোনটা বেজেই চলছে। ভাব শূন্য হয়ে আয়রা কলটা এবার রিসিভ ই করে নিলো। ঐ পাশ থেকে ঘুম জড়ানো কন্ঠে তাইমুম বলল,,

“হ্যালো।”

আয়রা নির্লিপ্ত স্বরে বলল,,

“হুম। বলুন।”

“কি করছ?”

“এই তো, পার্লারে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছি।”

তাইমুম করুণ কন্ঠে বলল,,

“তোমার মেহেন্দি রাঙ্গ হাতটা কিন্তু দেখা হলো না!”

“ছবি পাঠাতে বলেন নি কিন্তু।”

“না বললে ও বুঝে নিতে হয় প্রিয়।”

“সে বুঝ শক্তি এখন আমার মধ্যে নেই। যদি কখনো সেই বুঝ শক্তির আবির্ভাব হয়, তো ধরে নিতে পারেন না চাইতে ও অনেক কিছু পেয়ে যাবেন। যা আপনি কখনো এক্সপেক্ট ও করেন নি।”

“সেই অব্দি অপেক্ষা করার ধৈর্য্য নিয়েই হয়তো উপর ওয়ালা আমাকে পাঠিয়েছেন। ইউ ডোন্ট ওরি আয়রা, আমি সেই অনন্ত অপেক্ষায় অবিচল থাকব।”

আয়রা ম্লান হাসল। তাইমুম বড় একটা হাই তুলে বলল,,

“সো, এখন কি একটা পিকচার সেন্ড করা যাবে? তুমি রিসেন্ট যে অবস্থায় আছো, ঠিক সেই অবস্খাতেই!”

“কলটা রাখুন। সেন্ড করছি।”

তাইমুম মৃদ্যু হেসে বলল,,

“ওয়েট করব।”

“বেশিক্ষন ওয়েট করাব না। জাস্ট ফাইভ মিনিটস নিবো!”

তাইমুম কলটা কেটে অধীর আগ্রহ নিয়ে ফোনের স্ক্রীণের দিকে তাকিয়ে আছে। আয়রা ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসেই হালকা হেসে কয়েকটা ছবি ক্লিক করল। পাশাপাশি মেহেন্দি রাঙ্গা হাতের দুটো ছবি ও তাইমুমকে সেন্ড করল। ছবি গুলো পাওয়া মাএই তাইমুম উন্মাদের মতোন ফোনের স্ক্রীনে অসংখ্য চুমো খাওয়ার মত্ত হয়ে পড়ল।

,
,

ববির মুখোমুখি বেড রুমের সোফায় আড়ষ্ট ভাব নিয়ে বসে আছে লিলি। গভীর ভাবনা চিন্তায় মগ্ন সে। চোখে, মুখে তার আবদারের শত রাঙ্গা মাখা। আবদারের স্বরে সে কিছু বলতে চাইছে ববিকে। তবে ভয়ে, চিন্তায়, আতঙ্কে কিছুই বলে উঠতে পারছে না। পাল্লাক্রমে আঙ্গুলের নখ কাঁমড়ে দ্বিধা প্রকাশ করছে সে। নেইল পলিশ দেওয়া বাহারী নখ গুলো বিবর্ণ হয়ে উঠছে৷ নখের সৌন্দর্য কুৎসিত হয়ে উঠছে। ঐ দিকে ববি ফোনে স্ক্রলিং করতে মহা ব্যস্ত। হলুদের স্টেইজের ডিজাইন পাল্টে সে অর্কিড ফুলের সমারোহে নতুন একটা ইউনিক ডিজাইনের স্টেইজ সাজানোর জন্য বিভিন্ন অর্গানাইজারদের সাথে কন্ট্রাক্ট করছে। লিলির দিকে মনোনিবেশ করার বিন্দুমাএ ইচ্ছে, আগ্রহ বা সময় নেই তার। ববির দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য লিলি গলা খাঁকারি দিয়ে ও ববির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারল না। অপারগ হয়ে লিলি চোখে, মুখে বিরক্তির ছাপ ফুটিয়ে ববিকে ডান হাত দিয়ে পিঞ্চ মেরে বলল,,

“এই যে? সেই কখন থেকে যে আপনার পাশে বসে আছি, বিভিন্নভাবে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছি আপনি কি ঘুনাক্ষরে ও টের পাচ্ছেন না?”

স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে ববি ব্যস্ত স্বরে বলল,,

“হুম বলো। কি বলবে?”

“লুক এট মি। কাইন্ডলি আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলুন।”

ববি চোখ তুলে লিলির দিকে তাকালো। দাঁত বের করে হেসে লিলি আহ্লাদি স্বরে বলল,,

“শুনুন না ববি?”

ববি এক ভ্রু উঁচিয়ে জিগ্যাসু দৃষ্টিতে লিলির দিকে তাকালো। লিলি ফট করে মেহেন্দি রাঙ্গা ডান হাতটা ববির চোখের সামনে ধরে লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে বলল,,

“দেখুন দেখুন, আপনার নামের মেহেন্দি পড়েছি হাতে!”

ববি ভাবশূণ্য হয়ে বলল,,

“সো হোয়াট?”

পাত্তা না পেয়ে লিলি জোর পূর্বক হেসে ববির কনুইয়ের দিকটার মাংসপেশিতে ননস্টপ ছোট ছোট বাইট বসিয়ে চলছে। ববি বিরক্তি নিয়ে বলল,,

“শোনো লিলি, এতো ড্রামা না করে ডিরেক্টলি বলো কি চাইছ তুমি?”

সিরিয়াস হয়ে লিলি ববির দিকে সরল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে এক নিশ্বাসে বলে উঠল,,

“আমি পার্লারে সাজতে যাবো! আপনাকে পার্মিশান দিতেই হবে।”

ববি বসা থেকে উঠে জিগ্যাসু দৃষ্টিতে লিলির দিকে তাকিয়ে বলল,,

“আম্মুর থেকে পার্মিশান নিয়েছ?”

লিলি না সূচক মাথা নাঁড়ালো। ববি গাঁ ছাড়া ভাব নিয়ে বলল,,

“আম্মুর থেকে পার্মিশান নিয়ে এসো। আম্মু পার্মিশান দিলে আমার কোনো আপত্তি নেই।”

লিলি গম্ভীর স্বরে বলল,,

“আপনার পার্মিশানে হবে না?”

“না হবে না। আম্মু যা বলবে তাই হবে।”

“আম্মু যদি রাজি না হয়?”

“রাজি করিয়ে নিবে। এ আবার তোমার জন্য কোনো কঠিন ব্যাপার হলো?”

লিলি মৃদ্যু হেসে বসা থেকে উঠে ববিকে পাশ কাটিয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে রুম থেকে প্রস্থান নেওয়ার পূর্বেই ববি পেছন থেকে লিলিকে হেচকা টান দিয়ে বুকের পাজরের সাথে মিশিয়ে নিলো। লিলির দুচোখে শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই ববি হঠাৎ কপাল কুঁচকে হতভম্ব স্বরে বলল,,

“এই? তোমার চোখের মনিটা এমন দেখাচ্ছে কেনো? কালো থেকে ব্রাউন কালার হলো কিভাবে?”

লিলি ফিক করে হেসে বলল,,

“উফফ ওটা আই লেন্স।”

“মানে? তুমি আই লেন্স পড়েছ চোখে?”

লিলি বারংবার ভ্রু জোড়া উঁচিয়ে মৃদ্যু হেসে বলল,,

“হুম! কেমন লাগছে? বলুন বলুন?”

“ভালো। তবে তুমি আই লেন্স পেলে কোথায়? কে দিলো?”

“মেহের ভাবী দিয়েছেন। ভাবীর অনেক গুলো আই লেন্স আছে জানেন? গতকাল ও ভাবী নতুন কিছু কালেকশান অর্ডার করছিলেন তখন ভাবী হুট করে আমার জন্য ও আই, লেন্স অর্ডার করে দিলেন। খুশিতে আমি ও মানা করি নি। নিয়ে নিলাম!”

“কাজটা ঠিক করো নি তুমি। মেহের যখন তোমার জন্য ও অর্ডার করছিলো তখন তোমার না করা উচিত ছিলো। বাধ সাধা উচিত ছিলো।”

লিলি এক রোখা ভাব নিয়ে বলল,,

“একদম ঠিক করেছি। ভুল কিছু করি নি। আমি তো জেঁচে কিছু চাই নি। উনি নিজ থেকে অর্ডার করছিলেন। মুখের উপর না করতাম কিভাবে?”

ববি দাঁত কিড়মিড় করে বলল,,

“আমার খারাপ লাগছে বুঝলে? ভীষণ খারাপ লাগছে। লেন্সটা এক্ষনি তুমি মেহেরকে ব্যাক করে আসবে!”

“এখানে খারাপ লাগার কি আছে ববি? ভাবী তো আমাকে ভালোবেসে লেন্সটা দিয়েছেন।”

লিলিকে ছেড়ে ববি রাগে গজগজ করে রুম থেকে প্রস্থান নিচ্ছে আর পেছন থেকে লিলিকে উদ্দেশ্য করে ক্ষীপ্ত স্বরে বলছে,,

“এই লেন্স পড়ে একদম আমার চোখের সামনে আসবে না। একদম না। আই টোল্ড ইউ লিলি, সামনে পড়লেই সত্যি সত্যিই গলা টিপে মেরে ফেলব।”

ববির যাওয়ার পথে তাকিয়ে লিলি ভেংচি কেটে বলল,,

“ঢং। দু দন্ড আমাকে না দেখলে নিজেই হন্ন হয়ে ছুটে আসবে আমার কাছে। আর সে বেহায়া পুরুষ কিনা আমাকে হুমকি দিচ্ছে চোখের সামনে আমাকে দেখলেই মেরে ফেলবে!”

হনহনিয়ে রুম থেকে প্রস্থান নিয়ে লিলি ড্রইং রুমে চলে এলো। ড্রইং রুমের পরিবেশটা আজ বয়োজ্যৈষ্ঠদের পান খাওয়ার আসরে মশগুল। বাটা ভর্তি পান নিয়ে সাহেরা খাতুন খুব পাকাপোক্ত ভাবে সোফায় বিস্তর জায়গা দখল করে জর্দ্দা ভর্তি পান মুখে দিয়ে বাড়ির গেস্টদের সাথে গভীর আলাপে মগ্ন। পাশে জিনিয়া আহমেদ ও পান মুখে দিয়ে সাহেরা খাতুনের সাথে হাসি ঠাট্টায় মত্ত। মন্থর গতিতে হেঁটে লিলি সাহেরা খাতুনের ঠিক পেছনের দিকটায় দাঁড়ালো। ইতস্তত বোধ করে লিলি খানিক ঝুঁকে সাহেরা খাতুনের কানে ফিসফিসিয়ে আহ্লাদি স্বরে বলল,,

“আম্মু শুনছেন?”

সাহেরা খাতুন তৎক্ষনাৎ পিছু ফিরে তাকালেন। পানের পিচকিটা এক ঢোকে গিলে উনি তের্জশী চোখে লিলির দিকে তাকিয়ে চোয়াল শক্ত করে বললেন,,

“মাথায় ঘোমটা কোথায়? মুরুব্বিদের সামনে এভাবে নির্লজ্জের মতো ঠ্যাং ঠ্যাংয়িয়ে চলে এলে?”

লিলি ফটাফট মাথায় ঘোমটা টেনে নিচু স্বরে বলল,,

“হয়েছে?”

“হুম হয়েছে৷”

লিলি আবদারের স্বরে বলল,,

“আম্মু আমি না একটা পার্মিশান নেওয়ার জন্য আপনার কাছে এসেছি!”

সাহেরা খাতুন ভ্রু উঁচিয়ে বললেন,,

“কি?”

লিলি আহ্লাদি স্বরে বলল,,

“আম্মু, আমি পার্লারে যাবো, সাজতে। প্লিজ মানা করবেন না!”

সাহেরা খাতুন কিছুক্ষণ মৌণ থেকে পরক্ষণে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে বললেন,,

“হেমা ও যাবে সাথে?”

“সবাই যাবে আম্মু৷ মেহের ভাবী ও যাবে।”

সাহেরা খাতুন ভাবশূণ্য হয়ে বললেন,,

“যাও। পার্মিশান নেওয়ার কি আছে?”

“বারে! মায়ের থেকে পার্মিশান নিবো না?”

সাহেরা খাতুন সন্তুষ্টির হাসি হাসতে গিয়ে ও থেমে গেলেন। মুখে গম্ভীর ভাব ফুটিয়ে পরমুহূর্তে বললেন,,

“যাও৷ বেশি রং চং মেখো না আবার। নরমাল সাজবে বুঝেছ? নরমাল!”

লিলি ভীষণ এক্সাইটেড হয়ে হুট করে সাহেরা খাতুনের মাথায় চুমো খেয়ে বলল,,

“থ্যাংকস আম্মু। আমি আসছি৷ কেমন?”

উপস্থিত সবাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে লিলির যাওয়ার পথে তাকিয়ে আছে। সাহেরা খাতুন জোর পূর্বক হেসে সবার দিকে তাকিয়ে বললেন,,

“ববির বউ। খুব চঞ্চল আর ছেলে মানুষ তো! তাই হুটহাট যা তা করে বসে! হিতাহিত জ্ঞান একদম নেই বললেই চলে।”

মোট চারজন মুরুব্বি থেকে একজন মুরুব্বি জিগ্যাসু দৃষ্টিতে সাহেরা খাতুনের দিকে তাকিয়ে বললেন,,

“মেনে নিয়েছ তাহলে বউকে? এই মেয়ের জন্যই তো আয়রার সাথে ববির বিয়েটা ভেস্তে গেলো।”

প্রতিত্তুরে সাহেরা খাতুন বেশ সোজা ভাষায় বললেন,,

“এই মেয়ের জন্য না আসলে৷ আয়রার ভাগ্যে ববি ছিলো না, তাই তাদের বিয়ে হয় নি। আল্লাহ্ দুজনের ভাগ্যে অন্য কিছুই ভেবে রেখেছিলেন। তাই ক্রস কানেকশান হয়েছে। এতে অবশ্য আমার কোনো আপত্তি নেই। আল্লাহ্ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। আর রইল মেনে নেওয়ার কথা? বাপ মরা ছেলে আমার। এই ছেলেকে নিয়েই আমার সমস্ত আশা, ভরসা, স্বপ্ন, বেঁচে থাকা। পৃথিবীতে ছেলের সুখের চেয়ে বড় কোনো সুখ আমি কখনোই বড় করে দেখি নি। ছেলের সুখেতেই আমি সুখি। যতোদিন বেঁচে থাকব ছেলের সুখের উপর ভরসা করেই বেঁচে থাকব। ব্যাস এটাই উপর ওয়ালার কাছে চাওয়া!”

“তা ও ঠিক। তো বউ কেমন? ভালো তো? মেনে শুনে চলে তো?”

জিনিয়া আহমেদ ফট করে কথা টেনে নিয়ে সন্তোষজনক স্বরে বললেন,,

“বউ মাআল্লাহ্ লাখে একজন। সাহেরাকে খুব মানে এবং খুব মিশুক প্রকৃতির ও। একটু আগেই তো প্রমাণ পেলেন। শ্বাশুড়িকে কেমন আদর করছিলো!”

জিনিয়া আহমেদের সাথে উপস্থিত বাকিরা ও ফিক করে হেসে দিলেন। সাহেরা খাতুন ম্লান হেসে সবাইকে প্রদর্শন করছেন। অন্য একজন মুরুব্বি প্রসঙ্গ পাল্টে পুনরায় সাহেরা খাতুনকে প্রশ্ন নিক্ষেপ করে বললেন,,

“তো সাহেরা? নাতি-নাতনী আসবে কবে? বিয়ের তো অনেক মাস চলছে!”

সাহেরা খাতুন জোর পূর্বক হেসে বললেন,,

“এখনি না। বউ তো সবে মাএ ইন্টার পড়ছে। ইন্টার কমপ্লিট করুক এরপর বিবেচনা করে দেখা যাবে।”

“বেশি বিলম্ব করতে বলো না যেনো! পরবর্তীতে সমস্যা হতে পারে। দু, এক বছরের মাথায় এসেই ছেলের বউকে বলবে নাতি চাই আমার। নাতি!”

“সেসব নিয়ে এখনো ভাবি নি আসলে। ছেলে এবং ছেলের বউয়ের যখন সময় হবে তখন তারা নিজেরাই পদক্ষেপ নিবে। ভালো, মন্দ বিচার বিবেচনার বয়স হয়েছে তাদের। আমি আসলে তাদের ব্যক্তিগত বিষয় গুলোতে হস্তক্ষেপ করতে চাই না। খল শ্বাশুড়ী হওয়ার কোনো ইচ্ছেই নেই আমার।”

আড়ালে দাঁড়িয়ে ববি সব শুনছিলো। অজান্তেই ববির চোখের কোটরে জল চিকচিক করছিলো। চোখের জল সংবরণ করে ববি মৃদ্যু হেসে সাহেরা খাতুনের সম্মুখে দাঁড়ালো। ভাব ভঙ্গি পাল্টে ববি ফট করে পানের ডাবা থেকে জর্দ্দার কৌটো টা হাতে নিয়ে রাগান্বিত স্বরে সাহেরা খাতুনককে বলল,,

“তোমার না হাই প্রেশার? জর্দ্দা খাচ্ছ কেনো? নেক্সট টাইম যেনো না দেখি।”

জর্দ্দার কৌটো হাতে নিয়ে ববি প্রস্থান নিলো। সাহেরা খাতুন মলিন হেসে ববির যাওয়ার পথে তাকিয়ে আছে। জিনিয়া আহমেদ ফিক করে হেসে মুরব্বিদের উদ্দেশ্য করে বললেন,,

“দেখলে? সাহেরার প্রতি কতো নজর ববির? প্রাণ জুড়িয়ে যায় দেখলে।”

উপস্থিত মুরুব্বিরা মুচকি হাসলেন। সাহেরা খাতুন চোখের জল আড়াল করে পুনরায় সবার সাথে আলাপচারীতায় মগ্ন হয়ে পড়লেন।

ঐদিকে, আফনান ব্যতিব্যস্ত হয়ে তার বেড রুমে প্রবেশ করতেই মেহেরকে দেখল কাবার্ড থেকে শাড়ি এবং অরনামেন্টস বের করে সাইড ব্যাগে গচ্ছিত রূপে রাখছে। মেহেরের খানিকটা কাছে এগিয়ে এসে আফনান প্রশ্নবিদ্ধ চোখে পেছন থেকে মেহেরকে বলল,,

“কি হলো? ব্যাগ গুছিয়ে কোথায় যাচ্ছ?”

বড় সাইড ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে মেহের আফনানের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মৃদ্যু হেসে বলল,,

“পার্লারে যাচ্ছি, সাজতে।”

আফনান বাঁকা হেসে মেহেরের কোঁমড়ে হাত রেখে হেচকা টান দিয়ে মেহেরকে তার বুকের পাজরের সাথে মিশিয়ে বলল,,

“আগে তো বরকে সন্তুষ্ট করে যাও!”

মেহের হুট করে আফনানের ঠোঁট জোড়া দখল করে অস্পষ্ট স্বরে বলল,,

“সন্তুষ্ট করেই যাচ্ছি।”

আফনান মৃদ্যু হাসল। ঘোরে ডুবে সে মেহেরের কোঁমড় আঁকড়ে ধরল।

,
,

দুপুর ১টা। আয়রাকে নিয়ে সবে মাএ পার্লার থেকে বাড়ি ফিরেছে লিলি, হেমা এবং মেহের। বউয়ের সাজে আয়রাকে দেখা মাএই বাড়ির সমস্ত অতিথি, এলাকার বিবাহিত মহিলারা, ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা, এমনকি বাড়ির মুরুব্বিরা পর্যন্ত ভীড় জমিয়ে রেখেছে আয়রার চতুর্পাশে। ভীড় ঠেলে কোনো মতে আয়রাকে সামলে লিলি এবং মেহের রুমে প্রবেশ করে দরজার খিল আটকে দিলো। ভারী লেহেঙ্গা এবং অরনামেন্টসের ভারে আয়রা কুঁজো হয়ে আছে। নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে আয়রা ম্লান হাসল৷ চোখ ফিরিয়ে একবার লিলির দিকে তাকালো৷ লিলির রূপ যেনো উপছে পড়ছে। পার্লারের জাকজমক সাজে লিলিকে আয়রার তুলনায় সাংঘাতিক আকর্ষনীয় লাগছে। দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে আয়রা ক্ষীণ স্বরে লিলিকে ডেকে বলল,,

“তুমি ভয়ঙ্কর “মায়াবী সুন্দুরী” লিলি৷ সৌভিক, কুহকী, ঐন্দ্রজালিক! মায়ার সমস্ত উপমা দিয়ে ও হয়তো তোমার মায়ার যথার্থ রূপটা ফুটিয়ে তোলা যাবে না। বউয়ের সাজে আমাকে না যতোটা আকর্ষণীয় লাগছে তার’চে দ্বিগুন আকর্ষণীয় লাগছে হালকা পার্টি সাজে তোমাকে। এদিকেই হয়তো আমাদের পার্থক্য তাই না? এই পার্থক্যের কারণেই ববি আমাকে রিজেক্ট করে তোমাকে ভালোবেসেছিলো, তোমার কাছে ছুটে গিয়েছিলো, তোমাকে বিয়ে করেছিলো!”

লিলি ম্লান হেসে আয়রার দিকে শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,,

“তোমার দৃষ্টিতে হয়তো আমাকে তোমার চেয়ে বেশি মায়াবতী লাগছে। তবে আমার দৃষ্টিতে তোমাকে আমার চে দ্বিগুন বেশি মায়াবতী লাগছে। পার্থক্য কোথায় জানো? দুজনের দেখার দৃষ্টিতে। ববির দৃষ্টিতে যেমন আমাকে মনে ধরেছিলো। তেমনি তাইমুম ভাইয়ার দৃষ্টিতে তোমাকে মনে ধরেছে। ববির চোখে আমি যতোটা সৌভিক, কুহকী, ঐন্দ্রজালিক। তেমনি তাইমুম ভাইয়ার চোখে তুমি এর চেয়ে ও বিশেষ কিছু! যা হয়তো তুমি সংসার জীবনে পদার্পণ করার পর টের পাবে। যেমনটা আমি টের পাচ্ছি।”

আয়রা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। লিলি মুচকি হেসে আয়রাকে বেডের উপর গোল করে বসিয়ে দিলো। মেহের অনেকক্ষণ পূর্বেই রুম থেকে বের হয়ে রাশেদা খানমের বেড রুমে ঢুকেছে। রাশেদা খানমের শাড়ি, অরনামেন্টস বেডের উপর সাজিয়ে রাখছে। মেয়ের বিয়েতে পড়ার জন্য। হেমা ব্যস্ত গেস্টদের আপ্যায়নে। চা, কফি পরিবেশন করতে করতে তার হাঁটু, কোঁমড়, মাজা উভয় ধরে আসছে। আতিক এবং আফনান ক্যাটেরিংয়ের দিকটা সামলাচ্ছে। ববি কিছুক্ষণ আগেই জুয়েলারী শপের উদ্দেশ্যে বের হয়েছে। আয়রার বিয়েতে প্রেজেন্টেশান হিসেবে ববির পরিবার ডায়মন্ডের একটা এক্সপেন্সিভ রিং আয়রাকে গিফট করবে সেই তাগিদে!

আয়রাকে রুমে রেখে লিলি বাহির থেকে দরজার খিল আটকে সাহেরা খাতুনের রুমে প্রবেশ করল। সদ্য শাওয়ার নিয়ে সাহেরা খাতুন ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে এলেন। জিনিয়া আহমেদ ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে হালকা ঝুঁকে মেরুন রঙ্গের জামদানি শাড়ির কুঁচিটা ঠিক করছেন। লিলি মৃদ্যু হেসে দ্রুত পায়ে হেঁটে উড়ু হয়ে নিচে বসে জিনিয়া আহমেদের শাড়ির কুঁচিটা টেনে ধরল। লিলির দিকে দৃষ্টিপাত করতেই জিনিয়া আহমেদ চোখ দুটো প্রকান্ড করে বললেন,,

“এই? এটা কি আমাদের লিলি? ববির বউ?”

লিলি মাথা তুলে জিনিয়া আহমেদের দিকে তাকিয়ে এক চোখ মেরে দুষ্টু হেসে বলল,,

“কি? লাগছে তো ববির বউ?”

জিনিয়া আহমেদ নিষ্পলক দৃষ্টিতে লিলির দিকে চেয়ে আছেন। সাহেরা খাতুন ব্যালকনী থেকে তেড়ে এসে লিলির দিকে তেজী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,,

“সাজের এই অবস্থা কেনো তোমার? এতো সাদা লাগছে কেনো?”

লিলি বসা থেকে উঠে গম্ভীর ভাব নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে সাহেরা খাতুনকে বলল,,

“কেনো আম্মু? আমাকে সুন্দর দেখাচ্ছে না?”

লিলির থেকে চোখ সরিয়ে সাহেরা খাতুন ম্লান স্বরে বললেন,,

“সুন্দর দেখালে সমস্যা ছিলো না। তবে, তোমাকে তো একটু বেশিই সুন্দর দেখাচ্ছে। পাড়ার কুটনী শ্বাশুড়ীরা আমাকে দেখে জ্বলবে, পুড়বে। আমি জেনে, বুঝে কারো মনে জ্বলন ধরাতে চাই না!”

কথার ইতি টেনে সাহেরা খাতুন নিজেই সশব্দে হেসে দিলেন। জিনিয়া আহমেদ ফিক করে হেসে লিলির দিকে তাকালেন। লিলি ভীষণ আহ্লাদি স্বরে ঠোঁট উল্টে সাহেরা খাতুনকে উদ্দেশ্য করে বলল,,

“আপনার ছেলেকে কিন্তু বারণ করে দিবেন আম্মু৷ আমাকে এই সাজে দেখলে যেনো কোনো রকম বকা ঝকা না করে। উনি কিন্তু অযথা আমাকে বকেন। বিয়ে বাড়িতে এসে আমি অন্তত কারো বকা শুনতে পারব না।”

তন্মধ্যেই রুমের দরজা ঠেলে ববি জুয়েলারীর প্যাকেট হাতে নিয়ে রুমে প্রবেশ করল। ঘেমে, নেয়ে একাকার অবস্থা ববির। ব্ল্যাক শার্টটা গাঁয়ের সাথে একদম চিপকে আছে। রোদের ভাপে শুভ্র মুখটা ও লাল বর্ণ ধারণ করেছে। কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম গুলো মুছে ববি পুরো রুমে চোখ বুলাতেই জিনিয়া আহমেদকে সম্মুখে দেখতে পেলো। পাশাপাশি সাহেরা খাতুনকে ও দেখতে পেলো। সাহেরা খাতুনের ঠিক পেছনটাতেই তৃতীয় কোনো মহিলার গোলাপী রঙ্গের শাড়ির আঁচল দেখা যাচ্ছে। লিলি ভয়, ভীতি নিয়ে সাহেরা খাতুনকে ছাঁয়া করে ববির থেকে নিজেকে আড়াল করার জন্য মুখ লুকিয়ে রেখেছে। ববি ভ্রু কুঁচকে বলল তেজী স্বরে বলল,,

“লিলি। বের হয়ে এসো।”

লিলি মাথা নিচু করে শুকনো মুখে সাহেরা খাতুনের পেছন থেকে সরে আলাদা হয়ে দাঁড়ালো। জুয়েলারী প্যাকেটটা বেডের উপর রেখে ববি অন্যপাশ ফিরে শান্ত স্বরে লিলিকে উদ্দেশ্য করে বলল,,

“রুমে এসো। পাঞ্জাবিটা নামানো হয় নি।”

ববি প্রস্থান নিলো। লিলি শুড়শুড়িয়ে রুম থেকে বের হয়ে ববিকে অনুসরণ করে সোজা বেড রুমে চলে এলো। লিলি রুমে প্রবেশ করতেই ববি ফট করে রুমের দরজাটা আটকে দিলো। হেচকা টান দিয়ে লিলিকে দেয়ালের সাথে চেঁপে ধরল। ভয়ে লিলির হার্টবিট সশব্দে কম্পিত হচ্ছে। গলাটা শুকিয়ে আসার উপক্রম হয়েছে। ববি ঘোর লাগা দৃষ্টিতে লিলির সর্বাঙ্গে চোখ বুলাচ্ছে। এমব্রয়ডারির কাজ করা গোলাপী রঙ্গের একটা সিল্ক শাড়ি পড়েছে লিলি। ম্যাচ করা কানের দুল, হার, আংটি, চুড়ি, সিঁথির মাঝখানে গোলাপী পাথরের টিকলি। চোখের পাতার উপরিভাগে ঘন করে গোলাপী এবং গোল্ডেন রংয়ের মিশ্রণে আই স্যাডো। চোখের পাতার অগ্রভাগে মোটা করে কাজল, কপালের মাঝখানে মাঝারি আকারের গোলাপী টিপ, ঠোঁটে গাঢ় করে গোলাপী ম্যাট লিপস্টিক। ঘন চুলে বাঁধা খোঁপার মাঝখানে গোলাপী রঙ্গের টগবগে গোলাপী ফুল। লিলির নজর কাড়া সাজে ববি রীতিমতো হিপনোটিজম হয়ে পড়ছে। দৃষ্টি যেনো তার কিছুতেই সরছে না লিলির থেকে। ববিকে এখন যদি বলা হয় চোখ বুজো। ববি ঠিক চোখ বুজে নিবে। যদি বলা হয় রুম থেকে বের হও, বাড়ি থেকে বের হও, এটা করো, ওটা করো ববি সব করবে। মোদ্দা কথা, ববিকে এখন যেভাবে চালনা করা হবে ববি ঠিক সেভাবেই চালিত হবে!

ববির পাথর রূপ দেখে লিলি তিক্ত হয়ে ববিকে ঝাঁকিয়ে বলল,,

“এই কি হয়েছে আপনার? হঠাৎ পাথর রূপ ধারণ করছেন কেনো?

লিলির ঝাকুঁনিতে ববির সম্মতি এইমাএ ফিরল। মুহূর্তের মধ্যেই ববি বাঁকা হেসে লিলির ঠোঁটের কাছে এগুতেই লিলি হম্বিতম্বি হয়ে হাত দিয়ে ববির ঠোঁট জোড়া চেঁপে ধরে অর্ণগল বলল,,

“এই আপনার কি আক্কেল জ্ঞান নেই? হাজার টাকার সাজ একটু চুমোর জন্য আপনি নষ্ট করে দিতে চান?”

ববি বিষন্ন মন নিয়ে লিলিকে ছেড়ে বেডের উপর লম্বা হয়ে চোখ বুজে শুয়ে পড়ল। লিলি মুখ চেঁপে হেসে ববির পাশে বসল। পাখার বাতাসে ববির ছোট্ট সিল্কি চুল গুলো উড়ছে। মুখটা খুব শুকনো লাগছে তার। ঘামে কালো শার্টটার দিকে তাকানো যাচ্ছে না। লিলি ব্যতিব্যস্ত হয়ে ববির শার্টের সবকটা বাটন ক্রমান্বয়ে ওপেন করে অস্থির স্বরে বলল,,

“উঠুন দেখি। শাওয়ারটা সেরে নিন। একটু রিলিফ লাগবে। তাছাড়া, একটু পরেই বরপক্ষ চলে আসবে।”

ববি ম্লান স্বরে বলল,,

“পাঞ্জাবিটা কাবার্ডের উপর রেখে যাও। আমি একটু পরে আসছি।”

ববির দিকে একটু ঝুঁকে লিলি এক রোখা ভাব নিয়ে বলল,,

“না এখনি উঠতে হবে। উঠুন বলছি।”

ববি চোখ খুলে পর্যন্ত লিলির দিকে তাকাচ্ছে না। লিলি বেশ বুঝতে পেরেছে ঐ সময় ববিকে চুমো খেতে নিষেধ করাতে ববি ভীষণ রাগ করেছে। লজ্জা মাখা হাসি দিয়ে লিলি ববির ঠোঁটের দিকে অগ্রসর হলো। চোখ বুজে লিলি হুট করে ববির ঠোঁটে দীর্ঘ একটা চুমো খেয়ে উঠতেই ববি ফট করে চোখ জোড়া খুলে লিলির দিকে তাকালো। বাঁকা হেসে ববি পুনরায় লিলির ঠোঁট জোড়া দখল করতেই লিলি খিলখিলিয়ে হেসে ববিকে ছেড়ে দৌঁড়ে রুম থেকে প্রস্থান নিলো। ববি পুনরায় মন খারাপ করে আবারো চোখ জোড়া বুজে নিলো!

দুপুর ৩ টে বাজতেই তাইমুম বর ভেসে চলে এলো আয়রাকে নব বধূ ভেসে তার সাথে করে নতুন একটা জীবনে, নতুন একটা পরিবেশে নিয়ে যেতে। আয়রা না চাইতে ও খুব কাঁদছে। এই বাড়ি, এই পরিবার ছেড়ে যেতে তার বুকটা ফেঁটে যাচ্ছে। ভেতরের নিগূঢ় কষ্ট গুলো সে কাউকেই প্রকাশ করতে পারছে না। রাশেদা খানম তো কান্নার জন্য নিজের মেয়ের কাছে ঘেঁষতেই পারছেন না। জুবায়ের আহমেদ এই মাএ সোনিয়া আহমেদ, রেশমি, এবং রনককে নিয়ে বিয়ের নিমন্ত্রণ খেতে চলে এসেছেন। লিলি তাদের পেয়ে খুশিতে আত্নহারা হয়ে উঠেছে। বেশিরভাগ সময় তাদের সাথে কাটাচ্ছে। লিলির বাবা-মা কে ও অবশ্য বিয়েতে নিমন্ত্রণ করা হয়েছিলো। তবে উনারা আপাতত আসতে চাইছেন না। একদিন সময় বুঝে ঠিক উনারা লিলিকে দেখতে চলে আসবেন। ঐদিকে মেহেরের বাবা- মা তো বিয়ের আগা থেকে গোড়া অব্দি সব জায়গাতেই আছেন। দুতলা থেকে তিন তলা খুব বেশি দূরের না!

বাড়ির লনে বিয়ের প্যান্ডেল এবং স্টেইজ সাজানো হয়েছে। বর আসতেই ববি, আফনান, লিলি এবং মেহের বরকে নিয়ে মেতে উঠল। নানা রকম ইয়ার্কি দুষ্টুমিতে লেগে পড়ল। বর পক্ষকে তৃপ্তি মতো খাইয়ে বিবাহ্ পড়ানোর শুভলগ্ন ঘনিয়ে এলো। বিকেল ৫ টার মধ্যেই বিবাহ্ সুষ্ঠু মতো সম্পন্ন হলো। তখনই ঘনিয়ে এলো বিদায়ের লগ্ন। বাড়ি ভর্তি সবাইকে কাঁদিয়ে আয়রা নতুন জীবনে পা বাড়ালো। নতুন একটা পরিবারকে নিজের করতে এক কঠিন লড়াইয়ে পদার্পণ হলো! যে লড়াইয়ের একমাএ সম্বল তাইমুম। তার নতুন জীবনের সঙ্গি! যাকে সে আপাতত মন থেকে মেনে না নিলে ও ভবিষ্যতে তাকে ঘিরেই হয়তো তার বাঁচা, মরা নির্ভর করবে!

________________________________________________

মাঝখানে কেটে গেলো দীর্ঘ ৪ বছর! দিন, সপ্তাহ, মাস, বছর কিছুরই খবর রাখে নি লিলি এবং ববি!

#চলবে….?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here