প্রেম_ফাল্গুন #পর্ব_৪০ (অন্তিম পর্ব)

#প্রেম_ফাল্গুন
#পর্ব_৪০ (অন্তিম পর্ব)
#নিশাত_জাহান_নিশি

“হয়তো ভালো কোনো খবর আসছে লিলি৷ আমার মনে হচ্ছে, এবার প্রেগনেন্সি টেস্ট করাটা ভীষণ জরুরি। ববি বাড়ি ফিরলেই বিষয়টা শেয়ার করো কেমন?”

বেসিন থেকে মুখ তুলে লিলি বিস্মিত দৃষ্টিতে সাহেরা খাতুনের দিকে চেয়ে দেখল৷ লিলির বিস্ময়ভরা দৃষ্টি দেখে সাহেরা খাতুন মৌণ হেসে প্রশ্নবিদ্ধ স্বরে বললেন,,

“কি? খুব অবাক হচ্ছ?”

লিলি তব্দিত দৃষ্টিতে হ্যাঁ সূচক মাথা নাঁড়ালো। আঙ্গুল চুষতে থাকা ইলমাকে শক্ত হাতে আঁকড়ে ধরে সাহেরা খাতুন সন্দিহান কন্ঠে বললেন,,

“আমি অনুমান থেকে বলছি আসলে। পুরোপুরি আশ্বস্ত হয়ে বলছি না। তাই আমার মনে হচ্ছে প্রেগনেন্সি টেস্ট করাটা ভীষণ জরুরি। এতে অন্তত আমাদের সন্দেহটা কেটে যাবে।”

লিলি অতিশয় বিপাকে পড়ে জিভ কেটে নিজেই নিজেকে ধমকে মিনমিনে কন্ঠে বলল,,

“ইসসস, বিগত দু মাস ধরেই তো আমার পিরিয়ড মিস হচ্ছিলো। প্রেগনেন্সির বিষয়টা আমি ভুলে গেলাম কিভাবে?”

সাহেরা খাতুন কৌতুহলী দৃষ্টিতের লিলির দিকে চেয়ে বললেন,,

“কিছু বললে?”

লিলি লজ্জামাখা হাসি দিয়ে অপার সম্ভাবনায় মাথাটা নিচু করে মলিন কন্ঠে বলল,,

“না আম্মু! কিছু না।”

ইলমা অনেকক্ষন যাবত লিলিকে “মা মা” বলে ডেকে, লিলির কোলে যাওয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে ও লিলির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় শেষ মেষ ভীষণ রাগান্বিত হয়ে মুহূর্তের মধ্যে লিলির চুলের মুঠি টেনে ধরে মুখ ভঙ্গি পাল্টে ই ই ই করে জেদ দেখাতে লাগল। লিলি চোখ দুটো খিঁচে বন্ধ করে ব্যাথায় আংশিক কুঁকিয়ে উঠে ইলমার হাতের মুঠি ছাড়ানোর জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে মিহি কন্ঠে বলল,,

“কি করছ মা? ছাড়ো বলছি। মা ব্যাথা পাচ্ছি তো!”

ইলমার জেদ যেনো কিছুতেই সংবরন হচ্ছে না। উল্টে বেগতিক বৃদ্ধির দিকে নিরলসভাবে ধাবিত হচ্ছে। সাহেরা খাতুন খিটখিটিয়ে হেসে বহু কষ্টে ইলমার হাতের মুঠি থেকে লিলির চুলের মুঠি ছাড়িয়ে নিলো। ইলমার খর্ব, কোমল হাতের মুঠিতে ছেড়া কয়েকটা চুল পেঁচিয়ে আছে। উহ্ উহ্ উহ্ শব্দ করে ইলমা ভীষণ খুশি হয়ে চুল গুলো মুখে পুড়তেই লিলি ঠাস করে ইলমার হাতটায় একটা চড় বসাতেই ইলমা ঠোঁট ভেঙ্গে কেঁদে দিলো। তন্মধ্যেই রুমে তৃতীয় কারো অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হলো। ইলমার কান্নার শব্দ পেয়ে ববি অফিসের ব্যাগটা কোনো রকমে বেডের উপর ছুড়ে ফেলে দৌঁড়ে ওয়াশরুমের কাছটায় চলে এলো। পেছন থেকে লিলিকে উদ্দেশ্য করে ববি তীক্ষ্ণ কন্ঠে চেঁচিয়ে বলল,,

“মেয়েটা কাঁদছে কেনো লিলি?”

ববির গলার শব্দ পেয়ে ইলমা মুখ তুলে অস্থির চাহনীতে সামনে তাকালো। ববিকে এক নজর দেখার পরক্ষণেই ইলমা হাত বাড়িয়ে, বা বা বলে ডেকে ঠোঁট ভেঙ্গে দ্বিগুন তেজে কেঁদে উঠল। ববি হম্বিতম্বি হয়ে ইলমাকে কোলে নিয়ে বুকের পাজরের সাথে একদম মসৃণভাবে মিশিয়ে নিলো। ইলমা হেচকি তুলে কেঁদে নাকের জলে চোখের জলে ববির ফরমাল শার্টটা অবলীলায় ভাসিয়ে দিচ্ছেলো। ববি ভীষণ রাগান্বিত হয়ে ক্ষীণ কন্ঠে লিলিকে কিছু বলতে যাওয়ার পূর্বেই সাহেরা খাতুন ববিকে থামিয়ে বললেন,,

“থাম তুই। লিলি আজ ইচ্ছে করে তোর মেয়েকে মারে নি। চুল খেয়ে নিচ্ছিলো মেয়েটা। ভারী দুষ্টু হয়ে গেছে, কারো কথাই শুনে না একদম। তোর মতোই হয়েছে এক রোঁখা!”

লিলি ফিক করে হেসে দিলো। ববি থতমত খেয়ে পিছু ঘুড়ে ব্যালকনীর দিকটায় চলে এলো। সাহেরা খাতুন রুম থেকে প্রস্থান নেওয়ার পূর্বে লিলির ডান হাতটা চেঁপে ধরে ম্লান হেসে বললেন,,

“ববিকে বিষয়টা বলবে কেমন? আমি খুব এক্সাইটেড হয়ে আছি। কেনো জানি না মন বলছে, ভালো কোনো খবর আমাদের প্রত্যেকের জন্য অপেক্ষা করছে।”

লিলি মৃদ্যু হেসে হ্যাঁ সূচক সম্মতি জানালো। সাহেরা খাতুন আনন্দে আপ্লুত হয়ে এক গাল হেসে রুম থেকে প্রস্থান নিলেন। লিলি ধীর পায়ে হেঁটে ব্যালকনীতে ববির ঠিক পেছন দিকটায় দাঁড়ালো। ইলমার মাথায় মসৃণভাবে হাত বুলিয়ে ববি হেসে হেসে নানান রঙ্গের কথা বলছে ইলমার সাথে। দুষ্টু ইলমাটা ডান হাতের প্রতিটা আঙ্গুল চুষে দিব্যি মনযোগ দিয়ে বাবার সমস্ত আহ্লাদে ভরা এক তরফা বকবকানি গুলো শুনে চলছে। ববির দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য লিলি পেছন থেকে গলা খাঁকারি দিয়ে হেয়ালী কন্ঠে বলল,,

“শুধু মেয়েকে নিয়ে পড়ে থাকলেই হবে জনাব? বউটার দিকে ও তো একটু মুখ তুলে তাকাতে পারেন! তার ও তো মন চায়, বরের একটু সান্নিধ্য পেতে!”

ববি চোখ ঘুড়িয়ে মলিন দৃষ্টিতে লিলির দিকে তাকালো। ইলমা ঘ্যান ঘ্যানানি বন্ধ করে মুখে ডান হাতের সমস্ত আঙ্গুল পুড়ে আরামসে ঘুমিয়ে পড়েছে। ববির পাশে দাঁড়িয়ে লিলি ইলমার মাথায় দীর্ঘ একটা চুমো খেয়ে জিগ্যাসু দৃষ্টিতে ববির দিকে চেয়ে বলল,,

“কি জনাব? এতো গুরু গম্ভীর কেনো? বেফাঁস কিছু করলাম না তো আমি?”

ববি তিক্ত কন্ঠে বলল,,

“রোজ অফিস থেকে বাড়ি ফিরে এসেই মেয়েটাকে কান্নারত অবস্থায় দেখতে হয়, কেনো বলো তো? মানে তোমার কি বেছে বেছে এই সময়টাতেই মেয়েটাকে কাঁদাতে ইচ্ছে হয়? মারতে ইচ্ছে হয়?”

লিলি ঝগড়ুটে ভাব নিয়ে বলল,,

“মানে বুঝলাম না, আপনি সবসময় আমার দোষটাকেই কেনো বড় করে দেখেন? এই সময়টাতেই তো আপনার আদরের মেয়েকে রাতের খাবারটা খাওয়াতে হয়, আপনার মেয়ে কি খুব সভ্য, ভদ্র? যে আমার এক কথাতেই খেয়ে নিবে? কোনো রকম নাকরামী ছাড়াই?”

লিলিকে পাশ কাটিয়ে ববি ইলমাকে আস্তে, ধীরে খুব সতর্কতার সহিত লম্ব করে বিছানায় শুইয়ে দিলো। গাঁয়ের উপর নকশীকাঁথাটা মেলে দিয়ে ববি স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে ইলমার মুখ থেকে লালায় নিঁসৃত হাতটা সরিয়ে ইলমার কপালে দীর্ঘ একটা চুমো খেয়ে থাই মশারীটা চারিপাশে ছড়িয়ে দিলো। ব্যতিব্যস্ত হয়ে ববি ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে শার্টের বাটন খুলতে অভিপ্রায় হলো। লিলি গোমড়া মুখে ববির সম্মুখস্থ হয়ে অভিমানী স্বরে বলল,,

“কি হয়েছে আপনার হুম? ঠিকভাবে কথা বলছেন না কেনো আমার সাথে?”

ববি কর্কশ কন্ঠে বলল,,

“ক্লান্ত লাগছে আমার, সরো সামনে থেকে!”

তৎক্ষনাৎ লিলির চোখে অবাধ্য জলদের ছুটোছুটি শুরু হলো। মনে এক রাশ অভিমান জমিয়ে লিলি ববির সম্মুখ থেকে প্রস্থান নিতেই ববি পেছন থেকে লিলিকে ম্লান কন্ঠে
ডেকে বলল,,

“অভিমান আমার ও হয় লিলি। যখন তুমি রাতের পর রাত আমার ধারে কাছে ঘেঁষতে চাও না। জোর খাটিয়ে ও তখন তোমাকে আপন করতে পারি না। সারা দিনের কর্ম ব্যস্ততার পর তোমার সান্নিধ্যে একটু সুখ খুঁজতে আসি, তখন তোমার হাজারটা বাহানার লাইন পড়ে থাকে। অভিমান চাইলে আমি ও দেখাতে পারি লিলি, তবে তোমার স্বস্তির তুলনায় আমার অভিমান দীর্ঘ নয়!”

কাবার্ড থেকে প্যান্ট, শার্ট বের করে ববি হুড়মুড়িয়ে ওয়াশরুমে প্রবেশ করল। অবাক দৃষ্টিতে ববির যাওয়ার পথে চেয়ে থেকে লিলি মুখ ভাড় করে বলল,,

“কতোটা চাঁপা স্বভাবের এই লোক! গলা সমান অভিমান নিয়ে ও বলে কিনা তিনি অভিমান দেখাতে জানেন না? আপনার অভিমান তো আঁতে আঁতে পেঁচে থাকে ববি! বাহ্যিক আচরণ দিয়ে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটানো ভীষণ দুষ্কর!”

হনহনিয়ে লিলি কাবার্ড থেকে অফ হোয়াইট রঙ্গের একটা শাড়ি বের করে পড়নের শাড়িটা পাল্টে হাতে থাকা নুতন শাড়িটা গুছিয়ে এবং মাধুর্যপূর্ণভাবে গাঁয়ে জড়িয়ে নিলো। মুখে পাউডার লাগিয়ে লিলি চোখের পাতার অগ্রভাগে মোটা করে কাজল পড়ে, ঠোঁটে ব্রাউন কালার লিপস্টিক পড়ে, ঘন গুচ্ছ চুলে হাত খোঁপা বাঁধতেই আচমকা আয়নায় ববির দৃষ্টিনন্দিত প্রতিবিম্ভ দেখতে পেলো। সদ্য শাওয়ার নিয়ে ববি উদোম শরীরে গলায় সাদা রঙ্গের একটা টাওয়াল ঝুলিয়ে লিলির ঠিক পেছনটায় দাঁড়িয়ে নিষ্পলক দৃষ্টিতে লিলির মুগ্ধিত প্রতিবিম্বের দিকে চেয়ে আছে। অগোছালো সিক্ত চুল থেকে ববির টপটপ শব্দে পানির প্রতিটা ফোঁটা বাহিত হচ্ছে। টিউব লাইটের তীক্ষ্ণ আলোতে ববির শাওয়ার নেওয়া স্নিগ্ধ অবয়ব থেকে রূপোর মতো ঝলকানির সৃষ্টি হচ্ছিলো। হিম শীতল ঠান্ডার পরশ ববির সিক্ত গাঁ থেকে নিসৃত হচ্ছিলো। সেই শীতল হাওয়াতে লিলির দেহ থেকে আরম্ভ করে মন প্রাণ পুরোটাই জুড়িয়ে আসছিলো। ঘোর লাগা দৃষ্টিতে লিলির খোঁপার দিকে চেয়ে ববি খোঁপা থেকে লিলির হাতটা ছিটকে ফেলে ক্রমশ লিলির দিকে এগিয়ে এসে ফিসফিসিয়ে লিলির কানের লতিতে ঠোঁট ঠেকিয়ে গুঞ্জন তুলে বলল,,

“খোলা চুলেই তুমি শ্রেয়সী! মধুকুঞ্জের মতোন টানো আমায়। আজ খোঁপা বাঁধার জেদ করো না প্লিজ। তোমার ঐ অনাবৃত কেশরাশির মাতাল করা ঘ্রানেই আমি মত্ত হতে চাই, কলুষিত হৃদয়ে সুখের ধমনীতে বুকের বাঁ পাশটাকে নাজেহাল করতে চাই।”

লিলি লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে মাথা নিচু করে লম্বভাবে মুখের অর্ধ ভাগ ডান হাত দিয়ে ঢেকে নিলো৷ ববি খানিক ঝুঁকে মুখ থেকে লিলির হাতটা সরিয়ে হেচকা টানে লিলিকে তার সম্মুখীন করে নিলো। লিলির কোমড় পেঁচিয়ে ধরতেই লিলি মৃদ্যু হেসে ববির গলা থেকে টাওয়ালটা হাতে নিয়ে বেডের উপর ছুঁড়ে মারল৷ ববির গলায় দু হাত ঝুলিয়ে লিলি মুচকি হেসে ববির চোখের দিকে চেয়ে বলল,,

“খুব অভিমান না? খুব অভিমান? এতো গুলো দিন ধরে, মনে পুষে রাখা অভিমান গুলো খুব অনায়াসে আমার অন্তরালে রেখেছিলেন তাই না? ঘুনাক্ষরে ও আঁচ করতে দেন নি। আজ যখন মুখ খুলে অভিমানের মেঘটা সরিয়েই দিয়েছেন, তবে আজ রাতটা হোক শুধু আপনার এবং আমার! নীরবে, নিভৃতে এই চঞ্চলা মনের নেশাক্ত চাওয়াতে, মায়াবী রাতের এই জোছনা ঝড়া দিবসকে সঙ্গি করে লিলি একাত্নভাবে ববির সাথে মিশে যেতে চায়। হয়তো উদিত কোনো নুতন ভোরে জং ধরে যাওয়া নুতন কোনো শুভ সংবাদে ছেঁয়ে যাবে আমাদের মনের প্রতিটা আনাচ-কানাচ। দেউলিয়াত্বের কোনো ইঙ্গিত নিশ্চয়ই বয়ে আনবে সেই সু-সংবাদ!”

প্রশস্ত ভ্রু যুগল সংকুচিত করে ববি বিস্মিতভরা কন্ঠে বলল,,

“সু-সংবাদ? মানে?”

লিলি ফিক করে হেসে বলল,,

“অনুমানের বসে আপনাকে আশ্বস্ত করতে চাইছি না আসলে। তবে আমার মন বলছে, আমার গর্ভে হয়তো ছোট একটা প্রাণ বেড়ে উঠছে। যাকে, আমি অনুভব করতে পারছি, সবক’টা লক্ষণ ও উপলব্ধি করতে পারছি।”

ববি ভাবশূণ্য হয়ে নিস্তব্ধতায় বিলীন হয়ে আছে। কোনো দিকে কোনো প্রকার হেলদুল নেই তার। ববির এহেন স্তব্ধতার কারণ লিলি বেশ আঁচ করতে পারছে৷ মৌণ হেসে ববিকে আলিঙ্গন করে লিলি চোখ জোড়া বুজে প্রশান্তি ভরা কন্ঠে বলল,,

“হয়তো বিয়ের ৮ বছরের মাথায় এসে আপনাকে সন্তান সুখ দিতে আমি সামর্থ্য হচ্ছি ববি। বাকিটা উপর ওয়ালাই ভালো জানেন! বান্দাদের মন থেকে চাওয়া কোনো সৎ ইচ্ছেকেই আল্লাহ্ অপূর্ণ রাখেন না। সঠিক সময়ে আল্লাহ্ ঠিকই তার প্রতিদান দিয়ে থাকেন, বান্দাদের নিরাশ করেন না তিঁনি। আমাদের ও হয়তো হতাশ করতে চান নি তিঁনি। দীর্ঘ ৮ বছর পর আমাদের দিকে মুখ তুলে চেয়েছেন! উনার অলৌকিক মহিমায় আমাদের মনস্কামনা পূর্ণ করতে চলেছেন!”

আঁখি ভরা আনন্দ অশ্রু নিয়ে ববি লিলিকে শক্ত করে ঝাপটে ধরে কান্নাজড়িত কন্ঠে বলল,,

“বুঝাতে পারব না লিলি, আমার মনের বর্তমান অবস্থাটা। কতোটা সুখকর অনুভূতি হচ্ছে আমার হৃদয়জুড়ে, আই কান্ট এক্সপ্লেইন দেট।”

লিলিকে পাজাকোলে তুলে ববি বিছানায় শুইয়ে দিলো৷ পাশে ইলমা গুটিশুটি হয়ে গভীর ঘুমের তলানিতে আরোহন করছে। মাঝে মধ্যে মুখ নাঁড়িয়ে ঘুমের মধ্যই কিসব যেনো খেয়ে চলছে। ইলমার নিষ্পাপ, কলুষিত মুখ খানার দিকে মায়া ভরা দৃষ্টিতে চেয়ে ববি মলিন হেসে লিলির দিকে দৃষ্টি ঘুড়িয়ে নিলো। লিলি চোখে মিলনের আমন্ত্রণ নিয়ে ববির দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। মিলনের নিমন্ত্রণ পাওয়া মাএই ববি ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি ফুটিয়ে লিলির ওষ্ঠদ্বয় আঁকড়ে ধরল। একাগ্রচিত্তে লিলি মিলনের বাসনায় তৎপর হয়ে ববিকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল। মধু ঝড়া মায়াবী এই রাতে দুজনই মধুচন্দ্রিমায় ডুব দিলো!

________________________________________________

সময়ের বহমান ধারা নিয়ে যতোই বলব, ততোই যেনো কম পড়ে যাবে। অযথাই কবি, লেখক বা মনীষিরা সময় নিয়ে নানা ধরনের উক্তি করেন নি। বুঝ, বিবেচনা করেই তারা সময়কে বিভিন্ন উক্তির মাধ্যমে বিশ্লেষণ করতে প্রয়াত হয়েছিলেন। তার মধ্যে সব’চে প্রচলিত এবং সহজ উক্তিটা হলো,,

“সময় ও নদীর স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না।”

আমার মতে সময় মূলত, “বালিকণার মতো। হাতের মুঠোতে যতোই শক্ত করে আঁকড়ে ধরতে চাইবেন, ততোই যেনো আঙ্গুলের ফাঁক ফোঁকড় বেয়ে ঠিক লাগামহীন ভাবে তারা গড়িয়ে পড়বেই। সূক্ষ্ম বালিকণা ভর্তি সেই হাতটা মুহূর্তের মধ্যেই বালি শূণ্য হয়ে উঠবে! মূলত, সময়কে ধরে রাখার মতোন সামর্থ্য আমাদের মনুষ্য জাতির মধ্যে শুধু অনুপস্থিত ই নয় বরং এর চেয়ে ও উর্ধ্বে আছে।”

সেই সময়ের টানা পোঁড়নে পড়েই লিলি এবং ববির সাংসারিক জীবনের কেটে গেছে দীর্ঘ ৬ টা বছর। তাদের সাংসারিক জীবনের মোট হিসেব হলোঃ ১৩ বছর!

আনুমানিক ৫ বছর পূর্বেই লিলির গর্ভে জন্ম নেয় ববির এক ফুটফুটে ছেলে সন্তান। উপর ওয়ালার ইচ্ছেই যেনো ছিলো লিলি এবং ববিকে দিয়ে একটা পূণ্যের কাজ করানোর। “মা মরা” একটা অসহায় পরিবারের মেয়েকে যথাযোগ্য মেয়ের সম্মান দিয়ে সুষ্ঠুভাবে লালন পালনের মাধ্যমেই প্রকৃত মনুষ্যের পরিচয় দেওয়া। ইলমা এখন লকলকিয়ে বেড়ে উঠা ৮ বছরের কিশোরী মাএ। ছোট ভাই “ইফতিকে” নিয়ে আদরে, স্নেহে, ভালোবাসায় পালাক্রমে বেড়ে উঠছে ইলমা। পরিবারের প্রতিটা মানুষ ইফতিকে যতোটা স্নেহ ভরে ভালোবাসে, তেমনি ইলমাকে ও ততোটাই ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে আসছে। কখনো অভিযোগের ছিটেফোঁটা ও লাগতে দেয় নি। দুজনকেই তারা সমান চোখে দেখে আসছে। বাকি জীবনটা ও ঠিক তেমন ভাবেই দেখে আসবে!

ববির তো এখনো সারা রুহ্ টা ইলমাকে ঘিরে। মেয়ের কথায় ববি উঠবে এবং বসবে, মেয়ে যা বলবে সেটাই হবে তার কাছে শেষ কথা। এই নিয়ে ইফতির সাথে ভীষণ মনোমালিন্যের দেখা দেয় ববির। অবশ্য ইফতি যথেষ্ট ছোট বিধায় হিংসে মন মানসিকতা একটু বেশিই কাজ করছে তার মধ্যে৷ ববি বিভিন্ন ভাবে বুঝিয়ে শুনিয়ে ইফতির রাগ খুব দ্রুত দমন করে নেয়। রাগ বেশিক্ষণ পুষিয়ে রাখতে দেয় না। মাঝখান থেকে লিলি পড়ে মহা বিপাকে। দু ছেলে, মেয়ের জ্বালায় চাকরী থেকে ক্লান্ত, শ্রান্ত হয়ে ফিরে ও দু দন্ড শান্তি পায় না সে!

ইফতি ৩ বছরের হতেই লিলি পুনরায় উদ্যমী হয়ে চাকরীর প্রস্তুতি নেয়। স্বপ্ন পূরণের তাগিদেই সেই ২ বছর পূর্বে লিলি সাভার বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স শ্রেণির হিসাববিজ্ঞান বিভাগের টিচার পদে নিয়োগ প্রাপ্ত হয়েছিলো। লিলির এই প্রাপ্তিতে অধিক খুশি হয়েছিলো ববি। আবেগে আপ্লুত হয়ে ববি লিলির জন্য গিফটসের বন্যা বইয়ে দিয়েছিলো। শাড়ি, গয়না, সাজ সরন্জ্ঞামে লিলিকে মুড়িয়ে দিয়েছিলো। ঐদিকে লিলি তো অঝড়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলো। খুশিতে সে তব্দিত হয়ে পাথর রূপ ধারণ করেছিলো। তার এতো শতো লড়াই, কষ্ট, নিরলস পরিশ্রম, প্রখর সাধনা এবং অধ্যবসায়ের পূর্ণতা পেয়েছিলো ঐদিন। যার ভাগিদার ছিলো একমাএ ববি। পৃথিবীর প্রতিটা পুরুষ জাতি যদি মহিলাদের প্রতি এতোটা তৎপর হয় তবে, নির্দ্বিধায় পৃথিবীর সমস্ত মহিলারা সংসার জীবনে থেকে ও চোখ জোড়া স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে সাফল্যের চূড়ায় ঠিকই নিঃসন্দেহে আরোহণ করতে পারে! প্রয়োজন শুধু ভালো মনের একজন জীবন সঙ্গি এবং চোখ জোড়া স্বপ্নকে জয় করার মতোন অদম্য ইচ্ছেশক্তি! লিলির ইচ্ছে শক্তি প্রখর থেকে প্রখরতর ছিলো বিধায় সেই ইচ্ছে শক্তির টানেই সে ববির মতোন একজন ভালো মনের জীবন সঙ্গিকে তার ভাগ্যের সাথে জুড়ে নিতে পেরেছিলো। আল্লাহ্ র অশেষ মেহেরবানীতে সেই জীবন সঙ্গির হাত ধরেই সে স্বপ্নের উচ্চ শৃঙ্গে নির্দ্বিধায় আরোহন করতে পেরেছিলো! দীর্ঘ একটা পথ অতিক্রম করে স্বপ্নকে হাসিল করতে পেরেছিলো।

লিলি প্রতিমাসে তার বেতনের কিছু টাকা বাড়িতে তার বাবার বিকাশ নাম্বারে পাঠিয়ে দেয়, ববি এই বিষয়ে সবটা জানে। তবে সাহেরা খাতুন বা পরিবারের বাকি সদস্যরা তা জানে না। জানলে হয়তো লিলির বাবা মা কে হেয় ভাববে তাই! যদি ও লিলির বাবা লজ্জাবোধ থেকে টাকা টা রাখতে চান না, তা ও লিলি জোর করে বিকাশে প্রতিমাসে টাকাটা পাঠিয়ে দেয়। বাবার দুঃ সময়ে যদি মেয়ে হয়ে পাশে দাঁড়ানো না যায় তবে সন্তানকে এতো কষ্ট করে লালন, পালন করে মানুষ করানোর মধ্যে কোনো ফয়দা আছে?

ববি তার ফ্ল্যাটের দু তলাটা অনেক আগেই হেমার নামে লিখে দিয়েছিলো। আপত্তি থাকা সত্ত্বে ও আতিকের প্ররোচনায় পড়ে সেই ফ্ল্যাটের দলিল হেমা নিজের হাতে তুলে নিতে বাধ্য হয়। আতিক ভীষণ খুশি এই ফ্ল্যাট পেয়ে। লোভী মনোভাব তার মনে ভরপুর। কিছু মাস হলো সে তার পরিবার নিয়ে নতুন ফ্ল্যাটে উঠেছে। তবে আফনান ঢাকার উত্তরায় আলাদা ফ্ল্যাট নিয়ে মেহের এবং তার মেয়ের সাথে সুখেই সংসার করছে।

ববির ফ্ল্যাটের এক তলাটা ভাড়ায় পড়ে আছে। খায়রুল আহমেদ এবং জিনিয়া আহমেদকে ছেড়ে ববি তার পরিবার নিয়ে কিছুতেই নতুন ফ্ল্যাটে উঠতে চাইছে না। তারা চলে আসার পর জিনিয়া আহমেদ এবং খায়রুল আহমেদ চূড়ান্তভাবে একা হয়ে যাবে। যার নূন খেয়েছে, তার গুন ছেড়ে আসা সম্ভব না! এতোটা স্বার্থপর অন্তত ববি হতে পারবে না। জিনিয়া আহমেদ এবং খায়রুল আহমেদ যতোদিন বেঁচে থাকবে ততোদিন অব্দি ববি তার পরিবার নিয়ে এই একই বাড়িতেই থাকবে।

,
,

কার্তিক মাসের পহেলা ১ তারিখ আজ। হেমন্ত ঋতু শুরু হলো সবে মাএ। হেমন্ত মানেই শিশির স্নাত প্রহর। শরতের কাশফুল মাটিতে নুইয়ে পড়ার পর পরই হেমন্তের আগমন ঘটে। এরপর আসে শীত। তাই হেমন্তকে বলা হয় শীতের পূর্বাভাস! গাছে নরম, কচি পাতা গুলোর ফাঁকে মিষ্টি রোদ আর সুনীল আকাশ যেনো হাতছানি দিয়ে ডাকে! কবি সুফিয়া কামালের হেমন্ত কবিতার কয়েকটা লাইন মনে পড়ল। লাইন গুলো ছিলো এমনঃ

“সবুজ পাতার খামের ভেতর,
হলুদ গাঁদা চিঠি লিখে।
কোন পাথারের ওপার থেকে,
আনল ডেকে হেমন্তকে?”

হেমন্তের প্রথম প্রহরেই “ইফতির” শুভ জন্মদিনের লগ্ন ঘনিয়ে এলো। ইংরেজী মাসের ১৭ তারিখ আজ। সবুজ খামে হেমন্তের বার্তা নিয়ে হলুদ গাঁদা যেমন চিঠি লিখেছিলো? তেমনি ববি এবং লিলি ও সবুজ খামে হলুদ রঙ্গের কালিতে ইফতির জন্মদিনের শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছিলো। ভোরে ঘুম ভেঙ্গে উঠেই ইফতি তার বালিশের তলায় ববি এবং লিলির সেই শুভেচ্ছা বার্তাটা পেয়েছিলো। সেখানে গোটা গোটা ইংরেজি অক্ষরে লিখা ছিলোঃ

“Happy Birthday to our Prince. Pray for you heart and soul, Always be happy our little Prince.”

ইফতি অবশ্য হ্যাপি বানানটা ছাড়া বাকি কিছুই পড়তে পারে নি! দাঁত ভাঙ্গা অবস্থা হয়ে পড়েছিলো তার। ইলমা ফিক করে হেসে পুরোটা চিরকুট পড়ে বাংলা অনুবাদ সহ ইফতিকে শুনালো। চিরকুটটা পাওয়ার সাথে সাথেই ইফতি আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে দৌঁড়ে ববি এবং লিলির বেড রুমের বদ্ধ দরজায় অনবরত টোকা দিতে লাগল। লিলির ঘাঁড় থেকে মুখ উঠিয়ে ববি বিরক্তি নিয়ে দরজার দিকে তাকালো। লিলি হাঁসফাঁস করে ঘুম জড়ানো কন্ঠে ববিকে বলল,,

“ছাড়ুন এবার। “ইফতি” এসেছে হয়তো।”

ববি চোখে, মুখে তীক্ষ্ণ ভাব ফুটিয়ে জোরপূর্বক লিলির ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো। ঐদিকে দরজায় ক্রমশ টোকা পড়তে লাগল। নিরুপায় হয়ে ববি অবশেষে লিলিকে ছাড়তে বাধ্য হলো। কপাল চাপড়িয়ে ববি বিছানায় উবুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। লিলি হুড়মুড়িয়ে শোয়া থেকে উঠে এলোমেলো শাড়িটা গুছিয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে দরজার খিলটা খুলে দিতেই ইফতি এক গাল হেসে লিলিকে ঝাপটে ধরে বলল,,

“থ্যাংক ইউ মা।”

লিলি উচ্চ হেসে তার ৫ বছরের ছেলেকে কোলে নিয়ে ছেলের চোখে, মুখে অসংখ্য চুমো খেয়ে বলল,,

“হ্যাপি বার্থডে সোনা।”

ইফতি টুপ করে লিলির নাকে চুমো খেয়ে দাঁতের পাটি দেখিয়ে খুব হেসে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে বলল,,

“আমার বার্থডে গিফট কোথায় আম্মু?”

“আছে তো বাবা। তোমার বার্থডে তো আমরা খুব বড়ড়ড়ড় করে সেলিব্রেট করব, সন্ধ্যায় খুব ঝাঁকানাকা একটা পার্টি হবে বুঝলে? তখন তুমি নানা ধরনের গিফটস পাবে, কেক পাবে, আরো কতো কি!”

ইফতি ডান দিকে মাথাটা হেলিয়ে জিগ্যাসু কন্ঠে বলল,,

“নানা, নানু, খালামনি, আঙ্কেল, ফাহিম ভাই (লিলির বোন, ঝুলির ছেলে) সবাই আসবে তো?”

“আসবে তো বাবা। সব্বাই আসবে।”

“আদিল ভাইয়া, আদিবা আপু (হেমার মেয়ে), মেঘলা আপু, তীব্র ভাইয়া ওরা ও আসবে?”

লিলি কিছু বলার পূর্বেই ববি শোয়া থেকে উঠে ইফতিকে উদ্দেশ্য করে আহ্লাদি স্বরে বলল,,

“সবাই আসবে বাবা। তোমার সব ভাইয়া, আপুরা, সবাই আসবে।”

লিলির কোল থেকে নেমে ইফতি দৌঁড়ে এলো ববির কোলে। ববির ডান গালে চুমো খেয়ে ইফতি আর্জি নিয়ে ববির কানে ফিসফিসিয়ে বলল,,

“তুমি কিন্তু আমাকে এক্ষনি শপিংয়ে নিয়ে যাবে বাবা। আপুকে কিন্তু বলবে না আমরা যে একটু পরেই শপিংয়ে যাবো।”

ইফতির গাল টেনে চুমো খেয়ে ববি মিনমিনে স্বরে বলল,,

“তোমার আপুর ও তো শপিং করতে হবে বাবা। তোমার বার্থডে তে তোমার আপুর ও তো নতুন ড্রেস লাগবে, তার ও তো ভাইয়ের বার্থডে তে সেজে গুজে খুব মজা করার ইচ্ছে আছে তাই না বাবা?”

ইফতি মুখ ফুলিয়ে ববির দিকে তাকালো। তন্মধ্যেই ইলমা ভোঁ দৌঁড়ে রুমে প্রবেশ করে ববির সম্মুখস্থ হয়ে ঠোঁট উল্টে বায়নার স্বরে বলল,,

“বাবা৷ তুমি কিন্তু বলেছিলে আজ আমাদের দু ভাই, বোনকে নিয়ে শপিংয়ে যাবে। আমাকে একটা প্রিন্সেস ড্রেস কিনে দিবে। কখন যাবে শুনি? ঘড়ি দেখেছ? কয়টা বাজছে?”

ববি ঘড়ির দিকে চোখ ঘুড়িয়ে দেখেই মাথায় হাত দিয়ে বলল,,

“৯ঃ৩০ বেজে গেছে?”

ইলমা মুখ ফুলিয়ে বলল,,

“হুম বাবা। সেই কখন!”

লিলি ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে ববির গাঁয়ের উপর টাওয়ালটা ছুড়ে মেরে তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলল,,

“বসে না থেকে উঠুন এবার। নাশতা সেরে ছেলে, মেয়েদের নিয়ে বের হউন। শপিং প্লাস কাঁচা বাজার নিয়ে এরপর বাড়ি ফিরবেন। একটু পরেই হয়তো হেমা আপুর পুরো পরিবার চলে আসবে, আয়রা আপু ও হয়তো চলে এসেছে। কতো কাজ পড়ে আছে বলুন তো? তাড়াতাড়ি উঠুন।”

এক নিশ্বাসে বকবক করে লিলি রুম থেকে প্রস্থান নেওয়ার পূর্বেই ববি পেছন থেকে লিলিকে ডেকে বলল,,

“আম্মু, আব্বু, আপু, জিজু, ফাহিম আসছেন তো? মানে রওনা দিয়েছেন তো?”

“কল করেই জিগ্যেস করুন না। গতকাল রাতে তো আব্বু বলেছিলো, সকাল ৮ টা বাজতেই সবাই রওনা হবে।”

ববি বালিশের তলা থেকে ফোনটা বের করে লিলির আব্বুর নাম্বারে ডায়াল করল। কথা বলে কনফার্ম হয়ে নিলো। উনারা অলরেডি ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেছেন!

ববি ফ্রেশ হয়ে নাশতা করে দুই ছেলে, মেয়ে সমেত হৈ হৈ করে শপিংমল এবং কাঁচা বাজারের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলো। কিচেন রুমে কাজে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ল লিলি এবং বাড়ির একজন কাজের বুয়া। সাহেরা খাতুন এবং জিনিয়া আহমেদ ড্রইং রুমের সোফায় বসে কুমকুম এবং গয়নার ছেলে মেয়েদের সাথে ভিডিও কলে আলাপে মগ্ন হয়ে পড়লেন!
,
,

সন্ধ্যা ৭ টা বাজতেই বাড়ির ড্রইংরুমের পরিবেশটা আলো, রোশনাই এবং ফুলেল সৌরভে মুখরিত হয়ে উঠল। বাচ্চা কাচ্চাদের আমোদ, ফুর্তিতে রমরমা হয়ে উঠেছে বাড়ির পুরোটা পরিবেশ। বাচ্চাদের সেনাপতি আদিল, বয়সে সবার চে যথেষ্ট বড় হলে ও সে মেঘলা, তীব্র, আদিবা, ইলমা, ফাহিম এবং ইফতিকে নিয়ে ছুটে চলছে পুরো বাড়ি জুড়ে। কখনো কানামাছি খেলছে তো কখনো দৌঁড় প্রতিযোগীতায় লেগে পড়ছে। বাচ্চাদের পেরেশানিতে অতিষ্ট হয়ে উঠছে বাড়ির বড়রা। ধমকে, মারধর করে ও কিছুতেই যেনো তাদের দমানো যাচ্ছে না। আয়রা পুনরায় ৪ মাসের অন্তর্সত্তা, মেহের দ্বিতীয় কোনো সন্তান নিবে না বলে জেদ ধরে বসে আছে। তার একটা মেয়েতেই নাকি যথেষ্ট। আফনান ও এই পযন্ত দ্বিতীয় সন্তানের জন্য কোনো রকম চাপ প্রয়োগ করে নি মেহেরের উপর৷ মেহেরের ইচ্ছেই হলো তার শেষ ইচ্ছে!

ড্রইং রুমের সোফায় বসে আয়রা এবং মেহের চা এ বিস্কিট ডুবিয়ে বিভিন্ন আলাপচারীতায় মগ্ন আছে। তাদের পাশে আবার সাহেরা খাতুন, জিনিয়া আহমেদ, লিলির মা, বাবা, বোন, মন খুলে খুব আড্ডা দিচ্ছে। ঐদিকে লিলি এবং হেমা কিচেন রুমে বিরিয়ানী রান্না করে মাএ চুলো থেকে বিরিয়ানিটা নামিয়েছে। গরমে হালকা ঘেমে নেয়ে হেমা এবং লিলি পরিশুদ্ধ বাতাসের আশায় ড্রইং রুমের সোফায় এসে বসল। আয়রা এবং মেহেরের সাথে লিলি ও এবার আড্ডায় মজে গেলো। ঐদিকে ববি, আফনান, তাইমুম, আতিক, ফারহান (লিলির দুলাভাই) মিলে বাড়ির ছাঁদে সিগারেট ধরিয়ে বহুদিন পর বেশ জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। তাদের সুখ, দুঃখের প্রতিটা মুহূর্ত একে অপরের সাথে বন্টন করে নিচ্ছে। সংসার জীবনে হাসি, খুশি, ভালো, মন্দ সবটা মিলিয়েই সবাই খুব সুখে আছে। মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টাতেই প্রয়াত আছে!

রাত ৯ টা বাজতেই ইফতির বিশাল বার্থডে কেকটা কাটা হলো। হৈ, হুল্লোড়ে রকমারী খাওয়ায়, দাওয়ায় কেটে গেলো রাতের অর্ধেকটা সময়। বাড়ির সমস্ত গেস্টরা আজ লিলিদের বাড়িতেই থেকে যাবে৷ সকাল হতেই যে যার বাড়িতে ফিরে যাবে। একটু পূর্বেই সোনিয়া আহমেদকে নিয়ে জুবায়ের আহমেদ বাড়ি ফিরে গেছেন। লিলির চাচাতো বোন রেশমীর বিয়ের প্রায় ৩ বছর হতে চলল। সদ্য একটা ফুটফুটে ছেলের জন্ম দিয়েছে রেশমী। এখনো হসপিটালেই বাচ্চা সমেত ভর্তি আছে রেশমী। ছোট ভাই রনক ও ওখানেই আছে। রনকের বিয়ের কথা বার্তা চলছে। যেকোনো মুহুর্তের রনকের ও বিয়ের ডেইট ফিক্সড হয়ে যাবে। সোনিয়া আহমেদ এখন যথেষ্ট ভালো লিলির সাথে। প্রতিদিন বিকেলে চলে আসে লিলির সাথে আড্ডা দিতে। সংসারের অভাব অনটন দেখিয়ে প্রতিমাসেই লিলির থেকে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নেন উনি। লিলি বুঝে ও সরল মনে সোনিয়া আহমেদের সমস্ত চাহিদার যোগান দেয়। কথায় প্রকাশ না করে ও সে কাজে প্রকাশ করে বুঝাতে চায়,

“দেখো চাচী, আমার বর্তমান অবস্থা! সময় সর্বদা এক রকম থাকে না চাচী। একটা সময় আমি তোমার দ্বারে এসেছিলাম, একটু আশ্রয় খুঁজতে, নিজের স্বপ্ন গুলোকে পূরণ করতে, তুমি তো আশ্রয় দিলেই না বরং সাংসারিক অভাব, অনটন দেখিয়ে আমাকে দূর করে দিলে। যদি নম্র ভাষাতে ও আমাকে বুঝিয়ে বলতে না? যে তোমার পক্ষে আর্থিকভাবে সম্ভব না আমাকে সাহায্য করার, তবে আমি আপনা আপনি তোমার চৌকাঠের দরজাতেই নিজের স্বপ্ন গুলোকে বিসর্জন দিয়ে স্বপ্ন ভঙ্গের আঘাত নিয়ে গ্রামে ফিরে যেতাম। পিছু ফিরে এক পলকের জন্য ও তাকাতাম না। তোমার উপরে ও কোনো অভিমান জমে থাকত না। চাচার ঋণ আমি কখনো শোধ করতে পারব না চাচী! চাচা আমাকে আর্থিক ভাবে সাহায্য করতে না পারলে ও মানবিক দিকে থেকে আমার জন্য বিশাল কিছু করেছিলো। ববির মতোন একজন উৎকৃষ্ট জীবন সঙ্গীকে আমার হাতে সারা জীবনের জন্য তুলে দিয়েছিলেন, আমার স্বপ্ন গুলোকে পূরণ করতে পরোক্ষভাবে সাহায্য করেছিলেন!”

বার্থডে গিফট হিসেবে ইফতি বেশিরভাগই দামী দামী খেলনা, প্যান্ট, শার্ট এবং পাঞ্জাবি, পায়জামা পেয়েছে। লিলির বাবা গিফট হিসেবে ইফতিকে এক সেট পাঞ্জাবি, পায়জামা এবং রিমোট কন্ট্রোল একটা খেলনার উড়োজাহাজ কিনে দিয়েছে। সেই গিফট পেয়ে তো ইফতি মহাখুশি! তাকে আর ধরে রাখে কে?

,
,

রাত ১২ঃ১৫। বাচ্চা পার্টিকে আলাদা আলাদা রুমে ঘুম পাড়িয়ে ববি এবং লিলি ফ্রেশ হয়ে বিছানায় সবেমাএ ক্লান্ত গাঁ এলিয়ে দিলো। লিলিকে সাপের মতোন পেঁচিয়ে ধরে ববি লিলির কানে অনুরাগের গুঞ্জন তুলে ফিসফিসিয়ে বলল,,

“আজ কিন্তু বারণ করতে পারবে না। একদম না। ছুটিতে যা ও দুজন আজ বাড়িতে ছিলাম। সেই দিনটা ও ছেলের বার্থডে তে উৎসর্গ করতে হলো! একান্তে এক দন্ডের জন্য ও পেলাম না তোমাকে।”

লিলি চুল থেকে গাজরা ফুলটা ছাড়িয়ে নাক ফুলিয়ে ববির দিকে চেয়ে বলল,,

“বুড়ো বয়সে ভীমরতি হয়েছে আপনার তাই না? বিয়ের ১৩ বছরের মাথায় এসে ও আপনার রোমান্স কমে নি! মনে তো হচ্ছে, দিন দিন বাড়ছে!”

লিলি ঘোর লাগা চোখে লিলির মায়া ঝড়া মুখটার দিকে তাকিয়ে বলল,,

“যতোদিন না তোমার ঐ মিষ্টি আদলের জেল্লা কমছে ততোদিন পর্যন্ত এই ববির রোমান্স ও কমছে না। বুড়ি হওয়ার আগে জেল্লা কমিয়ে দেখাও। কথা দিচ্ছি, আমি ও রোমান্স কমিয়ে দিবো!”

লিলি ফিক করে হেসে ববির গাল টেনে বলল,,

“মহা চালাক তো আপনি! অসাধ্য এক শর্ত দিয়েছেন। সম্পূর্ণ করা আদৌ সম্ভব না।”

ববি বাঁকা হেসে বলল,,

“তাহলে সম্মতি দাও। আবারো সেই ১৩ বছর পূর্বের সেই প্রথম রাতে ফিরে যাই। যে রাতে আমি তোমাকে প্রথম বারের মতোন আপন করে নিয়েছিলাম!”

লিলি আশ্চর্যিত চোখে ববির দিকে চেয়ে জিগ্যাসু কন্ঠে বলল,,

“আপনার আবার সম্মতির প্রয়োজন হয় নাকি? এতো ইনোসেন্ট হলেন কবে থেকে শুনি?”

ববি হু হা করে হেসে লিলির ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বলল,,

“এমনই থেকো তুমি প্লিজ। টক, ঝাল, মিষ্টির মিশ্রণে। শত জনমের জন্য আমি তোমাকে চাই লিলি। ঠিক এতোটা কাছ থেকেই।”

পরম আবেশে চোখ জোড়া বুজে লিলি ববিকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে মসৃণ কন্ঠে বলল,,

“আপনি ও আজীবন আমার এতোটাই কাছে থাকবেন ববি। আমার স্বপ্ন পূরণে আমি যেমন আপনাকে ওতপ্রোতভাবে পাশে পেয়েছি। তেমনি শেষ নিশ্বাসের সময়টাতে ও আপনাকে ওভাবেই ওতপ্রোতভাবে আমার পাশে চাই, চেয়েছি এবং ভবিষ্যতে ও চাইছি!”

ববি মৃদ্যু হেসে হ্যাঁ সূচক সম্মতি জানিয়ে লিলিকে আপন করে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

#সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here