প্রেম_ফাল্গুন #পর্ব_১৬

#প্রেম_ফাল্গুন
#পর্ব_১৬
#Nishat_Jahan_Raat (ছদ্মনাম)

“ইসসস মুখ ফসকে কিসব বলে ফেললাম আমি। এখন যদি উনি জিগ্যেস করেন মামানী এবং চাচী আমাকে কি বলেছেন? তখন কি জবাব দিবো আমি?”

ববি প্রশ্নবিদ্ধ চোখে লিলির দিকে তাকিয়ে বলল,,

“কি বললে? চাচী, মামানী আমার থেকে দূরে থাকতে বলেছেন?”

লিলি হুড়মুড়িয়ে শোয়া থেকে উঠে আসাম পেতে বসল। মাথাটা নিচু করে আমতা আমতা করে বলল,,

“মুমুমুখ ফসকে কিকিসব বলে ফেলেছি। আআআপনি ও আআমার কথা ধরে বসে আছেন! জাজানেন ই তো আআমি চূড়ান্ত গম্ভাট।”

“কথা ঘুড়ানোর চেষ্টা করবে না একদম। বলো কি হয়েছে?”

“বললাম তো স্লিপ অফ টাং। যা বলেছি খামোখা বলেছি।”

ববি ক্ষুব্ধ হয়ে লিলির পাশে বসে বলল,,

“মুখ ফসকে সত্যি কথাটাই বলেছ। নাও টেল মি, চাচী এবং মামানী তোমাকে কি বলেছে? ফার্স্ট টু লাস্ট এভরিথিং।”

লিলি ভয়ার্ত চোখে ববির দিকে তাকিয়ে বলল,,

“বলব এক শর্তে৷ যদি আপনি চাচী এবং মামানীকে কিছু জিগ্যেস না করেন।”

ববি লিলির ডান হাতটা চেঁপে ধরে চোয়াল শক্ত করে বলল,,

“তোমার কাছে আমি কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নই। যা আস্ক করেছি, স্ট্রেটলি বলে ফেলো। উইদাউট এ্যানি ড্রামা এন্ড কন্ডিশান।”

লিলি মুখটা কাঁচু মাচু করে বলল,,

“মামানী বলেছেন, আমি এখনো ছোট। এনাফ ম্যাচুয়েড হই নি। তাই আপনার থেকে দু, এক বছর দূরে থাকতে। কিছু বছর সময় নিয়ে নিজেকে তৈরী করতে, স্টেবল করতে। শারীরিক সম্পর্ক ছাড়া ও মানসিক সম্পর্ক তৈরী করতে। আপনার পাশাপাশি থাকতে, আপনার যত্ন নিতে, আপনার খেয়াল রাখতে, আপনাকে ভালোবাসতে। দ্যাট’স ইট অর নাথিং।”

ববি লিলির হাতটা হালকা মোচড় দিয়ে শক্ত স্বরে বলল,,

“নাও টেল মি, চাচী কি বলেছেন?”

লিলি ব্যাথায় কুঁকিয়ে উঠে বলল,,

“চাচী কি বলেছেন, বলতে পারব না। প্লিজ ডোন্ট ফোর্স মি।”

লিলির হাতটা আরো জোরে মোচড়ে ধরে ববি রাগান্বিত স্বরে বলল,,

“এরপরে ও যদি মুখ না খুলো হাতটা কিন্তু এবার ভেঙ্গেই ফেলব। সো লেট মি আনসার কুইকলি।”

লিলি ব্যাথায় কুঁকিয়ে মরছে। ববির ক্ষুব্ধ দৃষ্টির কাছে লিলির কুঁকিয়ে উঠা ডাজন্ট ম্যাটার। লিলি বেশ বুঝতে পেরেছে, সত্যিটা না শোনা অব্দি ববি কিছুতেই লিলিকে ছাড়বে না। উল্টে আরো পিশাচ হয়ে উঠবে। বাধ্য হয়ে লিলি গলা জড়ানো স্বরে চোখের জল ছেড়ে বলল,,

“চাচী বলেছেন, আমাদের বিয়েটা কাজী অফিসে হয়েছে। কোর্ট ম্যারেজ ও নয়, যে বিয়েটা স্ট্রং হবে। যেকোনো মুহুর্তে বিয়েটা ভেঙ্গে যেতে পারে। তাই আপনার থেকে যথেষ্ট দূরে থাকতে। আপনি কোথায়, আর আমি কোথায়। আমাদের মাঝখানে তো আকাশ পাতাল তফাৎ। বিয়েটা আপনি সাময়িক আবেগের বসে করেছেন ঠিকি তবে এ্যানি টাইম আপনি পাল্টে যেতে পারেন। ফ্যামিলির চাঁপে হোক বা নিজের একক সিদ্ধান্তে৷ তাই আপনার সাথে মিশে নিজের শেষ সর্বনাশটা না করতে!”

লিলির হাতটা ছেড়ে ববি খড়তড় স্বরে লিলির দিকে তাকিয়ে বলল,,

“তার মানে, তুমি ও বিশ্বাস করো আমি যেকোনো মুহূর্তে পাল্টে যেতে পারি? তোমাকে ছেড়ে দিতে পারি? তোমার সর্বনাশ করতে পারি?”

রক্তবর্ণ ধারণ করা হাতটার দিকে তাকিয়ে লিলি হেচকি তুলে কেঁদে বলল,,

“চাচী তো ঠিকই বলেছেন ববি। আমি কোন দিক থেকে আপনার সাথে যাই বলুন? আপনি কত্তো স্মার্ট, হ্যান্ডসাম, টল, বডিবিল্ডার, সুদর্শন, একদম নজর কাড়ার মতোন। সেখানে আমি তো আপনার তুলনায় কিছুই না৷ জাস্ট নাথিং। আপনারা কতো রিচ ফ্যামিলির বলুন? জায়গা সম্পত্তির কোনো অভাব নেই, যথেষ্ট গ্রেজুয়েট আপনি, তার পাশাপাশি একজন ভালো মনের মানুষ ও। যার মনে অফুরন্ত দয়া, মায়া।”

লিলি দম নিয়ে আবার বলল,,

“কোন মোহে আপনি আমার কাছে থাকবেন বলুন? আপনি তো আমাকে ভালো ও বাসেন না। দয়া করে আর কতোদিন চলবে? একদিন তো সব ভেঙ্গে যাবে, দয়া ও উঠে যাবে। তখন তো আমি সর্বশান্ত হয়ে যাবো। কেউ আমাকে ঠাঁই দিবে না তখন। কেউ না!”

জেদ সংবরণ করতে না পেরে ববি শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ঠাস করে লিলির গালে এক চড় মেরে জোরে চেঁচিয়ে বলল,,

“কিচ্ছু জানো না তুমি কিচ্ছু না। আমি ভুল ছিলাম তুমি কখনো আমাকে বুঝো নি, আর বুঝবে ও না। দোষটা তোমার বয়সের না, দোষটা তোমার মনের। মন থেকে তুমি কিছু বুঝতে পারো না, কিছু না!”

উন্মুক্ত শরীর নিয়ে ববি চোখের কোণে জমানো দু ফোটা জলসহ রুম থেকে প্রস্থান নিয়ে সোজা ছাঁদে চলে এলো। ছাদের রেলিংয়ের উপর বসে ববি গলা জড়ানো স্বরে সামনের চুল গুলো খুব জোরে জোরে টেনে বলল,,

“যার জন্য এতো সেক্রিফাইজ করছি, সে ও আমাকে বুঝল না? দিন শেষে সে ও আমাকে হার্ট করল? আমাকে ভুল বুঝল? কি করে আমি লিলিকে বুঝাবো? লিলি আমার অপশন নয়, লিলি আমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য একটা অংশ। যার জন্য আমি আমার পরিবারের সাথে লড়াই করছি। প্রতিনিয়ত তাদের হার্ট করছি। ভেতরে ভেতরে নিজে ও ধুঁকে মরছি। আদৌ কি লিলি কখনো আমার ভালোবাসা বুঝবে না? ভালোবেসে আমাকে কাছে টেনে নিবে না? কতো যুগ অপেক্ষা করতে হবে আমার লিলির ভালোবাসার জন্য? কতো যুগ আমাকে এভাবে কষ্ট পেতে হবে? তার থেকে ডিস্টেন্স মেন্টেইন করে চলতে হবে? মাঝে মাঝে কি আমি ও হাঁফিয়ে উঠব না? বিরক্ত হয়ে উঠব না? কতো কাল এই মেয়েটা নির্বোধ থাকবে?কতো কাল?”

দুটো সিগারেট ববি একসাথে ফুঁকছে। চোখ দুটো তার লাভার রূপ ধারণ করেছে। লিলিকে মারা চড়টা তার চোখে বার বার ভাসছে। জেদের বসে সে লিলির কাছে যাওয়ার ইচ্ছেটাকে ও দমিয়ে রেখেছে। পুরোপুরি দমিয়ে রেখেছে।

ঐদিকে লিলি বেডের এক কোণায় গুটিশুটি হয়ে বসে হাঁটুতে কপাল ঠেকিয়ে অনবরত কাঁদছে। গাল, হাত দু্টোই তার প্রচন্ড ব্যাথা করছে। হাতের সাথে গালটা ও সাংঘাতিক লাল হয়ে আছে। লিলি ফুঁফিয়ে কাঁদছে আর বলছে,,

“চাচী ঠিকই বলেছে ববি। আপনি যেকোনো মুহূর্তে পাল্টে যাবেন। সেজন্যই তো আপনি আমার সাথে এতো রুড বিহেভ করেন, অযথা রাগারাগি করেন, আজ তো আমার গাঁয়ে হাত ও তুললেন। দয়া করেই আপনি আমাকে বিয়ে করেছেন। এখন হয়তো খুব পস্তাচ্ছেন। তাই এভাবে ক্ষোভ ঝাড়ছেন। মারধর করে আমার উপর ক্ষোভ ঝাড়ছেন।”

তন্মধ্যেই রুমের দরজায় টোকা পড়ল। দরজার ঐ পাশ থেকে জিনিয়া আহমেদ সশব্দে লিলিকে ডেকে বললেন,,

“লিলি। দরজাটা খোলো। আমার মেয়েরা তোমার সাথে কথা বলবে।”

লিলি ফটাফট চোখের জল মুছে নিজেকে শান্ত করে মাথায় বড় করে ঘোমটা টেনে দ্রুত পায়ে হেঁটে রুমের দরজা খুলে দিলো। অমনি জিনিয়া আহমেদ ফোন হাতে নিয়ে প্রফুল্লিত হাসিতে লিলির দিকে তাকিয়ে বললেন,,

“কুমকুম আর গয়না তোমার সাথে কথা বলতে চাইছে। ফোনটা ধরো, কথা বলো। দুজনই গ্রুপ কলে আছে।”

লিলি কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা নিতেই জিনিয়া আহমেদ কপাল কুঁচকে উদ্বিগ্ন চাহনীতে বললেন,,

“লিলি তোমার চোখ, মুখ এমন দেখাচ্ছে কেনো? ডান গালটা ও লাল হয়ে আছে। কি হয়েছে?”

লিলি থতমত খেয়ে আমতা আমতা করে বলল,,

“কিছু হয় নি মামানী। মাইগ্রেন থেকে মাথা ব্যাথা করছিলো। তাই হয়তো এমন দেখাচ্ছে।”

গ্রুপ কল থেকে কুমকুম জোরে চেঁচিয়ে বলল,,

“দাঁড়াও আম্মু, আমি ভিডিও কল করছি। অডিও কলে তো ববির বউকে দেখা যাবে না।”

গয়না জিভ কেটে বলল,,

“উফফস আমি তো ভুলেই গেছি। দাঁড়া আমি ও ভিডিও কলে আসছি।”

জিনিয়া আহমেদ মৃদ্যু হেসে লিলিকে বললেন,,

“দেখেছ, আমি বলেছিলাম না, ববির বিয়ের কথা শুনলে দুজনই পাগল হয়ে যাবে। দেখলে তো? ঠিক পাগল হয়ে গেছে। তোমাকে দেখতে।”

লিলি জোর পূর্বক হাসল। তন্মধ্যেই ভিডিও কল বেজে উঠল। লিলি মুখের কাছে ফোনটা ধরে ইতস্তত বোধ করে কলটা পিক করতেই ঐ পাশ থেকে কুমকুম, গয়নার সুন্দর প্লাস মায়াবী মুখটা স্পষ্ট হলো। দুজনই খুব হেসে একসাথে বলল,,

“হায় লিলি।”

লিলি জোর পূর্বক হেসে বলল,,

“হ্যালো।”

গয়না পুলকিত দৃষ্টিতে লিলির দিকে তাকিয়ে বলল,,,

“ওয়াও লিলি। তোমার নামের সাথে তো তোমার চেহারার বড্ড মিল আছে! একদম ফুটন্ত পদ্মের মতো শুভ্র, কোমল, সুশ্রি তুমি। আমাদের ববির চয়েজ আছে বলতে হবে!’

কুমকুম ও গয়নার সাথে তাল মিলিয়ে বলল,,

“সিরিয়াসলি লিলি। ইউ আর সো কিউট, লাভলী, এমেজিং এন্ড বিউটিফুল অলসো। নিশ্চয়ই ববি তোমার নাদুস নুদুস চোখের প্রেমে পড়েছে? তোমাকে সামনাসামনি দেখার ইচ্ছেটা প্রবল ভাবে বেড়ে গেলো। মনে তো হচ্ছে এবার দেশে আসতেই হবে। কি বলিস গয়না?”

গয়না সো এক্সাইটেড হয়ে বলল,,

“আমি আজই তোফাকে বলব টিকিট কাটার জন্য। আপু তুমি ও জিজুকে বলো খুব দ্রুত তোমাদের টিকিটটা ও কনফার্ম করে নিতে!”

লিলি খানিক উদ্বিগ্ন হয়ে আমতা আমতা করে বলল,,

“না আপু। এতো পেরেশান হয়ে আপনাদের আসতে হবে না। কতো দূরের পথ। আপনারা বরং ধীরে, সুস্থেই আসুন। আমি আপনাদের জন্য অপেক্ষা করব।”

জিনিয়া আহমেদ লিলির পাশে দাঁড়িয়ে লিলির কথায় সায় জানিয়ে বললেন,,

“লিলি ঠিকই বলেছে গয়না, কুমকুম। ধীরে, সুস্থে এসো তোমরা। এতো তাড়াহুড়ো করতে হবে না। লিলি তো আমাদের ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে না!”

গয়না ঠোঁট উল্টে বলল,,

“ঠিকাছে, ঠিকাছে। ধীরে, সুস্থেই আসব। তোমরা এতো ব্যস্ত হয়ো না।”

মৃদ্যু হেসে গয়না লিলির দিকে তাকিয়ে বলল,,

“তারপর বলো, কেমন আছো লিলি? আমার রাগী, গম্ভাট ভাইটার সাথে সংসার কেমন চলছে?”

লিলি মাথাটা নিচু করে মৌণ হেসে বলল,,

“ভালো!”

কুমকুম অট্ট হেসে বলল,,,

“দেখ দেখ, আমাদের ববির বউ গ্লো করছে। বেচারী ভীষণ লজ্জা পেয়েছে।”

গয়না হেয়ালী স্বরে বলল,,

“ববি এতো চাঁপা স্বভাবের ওহ্ মাই গড। প্রেম করল, ভালোবাসল, সাডেন বিয়ে ও করে নিলো! অথচ আমরা বোনরা কিছুই জানতে পারলাম না? হাউ স্ট্রেন্জ্ঞ কুমকুম আপু!”

জিনিয়া আহমেদ শান্ত স্বরে বললেন,,

“আর বলিস না। আমরা ঘরের মানুষরাই কিছু জানতে পারলাম না, আর তোরা তো সেই সুদূর লন্ডনে থাকিস। তোরা জানবি কিভাবে বল? তোদের বাবা, ফুফু, হেমা সবাই তো খুব ফায়ার হয়ে আছে ববির উপর। কেউ ববির সাথে ও কথা বলছে না অন্যদিকে লিলির নাম তো ওরা একদমই শুনতে পারছে না। রাগে গজগজ করছে।”

কুমকুম মৌণ স্বরে বলল,,

“সাময়িক কষ্ট সবাই ই পেয়েছে আম্মু। এর অবশ্য কারণ ও আছে। আব্বু, ফুফু, হেমা আপু সবাই তো আয়রার সাথেই ববির বিয়েটা ঠিক করেছিলো, মাঝখান থেকে ববি এমন আপত্তিকর ঘটনটা ঘটিয়ে বসল। সবার ক্ষেপে যাওয়াটা ইজ নরমাল। তবে আমরা তো আমাদের আব্বু, আপু, ফুফুকে খুব ভালো করেই চিনি, উনারা বেশিদিন রাগ করে থাকতে পারবেন না দেখো। ববি এবং লিলিকে উনারা ঠিক মেনে নিবেন। অপেক্ষা শুধু সঠিক সময়ের!”

গয়না প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলল,,

“ধ্যাত বাদ দাও তো এখন এসব কথা! লিলি আগে বলো, আমাদের রাগী ভাইটা কোথায়? নতুন বউ রেখে নিশ্চয়ই রুম থেকে এক দন্ড ও নড়ছে না?”

লিলি ইতস্তত বোধ করে কিছু বলার পূর্বেই ববি রুমের দরজা ঠেলে রুমে ঢুকল। ববিকে দেখা মাএই লিলি রাগে মাথাটা নিচু করে ফেলল। জিনিয়া আহমেদ মৃদ্যু হেসে কুমকুম এবং গয়নাকে বলল,,

“দেখ দেখ ববি এসে গেছে।”

ববি দু হাত দিয়ে সামনের এলোমেলো চুল গুলো ঠিক করে জিনিয়া আহমেদকে কিছু বলার পূর্বেই জিনিয়া আহমেদ ফোনটা ববির মুখের কাছে ধরল। গয়না, কুমকুমকে দেখা মাএই ববি শুকনো মুখে জোরপূর্বক হাসি টেনে বলল,,

“হায় আপুরা। কেমন আছো তোমরা?”

গয়না মুখ ফুলিয়ে বলল,,

“এই তোর সাথে আমাদের কোনো কথা নেই। একটা বার জানিয়েছিস? বিয়ে করেছিস যে?”

“একচুয়েলি সময় হয়ে উঠে নি। তাড়াহুড়োর মধ্যে বিয়েটা হয়েছে তো তাই!”

কুমকুম হালকা হেসে বলল,,

“যাই বলিস না কেনো ববি, তোর বউ কিন্তু লাখে একটা। হিরে বিয়ে করেছিস হিরে। কি সুন্দর দেখতে। ফুটফুটে একটা মায়াবী কন্যা। আমার তো তোর বউয়ের থেকে চোখ সরাতেই ইচ্ছে করছিলো না। তুই ও নিশ্চয়ই সরাতে পারিস না?

ববি পেছনের চুল গুলো টেনে ব্যালকনীর দিকে চলে এলো আর মৌণ হেসে বলল,,

“ধ্যাত আপু। তোমরা যে কি বলো না!”

এভাবেই তিন ভাই, বোন প্রায় আধঘন্টা নাগাদ কথা বলল। লিলি বেডের এক কোণায় মাথা নিচু করে বসে আছে। জিনিয়া আহমেদ লিলির পাশে বসে লিলির মন খারাপের কারণ জিগ্যেস করছে। লিলি কিছুতেই মুখ ফুঁটে হাত ব্যাথা, গাল ব্যাথা বা মন খারাপের কারণটা বলছে না। ববি কথা শেষ করে কলটা কেটে রুমে প্রবেশ করে জিনিয়া আহমেদের দিকে ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বলল,,

“মামানী। ডিনার সার্ভ করো। আমি লিলিকে নিয়ে আসছি।”

জিনিয়া আহমেদ ববির থেকে ফোনটা নিয়ে রুম থেকে প্রস্থান নিচ্ছে আর বলছে,,

“তাড়াতাড়ি চলে এসো। আমি বাড়ির সবাইকে ডেকে দিচ্ছি।”

ববি হ্যাঁ সূচক মাথা নাঁড়ালো। লিলি এখনো কোণ ঠাঁসা হয়ে বসে আছে। মাথা থেকে বড় ঘোমটা ও ফেলছে না। ববি বেশ পেরেশান হয়ে লিলির আশেপাশে পায়চারী করছে। লিলির সাথে কথা বলার সাহস যোগাতে পারছে না। চড় আর হাত মোচড়ানোর ঘটনাটা বার বার তার মনে পড়ছে। ভীষণ অপরাধবোধ কাজ করছে। লিলিকে কিভাবে ফেইস করবে তা নিয়েই ভাবতে ব্যস্ত ববি। পরিশেষে ববি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আমতা আমতা করে লিলির দিকে ঝুঁকে হালকা কেশে বলল,,

“তোমার কি ঠান্ডা লাগছে? ঠান্ডা লাগলে বলো, পাখাটা অফ করে দেই।”

লিলি নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে। কোনো প্রতিত্তুর করছে না। ববি প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়ে লিলির মাথা থেকে ঘোমটাটা সরিয়ে বলল,,

“মাথায় এভাবে ঘোমটা টেনে রেখেছ কেনো? আমি কি বাইরের পর পুরুষ? আমাকে ফেইস করা যায় না?”

লিলি তবু ও নিশ্চুপ। মাথা নিচু করে নীরবে চোখের জল ছাড়ছে। ববি হঠাৎ লিলির থুতনী চেঁপে ধরে লিলিকে ওর দিকে ঘুড়িয়ে বলল,,

“এই বোবা তুমি? কথা বলতে পারো না?”

লিলি চোখ বুজে ফুঁফিয়ে কাঁদছে। ববির দিকে চোখ মেলে তাকাতে ও তার ইচ্ছে করছে না। গালের পাঁচ আঙ্গুলের দাগটা এতক্ষনে ববির চোখে পড়ল। উদ্বিগ্ন হয়ে ববি লিলির থুতনী ছেড়ে লিলির দিকে ঝুঁকে বলল,,

“চড়ের দাগটা কি আমার হাতের?”

লিলি মাথা নাঁড়িয়ে হ্যাঁ সূচক সম্মতি জানালো। ববি প্রশ্নবিদ্ধ চোখে লিলির দিকে তাকিয়ে বলল,,

“আমি এতো জোরে চড় মেরেছি?”

“হুম।”

ববির নজর এবার লিলির হাতের কব্জিতে পড়ল। ডান হাতের কব্জিটা ও ভীষণ লাল হয়ে আছে৷ ববি ব্যতিব্যস্ত হয়ে হাঁটু গেড়ে ফ্লোরে বসে লিলির চোখের জল মুছে দিয়ে বলল,,

“ঐ সময় বলো নি কেনো তুমি ব্যাথা পাচ্ছিলে? কেনো কোনো রিয়েক্ট করলে না?”

লিলি নাক টেনে কেঁদে বলল,,

“বললে ও আপনি শুনতেন না। আপনার তো খুব রাগ আমার উপর। আমার জন্যই তো আপনার লাইফটা এলোমেলো হয়ে গেলো। আপনার পরিবারের সবাই আপনাকে ভুল বুঝল। দূরে সরিয়ে দিলো। কতো অপমান করলো, মার পর্যন্ত খেতে হলো। আমার উপর তো আপনার রাগ থাকবেই। আর সেজন্যই আপনি সবসময় আমাকে ধমকান, রুড বিহেভ করেন, আজ তো গাঁয়ে ও হাত তুললেন।”

ববি আচমকা লিলিকে ঝাপটে ধরে গলা জড়ানো স্বরে বলল,,

“স্যরি পুতুল বউ। আ’ম এক্সট্রেমলি স্যরি৷ মাথা ঠিক ছিলো না আমার। রাগে ব্লাইন্ড হয়ে গেছিলাম আমি। আর কক্ষনো হাত তুলব না আমি প্রমিস। রুড বিহেভ করলে ও কখনো গাঁয়ে হাত তুলব না।”

ববি ইচ্ছে মতো লিলির সমস্ত মুখ মন্ডলে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিচ্ছে। হাতের কব্জিটাতে ও অসংখ্য চুমো খেয়ে ববি লিলির দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে বলল,,

“ওয়িন্টমেন্ট লাগিয়ে দেই? খুব জ্বালা করছে না?”

লিলি এক ঝটকায় ববির থেকে হাতটা সরিয়ে অন্য পাশ ফিরে চোখের জল মুছে অভিমানী স্বরে বলল,,

“কিচ্ছু লাগবে না। জ্বালা ও করছে না। আপনি উঠুন আমার সামনে থেকে। এভাবে আমার সম্মুখে নতজানু হয়ে বসতে হবে না।”

ববি লিলির হাতটা ধরে রাগী স্বরে বলল,,

“যখন রাগ দেখানোটা এসেন্সিয়াল, তখন কেনো রাগ দেখাও না? বেছে বেছে সিরিয়াস মোমেন্টে গুলোতেই রাগ দেখাতে আসো।”

লিলি গম্ভীর ভাব নিয়ে ববির দিকে তাকিয়ে বলল,,

“হাতটা ছাড়ুন। আমার রাগকে এতো প্রশয় দিতে হবে না।”

“সব ব্যাপারেই তোমার বাড়াবাড়ি আমার পছন্দ না। চুপ করে বসে থাকো এখানে। আমি ওয়িন্টমেন্ট নিয়ে আসছি।”

ডেস্কের দু নম্বর ড্রয়ার থেকে ওয়িন্টমেন্ট নিয়ে ববি লিলির হাতের কব্জিতে লাগিয়ে দিলো, ফ্রিজ থেকে বরফ এনে লিলির গালে ঘঁষে দিলো। তন্মধ্যেই ড্রইং রুম থেকে জিনিয়া আহমেদের ডাক এলো। ববি গাঁয়ে টি শার্ট জড়িয়ে লিলিকে উদ্দেশ্য করে বলল,,

“চলো। ডিনার করবে!”

লিলি আড়ষ্ট হয়ে বসে ছোট আওয়াজে বলল,,

“ক্ষিদে নেই। আপনি যান।”

“এক কথা বার বার রিপিট করতে ভালো লাগে না আমার লিলি। মামানী ডাকছেন চলো!”

লিলি ভীষণ রেগে বলল,,

“গালে চড়ের দাগ নিয়ে আমি সবার সামনে যাবো? কি ভাববে সবাই?”

ববি তেজ দেখিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো। খাবার টেবিলে সবাই বসে আছে। ববির পাশে লিলিকে দেখতে না পেয়ে জিনিয়া আহমেদ উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন,,

“ববি। লিলি কোথায়?”

ববি চেয়ার টেনে বসে ম্লান স্বরে বলল,,

“ডিনার শেষে আমি লিলির খাবারটা রুমে নিয়ে যাবো। লিলির একটু সিক।”

সাহেরা খাতুন হেয় স্বরে বললেন,,

“বউ আসতে না আসতেই কতো যত্ন বউয়ের। বাহ্। খাবারটা পর্যন্ত রুমে দিয়ে আসছে। চাকর হয়ে গেছে বউয়ের। চাকর।”

ববি চোখ বুজে রাগ কন্ট্রোল করছে। কোনো রূপ রিয়েকশান করছে না। হেমা ও সাহেরা খাতুনের সাথে তাল মিলিয়ে বলল,,,

“আম্মু দেখবে, ঐ মেয়ে দুইদিনে তোমার ছেলেকে হাত করে নিয়েছে। ঐ মেয়ের কমান্ডেই তোমার ছেলে এখন উঠবে আর বসবে।”

খায়রুল আহমেদ তেজী দৃষ্টিতে ববির দিকে তাকিয়ে বলল,,

“রুমে কোনো খাবার দেওয়া যাবে না ববি। খেতে হলে সবার সামনে বসে খেতে হবে নতুবা উপোস থাকবে। এসব সার্ভেন্টদের কাজ ছেড়ে দাও বুঝেছ?”

ববি প্রচন্ড রেগে খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে সোজা রুমে ঢুকে রুমের দরজা আটকে দিলো। জিনিয়া আহমেদ পিছন থেকে অনেক ডেকে ও ববিকে ফেরাতে পারেন নি। সাহেরা খাতুন ও না খেয়ে খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে রুমে ফিরে গেলেন। হেমা এবং খায়রুল আহমেদ অল্প একটু খেয়ে নিজেদের রুমে চলে গেলেন। জিনিয়া আহমেদ লুকিয়ে প্লেইটে খাবার বেড়ে ববির রুমের দরজা ধাক্কাতেই ববি প্রখর চেঁচিয়ে বলল,,

“খাবো না মামানী প্লিজ। খাবারটা নিয়ে যাও। রিকুয়েস্ট করছি। প্লিজ লিভ মি এলোন।”

জিনিয়া আহমেদ মন খারাপ করে চলে গেলেন। ববি রুমের লাইট নিভিয়ে লিলিকে বুকে নিয়ে নিশব্দে শুয়ে পড়ল। লিলি হাঁসফাঁস করছে আর ছোট আওয়াজে ববিকে বলছে,,

“ববি আপনি কি না খেয়ে চলে এসেছেন?”

ববি গলা জড়ানো স্বরে বলল,,

“হুম।”

“কেনো খেলেন না? রাত কতো বড় জানেন? আপনার যদি ক্ষিদে পেয়ে যায়?”

“তোমার ক্ষিদে পেলে বলো, কিচেন রুম থেকে খাবার নিয়ে আসব।”

“আমি তো বেশিরভাগই রাতে খাই না। চিন্তা করবেন না। আমি অভ্যস্ত।”

ববি গলা জড়ানো স্বরে লিলিকে টাইট করে ঝাপটে ধরে বলল,,

“একটা ঠিক ঠাক জব পেয়ে নেই, তখন তোমার না খাওয়ার অভ্যেসটা আর থাকবে না!”

লিলি স্থির দৃষ্টিতে ববির দিকে তাকাল। ববি লিলির গালের দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বলল,,

“ব্যাথা আছে আর?”

লিলি ডানে বায়ে মাথা নাঁড়ালো। ববি আচমকা লিলির ডান গালটায় দীর্ঘ একটা চুমো খেয়ে বলল,,

“গুড নাইট।”

“আপনি কি এভাবেই আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমুবেন?”

ববি মাথা নাঁড়ালো।

“কিন্তু আমি তো এভাবে ঘুমুতে পারব না।”

লিলিকে ছেড়ে ববি অন্য পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ল। লিলি ও স্বস্তি পেয়ে চোখ জোড়া বুজে নিলো। সেই ঘুম ভাঙ্গল লিলির ফজরের আযানের মুখরিত প্রতিধ্বনিতে।

#চলবে…..?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here