প্রেমময়_বসন্তের_আগমন #পর্বঃ২ #বর্ষা

#প্রেমময়_বসন্তের_আগমন
#পর্বঃ২
#বর্ষা

রাত্রিবেলা চারপাশ ক্ষিণ্ন কুয়াশাচ্ছন্ন। শহরাঞ্চল তো তাই এমন স্বল্প শীতের প্রভাব এই শীতকালেও। ক্ষিণ্ন কুয়াশার মাঝেও শীতটা যেন রাস্তায় চলমানরত মানুষেরা বেশ বুঝতে পারছে।খান ভিলার সামনে বেশ অনেকক্ষণ বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওয়াজিহা। দারোয়ান চাচাকে নাকি বড় মালিক নিষেধ করেছেন গেট খুলতে এত রাতে কেননা চোর উপদ্রবও তো সুযোগের সৎ ব্যবহার করে ঢুকে পড়তে পারে। ওয়াজিহা যেন কথাটায় অনেক মজা পায়।এত রাতে গেট খুললে সমস্যা হতে পারে ওনাদের আর আজ ওয়াজিহা সারারাত বাইরে থাকলেও তাদের কোনো আপত্তি নেই।কত ভালো ফ্যামিলি তাই না!

ওয়াজিহা বাইকে হেলান দিয়ে ভিলার সামনের পোড়া বাড়িটার দিকে তাকিয়ে গুণগুণিয়ে গান গাইতে থাকে।এই বাড়িটায় ওর কখনো যাওয়া হয়নি। অবশ্য আগ্রহই হয়নি ওর কখনো।আজ হচ্ছে কেননা সারারাত তো আজ বাইরে কাটালে বাড়ির মানুষদের সমস্যা নেই তাই সে আজ নতুন কিছু এডভ্যান্চার করাকেই গুরুত্ব দেবে।

মোবাইল হাতে নিয়ে গেটটা একদিকে হালকা ঠেলে দিতেই দরজাটা নিচে পড়তে নিয়েও আটকে যায়।বাড়িটা অনেক পুরনো।লোকমুখে শোনা এই বাড়িতে নাকি সন্ত্রাসী হামলা হয়েছিলো।তারাই নাকি আগুন লাগিয়েছিলো এ বাড়িতে। মির্জা বংশের পিয়াল মির্জা তার পরিবার নিয়ে উত্তরার এই অংশে বাড়ি তুলেছিলো।সবাই মরে গেলেও নাকি এই বাড়ির উত্তরাধিকার বেঁচে আছে তাই নাকি এখনো এই বিশাল সম্পত্তি সরকার কর্তৃক কব্জা করা হয়নি।

ফ্লাস লাইটের আলোতে সামনের দিকটায় আগাতে গিয়েও উষ্টা খায় ওয়াজিহা।পায়ে হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়ে।লং শার্ট আর জিন্সের সাথে ওড়না পরিহিত সে।পর্দা না করলেও মোটামুটি শালীনতা আছে তার পোশাকে।ঘাড়ের ওপর দিয়ে এমন করে দুপাশে ওড়না ফেলেছে যে হিজাব করে বুক করা ফ্যাশন থেকে তা বেশ ভালোই বলা যায়।

ওয়াজিহা পায়ের দিকে ফ্লাস লাইট ধরে দীর্ঘদৃষ্টিতে তাকিয়ে।লাল রক্ত যেন তার সাথে কথা বলছে।এমন ঘটনা তার সাথে আগেও হয়েছে এমনই মনে হচ্ছে ওয়াজিহার।মাথাটা ধরে গেছে ওর।মাথা দু’হাতে চেপে ধরে উঠে দাঁড়ায় ওয়াজিহা।মাথাটা চক্কর দেওয়ায় পড়ে যেতে নিয়েই সামনের ওয়াটার ড্রপাটারটারের ছোট্ট দেয়ালটা ধরে নেয় সে‌। ওয়াজিহার চোখে ভাসছে কিছু দৃশ্য।

”বাবাই,বাবাই আমাকে মাম্মা ধরতে পারে না ”

হাস্যোজ্জল এক মিষ্টি বাচ্চা মেয়ে ছুটে চলেছে।লাল রঙের টপসের সাথে জিন্স আর গলায় একটা স্কার্ফ।বয়স ছয়/সাত হবে হয়তো।মেয়েটার পেছনে একজন সুন্দরী রমনী ছুটছেন।বয়স আন্দাজ করা অনেকটাই কঠিন।

” সোনা.. এভাবে ছোটে না পড়ে যাবে তো!”

”তুমি আমায় ধরতে পারোনি মাম্মা!”

বাচ্চাটা খিলখিলিয়ে হাসে।মহিলাটাও হাসতে হাসতে ছুটে এগিয়ে আসতে নিলেই ধরাম করে এক শব্দ হয়।মেন গেট দিয়ে বন্দুক হাতে কতগুলো মানুষ ঢুকছে।যাদেরই একটা গুলি লেগেছে বাচ্চাটার মাম্মামের গায়ে।তারপর…তারপর

ওয়াজিহা মাথা আরো জোরে চেপে ধরে।আর কিছু সে দেখতে পারছে না।মাথা ব্যথাটা প্রচন্ড থেকে প্রচন্ডতর হচ্ছে।ওখানেই একটু সময় বসে থেকে মাথাটা একটু হালকা হতেই বাড়িটার দিকে একবার তাকিয়ে বাড়ির বাইরে থেকেই চলে আসে।বাগান অব্দি গিয়েই ওর এঅবস্থা,বাড়ির ভেতর গেলে কি অবস্থাটা নাই হবে!

বাড়ির বাইরে এসে হাত-পা ছেড়ে নেয় ওয়াজিহা।দরজার জং গুলো ওর পোশাকে লেগেছে। পাশাপাশি লেগেছে ধুলোবালি। গোসল করা আবশ্যক। ওয়াজিহা ওদিক ওদিক তাকিয়ে বাইকটা গেটের কাছে পার্ক করে দেয়াল টপকানোর জন্য ফন্দি আটতে থাকে।বুদ্ধি পেয়েও যায়। অনেকক্ষণ সুক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণের পরই না দেয়ালের ত্রুটিআংশ পাওয়া এবং দেয়াল টপকানো।হাত ছিলে যায় ওয়াজিহার।বাড়ির কুকুরটাও ওর হঠাৎ দেয়াল টপকানোতে চিৎকার করতে শুরু করেছে।তবে ওয়াজিহাকে দেখেই নিশ্চুপ হয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।হয়তো ওয়াজিহার দুঃখটা বোঝার চেষ্টা করছে।

বাগানের পেছনের দিকটার আম গাছে চড়েই নিজের বারান্দায় পৌঁছায় ওয়াজিহা।রুমে এসেই সুন্দর একটা সুবাস পায়। হাসনাহেনা ফুলের সেন্ট হয়তো।রাহমি তো শৌখিন মানুষ তাই নিজেই নিজের সেন্ট বানানোর জন্য প্রায়ই আবিষ্কারের চেষ্টা করে।এবার হয়তো সফলতা পেয়েছে। ওয়াজিহা লক্ষ্য করে রাহমি ওর ঘরে বসে কিছু একটা করছে।মেয়েটা এতো পরিমাণ এরোগেন্ট যে বলার বাইরে। সম্পর্কে ওয়াজিহার বোন হয় সে।তবে রাহমি যে এককথায় ওয়াজিহাকে দেখতে পারে না তা নিঃসংকোচে বলা যায়। ওয়াজিহা আগে রাহমি আপন করতে চাইলেও এখন আর চায় না।সে এখন শুধু তাদের চায় তার জীবনে যারা তাকে চায়!

”রাহমি কার পার্মিশনে আমার রুমে এসেছো?”

ওয়াজিহার কথায় রাহমি দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে দরজা লাগানো।ভয় পায়।তবে কিঞ্চিত ব্যবধানে বারান্দায় তাকিয়ে ওয়াজিহাকে দেখে মুখ ভ্যাংচি দিয়ে বলে,

”তোর মতো চোর না যে চুরি করতে আসবে বারান্দা দিয়ে!”

”ওহ রিয়েলি বেবি?তা ঘরটা কি তোমার যে আমি বারান্দা দিয়ে আসায় চোর হয়ে গেলাম।ঘরটা যেহেতু আমার আমি যেকোনো দিক দিয়ে আসতে পারি।সে হিসেবে তুমি তো চোর।কি কি চুরি করলে?”

রাহমি রেগে আগুন হয়ে যায়।তেতে উঠলেও নিজেকে সামলে নেয়। বাঁকা হেসে বলে-

”আদৌ এই পরিবার তোর নাকি সেটা খুঁজে দেখ।তারপর আমার রুম,আমার রুম করিস।যেখানে বাবা তোর জন্য গেটই খোলেনি সেখানে এই রুমে যে তোকে কিভাবে থাকতে দেয় ভাবার বিষয়!”

রাহমি নিজের জিনিসগুলো নিয়ে চলে যায়। ওয়াজিহা দাড়িয়ে থাকে ঠাঁই। কথাগুলোর উত্তর ও নিজেও চায় তবে ভয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয় না।যদি সত্যিই এ পরিবার ওর না হয় তখন!এখন তো তাও পরিবারের ছায়া তলে আছে,তখন তো সে পুরোই মুক্ত পাখি হয়ে যাবে। এমনিতেই সে এত ছন্নছাড়া, অগোছালো, বেপরোয়া;রাহমির বলা দিকগুলো বিবেচনায় আনলে সত্যি খুঁজে পেলে সে যদি আরো বেপরোয়া, ছন্নছাড়া হয়ে ওঠে তখন!এখন তো তাও ভালোবাসাহীন,স্নেহহীন পরিবার আছে;তখন তো কেউ থাকবে না ওর!

ভাবনাদের মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে গোসলে ঢোকে সে। বাথটাবে নিজেকে ডুবিয়ে দেয়। উপলব্ধি করার চেষ্টা করে দমবন্ধকর মৃত্যু যন্ত্রণা।বেশ আনন্দ পায় এখেলায় সে। ছোট বেলাটা যতটুকু তার স্মৃতিতে আছে তার মধ্যেকার একদিনে সে স্মরণ করতে পারে যে ছোট-মা তাকে পানির মাঝে চুবিয়ে ছিলো কেননা তার একটা পছন্দের শাড়ি নিয়ে ওয়াজিহা খেলেছিলো। অবশ্য শাড়িটা ছাদে মেলা ছিলো।তখনই চুপিচুপি ওয়াজিহা গিয়ে সে শাড়ি পড়ার চেষ্টা করতে গিয়ে ময়লা করে ফেলছিলো।আর বাড়ির সাহায্যকর্মী রুবা তা ছোট-মা সাহারার কানে লাগিয়েছিলো।সেদিন পানিতে চুবানি খাওয়ার পরও কতই না গালিগালাজ শুনতে হয়েছিলো তাকে।

ভার্সিটিতে আজ বেশ আলোচনা হচ্ছে। জুনায়েদ স্যার নাকি র্যাগিং গ্যাংকে ইচ্ছে মতো মেরে তারপর পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে। অবশ্য এখনও পুলিশ যায়নি।যেই জুনিয়ররা এতদিন এদের ভয়ে সিটিয়ে থাকতো।তারা নালিশ জানাচ্ছে পুলিশের নিকট। জুনায়েদ স্যারকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে সবাই।

ওয়াজিহা সব পরখ করলো।মনে মনে জুনায়েদের জন্য আফসোস করলো। কেননা ভার্সিটিতে পুলিশ আনায় ভার্সিটি কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত ওনাকে বের করে দিবেন। ওয়াজিহা আর ভাবে না। ভার্সিটি থেকে জুনায়েদ স্যারকে সে বের করতে দেবে না। কেননা তার কারণ সে কারো ক্ষতি হোক সেটা চাইবে না।

ওয়াজিহা ক্লাসের উদ্দেশ্যে যেতে নিতেই জুনায়েদ ওকে আটকায়।বলে-

”মিস.খা….আই মিন ওয়াজিহা আমি বুঝতে পেরেছি আপনার কালকের কথাগুলোর মাহাত্ম্য।আমি আমার কালকের ব্যবহারের জন্য ক্ষমাপ্রাথী।আমি আপনাদের ভার্সিটি ছেড়ে দিচ্ছে।আমার মতো থার্ডক্লাস মেন্টালিটির মানুষ শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা রাখে না।”

”স্যার আপনি ওভার রিয়েক্ট করছেন। মানুষ মাত্রই ভুল। মানুষ ভুল করবে সুধরাবে এইতো জীবন।তাই বলে এতো ভালো চাকরিটা ছেড়ে দেওয়া আপনার সম্পূর্ণ বোকামি!”

”আপনার কি মনে হয় কতৃপক্ষ এই ঘটনার পর আমাকে এই ভার্সিটিতে রাখতে চাইবে? তাদের কিছু বলার পূর্বে নিজে থেকেই জবটা ছেড়ে দিবো..এই কি ভালো নয়!”

এবার ওয়াজিহা চুপ করে যায়।এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে বলার মতো কিছু পায় না সে।তবে তার কারণে কেউ শাস্তি পাক তাও সে চায় না। ওয়াজিহা জুনায়েদকে কিছু বলতে নিবে তার পূর্বেই সে চলে যায়। ওয়াজিহা পেছন থেকে ডাক দেওয়ার পূর্বেই তানিশা দৌড়ে এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ওকে।

ওয়াজিহা পেছনে ফিরতে দেখতে পায় রাব্বি,সিহাব ওরাও আছে।সিহাব বিশ্বজয়ের হাসি ফুটিয়ে বলে,

”তুই তো এক ঢিলে তুই পাখি মারলি ওয়াজিহা!প্রথমত আমাদের তানিশার বদলাও নিলি। দ্বিতীয়ত ওই হারামীগুলোকে তানিশার নাম জড়াতে না দিয়েই জেলে পাঠালি।এক্সিলেন্ট!”

”বাট স্যারের হয়তো চাকরিটা চলে যাবো!”

”তাতে তোর কি?”

তানিশার প্রশ্নে ওয়াজিহার মনেও প্রশ্ন জাগে তাতে ওর কি! কিঞ্চিত ভাবনার পরেই ওর হৃদয় জানায় মনুষ্যত্ববোধটা তার এখনো মরেনি তাই সে নিজের জন্য অন্যের চাকরি চলে যাওয়া দেখতে পারে না।ওয়াজিহা কারো সাথে আর কথা না বলে পা বাড়ায় কর্তৃপক্ষের অফিসের দিকে!

প্লেনের জানালা দিয়ে কেউ বাইরে তাকিয়ে।আকাশটা দেখছে।আকাশের বিশালতার মাঝে হয়তো কাউকে খুঁজছেও।পায়ের ওপর ম্যাগাজিনটা যত্নহীন পড়ে আছে।লোকটা চোখ বুজে কল্পনা করেন তার সবচেয়ে আনন্দময় করে তোলা দ্বিতীয় দিনটার।শত ভয়ের মাঝেও তিনি সেদিন হয়েছিলেন এক নতুন প্রাণের পিতা।বাচ্চাটা কি সুন্দর হয়েছে! নার্সদের এই বলাবলিতে তিনি ক্ষেপে গিয়েছিলেন।কি ধমকাধমকিই না করেছিলেন তাদের!

দিনগুলো কাটতে লাগলো।নতুন প্রাণটাও বাড়তে লাগলো।একবছরে পা রাখলো।আধো আধো বুলিতে মাম,বাবাই বলে ডাকতো।মা পাগলা হয়েছিলো বাচ্চাটা।মায়ের মাঝেই যেন নিজেকে লুকাতে চাইতো সে। মা’কে জ্বালাতো না তবে মায়ের সাথে মিলে বাবাইয়ের সাথে প্রচুর দুষ্টুমি করতো বাচ্চাটা।

অতীত ভেবে চোখের চশমাটা খুলে চোখ মোছেন মাঝবয়সী লোকটা। অবশ্য মাঝবয়সী হলেও শরীরের গঠন বেশ শক্তপোক্ত।এখনও হয়তো দু’তিনজনকে মেরে কাত করতে পারবে।

পাশের সীটে ওসমান বসেছে। অর্থাৎ লোকটা আর কেউ নয় বরং ওসমান মালেকের স্যার!লোকটা কেন আসছে বাংলাদেশে?কি কাজই বা করে সে যে তার বডিগার্ড সাথে?

চলবে?

বিঃদ্রঃ আসসালামু আলাইকুম পাঠকগণ।আজকে আমার শেষ পরীক্ষা ছিলো।তাই কালকে পড়াশোনাটা একটু বেশিই করতে হয়েছে।তাই আর সম্ভব হয়নি গল্প দেওয়াটা।তবে ইনশাআল্লাহ পরবর্তী পর্বগুলো যথাসময়ে এবং রাত্রিবেলায় পেয়ে যাবেন। আপনাদের গঠনমূলক মন্তব্যের অপেক্ষায় থাকবো! ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো।

পূর্ববর্তী পর্বঃ
https://www.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/924408432614263/?mibextid=2JQ9oc

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here