নিরুদ্দেশ ২য় খন্ড পর্ব ২৮

নিরুদ্দেশ ২য় খন্ড
পর্ব ২৮

সাথী কিছুক্ষণের জন্য সবুজের সাথে দেখা করার অনুমতি পেয়েছে। বাইরে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করল না। সামনের দিকে এগোলো। যতই এগোতে রইল ততই বুকের ধুকপুকানি বাড়তে থাকলো। অনেক দিনের পর সবুজের সাথে দেখা হবে। তাকে আজ চিনতে পারবে তো? শেষবারের মতো যখন দেখা হয়েছিল তখন সে ছিল কিশোরী। বর্তমানে সবকিছু বদলে গেছে। রহস্যময় ভাবে আজ তাদের সাক্ষাৎ হবে। নিজের প্রতি বিদ্বেষ চলে এলো। কেমন কেমন লাগছে। সবকিছু বিশৃংখল মনে হচ্ছে। ধীর পায়ে এগিয়ে গেল। দূর থেকে সবুজকে খেয়াল করলো। ঢিলেঢালা একটা পোশাক পরে বসে আছে। ছোট্ট একটা জানালা দিয়ে মিহি আলো আসছে। জানালার বাইরে তার চোখ। তবে তার চোখ যে প্রকৃতি উপভোগ করতে পারছে না বোঝা যাচ্ছে। কারণ বাইরে বিল্ডিং এর পর বিল্ডিং। এই ছেলেটা প্রকৃতি না হলে থাকতে পারতো না। একটা ঘরে খুব বেশিদিন থাকতো না। বাইরের জগৎ বারবার আকর্ষণ করতো। মায়ের কোল থেকে বেশি প্রিয় ছিল প্রকৃতি। অজানা কারণে সাধারণ মানুষ আর প্রকৃতির সঙ্গে এক হয়ে যেত। নিষ্ঠুর ভাগ্যক্রমে আজ সে এক ঘরে বন্দী। বিধাতার কেমন লিলা! বাইরে ঠায় দাঁড়িয়ে সবুজকে দেখে গেল। তাকে ডেকে তোলার ইচ্ছা নেই। কথা বলার ইচ্ছাটাও মরে গেছে। কি বলবে তাকে? সে যদি একবার জিজ্ঞেস করে, সাথী তুমি আমাকে ছাড়া ভালো আছো? তখন কি উত্তর দেবে? বলবে তোমার কথা এখন খুব মনে পড়ে। কিন্তু সবুজ কি বিশ্বাস করবে? সে যদি জিজ্ঞেস করে, সাথী তুমি সেদিন আমায় ছেড়ে গেয়েছিলে কেন? বলতে পারবে শুধুমাত্র ভালো থাকার জন্য আরও দিগুন ভালো কিছু পাওয়ার জন্য তাকে ছেড়ে চলে গেছিল। লোভ লালসা উচ্ছ্বাস আকাঙ্ক্ষা তাকে তাড়িয়ে বেড়িয়ে ছিল। ওই সময় শুধু ছুটে বেড়িয়েছে। ছুটতে ছুটতে বুঝেছে লোভ-লালসা শুধুমাত্র ক্ষণিকের জন্য। ভালোবাসা কাছে লোভ লালসা নগণ্য এক জিনিস। নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। যখন বুঝতে পারলো তখন সময় শেষ। ফিরে আসা সম্ভব নয়। তাই আসেনি। কিন্তু সবুজ কি সব বুঝবে? হয়তো সাথীর সমস্ত আবেগময় কথাবার্তা তার কাছে অভিনয় মনে হবে। মনে হওয়াই স্বাভাবিক। অনেকক্ষণ দাঁড়ানোর পর সাথী সবুজকে ডাক দিল। ঘাড় ঘুরে সাথীকে দেখলো। অনেক বছর দেখা হয়নি। মুখের আদল সম্পূর্ণ বদলে গেছে। তবে চিনতে অসুবিধা হলো না। আবার বুকের মধ্যে কোনো রূপ উত্তেজনাও এলো না। প্রশমন রইল। ধীর পায়ে সাথীর কাছে এগিয়ে এলো। রূপের বেশ পরিবর্তন ঘটেছে। শরীরের মধ্যে গৃহিণীপনা চলে এসেছে। এখন আটপৌরে কিশোরী নেই। সে এখন লাবণ্যময়ী সুন্দর রমনীও নয়। প্রচুর পরিবর্তন ঘটেছে। চোখেমুখে কিছুটা মাতৃত্বের কোমলতা ফুটে উঠেছে। জীবনটা কেমন যেন! কয়েকটা বছরে সবকিছু বদলে গেছে। যার সঙ্গে দিনের অর্ধেকটা সময় কাটতো। মাথার মধ্যে যে সবসময় ছিল কিছু বছর পর সে দূরে কোথাও চলে যায়। তাকে আর মনে পড়ে না। আর তার কথা ভেবে হাসে না। দেখা করার ইচ্ছে জাগে না। সবকিছু শান্ত ধীর মনে হয়। যাকে নিয়ে সারা জীবন বাঁচবে বলে সিদ্ধান্ত নেয় একটা সময়ের পর তার প্রতিও বিরক্ত চলে আসে। সবুজের এই মুহূর্তে এমনটাই হচ্ছে। এত বছর পর দেখা হলেও তার কোনো কৌতুহল হচ্ছে না বরং খুব বিরক্ত হচ্ছে। দেখা না হলেই ভালো হতো। সাথীর চোখের কোণায় জল চিকচিক করছে। চোখের জল সবুজকে নরম করলো। সাথী জিজ্ঞেস করল,’কেমন আছো?’
‘ঠিক আছি। তুমি কেমন আছো?’
‘ভালো, তোমার কষ্ট হচ্ছে না!’
‘না তো, ঠিক আছি।’
অতীত জিজ্ঞেস করার সাহস নেই সাথীর। জিজ্ঞেস করে লাভ কি? শুধু শুধু সবুজকে কষ্ট দেওয়া হবে। সবুজ খুন করেছে। কেন খুন করেছে তা অজানা নয়। সবকিছু জানার পরও তাকে নতুন করে জিজ্ঞেস করার কোনো অর্থ হয় না। জিজ্ঞেস না করলে কি বলবে? কি কথা বলার আছে? থমকে যাবে মুখের ভাব প্রকাশ। দীর্ঘদিনের পর তাদের দেখা হয়েছে। কত কথা জমে ছিল। কিছু বলতে পারলো না। কিছু বছর আগে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতো কিছু বলার জন্য। মানুষটাকে সামনে পেলে থামতো না। কথাগুলো ভুলে যাবে বলে খাতায় লিখে রাখতো। তাকে সবকিছু বলার জন্য কত আশায় বসে ছিল। তাকে রোজ রাতে মনে পড়ে। যখন দেখা হল কিছু বলতে পারলো না। একে অপরের দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে রইল। তাকানোর মধ্যেই অদৃশ্য এক ভাব বিনিময় হলো। একে অপরকে আয়ত্ত করতে পারল। ক্ষমা করে দিল। সাথী হালকা কন্ঠে বলল,’এমনটা কেন হয়ে গেলে? তুমি এমনটা হতে পারো ভাবা যায়? অধর্মের ভয় পেলে না! সামান্য চুমু খেতে চাইলে ভয় পেতে,আর…..!’
‘শরীরের ঔদ্ধত্য কাছে সবকিছু হার মানে। তখন আশেপাশের কিছুই চোখে পড়ে না। সবকিছু অন্ধকার অন্ধকার লাগে। আমরা যখন পিঁপড়াকে মেরে ফেলি তখন কি আমাদের মধ্যে অনুতাপ হয়। হয় না। কিন্তু তারও তো প্রাণ আছে। আমি যখন কাউকে মারতে উদ্যত হই তখন আমার বিবেক থেকে অনুতাপ শব্দটি হারিয়ে গেছিল। নিজেকে সব কিছু মনে হচ্ছিল। আমি বাদে সবকিছু তুচ্ছ। আমি সর্ব শ্রেষ্ঠ।’
‘তা বলে খুন করে ফেলবে?’
সবুজের চোখ দুটো ভেজা। এমন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা ঠিক হচ্ছে না। থাক যা হবার হয়ে গেছে। এত ভাবার কি আছে? এমনিতে সে বন্দী আছে। তাকে সবকিছু মনে করিয়ে তার কষ্ট বাড়িয়ে লাভ কি? দ্রুত প্রসঙ্গ পাল্টালো। খেয়াল করল তার চোখেও জল। শাড়ির আঁচল দিয়ে জল মুছে ফেলল। বলল,’ছোটোবেলার কথা মনে পড়ে?’
‘পড়বে না কেন? খুব মনে পড়ে।’
‘আমার কথা মনে পড়ে?’
‘কখনো কখনো।’
‘আমি শুধু জিজ্ঞেস করে যাচ্ছি। তুমি কিছু জিজ্ঞেস করবে না?’
‘জিজ্ঞেস করার মতো কিছু নেই।’
‘রাগ করে আছো এখনো!’
‘তুমি ভালো করে জানো আমি কারোর উপর রাগ করি না।’
‘বদলায়নি দেখছি।’
‘আর কিছু বলবে?’
‘অনেক দূর থেকে ছুটে এসেছি তোমার সঙ্গে সামান্য কথা বলার জন্য। আর তুমি তাড়িয়ে দিচ্ছ?’
‘হ্যাঁ, তাড়িয়ে দিচ্ছি।’
‘তুমি আর আমাকে ভালোবাসো না!’
‘বাসি তো কিন্ত ভালোবাসার অজুহাত দিয়ে মনের বিরুদ্ধে কিছু করতে চাই না।’
‘তোতাকেও ভালোবাসো?’
‘বাসি!’
‘কেমন পুরুষ তুমি? দুটো নারীকে একসঙ্গে ভালোবাসা?’
‘আমি নিজেও জানি না। কিন্তু স্বীকার করতে অসুবিধা নেই আমি দু-জন নারীকে ভালোবাসি। তোমার প্রতি ভালোবাসাটা তীব্র। তোমার জন্য শিরায়-উপশিরায় বারুতের বিস্ফোরণ ঘটে। সবকিছু ছেড়ে তোমাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে পারি। কিন্তু তোতার ক্ষেত্রে হয় না। তার প্রতি ভালোবাসা শান্ত আর ধীর।’
‘কি অদ্ভুত তুমি!’
‘যাইহোক, তুমি এখানে এসে ঠিক করোনি। ফিরে যাও। আমার স্ত্রী জানতে পারলে কষ্ট পাবে। আমি তাকে কষ্ট দিতে চাই না। তার আজকে আসার কথা আছে। ফিরে যাও।’
‘বারবার ফিরিয়ে দিচ্ছো কেন?’
‘ফিরিয়ে দিচ্ছি না তাড়িয়ে দিচ্ছি। চলে যাও। আর আশার চেষ্টা করো না। এলেও আমি দেখা করবো না।’
‘খুব বদলে গেছো তুমি?’
‘বদলে যেতে অনেক সময় লেগেছে। তুমি তো মুহুর্তের মধ্যে বদলে গেছিলে। বদলে যাওয়াটা তোমার কাছ থেকে শিখেছি।’
‘তখন আমার বয়স অল্প ছিল। আবেগের বশে কি সব করে ফেলেছি। এত কিছু ভাবিনি।’
‘ভালোবাসার একটা অংশ আবেগ। আবেগ কে অসম্মান করো না তাতে ভালোবাসাকে অসম্মান করা হবে। আবেগ ছিল বলে ভালোবাসতে পেরেছিলে আবেগ না থাকলে ভালোবাসতে পারতে না। এখন নিজেকে আড়াল করে আবেক কে দোষারোপ করো না। নিজের দিকে তাকাও। দোষ স্বীকার করো। তাতে ভালো থাকবে।’
সাথী কিছু বলতে পারল না। চোখ থেকে জল ঝরে পড়লো। সে সরে আসলো। যাওয়ার আগে বলল,’ভালো থেকো।’ ধীর পায়ে বেরিয়ে গেল। আর ঘুরে তাকালো না। সবুজও ফিরে তাকালো না। থানা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল এমন সময় একজন ভদ্রমহিলার মুখোমুখি হলো সাথী। তাকে চিনতে অসুবিধা হয়নি। মহিলাটি তোতা। এবার সাথী পেছনে ঘুরলো। তোতাকে লক্ষ করল। সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে তোতাকে অনেকবার দেখেছে। কিন্তু তোতা কখনো সাথীকে দেখেনি। তাই সে চিনতে পারেনি। হয়তো সবুজের মুখ থেকে তার কথা শুনেছে। কষ্ট পেয়েছে। আজ মুখোমুখি হয়েও কথা বলার সৌভাগ্য হলো না। সাথীর হৃদয়েয় সূক্ষ্ম ব্যথা শুরু হলো। বিচ্ছেদের কষ্ট খুব বেশি না। কিন্তু যে মানুষটা একসময় তার ছিল এখন অন্য কেউ তার উপর অধিকার ফলাচ্ছে। কোনো এক অচেনা মানুষ তার আদর যত্ন করছে। সে চাইলেও অধিকার ফলাতে পারছে না -কষ্টটা সেখানে। বিচ্ছেদের চাইতে প্রিয় মানুষটার উপর অধিকার হারানোর কষ্ট অনেক বেশি। এখান থেকে শুরু হয় যন্ত্রনা। খুব সহজে সেখান থেকে বেরিয়ে আসা যায় না। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। চাইলে কিন্তু সে আজ সবুজের কাছে থাকতো। তাদের ছোট্ট একটা সংসার হতো। কিন্তু সে নিজেই চায়নি। ভালো কিছু চাইতে গেয়ে ভালোটাকে হারিয়ে ফেলেছে। জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত এখন আফসোস ছাড়া আর কিছু নেই। সময় থাকতে আপন না হয়ে দূরত্ব বাড়িয়েছে। আমরা যেগুলোকে সাধারণ ভেবে ফেলে দেই সেগুলো কেউ তুলে নেয় অসাধারণ ভেবে। পৃথিবীর প্রত্যেকের গুরুত্ব রয়েছে। শুধু ব্যবহার করতে জানতে হয়।
তোতাকে দেখে সবুজের মুখে হাসি ফুটেছে। মাঝেমধ্যে সবুজ অবাক হয় মেয়েটাকে দেখে। কত ভালোবাসে তাকে। এতকিছুর পরও চলে যায়নি। কালো জগৎ মেনে নিয়েছে। সে জানে সবুজ কখনো জেল থেকে ছাড়া পাবে না। তবুও তার অপেক্ষায় বসে আছে। অনিশ্চিত অপেক্ষা কতটা যন্ত্রণাদায়ক কেউ কি জানে? তোতা হয়তো জানে। যন্ত্রণা সহ্য করার শক্তি তার মধ্যে রয়েছে। নারীরা যে এত তীব্রভাবে ভালোবাসতে পারে জানতো না। যার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ রয়েছে আর সে পড়ে রয়েছে এখন অনিশ্চিত আসামির অপেক্ষায়। হয়তো এটাই ভালোবাসা। ভালোবাসা মানুষকে নিঃস্ব করে। নিঃস্ব হয়ে গেছে তোতা। উদাশ চোখে একে অপরকে অনেক্ষণ তাকিয়ে রইল। মৃদু ভাব বিনিময় হয়ে গেল। এমন মূহুর্তে হয়তো কথা বলা যায় না। ঠোঁটে কথার অভাব পড়ে। শুধু তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগে। একেবারে শান্ত শীতল ভাবে দাঁড়িয়ে রইল। দুজনকে মুগ্ধ করল দুজনের স্নিগ্ধ মুখশ্রী। অনেকটা সময় কেটে যাওয়ার পর তোতা বলল,’কেমন আছেন রাজামশাই? দিনকাল কেমন যাচ্ছে?’
‘ভালো থাকবো বলে তো আপনি আমাকে এখানে পাঠিয়েছেন। অবশ্যই ভালো আছি।’
‘আপনি আমায় ভুল বুঝবেন না। আপনি আমাকে যেটা শিখিয়েছেন আমি সেটাই করেছি।’
‘জানি তো। তাই আপনার উপর রাগ করিনি। কিন্তু কি জানেন তো আমার এমন জীবন খুব ভয় করতো আর আমি পেলাম এমন জীবন। মানুষকে ভয় পেলে চলে না। তাকে সব কিছুর মোকাবিলা করতে হয়। তার ভয় পাওয়া উচিত নয়।’
‘আপনি আবার লিখতে শুরু করুন। তাতে ভালো থাকবেন।’
‘আমার লেখা আর কে পড়বে?’
‘চেষ্টা করুন। আপনি আবার পাঠকদের হৃদয় জয় করতে পারবেন।’
‘যে হৃদয়গুলোকে নিজের হাতে পুড়িয়েছি। সেগুলো আর ফিরে পাওয়ার আশা রাখি না। তাছাড়া আমি এখন আর লিখতে পারি না। কোনো চরিত্র আর মাথায় আসে না। সারাদিন শুধু আপনি থাকেন। কিন্তু আপনাকে নিয়ে লেখা যায় না। আপনাকে নিয়ে লেখা অসম্ভব। আপনার বর্ণনা হয় না। বর্ণনাতে শব্দের অভাব পড়বে। সৌন্দর্যের নৈপুন্যতা পূরণ করতে পারবো না’
‘ভালোবেসে ফেলেছেন?’
‘ভালো তো প্রথম থেকেই বাসি।’
তোতার সবুজের গালে হাত দিলো। চোখে জল জমা হয়েছে। মুছে দিয়ে বলল,’কাঁদবেন না। একদম কাঁদবেন না। আমি তো আছি সবসময়। কখনো মুখ ফিরিয়ে নেব না।’
‘ভয় তো সেখানে। আপনি আমাকে এত ভালবাসেন এটাই আমার ভয়। আপনাকে আমি কিছু দিতে পারলাম না।’
‘আমায় অনেক কিছু দিয়েছেন। আমি তাতেই সন্তুষ্ট। আর অভিযোগ করা বন্ধ করুন। এত অভিযোগ কিসের?’
দীর্ঘ সময় ধরে দুজন কথা বলল। বারবার ভাবনাহীন মন্তব্য দুজনকে অনেক খুশি করল। কিন্তু তারা চাইলে আগের মতো কথা বলতে পারবে না। সময়ের ব্যাপার রয়েছে। তোতা তাড়াহুড়ো করল। সবুজ শান্ত গলায় বলল,’খুব শূন্যতা অনুভব করছি। এত শূন্য কোথা থেকে এলো? কেউ একজন আমাকে নিয়ে খুব আফসোস করেছে। তারপর অভিমানে ফিরে গেছে।’
‘আমি তো আবার আসবো। আবার শূন্যতা ভরাট হয়ে যাবে।’
‘আমি এই শূন্যতার কথা বলছি না। আমার বুকে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে তা আর কখনো পূরণ হওয়া সম্ভব নয়। সে চলে গেছে। আর আসবে না।’ তোতা আঁতকে উঠল। কি বলছে সবুজ? তোতা যথেষ্ট সতর্ক ভাবে কথা বলেছে। সে কিছুতেই সবুজকে জানতে দেয়নি তার বন্ধু কয়েকদিন আগে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে। এই জগতে সবুজ মোটেও খুশি নয়। বন্ধুর মৃত্যু সংবাদ শুনলে সে আরও বেশি ভেঙে পড়বে।তাই গোপন করে রেখেছিল। কিন্তু সবুজ ঠিক বুঝতে পেরে গেছে। তার ভালোবাসা! সে বুঝতে পারবে না!
‘আপনি কি সবকিছু জেনে গেছেন? আপনাকে কে বলেছে?’
‘কেউ বলেনি। আমার মনে হচ্ছে সূর্যময় আর বেঁচে নেই।’ তোতার জলভর্তি চোখ তার ভাবনাকে বিজয়ী করল। সবুজ হু‌ হু করে কেঁদে উঠলো।

তোতা আর অপেক্ষা করতে পারল না। সময় শেষ। ফিরতে হবে। তার খুব কষ্ট হচ্ছে। তার রাজামশাই এর দু-চোখে জল। খুব কষ্ট পাচ্ছে। অথচ পাশে থাকতে পারছে না। সান্ত্বনা দিতে পারছে না। বুকে আগলে নিতে পারল না। ধীর পায়ে সরে এলো। বাইরে এসে অনেকক্ষণ বসে রইল। স্বাভাবিক হতে সময় লাগলো। একা বসতেই অতীত মাথার মধ্যে চেপে বসলো। সবুজের কষ্ট কখনো সহ্য হতো না। সে কষ্ট পেলে নিজে কেঁদে ফেলতো। অথচ তাকেই সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিয়েছে সে নিজেই। তার বন্ধু তাকে গ্রেফতার করতে চায়নি। ক্ষমা করে দিয়েছিল। কিন্তু সে পারেনি ক্ষমা করতে। কি করে ক্ষমা করতো? ক্ষমা হয় না। নিরীহ মানুষের প্রাণ নিয়েছে। তাছাড়া সবুজ তাকে শিখিয়েছিল কখনো অন্যায় করতে না। অন্যায় সহ্য করতে না। সব জায়গায় রুখে দাঁড়াতে। তাকে ক্ষমা করে দিলে বড়ো অন্যায় করতো। ক্ষমা করতে পারেনি। জীবনের কঠিন অধ্যায় মেনে নিয়েছে। শক্ত হতে হবে। ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছলো। উঠে দাঁড়ালো। পেছন ফিরে আবার একবার তাকালো। জীবনের এ কি পরিণতি? মানুষটার সঙ্গে যখন বিয়ে হয়েছিল কিংবা সদ্য মিশতে শুরু করেছিল তখন কি ভেবেছিলো মানুষটি একদিন কাউকে খুন করতে পারে? সম্পূর্ণ বদলে যেতে পারে? ভাবেনি। কিন্তু মানুষটা তেমনই হয়েছে। কি জীবন! বদলে যেতে খুব বেশি সময় নেয় না। ভাবনাহীন এই জীবনে যন্ত্রণা খুব বেশি গাঢ়। উদ্দেশ্যহীনভাবে বদলে গেছে। মন ভার হয়ে উঠে। বাড়িতে ফিরে এসে কোনো কাজ করতে পারল না। মন খারাপের সময় কথা বলার মতো মানুষের অভাব রয়েছে। রাধাশ্যাম বাবু ছোট ছেলেকে ত্যাগ করেছেন। উনার সম্মানহানি হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপকভাবে ভরাডুবি হয়েছে। জননী ছেলের এমন কীর্তির পর মুখ খোলেননি। তিনি শুধু কাঁদেন। আজকাল কারোর সাথে কথা বলেন না। রিপন ভাইয়ের এমন রুপে খুব বেশি অবাক হয়নি। সে যেন জানতো ছোট ভাইয়ের অন্তরের কুৎসিত হৃদয়ের কথা। তাই ভাইকে নিয়ে বেশি মাথা ঘামায় না। নিজেকে নিয়ে পড়ে রয়েছে। তার সম্মানহানি ততটা হয়নি। কারণ তার পরিচিতদের মধ্যে ভাইয়ের পরিচয় কখনো দেয়নি। অনেকেই তার ভাইকে চেনে না। বর্তমানে সে কাজে ব্যস্ত। গ্রামে প্রায় আসে না বললেই চলে। সবুজের জেল হয়ে যাওয়ার পর দুটো পরিবারের সম্পর্ক পুরোপুরি ছিন্ন হয়ে যায়। কিন্তু রাধাশ্যাম বাবু চাইছিলেন না তোতা এখানে আর থাকুক। সে ফিরে যাক। তার ভবিষ্যত রয়েছে। তোতা তো যায়নি। কারোর অনুরোধ শোনেনি। স্মৃতি আঁকড়ে পড়ে রয়েছে। স্বামীর প্রতি তীব্র ভালোবাসা রাধাশ্যাম বাবুকে মুগ্ধ করেছে। তিনি আগে কথা বলতেন না। এখন ছোট বৌমার সাথে বেশ কথা বলেন। অবাক হন। আবার আফসোসও করেন নিষ্ঠুর ভালোবাসার পরিণতি দেখে। ওর হাতে রান্নাও খান। তবে দুটো পরিবার এক হয়নি। পার্বতীর কোনো পরিবর্তন হয়নি। যেমনটা ছিল তেমনটা আছে। তোতাকে খুব ভালোবাসে। সময় পেলে দুজনে বসে গল্প করে। তাকে দুঃখ পেতে দেয় না। ভাইয়ের এমন কাজে ব্যাপক ভাবে বাকরুদ্ধ হয়েছে। মন থেকে মানতে পারছিল না। মানুষ কঠিনকে মানতে পারে না বলে মিথ্যাকে মানে। মিথ্যা বেশিদিন থাকে না। একসময় কঠিনটাকে মানতে হয়। সেও কঠিনটাকে মেনে নিয়েছে।
আজ পার্বতীর বাপের বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল। মন খারাপ হাওয়ায় নতুন বাড়িতে গেল তোতা। বারান্দায় বসে অভিমুন্য (পার্বতীর ছেলে) খেলা করছে। তার পাশে বসে দু-একটা কথা বলল। অভিমুন্যর মামার বাড়ি যাওয়ার কথা। এভাবে বসে আছে কেন? পার্বতী কোথায়? কখন যাবে? সন্ধ্যা হয়ে এলো তো! সে অভিমুন্য কে প্রশ্ন করল,’তুমি মামার বাড়ি যাবে না!’
‘না,মা বারন করেছে।’
‘সে কি কথা! তোমার মায়ের আবার কি হলো?’ তোতা ভাবলো তারা হয়তো এখন যাবে না পরে কোনো দিন যাবে। কিন্তু অভিমুন্যর পরবর্তী কথাতে খটকা লাগলো। পার্বতী একা যাবে আর ছোট বাচ্চাকে রেখে দিয়ে যাবে। এমনটা কেন? অভিমুন্যকে নিয়ে ভেতরে গেল। পার্বতী তৈরি হয়ে নিয়েছে। তোতাকে দেখে হাসি বিনিময় করলো।
‘কি ব্যাপার দিদি? একা যাচ্ছো ছেলেকে নিয়ে যাচ্ছো না কেন?’
‘ওর পড়াশোনা নষ্ট হবে। তোমার কাছে থাকুক না ক’দিন। বেশি দিন থাকবো না চলে আসবো।’
‘ও মা! এইটুকু তো বাচ্চা তার আবার পড়াশোনা!’
‘স্কুল কামাই করা একদম উচিত নয়।’ তোতা তার দিকে তাকাতে সঙ্গে সঙ্গে মুখ ঘুরিয়ে নিল। তার চোখ দেখে ফেললে তাকে বুঝে ফেলবে। চোখ যে কিছু লুকোতে পারে না। মনের সব ভাব প্রকাশ করে দেয়। তোতা মনে মনে হেসে ফেললো। পার্বতী নারী হয়ে আর একজন নারীর কষ্ট বুঝতে পারবে না তা কি হয়! সবুজকে হারিয়ে কতটা কষ্টে আছে পার্বতী তা ভালো করে জানে। এমন সময়ে একা থাকা খুব কষ্টের। অভিমুন্য সারাদিন এ-বাড়ি ও-বাড়িতে ঘুরতে থাকে। কাকিমার কাছে অনেক সময় থেকে যায়। তাতে তোতার মন ভালো থাকে। অনেক রাতে কাকিমার কাছে ঘুমিয়েও যায়। কয়েকদিন চলে গেলে তোতার মন খুব খারাপ হবে। তাই পড়াশোনার অজুহাত দেখাচ্ছে। তোতার চোখে জল চলে এলো। কোনোরকম সামলে নিল। মানুষটা কত ভালো! তাকে খুব সুন্দর ভাবে বুঝে ফেলে। অথচ একটা সময় সে সবুজের সাথে বেশি কথা বললে রেগে যেত। বহুবার বাঁধা দিয়েছে। আজ বুঝতে পারছে সে ভুল করেছে। তাদের সম্পর্কের মধ্যে কোনো খারাপ দৃষ্টি ছিল না। ভাই বোনের মতো ছিল। পার্বতী সুন্দর। খুব সুন্দর মেয়ে। পরিবারটা কত হাস্য উজ্জ্বল। যে পরিবারে সুখ বেশি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সে-ই পরিবারের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটা হারিয়ে যায়। আবার যে পরিবারে অশান্তি বেশি সে পরিবার থেকে কেউ হারায় না। কারণ পরিবারের মধ্যে সুখ সবসময় থাকে। কিন্তু ধরে রাখা যায় না। সুখের সাথে সাথে দুঃখ বজায় রাখার জন্য কাউকে থাকতে হয় নয়তো কাউকে চলে যেতে হয়।

পর্ব ২৯ আসছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here