নিরুদ্দেশ ২য় খন্ড পর্ব ২৭

নিরুদ্দেশ ২য় খন্ড
পর্ব ২৭

সাথী অনেক আগেই সবকিছু জেনে গিয়েছিল। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল সবুজ একদিনে তিন তিনটে খু*ন করছে। তাও আবার নিজের প্রিয় বন্ধু পত্নী এবং বাবাকে। বিশ্বাস করা শক্ত হলেও করতে হয়েছিল। সে শুধুমাত্র সাধারন নাগরিক ছিল না। সমাজে তার ভালো একটা পরিচয় ছিল। ভালোর মতো খারাপ দিকটাও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। তারপর সবুজের যখন সারা জীবনের জন্য জেল হয়ে যায় তখন সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। হঠাৎ করে তার মনের কোনো স্থানে নাড়া দিয়ে ওঠে কিশোরী বয়সে প্রেমের পুষ্পপঞ্চম। একটা সময় সে সবুজের চোখ দেখে ব্যাকুল হয়ে গেছিল। তাকে এক মুহূর্ত দেখার জন্য পাগল ছিল। সারাদিন ছটফট করে বেড়াতো। সুন্দর ভাবে সামলে নিতো সবুজ। সে-ই সব দিনগুলো খুব মিষ্টি ছিল। ভালো ছেলে ছিল সবুজ। তার সাথে অন্যায় করেছে সাথী -এখন স্বীকার করতে দ্বিধা বোধ করে না। কিন্তু তখন তো কিশোরী বয়স ছিল। আবেগ প্রাধান্য পেয়েছিল। এত কিছু ভাবেনি। তারপর থেকে সবুজের সঙ্গে দেখা করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেছে। সুযোগ হয়ে ওঠেনি। নিজের স্বামীকে কিছুতেই বুঝতে দেয়নি সবুজ তার পরিচিত। তার সাথে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। ততদিন থেকে সাথীর মন ভালো নেই। একটা সুযোগের অপেক্ষায় আছে। আজ সে-ই সুযোগ এলো। ললিত কাজের জন্য শহরের বাইরের গেছে। এক সপ্তাহ মতো বাইরে থাকবে। শ্বশুর-শাশুড়ি গেছেন ননদের বাড়িতে। সুবর্ণ সুযোগ হাতে এলো। সকালে উঠে তৈরি হয়ে নিল। ভোরের বাসে রওনা দিল কলকাতা থেকে মেদিনীপুরের উদ্দেশ্যে। আসতে আসতে মনে অনেক ভাবনার উদয় হলো। সবুজের সাথে কেন দেখা করতে চায়? আর তাকে যে সবুজের সাথে দেখা করতে দেওয়া হবে তার কোনো গ্যারান্টি কি আছে? কোন পরিচয়ে সে সবুজের সঙ্গে দেখা করবে? তাহলে কি এত দূর আসা ব্যর্থ হয়ে যাবে? ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না। যে কোনো উপায়ে তার সঙ্গে দেখা করতে হবে। না হলে এ জন্মে আর দেখা করা সম্ভব হবে না।
ওই রাতের কথা মনে পড়লে কেঁপে ওঠে সাথী। রান্না-বান্না শেষ করে সিরিয়াল দেখতে বসেছিল। চ্যানেল পাল্টাতে পাল্টাতে হঠাৎ করে খবরের চ্যানেলে চলে যায়। সেখানে সবুজকে দেখে চমকে ওঠে। আগে থেকে জানতো সবুজ বড়ো একজন লেখক হয়ে উঠেছে। বাঙালি পাঠকেরা তাকে নতুনভাবে দেখতে শুরু করেছে। এর জন্য আফসোসও হয় সাথীর। কিন্তু পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া এটা মেনে নিতে পারছিল না। কাঁদছিল না তবুও চোখ থেকে টপটপ করে জল ঝরে পড়েছিল।

সেদিন তৃধার সাথে কথা বলা শেষ করার পর কেঁপে উঠে সবুজ। খুব সাবধানের সঙ্গে কাজ করেছিল। তা সত্ত্বেও জানতে পেরে গেল। অথচ সেদিন সে কিচ্ছু করেনি। তার নামের পাশে একটা অপবাদে বসে যাবে। সবার প্রিয় সবুজ মাত্র কয়েক সেকেন্ডে সবার অপ্রিয় হয়ে উঠবে। সমাজের চোখে মুখ দেখাতে পারবে না। সবাই নোংরা শব্দ বলে গালি দেবে। তার উপর থুতু ফেলবে। তার ক্যারিয়ার এখানেই সমাপ্ত হবে। কিন্তু এগুলো তো হতে দেওয়া যাবে না। সবুজের রক্তে এক বর্বরতা জেগে উঠে। জীবনে যা যা চেয়েছিল তার সিকি ভাগও পায়নি। সে প্রথমে পড়াশোনা করে প্রতিষ্ঠিত হতে চেয়েছিল। অনেকদূর পড়তে চাইছিল। ক্লাসের সব সময় প্রথম হতে চাইছিল। বন্ধুকে কথা দিতে গিয়ে তা হয়নি। প্রথম প্রেম সাথী। তাকে বিয়ে করতে চাইছিল তাও হয়ে উঠেনি। শেষ পর্যন্ত তার লেখক জীবনে প্রভাব পড়তে চলেছে। এখানে কোনো রকম প্রভাব পড়তে দেওয়া যাবে না। অনেক কষ্ট অনেক স্ট্রাগল করে এখানে পৌঁছেছে। সবাই তার সাফল্যর কথা শুনে হাততালি দেয়। বাহবা দেয়। কিন্তু কেউ তার পেছনের ঘুমহীন রাত্রিগুলো দেখেনি। কতগুলো বছর সে কঠিন পরিশ্রম করেছে। কত প্রতারণার স্বীকার হয়েছে তা বলা সম্ভব নয়। প্রতিটা মুহূর্ত তাকে লড়াই করতে হয়েছে। কত রাত্রি কেঁদে কাটাতে হয়েছে তার কোনো ঠিক নেই। কঠোর পরিশ্রম করার পর সাফল্য পেয়েছে। এমনি এমনি সাফল্য আসেনি। আর ওই সাফল্য মাত্র এক সেকেণ্ডে মিলিয়ে যাবে -তা তো হতে পারে না। সম্মান বজায় রাখার জন্য সব কিছু করতে প্রস্তুত। তার এই সুন্দর জগতে আঘাত দিতে চলেছে জ্যোতির্ময় বাবু আর তৃধা। তাদেরকে সরিয়ে দিলেই তো হলো। কিন্তু তারা তো তার খুব প্রিয় মানুষ? তারা প্রিয় মানুষ ঠিকই তবে নিজের চেয়ে প্রিয় নয়। নিজের জন্য খুন করতে হবে। সময় নষ্ট করলে চলবে না। যা করার এক্ষুণি এবং নিখুঁত ভাবে করতে হবে। দেরি না করে বন্ধুর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। পেছনের দরজা দিয়ে ধীরে সুস্থে জ্যোতির্ময় বাবুর ঘরে আসে। সবুজকে ঘর্মাক্ত অবস্থায় দেখে অবাক হন তিনি। খুব চিন্তিত সে। হাত পা কাঁপছে। কিছু একটা অঘটন ঘটতে চলেছে তা বুঝতে বাকি রইল না। সবুজ ভেতরে গিয়ে জ্যোতির্ময় বাবুর সামনা সামনি বসলেন। কথা বেশি বাড়ালো না। ভারী কন্ঠে সবুজ বলল,’আপনার ছেলে আমার ছোটবেলা কেড়ে নিয়েছিল আর এখন আপনি আমার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কেড়ে নিতে চাইছেন!’ অবাক হলেন। সবুজ পৌঁছে কী সব কথা বলছে? সৌন্দর্য নেই, ভালোবাসা নেই? তড়িঘড়ি করে তিনি বললেন, ‘আমি তোমার ভবিষ্যৎ কেড়ে নিচ্ছে? আমি তোমার ক্ষতি চাই এটা কি করে ভাবলে?’
‘আমি যদি আপনার ক্ষতি চাইতে পারি। আপনাকে মারার জন্য ছু*রি ধরতে পারি তাহলে আপনি কেন আমার জন্য সামান্য খারাপ কিছু করতে পারবেন না?’
‘তুমি আমাকে মারবে?’ বেশ হেসে হেসে বললেন। সবুজ ধারালো ছু*রি বের করে বলল,’আমি আপনাকে এই মুহূর্তে মেরে ফেলবো।’ জ্যোতির্ময় বাবুর মধ্যে তেমন কোনো পরিবর্তন এলো না। মুখ কালো করে রেখেছেন। ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ল। সবুজ কাকামশাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,’আপনি আমায় ভালোবাসেন?’ তিনি সবুজের দিকে তাকালেন। সবুজ কি মজা করছে? কারোর মৃ*ত্যু নিয়ে মজা করা যায়? সবুজের চোখ-মুখ বলছে সে মজা করছে না। যথেষ্ট সচেতন। এবং খুব দ্রুত সবকিছু করতে চাইছে। কাকামশাই আনাড়ি কন্ঠে বললেন,’আমাকে কি এখন ভালোবাসাটা প্রমান করতে হবে? তুমি জানো না আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি? নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসি।’
‘আপনি তো আমায় আপনার ছেলের মতো ভালোবাসেন তাহলে আমার জন্য একটা কাজ করতে পারবেন?’
‘বলো কি কাজ? আমি সন্তানের জন্য সব কিছু করতে রাজি।’
‘গলায় দড়ি দিতে পারবেন?’
‘পারবো।’
‘তবে তাই করুন।’ জ্যোতির্ময় বাবুর চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইলো। পুরো শরীর ঘামে ভিজে গেছে। বুকের মধ্যে অদ্ভুত এক যন্ত্রণা হচ্ছে। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। চোখের কোণে জল জমা হয়েছে। অল্পক্ষণে যেন নদীর বাঁধ ভেঙ্গে যাবে। বিশ্বাস করতে শক্ত হচ্ছে তার সামনে যে বসে আছে সে সবুজ। যার ছোট বেলায় কাকামশাই না হলে চলতো না। আজ সে নিজে থেকে এসেছে খু*ন করতে। জ্যোতির্ময় বাবুকে ভাবতে দেখে সবুজ বলল,’কি এত ভাবছেন? পারবেন না? যদি পারবেন না তাহলে বলে দিন। আমি করে দিচ্ছি। আপনাকে মরতে হবে এটাই সবচেয়ে বড়ো কথা।’
‘তোমাকে পাপ কাজ করতে হবে না। তুমি তো পাপ কাজকে ভয় পাও। আমি নিজেই আত্মহত্যা করছি। আমার ছেলেকে ভালো রেখো। আমি না থাকলেও তোমাদের কাছে ভালো থাকবে সে।’
‘আপনাকে কেন মারতে চাইছি জানতে চাইবেন না।’
‘না।’
‘কেন?’
‘আমি তোমাকে ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি। তুমি আমাকে মারবে বলে যখন সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছো তখন মেরে ফেলা কারণ জানাটা অর্থহীন। এরপরে বেঁচে থাকলেও সারা জীবন আমাকে লাশের মতো বেঁচে থাকতে হবে। আমি পারবো না। তাই আমি নিজে থেকে চলে যাচ্ছি।’
‘বেশ,তবে তাই করুন। দেরি করে লাভ নেই।’
জ্যোতির্ময় বাবু উঠে গেলেন। গলায় ফাঁস তৈরি করলেন। চোখ থেকে ঝরঝর জল ঝরে পড়ছে। বারবার বাইরের দিকে তাকাচ্ছেন। এই মুহূর্তে তৃধা যেন এখানে না আসে। নাহলে এই শয়তান তাকেও ছাড়বে না। গলায় দড়ি দেওয়ার আগে তিনি বললেন,’জানো সবুজ, মানুষ কখনো হারে না। মানুষ হারতে পারে না। কিন্তু মানুষ অসহায় ভালোবাসার কাছে। আর ভালোবাসাই মানুষকে বারবার হারিয়ে দেয়। আজ আমি হেরে গেলাম শুধুমাত্র ভালোবাসার কাছে।’ আর কিছু বললেন না। একটু থামলেন। হয়তো সবুজ বাধা দেবে এই আশায়। কিন্তু না। তার পাষাণ হৃদয় কোমল হলো না। কাঁদতে কাঁদতে গলায় দড়ি দিলেন। ছটপট করতে শুরু করলেন। মুখ থেকে অদ্ভুত গোঙানির শব্দ বেরিয়ে এলো। মুখ আর নাক থেকে র*ক্ত বেরোলো। কিছুক্ষণ জীবিত প্রাণ ছটপট করতে করতে স্থির হয়ে গেল। সবুজ সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। তার হৃদয় কতটা নিষ্ঠুর। কঠিন মৃ*ত্যু দেখতে ভয় পেলো না। অনেক সাহসী সে। ধীর পায়ে তৃধার ঘরে আসে। সবুজকে হঠাৎ করে নিজের ঘরের মধ্যে দেখে চমকে ওঠে। তাকে স্বাভাবিক হতে সময় দেয়নি সবুজ। তার আগেই আক্রমণ করে বসে। মুহূর্তের আক্রমণে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে তৃধা। সবুজ তাকে মারতে চায়? কিন্তু কেন? সবুজ তাহলে সত্যি সত্যি কোনো খারাপ কাজ করেছে? পেটে আঘাত পেয়েছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বাবাকে ডাকলো। ওপাশ থেকে কোনো সাড়া এলো না। নিরুপায় হয়ে নিজেই নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করলো। হাতের কাছে ভারী কিছু খুঁজে পেল না। শেষ পর্যন্ত কাতর প্রার্থনা করল। সে কিছু জানে না। শ্বশুর মশাই যেটুকু বলেছে ওটুকুই জানে। এর বেশি কিছু জানে না। নিজের এবং সন্তানের প্রাণ ভিক্ষা চাইলো। কাতর মিনতী পাষাণ হৃদয় দোলাতে পারল না। সে মরতে চায় না।‌ তার অনেক স্বপ্ন রয়েছে। সেগুলো এখনই বিসর্জন দিতে পারবে না। সে চলে গেলে সংকেত সম্পূর্নভাবে ভেঙ্গে পড়বে। তাকে ছাড়া থাকতে পারবে না। অনেক গুলো দিন থাকতে চায়। তার প্রার্থনা কর্ণপাত করলো না সবুজ। পেটে বার কয়েকবার ছু*রি চালানোর পরও তৃধা মরলো‌ না।‌ জোরে চিৎকার করতে শুরু করেছে। আনাড়ি হাতে কিছুতেই খুন করতে পারছে না। কী করবে বুঝে উঠতে পারল না সবুজ। ধরা পড়ে যাবে তো? ছু*রি তুলে এবার সোজা গলায় চালিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো তৃধা। বার কয়েকবার খুব জোরে জোরে নিঃশ্বাস ছাড়লো। ডান হাত থরথর করে কাঁপছে। হাত স্থির হতে নিঃশব্দে বাইরে বেরিয়ে গেল সবুজ। তারপর ফিরে এলো নিজের বাড়িতে।‌ কয়েকমিনিটে কাজ সেরে ফেলল……।
সব হারিয়ে সর্বহারা হয়ে যায় সংকেত। পিতৃহীনতা তাকে পুড়িয়ে মারে। কোনো কিছুতে মন দিতে পারছিল না। নতুন করে আর কোনো কিছু শুরু করা যায় না! দুঃখ যন্ত্রণা বেদনা তাকে অতিষ্ঠ করছিল। সবুজ বন্ধুকে নিজের বাড়িতে এনে রাখে। কর্মজীবনে ফিরতে আর ইচ্ছে করছিল না। আবার বাবা আর স্ত্রীর হ*ত্যাকারীকে নিজের হাতে শাস্তি দিতে চাইছিল। সে যেই হোক না কেন তাকে উপযুক্ত শাস্তি পেতে হবে। অন্তত এর জন্য কর্মজীবনে ফিরতে হবে। কাজে ফিরেই তদন্ত শুরু করলো। বিশেষ একটা কমিটি গঠন হলো। কিন্তু তারা কিছু করে উঠতে পারলঝ না। খু*নি কোনো প্রমাণ রেখে যায়নি। হিমসিম খেয়ে উঠে। দু-মাস পেরিয়ে যাওয়ার পরও একটু এগোতে পারলো না। মস্তিষ্ক খুব অস্থির হয়ে ওঠে সংকেতের। তাকে বাড়িতে একা থাকতে দেয়নি তোতা। তাদের বাড়িতে নিয়ে এসেছে। ও বাড়িতে গেলে স্মৃতি তেড়ে বেড়ায়। মন খারাপ হয়। কথা বলার মতো কেউ নেই সবসময় একা থাকতে হয়। এতে মন আরও বেশি খারাপ হবে। তাই তোতার অনুরোধে তাদের বাড়িতে রয়েছে। একদিন বিকেলে বাড়ির বারান্দায় বসে গভীর ভাবনায় ডুবে গেল। একটু একটু করে ঘটনা সাজালো। ছোটবেলার কথা মনে করলো। তার খুব মনে আছে বাবা খুব সহজ-সরল ছিলেন। কারোর ওপর ভারী কন্ঠে কখনো কথা বলেননি। নিজের প্রাপ্য ছাড়া বেশি কিছু চাননি। তৃধাও তাই। তাহলে এদের শত্রু কে? সমস্ত ঘটনা সাজানোর পর তার সন্দেহ হয় সবুজের উপর। সবুজ সত্যি সত্যি খারাপ কিছু করেছে। যার জন্য খু*ন করতে বাধ্য হয়েছে। নিজেকে ভালো মানুষ প্রমাণ করার উপায় আর ছিল না। ভালো মানুষ হওয়ার জোর তার মধ্যে প্রবল ছিল। সহজে বিসর্জন দেওয়া সহজ ছিল না। সবুজ খারাপ কাজ করেছে আর এটা বিশ্বাস করতে হবে সংকেতকে। এ কি করে সম্ভব! কিছু কিছু ক্ষেত্রে পাথরকেও বিশ্বাস করতে হয়। বিশ্বাস করে এগিয়ে গেল। কিন্তু সবুজকে কি করে ধরবে? তার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ নেই। তবে সবুজের একটা বড় দুর্বলতা রয়েছে। সে সবসময় সত্য কথা বলে এবং প্রতিশ্রুতি দিলে প্রতিশ্রুতি রাখে। এই দুর্বলতাকে কাজে লাগাতে হবে। আবার পরক্ষণে ভাবলো তার ভাবনা যদি সত্যি হয় -তাহলে সবুজ কেন নিজের দোষ স্বীকার করবে? দোষ স্বীকার করে নিলে তার শাস্তি হয়ে যাবে। নিজের ক্যারিয়ার সুরক্ষিত রাখার জন্য খু*ন করেছে সত্য কথা বলে নিশ্চয়ই নিজের ক্যারিয়ার অনিশ্চিত করে তুলবে না। মিথ্যাটা বলবে। তবুও সবুজের উপর বিশ্বাস রাখলো সংকেত। সে সত্য কথাই বলবে। পরেরদিন সন্ধ্যার সময় ছাদের উপর চায়ে চুমুক দিতে দিতে সবুজকে দিয়ে একটা প্রতিশ্রুতি নিয়ে নিল। সবুজ সত্যি কথা বলবে বলল। তৎক্ষণাৎ হো হো করে হেসে উঠল সংকেত। তাকে হাসতে দেখে অবাক হল সবুজ। বলল,’হাসছো কেন? আমি হাসির কিছু বলেছি বলে তো মনে হয় না।’
‘তুমি ফেঁসে গেছো!’
‘ফেঁসে গেছি মানে!’
‘একটু পরেই বুঝতে পারবে। দেখা যাক আজকে কে জেতে, সবুজ না সংকেত!’
সবুজ কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না। কিসের হার জিতের কথা বলছে বন্ধু! সংকেতের মুখের দিকে তাকালো। লাবণ্য ভরে গেছে। কিছু বলার জন্য উশখুশ করছে। হঠাৎ করে তার মুখমন্ডলে অন্ধকার নেমে এলো। কিসের একটা প্রতীক্ষা করছে প্রাকৃতি। ঝড় উঠতে চলেছে। ক্ষণিকের মধ্যে যেন সবকিছু তছনছ হয়ে যাবে। খুব শান্ত কন্ঠে সংকেত বলল,’তুমি আমার বাবাকে হ*ত্যা করেছো কেন? আমার স্ত্রীকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিলে কেন? আমি কি ক্ষতি করেছি তোমার? জবাব দাও? আজ চুপ থাকলে শুনবো না। তোমাকে জবাব দিতেই হবে।’ সবুজ সঙ্গে সঙ্গে মুখ নিচু করে ফেললো। সংকেতে সবকিছু জেনে গেছে? কি করে জানলো? ঘাবড়ে গেল। সংকেত আবার বলল,’তুমি কিন্তু কখনো মিথ্যা কথা বলো না। আমাকে সত্যি কথা বলো! বলে দাও তুমি খুন করনি। আমার মন থেকে সন্দেহ দূর করো। আমি তোমাকে সন্দেহ করে ভালো নেই। আমাকে মুক্তি দাও। মুক্তি পেতে চাই। তোমার কাঁধে মাথা রেখে আকাশের তারা দেখতে চাই।’
দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়লো। কি বলবে সে? সত্যি বলুক আর মিথ্যা বলুক তাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক যে শেষ হয়ে গেছে বুঝতে পারলো। সবকিছু শেষ করে দিয়েছে এক টুকরো সন্দেহ। সত্য কথা বললে তার ভবিষ্যৎ শেষ আর মিথ্যা বললে তাকে হেরে যেতে হবে। তার এতকালের ভাবনা মিথ্যা হয়ে যাবে। সবুজ মানে শান্ত সহজ সরল এবং সত্য। সবুজের বিসর্জন হতে পারে না। সবুজ সবুজ-ই থাকবে। সমস্ত কিছু স্বীকার করল সংকেতের সামনে। সব কিছু শুনে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পরলো সংকেত। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না -সবুজ এই সব করছে। আর জানতে ইচ্ছে করলো না। চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে। জলে ভর্তি। চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,’কি লাভ পেলে? সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। আর কিছু ফিরে পাওয়া যাবে না। আমার সাথে সাথে তোমার ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে গেছে। আমি আর কাকে নিয়ে বাঁচবো? কি পেলাম জীবনে? আমার বুক কতটা দুমড়ে মুচড়ে দাহ হচ্ছে তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না। জীবনে এমন কঠিন সময় আসবে স্বপ্নেও ভাবিনি।’ সবুজ ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকলো। কোনো কথা বলছে না। শুধু সংকেত তার রাগ অভিমান ক্ষোভ দুঃখ যন্ত্রণা বেদনা পরাধীনতা প্রকাশ করে গেল। অনেকটা সময় নিঃশব্দে কেটে যাওয়ার পর সবুজ বলল,’আমায় গ্রেফতার করো। আমি সারেন্ডার করছি।’ সংকেত হা হা করে হেসে উঠলো। হাসির মধ্যে প্রকাশ পেল বিদ্রুপ আর কিছুটা ভালোবাসামাখা স্নেহ। বন্ধুকে জড়িয়ে ফেলল। ফিসফিস করে বলল,’আমি তোমায় অনেক ভালোবাসি। তোমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার হোক ছোটবেলায় চাইতাম না আজও চাইবো না। আমি পারবো না তোমাকে গ্রেফতার করতে। তুমি আমার বন্ধু ছিলে আর বন্ধু থাকবে। আমি তোমাকে মাফ করে দিলাম।’
‘তা হতে পারে না। অন্যায় যখন করেছি তখন শাস্তি দাও। আমাকে শাস্তি পেতে হবে।’ সবুজ নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। সংকেত কিছুটা দূরে সরে গেল। পকেটের মধ্যে হাত দুটো পুরে বলল,’পারবো না আমি। আমার পক্ষে কখনো সম্ভব নয়।’
‘আমি তোমার বাবাকে হত্যা করেছি। স্ত্রীকে কুপিয়ে মেরে ফেলেছি। এরপরও তুমি আমায় গ্রেফতার করবে না?’
‘না, আমি হারতে পছন্দ করি আর তুমি জিততে পাচন্দ করো। ছোট বেলায় একবার আমি জিতে গেছিলাম। আর চারটা বছর কত কষ্টে দিন কাটিয়ে ছিলাম তা তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না। আমি আর জিততে চাই না।’
‘তুমি একজন আদর্শ পুলিশ অফিসার। তোমার মুখে এসব কথা মানায় না। আমায় গ্রেফতার করো।’
‘কেন করবো? কি করেছো তুমি?’
‘বাচ্চার মতো কথা বলো না।’
‘বাচ্চা নয় আমি সঠিক কথাই বলছি।’
দুই মেরুতে দুজন চলে গেল। কেউ কোনো কথা বলল না। দীর্ঘ সময় কেটে গেল নীরবে। দুজনের চোখ থেকে জল ঝরঝর করে ঝরে পড়ছে। একজন প্রিয় মানুষগুলোকে হারিয়ে কাঁদছে আর একজন প্রিয় মানুষগুলোকে হ*ত্যা করে কাঁদছে। কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। জীবনে কোন বাঁকে এসে পড়লো? চারিদিকে শুধু জল আর জল। সাঁতার না জানলে ডুবে যেতে হবে। উপায় কি? তার বন্ধু কত ভালো। এতকিছুর পরও তাকে ক্ষমা করে দিল। কত ভালোবাসে তাকে। সে-ই ছোট সংকেত আজ কত বদলে গেছে। আজ সে হেরে গিয়েও যেন জিতে গেল আর নিজে জিতে গিয়েও যেন হেরে গেল। সে সবসময় ভালো হতে চাইতো আর বন্ধুরা চাইতো খারাপ হতে। তারা খারাপ হতে হতে ভালো হয়ে গেছে আর সে ভালো হতে হতে খারাপ হয়ে গেছে। তারা হয়তো নেশাখোর হয়তো তারা উৎশৃংখল হয়তো তারা বদমেজাজি কিন্তু তারা কাউকে খু*ন করেনি। আর শান্ত নির্মল বড় মনের মানুষ হয়েও খুন করতে পেরেছে। সবচেয়ে বড় পাপ কাজ করেছে। বন্ধুরা যত অন্যায় করেছে সমস্ত অন্যায়ের ক্ষমা হয়ে যাবে। কিন্তু তার অন্যায় কি ক্ষমা হবে? ঈশ্বর কি তাকে ক্ষমা করবেন? নিরবে আরও অনেকটা সময় কেটে গেল। নিচ থেকে খাবারের জন্য তোতা বারবার ডেকে চলেছে। সবুজ বন্ধুর পাশে এসে দাঁড়ালো। তার কাঁধে হাত রাখলো। সংকেত মুখ ঘুরিয়ে দেখলো। চাঁদের আলোয় মুখখানা চকচক করছে। সবুজ নিরীহ কন্ঠে বলল,’কিছু বলবে না আর!’
‘আমার আর কি বলার আছে!’
‘কিছুই কি বলার নেই।’
‘একটা কথা বলার আছে।’
‘কি, বল?’
সংকেত সবুজের কাঁধে হাত রাখল। শূন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,’আসলে কি জানো বন্ধু, ধুলোবালি সবসময় আমাদের শরীরে লেগে থাকে আর আমরা মিছামিছি মসৃন কাপড় দিয়ে আয়না পরিস্কার করি।’

আরও কয়েকটা দিন কেটে যায়। সংকেত আর সবুজ কয়েকবার মুখোমুখি হয়। সুন্দর ভাবে কথা বলেছে। তবে মনের মধ্যে ছিলো উত্তাপ। কিছুতেই ঠান্ডা করা সম্ভব হচ্ছে না। আগের মতো কথা হয় কিন্তু মাধুর্যতা নেই। সবুজ খুব ভেঙ্গে পড়ে। কারোর সাথে ঠিকমতো কথা বলছে না। সবাইকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। একা থাকতে চাইছে। হঠাৎ এমন পরিবর্তনে অবাক হয় তোতা। সে তার মুষড়ে পড়ার কারণ জানতে চায়। একনাগাড়ে বলতে শুরু করে সবুজ। একটা কথাও গোপন রাখেনি। সে কখনো ভাবেনি সবুজ কাউকে খু*ন করতে পারে। মুহূর্তের আঘাতে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে। এতকাল কার সঙ্গে সংসার করছে সেটা ভেবেই অবাক হয়। সে আরও বেশি অবাক হয়ে সংকেতের ব্যবহার দেখে। বন্ধুর প্রতি ভালোবাসা তাকে অবাক করে। ভালোবাসা এমনও হয়! কত পবিত্র ভালোবাসা! সে-ই ভালোবাসাকে অপমান করেছে সবুজ। সমস্ত লেখকের সৃজনশীলতা নষ্ট করেছে। যতই ভালো মানুষ হোক! যতই মহান হোক! নিকৃষ্ট খু*নের মতো পাপ কাজে তাকে শাস্তি পেতে হবে। সে সবকিছু সবার সামনে আনতে চায়। তৎক্ষণাৎ বাঁধা দেয় সবুজ। বলে, সমস্ত ঘটনা সবার সামনে চলে এলে তার জেল হয়ে যাবে। একসঙ্গে আর থাকা হবে না। আর হাসি খুশি দিন আসবে না। সবাই তার দিকে পাথর ছুঁড়ে মারবে। তার জীবন কালো অন্ধকারে ঢেকে যাবে। বুকে পাথর চেপে নিয়ে তোতা সবুজের কথা মেনে নেয়নি। এই অন্যায়ের ক্ষমা হয় না। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে,’আপনি আমাকে বলেছিলেন ভালোবাসা মানে বারান্দা আর খিড়কী। আমি বারান্দাকে দেখে বাড়িটিকে ভালোবেসেছি আর আজ খিড়কী দেখেও বাড়িটাকে ভালোবাসবো। খিড়কী পাশে নোংরা পরিষ্কার করতে আমি নাক বাঁকাবো না।’
‘তাহলে তো আমাদের আর একসঙ্গে থাকা হবে না। আমি কাকে তোতাপাখি বলে ডাকবো?’ তোতা সবুজকে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে ধরল। দীর্ঘক্ষণ জড়িয়ে ধরে কেঁদে গেল। বিশ্বাস করতে পারছে না তার স্বামী এতটা নিচে নেমে গেছে। কপালে চুম্বন করে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,’আমায় ক্ষমা করবেন রাজামশাই। আমায় ক্ষমা করবেন। আমাদের আর একসঙ্গে থাকা হবে না। তবে আমার ভালোবাসা সব সময় আপনার কাছে থাকবে। আমি কখনো এ বাড়ি ছেড়ে যাবো না। ভালোবেসে থেকে যাবো।’ তোতাই সবুজকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। সেদিন রাতে খুব কেঁদে ছিল তোতা। তার জীবনটা অদ্ভুতভাবে বদলে গেল। কাকে নিয়ে থাকবে এখন? একা একটা রাত কাটাতে ভয় করতো এখন কিভাবে প্রতিটা রাত কাটাবে? সবুজকে ছাড়া থাকতে পারবে তো? এমন অজস্র ভাবনা তাকে অশান্ত করে তোলে। এমন সময় দরজায় টোকা পড়ে। এত রাতে কে এলো? দরজা খুলে সংকেত কে দেখে চোখের জল মুছে ফেলে। ভেতরে আস্তে বলে। দুইজনে মুখোমুখি বসে। কেউ কারোর দিকে তাকাতে পারছিল না। নীরবে বসে অনেক সময় কেটে যায়। তারপর নিরবতা ভেঙ্গে সংকেত প্রশ্ন করে,’নতুন বৌঠান আমায় একটা সত্যি কথা বলবে?’
‘যদি সম্ভব হয় অবশ্যই বলব।’
‘সবুজ কি এমন ভুল কাজ করেছিল যার জন্য খু*ন করতে হলো? আমি তাকে অনেকবার জিজ্ঞেস করেও কিছু সুবিধা করতে পারিনি। তুমি বল অন্তত।’ তোতা সংকেতের দিকে তাকালো। কি জবাব দেবে। স্ত্রী থাকতে অন্য নারীর সঙ্গে ঘোরাফেরা করতো; -কথাগুলো বলতে পারল না। সংকেত আবার বলল,’নতুন বৌঠান, বল!’
‘এসব কথা জিজ্ঞেস করো না। আমি বলতে পারবো না। সবুজ আমার স্বামী হয়। আমি পারবো না বলতে।’ সংকেত এই বিষয়ে আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। দু-একটা কথা বলে বিদায় নেয়। তারপরের দিন থেকে সংকেতকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। চাকরি থেকে ইস্তফা নিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। সূর্যময় থেকে শুরু করে তোতা সবাই সংকেতের অনেক খোঁজাখুঁজি করে। কিন্তু কোথাও খুঁজে পায়নি। সে-ই রাতে সে কোথাও হারিয়ে গেছে।
কোর্টে এক মাসের মতো কেস চলে। তীব্র সমালোচনা হতে থাকে শহরজুড়ে। সবুজের শাস্তির দাবি ওঠে। তার প্রিয় পাঠকেরা এক রাতেই তার বিরুদ্ধে চলে যায়। সবুজ নিজের মুখে সমস্ত কিছু স্বীকার করে নেয়। তাই কেশ বেশি জটিল হয়নি। একজন বৃদ্ধকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা এবং একজন গর্ভবতী মাকে কুপিয়ে হত্যা করার অপরাধে সারা জীবনের জন্য জেল হয়ে যায় সবুজের।

পর্ব ২৮ আসছে।।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here