নিরুদ্দেশ ২য় খন্ড পর্ব ২৯

নিরুদ্দেশ ২য় খন্ড
পর্ব ২৯

বেশিদিন বাপের বাড়িতে থাকেনি পার্বতী। ঘুরে এসে আবার মন দিয়েছে সংসারে। সংসারের জটিলতা কম নয়। ছেলে খুব দুষ্টু হলেও তাকে সামলে নেয় তোতা। তাকে নিয়ে চিন্তা করতে হয় না। তবে তার সমস্ত চিন্তা অন্তিমকে ঘিরে। ভেবেছিলো ভালোবাসা দিয়ে মানুষটিকে বদলে ফেলবে। তাকে ভালোবাসবে। বছরের পর বছর পেরিয়ে গেছে তার মধ্যে তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। স্বামী থেকেও যেন নেই। তার উপস্থিতি আজকাল খুব বেশি টের করতে পারে না। সময়ের সাথে সাথে অনুভূতিগুলো মরে গেছে। তারা একে অপরের অনুকরণ কিন্তু সে মানতে চায় না নয়তো বুঝতে চায় না। নিজের সম্পর্কে সমস্ত সিদ্ধান্ত নিজেকে নিতে হয়। সঠিক সিদ্ধান্তের জন্য কোনোরকম ভরসা বা কোনো উৎসাহ পায় না। একটু একটু করে নিজেকে কেন্দ্র করে বাঁচতে শুরু করেছে। আর কারোর উপর আশা রাখে না। একটা সময় প্রচুর অপেক্ষা করতো। স্বামী ফিরবে প্রচুর আনন্দ হবে। কিন্তু তার অপেক্ষা প্রত্যেকবারই হয়েছে বিবর্ণ। তার প্রতিটা মুহূর্তের অপেক্ষা ছিল কয়লা গহ্বরের গভীর অন্ধকারের মতো অন্ধকার। রাতের বেলা খাওয়া-দাওয়া শেষ করে সবুজের লেখা একটা বই পড়ছিল তোতা। এমন সময় বাইরে অভিমুন্য আর তার মায়ের কথোপকথনের মৃদু বার্তা ভেসে আসে। রাতে তারা বাইরে বেরিয়েছে কেন? কি দরকার? কৌতূহলবশত সেও দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো। লক্ষ করলো তারা তার বাড়ির দিকে আসছে। একটু অবাক হলো। অভিমুন্য ছুটে এসে কাকিমাকে জড়িয়ে ধরল। একটু আদর করে জিজ্ঞেস করল,’কি হলো বাবু,এত রাতে কি খবর?’
‘আমি তোমার কাছে থাকবো।’ তোতার মুখে হাসি ফুটলো না। মুখ তুলে পার্বতীর দিকে তাকালো। সে স্থির চোখে দাঁড়িয়ে রয়েছে। চোখেমুখে অসংখ্য ভাবান্তর। কিছু একটা যেন অঘটন ঘটতে চলেছে। নিজেকে সামলে আমতা আমতা করে বলল,’দিদি ছেলে তো অনেক কিছু আবদার করবে। তা বলে সব কিছু শুনবে নাকি! ওকে বোঝাতে হবে।’ কথা শেষ করে অভিমুন্যকে কাছে টেনে বলল,’এমন আবদার করতে নেই বাবু। যাও মার কাছে। মা একা থাকলে কষ্ট পাবে।’ অভিমুন্য জবাব না দিয়ে বারবার মায়ের দিকে কাকিমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকাতে রইল। অবোধ শিশু এই জটিল সম্পর্ক বোঝে না। শুধুমাত্র নিজের ভালোলাগাটা বোঝে। পার্বতী শান্তকণ্ঠে বলল,’থাক না। তার যেখানে ভালো লাগে সেখানে থাকুক। অসুবিধা নেই। বাচ্চা ছেলে জোর করো না।’ তোতা আবার একবার পার্বতীর চোখের দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল। তার মন যেন সায় দিচ্ছে না। তোতার মতো পার্বতীও সর্বহারা। একমাত্র বাঁচার ধন অভিমন্যু। সে যেন তার ছেলেকে ছিনিয়ে নিচ্ছে। খুব খারাপ লাগলো তোতার। হয়তো অভিমন্যুর প্রতি এত ভালোবাসা দেখানো উচিত হয়নি। বাচ্চা ছেলে যেখানে সবচেয়ে বেশি আদর-যত্ন ভালোবাসা পাবে সেটার প্রতি ঝোঁক বেশি থাকবে। সে-ই দিক দিয়ে তোতা পারফেক্ট। সে অভিমুন্যর উপর কখনো চোখ রাঙায় না। উচ্চস্বরে কথা বলে না। কিন্তু পার্বতী! তার অনেক কাজ থাকে। সবসময় ছেলের সঙ্গে থাকতে পারে না। বিরক্ত হয়ে উঠলে ছেলের উপর শুধু চোখ রাঙায় না গালে চড় বসিয়ে দেয়। মায়ের প্রতি ভয় রয়েছে। মায়ের কাছে নির্বিধায় দুষ্টুমি করতে পারে না কিন্তু তার কাছে করতে পারে। তাই তার প্রতি ঝোঁক তো বেশি থাকবে। এই ভালোবাসা যেন কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তোতা মায়ের কষ্ট খুব ভালো করে বুঝতে পারে। সন্তান যখন মায়ের কোলকে অবজ্ঞা করে অন্যের কোলে যেতে পছন্দ করে তখন মায়ের যে কি কষ্ট হয়, সে-ই কষ্ট কেবল একমাত্র মা-ই বোঝে। তোতার ভীষণ খারাপ লাগলো। নিজেকে অপরাধী মনে করলো। পার্বতী মুখ শুকনো করে ফিরে যাচ্ছিলো। তোতা ডাকলো। পার্বতী পেছনে ঘোরে সাড়া দিল।
‘দিদি, তুমিও থেকে যাও। ও ঘরে একা ঘুমাতে হবে না। এখানে চলে এসো একসঙ্গে তিনজন ঘুমাবো।’ পার্বতী মাথা নাড়িয়া বলিল,’ও ঘরে দরজা-জানালা বন্ধ করে আসছি।’ তোতার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। বই পড়া আর হলো না। গুছিয়ে রেখে দিল। পার্বতী তাড়াতাড়ি ফিরে এলো। একটুখানি গল্প করে তিনজনে শুয়ে পড়লো। আলো নিভিয়ে দিল। অভিমুন্য কাকিমাকে জড়িয়ে ঘুমালো। তার মাথায় হালকা হাত বুলিয়ে দিতে ঘুমের মধ্যে তলিয়ে গেল। শুধু ঘুমোতে পারলো না পার্বতী আর তোতা। অল্প সময় নিস্তব্ধে কেটে গেল। পরে বলল,’দিদি, সবকিছুর জন্য সরি। আমি এমনটা হবে ভাবতে পারিনি।’ পার্বতী একটু অবাক হয়ে পাশ ঘুরে তাকালো।
‘সরি কেন? কি করেছো?’
‘আমি অভিমুন্যকে তোমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে চাই না। আমি বুঝতে পারছি না সে কেন আমার সঙ্গে থাকতে চাইছে। আমি…।’
‘তুমি অভিমুন্যকে কেন কেড়ে নিতে চাইবে? আর আমি এমনটা ভাববো কেন?’
‘যতই হোক তুমি মা। তুমি কখনো চাইবে না তোমার সন্তান তোমার কাছে না থেকে অন্য কারোর কাছে থাকুক। অন্য কারোর ভালোবাসায় বড় হোক।’
‘এই তোতা, কি সব বলছো তুমি? আমি কখনো এমনটা ভাবিনি। আমি তোমাকে নিজের বোন ভাবি। অভিমুন্য শুধু আমার ছেলে নয়। সে তোমারও ছেলে। দেখতে পাওনা তোমার কাছে থাকলে কত খুশি থাকে।’
‘সবকিছু কি এত সহজ?’
‘অন্যদের কাছে সহজ কিনা জানি না। তবে আমার কাছে খুবই সহজ। ও যখন তোমার কাছে আসতে চাইলো আমি একবারের জন্যও বাধা দেইনি। আমি তোমার কাছে নিয়ে এসেছি। এই প্রসঙ্গ নিয়ে আর কোনো কথা বলো না। শুধু মনে রেখো অভিমুন্যর মা শুধুমাত্র আমি একা নই। তুমিও তার মা। তাকে মানুষ করার দায়িত্ব তোমারও।’
‘তোমার অনেক বড় মন দিদি। তোমার জন্য ঈশ্বর অনেক বড় কিছু রেখেছেন। সঠিক সময়ে তা ঠিক পাবে।’ পার্বতী মৃদু হেসে উঠলো। বলল,’দেখা যাক কি হয়! অনেক রাত হয়েছে। এবার ঘুমিয়ে পড়ো।’
অনেকটা সময় আবার নিস্তব্ধে কেটে গেল। কিছু সময়ের পর তোতা অস্পষ্ট কন্ঠে ডাকলো,’জেগে আছো?’
‘হ্যাঁ।’
‘রোজ রাতে ঘুম হয়? না এভাবে জেগে থাকো?’
‘ঘুম নিশ্চয়ই হয়। না হলে বেঁচে আছে কি করে? তবে আগের মতো হয় না।’
‘এখনো অপেক্ষা করো?’
‘অপেক্ষা করি। প্রতিদিনই মনে করি আজ হয়তো ফিরবে। আজ হয়তো আমার কথা মনে করে চলে আসবে। কিন্তু….।’ পার্বতী হেসে উঠলো। বলল,’আমার কথা বাদ দাও। তুমি এখানে কেন পড়ে রয়েছো? তোমার জীবন নেই? আমার স্বামী আছে। হয়তো ততটা গুরুত্ব দেয় না তবুও মানুষটা আছে। কোনোদিন হয়তো বুঝবে আমায়। না বুঝলেও অসুবিধা নেই। সন্তান আছে। তাকে আঁকড়ে সারা জীবন কাটিয়ে দেবো। বেঁচে থাকার জন্য কোনো একটা অবলম্বন তো প্রয়োজন। কিন্তু তোমার? তুমি জানো সবুজ আর কোনো দিন ফিরবে না। অসম্ভব। তবুও কেন অপেক্ষা? অনিশ্চিত অপেক্ষা ভালো নয়। তুমি আমাকে দিদি বলো। দিদি হিসেবে একটা পরামর্শ দিতে পারি। তুমি ফিরে যাও। তোমার বয়স অল্প। নতুন করে সবকিছু শুরু করো। এভাবে নিজের জীবন নষ্ট করো না।’
‘আমি পারবো না। আমার পক্ষে অসম্ভব। এই অপেক্ষা আমাকে ভালো রেখেছে। অপেক্ষাই
আমার জীবন। আমি জানি না আমি কেন এত ভালোবাসি সবুজকে। আমি একটা জিনিস খুব ভালো করে বুঝে গেছি কাউকে তীব্র ভালোবাসলে তাকে আদর যত্ন করলে সে-ই মানুষটা যে তোমায় ভালোবাসবে এই ভাবনাটা সম্পূর্ণ ভুল। ভালোবাসা কি করে সৃষ্টি হয় তার ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই। তবে এটুকু জানি ভালোবাসা সবার প্রতি সৃষ্টি হয় না। আজ এতগুলো বছর সংসার করেছি। পাশাপাশি ঘুমিয়েছি। সুখের দুঃখের মুহূর্ত কাটিয়েছি। একটা মানুষকে কেন্দ্র করে হাজার হাজার স্বপ্ন দেখেছি, দেখিয়েছি, ভালোবেসেছি তবুও মানুষটার মনে জায়গা করে নিতে পারিনি। মানুষটা আমাকে ভালোবাসলোই না। তার মনে আজও সাথীর বসবাস। তাকে বিসর্জন দেয়নি। নিজের বিবাহিত জীবন নিয়ে কখনো খুশি ছিল না।’
‘তোমাদের দেখে কখনো এমনটা মনে হয়নি। সবসময় মনে হয়েছে সবুজ তোমায় খুব ভালোবাসে। পারফেক্ট স্বামী। ও তোমাকে ভালো রেখেছে।’
‘এটা আমি স্বীকার করি। সবুজ আমায় সবকিছু দিয়েছে। ভালোবাসা সম্মান শ্রদ্ধা আদর যত্ন সবকিছু দিয়েছে সবকিছু। আমার অভাব রাখেনি।’
‘তোমার কথা আমি সঠিক ভাবে বুঝতে পারছি না। কিছুক্ষণ আগে বললে ভালোবাসে না আবার এখন বললে ভালোবাসে। ঘুমের ঘোরে যা তা বকে যাচ্ছো!’ তোতা সোজা হলো। একটু হাসি মাখা কন্ঠে বলল,’আমার ঘুম পায়নি। আমি ঠিক কথাই বলছি। সবুজ একজন পারফেক্ট পুরুষ মানুষ। খুব সতর্ক এবং সুন্দরভাবে জীবন যাপন করতে পছন্দ করে। কঠোর দায়িত্ববান পুরুষ। বিয়ে করেছে বাড়িতে স্ত্রী এনেছে। এবার স্বামী হিসেবে তার কর্তব্য কি? স্ত্রীকে ভালোবাসতে হবে,আগলে রাখতে হবে, খেয়াল রাখতে হবে,তার দায়িত্ব নিতে হবে, তাকে সবসময় খুশি রাখতে হয়। সবুজ তাই করেছে। খুব দায়িত্ব সহকারে করেছে। কোথাও কোনো ভুল না হয় তার জন্য কঠিন লড়াই করেছে। স্ত্রীকে ভালোবাসতে হবে তাই ভালোবাসে কিন্তু মন থেকে কখনো ভালোবাসেনি। মন থেকে কখনো আমার কাছে থেকে কিছু চায়নি এবং নিজেও আমাকে দেয়নি। স্বশরীরে তার সামনে আমি ছিলাম আর কল্পনায় এবং মনে সাথী ছিল এবং আছে। এটা শুধু আমার মুখের কথা নয় সবুজ নিজেও বলেছে, সাথীর জন্য সে সবকিছু করতে পারে। সবকিছু ছেড়ে তাকে নিয়ে একা বাঁচতে পারে। তার প্রতি ভালোবাসাটা তীব্র আর আমার প্রতি ভালোবাসাটা ধীর স্থির নির্মল। আমার চোখে দেখে সে নাকি বিদ্যুৎ খুঁজে পায় না। ভালোবাসা কি অদ্ভুত না? যে মানুষটা তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। যে মানুষটা তাকে ঠকিয়েছে। এতগুলো বছর যার সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। তবুও মানুষটা তাকে ভালোবাসে।’ পার্বতী জবাব দিল না। নিরবে কেটে গেল কয়েকটা মুহূর্ত। তারপর বলল,’যে মানুষটা তোমায় ভালোবাসে না। তার জন্য কেন অপেক্ষা?’
‘সে ভালোবাসে না। কিন্তু আমি তো ভালোবাসি। আমার মনে তো সে রয়েছে।’ আবার চুপচাপ। নিরবতা ভেঙ্গে তোতা বলল,’আচ্ছা দিদি, সত্য ভালোবাসা মানে কি?’
‘সত্য ভালোবাসা মানে নিজেকে নিঃস্ব করে ফেলা। আমাদের সমাজে বেশিরভাগ ভালোবাসা এক তরফা। দুই তরফা ভালোবাসা খুব কম। কারণ সত্য ভালোবাসা মানে নিজেকে নিঃস্ব করে ফেলা। আর দুতরফা ভালোবাসার ক্ষেত্রে একটা মানুষ আরেকটা মানুষকে কখনো নিঃস্ব হতে দেবে না।’

কাজল শুকনো মুখে থানার বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সবুজের সাথে দেখা করতে এসেছিল কিন্তু দেখা করতে দেওয়া হয়নি। তার কাছে তেমন কোনো পরিচয় পত্র নেই। হতাশ হয়ে ফিরে যাওয়া ছাড়া দ্বিতীয় কোনো উপায় নেই। তবুও দেখা করার শেষ চেষ্টা। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উপায় খুঁজলো। এমন কিছু কি রয়েছে যার মাধ্যমে সবুজের সঙ্গে দেখা করা যেতে পারে! কিংবা এমন কোনো মানুষ কি আছে যার সাহায্যে কাজটি সম্পন্ন করা যেতে পারে! তীব্র রোদ উঠেছে। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। দু-পা এগিয়ে গেল। সামনে ছায়া জায়গায় দাঁড়ালো। ভাবলো তাকে এই কাজে সাহায্য করতে পারে একমাত্র তোতা। তার সাহায্যে সবুজের সঙ্গে দেখা করা সম্ভব। কিন্তু তোতা কি রাজি হবে? সে কখনো রাজি হবে না। কয়েক বছর আগেকার ঘটনা খুব ভালো করে মনে আছে কাজলের। সামান্য কথা বলছিল তারা আর তাতেই তোতা ভয়ংকরভাবে রেগে গেছিল। ভাবলেই কাজলের গা শিরশির করে ওঠে। আবার এক অজানা কারণে মুখে হাসি ফুটে ওঠে। তার পাগলামি গুলো একটা মানুষকে যেমন অস্বস্তির মধ্যে ফেলতে পারে তেমনি একটা মানুষকে অনেকটা স্বস্তি ফিরিয়ে দিতে পারে। ঠিক কালবৈশাখীর পূর্বের এবং পরের পরিস্থিতি। যাক তোতার কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলা ভালো। বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল আর এমন সময় তার চোখ দুটো ঝলমল করে ওঠে। সামনে থেকে তোতা এগিয়ে আসছে। তাকে দেখতে অনেক দেরি করে ফেলেছে। তাই আড়াল হওয়ার চেষ্টা করল না। কারণ তোতা বুঝে ফেলেছে। কাছাকাছি আসতেই দুজনে একে অপরকে হাসি বিনিময় করল। তোতা হাসি মাখা কন্ঠে জানতে চাইল,’তুমি এখানে! হঠাৎ?’ কাজল থতমত খেয়ে গেল। কি উত্তর দেবে ভেবে পেল না। সহজ হতে সময় লাগলো। মিথ্যা কথা বলল না। সব কিছু বলল। কিন্তু তোতার মধ্যে তেমন কোনো পরিবর্তন না দেখে অবাক হল কাজল। এতক্ষণে তো তার রেগে যাওয়ার কথা। তোতা রাগ করেনি। বরং উল্টে বলল,’আমার সাথে এসো। দুজনে একসঙ্গে যাই।’ কাজল দ্বিতীয়বারের মতো অবাক হলো। এই কি পূর্বের তোতা? কত পরিবর্তন কয়েক বছরের মধ্যে। স্বাভাবিকভাবে তার সঙ্গে কথা বলছে এটাই বিস্ময়কর বিষয়। অবশ্য তার মধ্যে এই পরিবর্তন কাজলের মনকে খুশি করেছে। হাঁটতে হাঁটতে তোতা জিজ্ঞেস করল,’অবাক হচ্ছো না?’
‘ভীষণভাবে।’
‘তখন ছেলেমানুষি জেদে কি সব করে ফেলেছি। ওইগুলো ভেবে মনে রাগ পুষে রেখো না। ছোট বোন ভেবে ক্ষমা করে দাও।’
‘আমি কখনো কারোর উপর রাগ করি না। আমি ওই দিনই ওই দিনের ঘটনা ভুলে গেছি। আমি কখনো পিছুটানকে কেন্দ্র করে বাঁচি না। আর ওই সামান্য কথা ভেবে রাখ পুষে রাখবো?’
‘আমি শুধু তোমার সঙ্গে নয় অনেকের সঙ্গে এমন ভুল করেছি। তখন ভাবতাম আমার মানুষ মানে শুধু আমার। সে আর অন্য কারোর নয়। কিন্তু একবার ভেবে দেখো সে যদি আমার হতে না চায় তাকে জোর করে কি আমার হতে দেওয়া যায়? সম্ভব নয়। জোর করে কিছু হয় না। জোর করে শুধুমাত্র মানুষ আর মিথ্যাকে জয় করা যায়। সত্য আর মনকে জয় করতে গেলে তোমাকে নিঃস্ব হতে হবে। তবুও হয়তো তুমি সত্য আর মনকে জয় করতে পারবে না। মন আর সত্যকে জয় করা সহজ নয়।’
কথা বলতে বলতে তারা সবুজের কক্ষের দিকে এগোলো। কক্ষের কাছাকাছি পৌঁছে তারা দুজনে চুপ করে গেল। সবুজ দুজনকে একসঙ্গে দেখে ভিরমি খেয়ে গেল। অন্তর থেকে একটা খুশির ছোঁয়া পেলেও সে-ই খুশিটা মুখে ফুটে উঠল না। এটাও কি সম্ভব? তোতা কাজল একসঙ্গে! সবুজের সবচেয়ে খুশির দিন। কিন্তু খুশি হতে পারল কোথায়? কাজল দিদি তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। কত সৌভাগ্যবান সে! তার এত কর্মকাণ্ডের পরও তাদের চোখে আজও ভালো সে‌। তাই তো দূর থেকে ছুটে এসেছে দেখা করতে। তার কথা এখনো তারা মনে করে। ওই যে কেউ বলেছে না কাউকে ভালোবাসতে কোনো কারণ লাগে না। পাপীকেও ভালোবাসা যায়। কিন্তু আজকে কি আর ওই দিনগুলো আছে? পুরোনো অনুভুতিটা হারিয়ে গেছে। পুরনো কোনো কিছু নেই। পুরনো সবুজটাও অতীত। কাজল যতটা কাছে এগিয়ে এলো তার লজ্জা ততটা বাড়লো। লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছা করলো। কি করে তার সামনে মুখ দেখাবে? নিজেই সবসময় বলতো ধর্মের পথে চলো। কোনো কিছুর বিনিময়ে ভুল করো না। কিন্তু জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল গুলো সে নিজেই করেছে। এরপরেও কি তার সামনে মুখ দেখানো যায়? কাজল দিদি যদি জিজ্ঞেস করে, সে কেন এসব করেছে? তখন কি উত্তর দেবে? উত্তর তো নেই। তবে এটুকু ধারণা করতে পারে, কাজল দিদি এগুলো জিজ্ঞেস করবে না। সে-ই ছোটবেলা থেকে কাজলকে দেখে এসেছে। কাউকে কখনো অস্বস্তির মধ্যে ফেলবে না। কাছে আসতেই মুখ নিচু করে ফেলল। আবার নিজেই মুখ তুলে কাজলকে দেখল। অনেক কিছু পরিবর্তন হয়ে গেছে। মাথার চুল অনেকটা উঠে গিয়ে পাতলা হয়ে গেছে। মুখে বয়সের ছাপ পড়েছে। আগের তুলনায় অনেকটা পাতলা হয়ে গেছে। হাতে শাঁখা পলা নেই। কপালে সিঁদুর নেই। অবাক হলো সবুজ। আচ্ছা, কাজলদিদি কি এখনো বিয়ে করেনি? কাজল ঘরোয়া বাঙালি মেয়ে। আধুনিক জীবন কখনোই পছন্দ করতো না। বিয়ে করলে অবশ্যই শাঁখা-সিঁদুর পরতো। সবুজ সহজ কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,’কাজল দিদি!’ পুরনো এক অনুভূতি। এই ডাকের মধ্যে একটা অদ্ভুত শান্তি রয়েছে। অনেক স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। কাজল নম্রভাবে সাড়া দিল।
‘তুমি বিয়ে করোনি?’
তোতা আর কাজল হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে কাজল বলল,’ছেলের কান্ড দেখো। কত দিনের পর মুখোমুখি হলাম ‘কেমন আছি’ জিজ্ঞেস করবে তা না করে জিজ্ঞেস করছে বিয়ে করেছি কিনা। মানুষের জীবনে বিয়েই কি সবকিছু? তার জীবনে আর কিছু নেই?’
‘জবাব দাও! বল,বিয়ে করোনি?’
‘তোমাকে ছোটবেলায় বলেছিলাম আমি আর সাধারণ দশটা মেয়ের মতো নই‌। আমার পছন্দটা সম্পূর্ণ আলাদা। আমি বিয়ে করতে চাই না..মা হতে চাই না… প্রতিষ্ঠিত হতে চাই না…।’
‘খুব মনে আছে। কিন্তু তা বলে…।’ সবুজ চুপ করে গেল। কাজলদিদি খুব অদ্ভুত! ছোটবেলা থেকে বলতো সে মা হতে চায় না। প্রতিষ্ঠিত হতে চায় না। একটা আকাশ চায় আর সম্পূর্ণ স্বাধীনতা চায় -ব্যাস এটুকুই। তার জীবনে আর কোনো কিছুর প্রয়োজন নেই। সবুজ ভাবতো ওই বয়সে সবাই এমন ভাবে। কিন্তু নিজের ভাবনাকে শেষ জীবন পর্যন্ত টিকিয়ে রাখতে পারে না। একটা সময়ের পর সমাজের চাপে নয়তো পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে নিজের ভাবনা গুলোকে পরিবর্তন করতে হয়। নয়তো প্রকৃতির নিয়মে নিজের মনের মধ্যে পরিবর্তন চলে আসে। আর সেখানে কাজল সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। ছোটবেলার ভাবনাগুলোকে এখনো পুষে রেখেছে। সে জিতে গেছে। পেরেছে নিজের ভাবনাকে সঠিক রাখতে। সত্যি সে সংসার করেনি। নিশ্চয়ই সমাজের গঞ্জনা সহ্য করতে হয়। সবকিছু তুচ্ছ করে নিজেকে সঠিক রাখতে কতজন পারে? কাজল পেরেছে। সে তো অনেক নারীর আদর্শ। দু-চোখ ভরে সবুজ কাজলকে দেখল। তার জীবনে প্রথম নারী। মায়ের ভালোবাসা না পাওয়া বেপরোয়া ছেলেটাকে মানুষ করেছিল। মানুষকে ভালোবাসতে শিখিয়েছিল। মানুষের সাথে মিশতে শিখিয়েছিল। অদ্ভুতভাবে তার সাথে পরিচয়। তার দিদি! তার বড়ো দিদি! মনে পড়ে গেল গ্রীষ্মের বিকেলে দিদির সাথে সে-ই ছোট ছোট টিলায় ঘুরে বেড়ানোর কথা। রোগাক্রান্ত শরীরের দিদির সুষমা হাতে স্নেহ আদর। একসাথে কাটানো হাজার হাজার মুহূর্ত। চোখ দুটো ভিজে গেল। খেয়াল করে দেখল কাজলের চোখের কোণেও জল টিপটিপ করছে। হয়তো তারও মনে পড়ে গেছে অতীতের কথা। পল্লী গ্রামের নির্জন দুপুরের কথা। কাজলের চোখে ভাইয়ের প্রতি রয়েছে অকৃত্রিম ভালোবাসা আর স্নেহ। কাজল হয়তো সবুজকে সঠিকভাবে গড়ে তুলতে চাইছিল। কিন্তু সবুজ গড়ে উঠতে পারেনি। নিজের প্রতি ঘেন্না এল। যে মানুষগুলো তাকে এত ভালোবাসে। তাকে ভরসা করে কত স্বপ্ন দেখে। সে সমস্ত মানুষের ভরসা দুমড়ে মুচড়ে শেষ করে দিয়েছে। অকৃত্রিম ভালোবাসাকে কৃত্তিমে পরিণত করেছে। বড় ইচ্ছে করে অনেক কিছু জানতে। ওই বাড়ির সবাই কেমন আছে? লীলা! তার কথা ভাবলেই নিজেকে আর সামলে রাখতে পারে না। কিছু বলতে পারে না। মুখের কথা হারিয়ে যায়। অনেক কথা থাকলেও কিছু বলল না। শামুকের মতো নিজেকে গুটিয়ে নিল। কাজল খানিকক্ষণ সবুজের দিকে তাকিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। কাজল বেরিয়ে যাওয়ার পর সবুজ ধপ করে মেঝেতে বসে পরল। পাশে (মাঝখানে লোহার বেড়া দেওয়া আছে) বসল তোতা। স্বামীর দিকে তাকালো। আগের চেয়ে অনেক পাতলা হয়ে গেছে। দাড়ি গোঁফ অনেকদিন কামায়নি। চুলের জট ধরেছে সাথে অনেকগুলো চুল সাদা হয়ে গেছে। নির্লিপ্তি চোখে তাকিয়ে বলল,’কষ্ট হচ্ছে না?’ তোতার দিকে ফিরে তাকাল। বলল,’তুমি ফিরে যাও। আজ আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না।’
‘ঠিক আছে। চলে যাব। কিছুক্ষণ এভাবে বসে থাকি। তোমাকে দেখতে আমার ভালো লাগে। তোমাকে কিছুক্ষণ দেখে আমি অনেকগুলো দিন অনায়াসে কাটিয়ে দিতে পারি।’ সবুজ শুধু তাকিয়ে রইল কোনো জবাব দিতে পারল না। তোতাও নির্লজ্জের মতো স্বামীর দিকে তাকিয়ে থাকলো। কেউ কোনো কথা বলল না।

কাজল যে বাইরে তার জন্য অপেক্ষা করবে বুঝতে পেরেছিল তোতা। তার অনুমান অমূলক হলো না। বাইরে এসে কাজলকে দেখতে পেল। তোতাকে দেখার সাথে সাথে চোখের জল মুছে ফেলল। কারণ জানতে চাইল না তোতা। সে সবকিছু বুঝতে পারছে। আচমকাই কাজল বলে ফেলল,’তুমি এক্ষুণি বাড়ি ফিরে যাবে?’
‘হ্যাঁ, তুমি আমার সাথে চলো। আজ আমার বাড়িতে থেকে যাও।’
‘না না, তা কী করে সম্ভব?’ তোতা কোনো বাধা মানলো না। জোর করে কাজলকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এলো। প্রথমবারের মতো তাদের বাড়িতে এসেছে। কোনো কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। তোতা ফিরে এসেই রান্না বসিয়েছে। কাজল পুরো বাড়ি ঘুরে দেখল আর একা একা হাসলো। সবুজ যে একটা পাগল ছিল পুরো বাড়ি জুড়ে তা ছড়িয়ে রয়েছে। প্রতিটি পদে-পদে সৃষ্টি করেছে অসংখ্য জিনিস। প্রতিটা জায়গায় তার ছোঁয়া লেগে রয়েছে। তার ছেলেমানুষি সারা বাড়ি জুড়ে রয়েছে। সবকিছু ঘুরে দেখতে তার ভালো লাগলো। একটা স্বপ্নের মতো মনে হলো। একটা সময় ভেবেছিল সে একদিন সবুজের বাড়িতে আসবে। পরে সে-ই আশা নিজে থেকে ত্যাগ করেছিল। হঠাৎ করে এভাবে স্বপ্ন পূরণ হবে ভাবতে পারেনি। কাছে আর একটা বাড়ি দেখে মনে খটকা জাগেনি কাজলের। নিজে নিজেই সঠিকটা অনুমান করে নিল। রান্না-বান্না শেষ করার পর দুজনে আবার মুখোমুখি হলো। বসে খানিকক্ষণ গল্প করলো। তোতা একটু অবাক হলো। কারণ কাজল তাদের সম্বন্ধে কিছুই জানতে চাইছে না। এই বাড়ির প্রতিটি পদে অনেক কিছু রয়েছে যেগুলো অচেনা মানুষের চোখে প্রশ্ন জাগাবে। কিন্তু কাজল কোনো প্রশ্ন করছে না। সে যেন সবকিছু জানে। কাজল সবুজকে ভালো করে জানে। তাকে বুঝতে পারে। তাই আগে থেকে হয়তো সবুজের বাড়ি এবং তার আশেপাশে পরিবেশ কেমন হবে মনের মধ্যে কল্পনা করে রেখেছিল। এ বাড়িতে এসে সে সেগুলোই পেয়েছে। তাই প্রশ্ন করার মতো কিছু নেই। একটা মানুষকে বুঝতে পারা মানে তার পৃথিবীর সম্বন্ধে সবকিছু জানতে পেরে যাওয়া -হয়তো কাজলের ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। অনেকক্ষণ কথাহীন ভাবে কেটে যাওয়ার পর তোতা গলা খাঁকরে বলল,’তুমি কি কাউকে ভালোবাসো?’ কাজল চমকে উঠলো। তোতা তার খুব পরিচিত নয়। এর আগে তেমন একটা কথা হয়নি। তাই এমন প্রশ্নটা খুব অস্বাভাবিক। তাই অবাক কন্ঠে বলল,’হঠাৎ!’
‘হঠাৎ বলতে….। আমি তোমার সম্বন্ধে বেশকিছু জানি না। সবুজ যেটুকু বলেছে ততটুকুই। আজ সবুজের সঙ্গে কথা বলার সময় বুঝতে পারলাম তুমি বিয়ে করোনি। বর্তমানে মানুষ বিয়ে করে না কেন?সাধারণ ভাবে যদি দেখা হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সে কাউকে ভালোবাসতো কোনো কারণে সম্পর্কটা টিকেনি। খুব ভালোবাসতো তাই আর কাউকে জীবনে পেতে চায়নি। বিয়ে করা হয়নি।’ কাজল হাসলো। বলল,’না না, তেমন কোনো কারণ নেই। আমার ছোটবেলা থেকে বিয়ের প্রতি কোনো আগ্রহ ছিল না। বিয়ে মানে আমার কাছে জেলখানা মনে হতো।’
‘বুঝলাম না ঠিক।’
‘আমি যে পরিবেশে বড়ো হয়েছি ওই পরিবেশটা আমাকে বিয়ে থেকে দূরে রেখেছে। আমি যখন ছোট ছিলাম তখন থেকে দেখেছি আমার বাবা-মা একে অপরকে খুব ভালোবাসে। কিন্তু তাদের মধ্যে প্রতিদিন ঝগড়া হতো। আমার চার ভাই বোনকে সামলাতে হিমশিম খেয়ে উঠতো মা। এত বড় বাড়িতে সবসময় কাজে লেগে থাকতে হতো। বিশ্রাম করার সময় পেতো না। বাপের বাড়িতে যাওয়া প্রায় ছেড়ে দিয়েছিল। তবুও ঠাম্মি সবসময় বলতো, তুমি কি কর? আর বাবা কখনো নিজের মায়ের উপর কথা বলতো না। নিজের মা যা বলেছে তাই সত্য। শুধু আমার পরিবার না আমি আশেপাশের পরিবারেও একই ঘটনা দেখেছি। মায়েরা নিজের সবটুকু দিয়ে সংসার আগলে রাখছে কিন্তু দিনশেষে সামান্য সম্মানটুকু পাচ্ছে না। তখন মনে হতো তার সন্তানরা হয়তো একদিন তাকে সম্মান দেবে। কিন্তু না। সন্তানরা বড়ো হয়ে মাকে ফেলে বাইরে চলে যায়। তাদের কাছে বোঝা মনে হয়। অবহেলা করে। নিজের জীবনটা তাহলে কার জন্য নষ্ট করলো? নিজের জীবনটা অন্যের জন্য নষ্ট করে লাভ কি? কি পাবো জীবনে? ওইসব ঘটনা আমার চোখের সামনে বারবার ধরা পড়েছে। তাই বিয়ের প্রতি আমার বরাবরই অনীহা ছিল। আমি ঠিক করে নিয়েছিলাম কখনো বিয়ে করবো না। নিজের মতো থাকবো। নিজেকে ভালোবাসবো। নিজেকে সবসময় খুশি রাখবো। নিজেকে খুশি রাখার জন্য আমি আকাশ পাহাড়-পর্বত সমুদ্র জঙ্গল বৃষ্টি বেছে নিয়েছি।’
‘বড় অদ্ভুত মেয়ে তুমি! এভাবে কি জীবন কাটানো যায়?’
‘যায় তো। আমি প্রতিষ্ঠিত হতেও চাইছিলাম না। ধরাবাঁধা জীবন আমার পছন্দ নয় কিন্তু বেঁচে থাকার জন্য তো প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। রোজগার করতে হবে। তুমি বিশ্বাস করবে না আমি এখনও কোনো কাজ করি না। আমি কোনো কাজ খুব বেশি হলে একবছর করি। ওইখান থেকে যা টাকা রোজগার হয় তা দিয়ে পাঁচ বছর মতো কাটিয়ে দিতে পারি। তারপর আবার কোনো কাজ খোঁজ করি।’
তোতা অবাক চোখে কাজলের দিকে তাকালো। বলল,’তাহলে তুমি সারাদিন করো কি?’
‘কিচ্ছু না। সমুদ্রের পাড়ে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকি। পাহাড়ে গিয়ে একা একা বসে থাকি। ঘাসের উপর শুয়ে থাকি। পাখিদের সাথে খেলা করি। মাঝেমধ্যে একা একা জঙ্গলের দিকে চলে যাই। সবকিছু ঘুরে দেখি। ওরাই আমার প্রেমিক। ওদের খুব ভালোবাসি আর ওরাও আমায় খুব ভালোবাসে।’
‘বাপরে বাপ। তোমার কথা শুনে তো আমার ভয় করছে। খুব সাহসী তুমি। এত চুপচাপ থাকতে ভালো লাগে তোমার?’
‘কে বলেছে আমি চুপচাপ থাকি? আমি ওদের সাথে কথা বলি। মানুষের সাথে অবশ্য কথা বলি তবে খুব কম।’
‘এমন জীবন তোমার খুব পছন্দ?’ কাজল হাসলো। একটু থেমে বলল,’রবি ঠাকুর একটা কথা বলেছে না নদীর এপারের মানুষ ভাবে ওপারের মানুষ সুখে আছে আর ওপারের মানুষ ভাবে এপারের মানুষ সুখে আছে। ব্যাপারটা এমন। আমার জীবনে শান্তি প্রচুর। কিন্তু এই জীবনে অশান্তি নেই, সুখ নেই। তাই এ জীবনটাও খুব বেশি ভালো নয়। এ জীবনে কঠিন পরিস্থিতি আসে না। এমন জীবনে লড়াই নেই। অশান্তি নেই। আর এগুলো ছাড়া জীবন অসম্পূর্ণ। জীবনে শুধু সহজ-সরল শান্তি নয়, মিথ্যা অশান্তি মনোমালিন্য এগুলোরও প্রয়োজন। এগুলো ছাড়া জীবন অসম্পূর্ণ।’

পর্ব ৩০ আসছে।।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here