নাগিন_কন্যা ৩য় পর্ব

#নাগিন_কন্যা
৩য় পর্ব

একটা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ছুটছে চন্দ্র। সামনে সব কিছু কেমন ঘোলা ঘোলা লাগছে। সে বুঝতে পারছে সে মানুষ নয় , একটা সাপ হয়ে ছুটছে। নিজের উপর ওর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। কেন ছুটছে এইভাবে এখনো বুঝতে পারছে না। ঝোপঝাড় , গাছের শিকড় , নরম , শক্ত মাটি পেরিয়ে সে জঙ্গল দিয়ে ছুটছে তো ছুটছেই। পর মুহূর্তেই বুঝতে পারলো কেন সে ছুটছে। তাকে একটা লোক তারা করেছে। সে ছুটছে লুকানোর একটা জায়গা খোঁজার জন্য। একটা গর্ত চোখে ধরা পড়লো তার এবং সাথে সাথে এও বুঝতে পারলো লোকটা তার খুব কাছে চলে এসেছে। গর্তে ঢুকে পড়লো সে এমন সময় লেজে টান পড়লো তার। মাথার কাছে শক্ত একটা হাত চেপে ধরেছে ওকে। ওর সাপের শরীর পেঁচিয়ে ধরার চেষ্টা করছে লোকটার হাত। অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছে লোকটা তাকে ধরার আনন্দে। কিছুতেই লোকটার মুখ দেখতে পাচ্ছে না ও। অস্বস্তিতে শুধু ছটফট করছে।

ভয়ে অস্থির করা সেই অনুভূতি নিয়েই ঘুম ভেঙে গেল চন্দ্রের। এই স্বপ্নের মানে কী ? দ্রুত বুক উঠা-নামা করছে তার। সে প্রায়ই এখন স্বপ্নে নিজেকে সাপের রূপে দেখে। কিন্তু আজকের মতো এমন ভয়ঙ্কর কোনো স্বপ্ন ছিল না ওগুলো। জানলা দিয়ে বাইরে তাকালো , জোৎস্নার আলোর সঙ্গে হালকা কুয়াশার চাদর এক ঝাপসা পরিবেশ করে রেখেছে। এখন মাঝরাত। বড় বড় শ্বাস নিয়ে নিজের আতঙ্ক দূর করতে চাইছে যেন সে। এখন এক ঘরে একাই ঘুমায় চন্দ্র , দাদি অন্যঘরে। হিসহিস শব্দ তুলে নিচ থেকে একটা সাপ উঠে এলো বিছানায় তার পায়ের উপর। পা বেয়ে বেয়ে চন্দ্রের কোলের কাছে চলে এলো ওটা , যেন ওকে স্বান্তনা দিতে । শাঁখামুটি সাপ এটা। পুরো মেঝেময় ছড়িয়ে আছে ভিন্ন জাতের আরো ৮-১০ টা সাপ। এগুলো সব সারাদিন গর্তে লুকিয়ে থাকে। কেউই জানে না এতগুলো সাপ নিয়ে ঘুমায় চন্দ্র। এমন কী দাদিও না। চন্দ্রকে উঠে বসে হাঁপাতে দেখে ওগুলোও ধীরে ধীরে পায়া বেয়ে উঠে এলো বিছানায়। ওরাও যেন আদর চায় ওর, ওর মনকে শান্ত করতে চায়। চন্দ্রের পুরো শরীরে কিলবিল করতে লাগলো ওগুলো উঠে। যে কেউ এই অবস্থায় ওকে দেখে মূর্ছা যাবে। চন্দ্র খিলখিল করে হেসে উঠলো। এক মুহূর্তে সব দুশ্চিন্তা মন থেকে উড়ে গেছে। এরা একে এত ভালোবাসে! কোনো বিপদই তাকে স্পর্শ করতে পারবে না।

চন্দ্রবাড়ির পেছনে একটা ফুলের বাগান করেছে। জঙ্গলে হাটতে গিয়ে যত রকম ফুল চারা পায় সব এনে লাগায় এখানে। সেখানে পরদিন বিকেলে পরিচর্চা করছে। এমন সময় হাবলু মেম্বারের ছোট ছেলে ছুটে আসলো তার কাছে। কান্না জড়িত কণ্ঠে বলল , আব্বারে সাপে কাটছে! তাড়াতাড়ি চলেন। বড় কেউ না এসে এইটুকু বাচ্চাকে পাঠিয়েছে দেখে চন্দ্র অবাক হলো। হাবলু মেম্বার দুই চোখে দেখতে পারে না চন্দ্রকে। সবাইকে বলে বেড়ায় চন্দ্র একটা অভিশপ্ত ডাইনি , ওর জন্মের আগে এই গ্রামে এত সাপের উপদ্রব ছিল না। তবুও চন্দ্র হাবলুর ছেলের সাথে তাদের বাড়িতে গেল। বাড়ি ভর্তি মানুষ। বাড়িতে গিয়েই বুঝতে পারলো ওর জন্য কেউ অপেক্ষা করে নেই। বিষ নামানোর কাজ অন্য কেউ করছে। কিছুটা অবাক হয়ে এগিয়ে গেল সে।

তাকে দেখে সবাই জায়গা করে দিল হাবলুর ঘরের ভেতর ঢুকতে। ঘরের দরজার কাছে গিয়েই দেখলো মেঝেতে পাটির ওপর শুইয়ে রাখা হয়েছে হাবলুকে মাথা দরজার দিকে দিয়ে। ঘরে কিসের যেন তীব্র একটা গন্ধ । হাবলুর পায়ের কাছে একটা কালাচ সাপ বসে আছে। আরেকটা লোক তার পাশে বসে কীসব মন্ত্র পড়ছে , আর হিসহিস করে শব্দ করে সাপটাকে উত্তেজিত করার চেষ্টা করছে। ভালো করে তাকাতেই চন্দ্র দেখলো লোকটার বাম হাতে কব্জির পরের অংশ নেই। সাজপোশাক দেখে ভাবলো, গ্রামের নতুন ওঝা নাকি! চন্দ্র ঘরে ঢুকতে ওর দিকে ফিরেও তাকালো না লোকটা। একমনে মন্ত্র পড়ছে সাপটার দিকে তাকিয়ে , হিসহিস শব্দ তুলে মেঝেতে আঘাত করছে।

চন্দ্র প্রায় সব সাপের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে শুধু এই কালাচটাকে ভয় পায়। অনেক চেষ্টা করেও এই জাতের সাপের সঙ্গে সে যোগাযোগ করতে পারে না। এই সাপ কোথায় থাকে তাই বুঝতে পারে না। চন্দ্রকে চমকে দিয়ে সাপটা তার দিকে অর্থাৎ দরজার দিকে মুখ করে হিসহিস করে উঠলো। চন্দ্র এক পা পিছিয়ে এলো। অবাক হয়ে দেখলো সাপটার লেজ ক্রমশ সরু হতে হতে একটা সুচের আকার ধারন করলো। লাফিয়ে উঠে ওটা গেঁথে গেল হাবলুর পায়ের উপর যেখানে সাপে কামড়েছিল। মুখ দিয়ে অদ্ভুত হিসহিস শব্দ তুলছে ওটা আর কাঁপছে। এরপর সুচের মতো লেজটা বের হয়ে এলো , ক্রমশ আগের রূপ নিল। এত জাদু! বিস্ময় ভরা চোখে দেখলো চন্দ্র। ঘরের ভেতর হাবলুর স্ত্রী , ছোট ভাই ওরাও হতভম্ব হয়ে গেছে। কালাচের লেজতো এমন হয় না! ক্ষত দিয়ে বেরিয়ে এলো রক্ত। ওঝা এবার মুখ তুলে জায়গাটা বেঁধে দিতে বললেন। কয়েক মুহূর্ত পরেই চোখ খুলে তাকালো হাবলু। একেবারে সুস্থ সে। সাপটাকে ধরে একটা কাপড়ের ব্যাগের ভেতর ভরলো ওঝা এরপর ওটাকে নিজের ঝোলায় ঢুকিয়ে ফেলল।

এবার ওঝার চোখ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কিশোরীর উপর পড়তেই কয়েক মুহূর্ত অপলক তাকিয়ে রইলেন , চোখে বিস্ময়। কী যেন মেলানোর চেষ্টা করছেন , চোখটা চকচক করে উঠলো। চন্দ্রও বিস্ময় ভরা চোখে ওঝা মালেকের দিকে তাকিয়ে আছে। কেমন শরীরটা শিরশির করে উঠলো তার।

ওঝা উঠে ওকে পাশ কাটিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। সবাই জয়ধ্বনি দিতে লাগলো ওঝাকে। দরজার পেছনে দাঁড়িয়ে কয়েকজন ওঝার এই কেরামতি দেখেছে। সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়লো ওঝার এই অলৌকিক ক্ষমতার কথা। একজনকে বলতে শুনলো চন্দ্র , ওঝার নাম মালেক। সে নাকি স্বপ্নাদেশ পেয়ে এই গ্রামে এসেছে সাপের অভিশাপ থেকে গ্রামকে বাঁচাতে। কেমন যেন একটা অস্বস্তি কাজ করতে লাগলো চন্দ্রের মনে। ধীরে ধীরে হেটে বাড়িতে ফিরে এলো।

সারারাত ধরে শুয়ে ছটফট করলো , অস্বস্তি গেল না ঘুমও এলো না। সাপগুলো তার দিকে আসছে দেখে রাগে হিসহিস করে উঠলো চন্দ্র। ওরা পিছিয়ে গেল।

পরদিন সকালে চন্দ্র ঘর থেকে বেরিয়ে অবাক হয়ে দেখলো উঠানে পিঁড়ি পেতে একটা লোক বসে আছে। ওর দাদির সঙ্গে গল্প করছে। ভালো করে দেখে চিনতে পারলো, এই সেই ওঝা যে হাবলু মেম্বারকে গতদিন বাচিয়েছিল। চন্দ্রকে দেখেই লোকটা জড়সড় হয়ে উঠে দাঁড়ালো , ওর সামনে গিয়ে বিনীত ভাবে সালাম দিয়ে বলল , আপনার কাছে ক্ষমা চাইতে আসছি মা!

চন্দ্র অবাক হয়ে জানতে চাইলো , কেন?

আসলে আমি আপনার কথা জানতাম না। গ্রামে ঢুইকাই হুনলাম একটা লোকেরে সাপে কাটছে। আমি গিয়া তাই বিষ নামাইলাম। পরে জানলাম গ্রামের সব মানুষের বিষ নামানোর জন্য আপনে আছেন। হুদাই আপনার অধিকারে হাত দিলাম।

এটা আমার অধিকার না! আমি উপকার করতে পছন্দ করি তাই ওদের সাহায্য করি। আপনিও হাবলুর উপকার করেছেন। রাগ করবো কেন ! আপনি নাকি স্বপ্নে আদেশ পেয়ে এই গ্রামকে সাপের অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে এসেছেন ?

জিহ্বায় কামড় দিল হাতকাটা ওঝা মালেক। কী কন! এই গ্রামের মানুষগুলা আজগুবি সব! আন্দাজে এই গুজব ছড়াইছে। আমি আসলে গ্রামে গ্রামে ঘুইরা ওঝাগিরি করি। হাটতে হাটতে এই গ্রামে চইলা আসছি। মেম্বার হাবলু অবশ্য কইছে এই গ্রামে কোনো ওঝা নাই তাই থাইকা যাইতে। কিন্তু আপনার আপত্তি থাকলে চইলা যাব!

আমি আগেই বললাম এটা তো আমার পেশা না। এটা আপনাদের কাজ। আমার আপত্তি থাকবে কেন !

আপনার বড় দয়া মা। এইটুকু বয়স আপনের তাই সাপের তিন অবস্থা করে রেখেছেন এই গ্রামের, তা শুনেই আপনার প্ৰতি আমার সম্মান জন্মাইয়া গেছে। দেখা করার জন্য মন ছটফটাইয়া ছিল সারারাত। আপনে কেমনে সাপের বিষ নামান তা একবার দেখার খুব শখ। আপনাদের জাত-গোষ্ঠীতে শুনেছি কোনো সাপুড়ে নাই , তাইলে আপনে এই বিদ্যা শিখলেন কেমনে মা?

চন্দ্র আড়চোখে একবার লোকটার ঝোলার দিকে তাকালো, তারপরেই চোখ গেল কাটা হাতের দিকে। তারপর অন্যমনস্ক সুরে বলল , আমি এখন বাগানে যাব। গাছে পানি দিতে হইবো।

আচ্ছা , আচ্ছা মা! এক গ্রামে যখন আছি সবই আস্তে আস্তে জানবো আমরা একজন আরেকজনের সম্পর্কে। আজ তাইলে আসি মা!

চন্দ্র সত্যিই বাগানের দিকে চলে গেল। চন্দ্রের দাদির কাছে বিদায় নিয়ে ওঝা মালেক পথে বেরিয়ে এলো। তার চোখ জ্বলজ্বল করছে। তার পুরোপুরি সন্দেহ এই কিশোরী মেয়েটাই ইচ্ছাধারী নাগিন , অথচ মেয়েটা নিজেও হয়তো টের পায়নি এখনো। কী সরল! মুখে পৈশাচিক হাসি ফুটে উঠলো মালেকের। চন্দ্র কী সত্যিই ইচ্ছাধারী নাগিন, তা আগে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে হবে। এটা পরীক্ষা করার একটা উপায় তার জানা আছে। ভালোয় ভালোয় আগামী অমাবস্যা পর্যন্ত ওয়ালিপুর গ্রামে তাকে কাটাতে হবে সাধারণ ওঝার ভেসে। তারপর সেই অন্ধকার রাতে এলেই সে তার জাদুর ক্ষমতা দিয়ে নিশ্চিত হবে চন্দ্রই আসলে নাগিন কিনা। ও নাগিন হলে একটা কিশোরী নাগিনকে কাবু করতে ওর তেমন কষ্ট হবে না!

ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করতেই শরীরে এক ধরণের ঐশ্বরিক শক্তি অনুভব করল ওঝা মালেক। ভয়ঙ্কর এক শক্তি ডাকছে তাকে। ………………….
.
.
. . . চলবে . . .
.
.
লেখা: #Masud_Rana

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here