নাগিন_কন্যা ৪র্থ পর্ব

#নাগিন_কন্যা
৪র্থ পর্ব

চন্দ্র তার দাদির কাছে জানতে চাইলো, ‘আচ্ছা দাদি , মানুষ কী সাপ হইতে পারে? ‘ তার দাদি অবাক হয়ে বলল , ‘ এইসব কী কথা? ‘ চন্দ্র রান্নাঘরের পিঁড়ি টেনে নিয়ে বসলো ; ‘ অনেকেই কয় , দাই রহিমের মা নাকি বলছিল আমি একটা সাপ হইয়া জন্মাইছিলাম। তারপর মানুষ হইছি ? ‘

ওর মাথা ছিল আউলা। সব সময় উল্টাপাল্টা কথা কইতো।

চন্দ্র উঠে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসে। গতকাল রাতে তার সঙ্গে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। মাঝরাতে টিনের চালে কিছুর হাঁটার শব্দে ঘুম ভেঙে যায় তার। শব্দটা তেমন জোরালো না। পাখি বা ছোট কোনো প্রাণীর হাঁটাচলা। এই সামান্য শব্দে ঘুম ভেঙে গেল তার! অবাক হলো। ঘরে হারিকেন জ্বালিয়ে ঘুমায় সে। অবাক হয়ে দেখলো , হারিকেন নিভে আছে। আজকে জোৎস্নারাত ছিল, কিন্তু এখন বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিছু একটা অস্বাভাবিক লাগলো তার। মুখ দিয়ে হিসহিস শব্দ তুলে চৌকির কাঠে আঘাত করে এক বিশেষ ধরনের কম্পন তৈরি করলো সে।

তার ঘরের সব সাপকে আহ্বান করছে সে তার কাছে আসার জন্য। এতে কিছুটা ভরসা পাবে সে। আশ্চর্য্য কয়েক মিনিট কেটে গেলেও কোনো সাপের সাড়া পেল না চন্দ্র। ধীরে ধীরে বিছানায় উঠে বসলো। মাথার কাছেই ম্যাচ ছিল। ওটা নিয়ে একটা কাঠি জ্বালালো। মৃদু আলোতে সব কিছু আরো যেন ঝাপসা হয়ে এলো। ধীরে ধীরে মেঝেতে পা রেখে হারিকেনের দিকে এগিয়ে গেল। হারিকেন জ্বালতেই পুরো ঘর মোটামুটি আলোকিত হলো। সেই আলোতে পুরো ঘরে শাঁখামুটি কিংবা অন্য কোনো সাপই চোখে পড়লো না তার। ওরাতো এমন ভাবে ওকে ছেড়ে যায় না! অন্তত শঙ্খিনী ( শাঁখামুটি ) তো এই ঘর ছেড়ে তেমন বের হয় না।

হঠাৎ করে আৎকে উঠলো টিনের চালে কারো জোরে ঘুষির শব্দ শুনে। সাথে সাথেই হারিকেন নিভে গেল। চন্দ্র কিছু বুঝে উঠার আগেই অনুভব করলো তার পেছনে অন্ধকারে কিছু একটা দাঁড়িয়ে আছে। মানুষ! কে! ধীরে ধীরে ঘুরলো পেছনে। ঘুটঘুটে অন্ধকার থাকলেও বুঝতে পারলো দুজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে পাশাপাশি। মুখ দিয়ে কোনো শব্দ করতে পারলো না সে। ধীরে ধীরে পিছিয়ে এসে চকির সাথে ধাক্কা খেয়ে থেমে গেল। এবার লোকগুলোর মাথার উপর গোল আকৃতির কিছু একটা জ্বলে উঠতে দেখলো সে। সেখান থেকে বিচ্ছুরিত আলোতে ধীরে ধীরে ঘরের ভেতরের আলোকিত হয়ে উঠলো। সবকিছু পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে এখন সে। বুকটা কেঁপে উঠলো তার। এসব কী!

তার সামনে সম্পূর্ন বিবস্ত্র দুজন নর-নারী দাঁড়িয়ে আছে। এদের গলা পর্যন্ত মানুষের হলেও বাকি অংশ ফণা তলা বড় সাপের মাথা। আতঙ্কে মুখ দিয়ে টু শব্দও বেরোলো না তার। চোখ বিস্ফোরিত হয়ে আছে। এবার চোখ গেল মেঝেতে। পুরো মেঝেময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য অপরিচিত জাতের সাপ। মেঝে ঝুরে ছুটে বেড়াচ্ছে ওগুলো এদিক সেদিক। একটা পেঁচিয়ে ধরছে আরেকটাকে। এক কথায় কিল-বিল করছে। এই প্ৰথম সাপ দেখে সে এত ভয় পেল। তার পায়ের পাতার উপর দিয়ে ওগুলোর চলাচল অনুভব করে গা শিরশির করে উঠলো। স্বপ্ন দেখছে সে! না , সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে অলৌকিক হলেও তার আশেপাশে যা কিছু আছে সব বাস্তব। চিৎকার করতে ইচ্ছা করলেও কেন যেন সে চিৎকার করলো না। এক মনে সামনের নর-নারীর দিকে তাকিয়ে রইলো।

তার সামনের দুজন নর-নারী একে অপরের দিকে তাকালো। মাথা থেকে আলো বিচ্ছুরিত হওয়া পাথর দুটো তুলে হাতে নিল। দুজনের দুটো পাথর একসাথে স্পর্শ করাতেই প্রচণ্ড আলোর একটা স্রোত আঘাত করলো চন্দ্রের চোখে। সে ধাক্কা খেয়ে বিছানার উপর পড়ে গেল। আড়ষ্ট , অবশ হয়ে গেল তার শরীর। সে নড়তে পারছে না! চোখ স্থির হয়ে আছে উপরে। সেই সাপ মস্তকের নর-নারী তার মাথার কাছে এলো। নারী সর্পমানুষের হাতে একটা পাথর। আকারে আগের দুটো থেকে বড়। আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে এটা থেকেও। ওই দুটো পাথর মিলেই যে এটি তৈরি হয়েছে তা সে বুঝতে পারলো। পাথরটা ওর কপালে স্পর্শ করালেন তিনি। প্রচণ্ড মাথা ব্যথায় চিৎকার করে উঠলো এবার চন্দ্র। হঠাৎ করেই পুরো ঘর আবার অন্ধকারে ডুবে গেল , পরমুহূর্তেই জ্বলে উঠল হারিকেন। শরীর নড়াচড়ার শক্তি ফিরে পেয়েই দ্রুত উঠে বসলো সে । ঐ নর-নারীর কেউ কিংবা মেঝে ভর্তি অদ্ভুত অপরিচিত সাপগুলো কিচ্ছু নেই ঘরে। বিছানার একপাশে তার প্রিয় শাঁখামুটি সাপটা শুয়ে আছে।

ঘরের এক কোণে তার পোষা সাপগুলো একটার সঙ্গে আরেকটা মিশে গিয়ে শুয়ে আছে। হাপাচ্ছে চন্দ্র , কী হয়ে গেল কিছুই বুঝতে পারছে না। মাথা এখনো ঝিমঝিম করছে। বিছানায় শুয়ে পড়লো সে। এটা কিছুতেই স্বপ্ন ছিল না , সে অনুভব করেছে সবটাই বাস্তবে ঘটেছে। ঐ পাথরটা কিসের , অদ্ভুত দর্শন সর্প মানব-মানবী কোথা থেকে এলো , আর কেন তার কপালে ওটা স্পর্শ করালো! কিছুই মাথায় ঢুকছে না তার।

শঙ্খিনী ( শাঁখামুটি) সাপটা তার বুকের কাছে উঠে এলো। চন্দ্র ওটার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ঘুমিয়ে পড়লো।

পরদিন সকালে দাদির ব্যবহারে সে বুঝতে পারলো রাতে যা কিছু ঘটেছে এর কিছুই টের পাননি তিনি। তাহলে পুরোটাই কী স্বপ্নে ঘটেছে! সন্দিহান না হয়ে উপায় রইলো না চন্দ্রের।

গ্রামে এক মাস হয়ে এলো ওঝা মালেক এসেছেন। এরমধ্যে সাপের উপদ্রব একেবারে নেই বললেই চলে। যদিও বা কাউকে সাপে কাটে এখন কেউ আর চন্দ্রের কাছে আসে না , সোজা মালেকের কাছে যায়। চন্দ্র অবশ্য এতে হিংসা করে না , বরং কিছুটা মুক্ত অনুভব করে নিজেকে। এইসব ঝামেলায় না জড়িয়েই শান্তি পায় সে। যদিও দাদি সব সময় খিটখিট করে হঠাৎ আয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায়। সেই যে ওঝা মালেক ওর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল এরপরে আর আসেনি। ওঝা মালেককে অদ্ভুত আর রহস্যময় মনে হয়েছে চন্দ্রের কাছে। কথা বলার ভঙ্গিতে বিনয় থাকলেও তার চেহারা দেখেই বোঝা যায় সে এই বিনয়ে অভ্যস্ত নয়। তাই চেহারায় অদ্ভুত এক নিষ্ঠুরতা ভাব ফুটে উঠে। তাছাড়া ওর ওই অদ্ভুত লেজ ওয়ালা কালাচ সাপটা! এর রহস্য সে জানে না , কিন্তু জানার জন্য মন কেমন উসখুস করে।

ওঝা মালেককে হাবলু মেম্বার খুব ভালো ভাবেই প্রশ্রয় দিয়েছেন। প্রথমত তার জীবন বাঁচানোর জন্য। তারপর আবার তার চিরও অপছন্দের চন্দ্রের বিরুদ্ধে বিকল্প কাউকে পাওয়ায়। মালেক যদিও চন্দ্রের চাইতে দূরত্ব রেখে চলার চেষ্টা করে , তবুও চন্দ্র এক প্রকার তার নজরবন্দি। দূর থেকে লুকিয়ে চন্দ্রের কর্মকাণ্ড লক্ষ্য রাখে সে। এই মেয়েটা যে সাধারণ কোনো মেয়ে না , তা সে আগেই বুঝতে পেরেছে। বিশেষ করে নিজে চন্দ্রের সাপে কামড়ানো মানুষের বিষ ছাড়ানো দেখে হতভম্ব হয়ে গেছে। নিজের কোনো ক্ষতি করা ছাড়া এইটুকু একটা কিশোরী মেয়ে মুখ দিয়ে যেকোনো বিষধর সাপের বিষ তুলে আনে কী করে! আর তার দেওয়া সেই শিকড়! এই শিকড়ের নাম অনেক শুনেছে ওঝা মালেক , কতটা ভয় করে চলে এটাকে তারা , কিন্তু অনেক খুঁজেও এর সন্ধান পায়নি সে। চন্দ্র কোথা থেকে এই শিকড় সংগ্রহ করে ভেবে পায় না। তবে আজকে রাতটা খুব গুরুত্বপূর্ণ হাতকাটা ওঝা মালিকের জন্য। আজ অমাবস্যা। এই রাতের জন্যই অপেক্ষায় ছিল সে। আজ রাতেই তাই যে করেই হোক চন্দ্র ইচ্ছাধারী নাগিন কিনা তা নিশ্চিত হতে হবে তাকে। পুরো গ্রামে ঘুরে প্রায় প্রতিটি মেয়েকেই পর্যবেক্ষণ করেছে সে এতদিনে। কিন্তু চন্দ্রের মতো রহস্যময় আর কাউকে মনে হয়নি তার। তাই বিশ্বাস করেই নিয়েছে সে চন্দ্রই ইচ্ছাধারী নাগিন , এখন শুধু নিশ্চয়তা চাই।

রাত ১১ টা বাজে ওঝা মালেক উপস্থিত হয়েছে চন্দ্রের বাড়ির খুব কাছে। ঘুটঘুটে অন্ধকারেও তার পথ চিনতে অসুবিধা হচ্ছে না। একটা ব্যাটারি টর্চ সে জোগাড় করেছিল অনেক আগে , খুবই ক্ষীণ আলো ওটায় থাকায় ,পথ চলতে যেমন অসুবিধা হচ্ছে না, তেমন দূর থেকে তাকে কেউ তেমন ভাবে লক্ষ্য করবে না। তবুও সাবধানে এগিয়ে গেল সে। তার ঝোলার ভেতর যে কালাচ সাপ আছে ওটা আসলে কোনো সাপ না , একটা পোষা পিশাচ যেটা অভিশপ্ত সাপে রূপান্তরিত হয়েছিল কয়েক শ বছর আগে। অনেক কষ্টে , অনেক পথ পেরিয়ে , অনেক সন্ধান করে এটার জোগাড় সে করেছিল ৮ বছর আগে। এরপর থেকেই ভাগ্য ফিরতে থাকে তার। অমাবস্যার রাতে অদ্ভুত ক্ষমতা লাভ করে এটা , সাধারণ সাপের চাইতে কয়েক হাজার গুণ বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠে।

পাশাপাশি দুটো ঘর। টিনের ছাপড়া। দুটো ঘর থেকেই হারিকেনের আলো ভেসে আসছে। ওঝা মালেক জানে ডান পাশেরটায় চন্দ্র ঘুমায় আর বাম পাশের টায় ওর দাদি। কোমরের গামছাটা খুলে শক্ত করে নাক-মুখ বেঁধে নিল নিজের, যাতে কোনো গন্ধ নাকে না আসে। ভাগ্য ভালোই বলতে হবে দুটো ঘরের জানলাই খোলা। দুটো কাঁচের শিশি বের করলো ঝোলা থেকে সে। প্রথমে চন্দ্রের দাদির ঘরে উকি দিল। বিছানায় মরার মতো ঘুমাচ্ছে। একটা শিশি ছুড়ে ফেলল ঘরের মাঝে , ওটা ভেঙে পুরো ঘরে ধুয়ার একটা আবরণ পড়ে গেল।

যেকোনো মানুষের পক্ষে শিশির এই বিষের ক্রিয়ায় ২৪ ঘণ্টার আগে জ্ঞান ফেরার কথা না। এবার চন্দ্রের ঘরের জানলা দিয়ে উকি দিল মালেক। গা শিউরে উঠলো তার। ঘুমিয়ে আছে চন্দ্র। পরনে রোজকার শাড়ি। কিন্তু চন্দ্রের পুরো শরীর জুড়ে ৭-৮ টা শঙ্খচূড় ( রাজ গোখরা ) সাপ বেয়ে বেড়াচ্ছে বা ঢেকে রাখছে ওকে। তাকে উকি দিতে দেখেই একসাথে সবগুলো সাপ তাদের মুখ তার দিকে ঘুরিয়ে নিল। জিহ্বা বের করে একত্রিত কণ্ঠে ভয়ঙ্কর , নিষ্ঠুর হিস হিস শব্দ তুললো। মেঝের অবস্থা আরও ভয়াবহ , কম করেও ২০ টা নানান জাতের বিষধর সাপ পুরো ঘরে ছুটে বেড়াচ্ছে । জানলা দিয়ে ওঝা মালেককে তাকাতে দেখে ওগুলোও থমকে গেল। জানলার দিকে ঘুরে তাকিয়ে আছে সবগুলো এক দৃষ্টিতে ওর দিকে। ওর উপর ছুটে এসে লাফিয়ে পড়ার পূর্ব-প্রস্তুতি নিচ্ছে যেন ওগুলো।

ভয়ে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো মালেকের। এটা কোন জগৎ দেখছে সে ! একটা মানুষের ঘরে এতগুলো সাপ থাকতে পারে! আর কোনো সন্দেহ নেই চন্দ্রই আসল ইচ্ছাধারী নাগিন। বুঝতে পারলো কয়েক মুহূর্ত পরেই ঝাঁপিয়ে পড়বে সাপগুলো তার উপরে, ছোবল মারতে মারতে টুকরো টুকরো করে ফেলবে তার শরীর। যা করার এক মুহূর্তের মধ্যেই করতে হবে।

এমন কিছু হবে আশা না করলেও সিদ্ধান্তহীনতা ভুগালো না তাকে। মুহূর্তে কাঁচের শিশি ছুড়ে ফেলল ঘরের মাঝে। জানে এতে শুধু লাভ যা হবে , চন্দ্র আগামী ২৪ ঘণ্টা অচেতন হয়ে থাকবে। কিন্তু সাপগুলোর এই বিষে কোনো ক্ষতিই হবে না। ওগুলো এখনো জেগে আছে। ওগুলোর বিরুদ্ধে লড়ার শক্তি তার নেই। তার ঝোলা হঠাৎ করে ভয়ঙ্কর রকম কাঁপতে শুরু করলো। মুহূর্তেই সব দুশ্চিন্তা চলে গেল মালেকের। ওটা তার সব শক্তি ফিরে পেয়েছে। জানলার কোনো গরাদ নেই , দ্রুত ঝোলাটা ছুড়ে ফেলল ঘরের ভেতর। ঠাণ্ডা দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঝোলা ফুঁড়ে কালাচ সাপটাকে বেরিয়ে আসতে দেখলো। ওটা আকারে চারগুণ বড় হয়ে গেছে এখন।

মুহূর্তেই জানলার কাছে পৌঁছে গেছে দুটো শঙ্খচূড়ও। লম্বায় একেকটা মানুষের সমান। ওঝা মালেক কিছু বুঝে উঠার আগেই দুটো ওর উপর লাফিয়ে পড়লো। এক হাতে একটার ধর চেপে ধরতে পারলেও অপর সাপটা কামড়ে ধরলো তার এক কান। মাটিতে শুয়ে পড়লো মালেক। ঘরের ভেতর এরমধ্যেই ভয়ঙ্কর কালাচের তাণ্ডব শুরু হয়ে গেছে। ভয়হীন ভাবে এক সাথে ঝাঁপিয়ে পড়ছে সব সাপ ওটার উপর কিন্তু কোনোটাই সামান্য পরিমাণও ক্ষতি করতে পারছে না ওটার। …………………….
.
.
. . . চলবে . . .
.
.
লেখা : #Masud_Rana

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here