নাগিন_কন্যা ৭ম পর্ব

#নাগিন_কন্যা
৭ম পর্ব

ওঝা মালেক গভীর ঘুমে শুয়ে আছে তার বিছানায়। তার চোখ বন্ধ থাকলেও সে স্পষ্ট অনুভব করতে পারছে ঘরের এক কোণে থাকা ঝোলার ভেতর থেকে শত বছরের সেই অভিশপ্ত পিশাচ শক্তির অধিকারী কালাচ সাপটা বেরিয়ে মেঝেতে নেমে পড়েছে। ওটা এমন কখনই করে না। সে যতক্ষন পর্যন্ত না ডাকে ওটাকে, নিজ থেকে ঝোলার বাইরে বেরোয় না। ওঝা মালেক অনেক চেষ্টা করেও শরীর নাড়াতে কিংবা চোখ খুলতে পারছে না। তবুও আশেপাশে যা ঘটছে সবই স্পষ্ট বুঝতে পারছে। সাপটা তার খাটের পায়া বেয়ে বিছানায় উঠে এলো এবার। থরথর করে কাঁপছে মালেক। ওটা তার পা বেয়ে উরুর উপর দিয়ে তার বুকের উপর উঠে গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়ল। ওটার ওজন অনেক বেড়ে গেছে যেন, মনে হচ্ছে বুকের উপর কেউ একটা বড় পাথর বসিয়ে দিয়েছে। আশ্চর্য , ওটাকে এত ভয় লাগছে কেন তার! এটা যত অভিশপ্তই হোক , তার পোষা সাপ। তার কোনো ক্ষতিই এটা করবে না।

সাপটা এবার ধীরে ধীরে তার গলা পেঁচিয়ে ধরে চাপ সৃষ্টি করতে লাগলো। আতঙ্কে অস্থির বোধ করছে মালেক। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে , দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। শরীর ঘামছে কিন্তু কিছুতেই চোখ খুলতে পারছে না। হঠাৎ অনুভব করলো কোনো কালাচ সাপ নয় , একটা কিশোরী মেয়ে বসে আছে তার বুকের উপর। হাত দিয়ে চেপে ধরেছে ওর গলা। একবার চেষ্টা করতেই এবার চোখ মেলতে পারলো সে। তার বুকের উপর বসে আছে চন্দ্র। মুচকি বিদ্রুপের হাসি লেগে রয়েছে চন্দ্রের ঠোঁটে। হাত আরো শক্ত করে চেপে ধরছে চন্দ্র ওর গলায়। মরে যাচ্ছে মালেক। চিৎকার করে উঠলো।

অবশ্যই এটা একটা স্বপ্ন ছিল। ভয়ংকর স্বপ্ন! বিছানায় উঠে বসে হাপাচ্ছে মালেক। এটা কীরকম স্বপ্ন ছিল! বাম কানটা এখনো ব্যথায় টনটন করছে। শরীরও কেমন শক্তিহীন বোধ হচ্ছে। সেই রাতের ঘটনাটা মনে হতেই কেমন অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো! চন্দ্রের ক্ষমতা সম্পর্কে সে আচঁ করতে পারছে। আর নাগিন সম্পর্কে সে যতটুকু জানে ১৯ বছর পূর্ণ হলে এরা সম্পূর্ণ ক্ষমতা লাভ করে। তার কালাচ আর সে একত্রে মিলেও কিছুতেই চন্দ্রের ক্ষমতার মোকাবেলা করতে পারবে না। তারমানে এর আগেই যে করেই হোক চন্দ্রকে সাপে রূপান্তর করে আটকে ফেলতে হবে তাকে। অবশ্যই বুদ্ধি আর কৌশল দিয়ে। একবার ওকে হত্যা করে ওর সর্প শরীরের অংশ দিয়ে সেই মহা ঔষধ তৈরি করে সেবন করতে পারলেই সে সর্ব শক্তির অধিকারী হয়ে যাবে , দুনিয়ার কোনো সাপের বিষই তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না , আর অধিকাংশ সাপই থাকবে তার নিয়ন্ত্রণে। সে চাইলেই তারা আক্রমণ করে ধ্বংস করে দেবে যেকোনো গ্রাম , শহর। দুনিয়ার ক্ষমতাবান মানুষদের একজন হবে সে। কিন্তু চন্দ্রকে সে বশ করবে কী করে! চন্দ্র কী তার ক্ষমতা দিয়ে আঁচ করতে পেরেছে , এই গ্রামে সে এসেছে কেবল চন্দ্রের শত্রু হয়ে! এই স্বপ্নের আর কী অর্থ হয়!

চন্দ্র বিস্মিত হয়ে ভাবছে সেই রাতের ঘটনা। রাজ নাগ-নাগিন , সাপ সাম্রাজ্য, তার জন্মের সব ইতিহাস, সব স্মরণ করতেই কেমন গুলিয়ে উঠছে মাথা। সে কী আসলেই নাগিন কন্যা! ইচ্ছাধারী নাগিন! সে রাতের পুরো ঘটনাটাই কী স্বপ্নে ঘটেছে, তার কল্পনা , নাকি সত্যিই সে সাপ সাম্রাজ্যে গিয়েছিল! তার জন্ম, নিয়তি সব যা তাকে বলা হয়েছিল সব সত্যি নাকি! এমন কিছু কী আসলেই সম্ভব! সত্যিই কী ১৯ বছর পূর্ণ হওয়ার সাথে সাথে তাকে এই চেনা-পরিচিত জগৎ ছেড়ে চলে যেতে হবে সর্পরাজ্যে! সে সেখানকার রাজকন্যা , তার সর্প পিতা-মাতার সাথে তাকে রাজ্য উদ্ধারে অংশগ্রহণ করতে হবে! ভাবতেই কেমন আজগুবি , এলোমেলো লাগছে সব কিছু। আর এই গ্রামে তার কোন, এমন শত্রু আছে যে তাকে হত্যা করতে চাইছে , যার হাত থেকে তাকে বেঁচে থাকার ইঙ্গিত দিয়েছে সেই সর্প নর-নারী! নানান প্রশ্ন আর চিন্তা একসাথে মাথায় ভর করছে চন্দ্রের। এসবের উত্তর পেতে হলে অপেক্ষা করে যেতে হবে আর বেঁচে থাকতে হবে তাকে।

কয়েক মাস কেটে গেছে। গ্রামে হঠাৎ করেই আবার সাপের উপদ্রব প্রচণ্ড রকম বেড়ে গেল। সমানে মানুষকে সাপে কামড়াতে লাগলো। কেউ ধানের খেতে কাজ করছে হঠাৎ দেখলো এক কোণা থেকে একটা সাপ ছুটে আসছে তার দিকে। বিস্মিত হয়ে গেল সে , কারণ সবাই জানে সাপ আক্রমণাত্মক প্রাণী নয়। মানুষ জন হঠাৎ করে তাদের সামনে উপস্থিত হয়ে গেলে কিংবা তাদের বিরক্ত করলেই এরা কামড়ায়। দূর থেকে কেবল আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে এরা কখনো ছুটে আসে না। কিন্তু এমনটাই ঘটছে। কেউ পুকুরে গোসল করছে , হঠাৎ করে অনুভব করলো পায়ে কিছু একটা পেঁচিয়ে উঠছে , চিৎকার দেওয়ার আগেই স্পষ্ট সাপের কামড় টের পেয়ে যায় , কেউ মাছ ধরতে বসে আছে আচমকা কোথা থেকে এসে কামড়ে দিচ্ছে সাপ , গাছ বেয়ে উঠে ফল পারতে যাওয়া কিশোর-কিশোরী কিছু বুঝে উঠার আগেই কোনো পাতার ঝোপ থেকে বেরিয়ে আসছে বিষধর সাপ , কামড়ে দিচ্ছে হাতে। সকাল বেলা রান্না ঘরে ঢুকেছে গৃহিণী রান্না করতে , আনমনে মাটির চুলার ভেতর হাত ঢুকিয়েছে বাসী ছাই বের করতে তখনই অনুভব করলো সাপের দংশন। বিছানায় শুয়ে আছে কেউ নিশ্চিত মনে এমন সময় হঠাৎ শরীরের উপর কিছু নড়াচড়া টের পেয়ে চোখ খুললো , আর তখনই কামড়ে দিল সাপটা। নানান প্রজাতির বিষধর সাপ ওগুলো। কেউটে , কালাচ , শঙ্খচূড়, গোখরা।

এইসবই অস্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু মহা অস্বাভাবিকতার কাছে এইগুলো খুবই তুচ্ছ। এবং বাস্তবেই ওয়ালিপুর গ্রামে ঘটছে এসব। অস্বাভাবিকতার আরো একটা অংশ ছিল এইযে , কাউকেই অবচেতন অবস্থায় একটা সাপও দংশন করছিল না। সবাই যখন খেয়াল করলো একটা সাপ আছে তার পাশে তখনই ওটা কামড়ালো বা কামড়ানোর পর তার দৃষ্টির সামনে এসে জানান দিয়ে গেল ওটা একটা সাপ এবং তাকে দংশন করেছে। কেউ সাপের উপস্থিতি খেয়াল না করলে অস্বাভাবিক ভাবে নড়া-চড়া করে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সাপগুলো ,তারপর কামড়ে দেয়। যাতে সবাই বুঝতে পারে সাপ কামড়েছে ওদের।

চন্দ্র যেমন বিস্মিত হয়েছে হঠাৎ এই গণহারে সাপের উপদ্রব , আক্রমণে। ওঝা মালেকও বিস্মিত হয়ে এইসবের আগা-মাথা কিছুই বুঝতে পারলো না। সাপ আবার এমন গণহারে সব মানুষকে কামড়ায় নাকি!

অবশ্য এই পুরো সময়ের মধ্যে সাপে কামড়ানো একটি মানুষও মারা যায়নি। হয় চন্দ্র তার মুখ দিয়ে অসাধারণ বিষ নামানোর ক্ষমতা দিয়ে বিষ নামিয়ে বাঁচিয়েছে। নয় ওঝা মালেক তার কালাচ সাপ দিয়ে বিষ নামিয়ে বাঁচিয়েছে। খবর দিতে যতক্ষন দেরি ওরা হাজির হয়ে গেছে। ওঝা মালেক এমন খাটা-খাটনিতে বেশ বিরক্তই হচ্ছিল। তার উদ্দেশ্য পূরণের ধারে-কাছেও যেতে পারছে না এসবের কারণে। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে এছাড়া আর উপায়ই বা কী। অনেক খুঁজেও চন্দ্রকে বশ করার কোনো পথ খুঁজে পায়নি সে। সে জানে না যে ১৯ বছর না হওয়া পর্যন্ত চন্দ্র ইচ্ছামতো সাপ থেকে মানুষ , আর মানুষ থেকে সাপ হতে পারবে না। তাই সে গোপনে চন্দ্রকে অনুসরণ করে। ভাবে এক সময় না এক সময় নিজচোখে চন্দ্রকে সাপ হয়ে যেতে দেখবে। কিন্তু বরাবরই বৃথা পরিশ্রম । অস্বাভাবিক কিছুই চোখে পড়ে না তার।

সাপে কামড়ানো মানুষ গুলো সবাই বেঁচে যাওয়ায় তাদের মুখ থেকে সাপে কামড়ানোর বিবরণ গ্রামের সবাই শুনতে পেল। এবং আতঙ্কে অস্থির হয়ে উঠলো। সাপ নিজে পরিকল্পনা করে , একত্রিত হয়ে , ওৎ পেতে মানুষ কামড়াচ্ছে! সাপ হঠাৎ উপস্থিত হলে যাতে মুহূর্তেই আক্রমণ করে ওটাকে দমিয়ে দেওয়া যায় এরজন্য সব সময় হাতের কাছে কিছু না কিছু রাখলো তারা। কিছু সাপ অবশ্য মারা পড়লো তাদের কামড়াতে এসে। কিন্তু মারা যাওয়ার আগে সবগুলোই তাদের বিষ মানুষের শরীরের রক্তে ঢুকিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় চন্দ্রের সেই অদ্ভুত গাছের শিকড় যেটা সাপকে মানুষ হতে দূরে রাখতো , ঐ গাছের শিকড়ের সব ক্ষমতা যেন মুহূর্তেই নষ্ট হয়ে গেছে। কোনো উপকারেই আসছে না ওটা।

ওঝা মালেক কিছুতেই এইসব ঘটনার কুল কিনারা খুঁজে না পেলেও চন্দ্র আচঁ করতে পারে এর সাথে সামান্য হলেও ওর সম্পর্ক আছে। কারণ ঐ রাজ নাগ-নাগিন তাকে বলেছিল। এখন সাপ তার বন্ধু হলেও তার ১৯ বছর পূর্ণ হলেই অধিকাংশ তার শত্রুতে রূপান্তরিত হবে। যদিও তার উনিশ বছর হয়নি এবং তার উপর কোনো সাপ আক্রমণ করে না। কিন্তু সেতো ১৭ থেকে ধীরে ধীরে ১৯ এর দিকেই যাচ্ছে। হয়তো এটাই এর পূর্বাভাস! চন্দ্রের মনে হচ্ছে আশেপাশের গ্রাম , ঝোপ , জঙ্গলের সব সাপ ধীরে ধীরে এসে ওয়ালিপুর গ্রামের কাছে জড়ো হচ্ছে। ভয়ঙ্কর কিছু একটা ঘটানোর পূর্বপ্রস্তুতি চলছে!

তাকে প্রকৃতি বলতে চাইছে , এটা তোমার জগৎ না , এই জগৎ ছেড়ে তুমি তোমার পরিচিত জগতে ফিরে গেলেই আবার সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে আসবে! এইসব কিছু , তার দাদি , তার গ্রামের মানুষ , বন্ধু সাথী সব ছেড়ে তাকে চলে যেতে হবে ভেবেই একরকম মন উদাস হয়ে যায় তার। প্রচণ্ড কান্না পায়। তার তার বয়স বাড়ছে , গ্রামে সাপের উপদ্রব তত বাড়ছে। তার ধারণাটা যে সত্যি এটা প্রমাণ করবার জন্যই যেন এসব ঘটছে।

ওঝা মালেক এখন কোমরের গামছাটা কপালের উপর দিয়ে পেঁচিয়ে দুই কান ঢেকে রাখেন। তার বাম কানটা যে পুরোপুরি কেটে ফেলা হয়েছে তা যেন গ্রামের কেউ আর টের না পায়। হ্যা , আবার পিশাচ সাধনার আশ্রয় নিয়েছে সে। পিশাচ সাধনার এই নিয়মে পিশাচিকে শরীরের একটা অঙ্গ কেটে দান করলে সে নানান তথ্যে আর শক্তি দিয়ে পূজারীকে সাহায্য করে। সে তার বাম হাত কেটে দিয়ে ইচ্ছাধারী নাগিন যে এই গ্রামে আছে সে তথ্য জানতে পেরেছিল। এবার সে বাম কান কেটে পিশাচিকে উৎসর্গ করেছে , মাতবর বাড়ির এক কামড়াতেই খুব গোপনে কাজটা করেছে সে, চন্দ্রের জীবনের ইতিহাস পিশাচির মাধ্যমে জানতে। পিশাচি তাকে সাহায্য করেছে।

চন্দ্রের সমস্ত জীবনের ইতিহাস , নিয়তি সবই তার অলৌকিক ক্ষমতা দিয়ে মালেকের সামনে উপস্থাপন করেছেন তিনি। মালেক এখন জানে সে শুধু শুধুই চন্দ্রের সাপ হওয়ার অপেক্ষা করে গোপনে তাকে অনুসরণ করে সময় নষ্ট করেছে এতদিন। চন্দ্র ১৯ বছর পূর্ণ করলেই কেবল ইচ্ছাধারী নাগিনে রূপান্তরিত হতে পারবে। এর আগে না। সেই পর্যন্ত তাকে অপেক্ষা করতে হবে এই গ্রামে। তার ১৯ বছর পূর্ণ হলেই কী উপায়ে সে চন্দ্রকে বশ করে আটকে ফেলতে পারবে এই উপায়ও পিশাচি তাকে বলে দিয়েছেন। এখন নিজেকে প্রচণ্ড ক্ষমতাবান , জ্ঞানী মনে হচ্ছে মালেকের। এখন শুধু চন্দ্রের ১৯ বছর পূর্ণ হওয়ার অপেক্ষা। তারপরেই পরিকল্পনা মতো যা করার করবে সে। তার এতদিনের সব স্বপ্ন এত সহজেই পূর্ণ হয়ে যাবে ভাবতেই পুলকিত হয়ে ওঠে ওঝা মালেক। আনন্দ আর লোভে চকচক করতে থাকে তার চোখ। …………………………….
.
.
. . . চলবে . . .
.
.
লেখা: #Masud_Rana

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here