দোলনচাঁপার_টানে,চতুর্থ_পর্ব
দেবারতি_ধাড়া
কিঙ্কিণী নিচে গিয়ে দেখলো ওর ঘরের সামনে দুলাল বাবু দাঁড়িয়ে আছেন। দুলাল বাবুকে দেখেই কোকো ওনার পায়ের কাছে গিয়ে মুখ ঘষতে লাগলো। দুলাল বাবু রোজ তিনবার করে খাবার দিতে আসায় ওনাকে বেশ ভালোই চিনে গেছে কোকো। দুলাল বাবুরও আগের থেকে ভয়টা একটু কমেছে।
-একী দুলাল বাবু? আপনি কখন এলেন? ডাকেননি কেন আমাকে? আমি একটু ছাদে গাছটাতে জল দিতে গিয়েছিলাম।
-গাছটাতে মানে? আপনি গাছ বসিয়েছেন?
-না না আমি কেন গাছ বসাবো? ছাদে যে গাছটা ছিলো আগে থেকে সেটাতেই.. আচ্ছা দুলাল বাবু ওই গাছ গুলো কে বসিয়েছিলেন? একটামাত্র গাছই বেঁচে আছে। বাকি সব গাছই তো মরে গেছে! দেখে ভীষণ কষ্ট হয় গাছ গুলোর জন্য। কিন্তু যে গাছটা বেঁচে আছে ওটাকে আমি যত্ন করে ঠিক বাঁচিয়ে রাখবো.. জানেন কয়েকটা কুঁড়িও ধরেছে গাছটায়!
-আ..আমি ঠিক জানিনা! হয়তো এখানে আগে যিনি থাকতেন তিনিই বসিয়েছিলেন!
-তাহলে উনি গাছ গুলোকে না নিয়ে গিয়ে এখানে রেখে চলে গেলন কেন? আচ্ছা আমার আগে এখানে কে থাকতেন দুলাল বাবু?
-আগে এই স্কুলেরই একজন ম্যাডাম থাকতেন। পরে উনি ট্রান্সফার নিয়ে অন্য কোথাও চলে যান। গাছ গুলো হয়তো কোনো কারণে নিয়ে যাননি। কেন নিয়ে যাননি আমি কী করে জানবো বলুন তো?
-উনি হঠাৎ ট্রান্সফার নিয়ে অন্য স্কুলে চলে গেলেন কেন?
-সেটা আমি কী করে বলবো বলুন তো? ওনার হয়তো কোনো সমস্যা ছিলো! এই নিন আপনাদের জলখাবারটা.. আমার একটু তাড়া আছে। আমি আসি..
দুলাল বাবু কিঙ্কিণীর হাতে খাবারের বক্সটা দিয়েই বেরিয়ে গেলেন বাড়ি থেকে। মাঝে মাঝে দুলাল বাবু কেমন যেন অদ্ভূত আচরণ করেন! সেটা দেখে কিঙ্কিণীর বেশ অবাক লাগে। এসব নিয়ে আর না ভেবে ফোনটা বাজায় ঘরে চলে গেলো কিঙ্কিণী। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো কুশ কল করছে। ফোনটা রিসিভ করলো কিঙ্কিণী।
-কী ব্যাপার কিঙ্কি ডার্লিং আমাকে ভুলে গেলে নাকী হ্যাঁ? আগে তো রোজ আমাকে ফোন করেই ঘুম ভাঙাতে হতো তোমার। আর এখন দিদিমণি নিজেই উঠে পড়ে! আমাকে একটা গুডমর্নিং টেক্সটও করোনা তুমি!
-আচ্ছা কুশ, তুমি এত বাচ্চাদের মতো করো কেন বলোতো?! আমি তো জানি তুমি এখন ঘুমাচ্ছ, তাই জন্যই আর ফোন বা টেক্সট করিনি.. ভাবলাম তুমি উঠে নিজেই কল করবে, তাই আর কি..
-তাই কী হ্যাঁ? তাই কী? আমি কিছু জানিনা! কাল থেকে তুমি ওঠার আগে আমাকে কল করবে ব্যাস!
-আচ্ছা বাবা ঠিক আছে তাই করবো.. এবার খুশি তো?
-এখনো না! আগে কাল থেকে কলটা করবে, তারপর খুশি হবো..
-উফ! পাগল একটা!
-হ্যাঁ আমার কিঙ্কি ডার্লিং এর জন্য! আচ্ছা শোনোনা! কাল তো সেভাবে কথাই হলোনা.. তুমি তো ঘুমিয়ে পড়লে! কেমন লাগলো কাল প্রথম স্কুলে গিয়ে?
-খুব ভালো লেগেছে গো.. বাচ্চা গুলোকে পড়িয়ে আমার ভীষণ ভালো লাগলো! আমার কত দিনের স্বপ্ন পূরণ হলো কাল.. আচ্ছা শোনোনা, আমি এবার রাখি কেমন? কোকোর ঘুম থেকে উঠে কিছু খাওয়া হয়নি ওকে খেতে দিয়ে, আমি ব্রেকফাস্ট করে রেডি হবো.. জানোই তো শাড়ি পরতে আমার কতক্ষণ সময় লাগে!
-হ্যাঁ! সে আর বলতে! প্রত্যেক বছর সরস্বতী পূজো আর অষ্টমীতে তো দেখি.. ওয়েট করতে করতে আমার যে কী হাল হয়! তোমাকে শাড়ি পরে কিন্তু দারুণ লাগে কিঙ্কি.. আজ একবার ভিডিও কল করবে প্লিজ শাড়ি পরার পর?
-নাহ! তার কোনো দরকার নেই! তোমাকে যদি আমি শাড়ি পরার পরে ভিডিও কল করি, তাহলে তোমার সাথে বকতে বকতে আমার আর আজ স্কুলেই যাওয়া হবেনা!
-আমি দু-মিনিট দেখেই রেখে দেবো প্রমিস.. প্লিজ একটু..
-আচ্ছা ঠিক আছে.. এবার তো রাখি..
-আচ্ছা শোনোনা?
-আবার কী হলো?
-বলছি কয়েকটা সেলফি তুলে রেখো প্লিজ.. ভিডিও কলে তো বেশিক্ষণ দেখতে পারবোনা, তাই অগত্যা সেলফি গুলোতেই চোখ রাখবো সারাক্ষণ…
-হে ভগবান! আচ্ছা ঠিক আছে.. এবার রাখছি টাটা!
-হ্যাঁ টাটা!
ফোনটা রাখার পর কোকোকে খাইয়ে দিয়ে নিজেও খেয়ে নিয়ে রেডি হয়ে নিলো কিঙ্কিণী। কালো ব্লাউজের সাথে একটা হালকা আকাশী রঙের শাড়ি পরেছে ও। যদিও সেভাবে একদমই শাড়ি পরার অভ্যাস নেই ওর। আগের অফিসে কুর্তি, লেগিন্স, জিন্স, টপ সবই অ্যালাও ছিলো। তাই শাড়ি পরার আর কোনো দরকার ছিলোনা। আর এখানে যদিও চুড়িদার পরে যাওয়াই যায়, তবুও শাড়িই পরে যায় কিঙ্কি। বেশ ভালোই লাগে ওর। শাড়ি পরলে বেশ দিদিমণি দিদিমণি দেখতে লাগে, আর পড়ানোর সময় একটা আলাদা রকম ফিলিংস হয়, তাই শাড়ি পরেই যায়। চুলটা ভিজে থাকায় সামনের কিছু চুল পিছনে নিয়ে একটা ছোট্ট ক্লিপ আটকে নিলো, আর কপালে একটা ছোট্ট কালো টিপ পরলো। বেশ সুন্দর দেখতে লাগছে আজ কিঙ্কিণীকে। হয়তো কুশ দেখতে চেয়েছে বলেই মনের মধ্যে একটু অন্যরকম ভালো লাগায় আরও বেশি সুন্দর লাগছে ওকে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকটা সেলফি তুলে সেন্ট করে দিলো কুশলকে। সেগুলো দেখেই সাথে সাথে ভিডিও কল করল কুশ। দু-মিনিট কথা বলে ফোনটা কাঁধে রাখা একটা সাইড ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়ে কোকোকে একটু আদর করে গেটে তালা দিয়ে স্কুলে চলে গেলো কিঙ্কিণী।
-কী কিঙ্কিণী ম্যডাম কাল প্রথম ক্লাস কেমন লাগলো?
-খুব ভালো.. আপনিও তো কালই জয়েন করলেন তাইনা? আপনার কেমন লাগলো?
-আমারও বেশ ভালোই লেগেছে। বাচ্চাদের পড়াতে আমার এমনিতেই খুব ভালো লাগে। আমি তো বাড়িতে টিউশন পড়াই তাই.. তবে এখানে এতজনকে একসাথে সামলানোটা একটু চাপের হয়ে যায় এই আর কী!
-হ্যাঁ সেটা আপনি ঠিকই বলেছেন, বাচ্চা গুলো যা দুষ্টু!
-হ্যাঁ সেই! শুনলাম আপনি নাকি স্কুল কর্তৃপক্ষের বাড়িতেই থাকেন?
-হ্যাঁ ঠিকই শুনেছেন। আসলে আমার সব জায়গায় লেটে পৌঁছনোর একটা রেকর্ড আছে। তাই আর অন্য কোথাও বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকার রিস্ক নিলামনা! আর আমার বাড়ি থেকেও রেগুলার যাতায়াত করাটা পসিবল নয়। তাই বাধ্য হয়েই এখানে থাকা আর কী!
-হ্যাঁ তা ভালোই করেছেন। কিন্তু আপনার বাড়িটা কোথায়? অনেক দূর?
-হ্যাঁ কোলকাতায়। আর আপনার?
-আমার এই ফুলতলি গ্রামের পাশের গ্রামেই বাড়ি। তবে খুব একটা কাছেও নয়। আমি ট্রেনেই আসছি দুদিন। তবে কাল থেকে ভাবছি বাইক নিয়েই আসবো। কিন্তু আপনি কোলকাতায় থাকেন, আর আপনার স্কুল এত দূরে পড়লো? কাছাকাছি কোথাও পেলেননা?
-না সেটা নয়, অপশন পেয়েছিলাম আমাদের ওখানেও, কিন্তু আমি এই স্কুলটাই বেছেছি। আচ্ছা আমি এখন আসি ক্লাস আছে, আপনার ক্লাস নেই এখন?
-হ্যাঁ আমারও ক্লাস আছে, এই এবার যাবো..
-আচ্ছা, আমি এলাম!
কিঙ্কিণীর সাথেই কাল জয়েন করেছে অভিমন্যু। স্টাফরুমে বসে একটু ফাঁকা সময়ে কথা বলছিলো একে অপরের সাথে। তারপর যে যার মতো ক্লাস নিতে চলে গেলো। বেশ হ্যান্ডসাম দেখতে অভিমন্যুকে। লম্বা, চওড়া, ফর্সা, টিকালো নাক, পুরো সেভিং করা মুখ। সাথে দেখে মনে হয় জিম করা বডি। ক্রীম কালারের একটা শার্ট পরেছে, হাতা গুলো কনুই পর্যন্ত গুটিয়ে রাখা। বেশ স্মার্টলি কথা বলছে সবার সাথে। দেখে ওকে খুব মিশুকে ছেলে বলেই মনে হয়।
বেশ কয়েকদিন এভাবেই কেটে গেছে। কিঙ্কিণীর কোনো অসুবিধাই হচ্ছেনা একা থাকতে। তবে সারাদিন কেমন যেন হালকা ঘোরের মধ্যে থাকে। কোকোও মাঝে মাঝে একটু চেঁচায় ঠিকই, তবে খুব শান্ত হয়েই থাকে। হেড স্যারসহ বাকি স্যার ম্যাডামরাও মাঝে মাঝেই জিজ্ঞেস করেন কিঙ্কিণীকে কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা থাকতে। কিন্তু কিঙ্কিণীর কোনো অসুবিধাই হচ্ছেনা থাকতে। তাই ও সেটাই বলেছে। এদিকে সবার সাথেই বেশ ভালোই বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে কিঙ্কির। আর অভিমন্যুর সাথে আরও বেশি ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে কারণ ওরা দুজন জুনিয়র সবার থেকে। তাই সবার বেশ আদরেরও।
আজ কিঙ্কিণীর শরীরটা একদম ভালো নেই। স্কুল থেকে ফিরে ফ্রেস হয়েই শুয়ে পড়েছে। কোকোও চুপচাপ বসে আছে ওর পাশে। কিছু খেতেও ইচ্ছা করছেনা যেন আজ। স্কুল থেকে ফেরার আগে সবাই মিলে সামনের চায়ের দোকানটা থেকে চা খেয়েছিলো। এমনিতে কিঙ্কিণী খুব একটা চা খেতে ভালোবাসেনা, স্কুলে সবাই চা খেলেও ও খায়না। তবে আজ মাথাটা খুব ধরে ছিলো বলে কিঙ্কিও আর না করেনি। এমনিতেই মাইগ্রেন আছে কিঙ্কিণীর। তাই যখন মাথার যন্ত্রণা শুরু হয় কখনও কখনও আবার প্রায় তিন-চারদিনও সেটা থাকে। তার সাথে ভীষণ গা গুলোয় ওর। বমিও হয় মাঝে মাঝে। কিচ্ছু খেতে পারেনা তখন। তাই দুলাল বাবু রাতের খাবার দিয়ে গেলে কোকোকে কোনো রকম খেতে দিয়ে নিজে না খেয়ে শুধু একটা স্যারিডন খেয়ে আবার শুয়ে পড়লো কিঙ্কি। কোকো খাওয়ার পর একটু জল খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লো। কিঙ্কি মাথার যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে কখন একটু চোখ লেগে গিয়েছিলো ওর। যখন ঘুমটা একটু ভাঙলো তখন কোনোরকমে একটু চোখটা খোলার চেষ্টা করলো কিঙ্কিণী। চোখটা খুলতেই যেন ওর হার্টবীট বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। চোখটা খুলে নাইট ল্যাম্পের হালকা আলোয় ও দেখলো কেউ যেন নিচে দাঁড়িয়ে ওর মুখের কাছে মুখটা নিয়ে গিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকেঈ। যদিও হালকা আলোয় তার মুখটা সেভাবে বোঝা যাচ্ছেনা। তবে যেটুকু বোঝা যাচ্ছে তাতে কিঙ্কিণী বুঝলো এটা কোনো মানুষ নয়। কোনো মানুষের চোখ গুলো এভাবে জ্বলতে পারেনা। ও মাথা তুলতেও পারলোনা কোনোভাবেই। মাথা তোলার চেষ্টা করতে গেলেও সেই ছায়ামূর্তিটার মুখের সাথে ওর মুখের অথবা মাথার স্পর্শ হবেই। তাই কোনো রকমে একটু একটু করে শরীরটাকে বিছানায় ঘষতে ঘষতে নিচের দিকে নামতে থাকলো, আস্তে আস্তে যখন অনেকটা নিচের দিকে নেমে এসেছে তখনও দেখছে ছায়ামূর্তিটা একভাবে তাকিয়ে আছে ওর দিকেই। কিঙ্কি তড়াক করে বিছানা থেকে উঠে নেমে গিয়ে ঘরের বড় আলোটা জ্বালিয়ে দিয়ে পিছন ফিরে তাকাতেই যেন অদৃশ্য হয়ে গেলো সেই ছায়ামূর্তি। তখনই কিঙ্কি কোকোকে ডাকতে লাগলো চিৎকার করে।
-কোকো! কোকো ওঠ! কোকো.. কোকো প্লিজ ওঠ!!
কোকোর গায়ে হাত দিয়ে ঠেলে ঠেলে ডাকতেও কোকোর যেন কিছুতেই ঘুম ভাঙছেনা! অনেক কষ্টে ও কিঙ্কিণীর দিকে তাকালো। কিঙ্কি বুঝতে পারলো কোকো অঘোরে ঘুমাচ্ছে। তাই এত করে ডাকতেও উঠতে পারছেনা কোকো। কিঙ্কির মাথার কাছের জানলাটা খোলাই থাকে। হঠাৎ জানলার দিকে চোখ যেতেই কিঙ্কির মনে হল একটা ছায়ামূর্তি সরে গেলো জানলা থেকে!
-কে? কে ওখানে? কে সরে গেলেন জানলা থেকে? কে…
জানলার কাছে গিয়ে কিঙ্কিণী এদিক ওদিক তাকিয়ে চিৎকার করতে লাগলো জোরে জোরে। কিন্তু কারোর কোনো সারা নেই। বাইরেটা ঘুটঘুটে অন্ধকার! ঘরের বড় আলোটা জ্বলায় আরও বেশি অন্ধকার লাগছে বাইরেটা। কোকোও ঘুমের ঘোরে একটু ঘেউ ঘেউ করে এগিয়ে গেলো জানলার দিকে। কিন্তু কাউকেই আর দেখতে পেলোনা কিঙ্কিণী। তাই জানলাটা তাড়াতাড়ি বন্ধ করে দিলো। আজ ও কিছুটা হলেও বুঝতে পারলো সেদিন জানলাটা খোলা থাকায় কেন কোকো ওভাবে চিৎকার করছিলো! এসব ভাবতে ভাবতেই কিঙ্কিণীর মাথার যন্ত্রণাটা আরও যেন বেড়ে গেলো মুহূর্তেই। আর চিৎকার করার ক্ষমতা নেই ওর। তাই কোনো রকমে বিছানায় গিয়ে কোকোকে জড়িয়ে জানলার দিকে মাথা না করে উল্টো দিকে মাথা করে শুলো কিঙ্কিণী। বড় আলোটা নেভানো হয়নি। আর ওঠার ক্ষমতা নেই ওর। তাই সারারাত আলোটা জ্বলেই গেলো…
ক্রমশ…