কোথাও_কেউ_নেই হুমায়ুন আহমেদ ১৬.

কোথাও_কেউ_নেই
হুমায়ুন আহমেদ

১৬.
আগামীকাল বকুলের গায়ে হলুদ। গায়ে হলুদ জাতীয় অনুষ্ঠানের আগের দিনটি যেমন জমজমাট হওয়া উচিত তেমন লাগছে না। বকুলের মনে হল সবাই কেমন যেন গা ছেড়ে দিয়েছে। মুনা। আপা যথারীতি অফিসে চলে গিয়েছে। আজ অফিসে না গেলে কি হত? বাবুও রান্নাঘরে ভাত নিয়ে বসেছে। সেও বোধ হয়। স্কুলে যাবে। কি আশ্চর্য এত বড় উৎসবের ঠিক আগের দিনটিতে সবাই সবার কাজ নিয়ে ব্যস্ত। যেন গায়ে হলুদ খুব সাধারণ ব্যাপার। এ বাড়িতে রোজই এ রকম একটা উৎসব হচ্ছে। বকুল বেশ মন খারাপ করে রান্নাঘরে গেল। ইতস্তত করে বলল স্কুলে যাচ্ছিস, বাবু?
হুঁ।
তোরা সবাই যদি যে যার ধান্ধায় বেরিয়ে যাস তাহলে কাজগুলি কে করবে?
ঘরের কি কাজ?
বকুলের কান্না পেয়ে গেল। কাল তার গায়ে হলুদ আর আজ বাবু বলছে ঘরের কি কাজ? কত কিছু করে লোকজন। ঘর সাজায়। কলাগাছ পুঁতে। কি কি রান্না হবে তার লিস্ট করে। তার বেলায় কিছুই হচ্ছে না। প্রথম দিকে বাবা খানিক উৎসাহ দেখিয়েছেন। বকুলের সঙ্গে দেখা হল। কিন্তু একটি কথাও বললেন না। এর মানে কি এই যে বকুলের বিয়েটা কেউ পছন্দ করছে না?
বাবু হাত ধুতে ধুতে বলল, কি কাজ বললে না? বকুল মুখ কালো করে বলল, কোন কাজ নেই। কাজ আবার কি?
কিছু আনতে হলে বল।
আনতে হবে না কিছু।
বকুল তার ঘরে চলে গেল। সে আজ সারাদিন শুয়ে শুয়ে গল্পের বই পড়বে। তিনটা গল্পের বই হাতে আছে। একটা বইয়ে নাম এক বৃন্তে দু’টি ফুল। খুব নাকি ভাল বই। টিনা ভাবীর মতে, . অসাধারণ বই। টিনা ভাবীর কথার তেমন গুরুত্ব অবশ্যি নেই। সে অতি অখাদ্য বইকেও মাঝে মাঝে বলে অসাধারণ।
দশ পাতা পড়বার পর বকুলের মনে হল সে কি পড়ছে তা নিজেই বুঝতে পারছে না। এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। মন বসছে না।
বাড়িতে কোন লোকজন নেই। যে কাজের মেয়েটি ছিল সে পরশু দিন মুনা আপার দু’টি শাড়ি চুরি করে পালিয়েছে। কেমন নির্জন চারদিক। বকুলের গা ছমছম করতে লাগল। তার শ্বশুর বাড়ি নিশ্চয়ই এমন নির্জন হবে না। চারপাশে লোকজন থাকবে। সেটা হবে একটা হৈচৈয়ের বাড়ি। আনন্দের বাড়ি। অদেখা সুখ ও আনন্দের কথা ভাবতে ভাবতে বকুলের চোখ ভিজে উঠতে লাগল। দরজার কড়া নড়ছে। বকুলের উঠে গিয়ে দরজা খুলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। কোন ভিখিরি নিশ্চয়ই। আজকাল ভিখিরিরা খুব গম্ভীর ভঙ্গিতে দরজায় কড়া নাড়ে, কলিং বেল টিপে ভিক্ষা চায়।
কড়া নেড়েই যাচ্ছে। এ ভিখিরি নয়। বকুল চোখ মুছে দরজা খুলল। টিনা ভাবী বিরাট একটা প্যাকেট হাতে দাঁড়িয়ে আছেন।
ঘুমুচ্ছিল নাকি? এক ঘণ্টা ধরে দরজা ধাক্কাচ্ছি। চোখ লাল কেন?
বকুল জবাব দিল না। টিনা বিরক্ত হয়ে বলল, বাড়িঘরের এই অবস্থা কেন? এটাকে তো বিয়ে বাড়ি বলে মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে যেন তোদের কোনো আত্মীয়-স্বজন মারা গেছে। যা ময়দার লেই তৈরি কর।
কেন ?
কেন কি? ঘর সাজাব। জানি তোরা কেউ কিছু করবি না। কাগজ নিয়ে এসেছি। কাচি আছে ঘরে?
জি আছে।
বের কর। বাবু কোথায়?
স্কুলে।
আজকের দিনটায় স্কুলে না গেলে হত না। কি সব অদ্ভুত ভাইবোন তোর।
নিজের বিয়েব জন্যে রঙিন কাগজের মালা বানাবো খুবই অস্বস্তির ব্যাপার। কিন্তু উপায় নেই। টিনা ভাবী ছাড়বে না।
মুখ এমন অন্ধকার করে রেখেছিস কেন রে বকুল?
কিছু ভাল লাগছে না ভাবী।
বিয়ের ঠিক আগে এ রকম হয়। হঠাৎ করে মনের মধ্যে একটা ভয় ঢুকে যায়। ভয়টা কেটে যায় বিয়ের রাতেই।
এই বলে টিনা মিটিমিটি হাসতে লাগল।
বকুল।
কি?
তোকে কিছু কায়দা-কানুন শিখিয়ে দেব, বুঝলি?
কি কায়দা-কানুন?
বলব বলব। এত ব্যস্ত কিসের?
বকুল উঠে দাঁড়াল। টিনা বলল, যাচ্ছিস কোথায়?
চা নিয়ে আসি। তুমি তো আবার মিনিটে মিনিটে চা খাও।
চায়ে চুমুক দিয়ে টিনা প্রথম যে কথাটি বল সেটা হচ্ছে–বিয়ের রাতে তোর বর যখন প্রথম তোর গাযে হাত দেবে তখন ইলেক্ট্রিক শক খাবার মত লাফিয়ে উঠবি না। বুঝলি?
বকুল অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। এ জাতীয় কথাবার্তা শুনতে তার অস্বস্তি লাগে আবার সেই সঙ্গে ভালও লাগে। সে এ রকম কেন? সে কি খারাপ মেয়ে? বকুলের বুক হু-হু করতে লাগল।
মুনা ভেবে রেখেছিল। সে আজ লাঞ্চ টাইম পর্যন্ত কাজ করবে। তারপর ঘরে ফিরে আসবে। সেটা সম্ভব হল না। সিদ্দিক সাহেব তাকে ডেকে একগাদা কাজ দিয়ে দিলেন এবং শান্ত গলায় বললেন, যে ভাবেই হোক আজ পাঁচটায় শেষ করে দেবেন। পারবেন না?
জি পারব।
গুড। ভেরি গুড। আপনি ছাড়া অন্য কেউ হলে বলত–একদিনে সম্ভব না।
মুনা কিছু বলল না। সিদ্দিক সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, মেয়েদের মধ্যে একটা ব্যাপার আছে এরা সহজে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে। তবে শেষ পর্যন্ত কন্টিনিউ করতে পারে না।
আমি স্যার পাঁচটার মধ্যেই শেষ করে দেব।
গুড। পাঁচটার সময় আমি অফিস থেকে বেকবি। তখন ফাইলগুলি নিয়ে যাব।
যেদিন খুব মন দিয়ে কাজ করবার থাকে সেদিনই যন্ত ঝামেলা দেখা দেয়; যেমন আজ একাউন্টের নতুন মেয়েটি এসে গলা নিচু করে তার এক গাদ সমস্যার কথা বলতে লাগল। সেই সমস্যাও ভয়াবহ সমস্যা। তার স্বামীর ছোট ভাই তাকে একটি প্ৰেমপত্র লিখে বসে আছে। এই ব্যাপারটি সে তার স্বামীকে জানাবে, না জানাবে না। এই হচ্ছে সমস্যা। মেয়েটির সঙ্গে মুনার তেমন কোন আলাপ নেই। আজ হঠাৎ করে এ রকম একটি জটিল সমস্যার কথা তাকে বলতে এল মুনা? মুনা একবার ভাবলী বলবে. পরে তোমার কথা শুনব ভাই। আজ একটু ব্যস্ত আছি। কিন্তু এটা বলা সম্ভর নয়।
মেয়েটি যাবার পরপর এলেন পাল বাবু। তিনি কোন এক তান্ত্রিক সন্ন্যাসীর খোঁজ পেয়েছেন। যিনি মানুষের ভূত-ভবিষ্যৎ সবই বলতে পারে। পাল বাবুর ইচ্ছা মুনাকে নিয়ে একবার তার কাছে যাওয়া। বহু কষ্টে মুনা পাল বাবুকে বিদেয় করল তখন এসে উপস্থিত হলেন শওকত সাহেব। মুনা বিরক্ত হয়ে বলল, ব্যাপার কি মামা?
তোর সঙ্গে একটা জরুরি কথা আছে।
জরুরি কথা বাসায় গিয়ে শুনব। এখন কাজ আছে তুমি যাও।
না এখনই বলতে হবে।
বল তাহলে। এক মিনিটের মধ্যে শেষ করতে হবে।
এখানে বলা যাবে না। বাইরে আয়।
বাইরে কোথায় যাব?
চল তোদের ক্যান্টিনে যাই। জায়গাটা নিরিবিলি।
ক্যান্টিনে যেতে পারব না। যা বলার এখানেই বল। আমি টেবিল ছেড়ে উঠব না।
শওকত সাহেব বেশ কিছু সময় চুপ করে রইলেন। মুনা তাকিয়ে রইল। বড় ঝামেলায় পড়া গেল।
মামা বল।
বলছি।
বলছি বলেও তিনি মুখ বন্ধ করে বসে রইলেন। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিল।
মুনা।
বল শুনছি।
বকুলের বিয়েটা বন্ধ করে দেয়া দরকার। ওদের খবর পাঠিয়ে দে বিয়ে হবে না।
কেন?
কাল রাতে একটা স্বপ্ন দেখলাম। খারাপ স্বপ্ন! ভোর রাতে স্বপ্নটা দেখলাম।
তুমি স্বপ্ন দেখছ এই জন্যে বিয়ে হবে না?
স্বপ্নটা শুনলে তুই বুঝবি?
কিছু শুনতে হবে না। তুমি বাড়িতে গিয়ে ঘুমাও।
আমার কথাটা পুরোপুরি শোন–স্বপ্নে দেখলাম তোর মামি এসে আমাকে বলছে, জহির ছেলেটা ভাল না। ও আমার মেয়েকে গলা টিপে মেরে ফেলবে। তারপর দেখলাম। বকুল শুয়ে আছে আর জহির একটা বটি হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকছে এই সময় ঘুমটা ভেঙে গেল।
মুনা বলল, চা খাবে মামা? শওকত সাহেব কিছু বললেন না।
চা এনে দিচ্ছি। খাও। তারপর বাড়িতে চলে যাও।
আর কিছু বলবি না?
না। খবরের কাগজে। আজকাল প্রায়ই খবর উঠছে যৌতুকের জন্যে স্বামীর হাতে স্ত্রী খুন এইসব খবর পড়ে পড়ে স্বপ্ন দেখেছি।
শওকত সাহেব রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছলেন। মুনা শান্ত স্বরে বলল, বাড়িতে গিয়ে কোনো খোঁজ নিয়ে দেখ, যে রাতে তুমি স্বপ্ন দেখেছি আগের দিনের পেপারে এ রকম কোন খবর আছে।
কথা সত্যি। এ জাতীয় একটি খবর সত্যি সত্যি আছে। শওকত সাহেব উঠে দাঁড়ালেন।
চলে যাচ্ছ মামা?
হুঁ।
চা খাবে না?
না।
বিকেল পাঁচটায় সিদ্দিক সাহেব এসে দাঁড়ালেন টেবিলের সামনে। নিচু গলায় বললেন, কাজটা শেষ করতে পারেননি। তাই না? মুনা বিব্রত স্বরে বলল জি না স্যার।

বকুলের বিয়ে হয়ে গেল।
শওকত সাহেব বিয়ের অনুষ্ঠানে খুব মনমরা হয়ে রইলেন। বকুলকে নিয়ে যাবার সময়ও তেমন কোন উচ্ছ্বাস দেখালেন না। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন না। কেমন যেন শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে রইলেন। বকুল খুব কাঁদল। সে সারাদিনই কাঁদছিল। কনে বিদেয়ের সময় হতেই তার হেঁচকি উঠতে লাগল। মুনা তাকে একপাশে নিয়ে গিয়ে বলল, এ রকম করছিস কেন? মরা কান্না কাঁদছিস। বিশ্ৰী লাগছে শুনতে। কান্না থামা।
বকুল ধরা গলায় বলল, বাবার কি হয়েছে? বাবা এ রকম করছে কেন?
কি রকম করছে?
দেখ না কেমন করে তাকাচ্ছে।
কোন রকম করে তাকাচ্ছে না। মামা ভালই আছে। তুই কোন রকম হৈচৈ না করে তোর বরের বাড়ি যা।
বকুলের কান্না থামল না। জহিরকে দেখা গেল ফিসফিস করে কয়েকজনকে কি সব বলছে। নিশ্চয়ই কোন হাসির কথা। কারণ সেই ফিসফিসানি শুনে সবাই হাসছে। মুনার মন খারাপ হয়ে গেল। যার স্ত্রী এমন ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে সে হাসির কথা বলবে কেন? কেন সে এই কিশোরী মেয়েটির দুঃখ বুঝবে না?
মুনা জহিরকে ডেকে ভেতরে নিয়ে গেল। আলাদা করে কিছু বলার উপায় নেই। বাড়িতে মানুষ গিজগিজ করছে। বর ভেতরে এসেছে কাজেই অল্পবয়সী মেয়েগুলি চেষ্টা করছে গা ঘেঁষে দাঁড়াতে। মুনা অনেক চেষ্টা করে ওদের সরাল। জহির বলল, আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে ভাবী, তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিন। মুনা তার ভাবী নয়। কিন্তু সে ভাবী ডাকছে। বিচার-বুদ্ধি কমে এসেছে। সেও নিশ্চয়ই একটা ঘোরের মধ্যে আছে।
ভাবী ডাকছ কেন জহির? আমি তোমার আপা।
সরি আপা। আপনি কি আমাকে কিছু বলবেন?
হ্যাঁ বলব। বকুল খুব বাচ্চা মেয়ে একটু খেয়াল রাখবে। বিয়ে হয়ে গেছে বলেই কিন্তু সে বড় হয়ে যায়নি। বকুলের স্বভাব-চরিত্র অনেক’দিন পর্যন্ত কিশোরীদের মত থাকবে।
এইসব আপনি আমাকে কেন বলছেন?
যাতে তুমি বুঝতে পার সেই জন্যেই বলছি।
বুঝতে পারব না কেন? আমার যথেষ্ট বুদ্ধিবিবেচনা আছে বলেই আমার ধারণা।
জহিরের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। গলার স্বর হল কঠিন। মুনা ভেবে পেল না তার কথায় এই ছেলেটি রাগ করছে কেন। এই ছেলেটিকে সে এখন রাগাতে চায় না।
আপা আমাদের তো এখন যেতে হয়। নটা বেজে গেছে।
চল দেখি যাওয়ার ব্যবস্থা করা যায়। কিনা।
যাবার ব্যবস্থা খুব সহজেই হল। বকুলকে আরো খানিক্ষণ এ বাড়িতে ধরে রাখার কেউ নেই। রাত হয়ে যাচ্ছে। উৎসব শেষ হলেই যেন সবাই বাঁচে। নিজের নিজের বাড়িতে ঘুমুতে যেতে পারে। রাত দশটার মধ্যে বাড়ি খালি হয়ে গেল! একেবারেই ফাঁকা। বকুলের মামির বোধ হয় থাকার ইচ্ছা ছিল। মুনা কোনো রকম আগ্রহ দেখাল না। মুখ ফুটে বলে ফেলল, বাড়িতে বিছানা নেই মামি আপনার কষ্ট হবে। মুনার ইচ্ছা নয়। কেউ থাকুক। একা হয়ে যেতে মন চাইছে।
ডেকোরেটরের ঘর থেকে দুইজন ছোকরা এসেছে। অল্প বয়সের কিন্তু ভারি ছটফটে। রাত এগারটার মধ্যে সব ঐটে থালাবাসন ধুলে ফেলল। ঠেলাগাড়ি এনে চেয়ার-টেবিল সরিয়ে ফেলল। বাসি খাবারের গন্ধ ছাড়া বিয়ে বাড়ির আর কোন চিহ্ন রইল না। সে অনায়াসে চলে যেতে পারে কিন্তু গেল না। তার এই বাড়িতে আরও কিছুক্ষণ থাকতে ইচ্ছা করছে। বিয়ের সমস্ত ঝামেলা সে একা কি করে সামাল দিয়েছে সে বিষয়ে মুনার কাছ থেকে কিছু শোনার ইচ্ছা করছে। মুনা কিছুই বলেনি। এখন হয়ত বলবে।
বাকের নিতান্ত আপনজনের ভঙ্গিতে রান্নাঘরে উঁকি দিল। মুনা উনোনে চায়ের পানি বসিয়েছে। বিজবিজ শব্দ হচ্ছে। সে বসে আছে মাথা নিচু করে। কাঁদছে নাকি? অস্বাভাবিক নয়। বোন চলে গিয়েছে, কাঁদাই উচিত।
মুনা অবশ্যি কাঁদছিল না। বাকেরকে দেখে বলল, কিছু বলবেন?
না কিছু বলব না। খাওয়া-দাওয়া কেমন হয়েছে?
ভালই তো। খারাপ কেউ বলেনি।
বাচু বাবুর্চিকে ধরে এনেছি। খারাপ বলবে মানে। মারাত্মক বাবুর্চি।
তাই নাকি?
এক নাম্বারা যাকে বলে। হাই ডিমান্ড। এক মাস আগে থেকে বলে না রাখলে পাওয়া যায় না। আমাকে না করে দিয়েছিল। শেষে পা চেপে ধরলাম।
মুনা হেসে ফেলল। বাকের অপ্রসন্ন মুখে বলল, হাসছ কেন?
বাবুর্চির পা ধরতে হল। তাই হাসছি। চা খাবেন? চা হচ্ছে।
দাও এক কাপ চা খাই।
বাকের মুনার সামনে উবু হয়ে বসে পড়ল। তার মুখ হাসি হাসি।
আপনার খুব কষ্ট হল বাকের ভাই।
আরে না। কষ্ট কিসের? বকুল হচ্ছে আমার বোনের মত। তার বিয়েতে কষ্ট না করলে কার বিয়েতে কষ্ট করব?
এই পাড়ার সব মেয়ের বিয়েতেই তো আপনি কষ্ট করেন। খাটাখাটি করেন। করেন না?
তাই নাকি?
আমার বিয়েতেও কি করবেন?
বাকের জবাব দিল না। আড়চোখে তাকাল মুনার দিকে। মুনা কাঁপে চা ঢালছে। আগুনে আঁচে তার মুখ লাল হয়ে আছে। কি সুন্দর লাগছে দেখতে।
কি জবাব দিচ্ছেন না যে? করবেন আমার বিয়েতে খাটাখাটনি?
কেন করব না? নিশ্চয়ই করব।
এত মারা গলায় বলছেন কেন? শক্ত করে বলুন।
বাকের চায়ের কাঁপে চুমুক দিল। এই কি যে অদ্ভুত কথাবার্তা!
বাকের ভাই।
বল।
একটা কথা বোধ হয়। আমি আপনাকে কোনোদিন বলিনি, কথাটা হচ্ছে। আমি আপনাকে খুব পছন্দ করি। আপনি আবার এটাকে প্রেম বলে ধরে নেবেন না। প্রেম অন্য জিনিস।
বাকের একবার ভাবল জিজ্ঞেস করে–প্ৰেম কি জিনিস? সে জিজ্ঞেস করল না। গম্ভীর মুখে চায়ে চুমুক দিতে লাগল। গুছিয়ে কিছু-একটা বলতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু কোনো কথা মনে আসছে না। সে নিজের অজান্তেই বলে বসল।–রোসটটা বেশ নরম হয়েছিল। তাই না?
মুনা অবাক হয়ে বলল, হঠাৎ রোস্টের কথা বলছেন কেন?
না মানে…
অনেক খাবার বেঁচে গেছে। আপনি খাবেন?
দাও খাই।
বাকেরের খিদে বিন্দুমাত্র ছিল না। বিয়ে বাড়ির খাবার দ্বিতীয়বার খাওয়া যায় না। কিন্তু মুনা খাবার বেড়ে দেবে বসে থাকবে সামনে এর জন্যেও দ্বিতীয়বার খাওয়া যায়।
আপনি হাত-মুখ ধুয়ে আসুন আমি খাবার গরম করছি।
এখানে বসে খাব?
না। এখানে কেন? খাবার টেবিলে যান।
বাকের উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, এগার নাম্বার বাড়িতে ঐ মেয়ে তিনটি আসলে কি জিনিস জানো?
না জানি না। জানার ইচ্ছাও নেই।
ওরা হচ্ছে বাজারের মেয়ে।
বাজারের মেয়ে মানে?
খারাপ মেয়ে।
কি সব আজেবাজে কথা যে আপনি বলেন বাকের ভাই। অসহ্য। যান হাত-মুখ ধুয়ে খেতে বসুন। আপনাকে খাইয়ে আমি শুয়ে থাকব। প্রচণ্ড মাথা ধরেছে।
প্যারাসিটামল খাও।
প্যারাসিটামল আমি এখন পাব কোথায়?
এনে দিচ্ছি। নো প্রবলেম। ময়না মিয়া রাত এগারটার আগে দোকান বন্ধ করে না। মুনাকে কিছু বলবার সুযোগ না দিয়েই সে রাস্তায় নেমে পড়ল।
আজ সন্ধ্যায় রাতের পাখিরার অভিনয় হবে। বাকের তার কিছুই জানে না। কেউ তাকে বলেনি। এর মানে কি? তাকে কেউ কিছু বলবে না কেন? সারা বিকাল ব্যাপারটা নিয়ে সে চিন্তা করল। পরিষ্কার কোন কারণ সে ভেবে পেল না। একটা হতে পারে তাকে খবর দেয়ার কথা মনে নেই। থিয়েটার মানেই অসম্ভব ঝামেলা। ঝামেলাতে কথা এলোমেলো হয়ে যায় সব কিছু মনে পড়ে না। কিন্তু এই সহজ যুক্তিটি বাকেরের মনে ধরছে না। কারণ জসীমের সঙ্গে তার কয়েকবার দেখা হয়েছে। জসীম তাকে এড়িয়ে গেছে। স্পষ্ট মনে আছে একবার সে জিজ্ঞেস করল বই কবে নামোচ্ছ? জসীম তার উত্তর দেয়নি। ফ্যাকাশে ভঙ্গিতে হোসেছে। ফন্ট করে তো আর ঠিক করা হয়নি। আজি সন্ধ্যায় অভিনয় হবে। নিশ্চয়ই অনেক আগে থেকে ঠিকঠাক করা।
জলিল মিয়ার চায়ের স্টলে সে উপস্থিত হল সন্ধ্যার আগে। তোলা-উনুনে পেয়াজু ভাজা হচ্ছে। জলিল, মিয়া এই ব্যাপারটি নতুন শুরু করেছে। সন্ধ্যা হতেই পেঁয়াজু, ডালপুরি ভাজা। ভাল বিক্রি হচ্ছে। ভাজাবুজির জন্যে নতুন লোক রাখা হয়েছে। জলিল মিয়া ভালই দেখাচ্ছে। বাকের বারান্দায় চেয়ার টেনে বসল। জলিল মিয়া উঁচু গলায় বলল, বাকের ভাইরে পেয়াজু দে। চা দে।
বাকের ইশারায় নিষেধ করল। জলিল মিয়া বলল, বই শুরু হতে দেরি আছে বাকের ভাই। আটটা বাজাবে। মিনিসটার আসতাছে।
কে আসছে?
মিনিস্টার।
মিনিস্টার মানে? কি মিনিস্টার?
মিনিস্টারের কি আর দেশে অভাব আছে ভাইজান?
কথা খুবই ঠিক। দেশে প্রচুর মিনিস্টার আছে কিন্তু এরা নিশ্চয়ই পাড়ার নাটকে উপস্থিত হয়। না। এদের অন্য কাজ আছে।
মিনিস্টারের কথা। আপনি কিছু জানেন না বাকের ভাই?
না!
হুলস্থূল হয়ে যাচ্ছে। সিদ্দিক সাহেব ব্যবস্থা করলেন। কার্ড-টার্ড ছাপিয়েছে।
তাই নাকি?
আপনি কিছুই জানেন না?
বাকের গম্ভীর মুখে বসে রইল। তাকে কিছু না বলার রহস্যটা বোঝা যাচ্ছে। সিদ্দিক সাহেবেব চাল। মিনিস্টার-ফিনিস্টাের আনছেন। ভবিষ্যতে কোন পরিকল্পনা আছে নিশ্চয়ই।
বাকের ভাই!
বল।
চা খান এক কাপ। স্পেশাল পাত্তি আছে। কাস্টমারদের দেই না। দিতে বলি?
বল।
জলিল চায়ের কথা বলল। তার বেশ মজা লাগছে। সে বুঝতে পারছে সিদ্দিক সাহেবের সঙ্গে বাকেরের একটা ঝামেলা শুরু হয়েছে। বাকের একা পড়ে গেছে। এই সময়ে থাকা মানেই ডুবে যাওয়া। সামনে দিনগুলিতে বাকেরকে আর ডেকে ডেকে চা-পিয়াজু খাওয়াতে হবে না। স্পেশাল পাত্তির চা বানাতে হবে না। কিন্তু তাতে তার কোন লাভ নেই। নতুন দল আসবে। স্পেশাল পাত্তি তাদের জন্যে রাখতে হবে।
বাকের ভাই।
উঁ।
মিনিস্টার সাহেব নাকি যুব সমিতিতে অনেক টাকা-পয়সা দিচ্ছেন। ঘর দিচ্ছেন।
ভালই তো।
যুব সমিতির পাঠাগার হবে। বিশ ইঞ্চি টিভি দিবে। পাঠাগারে।
ভাল।
এরশাদ সাহেবের দলটা খারাপ না কি বলেন? খরচপাতি করছে। জিয়া সাহেবের সময় এত খরচপাতি করে নাই। খালি খাল কাটা হয়েছে। কি বলেন বাকের ভাই?
বাকের জবাব দিল না। জলিল মিয়া হৃষ্টচিত্তে বলতে লাগল, মিলিটারি ছাড়া এই দেশ ঠিক রাখা যাবে না। এরশাদ সাব মিলিটারি মানুষ। দুই মেয়ে পলিটিশিয়ানদের কেমন চরকি বাজি দেখিয়ে দিল। ঠিক বললাম। কিনা বলেন বাকের ভাই?
ঠিকই বলেছেন।
মেয়ে মানুষের কাজ হইল বাচ্চা দেওয়া। এই কাজ ছাড়া অন্য কোনো কাজ মেয়ে মানুষ দিয়ে হয় না। ঠিক বললাম না বাকের ভাই?
বাকের উত্তর না দিয়ে উঠে এল। জলিল মিয়ার দোকানে এখন কাস্টমার নেই। সে অনবরত বকর বকর করতে থাকবে। পলিটিক্স তার প্ৰিয় বিষয়। প্রেসিডেন্ট জিয়ার সময় সে ছিল জিয়া ভক্ত। এখন এরশাদ প্রেমিক। এরশাদ সাহেবের একটা বাঁধানো ছবি দোকানে ঝুলিছিল। লোকজন হৈচৈ করাতে ছবি সরিয়ে ফেলেছে। এই দেশের মানুষগুলি অদ্ভুত যে ক্ষমতায় থাকে তাকে কেউ সহ্য করতে পারে না। সবাই তার বিরুদ্ধে চলে যায়। কেন যায়?
বাকের অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে রাস্তার এ-মাথা থেকে ও-মাথা পৰ্যন্ত কয়েকবার হাটল। রাস্তার মোড়ে টর্চ হাতে দু’জন ট্রাফিক পুলিশ। এই রকম জায়গায় ট্রাফিক পুলিশ? নিৰ্ঘাৎ মিনিস্টার সাহেব আসছেন সেই উপলক্ষে। একবার গিয়ে দেখে আসবে নাকি কেমন জমেছে। সব কিছু? বাকের মনস্থির করতে পারল না। মুনাদের বাসায় গেলে কেমন হয়? না, তাদেরও পাওয়া যাবে না। সেজেগুজে দল বেঁধে হয়তো গিয়েছে থিয়েটার দেখতে। বাকের রওয়ানা হল কম্পাউন্ডওয়ালা বাড়িটির দিকে। এই বাড়ির কেউ থিয়েটারে যাবে না। এরা ঘরে থাকবে। সে যদি গিয়ে বলে, চলুন থিয়েটার দেখে আসি তাহলে কেমন হয়? চশমা পরা বুড়ি তার উত্তরে কি বলবে? মেয়ে তিনটিই বা কি করবো? এদের সঙ্গে এখনো কথাবার্তা হয়নি? নাম পৰ্যন্ত জানা নেই। এদের নিশ্চয়ই খুব বাহারি নাম। ফুলেশ্বরী, রত্নেশ্বরী এ রকম। এর নিশ্চয়ই কণা, বীণু এ রকম নাম রাখবে না; রাখলেও বদলে ফেলবে।
গেট তালাবন্ধ। গেটের ভেতরে একটি কালো রঙের গাড়ি। জোবেদ আলিকে দেখা গোল গাড়ির ড্রাইভারের সঙ্গে সেহে হেসে কি বলছে। জোবেদ আলির হাতে সিগারেট। অথচ কয়েক’দিন আগেই সে বলেছে সিগারেট খায় না। বাকের গেটের পাশে দাঁড়িয়ে উঁচু গলায় ডাকল, এই যে জোবেদ আলি সাহেব। একটু শুনে যান।
জোবেদ আলি গম্ভীর মুখে এগিয়ে এল।
কেমন আছেন ভাই?
ভাল। কি চান?
কিছু চাই না। গল্পগুজব করতে আসলাম।
জোবেদ আলি তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইল। বাকের হাসিমুখে বলল, থিয়েটারে যান নাই? রাতের পাখিরা হচ্ছে।
জি না। থিয়েটার দেখি না।
মেয়েরাও যায় নাই?
না।
যান নাই কেন? কাস্টমার এসেছে নাকি?
কি বললেন?
বললাম কাস্টমার এসেছে নাকি? মেয়ে তিনটা তো ব্যবসা করে তাই না?
জোবেদ আলি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। বাকের গম্ভীর গলায় বলল, ভদ্রপাড়ায় বেশ্যাবাড়ি খুলে ফেললেন?
জোবেদ আলি থমথমে গলায় বলল, পাগলের মত কি বলছেন? বাকের ঠাণ্ডা গলায় বলল, ঠিক বলছি। একটা কথাও ভুল বলি নাই। গেট খুলেন। বুড়ির সঙ্গে কথা বলব।
আপনি সকাল বেলায় আসেন। যা বলার সকালে বলবেন।
বাকের সিগারেট ধরিয়ে উদাস স্বরে বলল, বেশ্যার দালালি কতদিন ধরে করছেন?
আমাকে বলছেন?
হ্যাঁ আপনাকেই। আপনি ছাড়া আর কে আছে। নেন সিগারেট নেন।
আমি সিগারেট খাই না।
একটু আগেই তো দেখলাম সিগারেট টানছেন।
জোবেদ আলি নিচু গলায় বলল–বাকের ভাই, আপনি সকালে আসেন। এখন হৈচৈ করবেন না।
হৈচৈ? হৈচৈ কোথায় করলাম?
ভাই আপনি এখন যান।
সাদা শাড়ি পরা ফর্সা মহিলা বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন। সে রিনারিনে গলায় বলল, কে কথা বলে রে?
জোবেদ আলি বলল, কেউ না আম্মা।
জোবেদ আলি এই মহিলাকে আম্মা ডাকে নাকি? এটা জানা ছিল না। বাকের সিগারেট টানতে টানতে রাস্তার দিকে রওনা হল। এখন তার বেশ একটা ফুর্তির ভাব হচ্ছে। কালো গাড়িতে করে যে ভদ্রলোক তিন কন্যার কাছে এসেছেন তার শার্টের কলার চেপে ধরলে কেমন হয়? বাকের নিজের মনে খানিক্ষণ হাসল। দলবল জুটিয়ে বাড়ি ঘেরাও করলে হয়। কিন্তু সবাই গেছে রাতের পাখিরা দেখতে। সেখান থেকে হাতী নিয়ে টেনেও কাউকে আনা যাবে না। বাকের মুনাদের ঘরের দিকে রওনা হল। কাউকে ঘটনাটা বলতে না পারলে রাতে ঘুম হবে না।
অনেক্ষণ কড়া নাড়ার পর দরজা খুলল। বাকের হাসিমুখে বলল, খবর কি মুনা? মুনা বিরসমুখে বলল, কোনো কাজে এসেছেন?
না কোনো কাজ নেই। যাচ্ছিলাম। এদিক গিয়ে ভাবলাম…।
আমার শরীরটা ভাল না। এখন চলে যান।
বাসায় কেউ নেই?
না। মামা কোথায় যেন গেছেন। বাবু গেছে বকুলের শ্বশুর বাড়ি।
ও আচচ্ছা। একা এক ভয় লাগছে না?
আমার এত ভয়টয় নেই।
একটা মজার খবর আছে মুনা। রহস্যভেদ হয়েছে। ভূতের কাছে মামদোবাজি। ফটাস করে হাড়ি ভেঙে ফেলেছি। অপেন মার্কেট পট ব্ৰেকিং হয়ে গেছে।
কি বকবক করছেন?
শুনলে লাফ দিয়ে উঠবে।
লাফ দিয়ে উঠার কোনো ইচ্ছা আমার নেই। এখন যান তো।
বেশিক্ষণ না এক মিনিট বসব।
বাকের ঘরে ঢুকে পড়ল। সহজ গলায় বলল, চা কর এক কাপ। চা খেয়ে জুত হয়ে বসে গল্পটা করি।
আপনি বড্ড বিরক্ত করেন বাকের ভাই।
বিরক্ত করব না। এক মিনিটের মামলা। তুমি নাটক দেখতে যাওনি।
যাইনি। সে তো দেখতেই পাচ্ছেন। শুধু শুধু কথা বলা আপনার একটা বদ অভ্যাস।
তা ঠিক। নাটকে মিনিসটার সাহেব আসছেন জানো নাকি?
না জানি না। আসুক যার ইচ্ছা।
সিদ্দিক সাহেবের চাল। ব্যাটা ইলেকশন করবে। ফিল্ড করছে। বুঝলে মুনা? লোকজনদের খেলাচ্ছে।
খেলাক। আপনি চুপ করে বসুন। চা এনে দিচ্ছি খেয়ে বিদেয় হোন।
নাটক যদি দেখতে চাও নিয়ে যেতে পারি। ঘরে তালা দিয়ে চলে যাব। নো প্রবলেম।
কিচ্ছু দেখতে চাই না।
মুনা ভেতরে চলে গেল। বাকের সিগারেট বের করল। পকেটে দেয়াশলাই আছে। তবু সে রান্নাঘরে উঁকি দিল ম্যাচ আছে? সিগারেট ধরাতে পারছি না। মুনা নির্বিকার ভঙ্গিতে দেয়াশলাই এগিয়ে দিল।
কাজের একটা মেয়ে ছিল না? সেও নেই?
না। দেশের বাড়ি গেছে। আপনি এখানে বসছেন কেন? বসার ঘরে গিয়ে বসুন।
তুমি একা একা আছ!
। বাকের ভাই, বসার ঘরে গিয়ে বসুন তো।
বাকের উঠে গেল।
মিনিস্টার সাহেব চলে এসেছেন। অনেক মাইকী-টাইক লাগানো হয়েছে। এখান থেকেও পরিষ্কার শুনা যাচ্ছে। সব মিনিস্টাররা এক ধরনের ভাষায় বক্তৃতা দেন। গলা উঠানামা করে এক ভঙ্গিতে। এক এক সরকারের মন্ত্রীদের এক এক ধরনের বক্তৃতা। শেখ মুজিবের মন্ত্রীরা আঙুল দেখিয়ে বক্তৃতা করতেন। রেসকোর্স ময়দানে মুজিবের ভাষণের নকল করতেন। এরশাদ সাহেবের মন্ত্রীরা সবাই খুব আল্লাহ ভক্ত। সবাই কোরান শরীফ থেকে উদ্ধৃতি দেন। তাদের বক্তৃতায় ইহকালের চেয়ে পরকালের কথা বেশি থাকে। বক্তৃতা শুনলে মনে হয় ওয়াজ করছেন।
বাকের শুনল মিনিস্টার সাহেব বলছেন–যুবকদের সমাজের প্রতি দায়িত্ব আছে। যুবকদের অনুসরণ করতে হবে রসুলুল্লাহর নির্দেশিত পথ। কারণ সেই পথেই ইহকাল ও পরকালের জন্যে
মুনা চা এনে সামনে রেখে ক্লান্ত গলায় বলল, বাকের ভাই, আমার শরীরটা ভাল না। চা খেয়ে আপনি চলে যান।
হয়েছে কি?
কি জানি কি! বমি বমি লাগছে।
নো প্রবলেম দু’টি এভোমিন ট্যাবলেট নিয়ে আসছি।
আপনাকে কিছু আনতে হবে না, প্লিজ।
বাকের চায়ে চুমুক দিল। মুনা তার সামনেই বসে আছে। চোখ ঈষৎ রক্তাভ। সন্ধ্যা বেলাতেই ঘন ঘন হাই তুলছে। কেমন কঠিন একটা ভঙ্গি তার চারদিকে। মেয়েরা এমন কঠিন হলে ভাল লাগে না।
রাত সাড়ে এগারটার দিকে শেষবারের মত চা খাবার জনো বাকের বের হল। ভাইয়ের বাসায় থাকার সময় তাকে এই কষ্টটা করতে হত না। শোবাব আগে এক কাপ চা খাওয়া যেত। এখন বাইরে থেকে খেয়ে আসতে হয়। অস্বস্তিকর ব্যাপার। বিছানায় বসে চা খাওয়া আর দোকানের চেয়ারে বসে চা খাওয়া একটা বড় রকমের পার্থক্য আছে।
জলিল মিয়া তার সন্টল বন্ধ করে দিয়েছে। সাধারণত বারোটার দিকে বন্ধ হয়। আজ সকাল সকাল বন্ধ হল। বাকের এগিয়ে গেল মেইন রোডের দিকে। সেখানে হোটেল আকবরিয়া সারারাত খোলা থাকে।
বাকের ভাই। বাকের ভাই।
বাকের থমকে দাঁড়াল। জসীম লম্বা পা ফেলে এগিয়ে আসছে। তার মধ্যে ব্যস্ত একটা ভঙ্গি। মনে হচ্ছে বেশ ফুর্তিতে আছে।
কি খবর জসীম?
জি খবর ভাল।
তোমাদের নাটক কেমন?
জসীম খানিকটা চুপসে গেল। নিচু গলায় বলল, ভাল হয়েছে।
ভাল হলেই ভাল। মিনিসটার এসেছিল নাকি?
হুঁ।
গুড, ভেরি গুড।
আমি আপনাকে খুঁজছিলাম বাকের ভাই। দু’বার আপনার ঘরে গিয়ে খুঁজে এসেছি
কি জন্যে?
জসীম ইতস্তত করতে লাগল। যেন কোন একটি অপ্রিয় প্রসঙ্গ তুলতে চায়। কিন্তু সাহসে কুলুচ্ছে না। সে অকারণে কাশতে লাগল।
বলে ফেল কি ব্যাপার।
আপনি জোবেদ আলিকে কি বলেছেন?
বাকেরের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হল। সে দাঁড়িয়ে পড়ল।
আজ সন্ধ্যার কথা বলছ?
হুঁ।
তা দিয়ে তোমার কি? জোবেদ আলির সঙ্গে তোমার কি? জোবেদ আলি বেশ্যার দালাল। তুমি করা দোকানদারি। তাকে কি বললাম না বললাম তাতে তোমার গায়ে লাগছে কেন বুঝলাম না।
না। আমার কিছু না। সিদ্দিক সাহেবের কাছে ওরা গিয়েছিল। সিদ্দিক সাহেব আমাকে খবর দিয়ে আনলেন। আমাকে আর মাখনা ভাইকে। বললেন…
জসীম থেমে গেল। বাকের গভীর স্বরে বলল, কি বললেন?
বললেন আপনাকে সাবধান করে দিতে। ঝামেলা করলে অসুবিধা হবে।
কি অসুবিধা হবে?
জসীম চুপ করে রইল। বাকের কড়া গলায় বলল, তোমরা সিদিকের সঙ্গে গিয়ে জুটেছ?
তা না। উনি পাড়ার একটা মাথা।
কবে থেকে পাড়ার মাথা হল? কি, কথা বলছি না যে? গিয়ে বলবে তোমার পাড়ার মাথাকে, আমি তার মুখে পেচ্ছাব করে দেই।
জসীম রুমাল দিয়ে তার ঘাম মুছতে লাগল। বাকের বলল, কি বলতে পারবে না?
এটা কেমন করে বলি বাকের ভাই?
অসুবিধা কি? আমি যেমন বললাম। সে রকম বলবে। তোমাদের কাজই তো হচ্ছে একজনের কথা অন্যজনকে বলা।
আপনি যাচ্ছেন কোথায়?
চা খেতে যাই। হোটেল আকবরিয়ায়। খাবে নাকি?
জি না।
না খেলে চলে যাও। সিদ্দিক সাহেবকে খবরটা দাও। মুখে পেচ্ছাবের কথাটা গুছিয়ে বলবে। ওটা বাদ দি ও না।
জসীম শুকনো মুখে চলে গেল। হোটেল আকবরিয়ার মালিক দিলদার মিয়া খুবই যত্ন করল। নিজে উঠে গিয়ে চা নিয়ে এল। বসল মুখোমুখি। দিলদার মিয়ার মুখে বসন্তের দাগ। চিবুকের কাছে এক গোছা কুৎসিত দাড়ি। তবু বাকেরের দিলদার মিয়ার সঙ্গে গল্প করতে বেশ লাগল। সে ঘরে ফিরল রাত একটায়। রাত দুটায় পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে গেল। অভিযোগ গুরুতর। বেআইনি অস্ত্র রাখা। জনগণের ওপর জোরজবরদস্তি। সে ধরা পড়ল। গুণ্ডা আইনে। তার কাছে অস্ত্রশস্ত্র কিছুই ছিল না। কিন্তু পরদিনের পত্রিকায় তার ছবি ছাপা হল। তার সঙ্গে যে সব অস্ত্রশস্ত্র পাওয়া গেছে তার ছবিও উঠল। একটি পিস্তল, দু’টি ন’ইঞ্চি ড্যাগার এবং তিনটি তাজা হাতবোমা।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here