কোথাও_কেউ_নেই হুমায়ুন আহমেদ ২৩.

কোথাও_কেউ_নেই
হুমায়ুন আহমেদ

২৩.
সিদ্দিক সাহেবকে আজ একটু বিমর্ষ দেখাচ্ছে।
কোন কারণে তিনি চিন্তিত এবং বিরক্ত। বিরক্ত হলে তার মুখে ঘন ঘন থুথু ওঠে। এখন তাই উঠছে। তিনি চারদিকে থুথু ছিটাচ্ছেন। সরকারি দলের নমিনেশন তিনি পাবেন, এই নিয়ে তার কোনো চিন্তা নেই। এক লাখ টাকার চাঁদা দেয়া ছাড়াও অন্য এক কায়দায় বিশেষ একজনকে এক লক্ষ আশি হাজার টাকা নগদ দেয়া হয়েছে। তিনি হিসেবি লোক পুরোপুরি নিশ্চিত না হলে এতগুলি টাকা বের করতেন না। সমস্যা এখানে নয় সমস্যা ভিন্ন জায়গায়। সরকারি দল মানেই বেশির ভাগ লোকের অপছন্দের দল। এই দেশের মানুষদের সাইকোলজি হচ্ছে ক্ষমতায় যে আছে তার বিপক্ষে কথা বলা। যতদিন পর্যন্ত তুমি ক্ষমতায় নেই। ততদিন পর্যন্ত তুমি ভাল। যে মুহূর্ত ক্ষমতায় চলে গেলে সেই মুহূর্তে থেকে তুমি খারাপ। তোমার বিরুদ্ধে জ্বলাও-পোড়াও আন্দোলন। বড় বড় বক্তৃতা।
সরকারি দলে থাকা বুদ্ধিমানের কাজ হবে কিনা এটাই সিদ্দিক সাহেব বুঝতে পারছেন না। চালে ভুল হলে মুশকিল। রাজনীতিতে প্রতিটি চাল ভেবেচিন্তে নিতে হয় এবং ভবিষ্যতের কথা মনে রাখতে হয়। আওয়ামী লীগের এক সময় রমরমা ছিল. কোথায় গেল সেই রমরমা? তবে কিছুই বলা যায় না। রমরমা ফিরেও আসতে পারে।
কোন রকম দলে না গিয়ে স্বতন্ত্র থেকে ইলেকশন করাই ভাল। তাহলে সব দলকেই বলা যায় আছি তোমাদের সাথে। তবে স্বতন্ত্র থেকে দাঁড়ালে ইলেকশনে জেতা কষ্টকর। প্রশাসনের সাহায্য দরকার। প্রশাসন শুধু শুধু সাহায্য করবে কেন? তাদের কী ঠেকা?
এই ইলেকশন সিদ্দিক সাহেবের কাছে খুবই সামান্য ব্যাপার। কিন্তু বড় কিছুতে যাওয়ার এটা হচ্ছে প্রথম সিঁড়ি। নামটা প্রথম ভাসতে হবে। মুখে মুখে ফিরতে হবে। খুনখারাবি হবে। হাঙ্গামা হবে। খবরের কাগজে লেখালেখি হবে–তখন সবাই বুঝবে এই কনসটিটিয়েনসি একটা জটিল জায়গা। সিদ্দিক সাহেব সেই জটিল জায়গা পানি করে দিয়েছেন। তার চেহারা এবং কার্যকলাপে। বোঝা যাওয়া চাই যে তিনি মহা ধুরন্ধব এবং মহা কঠিন ব্যক্তি।
আগেকার অবস্থা এখন নেই হেঁ হেঁ করে ভোটারের সামনে হোত কচলালে হবে না। হাত কচলান ক্যান্ডিডেটের দিন ফুরিয়েছে। এখনকার ভোটাররা শক্তের ভক্ত।
শুধু ভোটাররা না–সবাই এখন শক্তের ভক্ত।
সিদ্দিক সাহেব বসে আছেন তার বসার ঘরে। তার সামনে একগাদা পোস্টার। ছাপানো নয় আর্টিস্ট এনে লেখান হয়েছে। নগর কমিটির পোস্টার। নগর কমিটি তিনি কিছুদিন হল করেছেন। সরাসরি এই কমিটিতে তিনি নেই। কাজ করছেন উপদেষ্টা হিসেবে। যদিও সমস্ত কিছুই তাঁর করা। পোস্টারগুলিতে নানান ধরনের বক্তব্য–
“এই নগর আপনার
একে সুন্দর রাখুন।
যেখানে সেখানে মযলা ফেলবেন না।
নির্দিষ্ট ডাস্টবিনে ফেলুন।”
–নগর কমিটি
“আপনার আশপাশে কী অসামাজিক
কার্যকলাপ হয়? অসামাজিক কার্য
কলাপ প্রতিরোধ করা আপনার
সামাজিক দায়িত্ব।”
–নগর কমিটি
“আপনার আশপাশে কী বখাটে
ছেলেপুলের আড্ডা দেয়? নেশা করে?
নগর কমিটিতে খবর দিন।
–নগর কমিটি
“হিরোয়িন, মদ, গাঁজা আপনার
শত্ৰু। যারা এসবের ব্যবসা করছে
তারাও আপনার শত্রু। শত্রু নিৰ্মল করুন।”
–নগর কমিটি
“ধূমপান মনে বিষপান। পয়সা খরচ করে
কেন বিষপান করছেন? ধূম্রমুক্ত নগর
সৃষ্টি করুন।”
–নগর কমিটি
প্রায় একশর মত পোস্টার। লাল কাগজে ঘন কালো রঙে লেখা। আর্টিস্ট ছোকরা লিখেছে। ভাল। জায়গায় জায়গায় পোস্টার পড়লে দেখতে ভালই লাগেব।
সামনের সপ্তাহে তিনি শিশু নিকেতনের উদ্বোধন করতে মন ঠিক করেছিলেন সেখানে একটা ঝামেলা বেধেছে।
শিশু নিকেতনের চেংড়াহেগুলি উদ্বোধনের দিন কোন কবিকে নাকি আনতে চায়। প্রস্তাবটা তার মন্দ লাগেনি। তিনি সভাপতি কবি প্রধান অতিথি। এখন আবার বাতাসে অন্য রকম কথা ভাসছে। শিশু নিকেতনের সেক্রেটারি নাকি সভাপতি, কবি শামসুর রাহমান প্রধান অতিথি, সওগাত পত্রিকার নাসিরুদিন সাহেব বিশেষ অতিথি।
সিদ্দিক সাহেবের মেজাজ খারাপ হওয়ার মূল কারণ এটা। ওরা করতে চাইলে করুক তাঁর কোন আপত্তি নেই। কিন্তু তিনি ষড়যন্ত্রের আভাস পাচ্ছেন। তার ধারণা এর পেছনে নুরুদিনের হাত আছে। নুরুদ্দিন তার সঙ্গে কনটেস্ট করছে। তার পেছনে আছে আওয়ামী লীগ। নরুদ্দিন খুবই ঘুঘু লোক। পুরনো আওয়ামী লীগার। শেখ সাহেবের মৃত্যুর পর পর অবশ্য সে আওয়ামী লীগের সম্পর্কে অদ্ভুত অদ্ভুত সব কথাবার্তা বলতে থাকে যার একটা হচ্ছে দেশটা লিজ দেয়া হয়ে গিয়েছিল ইন্ডিয়ার কাছে। আল্লাহ পাকের দয়ায় রক্ষা পেয়েছে।
জিয়াউর রহমান সাহেবের সময় নুরুদিন কঠিন বিএনপি হয়ে যায়। তাতে তার আওয়ামী লীগে আবার ফিরে যাওয়াতে কোন অসুবিধা হয়নি। ঘুঘু লোক বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। এ জাতীয় লোকদের সম্পর্কে সাবধান থাকা ভাল। সিদ্দিক সাহেব যথেষ্ট সাবধান। তবুও অস্বস্তি লেগেই থাকে। সিদ্দিক সাহেব শিশু নিকেতনের সেক্রেটারিকে আসতে বলেছেন ব্যাপারটা পুরোপুরি পরিষ্কার করে নিতে চান। ব্যাটাকে আসতে বলা হয়েছে চারটার সময় এখন বাজে পাঁচটা। এখনো আসছে না। সিদ্দিক সাহেবেবী মেজাজ ক্রমেই খারাপ হচ্ছে।
সেক্রেটারি ঢুকাল পাঁচটা পচিশে। মুখে তেলতোলে ধরনের হাসি। পরনে নকশাদার পাঞ্জাবি। পাতলা গোঁফের জন্যে চেহারাটাই কেমন ধূর্ত ধূর্ত হয়ে গেছে। লোকটির নাম মনোয়ার হোসেন তবে সবাই ডাকে মনু ভাই।
স্নামালিকুম স্যার।
ওয়ালাইকুম সালাম। কী ব্যাপার?
মনোয়ার হোসেন অবাক হয়ে বলল, আপনি তো ডেকে পাঠালেন।
ও আচ্ছা আচ্ছা, মনেই ছিল না। আরেকটু হলে চলে যেতাম! ভাগ্যিস এসেছে। হাজার ঝামেলা নিয়ে থাকি কিছু মনে থাকে না। বস বস।
মনোয়ার হোসেন বসল। তার মুখের হাসি আরো বিস্তুত হল।
তোমাদের শিশু নিকেতন সম্পর্কে জানার জন্যে ডাকলাম। কত দূর কি করলে?
হাঁটি হাঁটি পা পা অবস্থা স্যার। তবে একটা ঘর পাওয়া গেছে এটা একটা বড় উপকার হয়েছে।
ঘর কোথায় পেলে?
নুরুদিন সাহেব দিয়েছেন। কিছু ফার্নিচার ও পাওয়া গেছে। আপনাদের দশজনের সাহায্য ছাড়া তো স্যার হবে না। দশের লাঠি একের বোঝা।
সিদ্দিক সাহেব শুকনো গলায় বললেন, তা তো বটেই।
আপাতত ছবি আঁকা, নাচ আর গান শিখানো হবে। একটা শিশু লাইব্রেরি থাকবে। শিশুদের জন্যে হাতে লেখা দেয়াল পত্রিকা বের হবে। পত্রিকার নাম স্যার অনির্বাণ।
ভাল খুবই ভাল।
অনিৰ্বাণ প্রথম সংখ্যায় স্যার আপনাকে একটা বাণী দিতে হবে। না বললে হবে না স্যার।
উদ্বোধনের কী ব্যবস্থা করলে?
এখনো ফাইন্যাল কিছু হয়নি। শামসুর রাহমান সাহেব প্রধান অতিথি। এটা শুধু ফাইন্যাল হয়েছে।
ভাল ভাল খুবই ভাল।
আপনাকে স্যার উদ্বোধনীর দিন থাকতে হবে।
থাকব। নিশ্চয়ই থাকব। কেন থাকব না?
মনোয়ার হোসেন চা-বিসকিট খেয়ে বিদায় হল। সিদ্দিক সাহেব দীর্ঘ সময় চুপচাপ বসে রইলেন। ঝামেলা বাড়ছে–এত সব ঝামেলা সহ্য করা কঠিন। ব্যবসার ঝামেলা, জমিজমার ঝামেলা; প্রতিষ্ঠার ঝামেলা। একটা পরিত্যক্ত সম্পত্তি তিনি কিনেছেন। কিন্তু দখল পাচ্ছেন না। চারতলা বিল্ডিং ভাল জায়গায় গ্রিন রোড়ে। দখল না পেলে লাভ কি? সম্পত্তি, আসল মালিকের কাছ থেকেই কেনা। বলাই বাহুল্য। জলের দামে কেনা। কত দামে কেনা সেটা বড় কথা নয়। কাগজপত্র ঠিক আছে এটাই বড় কথা। কাগজপত্র থেকেও লাভ হচ্ছে না।
বাড়িতেও ছোটখাটো অশান্তি লেগে আছে। মন টেকে না। তার স্ত্রী দশ বছর আগে হঠাৎ করে মোটা হতে শুরু করেছিলেন–এখন মৈনাক পর্বত। দুই হাত দিয়ে বেড় পাওয়া যায় না। গাড়িতে উঠলে গাড়ি খানিকটা ডেবে যায়। এক মেয়েও মায়ের পথ ধরেছে। বয়স তেইশ। এর মধ্যেই হুঁলস্থূল কারবার। ছোট মেয়েটা এখনো ঠিক আছে। ভবিষ্যতে কী হবে কে জানে?
সিদ্দিক সাহেব রাত আটটার দিকে বেরুলেন। তার মন-মেজাজ খুব যখন খারাপ থাকে তখন এগার নম্বর বাড়িতে কিছু সময় কাটান। মেয়ে তিনটার সঙ্গে হালকা গল্পগুজব করেন। এর বেশি। কিছু না। সেই সাহস তার নেই। মেয়ে তিনটার বয়স তার বড় মেয়ের বয়সের চেয়েও কম। এদের নিয়ে অন্য কোন চিন্তা কেমন যেন দানা বঁধতে পারে না। তাছাড়া ভয়ও আছে। জানাজানি হয়ে যেতে পারে। কে জানে কিছুটা জানাজানি ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে কি না। বাকের বড় যন্ত্রণা করছিল। হাজতে যতদিন ছিল ভাল ছিল এখন আবার ছাড়া পেয়েছে। এগার নম্বর বাড়ি প্রসঙ্গ তুলে তাকে বেইজিত করবে। কী না কে জানে? সম্ভাবনা আছে। নুরুদিন এই সুযোগ ছাড়বে না। তার আগেই একটা কিছু ব্যবস্থা করতে হবে।
জোবেদ আলি তাকে দেখে ছুটে এসে তালা দেয়া গেট খুলল। এই ব্যবস্থাটা সিদ্দিক সাহেবের খুব পছন্দ। গেট সব সময় তালাবন্ধ থাকে। লোকজন আসছে যাচ্ছে। এ রকম কোনো ব্যাপার নেই। বাড়ির চেহারাও এরা পাল্টে ফেলেছে। চারদিকে ফুলের টব। রঙ-বেরঙের পাতা বাহার, অৰ্কিড মুগ্ধ হয়ে দেখতে হয়। পাড়ার মধ্যে এমন একটা সুন্দর বাড়ি দেখতে ভাল লাগে। আরো ভাল লাগে যখন মনে হয়। এই বাড়িটা তার। বেনামীতে কেনা।
জোবেদ আলি হাত কচলাতে কচলাতে বলল, বাড়িতে তো কেউ নাই।
তাই নাকি?
জি কক্সবাজার গেছে।
বৈশাখ মাসে কক্সবাজার?
ভিড় কম থাকে। নিরিবিলি। আসেন বসেন চা খান।
না চা খাব না। আসবে কবে?
তা তো জানি না। ইতালির দুই সাহেব আছে সাথে বাংলাদেশ ঘুরতে আসছে।
ও আচ্ছা আচ্ছা।
সিদ্দিক সাহেবের বেশ মন খারা হয়ে গেল। সুন্দর সুন্দর মেয়েগুলিকে নিয়ে কোথাকার কোন বিদেশী ঘুরে বেড়াচ্ছে অথচ তিনি নিজে গায়ে হাত রাখার মত সাহস সঞ্চয় করতে পারেননি। কোনো মানে হয় না।
সব দিকেই তার সাহস আছে এই একটা দিকে শুধু সাহস হচ্ছে না। তার ধারণা মেয়েগুলি অতিরিক্ত সুন্দরী বলেই সাহস হয় না। তেমন সুন্দরী মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ তার হয়নি। আর এই তিনটি মেয়ে দেখতে পরীর মতো। হারামজাদি বুড়ি এদের কোথেকে জোগাড় করেছে কে জানে?
স্যার বসবেন না?
না না বসব না। কোন রকম ঝামেলা-টামেলা আছে?
জি না শুধু বাকের মাঝে-মধ্যে…
কি করে সে?
কিছু না গেটের সামনে দাঁড়ায়ে থাকে সিগারেট খায়। আফারা ভয় পায়।
অন্য কিছু করে না?
জি না।
বাকেরের সাথে আর কেউ আসে?
জি না। উনি একা।
আচ্ছা আমি দেখব। ব্যাপারটা।
আম্মা বলছিল বাকেরকে মাসে মাসে হাতখরচের টাকা কিছু দিবে। কিনা আপনার সঙ্গে আলাপ করতে বলছিল।
হাতখরচ দিতে হবে না। ঐটা আমি দেখব। এই পাড়ার কেউ আসে এই বাড়িতে?
জি না।
কেউ কিছু জিজ্ঞেস করে?
জি না।
ঠিক আছে। তারা কবে কক্সবাজার থেকে আসবে কিছু জান না?
জি না।
আসলেই খবর দিবে।
আমি আম্মারে টেলিফোন করতে বলব।
টেলিফোন এসেছে নাকি?
টেলিফোন তো কবেই আসছে।
সিদ্দিক সাহেবের ভ্রূ কুঞ্চিত হল। টেলিফোন এসেছে অথচ টেলিফোনের খবর তাকে জানানো হয়নি। নম্বর পর্যন্ত দেয়নি। এর মানে হচ্ছে এরা তাকে খুব মুরুকিব ধরছে না। তার চেয়েও অনেক বড় মুরুব্বি এদের আছে। কে সেই বড় মুরুব্বি?
তিনি জলিল মিয়াকে ডেকে পাঠালেন। কাস্টমারের যন্ত্রণায় জলিল মিয়ার দম ফেলার ফুরসূত হয় না–এর মধ্যে কেউ ডেকে পাঠালে মেজাজ খিচড়ে যায়। মুখের ওপর বলতে ইচ্ছে করে যা শালা ভাগ। চায়ের দোকানের মালিকের পক্ষে যা কখনো বলা সম্ভব নয়। জলিল মিয়া ক্যাশা অনা একজনকে বুঝিয়ে দোকান থেকে বেরুল। তাকে দেখলে মনে হবে সিদ্দিক সাহেব ডেকে পাঠানোয় সে আনন্দে আত্মহারা।
স্যার ডাকছেন?
কি খবর জলিল?
জি। আপনাদের দশজনের দোয়া।
দোকান তো দেখি ভালই চলছে। সব সময় দেখি কাস্টমার।
আড্ডা দেওউন্যা কাস্টমার স্যার।
চায়ের দোকানে আড্ডাটাই প্রধান। যেখানে যত বেশি আড়ড়া হবে সে দোকান তত তাড়াতাড়ি জমবে।
জলিল মিয়া উসখুস করতে থাকে মূল বিষয়টা জেনে চলে যেতে পারলে বাঁচা যায় ক্যাশে যাকে বসিয়ে এসেছে সে বিরাট চোর। ইতিমধ্যেই টাকা-পয়সা নিশ্চয়ই কিছু সরিয়েছে।
জলিল মিয়া।
জি স্যার।
ঐ যে তোমার দোকানের সামনের বাড়ি, এগার নম্বর বাড়ি। কিছু জানো তুমি?
কী জানব স্যার?
না মানে এই পাড়ার লোকজন কারোর সঙ্গে এ বাড়ির যোগাযোগ আছে?
কিছুই তো স্যার জানি না। আমার স্যার মাথার ঘায়ে কুত্তা পাগল অবস্থা। কাশে বসে নজর রাখতে হয় চাইর দিকে। গতকাল স্যার রান্নাঘর থেকে ডালডার টিন চুরি গেল। চার কেজি ডালডা।
সিদ্দিক সাহেব অপ্রসন্ন মুখে বললেন ঠিক আছে, তুমি যাও। জলিল মিয়া ইতস্তত করতে লাগল। কাউকে অপ্রসন্ন করে চলে যাবার মত মনের জোর তার নেই।
কিছু বলবে?
জি না। তবে স্যার বাকের ভাই কিছু জানলে জানতে পারে।
বাকের জানবে কেন? বাকেরের কি যোগাযোগ আছে?
মনে হয় আছে।
বাকের এখন থাকে কোথায় জান?
জি না।
শুনেছি তার ভাইয়ের বাসায় থাকে না।
আমি বলতে পারি না। স্যার নিজের দোকানের যন্ত্রণায় অস্থির। চোখের সামনে থেকে ডালডার টিন নিয়ে গেল–পাঁচ কেজি ডালডা ছিল।
একটু আগে তো বললে চার কেজি।
জলিল মিয়া হকচাকিয়ে গেল।
ঠিক আছে তুমি যাও।
বাকের ভাইকে কিছু বলতে হবে স্যার?
না কিছু বলতে হবে না।
জলিল মিয়া চিন্তিতমুখে বের হয়ে এল। সবাইকে খুশি রাখা এই দুনিয়ার বিরাট কঠিন কাজ। তবে খুশি রাখতেই হবে। কেউ বোজার হলে দোকানদারি করা যাবে না।

স্যার আমার নাম বাকের।
চিনতে পারছি। কী ব্যাপার?
মঙ্গলবার মঙ্গলবার করে থানায় হাজিরা দিতে বলেছিলেন। তাই এলাম। আজ স্যার মঙ্গলবার।
মাঝখানে তো বেশ কয়েকটা মঙ্গলবার চলে গেল।
ঢাকার বাইরে ছিলাম স্যার। নেত্রকোনা গিয়েছিলাম।
আপনাকে কি হায়ার করে নিয়ে গেল?
কি বললেন বুঝলাম না।
আগে মফস্বলের লোকজন ঢাকা থেকে ফুটবল প্লেয়ার হায়ার করে নিত। আজকাল মাস্তান হায়ার করে। মাস্তানি এখন মোটামুটি লাভজনক ব্যবসা।
আমার ছোটবোনের বিয়ে হয়েছে নেত্রকোনা। দেখতে গিয়েছিলাম।
ভবিষ্যতে ঢাকার বাইরে গেলে আমাদের ইনফরম করে যাবেন।
জি আচ্ছা। এখন কি উঠব?
উঠুন বসে থেকে কি করবেন?
বাকের চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বলল একটা কথা স্যার, যদি কিছু মনে না করেন।
বলে ফেলুন কিছু মনে করব না।
মাঝে মাঝে স্যার মন্ত্রীরা মাস্তান হাযাবি করে নিজেদের জায়গায় নিয়ে যান। গত ইলেকশনের সময় এই অধমকেও একজন নিয়েছিল। এই রকম কেইসে ও কী থানায় খবর দিয়ে তারপর যাব? নাকি সরাসরি চলে গিয়ে কাজকর্ম মিটিয়ে আপনাদের খবর দিব?
ওসি সাহেব কিছু বললেন না। ওসি সাহেবের বা পাশে বসা সেকেন্ড অফিসার উচ্চস্বরে হোসে উঠেই ওসি সাহেবের গম্ভীর মুখ দেখে হাসি গিলে ফেলল। বাকের বলল, স্যার তাহলে উঠি? আগামী মঙ্গলবার ইনশাআল্লাহ দেখা হবে।
ওসি সাহেব কিছু বললেন না। সেকেন্ড অফিসার দ্বিতীয় দফায় হেসে ফেলে আবার গম্ভীর হয়ে গেলেন। ওসি সাহেব বললেন, থানা হাসি-তামাসার জায়গা নয়–এটা মনে রেখে কাজকর্ম করলে ভাল হয়।
বাকের থানা থেকে খুশি মনে বের হল। বেশ ফুর্তি লাগছে। যদিও ফুর্তি লাগার তেমন কোন কারণে নেই। তার থাকার জায়গাই এখনো ঠিক হয়নি। একেক রাত একেক জায়গায় কাটাচ্ছে। গত রাতে বড় ভাইয়ের বাসায় গিয়েছিল। বুক ধকধক করছিল যদি ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। আল্লাহতালাব অসীম অনুগ্রহ দেখা হয়নি। কোথায় যেন গিয়েছে রাত দশটার আগে ফিরবে না। ভাবী ছিল। তাকে দেখে ঠাণ্ডা গলায় বলল, তুমি যে? কী মনে করে?
বাকের হক চকিয়ে গেলেও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ভাবী ভাল আছেন?
হ্যাঁ ভালই আছি।
একটু রোগা রোগা লাগছে।
আমার শরীর স্বাস্থ্য নিয়ে তোমাকে কনসার্নড হতে হবে না। কোন কাজে এসেছ?
ভাইজান কি আছেন?
সে আছে কী নেই সেটা তুমি বাড়ি ঢুকবার আগেই খোঁজখবর করেছ। আমি দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। সেখান থেকেই শুনছিলাম।
ভাবলাম দেখা করে যাই। হাজত থেকে ছাড়া পেয়েছি।
সে তো পনের দিন আগেই ছাড়া পেয়েছ। পনের দিন পর দেখা করতে এলে যে?
ঢাকার বাইরে ছিলাম। আচ্ছা ভাবী যাই।
দাঁড়াও।
সেলিনা ভেতর থেকে মুখ বন্ধ খাম এনে দিল। গলার স্বর আগের চেয়েও শীতল করে বলল, তোমার ভাই দিয়ে গেছে। নিয়ে তোমার ভাইকে ধন্য কর।
এত রাগ করছেন কেন ভাবী?
রাগ কবছি না। রাগ করলে সংসার ছেড়ে অনেক আগেই চলে যেতাম। ঝুলে তো আছি। তুমি থাক কোথায়?
ঠিক নেই ভাবী। একেক দিন একেক জায়গায়।
এক জায়গায় বেশিদিন থাকতে অসুবিধা হয় তাই না? লোকজন খোঁজ পেয়ে যায়।
তা না। ভাবী চা খাব, যদি আপনার অসুবিধা না হয়।
ফরিদ চায়ের কথা বলতে গেল। এই ফাঁকে রাকিব খাম খুলে আনন্দে প্রায় লাফিয়ে উঠল। বারশো টাকা। সব চকচকে নোট। ভাইয়ের কাছ থেকে সে মাঝে মাঝে এ রকম পায়। তবে ব্যাপারটা খুবই অনিয়মিত।
খুবই অবাক কাণ্ড ফরিদা নিজেই চায়ের কাপ নিয়ে ঢুকল। পিরিচের এক কোণায় এক টুকরো ঠাণ্ডা কেক। দীর্ঘ দিন ফ্রিজে ছিল আজ গতি হতে যাচ্ছে।
তোমার ভাইয়ের কথা শুনেছ বোধ হয়।
জি না। কি ঝামেলা?
চাকরি নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে।
বলেন কি? কে ঝামেলা করছে? নামধাম দেন। বডি ফেলে দেব।
বাজে কথা একদম বলবে না। বডি ফেলে দেবে মনে? কার বাড়ি তুমি ফেলে দেবে? চা খেতে চেয়েছ চা খাও। চা খেয়ে বিদেয় হও। বড় বড় কথা বডি ফেলে দেব।
বাকের নিঃশব্দে চা শেষ করে উঠে এল। মেজাজ খুব খারাপ করা উচিত ছিল। কিন্তু করতে পারেনি কারণ পকেটে এতগুলি টাকা। তাছাড়া ভাই ভাবী এই দুজনের ওপর সে রাগ করতে পারে না।
আজও একবার যাবে বলে ঠিক করল। চাকরির ঝামেলা মানে কী ঝামেলা জানতে ইচ্ছা করছে। তবে খোঁজখবর নিয়ে যেতে হবে। ভাই থাকলে যাবার প্রশ্ন ওঠে না।
বাকের জলিল মিয়ার স্টলের সামেন এক মুহূর্তের জন্যে দাঁড়াল জলিশ মিয়া ক্যাশ সামালাতে ব্যস্ত তার দম ফেলার সময় নেই। তবু বাকেরের দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে দিল।
চা খাইয়া যান বাকের ভাই।
বাকের উত্তর না দিয়ে হাঁটতে শুরু করল। রঙবেরঙের নানান পোস্টার চোখে পড়ছে। মহানগর কমিটি। এই বস্তুটি কি কে জানে। পাড়ায় অনেক কিছুই হচ্ছে সে খবর রাখে না। ইয়াদের কাছ থেকে ভেতরের খবর কিছু নেয়া উচিত। কিন্তু তার সঙ্গে দেখাই হচ্ছে না। যে ক’বার গিয়েছে ইয়াদের বউ মুখ কালো করে বলেছে উনি বাসায় নাই। মিথ্যা কথা বলছে না তো? না মিথ্যা কেন বলবে? বাকের অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল তখনি চোখে পড়ল। ইয়াদ মাথা নিচু করে হণহন করে যাচ্ছে। বগলে একটা দুধের টিন। চোখে চশমা। ব্যাটা চশমা নিল কবে।
ঐ শালা। ঐ ইযাদ।
ইয়াদ থমকে দাডাল। বাকের এগিয়ে গেল।
দেখাই পাওযা যায় না ব্যাপার কী? চাব দিন গোলাম।
দারুণ ব্যস্ত, কেমন আছিস রে দোস্ত।
ভালোই আছি। আয়া চা খাই।
আজি না দোস্ত বাসায় দুধ নেই। দুধ নিয়ে যাচ্ছি। দেরি হলে বউ মাইণ্ড করবে।
দুধ বউয়ের কাছে দিয়ে আয়, তাহলে তো আর মাইড কববে না। নামিয়ে দিয়ে ফুট করে চলে আসবি।
আজ বাদ দে দোস্ত। এক জায়গায় যেতে হবে। আমার বড়শালীর ছেলের জন্মদিন। না গেলে খুব মাইন্ড কববে। গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। বিশ্বাস না হয়। আমার সঙ্গে এসে গাড়ি দেখে যা। ডাইহাটসু গাড়ি।
বাকের উল্টো দিকে হাঁটা ধরল। মেজাজ খুব খারাপ হবার আগেই সরে যাওয়া ভাল। মুনাদের বাসায় কি একবার যাওয়া যায়? সকালে অবশ্যি একবার দেখা হয়েছে। তাতে কি? রুগী আছে একজন খোঁজখবর করা দরকার। মুনা রাগ নাও করতে পারে। সব সময় যে তাকে দেখলেই মুনা রেগে যায় তাও তো না। মাঝে মাঝে খুবই ভাল ব্যবহার করে। যেমন আজ সকালে বাকের ঘরে ঢোকা মাত্রই মুনা বলল, বাকের ভাই চা খাবেন?
বিস্মিত বাকের বলল, হ্যাঁ।
তাহলে এক কাজ করুন। ফ্লাক্স দিচ্ছি, ফ্লাস্ক ভর্তি করে দোকান থেকে চা নিয়ে আসুন। ঘরে চা নেই, চিনি নেই, দুধ নেই। বিশ্ৰী অবস্থা। কাল থেকে চা না খেয়ে আছি।
বাকের ফ্লাস্ক ভর্তি করে চা নিয়ে এল–সেই সঙ্গে হাফ কেজি চা। দুই কেজি চিনি এবং একটা কনডেন্সড মিল্প,। বাকের ভেবেছিল সঙ্গের জিনিসগুলি দেখে মুনা রাগ করবে। তা সে করেনি। হাসি মুখে বলেছে, থ্যাংকস।
মুনার কাছে যাওয়া যায়। অবশ্যই যাওয়া যায়। দুটো মেয়ে মানুষ একা একা আছে এই কারণেই তো যাওয়া দরকার। রাগ করলেই বা কি। তার একটা দায়িত্ব আছে না?
বাকের লম্বা লম্বা পা ফেলতে লাগল।
আকাশ ঘোলাটে। বৈশাখ মাস শুরু হয়েছে। ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি হবে। বৎসরের প্রথম কালবৈশাখী। ভাল। খুবই ভাল। ঝড়বৃষ্টি হোক। মাঝে মাঝে ঝড়বৃষ্টি হওয়া দরকার। তা না হলে সব ন্যাত মেরে যায়। লাইফ হেলা হয়ে যায়। বাকের গুনগুন করে একটা সুর উঠাবার চেষ্টা করছে। গানের কথাগুলি হচ্ছে ইয়ে হ্যাঁয় আখেরি জামানা। আখেরি শব্দটার ওপর লম্বা টান। আছে। টান দিয়ে গলা ভেঙে ফেলতে হয়। টানটা ভালই আসছে গলা ভাঙােটা আসছে না। তাঁর গুনগুন করতে ভাল লাগছে ইয়ে হ্যাঁয় আখেরি জামানা। এটা হচ্ছে শেষ সময়। হে প্ৰিয়তম এই শেষ সময়ে তুমি আমাকে ফেলে চলে যে ও না। অভিশপ্ত জীবন থেকে তুমি আমাকে মুক্তি দাও।
খুব আধ্যাত্মিক গান।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here