কোথাও_কেউ_নেই হুমায়ুন আহমেদ ১৫.

কোথাও_কেউ_নেই
হুমায়ুন আহমেদ

১৫.
হাসান সাহেব শুনলেন কে যেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। বসে আছে ড্রইং রুমে। সকাল ন’টা বাজে। অফিস যাবার তাড়া। এ সমযে কেউ আসে? হাসান সাহেব কাপড় পরতে পারতে ভাবলেন দু’ধরনের লোক এ সমযে তার কাছে আসতে পারে নির্বোধ ধরনের লোক কিংবা বড় ধরনের বিপদে পড়ে লোক। প্রথমটিই হওয়ার কথা। কারণ পৃথিবীতে বড় ধবনের বিপদে পড়া মানুষের চেয়ে নির্বোধের সংখ্যা বেশি।
ড্রইং রুমে সিদ্দিকুর রহমান সাহেব বসে ছিলেন। গায়ে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি! পান চিবাচ্ছেন। ঠোঁট বেয়ে এক ফোঁটা পানের রস পড়েছে সাদা পাঞ্জাবিতে। তার দিকে তাকালে পাঞ্জাবিতে সদা হওয়া পানের পিকের দাগই সবার প্রথম চোখে পড়বে। হাসান সাহেবেরও পড়ল। তিনি ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন।
স্নামালিকুম স্যার। আমার নাম সিদ্দিকুর রহমান। আমি থাকি আপনার…
আমি চিনি আপনাকে। কি ব্যাপার বলুন! আমার অফিসের তাড়া আছে।
বলতে একটু সময় লাগবে।
সময় লাগলে অন্য সময় আসতে হবে। এই মুহুর্তে আমার হাতে সময় নেই।
ঘটনাটা আপনার ভাই প্রসঙ্গে। বাকেরের বিষয়ে।
সেটা বাকেবের সঙ্গেই বলা উচিত। আমার সঙ্গে নয়।
ওর সঙ্গে কয়েক’দিন আগে আমায় একটা ঝামেলা হয়েছিল। তার পর থেকে একটার পর একটা ক্ষতি হচ্ছে আমার!
কি রকম ক্ষতি?
আমার গাড়ির উইন্ডশিল্ডটা চুরি গেল। একটা দোকান আছে আমার। স্টেশনারি শপ। তার কাচ-টাচ ভেঙে একাকার। তারপর একদিন…
আপনার ধারণা এসব বাকেরের কাজ?
পুলিশে কেইস করুন। আপনার সন্দেহের কথা বলুন।
এক পাড়ায় থাকি পুলিশে কেইস …?
এক পাড়ায় থাকলে পুলিশে কেইস করা যাবে না। এমন কোনো কথা নেই।
হাসান সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। তার গাড়ি এসে গেছে। আর বসে থাকা অর্থহীন। তিনি সব সময় অফিসে যাবার আগে সেলিনাকে বলে যান। আজ সেটা করতে ভুলে গেলেন। গাড়িতে উঠলেন অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে। সারা পথে কোন কথা বললেন না।
অফিসে তার জন্যে একটি বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। তাকে ওএসডি করা হয়েছে। অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি! মন্ত্রী সাহেব ব্যাপারটা তাহলে ভুলেননি। তার ক্ষমতা দেখিয়েছেন শেষ পর্যন্ত। হাসান সাহেবের এই মন্ত্রীর প্রতি খানিকটা সমীহ বোধ হল। এর ক্ষমতা তাহলে আছে। অধিকাংশেরই থাকে না। মাঠে বক্তৃতা দিয়েই যাবতীয় ক্ষমতা শেষ হয়ে যায়।
সেক্রেটারি। আমিরুল ইসলাম সাহেবের নিঃশ্বাস ফেলার সময় ছিল না। তবু তিনি হাসান সাহেবকে ডেকে পাঠালেন। শান্ত গলায় বললেন, কেমন আছেন?
স্যার, ভালই আছি।
নিন চা খান। চা খাবার জন্যে ডেকে পাঠিয়েছি।
থ্যাংক য়্যু।
খুব মন খারাপ করেছেন নাকি?
তা করেছি।
মন খারাপ করবার কিছুই নেই। ব্যাপারটা খুবই সাময়িক। আমি এটা ছেড়ে দেব এ রকম মনে করার কোনোই কারণ নেই। মন্ত্রী সাহেবের যে যোগাযোগ আছে আমার যোগাযোগ তারচে কম না।
হাসান সাহেব কিছু বললেন না। আমিরুল ইসলাম সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, ক্ষমতার মধ্যে একটা চালাচালির ব্যাপার আছে। একজন একটা চাল দেবে, অন্যজন তারচে বড় একটা চাল দেবে। এটা চলতেই থাকবে।
স্যার, আমি চাকরি ছেড়ে দেবার কথা ভাবছি।
হোয়াই? বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সুচাগ্র মেদিনী। মহাভারত পড়েননি নাকি?
আমিরুল ইসলাম ঘর কাঁপিয়ে হাসতে লাগলেন। মুহূর্তের মধ্যে হাসি থামিয়ে শক্ত মুখে বললেন, কয়েকটা দিন বিশ্রাম করুন। আমি কেমন প্যাচ লাগাচ্ছি। দেখুন।
প্যাঁচ লাগানোর কোনো দরকার দেখছি না। স্যার।
দরকার থাকবে না মানে? অফকোর্স আছে। এদের বুঝিয়ে দিতে হবে যে আমাদের খুব কাছাকাছি আসতে নেই। একটু দূরে থাকতে হয়। পুলিশে ছুঁয়ে দিলে হয় আঠার ঘা। সিএসপি কলম দিয়ে কিছু লিখলে হয় বিয়াল্লিশ ঘা। এবং সেই ঘার কোনো এন্টিডোেজ নেই। যান এখন বাড়ি যান। আজ আর অফিসে থাকার দরকার নেই।
হাসান সাহেব অসময়ে বাড়ি ফিরলেন। বাড়ি ফিরে তার ভালই লাগল। অনেক’দিন পর ফুলের টবগুলির পেছনে কিছু সময় দিলেন। চার-পাঁচটা বিশাল বনি প্রিন্স ফুটেছে। এদের দিকে তাকালেই মন ভাল হয়ে যায়। তিনি কাচি দিয়ে খুব যত্নে গোলাপ চারার মরা পাতাগুলি কাটলেন। মাটি খুঁড়ে দিলেন। বনি প্রিন্সের জন্যে চায়ের পাতার সার নাকি খুব ভাল। তিনি ভেবে রাখলেন, সেলিনাকে জিজ্ঞেস করবেন, চায়ের পাতা দেয়া হচ্ছে কিনা।
সেলিন রান্নাবান্না নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। আজ তার বিশেষ রান্না করতে ইচ্ছা হচ্ছে। হাসান সাহেবের অসময়ে ফিরে আসার ব্যাপারটা তার খুব ভাল লাগছে। কেন জানি বিয়ের প্রথমদিককার কথা মনে হচ্ছে। বিয়ের প্রথমদিকে এ রকম হত। অসময়ে সে এসে উপস্থিত। তার নাকি জুরািজ্বর লাগছে তাই চলে এসেছে। খুব মনে হয় ঐসব দিনের কথা। সুখের সময়গুলি বারবার কেন ফিরে আসে না। এই ভেবে সেলিনা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন।
বাকের দুপুরে খেতে এসে আকাশ থেকে পড়ল। খাবার টেবিলে ভাইয়া বসে আছে। এমন অবস্থা যে উঠে চলে আসা যায় না। আবার বসাও যায় না। অসময়ে ভাইয়া কেন?
সেলিনা বললেন দাঁড়িয়ে আছ কেন, বস।
বাকের বসল। যত দূর সম্ভব নিঃশব্দে খাওয়া শুরু করল। তার লবণ নেবার দরকার ছিল কিন্তু লবণদানীটা অনেকখানি দূরে। ভাইয়ার কাছে। তাকে নিশ্চয়ই বলা সম্ভব না–ভাইয়া লবণটা দাও।
হাসান সাহেব খাবার টেবিলে কথাবার্তা একেবারেই বলেন না। আজ নিচু গলায় সেলিনার সঙ্গে দু’একটা কথা বলছেন। যেমন, বনি প্রিন্সগুলি তো চমৎকার হয়েছে। টবে কী তুমি চায়ের পাতা দিচ্ছ। এই জাতীয় কথাবার্তা। বাকেরের মনে হল ভাইয়া কোন একটা ঝামেলা নিয়ে চিন্তিত। নিজের চিন্তা ঢাকার জন্যেই আজেবাজে ব্যাপার নিয়ে কথা বলছে।
বাকের!
জি ভাইয়া।
বাকেরের মেরুদণ্ড দিয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল। ভাইয়া তাকিয়ে আছে তার দিকেই। ব্যাপার কি?
বিছু বলবে আমাকে ভাইয়া?
হুঁ। তুই কি কারো গাড়ির উইন্ডশিল্ড ভেঙে দিয়েছিস?
বাকেরের গলায় ভাত আটকে গেল। সে হ্যাঁ-না কিছু বলতে পারল না। হাসান স্বাভাবিক স্বরে বললেন, কারো গাড়ির উইন্ডশিন্ড তোমার যদি ভাঙতে ইচ্ছা করে তুমি ভাঙবে। এটা তোমার ব্যাপার। তোমার কি করা উচিত বা উচিত নয় সেটা তোমাকে বলা আমি অর্থহীন মনে করি। উপদেশ শোনার বয়স তুমি অনেক আগেই পার হয়েছ।
হাসান সাহেব দম নেবার জন্যে একটু থামতেই সেলিনা বললেন, খাবার টেবিলে এই আলোচনা না করলেও হবে। খেতে এসেছ খাও।
অন্য সময় তো বাকেরকে পাওয়া মুশকিল, নানান কাজে সে ব্যস্ত থাকে। খাবার টেবিলটাই কথা বলার জন্যে ভাল। বাকের!
জি।
তুই নিজের পায়ে দাঁড়ানোর একটা চেষ্টা কর।
জি আচ্ছা।
তুই আমার কথাটা বুঝতে পারছিস না। না বুঝেই বলছিস জি আচ্ছা।
বাকের অবাক হয়ে ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। হাসান সাহেব বললেন, তুই অন্য কোথাও থাকার ব্যবস্থা কর। যাতে তোর বিরুদ্ধে কোনো কমপ্লেইন নিয়ে কেউ আমার কাছে না। আসে। তাছাড়া…
হাসান সাহেব একটু থামলেন। তাকালেন সেলিনার দিকে। সেলিনা চোখ বড় বড় করে বসে আছেন। খাবার টেবিলের এই নাটকের জন্যে তিনি একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না; হাসান সাহেব পানির গ্লাসে চুমুক দিয়ে ভাত মাখতে মাখতে বললেন, গুণ্ডা পোষার কাজটি আমি আর করতে রাজি নই।
সবাই নিঃশব্দ হয়ে গেল। সেলিনা ভাবলেন বাকের হয়ত খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে যাবে। কিন্তু সে উঠল না। সেলিনা বললেন, বাকের আচারের বোতলাটা দাও তো! বাকের আচারের বোতল এগিয়ে দিল।
সন্ধ্যাবেলা বাকের তার জিনিসপত্র নিয়ে মহিউদ্দিন সাহেবের দোকানে গিয়ে উঠল। ঠাণ্ডা গলায় বলল, আপনার এখানে কয়েকটা দিন থাকব। মহিউদ্দিন সাহেব পান-খাওয়া হলুদ দাঁত বের করে প্রচুর হাসতে লাগলেন। ভাবলেন এটা একটা রসিকতা।
হাসছেন কেন?
মহিউদ্দিন সাহেবের হাসি বন্ধ হয়ে গেল।
আমি আপনার দোকানে কিছু দিন থাকলে আপনার অসুবিধা হবে?
জি না অসুবিধা কিসের?
তাহলে একটা বোতলের ব্যবস্থা করেন বন্ধুবান্ধব নিয়ে খাব। বিদেশী জিনিস আনবেন। অনেক দিন খাওয়া হয় না।
মহিউদ্দিন সাহেবের মুখ শুকিয়ে গেল। একি যন্ত্রণায় পড়লেন।
বাকের বন্ধুদের খোঁজে বেরুল। নতুন জীবনযাত্রার শুরুটা তার খারাপ লাগছে না। ভালই লাগছে।
বিয়ের কার্ড শেষ পর্যন্ত ছাপা হল। চারশ কার্ড। দাওয়াতের এত মানুষ নেই। যেহেতু কার্ডের সংখ্যা বেশি কাজেই যাদের পাওয়ার কথা নয় তারাও দাওয়াত পেতে লাগল। বাবু চল্লিশটা কার্ড নিয়ে তার ক্লাসের সব ছাত্রকে একটি করে দিয়ে এল। শওকত সাহেব তার অফিসের চার-পাঁচজনকে বলবেন ভেবেছিলেন শেষ পর্যন্ত দেখা গেল। তিনি দাওয়াত করেছেন একুশজনকে। তাতেও শেষ নয়। তার মনে হল শুধু একুশজনকে বলাটা ঠিক হল না। অন্যরা কি দোষ করল। দ্বিতীয় দিনে তিনি আরো একগাদা কার্ড নিয়ে গেলেন। যাবার পথে মুনাকে বললেন, খরচপাতি কিছু হচ্ছে হোক একটাই তো বিয়ে ফ্যামিলিতে।
মুনা গম্ভীর গলায় বলল, একটাই বিয়ে মানে? আমি কি বিয়ে করব না নাকি?
শওকত সাহেব হকচকিয়ে গেলেন। মুনা বলল, কি চুপ করে আছ কেন? তোমার কি ধারণা আমি সন্ন্যাসী হয়ে যাব?
কি যে বলিস তুই।
শওকত সাহেব হাসতে চেষ্টা করলেন। মুনার আজকাল কি হয়েছে উল্টাপাল্টা কথা বলে ফেলে। মুনা তুই মামুনকে কার্ড পাঠিয়েছিস?
মামুনকে কার্ড পাঠাব কেন?
বিয়েতে যাতে আসে সে জন্যে। সে এলে তোদের বিয়েরও একটা ডেট ফেলে দেব। শরীরের অবস্থা ভাল না। কাজকর্ম সব শেষ করে রাখতে চাই। কী বলিস?
শরীরের অবস্থা খারাপ মনে করলে তাই করা উচিত। বাবুরও বিয়ে দিয়ে দাও।
কি বললি?
বললাম, বাবুরও বিয়ে দিয়ে ঝামেলা চুকিয়ে দাও। ক্লাস ফোর-ফাইভে পড়ে এমন একটা মেয়ে খুঁজে বের কর। একটা বাল্যবিবাহও হয়ে যাক।
শওকত সাহেব চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলেন। মুনা বলল, কি রাজি আছ?
তোর কি মাথাটা খারাপ হয়েছে নাকি রে মুনা?
একটা প্র্যাকটিক্যাল কথা বললাম, এর মধ্যে মাথা খারাপের কি দেখলে?
মুনা তার মামাকে গভীর সমুদ্রে ফেলে চলে এল বাবুর কাছে। বাবু স্কুলে যায়নি। দুহাতে মাথা চেপে বসে আছে। তার চোখ লাল। দেখেই মনে হচ্ছে তার অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে।
কি রে বাবু মাথা ধরেছে?
হুঁ।
তোর বিয়ের ঠিকঠাক করে এলাম। বালিকা বধূ চলে আসবে ঘরে। মাথা ধরলে মাথা টিপে দেবে? কি খুশি?
বাবু তাকিয়ে রইল। মুনা হাসতে লাগল। বাবু বলল, একটু মাথা টিপে দেবে আপা? মরে যাচ্ছি।
মাথা টেপার সময় নেই রে, এখন যেতে হবে অফিসে। বকুলের বিয়ের কার্ড ডিসট্রিবিউট করব। সবার বন্ধুবান্ধব আসবে, আমার কেউ আসবে না। এটা খারাপ না? তুই ঘর অন্ধকার করে শুয়ে থাকে। মাথা ধরা সেরে যাবে।
মুনা নতুন শাড়ি পরল। অনেক সময় নিয়ে চুল বাঁধল। কড়া করে লিপিসিন্টক লাগল ঠোঁটে। বকুলকে বলল, কেমন লাগছে রে আমাকে? পেত্নীর মত লাগছে নাকি?
ভালই লাগছে। পেত্নীর মত লাগবে কেন?
আমার তো মনে হচ্ছে ড্রাকুলার মত লাগছে। ঠোঁট দেখে মনে হচ্ছে এইমাত্র কারোর রক্ত খেয়ে এসেছি ঠোঁটে রক্ত লেগে আছে।
কি যে তুমি বল আপা। যাচ্ছ কোথায়?
অফিসে। সবাইকে তোর বিয়ের কার্ড দেব। এই কারণেই এত সাজগোজ করলাম। এলেবেলে ভাবে গেলে সবাই মনে করবে। ছোট বোনের বিয়ে হচ্ছে আমার হচ্ছে না। এই দুঃখে আমি…
মুনা কথা শেষ করল না। একগাদা কার্ড নিয়ে রওনা হল। বাকেরের সঙ্গে দেখা হল পথে। মুনা হাসিমুখে বলল, বাকের ভাই আপনাকে নাকি বাড়ি থেকে গেট আউট করে দিয়েছে? বাকের চুপ করে রইল। তার মুখ শুকনো। সে ঘন ঘন থুথু ফেলছে।
কি বাকের ভাই কথা বলছেন না কেন? যা শুনছি তা কি মিথ্যা?
মিথ্যা না। সত্যি।
হাতখরচ পাচ্ছেন, না তাও বন্ধ?
হাতখরচের দরকার কি?
দিন চলছে কিভাবে? ধারের ওপর?
বাকের তার জবাব না দিয়ে বলল, তোমার কি শরীর খারাপ নাকি?
মুনা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, এত সেজোগুজে বের হয়েছি তারপরও বলছেন শরীর খারাপ। দেখে সে রকমই মনে হচ্ছে।
অফিসেও সবাই এই কথা বলল। পাল বাবু চোখ কপালে তুলে বললেন, হয়েছে কি আপনার?
কি আবার হবে কিছু হয়নি।
গালটাল ভেঙে একাকার। অসুখটা কি?
কোন অসুখ নেই।
মুনা ভেবেছিল কার্ডগুলি দিয়েই চলে আসবে। কিন্তু সে অফিস ছুটি না হওয়া পর্যন্ত থাকল। সবার টেবিলে খানিকক্ষণ করে বসে হাত নেড়ে নেড়ে গল্প করল। সে ভেবেছিল অনেকেই তাকে জিজ্ঞেস করবে নিজের বিয়ের কার্ড নেই ছোট বোনের বিয়ের কার্ড। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার কেউ সে প্রসঙ্গ তুলল না। এখনো পনের দিনের মত ছুটি আছে তার হাতে তবু সে ঠিক করে ফেলল আগামী কালই সে জয়েন করে ফেলবে। শুধু শুধু বাড়িতে বসে থাকার কোন মানে হয় না।
তার জন্যে একটা বিস্ময়ও অপেক্ষা করছিল। অফিস ছুটির পর দেখা গোল কর্মচারীদের জন্যে ঝকঝকে নতুন বাস। পাল বাবু বললেন, ইউনিয়ন ঘাড় ধরে বাস কিনিয়েছে। এখন থেকে পায়ের উপর পা তুলে অফিসে যাবেন অফিস থেকে আসবেন। হা হা হা মুনাও উঁচু গলায় হাসতে লাগল। তার বড় ভাল লাগছে। অফিস-টফিস বাদ দিয়ে বাড়িতে বসে থাকাটা খুব বোকামি হয়েছে।
শুধু বাস নয় বুঝলেন মিস মুনা, আরো আছে।
আর কি?
আন্দাজ করেন দেখি।
মুনা আন্দাজ করতে চেষ্টা করল, কিন্তু কিছু বলার আগেই পাল বাবু নিচু গলায় বললেন, কর্মচারীদের জন্যে ফ্ল্যাট হচ্ছে।
বলেন কি?
বোর্ড মিটিং-এ পাস হয়েছে। ছমাসের মধ্যে তিনটা চারতলা ফ্ল্যাট। দু’টা বেডরুম ড্রইং কাম ডাইনিং রুম। বারান্দা।
বাহ চমৎকার তো।
এর নাম ইউনিয়নের চাপ। রাম চাপ।
চাপ তো আগেও ছিল তখন তো কাজ হয়নি।
তখন হবে না বলে এখনো হবে না? দিনকাল পাল্টে যাচ্ছে না? আগের দিন কি আছে নাকি?

মামুন লক্ষ্য করেছে যাদের নাম ক দিয়ে শুরু হয় তারা বেশ প্যাচানো স্বভাবের মানুষ হয়ে থাকে। সে ক নামের কজনকে চেনে সবার পেটে স্কুর প্যাচ। কৃষি ব্যাংকের ম্যানেজারের কথাই ধরা যাক। তার নাম কাশেম আলী, হাড় বজাত। লোনের ব্যাপারটা নিয়ে ক্রমাগত ঘুরাচ্ছে। কলেটরেল হিসেবে জমিজমার দলিলের নকল চেয়েছিল সেগুলি দেয়া হয়েছে যথাসময়ে। এখন সে বলছে, দলিলের নকলগুলি আবার দিন। আগেরগুলি মিস প্লেসড হয়েছে। মনে হচ্ছে কাশেম আলী সাহেব পান খাওয়ার জন্যে কিছু চান মুখ ফুটে বলতে পারছেন না। নিজ থেকে না চাইলে পান খাওয়ার টাকা দেয়াও তো মুশকিল। মামুন নিশ্চয়ই বলতে পারবে না। ভাই আপনাকে আমি ঘুষ দিতে চাই। কত টাকা দেব বলুন? আপনার রেট কত? আর একটা বলতে পারবে না। বলেই প্রতি সপ্তাহে তাকে দুতিনবার এসে ঘণ্টা খানিক বসে থাকতে হবে। আজও তাই হবে। কাশেম আলী সাহেব ভীষণ ব্যস্ততার ভান করে বললেন, আপনি কাইন্ডলি আগামী সপ্তাহে আসুন। আমাদের এজিএম সাহেব আসছেন। নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই এখন।
মামুনের ভাগ্য ভাল। আজ সে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের কথা শুনল। কাশেম আলী সাহেব সরু গলায় বললেন, আপনার কাগজপত্র গুছানো হয়ে গেছে। ফাইল জাহানারার কাছে। সে আপনাকে বলবে এখন কি করতে হবে। মামুন অবাক হয়ে বলল, জাহানারা কে?
আমাদের নতুন সেকেন্ড অফিসার। পরশু জয়েন করেছেন। আপনি অপেক্ষা করুন। তিনি কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবেন।
মহিলা অফিসারদেরও এত দূর পাঠানো হচ্ছে?
হবে না কেন? দিনকাল পাল্টে গেছে। মেয়েদেরও এখন সমানে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে ইনটেরিয়রে। মেয়েরাও তেমন আপত্তি করছে না। ইয়াং ইয়াং সব মেয়েরা কাজ নিয়ে কোথায় যাচ্ছে।
ভালই তো।
হুঁ ভালই। মেয়েরা হচ্ছে আপনার অফিসারের শোভা। সেজোগুজে বসে থাকে। সেজোগুজে বসে থাকে, দেখতে ভালই লাগে, হা হা হা।
মামুন লক্ষ্য করল, কাশেম আলী সাহেবকে বেশ খুশি খুশি লাগছে। সুন্ট-টুট পরেছেন। গ্রামের কৃষি ব্যাংকের ম্যানেজাররা এমন স্যুট পরে না।
জাহানারার বয়স তেইশ-চব্বিশ। রোগা পাতলা মেয়ে। চশমার ফ্রেমটি মুখের তুলনায় একটু বড় বলেই বোধ হয় তাকে অনেক বেশি রোগা লাগছে। গলার স্বর খুব নরম। শুনতে ভাল লাগে। টেবিল ভর্তি কাগজপত্র নিয়ে সে এমন ভাবে বসে আছে যেন মনে হচ্ছে গভীর সমুদ্রে পড়েছে। মেয়েটির নাকে একটা ফুটো, সেখানে সুতো বাধা এটা একেবারেই মানাচ্ছে না।
কাশেম আলী সাহেব পরিচয় করিয়ে দিলেন। মামুনের ফাইল বের করে কি সব করতে বললেন। মামুন তার কিছুই বুঝতে পারল না। এবং তার মনে হয় মেয়েটিও বুঝতে পারছে না। পরীক্ষার কঠিন প্রশ্নের দিকে মেয়েরা যে ভাবে তাকায় সেই ভাবে তাকাচ্ছে। মামুন হাসিমুখে বলল, এ রকম পাড়া গাঁয়ে এলেন কেন?
কি করব বলুন? অন্য কোথাও ভেকেন্সি ছিল না। তবে বেশিদিন থাকতে হবে না। এজিএম বলেছেন মাস দুয়েকের ভেতর ঢাকায় ট্রান্সফারের ব্যবস্থা করবেন।
ঐ সব মুখের কথা একেবারেই বিশ্বাস করবেন না। একবার যখন এনে ফেলে দিয়েছে। আর নড়াবে না।
মেয়েটি চোখ-মুখ অন্ধকার করে বসে রইল। বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে লাগল। মামুনের বড় মায়া লাগল। মেয়েটিকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে, সে বাবা-মা, ভাই-বোন ফেলে এসেছে। আসতে হয়েছে অর্থনৈতিক কারণে। সংসার চলছে হয়ত বাবার পেনশন এবং মেয়ের চাকরির টাকায়।
এখানে থাকেন কোথায়?
ম্যানেজার সাহেবের বাসায়। উনি ফ্যামিলি নিয়ে থাকেন। একটা কামরা আমাকে ছেড়ে দিয়েছেন।
অসুবিধা হচ্ছে না তো?
জি না।
অসুবিধা হলে বলবেন। আমি এখানকারই ছেলে।
মেয়েটি অল্প হেসে কাগজপত্রের ওপর ঝুঁকে পড়ল। যেন সে কথাবার্তা আর চালিযে যেতে আগ্রহী নয়। মামুনের হঠাৎ করে মনে হল এই মেয়েটির সঙ্গে মুনার কোথায় যেন একটা মিল আছে। সেই মিলটি কোথায় সে তার ধরতে পারছে না। অমিলগুলি ধরা পড়ছে সহজেই। মুনার মধ্যে এক ধরনের কাঠিন্য আছে এই মেয়েটির মধ্যে সে জিনিসটা একেবারেই নেই। চেহারাও দুজনের দুরকম। মুনার মুখ লম্বাটে, এ মেয়েটির মুখটি গোলাকার। তালে মিলের একটা ব্যাপার মনে আসছে কেন? মুনার সঙ্গে যে পরিস্থিতিতে আলাপ হয়েছিল। এই মেয়েটির সঙ্গে ঠিক সেই ভাবেই আলাপ হচ্ছে। এটিই কি কারণ? একটা কাজের ব্যাপারে সে মুনাদের অফিসে গিয়েছিল। কাজটি তেমন জটিল কিছু ছিল না। কিন্তু মুনা সেই সামান্য কাজ নিয়েই হাবুডুবু খাচ্ছিল। আজ যেমন এই মেয়েটি খাচ্ছে। কিছু কিছু ঘটনা কি আমাদের জীবনে ঘুরে ঘুরে আসে?
জাহানারা বলল, আপনি খানিক্ষণ বসুন। মামুন হাসিমুখে বলল, বসেই তো আছি। প্রায়ই আসি এবং বসে থাকি।
মামুন ভেবেছিল মেয়েটি কথার পিঠে কোন কথা বলবে। ইন্টেলিজেন্ট কিছু বলতে চেষ্টা করলে কিন্তু তা ঠিক ইন্টেলিজেন্ট হবে না। কিন্তু জাহানারা কিছুই বলল না। গভীর মনোযোগে ফাইল উল্টাতে লাগল। একটি মেয়ের সামনে চুপচাপ বসে থাকা কঠিন ব্যাপার। কিন্তু একা একা বকবক করাও মুশকিল।
আমাদের জায়গাটা কেমন লাগছে?
ভালই।
আগে কখনো গ্রামে কাটিয়েছেন?
না।
শহরেই মানুষ?
ঠিক শহরে না মফস্বল শহর।
কোন মফস্বল শহর?
জাহানারা তার জবাব না দিয়ে শান্ত গলায় বলল, আপনাকে আর আমাদের এখানে আসতে হবে না। কাগজপত্র সব ঢাকায় পাঠিয়ে দিচ্ছি। লোন স্যাংশন হলেই আপনাকে খবর দেয়া হবে।
ংশন হবে তো?
নিশ্চয়ই হবে। হবে না কেন।
ঘরে বসে থাকলেই হবে, না ধরাধরির ব্যাপার আছে?
আপনাতেই হবে।
এ দেশে আপনাতেই কিছু হয় না।
জাহানারা এ কথারও কোনো জবাব দিল না। অন্য কি সব কাগজপত্র দেখতে লাগল। মামুনের এখন উঠে পড়া উচিত। কিন্তু উঠতে চেষ্টা করছে না। এক ধরনের আলস্য লাগছে।
উঠি আজ? আবার দেখা হবে।
মেয়েটি সামান্য হাসল। মুনার হাসির সঙ্গে এই মেয়েটির হাসির কি কোন মিল আছে। আছে হয়ত। প্রতিটি মানুষ হাসে নিজের মত করে। একজনের হাসির সঙ্গে অন্যজনের হাসির কোন মিল নেই। অবশ্যি সবাই কাঁদে একইভাবে। নাকি একেকজন মানুষের কান্নাও একেক রকম।
ডাকে একটি রেজিস্ট্রি চিঠি এসেছে। মামুন মনে করতে পারল না রেজিস্ট্রি চিঠিতে সে কখনো কোনো জরুরি কিছু পেয়েছে কি না। না পায়নি। বরং আজেবাজে জিনিসপত্রই লোকে তাকে রেজিস্ট্রি করে পাঠিয়েছে। একবার সে চিঠি পেল যে কোনো এক লোক মদিনা শরিফে কি একটা স্বপ্ন দেখছে সেই স্বপ্নের কথা সাতজনকে লিখে জানাতে হবে। যদি না জানানো হয় তাহলে বিরাট ক্ষতি হবে। জানালে লটারিতে টাকা। কত অদ্ভুত ধরনের মানুষই না আছে পৃথিবীতে।
মামুন চিঠিটা খুলল না। সন্ধ্যার পর ধীবে-সুস্থে খোলা যাবে। সন্ধ্যার পর তার কিছু করার থাকে না তখন চিঠিপত্র পড়াটা ভালই লাগবে। এমনও তো হতে পারে এটা মুনার চিঠি। আবেগটাবেগে দিয়ে একগাদা কথা লিখেছে। যার মূল বক্তব্য হচ্ছে–যা হবার হয়েছে এখন তুমি এস। এই জাতীয় চিঠি পেলে তার তৎক্ষণাৎ ছুটে যাওয়ার কোনো কারণ নেই। বরং উল্টোটা করতে হবে। চিঠির জবাব না দিয়ে গ্যাট হয়ে বসে থাকতে হবে। তারপর আসবে দ্বিতীয় চিঠি। দ্বিতীয় চিঠির পর তৃতীয় চিঠি। তৃতীয় চিঠির জবাবও যখন আসবে না। তখন হয়ত সে নিজেই চলে আসবে। চমৎকার হবে সেটা।
মামুন সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারল না। বিকেলে চিঠি খুলে ফেলল। বকুলের বিয়ের কার্ড। সঙ্গে চিঠিপত্র কিছুই নেই। একটা লাইন পর্যন্ত না। এর মানে কি? খামের ঠিকানাও কি মুনার লেখা নয়?
ম্যানেজারের বাসায় থাকাটা জাহানারার সহ্য হচ্ছে না। ভদ্রলোক রোজ তার স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করছেন। বেগুন দিয়ে ডিমের তরকারি রান্না করার বদলে ম্যানেজার সাহেবের স্ত্রী আলু দিয়ে তরকারি রোধেছেন। এতেই ভূমিকম্প হয়ে যাচ্ছে।
পেয়েছ তুমি কি? যা ইচ্ছা তাই করবে? এমন তো না ঘরে বেগুন ছিল না। ছিল। আমি নিজে কিনে দিয়েছি। ঘরে থেকে জিনিস পচবে আর তুমি লোক পাঠিয়ে আলু কিনে আনবে। না। এই তরকারি। আমি খাব না। ফেলে দিয়ে আস। এক্ষুণি ফেলে দিয়ে আস। ·
অসহ্য। ভদ্রলোক কখনো বোধ হয় ভাবেন না যে এ বাড়িতে বাইরের একজন আছে। তার সামনে অন্তত কিছুটা সংযত আচরণ করা উচিত। স্ত্রীকে পশুর মত কেউ কি দেখে এই সময়ে? আর মেয়েটি এমন বোকা একটি কথাও বলবে না। নিঃশব্দে গাল হজম করবে। মাঝে মাঝে জাহানারারই বলতে ইচ্ছা করে, এসব কি শুরু করেছেন?
কিন্তু তা বলা সম্ভব নয়। অনেক কিছুই আমরা বলতে চাই কিন্তু বলতে পারি না। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করতে হয়। অবশ্যি জাহানারা একটা ঘর নেবার চেষ্টা করছে। যদিও সে জানে একা এক একটা বাড়ি ভাড়া করে থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়। ঢাকা থেকে মা এবং ভাই-বোনদের নিয়ে আসার প্রশ্নই উঠে না। বোন দু’টির স্কুল আছে। ছোট ভাই অনার্স পরীক্ষা দিচ্ছে। বাবার শরীরও ভাল হবে না। তবু জাহানারা যাকে পাচ্ছে তাকেই বলছে, আমার জন্যে একটা বাসা-টাসা দেখবেন। কেউ তার কথার তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না। গুরুত্ব দেবার কথাও নয়। এ রকম পাড়াগা জায়গায় লোকজন ভাড়া দেবার জন্যে গণ্ডায় গণ্ডায় বাড়ি রাখে না। ম্যানেজার সাহেব এক’দিন বেশ গম্ভীর হয়ে বললেন, শুনছি চারদিকে আপনি বাড়ি খুঁজছেন? জাহানারা কিছু বলল না।
আমার এখানে আপনার কি কোনো অসুবিধা হচ্ছে?
জি না স্যার।
অল্প কিছুদিন থাকবেন বাড়ি-টাড়ি খোজার ঝামেলা করবেন না। একা একা থাকবেন কিভাবে?
জাহানারা চুপ করে রইল। ম্যানেজার সাহেব শুকনো গলায় বললেন, তাছাড়া এই যে আপনি বাড়ি খোঁজাখুঁজি করছেন তার একটা বাজে দিক আছে।
বাজে দিক মানে?
লোকজন নানান কথা বলবে।
জাহানারা অবাক হয়ে বলল, স্যার আপনার কথা বুঝতে পারছি না।
আপনি এতদিন ছিলেন আমাদের সঙ্গে। এখন চলে যেতে চাচ্ছেন। অথচ একা মেয়ে মানুষ লোকজন আমাকে নিয়ে নানান কথা ভাববে।
জাহানারা হকচকিয়ে গেল। তার দারুণ মন খারাপ হল। এটা এমন জায়গা যে মন খারাপ হলেও কিছু করার নেই। কোথাও যাবার নেই। ঢাকায় থাকলে কত কি করা যেত। একটা গল্পের বই নিয়ে বারান্দায় বসে থাকা যেত। বই মুখের ওপর ধরে কাদা যেত। কেউ দেখে ফেললে অসুবিধা নেই। ভাববে পড়ে কাঁদছে।
কিন্তু এখানে কিছুই করার নেই। তবু সে মন খারাপ হলে একা একা হাঁটে। লোকজন প্রথম দিকে কৌতূহলী হয়ে তাকাত, এখন তাকায় না। কাঁচা রাস্তা ধরে হেঁটে হেঁটে সে কুসুমখালি নদী পর্যন্ত যায়। মরা নদী। তবে বর্ষার সময় নদী নাকি খুব ফুলে-ফেপে ওঠে। ম্যানেজার সাহেবের কাছে শুনেছে সেটা নাকি একটা দেখার মত ব্যাপার। জাহানারা নিশ্চিত জানে সে বর্ষা পর্যন্ত থাকবে না। কিন্তু কোনো-এক বিচিত্র কারণে মাঝে মাঝে তার মনে হয়। বর্ষা পর্যন্ত থেকে গেলে ভালই হবে।
নদীর যে দিকটায় জাহানারা যায়। সেখানে শ্মশান ঘাট। ভাঙা হাঁড়ি-কুড়ি আছে। শ্মশান যাত্রীদের বিশ্রামের জন্যে একটা শ্যাওলা ধরা পাকা ঘর আছে। তার দেয়ালে কাঠ কয়লা দিয়ে অদ্ভুত অদ্ভুত সব কথাবার্তা লেখা। এক’দিন অফিসের পিওনাকে সঙ্গে নিয়ে সে লেখা পড়তে এসেছিল। রোজ রোজ তো তাকে সঙ্গে নিয়ে আসা যায় না।
শ্মশান ঘাটেই এক’দিন তার মামুনের সঙ্গে দেখা। মামুন চোখ কপালে তুলে বলল, এখানে কি করছেন?
জাহানারা বিব্রত ভঙ্গিতে বলল, কিছু করছি না। বেড়াচ্ছি।
বেড়াচ্ছেন্ন মানে? এটা কি বেড়াবার জায়গা?
কেন ভূত আছে নাকি?
ভূত আছে কি না জানি না। তবে এখানে সেভেন্টিওয়ানের যুদ্ধের সময় বহু মানুষকে গুলি করে মেরেছে। আমরা কেউ একদিকটায় আসি না।
এই তো আপনি এসেছেন।
আমি আপনার জন্যেই এসেছি। দূর থেকে দেখলাম শাড়ি পরা একটা মেয়ে ঘুরছে। তাও শহরের মেয়ে। আপনার ব্যাপারটা কি বলুন তো?
ব্যাপার কিছু না। বেড়াচ্ছিলাম। বেড়াবার তো জায়গা নেই।
বেড়াবার জায়গা থাকবে না কেন? বিরাট একটা দেয়াল আছে। সারদেয়াল নাম। কারা তৈরি করেছে। কেউ জানে না। বিশাল ব্যাপার। দেখলে অবাক হয়ে যাবেন।
জাহানারা কিছু বলল না। লোকটির তাকে বেড়াতে নিয়ে যাবার এই বাড়াবাড়ি আগ্রহ ভাল লাগছে না।
কি যাবেন। সারদেয়াল দেখতে?
জি না।
এখান থেকে মাইল দুয়েক দূরে বড় গঞ্জ আছে। একটা সিনেমা হলও হয়েছে। গিয়েছেন সেখানে?
জি না।
যাবেন। যেতে চাইলে আমি নিয়ে যেতে পারি।
থ্যাংকস। আমি কোথায় যাব না।
জাহানারা হাঁটতে শুরু করল। মামুন আসছে তার পাশাপাশি। এরকম সরু রাস্তায় পাশাপাশি হাঁটার দরকার কি। একবার গায়ে গা লেগে গেল জাহানারা বিরক্ত গলায় বলল, আপনি আগে আগে যান। আমি আসছি আপনার পেছনে।
পাশাপাশি না হাঁটলে গল্প করা যাবে না তো। গল্প করার সময় মাঝে মাঝে মুখের দিকে তাকাতে হয়। অন্যের মুখের ভাবের দিকে লক্ষ্য রাখতে হয়।
আপনিও কি লক্ষ্য রাখছেন?
হ্যাঁ রাখছি। এবং বুঝতে পারছি আপনি আমার ওপর অসম্ভব বিরক্ত হচ্ছেন।
তা হচ্ছি।
বিরক্ত হবার কিন্তু কোনো কারণ নেই। আপনি যদি মনে করে থাকেন–আপনার সঙ্গে খাতির জমানোর জন্যে বেড়াতে-টেড়াতে নিতে যাচ্ছি তাহলে ভুল করবেন। ঐ জাতীয় কোন উদেশ্য আমার নেই। আপনাকে কেমন লোনলি লাগছিল তাই বলছিলাম। আচ্ছা, যাই তাহলে।
মামুন লম্বা লম্বা পা ফেলে ডানদিকে রওনা হল। জাহানারার অস্বস্তির সীমা রইল না।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here