কোথাও_কেউ_নেই শেষ পর্ব হুমায়ুন আহমেদ

কোথাও_কেউ_নেই শেষ পর্ব
হুমায়ুন আহমেদ

২৫.
বকুলের বড় মায়া লাগছে। জহিরের কথা বলার ভঙ্গিতে বোঝা যাচ্ছে সে গভীর জলে পড়েছে উদ্ধারের আশা নেই। ডুবন্ত মানুষ যেমন খড়কুটো ধরে ও তেমনি ধরেছে বেনী মাধবকে।
রাতে ঠিকমত খেতেও পারল না। একগাদা ভাত মাখিয়ে দু’এক নলা মুখে দিয়েই বলল খেতে পারছি না বকুল।
কেন খেতে পারছি না?
বুঝতে পারছি না। খুব ক্ষিধে লেগেছিল। হঠাৎ ক্ষিধেটা মরে গেল।
একটু দুধ দেই। দুধ গুড মাখিয়ে খাও।
দাও।
দুধ দেয়া গেল না। ঘরে দুধ ছিল না।
বকুলের কেমন জানি কান্না পেতে লাগল। আহ বেচারি দুধ ভাত খাবার জন্যে হাত গুটিয়ে বসে ছিল। বকুল ভেবে রেখেছিল রাত জেগে অনেক গল্প করে জহিরের মনটা সে ভাল করবে। গল্প ছাড়াও তো পুরুষদের অন্যসব দাবিও থাকে। সেই সব সে খুব আগ্রহ করেই মেটাবে। ঘুমুবার সময় ঘুমুবে জহিরকে জড়িয়ে ধরে। আহা বেচারা একা একা কত ঝামেলা সহ্য করছে। আর তাকে একা ঝামেলা সহ্য করতে দেবে না। এবার সে নিজেও সঙ্গে যাবে।
জহির বলল, এক কাপ আদা চা খাওয়াবে বকুল। শরীরটা কেমন ঝিম মেরে আছে। কিছু ভাল লাগছে না।
তুমি বিছানায় শুয়ে থাক। আমি চা বানিয়ে আনছি।
মাথা ধরার ট্যাবলেট থাকলেও একটা নিয়ে এস। মাথাটা কেমন ধরা ধরা মনে হচ্ছে।
বকুল চা নিয়ে এসে দেখে জহির ঘুমুচ্ছে। ক্লান্ত-শ্রান্ত মানুষের ঘুম; বড় বড় করে নিঃশ্বাস ফেলছে। মাথাটা বালিশ থেকে খানিকটা সরে গেছে। বকুলের ঘুম এল না।
জহিরকে জড়িযে ধরে সে জেগে রইল। পুরানো কথা মনে পড়তে লাগল। প্রথম যখন পরিচয় হয়। জহিরের সঙ্গে কথা বলতে কেমন ভয় ভয় লাগত। আবার ভাল ও লাগত। জহিরের ফার্মেসির সামনে দিয়ে যাবার সময় সে হাঁটতে মাথা নিচু করে যাতে জহির তাকে দেখতে না পায় অথচ মনে মনে সারাক্ষণ চাইত জহির তাকে দেখে ফেলুক। প্রায় সবদিনই জহির তাকে দেখতে। যেদিন দেখতে না সেদিন এমন কষ্ট হত চোখে পানি এসে যেত। আবার চোখে পানি আসার জন্যে নিজের ওপর রাগ লাগত। কী অদ্ভুত সময় গেছে। ইস এই সময়টা আর ফিরে আসবে না। ভালবাসার মানুষের সঙ্গে বিয়ে না হওয়াটাই বোধ হয় ভাল। বিয়ে হলে মানুষটা থাকে ভালবাসা থাকে না। আর যদি বিয়ে না হয় তাহলে হয়ত বেশি প্ৰিয।
বকুল।
কি?
ক’টা বাজে দেখ তো।
জহির বিছানায় উঠে বসল। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে যেন ঠিক বুঝতে পারছে না। সে কোথায়। বকুল বাতি জ্বালাল। ঘড়ি দেখল।
ক’টা বাজে?
দেড়টা। চা এনে দেখি তুমি ঘুমিয়ে পড়েছ-তাই আর জাগাইনি।
ঠাণ্ডা পানি খাওয়াও তো। গরম লাগছে খুব। জানালা খোলা না?
হ্যাঁ খোলা।
দমবন্ধ দমবন্ধ লাগছে।
বকুল পানি নিয়ে এসে দেখে জহির সিগারেট ধরিয়েছে। দুচুমুক পানি খেয়েই সে গ্রাস নামিয়ে রাখল। করুণ গলায় বলল, শরীরটা কেমন যেন লাগছে।
কেমন লাগছে?
বুঝতে পারছি না।
শরীর খারাপ লাগছে তো–সিগারেট টানছ কেন?
জহির সিগারেট ফেলে দিল। বকুল লক্ষ্য করল জহির খুব ঘামছে। সে ক্ষীণ স্বরে বলল, তল পেটে কেমন জানি চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে। বমি বমি লাগছে।
আপাকে ডেকে আনব?
উনাকে ডেকে এনে কি হবে? উনি কি করবেন? তুমি বরং চিনির সরবত করে দাও। তৃষ্ণা লাগছে।
বকুল চিনির সরবত করে আনল। দুচুমুক দিয়ে সরবতের গ্লাস নামিয়ে জহির ক্লান্ত গলায় বলল, বোধ হয় মারা যাচ্ছি।
কী বলছ তুমি? মারা যাবে কেন?
আপাকে ডাক। শরীরটা বেশি খারাপ লাগছে। মনে হচ্ছে স্ট্রোক। আমাকে সোহরাওয়াদীতে নিতে বল। আমি নিজে ডাক্তার।
মুনা বাবুকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। বাকেরকে খুঁজে বের করতে হবে। জহিরকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেত হবে। এক একটা মিনিটও এখন মূল্যবান।
বাকের ঘরে ছিল। স্যান্ডেল খুঁজে বের করার সময়ও সে নিল না। খালি পায়ে ছুটে বেরিয়ে গেল। কোথায় যাচ্ছে কি করার জন্যে যাচ্ছে তাও সে জানে কি না কে জানে।
বাকের অসাধ্য সাধন করল। চল্লিশ মিনিটের মাথায় জহিরকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারল। বড় রকমের একটা ঝাপটা সামলান গেল। তবে জহিরের শরীরের বা অংশ অচল হয়ে গেল।
বকুল ক্রমাগত কাঁদছিল। জহির ক্ষীণ স্বরে বলল, কাদার কিছু নেই। ঠিক হয়ে যাব। আমি ডাক্তার আমার কথা বিশ্বাস কর।
বকুল কোনো কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না–সে শুধু দেখছে। একজন সুস্থ সবল মানুষ হঠাৎ পা নাড়াতে পারছে না। এটা কেমন করে হয়।
মুনা বলল, এ রকম বিশ্ৰী করে কাঁদছিস কেন? বকুল থমথমে গলায় বলল, সুন্দর করে কাঁদাটা কেমন আমি জানি না আপা। তাই বিশ্ৰী করে কাঁদি। তোমার ভাল না লাগলে তুমি অন্য ঘরে যাও।
জহিরের শরীর যত দ্রুত সারবে ভাবা গিয়েছিল তত দ্রুত সারল না। মাস খানেক পর দেখা গেল। ডান পা কিছু কিছু নাড়াতে পারে; বা পায়ের আঙুল নাড়াতে পারে এর বেশি কিছু না।
এভাবে হাসপাতালে পড়ে থাকার কোন মানে হয় না। জহির নেত্রকোনায় ফিরে গেল। সঙ্গে গেল বকুল এবং বাবু।
মা হবার লক্ষণ বকুলের মধ্যে স্পষ্ট হতে শুরু করেছে–বেশি পরিশ্রম করতে পারে না হাঁপিয়ে উঠে। কিন্তু তবু জহিরের সব কাজ নির্জের হাতে করতে চায়। তার শাশুড়ির এই জিনিসটা কেন জানি ভাল লাগে না। এক’দিন তিনি বলেই ফেললেন, আলগা আদর কিন্তু ভাল না বৌমা। বকুল সঙ্গে সঙ্গে বলল, আলগা আদর কাকে বলে মা?
তুমি যা করছি তার নাম আলগা আদর।
এর নাম আলগা আদর কেন?
দু’দিন আগের কথা ভুলে গেছ। দু’দিন আগে তো এক ঘরে ঘুমুতে পর্যন্ত পারতে না।
এখন পারি তাতে অসুবিধা কি?
অসুবিধা কিছুই না। মুখের ধার একটু কমাও তো বাউ। এত ধরা ভাল না।
বকুলের মুখের ধার কমে না। বরং বেড়েই চলে। বাবু অবাক হয়ে বোনকে দেখে। অবাক হয়ে ভাবে কত দ্রুত একজন মানুষ বদলায়। কত ভাবেই না বদলায়।
বাবুকে এখানকার স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়া হয়েছে। তার কিছুই ভাল লাগে না। ঢাকায় যেতেও ইচ্ছা করে না। মাঝে মাঝে প্রচণ্ড মাথাব্যথা হয়। তখন শুধু মরে যেতে ইচ্ছা করে। মরণের কথা ভাবতে তার বড় ভাল লাগে।
জোবেদ আলি শুকনো মুখে অনেকক্ষণ ধরে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। মাথা অন্য দিনের চেয়েও নিচু করে রেখেছে। মনে হচ্ছে পিঠের কাছে একটা কুঁজ বের হয়েছে। তার হাতে একটা আধখাওয়া সিগারেট। সিগারেট টান দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে থুথু ফেলছে। তার গায়ে হলুদ রঙের চাদর। পরনের পায়জামা ইন্ত্রি করা। তবে গায়ের চাদর বেশ ময়লা।
জলিল মিয়া ব্যাপারটা লক্ষ্য করল। যদি সে তার নিজের দোকান ছাড়া অন্য কিছুই লক্ষ্য করে না। চাদরের হলুদ রঙটাই তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। মনে মনে বলল, দুপুরের এই গরমে গায়ে চাদর কেন? অসুখ-বিসুখ নাকি? অসুখ-বিসুখের কথা মনে হবার কারণ হচ্ছে তার নিজেই আজ জ্বর এবং তার গায়েও হলুদ খন্দরের চাদর। দোকানে তার আসার কোন ইচ্ছাই ছিল না। তবু এসেছে। ক্যাশে বসে ঝিমুচ্ছে। জলিল মিয়া লক্ষ্য করল জোবেদ আলি দুবার তার দোকানের সামনে দিয়ে হেঁটে গেল। মাথা নিচু করেই আড় চোখে তাকাল তার দিকে। লোকটা কী কাউকে খুঁজছে? কাকে খুঁজবে?
খুঁজুক যাকে ইচ্ছা। তোর কি? জলিল মিয়া মাথা ধরার দুটো ট্যাবলেট খেয়ে চোখ বন্ধ করল। কোন কাস্টমার নেই। তিনটার পর থেকে দোকান খাঁ খা করে। এ রকম হলে তো ব্যবসা তুলে ফেলতে হবে। জলিল মিয়া বেশিক্ষণ চোখ বন্ধ করে রাখতে পারল না। একজন এসেছে দশ টাকা ভাংতি নিতে। কৰ্কশ গলায় বলা যেতে পারে।–ভাংতি নাই। কিন্তু বলাটা ঠিক হবে না। এরা হচ্ছে কাস্টমার। এদের সঙ্গে ভদ্র ও বিনয়ী আচরণ করতে হবে। সে দু’টা পাঁচ টাকার নোট দিয়ে তেলতেলে ধরনের হাসি হাসল আর ঠিক তখন দোকানে ঢুকল জোবেদ আলি। চিচি করে বলল, ভাই সাহেব চা হবে?
জলিল মিয়া হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। জ্বর চেপে আসছে। কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। শরীর ভাল থাকলে দু’একটা টুকটাক কথা বলা যেত যেমন–এতদিন এই অঞ্চলে আছেন, আর আজ প্রথম চা খেতে আসলেন ব্যাপার কী ভাই? গায়ে চাদর যে? অসুখ-বিসুখ নাকি? এই দেখেন আমারো একই অবস্থা। নির্ঘাৎ একশ তিন জ্বর। তবু দোকানে আসতে হয়। উপায় কী ভাই বলেন? একটা বিশ্বাসী লোক নাই। সব চোর।
জোবেদ আলি চায়ে দু’টা চুমুক দিয়েই বসে আছে। সিগারেট ধরিয়ে খুঁক-খুক কাশছে। কেমন ভয়পাওয়া চোখে তাকাচ্ছে। জলিল মিয়া নিঃসন্দেহ হল এই লোক চা খেতে আসেনি। অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে। থাকুক উদ্দেশ্য। তার তা দিয়ে কোনো কাজ নেই। সে ব্যবসা করতে এসেছে ব্যবসা করবে। তার বেশি কোন কিছুতেই কাজ কী?
জোবেদ আলি চায়ের দাম দিলা চকচকে একটা এক টাকার নোট দিয়ে। এতে জলিল মিয়ার মনটা খানিকটা ভাল হল। কাস্টামাররা তাদের ছেড়াখুড়া পচা নোটগুলি তাকে দিয়ে পার পায়।
জলিল মিয়া বলল, ভাল আছেন?
জোবেদ আলি আগের মতোই চিঁচিঁ স্বরে বলল, জি ভাল। আপনি বাকের সাহেব কোথায় আছে বলতে পারেন?
জি না।
কোথায় পাওয়া যাবে উনাকে?
জানি না।
জোবেদ আলি খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বলল, খুব দরকার ছিল! যদি বলতে পারেন উপকার হয়।
ইদারিসের ওখানে খোঁজ করেন। ফার্নিচারের দোকান দিয়েছে যে ঐ ইদারিস। দুপুর বেলায় ঐ দোকানের দুতলায় ঘুমায়।
জি আচ্ছা। আপনার এখানে আসবে না?
জানি না। ইনার চলার তো কোন ঠিকাঠিকানা নাই।
খুব দরকার ছিল।
শরীর ভাল থাকলে জলিল মিয়া বলত, কী দরকার? শরীর ভাল নেই বলেই সে কিছু বলল না। তাছাড়া জোবেদ আলি মুখের কাছে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে। অসুস্থ শরীরের কারণে ধুয়া সহ্য হচ্ছে না। নাড়ির ভেতর পাক দিয়ে উঠছে। কিছু বলাও যাচ্ছে না। এরা কাস্টমার ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে হলে এদের খাতির করে চলতে হয়। জোবেদ আলি বলল, আপনার সঙ্গে দেখা হলে একটা খবর দিতে পারবেন?
কি খবর?
জোবেদ আলি বেশ কিছু সময় চুপ করে থেকে বলল, থাক কিছু বলতে হবে না। সে ইদারিসের ফার্নিচারের দোকানো গেল। ইদারিস একটা সোফাসেটে বানিস ঘসছে। সে জোবেদ আলিকে অনেক কথাই বলল, যার সারমর্ম হচ্ছে বাকের ভাই ঘুমুচ্ছে তাকে ডাকা যাবে না। ডাকলে খুব রাগ করবে।
খুব দরকার ছিল ভাই।
দুই ঘণ্টা পরে আসেন–মাত্র ঘুমাইছে।
আমি না হয় বসি?
ইচ্ছা হইলে বসেন।
জোবেদ আলি আধঘণ্টার মত বসল, এর মধ্যে সে পাঁচটা সিগারেট খেয়ে ফেলল। ৬ষ্ঠ সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, এক কাপ চা খেয়ে আসি। এর মধ্যে ঘুম ভাঙলে বলবেন আমার কথা। আমার নাম জোবেদ আলি। উনার সঙ্গে বিশেষ প্রয়োজন।
সন্ধ্যার আগে ঘুম ভাঙবে না। আপনার যেখানে ইচ্ছা যান।
জোবেদ আলি চা খেতে গিয়ে আর ফিরল না। রাত নটার দিকে আবার তাকে দেখা গোল বিভিন্ন জায়গায় বাকেরের খোঁজ করছে। তাঁকে আরো চিন্তিত ও বিষন্ন দেখাচ্ছিল। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও বাকেরের সে কোনো হদিস পেল না।
সন্ধ্যা মেলানোর পর বাকের ঘর থেকে বেরুল। জোবেদ আলি তাকে খোঁজ করছে এই খবরে সে বিশেষ আগ্রহ বোধ করল না। খোঁজ করছে বলেই ব্যস্ত হয়ে ছুটে যেতে হবে নাকি? যার দরকার সে আসবে।
বাকের চা খেতে খেতে ভাবতে লাগল। আজ রাতে করার কিছু আছে কী না। অনেক ভেবেও করার মত কিছু পেল না। মুনার সঙ্গে দেখা করা যেত। কিন্তু মুনা খুব একটা অন্যায় কাজ করছে। বাকেরকে কিছু না বলে তার কোনো এক মামার বাড়িতে গিয়ে উঠেছে। মামার বাড়িটা কোথায় তা অবশ্যি সে জানে। কী দরকার আগ বাড়িয়ে যাওয়ার? যে আমাকে চিনে না। আমিও তাকে চিনি না। মরে গেলেও মুনার বাড়ি সে খোঁজে বের করবে না। তার দায়টা কী?
রাত আটটার দিকে সে ইয়াদের বাসায় গেল। পুরানো বন্ধু-বান্ধব সব একেবারে ছেড়ে দেয়া ঠিক না। খোঁজখবর রাখা দরকার। ইয়াদের বাসার ভোল পাল্টেছে। নতুন রঙ করা হয়েছে। দরজার ওপর কায়দার একটি কলিং বেল। টিপলেই মিউজিক বাজে। বেশ লম্বা-চওড়া মিউজিক। কলিংবেল টেপার সঙ্গে সঙ্গেই ইয়াদ দরজা খুলে দিল। হাসি মুখে বলল, আরো দোস্ত তুই। বাকেরের মনে হল ইয়াদের হাসিটা আসল নয়, মেকি মাল। তাছাড়া ইয়াদ দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। যেন বাকেরকে ভেতর ঢুকতে দিতে রাজি না।
খোঁজখবর নিতে এলাম। আছিস কেমন?
ভাল। আরেক’দিন আয় তোস্ত। আজ একটা ব্যাপার আছে। মানে একটা ঝামেলা।
কি ঝামেলা?
আমার ওয়াইফ বাচ্চার জন্মদিন না কি যেন করছে। শ্বশুর বাড়ির দু’একজনকে বলেছে। মানে…
আমি থাকলে অসুবিধা কি?
মেয়েদের কারবার তোর ভাল লাগবে না।
অপমানিত বোধ করার মত কথা কিন্তু ইয়াদের ফ্যাকাশে মুখ দেখে বাকেরের মজাই লাগছে। ইয়াদ অপ্রস্তুত গলায় বলল, তুই কাল আয় দোস্ত। ভাত খাঁ আমাদের সাথে।
ঠিক আছে আসব।
সন্ধ্যা বেলা চলে আসিস–এক সঙ্গে ছবি দেখবে। ভিসিআর কিনলাম একটা, জি টেন।
ভিসিআরও কিনে ফেলেছিস? বাকি রইল কী?
নিজে কিনি নাই দোস্ত। আমার এক শালা প্রেজেন্ট করেছে। যা মুশকিলে পড়েছি…
মুশকিল কী?
রোজ ছবি আনতে হয়। এমন অভ্যাস হয়েছে দোস্ত–শোয়ার আগে একটা ছবি না দেখলে ভাল লাগে না। বোম্বের লেটেস্ট ছবি সবই পাওয়া যায়। ওদের হলে রিলিজ দেয়ার আগে ঢাকায় চলে আসে।
ভালই তো।
পয়সা যার যায়। সেই বুঝে ভাল কী মন্দ। তিনটা ভিডিও ক্লাবের মেম্বার হয়েছি। পঁচিশ টাকা করে ক্যাসেট। জলের মত টাকা যাচ্ছে রে দোস্ত।
তুই ভেতরে যা। তোর বউ বোধ হয় রেগে যাচ্ছে।
যাচ্ছি। চল তোকে একটা সিগারেট খাওয়াই। ঘরে সিগারেট টোটেলি স্টপড। কোথেকে শুনেছে ক্যানসার মেয়েছেলের কারবার।
ইয়াদ রাস্তা পর্যন্ত এল। দু’টা সিগারেট কিনল। বাকেরকে একটা দিয়ে নিজে একটা ধরাল, ফুর্তির ভঙ্গিতে বলল, কাল তোর জন্যে ছবি এনে রাখব। আন্ধা-কানুন। মারাত্মক।
বাকের বলল, সিগারেট খাচ্ছিস গন্ধে তোর বউ বুঝে ফেলবে?
বাথরুমে ঢুকে হেভি ওয়াসিং দিব কেউ টের পাবে না। বিয়ে করা বড় যন্ত্রণা রে দোস্ত। ভাল কথা ঐ তিন মেয়েওয়ালা বাড়ির ব্যাপারটার খোঁজ পাওয়া গেছে। তুই যা ভাবছিলি তাই। পাক্কা খবর আছে আমার কাছে।
তাই নাকি?
হাই ক্লাস মেয়েছেলে–শুধু মালদার পার্টির জন্যে। রুই-কাতলাদের জিনিস। তবে দোস্ত একটা রিকোয়েস্ট তুই এদের ঘাটাস না। বিপদে পড়বি।
কি বিপদ?
রুই-কাতলা ঘটালে বিপদ হয় না? পাগলামি করবি না। খবরদার। কাল বলব সব কিছু। সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় চলে আসবি।
বাকের ঘড়ি দেখল। মাত্র আটটা দশ। সময় কাটানোই একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বারোটার আগে ঘুম আসে না। বারোটা পর্যন্ত সে করবে কী? মুনার খোঁজে যাওয়াটা খুবই উচিত। মামার কাছে থাকলেও তো মেয়েটা একা। তাছাড়া আপন মামাও নিশ্চয়ই না। আপন মামা হলে ভাগীর খোঁজখবর করত। এর মধ্যে একবারও তো খোঁজ করতে দেখেনি।
এদিকে বকুলদেরও একটা খবর নেয়া দরকার। জহিরের অবস্থাটা কী। এত বড় রুগী গ্রামে নিয়ে ফেলে রেখেছে বেকুবীর চূড়ান্ত করছে। মুনার সঙ্গে কথা বলে আবার ঢাকা আনার ব্যবস্থা করতে হবে। এই কথাটা বলার জন্যেই মুনার কাছে যাওয়া দরকার। অনন্য কিছু না। রাগ করে ঘরে বসে থাকার কোন অর্থ হয় না। রাগ বড় না রুগী বড়?
মুনা খুব সহজ স্বরে বলল, ভেতরে আসুন বাকের ভাই। মুনার গলায় মাফলার জড়ানো। মুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে। চোখ ঈষৎ লাল। বাকের চিন্তিত মুখে বলল, অসুখ নাকি?
হ্যাঁ জ্বর। গতকাল মাত্র কমেছে। এখন আবার শরীর খারাপ লাগছে। আবার জ্বর আসবে কী না কে জানে। এ বাড়িতে এসেই জ্বরে পড়লাম। এই জন্যেই আপনাকে খবর দিতে পারিনি। কিছু মনে করবেন না বাকের ভাই।
আরে কি মুশকিল। মনে করার কি আছে?
এ বাড়ির দোতলার একটা ঘরে মুনা থাকে। মুনা বাকেরকে সরাসরি তার ঘরে নিয়ে গেল। ঘরটা বেশ বড়। মুনার যাবতীয় জিনিসপত্র গাদাগাদি করে রাখা। কিছুই গোছানো নেই। বাকের বিস্মিত হয়ে বলল, এই অবস্থা কেন?
টেম্পোরারি থাকার জন্যে আসা তাই কিছুই গুছাইনি। হোস্টেল টোস্টেল কিছু আমার জন্যে পান কী না দেখবেন তো। অবিবাহিত মেয়েদের একা থাকা যে কি সমস্যা।
হুট করে চলে এলে একটা খবর দিলে না।
মামা জোর করে নিয়ে এল। একা একা একটা বাড়িতে থাকি শুনেই মাথা খারাপের মতো হয়ে গেল। আমার নিজেরও ভয় ভয় লাগিছিল। কাজের মেয়েটা চলে গেল তো। বাকের ভাই আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন বসুন। খাটটায় বসুন। আমি চট করে আসছি।
চা-টা কিছু খাব না কিন্তু।
চা আনছি। আপনাকে বলল কে?
রাড়ি একদম খালি খালি লাগছে। লোকজন নাই।
অনেক লোক। বিয়ের দাওয়াতে গেছে। এগারটার দিকে আসবে।
মুনা নিচে নেমে গেল। বাকের দীর্ঘ সময় একা একা বসে রইল। মেঘ ডাকছে। ঝড়বৃষ্টি শুরু হলে মুশকিল। এতক্ষণ ধরে মুনা নিচে কী করছে কে জানে। একটা সিগারেট খেতে পারলে হত। সিগারেট পকেটে আছে। দেয়াশলাই নেই।
অনেক দেরি করে ফেললাম। তাই না বাকের ভাই?
মুনার হাতে ট্রে। ট্রেতে রাতের খাবার।
এসব কী?
ভাত নিয়ে এসেছি। বসে যান।
আরে কি মুশকিল।
কথা বাড়বেন না তো বসে পড়ুন। আপনার জন্যে আলাদা কিছু করিনি। আমারটাই আপনাকে দিচ্ছি। আমি রাতে কিছু খাব না। জ্বর আসছে।
আবার জ্বর আসছে?
হ্যাঁ আসছে। এই দেখুন কত জ্বর।
মুনা বাকেরকে স্তম্ভিত করে দিয়ে বাকেরের হাত ধরল। সত্যি সত্যি জ্বর এবং অনেক জ্বর। এতটা জ্বর নিয়ে কেউ এমন স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছে কী করে কে জানে।
হাত ধরায় লজ্জা পেলেন নাকি বারেক ভাই?
না লজ্জা পাব কেন? জ্বর দেখাবার জন্যে হাত ধরেছি। অন্য কিছু তো না।
মুনা হাসতে হাসতে বলল, তা ঠিক। ভাত নিয়ে বসুন। আপনাকে কেউ তো আদর করে খাওয়ায় না। আদর করে খাইয়ে দি।
বাকেরের চোখ ভিজে উঠল। সে আতংকে কাঠ হয়ে গেল। টপ করে যদি এক ফোঁটা চোখের পানি পড়ে যায় বড় মুশকিল হবে। মুনা দেখে ফেলবে। আর সে যা মেয়ে এই জিনিস দেখলে
বাকের ভাই!
বল।
আপনি কি আমাকে পছন্দ করেন?
বাকেরের অস্বস্তির সীমা রইল না। এইসব আবার কি ধরনের কথা? জ্বরে কি মেয়েটার মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি? ভাত শেষ করে একজন ডাক্তার নিয়ে আসতে হবে। ডিলে করা ঠিক হবে না।
কথা বলছেন না কেন? আমাকে পছন্দ করেন?
কেন করব না। করি। কতটুকু পছন্দ অল্প না অনেকখানি?
জানি।
আমি কিন্তু আপনাকে পছন্দ করি না বাকের ভাই।
জানি।
আপনি একজন অপদাৰ্থ মানুষ। আকাজের মানুষ।
জানি।
জানেন তো নিজেকে বদলান না কেন?
বাকের জবাব না দিয়ে ভাত মাখতে লাগল। সে এখন বেশ আরাম পাচ্ছে। চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। এ্যাকসিডেন্ট হবার সম্ভাবনা নেই।
নিজেকে বদলান না কেন?
বদলেছি তো।
কিছুই বদলাননি। আগে যেমন এখনো তেমনি আছেন। ভবঘুরের মতো চলাফেরা, গুণ্ডামি, বড় বড় কথা। এইসব ছাডুন তো।
আচ্ছা ছাড়ব।
আর ছাড়বেন। এই জীবনে ছাড়বেন না; বরং এক কাজ করুন খুব ভাল, খুব লক্ষ্মী এ রকম একটা মেয়েকে বিয়ে করে ফেলুন। তাতে কাজ হতে পারে। মেয়েরা মানুষ বদলাতে ওস্তাদ।
বাকেরের খাওয়া শেষ হয়ে গেছে। তবু থালা হাতে বসে আছে। মুনা তার সামনে। কী সুন্দর সরল মুখ অথচ কি কঠিন একটা মেয়ে।
বাকের ভাই।
উঁ।
কয়েকদিন জ্বরে খুব কষ্ট পেয়েছি। জ্বরের সময় মনে হত আমার মতো একলা এই পৃথিবীতে কেউ নেই। খুব কষ্ট হত।
কি যে কাণ্ড তোমার। একটা খবর দিলে চলে আসতাম না? রাত দিন থাকতাম। খবর দিবে না। কিছু না।
জ্বরের সময় আমি আরেকটা জিনিস বুঝতে পারলাম যে আপনাকে আমি খুব পছন্দ করি। আপনার মত বাজে ধরনের একজন মানুষকে এতটা পছন্দ করি ভেবে নিজের ওপর খুব রাগ হচ্ছিল।
রাগ হওয়ার কথা।
তারপর মনে হল আপনার মত ভাল মানুষই বা কজন আছে। আপনি যে একজন ভালমানুষ সেটা কী আপনি জানেন?
কি সব কথাবার্তা তুমি বলছ?
সবদিন কি এইসব কথা বলা যায়? হঠাৎ এক আধাদিন বলতে ইচ্ছা করে। বাকের ভাই আমি খুব একলা হয়ে পড়েছি। আর পারছি না।
মুনার চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। বাকের কি বলবে কিছু বুঝতে পারল না। কী বললে মুনা খুশি হবে? সে যা করতে বলবে তাই করবে। ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়তে বললে লাফিয়ে পড়বে।
ঝড়বৃষ্টি আসবে বাসায় চলে যান। আপনার বাসা তো আবার নেই। কোন একটা দোকানেটোকানে গিয়ে উঠে পড়ুন। ঐ কাঠের দোকানেই তো এখন থাকেন?
হ্যাঁ।
আপনাকে এই রকম আর আমি থাকতে দেব না। সুন্দর একটা একতলা বাড়ি ভাড়া করব। সারাদিন যত ইচ্ছা গুণ্ডামি করবেন। সন্ধ্যার পর ফিরে আসবেন। রাতে দু’জন মুখোমুখি বসে ভাত খাব।
মুনার গলা ধরে এল। কথা শেষ করতে পারল না। বাকের একটা ঘোরের মধ্যে তার ঘরে ফিরে এল। বৃষ্টি হচ্ছিল সে পুরোপুরি ভিজে গেছে। কাদায় পানিতে মাখামাখি। অথচ কিছুই বুঝতে পারছে না। ভেজা কাপড়েই সে তার বিছানায় বসে আছে। ঘোর কাটল রাত তিনটার দিকে।
পুলিশের বাঁশি বাজছে। ওসি সাহেব দরজায় লাথি দিচ্ছেন। পুলিশ কর্কশ গলায় ডাকছেন–বাকের, এই বাকের।
বাকের দরজা খুলতেই তাকে অ্যারেস্ট করা হল। অভিযোগ গুরুতর। জোবেদ আলি খুন হয়েছে। খুন করার দৃশ্য এবং খুনির পালিয়ে যাবার দৃশ্য তিনজন দেখে ফেলেছে। তিনজনই বলছে– খুন করছে বাকের।
বাকেরের এই মামলা দীর্ঘদিন ধরে চলল। ডেটের পর ডেট পড়ে। মামলা পরিচালনা করলেন মুনার সেই পরিচিত উকিল। কখনো তিনি মুনাকে বললেন না যে মামলা টিকবে না। উল্টোটাই বললেন। একবার না। অনেকবার বললেন। বলার সময় প্রতিবারই কিছুটা বিষন্ন হলেন।
ব্যাপারটা কি জানেন, ওরা মামলাটা খুব সুন্দর করে সাজিয়েছে। আমি কোন ফাক ধরতে পারিনি। মোটিভ আছে প্রত্যক্ষদশীর সাক্ষী আছে। মিথ্যা মামলার সাজানোটাই হয় অসাধারণ। এই ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। আমি আপনাকে মিথ্যা কোন আশ্বাস দিতে যাচ্ছি না। মনে হচ্ছে কনভিকশন হয়ে যাবে।
উকিলের মুখ বিষন্ন দেখা যায়।
বিষন্ন দেখায় না। শুধু বাকেরকে। মুনার সঙ্গে তার যতবারই দেখা হয় সে ততবারই বলে, কোনমতে যদি বের হতে পারি তাহলে সিদ্দিক শালাকে পুতে ফেলবে। তবে আমাকে আগেই যদি ঝুলিয়ে দেয় তাহলে তো কিছু করার নেই।
ভয় লাগে না বাকের ভাই। যদি সত্যি সত্যি…
আরে না। ভয় লাগে না।
সত্যি ভয় লাগে না।
রাতের বেলা একটু গা ছমছম করে। রাতের বেলা ফাঁসি দিলে একটা ভয়ের ব্যাপার হত। ফাসিটা তো দিনে দেয়। তাই ভয়টা থাকে না।
পাগলের মত কথাবার্তা বলছেন বাকের ভাই।
পাগলের মতো বলব কেন এটা হচ্ছে ট্রথা। রাতের বেলা মরা খুবই ভয়ংকর। দিনের মৃত্যু কিছু না। সিদ্দিক শালাকে আমি রাতের বেলা মারব। ওয়ার্ড অব অনার।
মামলা চলতে থাকে।
মুনা অপেক্ষা করে।
ক্লান্তির অপেক্ষা। দীর্ঘ দিবস। দীর্ঘ রজনী কিছুতেই যেন মার কাটে না।
আশা ও আনন্দের কথায় ভর্তি করে সুন্দর সুন্দর চিঠি লেখে বকুল। তার ছেলের কথা লেখে, ছেলের দুষ্টামির কথা লেখে, জহির যে ক্রমে ক্রমেই সেরে উঠছে সে কথাও লেখে। সে নিজেও সেরে উঠেছে। সেই কথাও থাকে।
এখন সে আর পুরনো দুঃস্বপ্ন দেখে না। স্বামীর গায়ে হাত রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমায়। তাকে সাবধান করে দিতে অশরীরী কেউ আর আসে না। কত সুন্দর সুন্দর চিঠি কিন্তু মুনার পড়তে ভাল লাগে না।
চিঠি লিখে জাহানার নামের অপরিচিত একটি মেয়ে। অচেনা একজন কিন্তু বড় চেনা একজন। বড় সুন্দর করে সে লেখে–আপা, আমরা দু’জন কিছু কী করতে পারি আপনার জন্যে? আপনার জন্যে ও বড় কষ্ট পচ্ছে। একটা কিছু করার সুযোগ আপনি ওকে দিন। বাকের সাহেবের মামলা যেদিন কোর্টে উঠে ও সেই সব দিনগুলিতে মামুন কোর্টে উপস্থিত থাকে। লজ্জায় আপনার সামনে যেতে পারে না। এক’দিন সে বলল, আপনি নাকি খুব কাঁদছিলেন বলতে বলতে সেও খুব কাদল। আপা, আপনি ওকে কিছু করার সুযোগ দিন।
এই মেয়েটির চিঠি পড়তে তার ভাল লাগে। কিন্তু জবাব দিতে ইচ্ছা করে না। বড় আলস্য লাগে। মাঝে মাঝে এমন ক্লান্তি লাগে যে কোর্টে যেতে পর্যন্ত ইচ্ছা করে না। তবু তাকে যেতে হয়। এক কোণে বসে থেকে সে প্রাণপণে চেষ্টা করে হাই গোপন করতে। কোর্ট থেকে বেরুতে বেরুতে কোন কোন দিন তিনটা সাড়ে তিনটা বেজে যায়। ক্ষিধেয় শরীর কেমন করতে থাকে। কিন্তু কিছু খেতে ইচ্ছা করে না। ঝিম ধরা দুপুরে সে রাস্তায় একা একা হাঁটে।
হাঁটতে হাঁটতেই কোনো কোনো দিন হঠাৎ সুখের কোনো কল্পনা মাথায় চলে আসে যেন সে রিকশা করে যাচ্ছে হঠাৎ পথে বাকেরের সঙ্গে দেখা। বাকের তাকে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে আসছে। উৎসাহ নিয়ে বাকের বলল–যাচ্ছ কোথায়?
মুনা বলল, তা দিয়ে আপনার দরকার কি?
না কোনো দরকার নেই। এমনি জিজ্ঞেস করলাম।
বলতে বলতে বাকেরের মুখ একটু যেন বিষন্ন হয়ে গেল। মুনা বলল, আপনার কোনো কাজ না থাকলে আসুন তো আমার সঙ্গে এক জায়গায় যাব।
বাকের রিকশায় উঠল। আনন্দে তার চোখ ঝিকমিক করছে। বৃষ্টি শুরু হল তখন। তারা হুঁড তুলল না। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে দু’জন এগুচ্ছে। হাওয়ায় মুনার চুল উড়ছে। বাকের বলছে বাতাসটা খুব ফাইন লাগছে তো। বড় ফাইন।
মুনার কোনো কল্পনাই দীর্ঘস্থায়ী হয় না। ঝিম ধরা ক্লান্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে সে ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে। আকাশের রঙ ঘন নীল। সেখানে–সোনালি ডানার চিল চক্রাকারে ওড়ে।

🔴 পরিশিষ্ট: ১৯৮২ সনের ১২ই জুন হত্যাপরাধে বাকেরের প্রাণদণ্ড দেয়া হয়। ১৯৮৩ সনের শেষ দিকে তার মার্সিপিটিশন অগ্রাহ্য হয়।

বাকেরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয় ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে ১৯৮৫ সনের ১২ই জানুয়ারি বুধবার ভাের পাঁচটায় ।

তার ডেডবডি গ্রহণ করবার জন্যে রােগা, লম্বা, শ্যামলা মত যে মেয়েটি ভাের রাত থেকে দাড়িয়ে ছিল তাঁকে জেলার জিজ্ঞেস করেন—

আপনি ডেডবডি নিতে এসেছেন, আপনি মৃতের কে?
মেয়েটি শান্ত গলায় বলল, কেউ না । আমি ওর কেউ না ।

সমাপ্ত
ভালো থাকবেন
বেশি বেশি শেয়ার করবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here