#কোথাও_কেউ_নেই
~হুমায়ুন আহমেদ
৯.
অনেক দিন পর জলিল মিয়ার চায়ের দোকানে বাকের এসে ঢুকল। আগে রোজ সন্ধ্যায় তাদের একটা আড্ডা বসত। তিন-চার বছর ধরে ভাঙন ধরেছে। একজন একজন করে খসে পড়তে শুরু করেছে। আশফাকের মত ছেলেও বিয়ে করে মদন বলে এক জায়গায় পড়ে আছে। শ্বশুরের সঙ্গে নাকি কাঠের বিজনেস করে। এক বছরের ওপর হয়েছে তার কোনো খোঁজ নেই। নিৰ্ঘাৎ বাচ্চা বাধিয়ে ফেলেছে বাই দিস টাইম।
শেষ পর্যন্ত টিকে ছিল ইয়াদ। তারও দিন শেষ। সকাল-বিকাল চাকরি করছে। ব্রিফকেস নিয়ে টু্যরে যাচ্ছে। শালা। পুরোপুরি ভেডুয়া হয়ে গেছে। দেখা হলেই আই.এ. পাস মেয়ের কথা শুরু হয়। নানান ধরনের গল্প। পরশুদিন একটি শুনল এ রকম, ইয়াদ নিউ মাকেটে গিয়ে দেখে তার সেই আই.এ. পাস একজন বান্ধবীকে নিয়ে শাড়ির দোকানে ঘুরছে। তারা যাতে ইয়াদকে চিনতে না পারে সে জন্যে সে চট করে সানগ্লাস পরে ফেলল। কিন্তু মেয়েটি ঠিকই চিনল। কী সব বলল তার বান্ধবীকে। সেই বান্ধবী তার দিকে চোখ ড্যাবি করে তাকাতে লাগল।
অসহ্য। গল্প শুনলেই ইচ্ছা করে একটা চড় বসিয়ে দিতে। ড্যাবি ড্যাবি করে তাকাচ্ছিল। ড্যাব ড্যাবি করে তাকানোর মাল হচ্ছে তুমি। শালা। ফকিরামির জায়গা পায় না।
জলিল মিয়ার চায়ের সন্টলে ইয়াদ বসে ছিল। তার গায়ে কালো কোট। গলায় লাল রঙের টাই। ক্লিন শেভড। মুখে ক্রিম ঘষেছে বোধ হয়। ভুরতুর করে গন্ধ বেরুছে। বাকেরকে দেখে সে হকচাকিয়ে গেল। বাকের অবহেলার ভঙ্গিতে বলল, তুই এখানে।
আসলাম। দেখা-সাক্ষাৎ হয় না।
সাজ-পোশাক তো মাশাআল্লাহ ভালই চড়িয়েছিস।
আর বলিস কেন। ওদের বাড়ি থেকে আমাকে দেখতে আসবে। ওর এক দূর সম্পর্কের চাচারও আসার কথা। এক্স মিনিস্টার এল রহমান।
দেখতে আসবে তো তুই এখানে কেন? চায়ের দোকানে দেখতে আসবে নাকি?
বাসায় তো আর সেজোগুজে বসে থাকা যায় না। মনে করবে। ইচ্ছে করে সেজে বসে আছি। ওরা এলে রঞ্জু এসে এখান থেকে ডেকে নিয়ে যাবে। ভাবটা এ রকম যেন বাইরে ছিলাম, বাসায় এসেছি।
বাকের চায়ের অর্ডার দিল। ইয়াদের কোনোদিকে দৃষ্টি নেই। সে ঘন ঘন ঘড়ি দেখছে। পাঁচ মিনিটের মাথায় তিনবার বলল, এত দেরি হওয়ার তো কথা না। এসে গেছে নাকি? বলে এসেছি জলিলের চায়ের দোকানে খোঁজ করতে। কোথায় না কোথায় খুঁজছে কে জানে। রঞ্জু হারামজাদা মহা বেকুব।
উত্তেজনায় ইয়াদ একটা ফাইভ ফাইভ সিগারেট উল্টোদিকে ধরিয়ে ফেলল। বাকের দেখেও কিছু বলল না। ফিল্টারের ধোঁয়া খেয়ে কেশে মরুক। বাকের উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রাস্তার দিকে। জলিল মিয়া বলল, বাকের ভাইকে নতুন পাত্তি দিয়া আর এক কাপ চা দেই?
না চা লাগবে না।
খান বাকের ভাই। চা এক কাপ যা দশ কাপ ও তা।
বাকের কিছু বলল না। জলিল মিয়া টেনে টেনে বলল, তারপর দেশের খবরাখবর কিছু বলেন।
বাকের বিরক্তমুখে তাকাল। জলিল মিয়ার স্টলে রাজনৈতিক আলাপ নিষিদ্ধ। দুই-তিন জায়গায় এই কথাগুলো ফ্রেম করে বাধানো, কিন্তু রাজনীতিতে জলিল মিয়ার নিজের খুব উৎসাহ। সে মনেপ্ৰাণে বিশ্বাস করে মাশলি ল ছাড়া এই দেশের কোনো উপায় নেই। কিন্তু এই কথাটা নিজে বলতে পারে না, অন্যের মুখে শুনতে চায়।
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি কেমন হইছে দেখছেন বাকের ভাই। সিভিল গভৰ্মেন্টের ক্ষমতা নাই ঠিক করার। সে পরিস্থিতি ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করা ছাড়া উপায় নাই।
বাকের তিক্ত স্বরে বলল, উপায় না থাকলে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে দিলেই হয়! পায়ে ধরে কেউ সাধছে?
জলিল মিয়া খুব অপ্রস্তুত হয়। বাকেরের বিরক্তির কারণ ঠিক বুঝতে পারে না। সে কাউকে বিরক্ত করতে চায় না। বাকেরের কাউকে তো নয়ই।
ইয়াদ বলল, কটা বাজে দেখ তো বাকের। শালা এত দেরি করছে কেন? বাকের কোনো উত্তর না দিয়ে উঠে দাঁড়াল। গম্ভীর মুখে বলল, যাই। ইয়াদ বলল, এত সকাল সকাল যাচ্ছিস কোথায়? বাস না। শালা এ তো দারুণ টেনশনের মধ্যে পড়লাম।
কাজে আছে।
তোর আবার কী কাজ?
খুব-একটা খারাপ কথা বাকেরের মুখে এসে গিয়েছিল। সে সেটা বলল না। ইয়াদ হারামজাদাটার সঙ্গে মুখ খারাপ করে কোনো ফয়াদা নেই।
রাস্তা অন্ধকার। সব কটি লাইটপোস্টের বাতি আবার চুরি হয়েছে। এই এক সপ্তাহের মধ্যে দুইবার বাতি চুরি গেল। চোরের উপদ্রবটা বড় বেশি হচ্ছে। বাকেরের ধারণা কাজটা করে মিউনিসিপ্যালিটির লোকেরা। মই ফিট করে কোন চোর যাবে বালু চুরি করতে? ধরতে হবে একবার শালদের। মামদোবাজি বের করে দিতে হবে।
বাকের দেয়াশলাই বের করে ঘড়ি দেখল, ঘড়ি ঠিকই চলছে। আটটা পঁয়ত্ৰিশ। এত সকাল সকাল বাড়ি গিয়ে হবেটা কী? লাভের মধ্যে লাভ হবে বড় ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। এবং লাটসাহেব বড় ভাই মুখটাকে এমন করবে যেন ভূত দেখছে। বড় অফিসার এদের মেজাজ-মর্জিই অন্য রকম।
রাত এগারটার পর বাড়িতে যাওয়ার অনেক সুবিধা। কারো সঙ্গেই দেখা হয় না। খাবার ঢাকা দেয়া থাকে। খেয়েদেয়ে লম্বা হয়ে পড়লেই সব সমস্যার সমাধান।
সকাল দশটার দিকে ঘর থেকে বেরুলে বড় ভাইয়ের সঙ্গে দেখা না করে দিন পার করে দেয়া যায়। অবশ্যি ভাবীর সঙ্গে দেখা হয়। সূর্যের চেয়ে বালির উত্তাপ বেশি, সেই কারণেই ভাবীর মেজাজ থাকে আকাশে। তিনি সহজ ভাবে বাকেরের সঙ্গে কোনো কথাই বলতে পারেন না। যাও বলেন এমন সব ভাষা ব্যবহার করেন যে বাকেরের প্রতিদিনই একবার বাড়ি ছেড়ে যেতে ইচ্ছা! করে। সেই ইচ্ছা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। কারণ বাকের মেয়েমানুষের কথার কখনোই তেমন কোনো গুরুত্ব দেয় না। মেয়ে মানুষের কাজই হচ্ছে বেশি কথা বলা এবং ফালতু কথা বলা। ফালতু কথাকে এমন গুরুত্ব দিলে চলে?
বাকের সিগারেট ধরাল। প্যাকেটে আর তিনটা সিগারেট আছে, রাত কাটবে না। ঘুম ভাঙলেই তার সিগারেটের তৃষ্ণা হয়। কিন্তু এখন আবার হেঁটে হেঁটে মোড় পর্যন্ত যেতে ইচ্ছা করছে না।
ফজলু সাহেবের বাসার সামনে একটা ছোটখাটো ভিড়। বাকের এগিয়ে গেল। বাড়ির ভেতর থেকে মেয়েলি গলায় কান্নার শব্দ।
কী হয়েছে?
কী হয়েছে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। ফজলু সাহেবের পোয়াতী স্ত্রী নাকি খাট থেকে পড়ে গিয়েছে। ফজলু সাহেব গিয়েছেন অ্যাম্বুলেন্স আনতে। বাকেরের বিরক্তির সীমা রইল না। ধামসী এক মহিলা খাট থেকে পড়ে যাবে কেন? কচি খুকু তো না। অ্যাম্বুলেন্স আনতে গেছে মানে? আনতে গেলেই অ্যাম্বুলেন্স চলে আসে নাকি? চলে এলে তো কাজই হত। হাসপাতালে সত্যি সত্যি নিতে হলে হাতের কাছে যা পাওয়া যায় তাতে করেই নিতে হবে।
বাকের ছুটিল বেবিটেক্সি ধরে আনতে। এই বেবিটেক্সিতেই টিনার যমজ ছেলে হল।
বাকের দাঁতে দাঁত চেপে মনে মনে বলল, বেকুব মেয়েছেলেদের নিয়ে মুসিবত।
বাচ্চা কার মত হয়েছে বকুল? আমার মত না তো ভাইয়ের মত?
কারো মতই না।
বকুল উজ্জ্বল চোখে তাকিয়ে রইল টিনার দিকে। টিনা ভাবী কেমন অন্য রকম হয়ে গেছে। কী চমৎকার মায়া মায়া চেহারা হয়েছে টিনা ভাবীর।
দু’জনকে সামলাবে কী ভাবে?
টিনা হাসতে হাসতে বলল, একটাকে তুই নিয়ে যা। অরুণকে নিয়ে যা। অরুণ বড্ড জ্বালায়।
অরুণ কোনটি?
বাঁ পাশেরটি।
দু’জনই তো এক রকম।
দূর-দূর এক রকম হবে কেন? চেহারা দুরকম, কাঁদে দুরকম করে। ওদের গায়ের গন্ধও দুরকম।
কী যে তুমি বল ভাবী।
ঠিকই বলি। নে তুই অরুণকে নিয়ে যা।
সত্যি সত্যি। কিন্তু নিয়ে যাব।
নিয়ে যাবার জন্যেই তো বললাম। তুই কী ভাবছিস ঠাট্টা করছি?
বকুল খুব সাবধানে একজনকে কোলে তুলল! কী চমৎকার একটা ঘ্রাণ আসছে গা থেকে। বাসি শিউলী ফুলের ঘ্রাণ এত মায়া লাগে কেন? বকুলের চোখে পানি আসার উপক্রম হল।
তোর ভাই যমজ বাচ্চা হওয়া উপলক্ষে আমাকে যমজ শাড়ি দিয়েছে। বাচ্চা-কাচ্চা হলে বউকে শাড়ি দিতে হয় জানিস তো?
না। জানি না।
দিতে হয়। কষ্ট করে বাচ্চা আনে। সেই জন্যে দেয়া। দেখ তো শাড়ি দুটো কেমন।
দু’টি একই রকম শাড়ি। নীল জমিনের ওপর সাদা ফুল।
খুব সুন্দর ভাবী, তোমাকে দারুণ মানাবে।
একটা শাড়ি তুই নিবি?
বকুল বিব্রত স্বরে বলল, আমি নেব কেন? কষ্ট করবে তুমি, শাড়ি নেব আমি?
দুটাই তো আর নিচ্ছিস না। একটা নিচ্ছিস।
না ভাবী প্লিজ।
না নিলে আমি খুব রাগ করব, ক’দিন কথা বলব না তোর সাথে। তোকে দেবার জন্যেই তোর ভাইকে বলে আমি দু’টি শাড়ি আনিয়েছি। শুধু শাড়ি না, ব্লাউজ-পেটিকোট সবই আছে। যা, কাপড় বদলে আয়।
বকুলকে শাড়ি পরে আসতে হল। টিনা দীর্ঘ সময় তার দিকে তাকিয়ে বলল, এখন যা ঐ ডাক্তারের চেম্বারে গিয়ে পেপসি খেয়ে আয়।
বকুলের মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেল। টিনা বিরক্ত স্বরে বলল তুই কী ভাবছিস কেউ কিছু টের পায় না। সবাই সব কিছু টের পায়। তোর ভাইয়ের কাছে শুনলাম। সে দেখেছে তুই ঐ ডাক্তার ছোকরার সঙ্গে বসে কোক না পেপসি কি যেন খাচ্ছিস, আর খুব হাত নেড়ে নেড়ে গল্প করছিস।
বকুলের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। এসব কি বলছে ভাবী। কিন্তু টিনা খুব স্বাভাবিক। বাচ্চার নাভিতে বরিক পাউডার দিতে দিতে বলল, কিছু মানুষই আছে যারা শুধু অল্প বয়সী মেয়েদের সঙ্গে ছোক ছোক করতে চায়। প্রথমে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে, তারপর গায়ে-টায়ে হাত দেয়।
কি যে তুমি বল ভাবী।
ঠিকই বলি। ঘাস খেয়ে তো বড় হইনি।
তুমি যা ভাবিছ সে সব কিছু না।
প্রথম প্রথম এ রকম মনে হবে। তারপর দেখবি এক’দিন হঠাৎ হাতের সঙ্গে হাত লেগে যাবে। যেন একটা অ্যাকসিডেন্ট। তারপর এক’দিন আশপাশে লোকজন না থাকলে জড়িয়ে ধরবে। চুমু খাবে।
কি যা তা বলছ?
ঠিকই বলছি। না জেনে বলছি?
ওনার সম্পকে এরকম বলাটা ঠিক না। সব মানুষ তো এক রকম নয়।
সব মানুষই এক রকম। সবারই দুটো করে চোখ, দুটো কান, একটা নাক। খবরদার আর কোনুন। এখানে যাবি না। দরকার হয় সে আসবে, তুই নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরারি।
ছিঃ।
এত ছিঃ করতে হবে না। যা বলছি মনে রাখিস।
খুব মন খারাপ করে বাড়ি ফিরল বকুল। নতুন শাড়ি পরে রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসতে কেন জানি তার লজ্জা করছিল। ফার্মেসির পাশ দিয়ে আসবার সময় খুব ইচ্ছা হল একবার তাকিয়ে দেখে ডাক্তার আছেন কি না। কিন্তু কিছুতেই তাকাতে পারল না। তার কেন জানি মনে হল ডাক্তার সাহেব আছেন এবং তিনি তাকে দেখছেন অবাক হয়ে। এক্ষুণি বেরিয়ে এসে ডাকবেন–এই বকুল, এইভাবে পালিয়ে যাচ্ছ কেন?
কিন্তু কেউ ডাকল না। কেউ ডাকেনি শুধুমাত্র এই কষ্টেই তার চোখ ভিজে উঠছিল। কেন তার এ রকম হচ্ছে? এটা কি কোন অসুখী? না অন্য কিছু?
শওকত সাহেব সুন্দর শাড়ি পরা এই মেয়েটিকে কাঁদতে দেখে থমকে দাঁড়িয়েছিলেন। এটি তারই মেয়ে এটা বুঝতে সময় লাগল।
বকুল মা, কাঁদছিস কেন?
কাঁদছি না। কাদর কেন শুধু শুধু।
বকুল তাকে পেছনে ফেলে তার তার করে এগিয়ে গেল। শওকত সাহেব অনেকক্ষণ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে রইলেন একই জায়গায়। তার মেয়েটি এত বড় হয়ে গেছে। এটি কেন এতদিনেও তার চোখে পড়েনি?
কাঁদছিস কেন? পাড়ার ছেলেরা কিছু বলেছে? মেয়েটির জন্যে তার নিজের মন কেমন করতে লাগল। এদেরকে অসহায় ফেলে রেখে দীর্ঘ দিনের জন্যে তাকে জেলে ঢুকে পড়তে হবে। উকিল সাহেব যদিও বলছেন কিছুই হবে না, কিন্তু তিনি জানেন ব্যাটা মিথ্যা কথা বলছে। উকিলরা সত্যি কথা বলতে পারে না।
শওকত সাহেব মাথা নিচু করে বুড়ো মানুষের মত হাঁটতে লাগলেন।
মামলার আবার একটি ডেট পড়েছে। এ রকম কি অনন্তকাল ধরেই চলতে থাকবে? উকিল সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, একেকটা মামলা চার-পাঁচ বছর ধরে ঝোলে। ঝোলাটাই ভাল। যত ঝোলে, মামলা তত দুর্বল হতে থাকে। সামনের মাসে আসেন দেখা যাবে।
শওকত সাহেবকে বেশ খুশি খুশি মনে হয়। তিনি যেন সমস্ত ব্যাপারটাকেই এড়াতে চাইছেন। তাঁর মুখ দেখে মনে হচ্ছে বুক থেকে পাষাণ ভার নেমে গেছে। তিনি উল্লসিত কণ্ঠে বললেন, চল রে মুনা বাড়ি যাই।
আমি যাব না, তুমি যাও। বাকের ভাইকে নিয়ে যাও।
তুই এখন কি করবি?
অফিসে যাব।
তিনটার সময় অফিসে গিয়ে কি কারবি?
আমার কাজ আছে।
কি কাজ?
আছে একটা কাজ। রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে ঘ্যান ঘ্যান করতে পারব না।
মুনা রিকশায় উঠে বসল। অফিসে পৌঁছতে পৌঁছতে সাড়ে তিনটা বেজে গেল। লোকজন বেশির ভাগই বাড়ি চলে গেছে। যারা যায়নি তারা টেবিলপত্র গুছিয়ে ফেলছে। পাল বাবু ছিলেন। তিনি হাসি মুখে বললেন, আপনার কাজ হয়েছে। লোন স্যাংশন হয়েছে। ঘণ্টাখানেক আগে এলে চেক পেয়ে যেতেন। অবশ্যি আজ পাওয়া আর কাল পাওয়া সোম। এখন তো আর ভাঙাতে পারছেন না।
এটা একটা ভাল খবর। টাকাটা পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু মুনা খুশি হতে পারছে না। টাকা খরচ হচ্ছে জলের মত। সামলানো যাচ্ছে না। রিকশা ভাড়াতেই অনেকগুলি টাকা চলে যাচ্ছে। সামনে কি অবস্থা হবে কে জানে। পাল বাবু বললেন, বিয়ে উপলক্ষে লোন নিলেন নাকি?
না।
না কেন? ঐ ঝামেলাটা চুকিয়ে ফেলুন।
দেখি।
উঠছেন নাকি? কোন দিকে যাবেন? আসুন। এগিয়ে দেই! এই টাইমে রিকশা পাওয়া মুশকিল।
কোথায় যাবে মুনা মনস্থির করতে পারল না। বাসায় ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না। মামুনের খোঁজে যাওয়াও অর্থহীন। সে নিশ্চয়ই ফেরেনি। আর ফিরলেই কি। যে লোক দীর্ঘ দেড় মাস কোনো রকম খবর না দিয়ে ডুব দিয়ে থাকতে পারে তার কাছে বার বার যাওয়ার কোনো কারণ আছে কি? তারেকের বাসার ঠিকানা জানলে সেখানে যাওয়া যেত। দেখা যেত কেমন মেয়ে বিয়ে করেছে। কিন্তু ওর ঠিকানা জানা নেই। কাঁচা বাজারের দিকে গেলে কেমন হয়, বেশ কিছুদিন ধরে বাজার হচ্ছে না। ডাল ভাত আর ডিম খেতে খেমে অরুচি ধরে গেছে। মুনা ব্যাগ খুলে টাকা গুণল। বাজার করার মত টাকা নেই। তার মানে এই দাঁড়াচ্ছে তার কোথাও যাবার জায়গা নেই। মুনা একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল।
দরজায় খুটাখুটি শব্দ হচ্ছে। মামুন অবেলায় ঘুমিয়ে ছিল। শীত্বের শুরুতে বিকেল বেলার ঘুম অন্য রকম একটা আলস্য এনে দেয় শরীরে। বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছা করে না।
কে?
আমি–আমি মুনা।
মামুন দরজা খুলে বিব্রত ভঙ্গিতে তাকাল। মুনার চোখ-মুখ কঠিন। দেখেই বোঝা যাচ্ছে রোগে আছে।
এস, ভেতরে এস। কেমন আছ বল?
মুনা শুকনো গলায় বলল, এসেছ কবে?
গতকাল। আজ ঠিক করে রেখেছিলাম যাব তোমার ওখানে। ভালই হয়েছে। দেখা হল। রোগা হয়ে গেছ মুনা।
মুনা চুপ করে রইল। মামুন বলল, বুঝতে পারছি খুব রেগে আছ।
রাগব কেন?
এই যে ডুব দিলাম দেড় মাস। এদিকে তোমার এমন দুঃসময়।
আমার দুঃসময়ের সাথে তোমার কি সম্পার্ক? আমি কি তোমাকে বলেছি আমার দুঃসময়ে আমার হাত ধরে বসে থাকতে?
জাস্ট এ মিনিট। আমি মুখ ধুয়ে চায়ের কথাটা বলে আসি। তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।
মুনা লক্ষ্য করল মামুন বেশ সহজ স্বাভাবিক। দীর্ঘ দিন যে ডুব মেরে ছিল তার জন্যে তার বিন্দুমাত্র লজ্জা বোধ নেই। যেন এটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া তার স্বাস্থ্যও ভাল হয়েছে। দেখেই মনে হয় সে সুখেই ছিল। সুখী সুখী চেহারা।
শুধু চা নয়। চায়ের সঙ্গে পিয়াজু এবং বেগুনী। মামুন খুব উৎসাহের সঙ্গে খেতে শুরু করল। মুনা বলল, এত দিন যে ডুব দিয়েছিলে চাকরির অসুবিধা হয়নি?র
আরে দূর চাকরি। মাস্টারি করে কিছু হয় নাকি? চাকরি ছেড়ে দিয়েছি।
ছেড়ে দিয়েছি মানে?
ছেড়ে দিয়েছি মানে ছেড়ে দিয়েছি। চাকরি করব না। ব্যবসা করব। গ্রামের বাড়িতে একটা অয়েল মিল দিচ্ছি। লোনের জন্যে অ্যাপ্লাই করব। সরিষা ভেঙে তেল করা হবে। ধান, গম, মসলা, সব ভাঙানো যাবে।
এই সব নিয়েই ব্যস্ত ছিলে?
রাইট। লোনও পেয়ে যাব।
থাকতে পারবে গ্রামের বাড়িতে?
পারব না কেন? ফাইন বাড়ি আমাদের। তুমি দেখলে মুগ্ধ হবে।
মুনা লক্ষ্য করল মামুন একবারও জিজ্ঞেস করছে না, তোমাদের খবর কি? তোমাদের মামলার কি অবস্থা? মুনা উঠে দাঁড়াল, আমি যাই। সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে।
মামুন হাত ধরে তাকে টেনে বসাল। অবাক হয়ে বলল, সন্ধ্যা হয়েছে তো কি হয়েছে, আমি আছি কি জন্যে? বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসব। এবং রাতে খাব তোমাদের ওখানে। বুঝতে পারছি তুমি রাগ করে আছে আমার ওপর। রাগ ভাঙানোর সুযোগ দাও। না তাও দেবে না।
চুপ করে ছিলে কেন?
নতুন এই আইডিয়া নিয়ে খুব জড়িয়ে পড়লাম। এবং ইচ্ছা করেই তোমাকে কোনো খবর দিলাম না। কারণটা হচ্ছে। আমি ভেবেছিলাম কোনো খবরাখবর না পেয়ে তুমি অস্থির হয়ে বাড়িতে এসে উপস্থিত হবে এবং সব কিছু দেখে মুগ্ধ হয়ে যাবে। তখন আমি বলব, না। আর ফিরে যেতে পারবে না। তোমাদের ঝামেলার কথা আমার তেমন করে মনে হয়নি। আই অ্যাম সরি। রাগ করেছ মুনা?
বলেছি তো আমি রাগ করিনি। আমি সহজে রাগ কবি না।
এই বার আমি তোমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাব। একদিনের জন্যে হলেও নিয়ে যাব। তোমার খারাপ লাগবে না, ভালই লাগবে। বাড়ি দেখেও তুমি মুগ্ধ হবে। বাড়ির সামনে বাগান করেছি। ওনলি ফর ইউ মাই ইয়ং লেড়ি। চল ওঠা যাক। বাইরে কোথাও খাব।
না।
চল না, প্লিজ। ফ্রায়েড স্পিং চিকেন। চিলি বিফ। এন্ড সুইট এন্ড সাওয়ার প্রন।
মামুন কাপড় পরতে শুরু করল। সে ধরেই নিয়েছে মুনা যাবে তার সঙ্গে। মুনা তার উল্লাসের কারণটা ঠিক ধরতে পারছে না।
তোমাদের মামলার কি অবস্থা?
ভালই।
ভালই মানে কি? উকিল ভাল দিয়েছ তো?
মুনা জবাব দিল না।
উকিল ভাল হলে খালাস করে নিয়ে আসবে, গায়ে আঁচড়ও লাগবে না। সিরিয়াস সিরিয়াস সব খুনিদের বের করে নিয়ে আসছে। এই দেশে অপরাধীদের সাজা হয় না।
মুনা শীতল স্বরে বলল, আমি কিন্তু তোমার সঙ্গে যাচ্ছি না।
কেন?
ইচ্ছা করছে না? আমার অনেক রকম সমস্যা আছে, এখন আমি তোমার সঙ্গে বসে। ফ্রায়েড চিকেন খেতে পারব না।
ফ্রায়েড চিকেন না খেলে অন্য কিছু খাওয়া যাবে।
আমি বাসায় যাব, মাথা ধরেছে।
রিকশায় দুজনের কোনো কথা হল না। মামুন দু’একবার কথা শুরু করতে চেষ্টা করল, লাভ হল না কিছু।
মাথা খুব বেশি ধরেছে নাকি?
হুঁ।
আমার সঙ্গে গ্রামে গিয়ে থাকতে তোমার অসুবিধা হবে না তো? মুনা জবাব দিল না।
প্রথম কিছুদিন ফাঁকা ফাঁকা লাগবে, তারপর দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে। কি, কিছু বলছ না কেন?
বললাম তো মাথা ধরেছে। মুনা গলির মাথায় নেমে পড়ল। সহজ ভাবেই বলল, থাক তোমাকে আসতে হবে না। আমি নিজে নিজেই যেতে পারব। রাস্তার আলো আছে।
আমি সঙ্গে এলে অসুবিধা আছে?
আছে। তুমি এলেই তোমার সঙ্গে বসতে হবে, কথা বলতে হবে। রাতে খাবার দিতে হবে। আমার এখন এসব করতে ইচ্ছা করছে না। মাথা ধরেছে খুব।
তোমার সঙ্গে আমার অনেক পরামর্শ আছে মুনা।
পরামর্শ পরে করা যাবে। সময় তো ফুরিয়ে যাচ্ছে না।
মুনা লম্বা লম্বা পা ফেলে এগুতে লাগল। মামুন তাকিয়ে রইল অবাক হয়ে।
চলবে…