কোথাও_কেউ_নেই হুমায়ুন আহমেদ ১০.

#কোথাও_কেউ_নেই
হুমায়ুন আহমেদ

১০.
লতিফা ছটফট করছিলেন সন্ধ্যা থেকেই–মুনা এসেছে? মুনা এসেছে? বকুল বিরক্ত হয়ে বলেছে এলে তো তোমাকে বলতাম মা। একশো বার এক কথা বলছ কেন?
আজ সমস্ত দিন লতিফার শরীর খারাপ গেছে। দুপুরে একবার বিছানা থেকে নামতে গিয়ে মাথা ঘুরে উঠল। শরীরটা একেবারেই গেছে। দুপুরে কিছুই খেতে পারেননি। বমি করে উগড়ে ফেলেছেন। সন্ধ্যাবেলা তার বুক কাঁপতে লাগল। পুরনো শ্বাস কষ্ট নয়, অন্য এক ধরনের কষ্ট। তাঁর ভয় করতে লাগল। তিনি চাপা স্বরে কয়েকবার বাবুকে ডাকলেন। কেউ এল না। হয়ত শুনতে পায়নি। কিংবা শুনেও আসছে না। আজকাল সহজে তার কাছে কেউ আসে না।
এক সময় সখিনা এসে ঘর ঝাঁট দিতে শুরু করল। কি অলক্ষুণে ব্যাপার। সন্ধ্যাবেলা কেউ গৃহস্থ বাড়িতে বাট দেয়? তিনি অনেকক্ষণ উঁচু গলায় বকাঝকা করলেন। তার বুকের ধরফরানি আরো বেড়ে গেল। এক সময় মনে হল ঘরের আলো অস্বাভাবিক উজ্জ্বল। চোখে বিধছে। অনেক রাতের দিকে মাঝে মাঝে এ রকম হয়। আলো হঠাৎ কিছুক্ষণের জন্য বেড়ে যায়। তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন মুনার জন্যে। মিনিটে একবার করে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, দেখ তো মুনা এসেছে নাকি?
মুনা এসে তার অবস্থা দেখে বড়ই অবাক হল। হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। ব্যাপার কী? মুনা উদ্বিগ্ন স্বরে বলল, মামা ফেরেননি?
বাবু বলল–ফিরেছিলেন, আবার কোথায় যেন গেছেন।
মামি কি রকম করছে তোরা দেখছিস না? যা দৌড়ে ডাক্তার নিয়ে আয়।
লতিফা হাঁপাতে শুরু করলেন। ঘরের আলো এত উজ্জ্বল যে চোখ মেলে রাখা যাচ্ছে না।
মামি খুব খারাপ লাগছে?
হুঁ। তুই আমার হাত ধরে বসে থাক।
মুন্না হাত ধরে পাশে বসল। বকুল অবাক হয়ে দূরে দাঁড়িয়ে আছে, লতিফা তাকালেন বকুলের দিকে। কি সুন্দর একটি মেয়ে, কে বলবে তার মত অতি সাধারণ একটি মায়ের কোলে এত সুন্দর একটি শিশু আসবে।
মুনা বলল, দাঁড়িয়ে দেখছিস কি? একটা ন্যাকড়া ভিজিয়ে এনে কপাল মুছিয়ে দে। বকুল ছুটে গেল রান্নাঘরে। লতিফা হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, যত তাড়াতাড়ি পারিস বকুলের বিয়ে দিয়ে দিবি। এত সুন্দর মেয়ে ঘরে বেশিদিন রাখবি না। অনেক সমস্যা হবে।
ঠিক আছে দেব।
পড়াশোনা কপালে থাকলে হবে, না থাকলে হবে না। তুই ওর বিয়ে দিয়ে দিবি। যত তাড়াতাড়ি পারিস।
বিয়ে দিলেই সব সমস্যা সমাধান হয় নাকি মামি?
লতিফা কিছু বললেন না। বকুল মাথায় ভেজা ন্যাকড়া বুলোতে লাগল। তিনি কাঁপা গলায় বললেন–আহ ঠাণ্ডা লাগে।
ডাক্তার এল সাড়ে সাতটায়। তারও ঘণ্টা তিনেক পরে দীর্ঘ ছবছরের রোগ যন্ত্রণার অবসান হল। ডাক্তার ছেলেটি বড় অবাক হল। সে এমন ভাবে সবার দিকে তাকাতে লাগল যেন ঘটনাটি সে নিজেও বিশ্বাস করতে পারছে না। তার হাতে এটিই কি প্রথম মৃত্যু?
কিছু কিছু ঘটনা মানুষ দ্রুত ভুলে যেতে চেষ্টা করে। সেই চেষ্টা সচেতন ভাবেই করা হয় এবং সে কারণেই সে লজ্জিতও বোধ করে। মৃত্যু এমন একটি ঘটনা। অতি প্রিয়জনের মনে হয় না সেই প্রিয়জন কোনো কালে আমাদের মধ্যে ছিল। কেন এ রকম করা হয়? আমাদের নিজেদেব ব্যবহারে নিজেরাই অবশ্য লজ্জিত হই, যার জন্যে প্ৰিয়জনটির একটি বড় ছবি যত্ন করে দেয়ালে টাঙানো হয়। এবং এক’দিন কেউ খুব রাগারগি করে ফ্রেমে মাকড়শার জাল, কেউ দেখছে না, ধ্যাপারটা কি?
লতিফার মৃত্যুর পর তার কোনো ছবি দেয়ালে টাঙানো হল না। তবে তার বিয়ের একটি ছবি মুনা বের করে খুব কাদাল। সেই ছবিতে তাকে দেখাচ্ছিল একটি দুষ্ট বালিকার মত। শওকত সাহেবের চোখে চশমা। কেমন ভয় পাওয়া চেহারা। ছবিটি স্টুডিওতে তোলা। সন্ট্রডিওতে তোলা সব ছবিই কেমন মূর্তি মূর্তি হয়। এই ছবিটি সে রকম নয়। প্রাণের একটা ব্যাপার আছে কোথাও। কিংবা এও হতে পারে মানুষের মৃত্যুর পর তাদের সব ছবিতে কিছু প্ৰাণ সঞ্চার হয়।
লতিফার ঘর আগের মতই আছে। মৃত মানুষদে বা ঘর দীর্ঘদিন একই রকম থাকে। সহজে সে ঘরের কোনো কিছুতে কেউ হাত দিতে চায় না। তবু ঘবটা কেমন যেন আগেবা মত থাকে না! সূক্ষ্ম। একটা পরিবর্তন হয় কোথাও। সে পরিবর্তন সূক্ষ্মণ হলেও যে-কেউ ধরতে পারে।
প্রথম রাত এই ঘরে ঘুমুতে এসে শওকত সাহেবের ভয় ভাগ করতে লাগল। লতিফার স্মৃতির প্রতি সম্মান দেখানোর জন্যেই তিনি প্রাণপণ চেষ্টা করলেন পুবনো দিনের কথা মনে করতে। সমস্তই মনে আছে কিন্তু সে সব নিয়ে ভাবতে ভাল লাগছে না; বরং শওকত সাহেবের মনে হতে লাগল। এই ঘবে কে যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে। খুব সাবধানে পা ফেলছে। নিঃশব্দ পদচারণা! এইবার যেন বসল পাশের চেয়ারটায়। ভয় কাটাবার জন্যে তিনি শব্দ করে কাশলেন। সেই কাশির শব্দে তার নিজেরই ভয় বেড়ে গেল। তিনি চোখ বন্ধ করে ঘুমুতে চেষ্টা করলেন। তখনি মনে হল মাথার উপরের ফ্যান ঘুরতে শুরু করেছে। লতিফা শীতের ব্যাতে ও ফ্যান না ছেড়ে ঘুমুতে পালিত না। সেই জন্যেই কি? ঘর অন্ধকার, তবুও সব কিছু আবছা আবছা দেখা যায়। তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ফানটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। হা ফ্যান ঘুরছে। শওকত সাহেবের নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এল। তিনি চোখ বন্ধ করে পড়ে রইলেন এবং স্পষ্ট শুনলেন মশারিব ওপাশে কেউ যেন মিষ্টি করে হাসল; প্রথম যৌবনে লতিফা যেমন হাসত। শওকত সাহেব ভাঙা গলায় ডাকলেন, মুনা মুনা।
মুনা সম্ভবত বারান্দায় বসে ছিল সে এসে দরজায ধাক্কা দিল, কি হয়েছে মামা? শওকত সাহেব কাঁপা গলায় বললেন, কিছু না তুই যা।
মামা দরজা খোলো।
শওকত সাহেব দরজা খুলে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইলেন।
কি হয়েছে?
তিনি জবাব দিলেন না। মুনা বলল, ভয় পাচ্ছ?
হুঁ।
কেন, ভয় পাঁচ্ছ কেন?
ফ্যানটা ঘুরছে শুধু শুধু।
কোথায় ঘুরছে?
না এখন আর ঘুবছে না। শওকত সাহেব ক্লান্ত স্বরে বললেন, যা খুমুতে যা। মুনা বলল, তুমি বরং আমাদের ঘরে ঘুমাও। বাবুর সঙ্গে শুয়ে পড়ে। আমি এখানে ঘুমাব।
শওকত সাহেব কোনো কথা বললেন না। মুনা বলল যাও মামা আমার কথা শোন। তাছাড়া আজ রাতটা এমনিতেই তোমার উচিত ছেলেমেয়েকে পাশে নিয়ে ঘুমানো।
শওকত সাহেব ক্ষীণ স্বরে বললেন, তোর মামির ওপর বড় অবিচার কবেছি রে মুনা।
তা করেছ।
বড় খারাপ লাগছে।
অল্প কয়েক দিন লাগবে, তারপর আর লাপবে না। মানুষ বড় অদ্ভুত প্ৰাণী মামা।
শওকত সাহেব কোনো কথা বললেন না। মুনা চাপা স্বরে বলল, ধর কিছু দিন পর আবার যদি তুমি বিয়ে কর তাহলে প্রথম কিছু দিন ঐ মেয়েটিকে খুব ভালবাসবে, তারপর আবার আগের মত নানান অবিচার শুরু করবে। এবং এক সময় বিছানা-বালিশ নিয়ে আলাদা ঘুমুতে চাইবে। চাইবে না?
শওকত সাহেব একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। মুনা বলল, যাও ওদের ঘরে গিয়ে শোও। ওরা জেগেই আছে, ওদের সঙ্গে দু’একটা কথা-টথা বল।
কি কথা বলব?
যা মনে আসে বল। ওদের সাহস দাও।
বাবু তার বাবাকে পাশে শুতে দেখে কেমন যেন কুঁকড়ে গেল। বকুল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মশারির ভেতর থেকে। শওকত সাহেব ডাকলেন, বাবু। বাবু জবাব দিল না।
ঘুমাচ্ছিস নাকি বাবু?
না!
বকুল ঘুমাচ্ছিস?
না।
শওকত সাহেব তাদের কি বলবেন বুঝতে পারলেন না। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তার তেমন যোগাযোগ নেই। চিরদিন দূরে দূরে থেকেছেন। একটা আড়াল তৈরি হয়ে গেছে। আজ হঠাৎ করে ওদের কাছে আসা যায় না। ওরা কাঁদছেও না। কাঁদলে বলা যেত কাঁদিস না রে। শওকত সাহেব ক্ষীণ স্বরে বললেন গরম লাগছে, তাই না? বকুল বা বাবু কেউই কিছু বলল না।
মুনার অনেক রাত পর্যন্ত ঘুম এল না। পায়ের কাছে জানালাটা খোলা। খোলা জানালায় শীতল হাওয়া আসছে। সেই হাওয়ায় সিলিং ফ্যানটি অল্প অল্প ঘুরছে। ঘরে অন্য রকম একটা গন্ধ। রোগের গন্ধ, শোকের গন্ধ, মৃত্যুর গন্ধ। মুনা ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে মৃদু স্বরে ডাকল, মামি। কেউ জবাব দিল না। মৃত্যুর ওপারে অন্য কোনো ভুবন আছে কী? না থাকাটা খুব কষ্টের হবে।
মুনার পানির তৃষ্ণা হচ্ছিল কিন্তু উঠে গিয়ে পানি আনার ইচ্ছা হচ্ছিল না। সে চোখ বন্ধ করে পড়ে রইল। কত অসংলগ্ন কথাই না তার মনে এল। যার সঙ্গে মামির কিছুমাত্র সম্পর্ক নেই। খুব ছোটবেলায় নদীর ধারে বেড়াতে গিয়েছিল। সেখানে লাল রঙের একটা প্রকাণ্ড কাকড়া তার দিকে হঠাৎ ছুটে আসতে শুরু করল। অনেক দিন পর সেই দৃশ্যটি পরিষ্কার মনে এল। কেন এল?
শীত করছে। এবার কি আগে ভাগে শীত পড়ে গেল নাকি? কাঁথায শীত মানবে না। লেপ বের করতে হবে শিগগির। লেপগুলির কি অবস্থা কে জানে। তেলাপোকায় কেটেকুটে সর্বনাশ করে। রেখেছে হয়ত। অনেক দিন রোদে দেয়া হয় না।
মুনা বিছানা ছেড়ে উঠল। পানির পিপাসা অগ্রাহ্য করা যাচ্ছে না। দরজা খুলে বের হয়ে সে একটি অদ্ভুত দৃশ্য দেখল। মামা তাঁর ছেলেমেয়ে দু’টিকে নিয়ে ক্যাম্পখাটে বসে আছেন। দুহাতে জড়িয়ে ধরে আছেন দু’জনকে। মামা ধরা গলায় ডাকলেন মুনা, আয় মা এদিকে।
মুনা গেল না। নিশিরাত্রির এই মুহূর্তটি ওদের। সেখানে তার স্থান কোথায়? সে রান্নাঘর থেকে পানি খেয়ে আবার শুয়ে পড়ল। আজ সারাদিন বড় পরিশ্রম গিয়েছে। বড় ক্লান্ত লাগছে। কিন্তু ঘুম আসছে না। মুনা চেষ্টা করল তার বাবার ছবিটি মনে আনতে। কিছুতেই মনে এল না। শুধু মনে পড়ল প্রচণ্ড একটা শীতের রাতে ছোট খালা তাকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে যাচ্ছেন। বাবার ঘরে। চারদিকে অনেক লোকজন, অনেক আলো। ছোট খালা বলছেন চল মা, বাবাকে একটা চুমু দিয়ে আসবে। লক্ষ্মী মেয়ের মত বাবাকে একটা চুমু দেবে।
বাবার ঘর ভর্তি মানুষ। সবাই কেমন অন্য রকম। বাবা তাকে দেখে কাঠির মত রোগা একটি হাত উঁচু করলেন। মুনা তার খালার গলা জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে উঠল। সে কিছুতেই যাবে না। বাবার কাছে। বাবা দুর্বল স্বরে বললেন, ও ভয় পেয়েছে, ওকে নিয়ে যাও। ছোট খালা ঘর থেকে বের করে এনে প্রচণ্ড একটা চড় দিয়ে বলেছিলেন, বোকা মেয়ে।
মুনা কথাটা গলা পর্যন্ত টেনে দিয়ে মৃদু স্বরে বলল বাবা ঐ ভয়ংকর রাতে তোমাকে চুমু খেতে পারিনি। কিন্তু তোমাকে আমি লক্ষ লক্ষ চুমু খেয়েছি। কোনোদিন তুমি তা জানতে পারবে না। এই দুঃখ আমি সারা জীবন বুকের মধ্যে পুষে হাসি মুখে ঘুরে বেড়াব। কত রকম সুখের ঘটনা ঘটবে আমার জীবনে। ঘর-সংসার হবে, ছেলেমেয়ে হবে। ওরা বড় হবে ওদের বিয়ে হবে, কিন্তু সেই দুঃখ থাকবেই।
মৃত্যুর পর কি কোনো জগৎ সত্যিই নেই? এই একটিই জীবন আমাদের? কোনোদিন বাবার কাছে দু’হাত বাড়িয়ে যাওয়া যাবে না? শৈশবের দিনগুলি কি ভয়াবহই না ছিল। কিছু দিন এর বাড়ি, কিছু দিন ওর বাড়ি। সাত বছর বয়সেই বুঝতে পারল সে একটা উপদ্রবের মত। কেউ তাকে দীর্ঘদিন রাখতে চায় না। তার যখন নবছর বয়স তখন এক’দিন মামা এসে বললেন মুনা, তুই চলে আয় আমার সাথে। আমার সাথে থাকবি। ছোট খালা বিরক্ত হয়ে বললেন, তোর সাথে থাকবে মানে! তুই একা মানুষ মেসে পড়ে আছিস।
একটা ঘর ভাড়া নেব। এখানে ওর কষ্ট হচ্ছে।
মামা সত্যি সত্যি ঘর ভাড়া করে তাকে নিজের কাছে নিয়ে নিলেন। দু’জন মাত্র মানুষ তারা, কত রকম সমস্যা। রাত নটা-দশটা পর্যন্ত মুনাকে মাঝে মাঝে একা থাকতে হত। কি যে ভয় লগত একেক দিন। কিন্তু সে সুখে ছিল। মামা তাকে ভালবাসায় ডুবিয়ে রেখেছিলেন। যার যতটুকু ভালবাসার প্রয়োজন সে বোধহয় তা কোনো না কোনো ভাবে পেয়েই যায়। মুনার অস্পষ্ট ভাবে মনে হল সে সুখী হবে। ভালবাসার অভাব তার জীবনে হবে না।
শেষ রাতের দিকে মুনা সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখল। রিকশা করে সে আর মামুন যাচ্ছে। রিকশা যাচ্ছে কোনো একটা পাহাড়ি অঞ্চল দিয়ে। অপূর্ব সব দৃশ্য চারদিকে। খুব বাতাস দিচ্ছে। সেই বাতাস অগ্রাহ্য করে মামুন সিগারেট ধরাতে চেষ্টা করছে। একটার পর একটা দেয়াশলাইয়ের কাঠি নষ্ট হচ্ছে। মামুন বড় বিরক্ত হচ্ছে। সে যতই বিরক্ত হচ্ছে মুনার ততই মজা লাগছে।
কত রকম অদ্ভুত স্বপ্নই না মানুষ দেখে।
মামুন ভেবেছিল ঢাকায় খুব বেশি হলে সাতদিন থাকবে।
বেশিদিন থাকা সম্ভব নয়। রাজমিস্ত্রী ঠিক করা আছে, ওরা বসে থাকবে। মেশিন রাখার বেস পাকা হবে। একটা হাফ বিল্ডিং হবে, প্রচুর কাজ। কিন্তু ঢাকা থেকে বের হবার সে পথ পাচ্ছে না। মুনার সঙ্গে সরাসরি কথা হওয়া দরকার। সমস্ত পরিকল্পনাটি তাকে ভালমত বোঝানো দরকার। তাও সম্ভব হচ্ছে না, একটির পর একটি ঝামেলা লাগছে। ছোটখাটো ঝামেলাও নয়, বিরাট সব ঝামেলা। এর মধ্যে ইন্ডাসট্ৰি-ফিন্ডাসটির কথা বলা যায় না।
তাছাড়া ঢাকায় এসে কেন জানি মনে হচ্ছে মুনা ঠিক আগের মত নেই। তাকে তেমন পছন্দ করছে না, এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করছে। সেদিন ওর অফিসে গিয়েছিল। সে ঠাণ্ডা গলায় বলল, কোনো কাজে এসেছ না। এমনি?
জরুরি কথা ছিল কিছু।
এখন তো খুব ব্যস্ত। তুমি চলে যাও, আমি যাব তোমার কাছে।
মামুন রাত আটটা পর্যন্ত অপেক্ষা করল। মুনার পাত্তা নেই। এমন কখনো হয় না। এই মেয়েটির কথার নড়াচড় হয় না। মামুন সে রাতেই মুনাদের বাসায় গিয়েছে। মুনা সহজ ভাবেই বলেছে মাথা ধরেছে কাজেই তোমার ওখানে যাইনি। তাছাড়া মন-টনও ভাল না, কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। তুমি বস, চা খাও। আমি একটু শুয়ে থাকব।
মামুন রাত প্ৰায় এগারোটা পর্যন্ত বসে রইল। মুনা একবার এসে শুধু চা দিয়ে গেল। শওকত সাহেব এই দীর্ঘ সময় তার সঙ্গে গল্প করলেন। সাপের গল্প। কবে বারহাট্টায় বেড়াতে গিয়েছিলেন। সন্ধ্যাবেলা বাইরে বেরুবেন। শার্ট গায়ে দিতেই মনে হল ঠাণ্ডা একটা কি যেন গা বেয়ে যাচ্ছে। হারিকেন আনতেই দেখা গেল কালো কুচকুচে একটা সাপ। আরেকবার চাদপুরে ঘুমিয়ে আছেন। মশারি-টশারি সব ফেলা। বাতি নিভিযে চাদর গায়ে দিতেই মনে হল ঠাণ্ডা একটা কি যেন পায়ের উপর দিয়ে যাচ্ছে…।
মামুনের মনে হল স্ত্রীর মৃত্যুর কারণেই হোক অথবা অন্য যে কারণেই হোক এই লোকটির মধ্যে বড় রকমের একটা পরিবর্তন হয়েছে। সাপের মত একটা বিষয় নিয়ে কেউ দুঘণ্টা একনাগাড়ে কথা বলতে পারে না। বিশেষত সেই লোক, যে কপালে বিরক্তির ভাজ না ফেলে। আগে একটি কথাও বলত না। অথচ এখন একে দেখে কেউ বুঝতে পারবে না। এর কোনো সমস্যা আছে। একবার হাল ছেড়ে দিলে যেমন একটা নিশ্চিন্ত আলস্যের ভাব চলে আসে মানুষের মধ্যে ওনারও কী তাই হয়েছে? মামুন একবার মামলার প্রসঙ্গ তুলতে চেষ্টা করল, নেক্সট ডেট কবে পড়েছে মামা?
জানি না কবে। মুনা বলতে পারবে। তারপর শ্ৰীপুরের গল্পটা শোন। ভাদ্র মাস, নৌকা করে যাচ্ছি। শ্ৰীপুর…।
শ্ৰীপুরের গল্প শেষ হতে পনের মিনিট লাগল। মুনা এসে বলল, যেতে দাও মামা। রিকশা পাবে না। শওকত সাহেব বললেন, রাত বেশি হয়ে গেছে। থেকে যাক না।
না না থাকবে কি?
মামুন উঠে পড়ল। মুনা কি সত্যি সত্যি তাকে অপছন্দ করছে? অপছন্দ করবার মত বাস্তব কোনো কারণ কি আছে। ওর একটা দুঃসময় যাচ্ছে এবং তখন মামুন তাকে কোনো রকম সাহায্য করেনি। গ্রামের বাড়িতে গিয়ে বসে ছিল। ঝামেলা এড়াবার জন্য যে সে এটা করছে তা তো না।
ফরিদা মারা যাবার পর বাবা-মা একলা হয়ে পড়েছেন। নানান রকম কথাবার্তা বলতে শুরু করেছেন। ফরিদাকে নাকি হঠাৎ হঠাৎ দেখতে পান। অসুস্থ ফরিদকে নয়। স্বাস্থ্য সৌন্দর্যে ঝলমলে ফরিদাকে; কখনো তাকে দেখা যায় বসে আছে লাল চাদর গায়ে দিয়ে; কখনো বা হেঁটে যায় পাশ দিয়ে। মানসিক ভাবে বাবা-মা দুজনেই বিপর্যন্ত। এমন অবস্থায় তার নিশ্চয়ই অধিকার আছে বাড়িতে থেকে যাওয়ার।
তাছাড়া বাড়ির সঙ্গে তার দীর্ঘদিন সম্পর্শক ছিল না। ফরিদার কারণেই ছিল না। বলতে গেলে সে পালিয়ে বেড়িয়েছে। এই নিয়ে তার অপরাধবোধ আছে। সেটা কাটানোর জন্যেও গ্রামে থাকা দরকার। গ্রাম তো সেই পুরনো গ্রাম নেই। পিলার বসছে, ইলেকট্রিসিটি মাস খানিকের ভেতর চলে যাবে। রেডিও-টেলিভিশন সবই চলবে। তেলের কল ঠিকমত কাজ করলে ভাল টাকা-পয়সা আসার কথা। ঢাকায় কলেজের মাস্টারির পুরো বেতনটাই তো চলে যায় বাড়ি ভাড়ায়। সেখানে বাড়ি ভাড়া দিতে হচ্ছে না। চমৎকার বাড়ি আছে নিজেদের। দোতলার দক্ষিণের ঘরটিতে একটা অ্যাটাচিড বাথরুমের ব্যবস্থা করলেই পুরোপুরি শহরের বাড়ি হয়ে যাবে।
কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এসব কথা বুঝিয়ে বলার মত সুযোগই তৈরি হচ্ছে না। মামুনের ধারণা মুনা তাকে এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করছে। টেলিফোনের কথাবার্তা থেকে সেটা কিছুটা স্পষ্ট হয়েছে। টেলিফোনের রিসিভার উঠিয়েই মুনা বলেছে আমার হাতে অনেক কাজ, তুমি কি পরে একবার রিং করবে। দুটোর পর। দুটোর পর টেলিফোন করা হল। সে অফিসে নেই এর মানে কি? স্পষ্ট কথা হওয়া উচিত। মামুন এখন আর তার বিয়ের ব্যাপারটি ঝুলিয়ে রাখতে চায় না। এই নিয়েও কথা বলতে চায়।
মুনার আশংকা সে বুঝতে পারছে। মামার জেল-টেল হয়ে গেলে এরা যাবে কোথায়?
সে যদি উপন্যাসের আদর্শ নায়িকাব মত ভাবে পরিবারের বাকি সবার জন্যে জীবন উৎসর্গ করবে, বাকি জীবন চিরকুমারী থাকবে তাহলে সে ভুল করবে।
সবার আলাদা আলাদা জীবন আছে। এইসব মহৎ আদর্শ উপন্যাসে এবং সিনেমায় ভাল লাগে। জীবন উপন্যাসেও না সিনেমাও না। আর এমন তো না মুনা ছাড়া ওদের অন্য কোনো গতি নেই। অবশ্যই আছে। আত্মীয়-স্বজনরা আছে। বকুলের এক মামা আছেন যথেষ্ট ক্ষমতাবান মানুষ।
মুনার এখন যে দুঃসময় তার চেয়েও ভয়াবহ দুঃসময় মানুষের আসে এবং তখন তারা নিজেদেব এ রকম করে গুটিয়ে নেয় না। মামুন মনে মনে মুনার সঙ্গে কথাবার্তাগুলি ঝালাই করতে লাগল।
তুমি এখন আর আমার সঙ্গে দেখা করতে আস না কেন?
ভাল লাগে না সেই জন্যে আসি না।
ভাল লাগে না মানে?
মানে-টানে কিছু নেই।
তার মানে আমাকে বিয়ে করবে না?
তোমাকে বিয়ে করব কেন? কি আছে তোমার?
মনে মনে কথাবার্তা বেশিক্ষণ চালিয়ে যাওয়া যায় না। তর্কে মুনা জিতে যায়। এটাও একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার। বাস্তবেও তর্কে মুনা জেতে, কল্পনার তর্কে ও সে-ই জেতে। অন্তত কল্পনাতে তো মামুনের জেতা উচিত।
অথচ প্রথম পরিচয়ের সময় মুনার এই তার্কিক স্বভাব তার চোখেই পড়েনি। বরঞ্চ মনে হয়েছিল বড় ঠাণ্ডা একটি মেয়ে। ঠাণ্ডা এবং লাজুক! মামুন তার বন্ধুর একটি কাজ নিয়ে গিয়েছিল অফিসে। লাজুক ধরনের মেয়েটি দ্রুত কাজটা করে দিল। মামুন বলল–মেয়েরা এত তাড়াতাড়ি কাজ করতে পারে জানতাম না তো। সে হেসে বলল–মেয়েদের এত অক্ষম ভাববেন না।
এখন থেকে আর ভাবব না।
মেয়েটি তাকে এক কাপ চা খাওয়াল।
সেই কাজটি নিয়ে মামুনকে পরদিন আবার যেতে হল। মেয়েদের যতটা সক্ষম ভাবা গিয়েছিল কার্যক্ষেত্রে সে রকম দেখা যায়নি। কাগজপত্র ঠিকমত তৈরি হয়নি। মেয়েটি দারুণ লজ্জিত হল। ছোটাছুটি করে আবার নতুন কাগজ তৈরি করে দিল। তাতেও ভুল বের হল। আবার আসতে হল মামুনকে এবং সে হেসে বলল–
আপনার এখানে এসে এসে এমন অভ্যাস হয়েছে যে, কাগজপত্র পুরোপুরি ঠিক হলে মন খারাপ লাগবে। মেয়েটি লাল হয়ে বলল, আপনাকে আব আসতে হবে না। এবার ঠিকঠাক না হলে আমি চাকরি ছেড়ে দেব।
কিন্তু সপ্তাহখানেক পর মামুন আবার এল। লাজুক ভঙ্গিতে বলল আজ কোনো কাজে আসিনি। আপনাকে থ্যাংকস জানাতে এসেছি। থ্যাংকস জানাতে এসে প্রায় দুঘণ্টা বসে রইল। এই দুঘণ্টায় সে এক প্যাকেট সিগারেট এবং চার কাপ বিশ্বাদ চা খেয়ে ফেলল। কি সব আনন্দের দিনই না গিয়েছে।

শওকত সাহেবের বাইরে হাঁটাহাঁটির পরিমাণ অনেক বেড়েছে। এখন আর আগের মত দুপুরে খেতে আসেন না। কোনো একটা সস্তা হোটেলে ঢুকে পড়েন। খাওয়া-দাওয়া সেরে চেয়ারে বসেই খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে নেন। এই নিয়ে হোটেলওয়ালাদের সঙ্গে মাঝে মাঝে মৃদু বাচসা হয়। সেদিন একেবারে হাতাহাতির পর্যায়ে চলে গেল। নীলক্ষেতের এক হোটেলওয়ালা বিরক্ত মুখে বলল এই যে ঘুমান কেন? ভাত খাইছেন এখন যান। অন্য কাস্টমাররা বসুক।
শওকত সাহেব লজ্জিত হয়েই উঠে পড়লেন। ক্ষেপে গেল অন্য কাস্টমাররা একজন বুড়ো মানুষ খাওয়ার পর বিশ্রাম করছে, আর তুমি যে জোর করে তুলে দিলে। পয়সাটাই শুধু দেখ।
দেখতে দেখতে ওদের সঙ্গে হোটেলওয়ালার তুমুল লেগে গেল। প্রায় হাততাতির উপক্রম। এ সব ক্ষেত্রে যা হয় হোটেলওয়ালার পরাজয় হল। এবং সে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, যান ভাই ঘুমান, ঐ বুড়া মিয়ারে একটা বালিশ আইন্যা দে।
শওকত সাহেব দ্বিতীয় দফায় ঘুমুতে গেলেন না। বিল মিটিয়ে চলে এলেন। লোকজন ইদানীং তাকে বুড়ো মিয়া ডাকছে। হঠাৎ করে বুড়ো হয়ে গেছেন নাকি? পান। কিনতে গিয়ে খুব নজর করে আয়নায় নিজেকে দেখলেন। চেহারা তো আগেই মতই আছে। শুধু কপালের কাছের কিছু চুল ইন্দিরা গান্ধীর মত পেকে গেছে। তবু সবাই কেন বুড়ো ভাবতে শুরু করল।
অবশ্যি বুড়ো হবার অনেক সুবিধাও আছে। বাসে উঠলে সহজেই সিট পাওয়া যাচ্ছে। গতকালই গুলিস্তান যাচ্ছিলেন। লেডিস সিটে বসা অল্পবয়সী একটা মেয়ে বলল জায়গা আছে বসুন না। মেয়েটি সরে কিছু জায়গা করে দিল।
কোথায় যাওয়া যায়? বাইরে বেশ রোদ। রোদ না কমলে হাঁটাহাঁটি করে আরাম পাওয়া যায় না। কোনো পার্ক-টার্কে খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিলে কেমন হয়? শওকত সাহেব চলে গেলেন সোহরাওয়াদী উদ্যানে। এই দুপুরের রোদেও জোড়ায় জোড়ায় ছেলেমেয়ে দেখা গেল। প্রেমের সুবিধা দেয়ার জন্যেই কি সরকার এই পার্ক বানিয়েছেন? এই ধরনের কথা ভাবতে ভাবতে শওকত সাহেব একটা ফাঁকা বেঞ্চ খুঁজে বের করলেন এবং সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুমুলেন। বেশ লাগল তাঁর।
আজও তিনি সে রকম করবেন ভাবলেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে মত বদলে চলে গেলেন নিজের অফিসে। মল্লিক। বাবুর কাছে পঞ্চাশ টাকা পাওনা আছে ম্যাদি পাওয়া যায়। আজ মাসের এক তারিখ, হাতে টাকা থাকার কথা। তার নিজের হাত দ্রুত খালি হয়ে আসছে। কয়েক দিনের মধ্যেই হয়ত মুনার কাছে হাতখরচ চাইতে হবে।
আরে আরে শওকত সাহেব যে, কোথায় ডুব দিয়েছিলেন?
শওকত সাহেব হকচকিয়ে গলেন। অফিসের কোথাও যেন সূক্ষ্ম একটা পরিবর্তন হয়েছে। সবাই আগ্রহ নিয়ে তাকাচ্ছে তার দিকে। তার পোস্টে যে নতুন ছেলেটির অ্যাপয়েন্টমেন্ট হয়েছে সে উঠে দাঁড়িয়ে স্নামালিকুম দিল। জসীম সাহেব হাসি মুখে বললেন, এসেছেন ভাল হয়েছে, অনেক কথা আছে। শরীর কেমন আপনার বলেন?
শরীর ভালই।
ভাল কোথায়? আপনি তো ভাই বুড়ো হয়ে গেছেন। এ কি অবস্থা!
সংসারে অনেক ঝামেলা গেল। আমার স্ত্রী মারা গেছেন।
তাই নাকি? আহা বলেন কি? বড় আফসোসের কথা। কোনোই খবর রাখি না। ঐদিন অবশ্যি মল্লিক বাবু বলছিলেন চলেন যাই খোঁজ নিয়ে আসি। ঝামেলার জন্য যেতে পারলাম না। অডিট হচ্ছে। কোনো কোনো দিন আটটা সাড়ে আটটা পর্যন্ত থাকতে হয়। চলেন ক্যান্টিনে চলেন। চাটা কিছু খাই।
চা খাব না। এই মাত্র ভাত খেয়ে এসেছি।
চা না খাবেন অন্য কিছু খাবেন। পেপসি খান। ফান্টা খান? আপনার সাথে কথা আছে।
অফিসের ক্যান্টিনাটিরও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। কাঠের চেয়ার সরিয়ে প্লাস্টিকের চেয়ার দেয়া হয়েছে। টেবিলের উপর পরিষ্কার টেবিল ক্লথ। জসীম সাহেব বললেন, ক্যান্টিনের ভোল পাল্টে গেছে, বুঝলেন তো?
জি।
ক্যান্টিন এখন ইউনিয়নের হাতে। ইউনিয়ন ক্যান্টিন চালাচ্ছে। এখন ইউনিয়ন খুব সন্ট্রং। এই জন্যেই আপনাকে খুঁজছিলাম।
কেন আমাকে কেন?
শওকত সাহেব বড়ই অবাক হলেন। ইউনিয়ন তাকে কেন খুঁজছে, সেটা জেনে তার বিস্ময়ের পরিমাণ আরো বাড়ল।
আপনাদের মামলাটার ব্যাপারেই খোঁজ হচ্ছে। আমরা সিরিযাস চাপ দিয়েছি। আমরা বলেছি, আসল যে আসামি দিব্যি চাকরি করছে বেতন নিচ্ছে। তার বিরুদ্ধে কেইস তোমরা তুলে নিয়েছ। আর যে নিরপরাধ তাকে জেলে পাঠাবার ব্যবস্থা করছি। আমরা এটা হতে দেব না।
আমি নিরপরাধ না।
আপনি তো এটা বললে হবে না। আমরা ব্যাপারটি জানি। আপনাকে সিগনেচার করতে বলা হয়েছে। আপনি দুর্বল মানুষ, ভয়ের চোটে সিগনেচার করেছেন। আপনার মুখ বন্ধ রাখার জন্য কিছু টাকা আপনার হাতে ধরিয়ে দেয়া হয়েছে, ব্যস।
শওকত সাহেব কপালের ঘাম মুছলেন।
ইউনিয়নের চাপে ওদের অবস্থা এখন কাহিল। সাপের ব্যাঙ খাওয়ার মত অবস্থা। ফেলতেও পারছে না গিলতেও পারছে না। হা হা হা। বারবার যে আপনার মামলার তারিখ পড়ছে, কি জন্যে পড়ছে? এই জন্যেই পড়ছে। ওরা সময় নিচ্ছে। আপনি এসেছেন যখন এক কাজ করুন। বড় সাহেবের সঙ্গে দেখা করুন।
দেখা করব?
হ্যাঁ। জাস্ট দেখা করবেন। অন্য কিছু বলার দরকার নেই। বড় সাহেব কিছু বললে শুনবেন।
সাহস হয় না।
সাহসের এখানে কি আছে, যান তো। ব্যাটার রি-অ্যাকশনটা কি দেখেন।
বড় সাহেব তাকে প্রথম চিনতেই পারলেন না। শওকত সাহেব কাঁপা গলায় বললেন, স্যার আমি শওকত। ক্যাশ সেকশনের।
ও আচ্ছা। একি অবস্থা হয়েছে। আপনার?
অনেক রকম বিপদ-আপদ যাচ্ছে স্যার; জানেনই তো। তার ওপর স্ত্রী মারা গেলেন।
তাই নাকি? কবে?
গত মাসের চব্বিশ তারিখ?
আই অ্যাম সরি। আই অ্যাম ভেরি সরি। বসুন বসুন চা খান!
জি না স্যার চা খাব না।
খাবেন না কেন–খান। সাড়ে তিনটা বাজে, এখন অলমোস্ট টি টাইম।
শওকত সাহেব সংকুচিত ভঙ্গিতে বসলেন। বড় সাহেব বললেন, আপনার নিজের শরীর কেমন?
শরীর ভালই। মামলাটা নিয়ে ঘোরাঘুরি বেশি হয়। বারবার ডেট পড়ে। জেল-টেল যা হবার একবারে হয়ে গেলে ভাল ছিল।
জেলে যাওয়ার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে নিয়েছেন?
জি স্যার।
বাসায় কে আছে? আমার একটা মেয়ে ক্লাস টেনে পড়ে, একটা ছেলে আছে ক্লাস সেভেনে পড়ে। আর আমার ভাগ্নী আছে একটি।
বড় সাহেব হঠাৎ বললেন, ধরুন আপনাকে যদি জেলে যেতে হয় তাহলে ওদের দেখাশোনা কে করবে?
আমার ভাগীই করবে স্যার। আমি সেটা নিয়ে চিন্তা করি না। ও খুব তেজী মেয়ে। বড় সাহেবের ঘরের চা শওকত সাহেবের খুব পছন্দ হল। এই চা ক্যান্টিন থেকে আসে না। আলাদা তৈরি হয়। হালকা লিকার, মিষ্টি মিষ্টি একটা গন্ধ। আসল চায়ের গন্ধ বোধ হয় এ রকমই।
স্যার যাই।
ঠিক আছে যান। আর শোনেন, বেশি চিন্তা করবেন না। স্বাস্থ্যের দিকে নজর রাখবেন। ঐ মামলাটা নিয়ে কোম্পানি চিন্তা-ভাবনা করছে। হয়ত শেষ পর্যন্ত তুলে নেবে। যদিও আমি ঠিক সিওর না।
শওকত সাহেব অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন।
আপনি দিন সাতেক পর খোঁজ নেবেন।
শওকত সাহেবের কি করা উচিত? ছুটে গিয়ে বড় সাহেবকে জড়িয়ে ধরা? কেঁদে ফেলা? এর কোনোটাই তিনি করতে পারলেন না। বেকুবের মত চারদিকে তাকাতে লাগলেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই তার হেঁচকি উঠে গেল।
মল্লিক বাবু ধারের পঞ্চাশ টাকা ফিরিয়ে দিলেন। গলার স্বর নিচু করে বললেন, এই টাকায় ভাল দেখে দৈ-মিষ্টি কিনে নিয়ে যান। আমোদ-ফুর্তি করেন।
শওকত সাহেব সত্যি সত্যি পঞ্চাশ টাকারই সন্দেশ কিনে ফেললেন। চল্লিশ টাকার কিনলে ভাল হত, রিকশা করে বাসায় ফিরতে পারতেন। এখন যেতে হবে হেঁটে হেঁটে। কিন্তু বেশ লাগছে। হাঁটতে। কিসের যেন একটা মিছিল বের হয়েছে। তিনি মিষ্টির প্যাকেট হাতে ওদের সঙ্গে মিশে গেলেন। মিছিলের সঙ্গে হাঁটা বেশ মজার ব্যাপার। নিজেকে তখন আর ক্ষুদ্র মনে হয় না। শওকত সাহেব কোনো কিছু না বুঝেই দলের সবার সঙ্গে গলা মিলিয়ে হুংকার দিতে লাগলেন–দিতে হবে দিতে হবে।
তিনি বাসায় পৌঁছলেন সন্ধ্যাবেলা! বাসায় তখন ছোটখাটো একটা উত্তেজনার ব্যাপার চলছে। পুরনো ফ্যানটি নিয়ে আসা হয়েছে। বাকের-এর তত্ত্বাবধানে সেই ফ্যান ফিট করা হয়েছে। সুইচ টিপতেই ফ্যানে এক ধরনের কক্ষপন দেখা গেল। মেঘ ডাকার মত একটা শব্দ হয়ে সমস্ত ঘর অন্ধকার হয়ে গেল। বাকের বলল শালা মদনা। হারামজাদার সবগুলি দাঁত আমি খুলে ফেলব। বকুল খিলখিল করে হেসে ফেলল।
হাসির কি হল? এর মধ্যে হাসির কি হল? কেউ একটা মোমবাতি আনো না। আরো ব্যাপার কি?
হ্যারিকেন, মোমবাতি, কুপী কিছুই পাওয়া গেল না। এ রকম একটা বিশৃঙ্খল অবস্থায় শওকত সাহেব মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে উপস্থিত হলেন। তার খুব ইচ্ছা ছিল ওরা জিজ্ঞেস করবে মিষ্টি কি জানো? কেউ কিছু জিজ্ঞেস করল না।
মুনা এক টুকরো সন্দেশ মুখে দিয়ে থু করে ফেলে দিল বাসি সন্দেশ। কোথেকে আনলে মামা?
শওকত সাহেব রাত আটটায় সন্দোশের দোকানে রওনা হলেন ফিরিয়ে দিয়ে পয়সা নিয়ে আসতে। বয়স হয়েছে টের পাওয়া যাচ্ছে। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। মুনার কাছ থেকে চেয়ে রিকশা ভাড়াটা নিয়ে এলে হত।
ঠাণ্ডাও লাগছে। এবার কি আগেভাগে শীত পড়ে গেল নাকি? গরম চাদরটা সঙ্গে আনলে হত।

টিনা বিরক্ত হয়ে বলল দুঘণ্টা আগে আসবার জন্যে খবর পাঠালাম না?
কাজ ছিল ভাবী।
টিনা রহস্যময় ভঙ্গিতে বলল, অল্পের জন্যে মিস কবলি, তোর ডাক্তার এসেছিল। বকুল বড় লজ্জা পেল। ইদানীং টিনা ভাবী কথায় কথায় বলছে তোর ডাক্তার। কি লজ্জার ব্যাপার, কারো কানে গেলে কি হবে কে জানে।
বাচ্চাদের গা গরম, ডাক্তার ডাকতে হয়। কোন ডাক্তারকে আর ডাকি, তোর ভাইকে বললাম বকুলের ডাক্তারকেই ডাক।
বকুল লাল হয়ে বলল কি যে তুমি কর ভাবী।
টিনা বকুলের কোলে একটা বাচ্চা তুলে দিল। গা সত্যি গরম, মুখে লাল লাল কি দেখা যাচ্ছে।
ওর কি হয়েছে ভাবী?
কিছু না, মাসি-পিসি। সব বাচ্চাদের হয়। তোকে একটা বিশেষ কাজে ডেকেছি। বকুল। একটা না দু’টা বিশেষ কাজ। প্রথমটা হচ্ছে নাম ঠিক করেছিস?
উঁহু।
আজকেই নাম চাই। খুব জরুরি।
কেন এত জরুরি কেন?
টিনা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলিল বাচ্চাদের দাদা চিঠি দিয়েছে। নাতীদের নাম যেন ফজলুর সঙ্গে মিল রেখে বজলু আর মজনু রাখা হয়। তোর ভাই বলছে, বাবা যা চান তাই রাখ। আমি মরে গেলেও ছেলেদের নাম বজলু মজনু রাখব না। এখন ছেলেদে বা কত সুন্দর সুন্দর নাম হয়, আর আমার দুটোর নাম হবে বজলু আর মজনু?
বকুল হেসে ফেলল।
টিনা বিরক্ত হয়ে বলল, হাসির কি হল? সুন্দর সুন্দর নাম দশ মিনিটের ভেতর বের কবি;
ঠিক আছে করব, এখন দ্বিতীয় জরুরি কথাটি বল?
তোর ডাক্তারকে আজ বললাম তোর কথ।
তার মানে।
খোলাখুলি বললাম। প্রথমে চা-টা খাইয়ে ভাই সম্পর্ক পাতালাম, তাপ প<ং পল পাম তুমি বয়সে আমার ছোট হবারই কথা, কাজেই তুমি বলছি। বকুল বলল, থাক ভাবী আমি আর শুনতে চাই না। শুনতে না চাইলে উঠে চলে যা, আমার যেটা বলার সেটা বলে যাচ্ছি। তারপর আমি বললাম তুমি কি ভাই বকুল নামের কোনো মেয়েকে চোন? সে দেখি লজ্জায টমেটোর মত হয়ে গেল। আমি বললাম। ওকে আমি ছোটবেলা থেকে চিলি। এ রকম মেয়ে পৃথিবীতে খুব কম জন্মায়। তুমি যদি চাও এই মেয়েটির সঙ্গে তোমার বিয়েব ব্যবস্থা করি। বকুল ভেবেছিল সে কোনো জবাব দেবে না, কিন্তু নিজের অজান্তেই সে বলল, উনি কি বললেন? কি বললেন সেটা শোনাল দরকার নেই। শুনলে পায়া ভাবী হয়ে যাবে। তোর মুনা। আপা বাসায়। আছে? তার সঙ্গে আমার কথা আছে। আছে বাসায়? না। কোথায় গেছে? জানি না। মামুন ভাইয়ের কাছে বোধ হয়। কখন আসবে? সন্ধ্যার পর চলে আসবে। ঠিক আছে সন্ধ্যার পর আমি যাব তোদের বাসায়। বকুল জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। তার চোখে পানি চলে এসেছে। সে টিনা ভাবীর কাছে তা গোপন করতে চায়। টিনা হেসে বলল, কেঁদে গাল ভাসাচ্ছিস কেন বোকা মেয়ে? যা, বাসায় চলে যা। তোর আপাকে বলিস মনে করে আমি আসব। জরুরি কথা আছে তার সাথে। টিনা এসে তাকে জড়িয়ে ধরল। বকুল দীর্ঘ সময় বসে বসে কাঁদল। দুজনের কেউই কোনো কথা বলল না। মামুন তাকিয়ে আছে। রাগী চোখে। এমন রাগী চোখে তাকিয়ে থাকার মত তো কিছু হয়নি। মুনার মাথায় সূক্ষ্ম যন্ত্রণা হচ্ছিল। সে বলল–চল যাই, কথা তো শেষ হল। না শেষ হয়নি, আরো কথা আছে। মামুন একটা সিগারেট ধরাল। মুনা ঘড়ি দেখল আটটা প্রায় বাজে বাজে। কল্যাণপুরের হাজি সাহেবের বাসায় আসতে অনেকখানি সময় লেগেছে। এখানে না এলেও চলত। এমন কোনো জরুরি কথা মামুনের ছিল না। যা শোনার জন্যে তাকে কল্যাণপুরের এই বাসায় আসতে হবে। মুনার নিজের হাতের কেনা জিনিসপত্র চারদিকে ছড়ান। থালা বাটি চায়ের কাপ। কাটা চামচ। বসার মোড়া। দেখতে এমন মায়া লাগে। মুনা ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস গোপন করল। দিনের অবস্থা ভাল না। আকাশে মেঘ করেছে। বাড়ি ফেরা দরকার। মামুন হাতে সিগারেট ছুড়ে ফেলে বলল। তুমি তাহলে আমাকে বিয়ে করবে না? করব

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here