হৃদয়ের_কোনো_ঠিকানা_থাকেনা পর্বঃ ০১

বড় আপার বিয়ে হয়েছিলো হাসপাতালে,না হয়েছে আপার গায়ে হলুদ,না পরেছে মেহেদী,না বেজেছে সানাই।বিয়ে হয়েছে আপার লাল বেনারসির বদলে কালো বোরকা পরে।
শোকের রঙ নাকি কালো হয়,অবশ্য সেই হিসেবে এই বিয়েতে আপার জন্য কালো কাপড় মানানসই।
বড় খালা,আমার মা,আব্বা,মামারা সবাই উপস্থিত ছিলো,পাত্র হাসপাতালেরই ডাক্তার।হাসপাতালের বেডে শুয়ে কাতর চোখে তাকিয়ে ছিলো বড় খালু,বড় খালুর এই চাহনির দিকে তাকিয়ে আপা জলাঞ্জলি দিলো নিজের ৬ বছরের ভালোবাসা।

কাবিনের ভিতরের এই নৃশংসতা আমি নিতে পারছিলাম না।তাই হাসপাতালের বারান্দায় চলে এলাম।
হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখি বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে সজল ভাই,হাতে একটা বেলী ফুলের মালা।

আমার ভিতরটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো সজল ভাইকে এরকম নিশ্চিন্তে আপার জন্য বেলী ফুলের মালা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে।
কেননা,সজল ভাই জানেও না এই মাত্র তার ভালোবাসার মানুষটির বিয়ে হয়ে গেছে অন্য একজনের সাথে।
সজল ভাইয়ের জন্য যতোটুকু কষ্ট হচ্ছিলো তারচেয়ে বেশি রাগ উঠেছিলো বড় খালুর উপর।ঠিক এক সময়ই কেনো তাকে অসুস্থ হতে হলো?
আপা আর সজল ভাই তো আর একটু সময় পেলেই বিয়ে করে নিতে পারতো।
কাজী অফিস থেকে আপা ছুটে এসেছে খালুর অসুস্থতার কথা শুনে।
পিতৃস্নেহের কাছে হেরে গেলো আপার ৬ বছরের ভালোবাসা।

ভাবতে ভাবতে আনমনেই কেঁদে দিলাম আমি।কেউ না জানুক আমি জানি সজল ভাই আপাকে কি পরিমাণ ভালোবাসতো!
ভিতরে বড় আপার কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে।হাউমাউ করে কাঁদছে আপা।কি জানি আপার কান্নার শব্দ ৪ তলা থেকে নিচে শোনা যাচ্ছিলো কিনা,তবে কেনো জানি সজল ভাই তখন উপরের দিকে তাকালো।
আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মুচকি একটা হাসি দিলো।
তারপর দুই হাত দুই দিকে ছাড়িয়ে ডানার মতো করে কিছু একটা বুঝালো আমাকে।আমার ও তখন ইচ্ছে করছিলো হাউমাউ করে কাঁদি।
সজল ভাই আমাকে দেখলেই বলতো,”পরী,তোমার ডানা কই?
ডানাকাটা একটা মেয়ের নাম পরী হবে কেনো আমাকে বলো তো?”

আমি জানি এখনো সজল ভাই আমাকে এটাই বুঝিয়েছে।আমি আর থাকতে পারলাম না,চলে গেলাম কেবিনে।
কেবিনে ঢুকতেই আমার চক্ষু চড়কগাছ!
একটু আগে বড় খালুর মুখে অক্সিজেন মাস্ক ছিলো,হাতে স্যালাইনের তার,অন্য হাতে ক্যানোলা,অথচ এখন কিছুই নেই।
উল্টো খালু বসে আছে বিছানায় দুই পা ভাজ করে।আমি একে একে সবার দিকে তাকালাম।
আশ্চর্য, আপা ছাড়া হাসপাতালে উপস্থিত সবার মুখে বিজয়ীর হাসি।
আমাকে কেউ বলে নি তবুও হঠাৎ করেই আমি বুঝে গেলাম,এটা একটা নাটক ছিলো,সাজানো নাটক ছিলো এদের সবার।
আমার বুকের ভিতর কেমন মোচড় দিয়ে উঠছে।আপার চাইতে বেশি কষ্ট যেনো আমি পাচ্ছি।

আপার দিকে তাকালাম,আপা দেখি মূর্তির মতো তাকিয়ে আছে বড় খালুর দিকে।
বুঝতে পারে নি,আমার সহজ সরল আপা বুঝতে পারে নি আমাদের পরিবারের সবার চালাকি।
আপাকে কি বলবো,আমি নিজেও তো বুঝতে পারি নি।

ছোট মামা টেবিল থেকে মিষ্টির প্যাকেট খুলে সবাইকে খাওয়াতে লাগলো।একপাশে দেখলাম দাঁড়িয়ে আছে আপার বর্তমান স্বামী,ডাক্তার রিশাদ আহমেদ।
ফর্সা বর্ণের এই লোকটার কাছে হেরে গেলো সজল ভাইয়ের ভালোবাসা!
মামা এনে আমার মুখে মিষ্টি দিলো,থু করে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম আমি মিষ্টি।

সবাই অবাক হয়ে তাকালো আমার দিকে,আমার মা চোখ রাঙালো,কিন্ত আজকে কেনো জানি মায়ের এই চোখ রাঙানো আমি ভয় পাচ্ছি না,অথচ অন্য সময় হলে আমি নিজেই ভয়ে হজম হয়ে যেতাম।
মা কে আমরা সবাই ভয় পাই,আমার সব খালাতো ভাইবোন,মামাতো ভাইবোন,এমনকি মামা,খালারাও।
আমি জানি এই ষড়যন্ত্রের রচয়িত্রী যদি কেউ থেকে থাকে তবে সম্ভাবনা ৮০% সেটা আমার মা।

বড় মামা মিষ্টির রস টিস্যু দিয়ে মুছতে মুছতে বললো,”এখন কি হবে রে সাজু?
ওই সজল হারামজাদা তো নিচে দাঁড়িয়ে আছে,এবার ওরে কি বলবি?”

আমার মায়ের নাম সাজেদা,মামারা আদর করে সাজু ডাকে।
মা জবাব দিলো,”চিন্তার কিছু নাই ভাইজান,আপনি আর ছোট ভাইজান এখন নিচে যাবেন,গিয়ে সজল রে বলবেন দুলাভাইয়ের অবস্থা খুবই খারাপ,আমরা দুলাভাই সুস্থ হলেই বিয়ের ব্যাপার নিয়ে ভাববো,তবে এই কয়দিন ও ফাইজার সাথে যোগাযোগ করতে পারবে না কিছুতেই,৫ দিন পর রিশাদের বদলি হয়ে যাবে এখান থেকে একটা গ্রামের হাসপাতালে,সজল আর খুঁজে পাবে না ফাইজা কে।”

“৫ দিন না ছোট আম্মা,২ দিন পরেই আমি ফাইজাকে নিয়ে চলে যাচ্ছি এখান থেকে।”

বুঝতে পারলাম আপার জামাইয়ের নাম রিশাদ তাহলে।আমার খুব রাগ লাগছে সবার উপর,সবচেয়ে বেশি রিশাদ নামের এই লোকটার উপর।
একটা মানুষ কতোটা নির্লজ্জ,নিষ্ঠুর হলে অন্য কারো ভালোবাসার মানুষ কে এভাবে ছিনিয়ে নিয়ে যেতে পারে জেনে শুনে!

মায়ের কথামতো ২ মামা নিচে নেমে গেলো।ক্লান্ত হয়ে আপা দেয়ালে মাথা ঠেকায়।
আমার ভীষণ ইচ্ছে করছে আপাকে জড়িয়ে ধরে একটু কাঁদতে,কিন্তু পারছি না।
আমার মা আর বড় খালা আমাকে কাঁচা খেয়ে ফেলবে যদি বুঝতে পারে আমিও আপার ভালোবাসা সমর্থন করতাম।

বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম আমি,একটু পরেই দেখি দুই মামা নিচে নেমে গেছে।সজল ভাই এগিয়ে এসে মনে হয় সালাম দিলো,তারপর দেখলাম হ্যান্ডশেক করছে মামাদের সাথে।
উপর থেকে শোনা যাচ্ছে না তবুও আমি জানি মামারা তোতাপাখির মতো আমার মায়ের শিখিয়ে দেওয়া বুলি উগরে দিচ্ছে সজল ভাইয়ের সামনে।

সজল ভাই মনে হয় বুঝতে পারে নি এই চালাকি,মাথা নেড়ে মেনে নিলো।
ছোট মামার হাতে বেলী ফুলের মালাটা দিয়ে বাইক নিয়ে চলে গেলো।
সজল ভাই চলে যেতেই মামা ময়লার ঝুঁড়িতে ফেলে দিলো মালাটা। তারপর উপরের দিকে আসতে লাগলো হাসতে হাসতে।

বাহিরে বসন্তের মৃদু বাতাস বইছে,আসা যাওয়া করছে অনেক অনেক মানুষ,এম্বুলেন্স।একটু পরেই দেখলাম একটা লাশ নিয়ে যাচ্ছে এম্বুলেন্স। আমার ভীষণ হাসি পেলো দেখে,কেউ কি জানে,তার আশেপাশে ঘুরে বেড়ায় কতো জীবন্ত লাশ!

অন্ধকার নেমে এসেছে চারদিকে,সন্ধ্যা হয়েছে কিছুক্ষণ আগে।একটু পরেই সবাই রেডি হয়ে নিলো বাসায় যাওয়ার জন্য,আজকে সবাই বড় খালাদের বাসায় যাবে।
একে একে সবাই গাড়িতে উঠে বসলাম।আপা দুলাভাই আর বড় খালু বসেছে ছোট মামার গাড়িতে,আমাদের গাড়িতে আমি মা বাবা বড় খালা বড় মামা।
বিচ্ছেদ হয়েছে আপার অথচ জ্বলেপুড়ে মরছি আমি।
আমার ভীষণ ইচ্ছে করছে এই মুহুর্তে আপার মুখটা দেখতে,৬ বছর ধরে যে মানুষটা আপাকে তার বাম পাশে বসাতো কোথাও যাওয়ার সময়,আজ সেই মানুষটার জায়গায় অন্য মানুষ বসেছে,আপা কিভাবে স্থির আছে!
কি ক্ষতি হতো সজল ভাইকে মেনে নিলে?
শুধুমাত্র সজল ভাই ফর্সা না বলে?
দুনিয়ায় সবাই কি ফর্সা হয়?
দেহের সৌন্দর্য টা সবাই বড় করে দেখলো অথচ কেউ দেখলো না সজল ভাইয়ের মনটা কতো সুন্দর।
কেউ জানলো না আকাশ ছোঁয়া ভালোবাসা বলে যদি কিছু থাকে তবে সেটা শুধু সজল ভাই দিতে পারতো আপাকে।
উজ্জল বাদামি বর্ণের এই মানুষটা কে কেনো সবাই এভাবে অপছন্দ করলো?
জানি না আমি,জানা নেই আমার এই উত্তর।
তবে আমি বুঝে গেলাম আমাকে সাবধান হতে হবে,প্রেম করলে ফর্সা কারো সাথে করতে হবে,যাতে আমার পরিবার বডি শেমিং করতে না পারে তারও।
কি জানি,তখন আবার কোন খুত খুঁজে বের করবে!

গাড়ি চলছে খালার উত্তরার বাসার দিকে,মা,খালা আর মামার হাসাহাসিতে আমার প্রাণ অতিষ্ঠ হয়ে গেলো।
কিভাবে মা এই প্ল্যান বের করলো,মায়ের কতো বুদ্ধি সেই প্রশংসা করছে সবাই মিলে বারবার।
আর লজ্জায় আমার ইচ্ছে করছে মাটির সাথে মিশে যাই।
সজল ভাই যদি কখনো জানতে পারে আমার মা এই প্ল্যান করেছে না জানি আমাকে কি ভাববে!

চলবে………

হৃদয়ের_কোনো_ঠিকানা_থাকেনা
পর্বঃ ০১
জাহান আরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here