এস_এল_আর,দ্বিতীয় পর্ব

এস_এল_আর,দ্বিতীয় পর্ব
ঈপ্সিতা_মিত্র

( ৩ )
যাইহোক, এরপর ঘড়ির কাঁটা কিছু দূর এগিয়ে যখন দশটা বাজলো, তখন ভ্রমর ব্রেকফাস্ট সেরে নেমে আসছিল হোটেলের গার্ডেনের দিকে। প্রিয়া যদিও কিছুক্ষণ আগেই নেমে গেছে। কাল যখন দুজনে দার্জিলিং পৌঁছেছিল, তখন বিকেল পাঁচটা। বেশ টায়ার্ড লাগছিল তাই। সেই জন্য আজকের দিনটা দুজনে ঠিক করেছে দার্জিলিং এর এদিক ওদিক হেঁটেই ঘুরবে। এইভাবে দুই বন্ধু মিলে এর আগেও বেশ কয়েকবার বেড়াতে গেছে। তবে সেটা কলকাতা থেকে দু তিন ঘন্টার জার্নি করে শর্ট ট্রিপ। কিন্তু এই প্রথমবার অনেক বলে কয়ে বাবা মা কে রাজি করিয়ে এই এক সপ্তাহের ট্রিপটা ম্যানেজ করেছে ভ্রমর আর প্রিয়া।
আনমনে এইসব ভাবতে ভাবতেই ভ্রমর নেমে এসেছিল রিসেপশনে সেইদিন। কিন্তু রিসেপশনের সামনে বাগানটায় চোখ যেতেই কেমন থমকে গেছিল ও। প্রিয়া ঘাড় দুলিয়ে দুলিয়ে, হাত নাচিয়ে নাচিয়ে, বেশ হেসে হেসে কথা বলছিল ওই আজ সকালের দেখা হওয়া ছেলেটার সাথে! ভ্রমর ব্যাপারটা বুঝলো না কিছুই। তারপর কিছুক্ষণ বাদে প্রিয়া কথা শেষ করে ছেলেটার সাথে হ্যান্ড শেক করে ওর কাছে আসতেই জিজ্ঞেস করলো,
—–” কি রে, তুই ওই ছেলেটার সাথে কি এত কথা বলছিলিস? আবার হ্যান্ডশেকও করে নিলি! ব্যাপারটা কি?”
প্রশ্নটা শুনেই প্রিয়া বেশ উজ্বল মুখে বলে উঠলো,
—–” আরে কি বলছিস! করবো না হ্যান্ডশেক! কত বড় সাংবাদিক আর ল্যান্ডস্কেপ ফটোগ্রাফার উনি জানিস? ‘ প্রথম আলো ‘ পেপারের কনটেন্ট হেড উনি। অচিন্ত বর্মন। আমি নাম শুনেছিলাম অনেক। এত কম বয়সে এরকম নাম করা একটা মিডিয়া হাউজের হেড মানে বুঝতে পারছিস! কতটা ট্যালেন্টেড। তার ওপরে আমি তো ওনার ফটোগ্রাফির ফ্যান! কলকাতা থেকে ইন্ডিয়া, কত ট্রাভেল ম্যাগাজিনের কভার ওনার ক্যামেরা দিয়েই তোলা। এমনকি কলকাতায় একটা একাডেমী খুলেছেন ফটোগ্রাফি কোর্সের জন্য। এইবার বইমেলায় তো স্টলও ছিল ওনার একাডেমির। আর আমি তো বহুদিন ‘ প্রথম আলো ‘ তে কাজ করার চেষ্টা করছি জানিসই। আমার তো তিন বছরের এক্সপিরিয়েন্সও আছে। তাই কথা বলে দেখছিলাম। আর জানিস, আমাকে আজ বিকেলে টাইমও দিয়েছেন উনি, এই হোটেলের ক্যাফেটাতে দেখা করতে বলেছে।”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে প্রিয়া খেয়াল করলো ভ্রমরের মুখটা কেমন অন্ধকার হয়ে এসেছে এই মুহূর্তে। এটা দেখে প্রিয়া একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলো ওকে,
—–” কি রে! কি হলো তোর? এত কি ভাবছিস?”
কথাটা শুনে ভ্রমর কেমন একটা ঢোঁক গিলে আলতো স্বরে বললো,
—–” না মানে ! আজ ভোরবেলা ব্যালকনিতে আমি!”
কথাটাকে আর শেষ করতে দিল না প্রিয়া, তার আগেই চোখ বড় বড় করে বললো,
—–” ডোন্ট টেল মি, তুই আজ সকাল সকাল এই অচিন্ত বর্মনকেই কথা শুনিয়ে এসেছিস বিনা কারণে?”
ভ্রমর কথাটা শুনে একটু এলোমেলো হয়ে বললো,
—–” না মানে! আমি!”
তবে এবারও ওর কথাটা শেষ করতে না দিয়ে প্রিয়া বলে উঠলো বেশ রেগে,
—–” তুই কি রে! মানে কিছু বলার নেই।”
এই কথায় ভ্রমর কিছুটা জোর দেখিয়ে বললো,
—-” আরে! আমি কি করে জানবো ওই ছেলেটা অতো কিছু! আর বেছে বেছে ওই মিডিয়া হাউজেই তোকে কাজ করতে হবে! আর ঘুরতে এসে চাকরি চেঞ্জ করার কথা কে ভাবে বলতো?”
এটা শুনে প্রিয়া সেই রাগটা দেখিয়েই বললো,
—–” তো কি করবো! একই ফিল্ডে থেকে ওরকম একজন বড় জার্নালিস্টকে দেখে না চিনে চলে যাবো; না কি নিজের চ্যানেল তৈরি করার চেষ্টা করবো শুনি! যাইহোক, আজ বিকেলে কফিশপে যখন যাবো, তুইও যাস। অচিন্ত স্যারকে দেখে বেশ ভদ্র বলে মনে হলো আমার। তুই গিয়ে সবটা মিটিয়ে নিস। নইলে আমাদের পাশের রুমেই আছে, যখন তখন আমাদের একসাথে দেখে নিতে পারে। তারপর আর আমার কাজটা হলো না!”
কথাগুলো বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো চিন্তায় প্রিয়া। ভ্রমর এই মুহূর্তে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে কেমন! ঘুরতে এসে কি কেসটাই না খেলো হঠাৎ! আর দোষটা তো সত্যি ওরই। কি দরকার ছিল বিনা কারণে যেচে পরে কথা শোনানোর! সব ওই ইডিয়েট রনটার জন্য। ভেবেই মনটা তেঁতো হয়ে গেল হঠাৎ।
( ৪ )
এরপর বিকেল সাড়ে চারটের সময় পৌঁছেছিল ভ্রমর আর প্রিয়া কফিশপে। প্রিয়া বেশ নার্ভাস ছিল এই মুহূর্তে। মনে হচ্ছিল একটা ছোটোখাটো ইন্টারভিউই দিতে যাচ্ছে নিজে। তার ওপরে ভ্রমরের সাথে সকালের ওই কেসটা! অচিন্ত স্যার সেইসব না মনে রেখে দেয়! এইসবই আনমনে ভাবছিল। তবে ভ্রমর তো মুখটা বাংলার পাঁচ করেই রেখেছিল। যদি লোকটা ওকে দেখেই এখান থেকে কেটে পড়ে, তাহলে তো প্রিয়া মনে হয় সারা জীবন কথা শোনাবে ওকে! কথাটা ভেবে নিজের ওপরই রাগ হচ্ছিল হঠাৎ। সত্যি, রনের ওকে ঠকানোর পর কেমন যেন একটা হয়ে গেছে ভ্রমর! না বুঝে অনেক ভুল করে ফেলে আজকাল। এইসবই ভাবছিল, তখনি ঐ কোণার টেবিলে বসে থাকা অচিন্তর সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল ওর। অচিন্ত তবে প্রিয়ার সঙ্গে সকালের ওই ব্যালকনির মেয়েটাকে দেখে কেমন যেন হকচকিয়ে গেছিল! এই মেয়েটা এখানে কি করছে! এই প্রিয়ার সাথেই এসেছে না কি ঘুরতে! এইসব ভাবনার ভিড়েই চুপচাপ বসেছিল ও। তখনই প্রিয়া আর ভ্রমর সামনের কয়েকটা টেবিল পার করে ওর কাছে চলে এলো। প্রিয়া এবার হাসি মুখেই অচিন্তকে বললো,
—-” গুড ইভিনিং স্যার.. ”
কথাটা শুনে অচিন্ত অল্প হেসে বললো,
—–” গুড ইভিনিং.. এন্ড ডোন্ট কল মি স্যার.. এটা তো অফিস না, তাই ডোন্ট বি ফরমাল.. কল মি অচিন্ত..”
কথাগুলো বলে অচিন্ত এবার থামলো। প্রিয়া এরপর আলতো হেসে বললো,
—–” ওকে, অচিন্তই বলবো। যাইহোক, মিট মাই ফ্রেন্ড, ভ্রমর.. আমরা একসাথেই বেড়াতে এসেছি এখানে।”
কথাটা শুনে অচিন্ত আর কোন বাক্য ব্যায় করলো না বিশেষ। বরং একটু গম্ভীর হয়েই বললো ‘ হুম…’। তারপর আরো এক সেকেন্ড সময় নিয়ে আরেকটু ভদ্রতা দেখিয়ে বললো, —-” প্লিজ বসো তোমরা।”
প্রিয়া এটা শুনে আর কোন কথা বাড়ালো না ভ্রমরের ব্যাপারে। মনে মনে ভাবলো আসলে, আর ইন্ট্রোডাকশন দিয়ে কাজ নেই বাবা! তারপর যদি ইনি কথা না বলেই কেটে পরেন! তার থেকে ভালোয় ভালোয় কাজের কথাটা হয়ে যাওয়া ভালো। এইসব ভেবেই বসলো চেয়ারে। ভ্রমরও আর কোন রকম কথা না বলে বসলো চুপচাপ পাশে। এরপর বেশ কিছুক্ষণ প্রিয়া আর অচিন্ত কাজের কথা বললো। অচিন্তদের হাউজে কটা ভ্যাকেন্সি আছে! প্রিয়ার এক্সপিরিয়েন্স কতটা! ফিল্ডে গিয়ে কতটা কাজ করেছে, এইসব। যাইহোক, এরপর আধ ঘণ্টা বাদে অচিন্ত বললো, —–” তুমি এপ্লাই করো আমাদের হাউজে.. আর আমাকে মেলেও একটা এপ্লিকেশনের কপি দিও। আমি তোমাকে আমার পার্সোনাল আইডি দিচ্ছি। এরপর দেখি, আমি কি করতে পারি!”
কথাটা শেষ হতেই প্রিয়া মন থেকে হেসে বলে উঠলো, —-” থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ.. আপনি বেড়াতে এসেও যে আমাকে সময় দিলেন কাজের কথা বলার জন্য! সত্যি রিয়ালি নাইস অফ ইউ..”
কথাটায় অচিন্ত অল্প হেসে উত্তর দিল,
—-” নো নিড টু থ্যাঙ্ক মি.. ইটস কমপ্লিটলি ফাইন.. যাইহোক, তোমাকে আরেকটা প্রশ্ন করার ছিল, তোমার ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি আর ডিএসএলআর এর ব্যাপারে কি মত? মানে সব ক্যামেরা ম্যানদেরই কি ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি থাকে মনে হয়?”
কথাটা শুনে প্রিয়া হোঁচট খেল হঠাৎ। ভ্রমর ও ঢোঁক গিললো এবার। প্রিয়া এই মুহূর্তে কি বলবে বুঝতে না পেরে একটু এলোমেলো হয়েই বললো,
—-” না না, এরম কেন হবে! ফটোগ্রাফার মানেই ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি কেন থাকতে যাবে!”
কথাটা শুনে অচিন্ত ভ্রমরের দিকে তাকিয়ে আলতো হেসে বললো, —–” না, অনেকের মনে হয় এরকম! যাইহোক, আসলাম। এন্ড এনজয় দ্যা ট্রিপ..”
কথাটা বলেই অচিন্ত আর থাকলো না। চলে গেল কফিশপটা থেকে। তবে ভ্রমর সেই মুহুর্তেই বেশ উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলো,
—–” দেখলি কেমন! কথা শুনিয়ে গেল আমাকে।”
এটা শুনে প্রিয়া অচিন্তর কথাটাকে একটু ঢাকার চেষ্টা করে বললো,
—- ” তো! তোরই তো দোষ। কথা শোনানোর শুরুটা তো তুই করেছিলিস। যাইহোক ছাড়, বাদ দে। আমার কাজটা তো মিটলো! এই নিয়ে তুই আর ভাবিস না।”
শেষ কথাটা ভ্রমরের মুডটাকে অন করার জন্যই বললো প্রিয়া। কিন্তু ভ্রমর আনমনা হয়েই রইলো এরপর। সত্যি! ছাড়তে কি পারলো ও এই দু বছরেও! মনে তো পড়েই যায়। সেই দুর্গা পুজোয়, কত ফটোই না তুলছিল রন! আর ফটো তোলার মাঝে মাঝে তাকাচ্ছিল ভ্রমরের দিকে বার বার। এমনকি লুকিয়ে ওরও কিছু ফটো তুলেছিল রন। যদিও ভ্রমরের ভালোই লেগেছিল ব্যাপারটা। এরপর দশমীর দিন প্রপোজ করেছিল রন ওকে নিজে থেকে। স্বপ্নের মতন দিনগুলো ছিল তারপর। কত কথা, কত গল্প! কত মুহূর্ত ছিল দুজনের। কিন্তু ধীরে ধীরে ছবিটা বদলাতে লাগলো। রনের হাজারটা মেয়ে বন্ধু, তাদের সাথে ওর হঠাৎ হঠাৎ এদিক ওদিক ঘুরতে চলে যাওয়া ভ্রমরকে কিছু না বলে, এগুলো নিয়ে নিত্যদিন অশান্তি লেগেই থাকতো দুজনের। এই সময় রন একবার ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি রাখলো, কোন একটা মেয়ে বন্ধুর কথা শুনে। ভ্রমরের মোটেও পছন্দ ছিল না সেটা। ওর এই নিউ লুক দেখে কতবার বলেওছিল, যে কলকাতার ডন লাগছে দেখতে। কিন্তু রন প্রত্যেকবারের মতন পাত্তা দেয়নি ওর কথায়। বলেছিল ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি না কি ইন্টেলেকচুয়াল লোকেরা রাখে! আর ক্রিয়েটিভ লোকেরা না কি নিজের লুক নিয়ে সব সময়ই এক্সপেরিমেন্ট করে! ওইসব ভ্রমর বুঝবে না।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here