এস_এল_আর ( চতুর্থ পর্ব )

#এস_এল_আর ( চতুর্থ পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র

<৬>
সেদিন এসব এলোমেলো চিন্তার মাঝেই গাড়িটা এসে থামলো পাহাড়ের কোলে ছোট্ট একটা কফিশপে। এখানে আধ ঘণ্টার ব্রেক নেবে ড্রাইভার। যাক, ভালোই হয়েছে। এই পাহাড়ি রাস্তায় কোন একটা দোকানে এক কাপ গরম কফি খাওয়ার মজাই আলাদা! তার ওপরে দোকানটা কি সুন্দর কাঠের, দূরে পাহাড় কিরকম নিঃস্তব্ধ গম্ভীরভাবে দাঁড়িয়ে। এর মাঝে ভ্রমর কেমন হারিয়ে গেছিল যেন এই সবুজে ঘেরা প্রকৃতির ভিড়ে। মনে হচ্ছিল কোন একটা রূপকথার দেশে এসেছে আজ! এসবই ভাবছিল এই শান্ত পরিবেশে। তখনই ফোনটা বেজে উঠলো, আর শান্ত পরিবেশটা অশান্ত হয়ে গেল এক মুহূর্তে। মা সেই বিয়ের টপিক নিয়েই পরে আছে দিন রাত। এখানেও ফোন করে সেই একই কথা! এমনকি ভ্রমরকে জিজ্ঞেস না করেই ছেলের বাড়ির লোককে আসতে বলেছে কদিন পর। কথাটা শুনে ভ্রমর বেশ রেগে বলেছিল,
—–” অসম্ভব মা! আমি এইভাবে মিষ্টির প্লেট হাতে ধরে কারোর সামনে শো পিস সেজে বসতে পারবো না! আমি এরেঞ্জ ম্যারেজ করতে চাইই না। আর তুমি আমাকে না জিজ্ঞেস করেই ছেলের বাড়ির লোককে আসতে বলে দিলে! আর চিনি না, জানি না, কোথাকার কে; তার সাথে আমি হঠাৎ করে কি কথা বলবো!”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেছিল ভ্রমর। কিন্তু ওপার থেকে কোন উত্তর না এসে ফোনটা কেটে গেছিল হঠাৎ। নেটওয়ার্ক প্রব্লেমের জন্য মা এই ঝামেলার কথা শুনিয়েই ডিসকানেক্টড হয়ে গেছিল সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু ভ্রমরের মুডের বারোটা বেজে তেরোটা হয়ে গেছিল যেন। জীবনে মানে কোথাও এসে শান্তি নেই! মা যেন তেন প্রকারেন ওর বিয়ে দিয়েই ছাড়বে বলে প্রতিজ্ঞা করেছে। আর এই প্রিয়াটাও নেই এই সময়ে। বয়ফ্রেন্ডের সাথে বকবক করছে গাড়িতে বসে একা একা। ওর না কি প্রাইভেসি চাই! সত্যি, এই পৃথিবীতে কি ও একদম একা! কেউ নেই যে ওকে বুঝবে! ওর মনের কথাগুলোকে শুনবে! কথাগুলো ভেবেই এই মুহূর্তে চোখটা ভিজে এলো হঠাৎ ভ্রমরের। এই পাহাড়ি সকালটা কেমন আবছা হয়ে ধরা দিল ওর কাছে! কিন্তু এর মাঝেই অচিন্ত আচমকা এসে জিজ্ঞেস করলো একটু আস্তে গলায়,
—-” এনি প্রব্লেম?”
প্রশ্নটা শুনেই ভ্রমর একটু হকচকিয়ে তাকালো ওর দিকে! এই ছেলেটা শুনে ফেলেছে না কি সব! কিন্তু অচিন্ত তো কফিশপের বাইরে দাঁড়িয়ে পাহাড়ের শোভা দেখছিল! তার মানে কি ভ্রমর এত জোরে কথা বলেছে যে বাইরে থেকেও শোনা গেছে সব কিছু! এইসবই ভাবছিল। তার মাঝেই অচিন্ত আবার বলে উঠলো,
—–” কি হলো? এনি প্রব্লেম? আই মিন ইফ ইউ ওয়ান্ট, ইউ ক্যান শেয়ার…”
এই কথাটায় ভ্রমর আর এই মুহূর্তে চুপ থাকতে পারলো না! আসলে এত রাগ দুঃখ হচ্ছে ওর যে কারোর সাথে একটা কথা বলতেই হবে এখন। এইসব ভেবেই ও বলে উঠলো কিছুটা নিজের মনে,
—–” প্রব্লেমই প্রব্লেম। আসলে আমার লাইফটাই একটা প্রব্লেম। আচ্ছা, আপনিই বলুন, মেয়ে হয়েছি বলে কি বিয়েটা করতেই হবে! মানছি প্রেমটা সাকসেসফুল হয়নি আমার। কিন্তু তা বলে এড়েঞ্জ ম্যারেজ! আর মা তো জিজ্ঞেস করারও প্রয়োজন মনে করলো না! সোজা ছেলেটাকে ফ্যামিলি সমেত বাড়িতে ডেকে নিয়েছে। এই ট্রিপ শেষ হয়ে কলকাতা ফিরলেই এইসব নাটক শুরু হবে।”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে গেল ভ্রমর। অচিন্তও এইসব শুনে একটু ভেবে বললো,
—-” ঠিকই তো। বিয়ে করা, না করা তো যার যার নিজের ডিসিশন। এই নিয়ে তো কারোর জোর করার কিছু নেই। তবে কি বলুন তো, মা বাবাকে সব কিছু বোঝানো সম্ভব না। স্পেশ্যালি এই বিয়ের ব্যাপারে। তখন একটু ট্রিকস খাটাতে হয়।”
কথাটা শুনে ভ্রমর উদাসভাবেই জিজ্ঞেস করলো,
—-” ট্রিকস! কিন্তু কি ট্রিকস? ছেলেটার সম্বন্ধ দেখতে এসে যদি পছন্দ হয়ে যায় আমাকে! তাহলেই তো কেস!”
কথাটার উত্তরে অচিন্ত খুব সহজ ভাবেই বললো,
—-” আরে, তুমি একটু বানিয়ে বলে দেবে কিছু ছেলেটার ব্যাপারে! এই যেমন ধরো বললে ছেলেটা ভেজিটেরি়য়ান। মাছ মাংস ডিম ছুঁয়েও দেখে না। আর বিয়ের পর এটাই শর্ত হলো যে তোমাকেও শাক পাতা খেয়েই থাকতে হবে। আমি শিওর, এটা শুনে কোন বাঙালি মা বাবা বিয়েতে রাজি হবে না! বাঙালিরা যা মৎস্যপ্রেমি! ভেজিটেরিয়ান শুনেই বিয়ে ক্যানসেল করে দেবে।”
কথাটা বলেই অচিন্ত আবার বলে উঠলো,
—–“ ওহ, আমি তুমি বলে ফেললাম। প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড। আসলে এই আপনি আজ্ঞেটা আমার ঠিক আসে না!”
কথাটা অচিন্তর শেষ হতেই ভ্রমরের মুখে হাসি। ও এই মুহূর্তে বেশ উজ্জ্বল মুখেই বললো,
—-” না না, মাইন্ড করার কি আছে! কোন প্রব্লেম নেই। আর সত্যিই তো! এটা তো ব্যাপক আইডিয়া। আর আমাদের বাড়িতে তো মা রোজ মাছ রান্না করে। বলে না কি মাছ খেলে ব্রেন খুলবে। মা কখনোই জামাই হিসেবে কোন ভেজিটেরিয়ানকে একসেপ্ট করতে পারবে না! সত্যি, থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ.. এত ভালো একটা আইডিয়া দেয়ার জন্য।”
কথাটা শুনে অচিন্তরও মুখে হাসি। তবে ভ্রমরের এরপর মনে হচ্ছিল, প্রিয়া ঠিকই বলেছে। অচিন্ত সত্যিই বেশ ভালো! আর এই একসাথে ঘুরতে না এলে, ছেলেটাকে ঠিকভাবে চেনা হতো না ওর! তাই সেদিন এরপর গাড়িতে ভ্রমর আর চুপ করে থাকেনি। নিজের মনেই বকবক শুরু করেছিল অচিন্তর সাথে। ওর স্কুলিং কোথায়, কলেজ কোথায়, বেড়াতে যাওয়ার এক্সপিরিয়েন্স এই সমস্ত এলোমেলো কথা শুনেছিল পুরো রাস্তা জুড়ে। আর এই কথার ভিড়েই কখন যে আপনি থেকে তুমি বলতে শুরু করেছিল ভ্রমর অচিন্তকে, এটা ও নিজেও বোঝেনি ঠিক!
<৭>
এরপরের দিন রাতে ক্যাম্প ফায়ারের আইডিয়াটা অচিন্তরই ছিল। তবে ভ্রমর আর প্রিয়া কথাটা শুনেই হ্যাঁ বলে দিয়েছে। এই হোটেলের সুন্দর বাগানটা, তার মাঝে তারায় ভরা আকাশ, একটা রুপোলি জোৎস্না ছড়ানো গোল থালার মতন চাঁদ, আর এলোমেলো ভেসে যাওয়া মেঘেদের ভিড়ে আগুনের তাপ নেয়ার মজাটাই আলাদা! এর মাঝে আবার অচিন্ত গান ধরেছিল নিজের মনে। ভ্রমর আর প্রিয়া তো অবাক হয়ে শুনছিল ওর গান! এত ভালো গলা যে অচিন্তর, ভাবেনি আসলে! আর সব মিলিয়ে সেদিন এই পাহাড়ি সন্ধ্যেটাকে একটা গিফ্ট বলে মনে হচ্ছিল ভ্রমরের। এত সুন্দর মুহূর্তগুলোর মধ্যে যেন ও হারিয়ে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে। তবে এর মধ্যেই প্রিয়ার ফোন মাঝে মাঝে বেজে উঠছিল! আর ও বেপাত্তা হয়ে যাচ্ছিল আবিরদার সাথে হ্যাজাতে। আসলে সেই একজনের কল তো; না ধরে থাকার উপায় আছে! আর সত্যি! আবিরদা পারেও। সারাক্ষণ প্রিয়াকে নিয়েই ভেবে যাচ্ছে ছেলেটা! এইসবই ভাবছিল ভ্রমর সেদিন বেখেয়ালে, তখনই নিঃস্তব্ধতা ভেঙে অচিন্ত হঠাৎ বলে উঠলো,
—-” আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি? একটু পার্সোনাল।”
কথাটা শুনে ভ্রমর সহজ গলাতেই বললো,
—–” পারমিশন নিচ্ছ কেন! কি কথা?”
এটা শুনে অচিন্ত অল্প সময় নিয়ে বললো,
—-” তুমি বিয়ে কেন করতে চাও না? আই মিন কোন ভয়? একজনের সাথে রিলেশন ভেঙে গেছে বলে অন্য কারোর সাথেও একই জিনিস হতে পারে!”
কথাগুলো অচিন্তর কাছ থেকে শোনার পর ভ্রমর নিজে একটু চুপ করে গেছিল কয়েক সেকেন্ড। তারপর নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বলেছিল,
—–” আসলে ভয় না। আর ইচ্ছে করে না কিছু নতুন করে শুরু করতে! আবার প্রথম থেকে নিজেকে চেনাবো! কথা শুরু করবো! এগুলোকে কেমন একটা এফোর্ট দিচ্ছি বলে মনে হয়। কেমন যেন জোর করে! মন থেকে না। আর রন কোথাও একটা থেকেই গেছে আমার মধ্যে। গিয়েও যায় না!”
কথাগুলো খুব স্তব্ধভাবে শেষ করেছিল ভ্রমর। অচিন্তও এরপর কি বলবে বুঝতে পারেনি! তবে এই গম্ভীর পরিবেশে এরপর প্রিয়া ফিরে এসেছিল নিজের মনে গজগজ করতে করতে। ভ্রমর এটা দেখে একটু অবাক হয়েই বলেছিল,
—-” কি হলো হঠাৎ তোর? বেশ তো প্রেম করতে গিয়েছিলিস! এরকম রেগে গেলি কেন!”
এর উত্তরে প্রিয়া বেশ বিরক্ত হয়েই বললো,
—–” ধুত্তেরিকার প্রেম! এই আবিরটা না চরম নেকা আর পজেজিভ। ঘণ্টায় ঘণ্টায় ফোন। আর মাঝে মাঝে মনে হয় আমাকে যেন কোন অনাথ আশ্রম থেকে এডপ্ট করেছে। ‘বেবি তুমি খেয়েছো?’ , ‘ বেবি তুমি ঠান্ডায় এরকম বাইরে বসে আছো কেন! যদি তোমার জ্বর সর্দি হয়!’ সারাক্ষণ শুধু বেবি বেবি! কেন রে বাবা, আমার এত ভালো একটা নাম আছে, প্রিয়া। সেটা বলে ডাক! তা না বেবি! আমি তো ঠিকই করেছি, কলকাতায় ফিরেই এবার ব্রেক আপ। আর সহ্য হচ্ছে না আমার।”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেছিল প্রিয়া। তবে ওর এইসব কথা শুনে অচিন্ত জোর করেও হাসি কন্ট্রোল করতে পারেনি নিজের। আর ভ্রমর তো বতৃশ পাটি বার করেই বলেছিল,
—-” প্রিয়া, এই নিয়ে তুই এই বছরে টোটাল চারবার ব্রেক আপ করলি অবিরদার সাথে! আসল কথা স্বীকার কর। তুইও তোর বেবিকে ছাড়া থাকতে পারিস না একটুও। দুদিন কথা না হলেই পাগল হয়ে যাস।”
প্রিয়া এই কথায় আর ঠিক কোন উত্তর করেনি সেদিন। শুধু মুখ ফুলিয়ে বসেছিল কিছুক্ষণ অকারণ রাগে।

<৮>
এই রাগ অভিমানের পর্ব মিটে এখন ঘড়িতে রাত এগারটা। পুরো দার্জিলিং শহরের সাথে প্রিয়াও ঘুমের দেশে। কিন্তু ভ্রমরের চোখে এখনো ঘুম নেই। আসলে বাড়িতে তো রাত বারোটা একটার আগে কোনদিন বিছানায় যায় না, তাই বেড়াতে এসেই বা অভ্যাসটা বদলায় কিভাবে! যদিও প্রিয়ার এইসব কোন সমস্যা নেই। ওর যখন তখন যেকোন জায়গায় ঘুমিয়ে পরার একটা অদ্ভূত ট্যালেন্ট আছে। সেইদিন হোটেলের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভ্রমর এইসবই ভেবে যাচ্ছিল আনমনে। আর দেখছিল হাজারটা জোনাকির মতন আলো ছড়িয়ে আছে দূরের পাহাড়গুলোর বাড়িগুলোতে। তার মাঝে আকাশেও রুপোলি চাঁদ, এক ঝাঁক তারা! তাই কেমন যেন স্বপ্নের শহর লাগছিল দার্জিলিংকে এখন। এইসব এলোমেলো চিন্তার ভিড়েই ঠান্ডায় নিজের চাদরটাকে আরেকটু বেশি ভালো করে জড়িয়ে নিল ভ্রমর। আর এই সময়েই পাশের ব্যালকনি থেকে সেই চেনা গলার স্বর,
——” কি হলো! জেগে এখনও? ঘুম আসছে না?”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here