একা_তারা_গুনতে_নেই — লামইয়া চৌধুরী। পর্বঃ ৪১

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৪১
মায়ের কথায় বাধ্য হয়ে দীপাকে কল করতে হলো। কাদিন ফোন ধরে বলল, “চলে এসেছি। এই তো আর পাঁচ দশ মিনিট।”
দীপা ফোন রেখে মাকে বলল, “হলো তো? কিছুই হয়নি কাদিনের সাথে। চলে আসছে। আমাকে কেউ বিশ্বাস করে না। সব দোষ দীপার।” কারেন্ট চলে গেল হঠাৎ। দীপা বলল, “এখন বলো কারেন্টও আমার জন্য চলে গেছে।”
বলেই ফুঁসতে ফুঁসতে চট করে উঠে দাঁড়াল। দীপার কোলের উপর রাখা পিরিচটা ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল মেঝেতে। দীপার মা চোখ লাল করে তাকিয়ে বলল, “এখন বল পিরিচ ভাঙায় তোর দোষ নেই?”
দীপা চোখ বন্ধ করে জিহ্বা কাটল। তারপর চোখ খুলে অপ্রস্তুত হয়ে হেসে বলল, “আরেকটা কিনে দিব তোমায়? ঐ যে ছোট ছোট রজনীগন্ধা আঁকা…”
দীপার মা কঠিন ধমক দিয়ে বললেন, “সামনে থেকে সর তুই।”
দীপা ধমক খেয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে পালাচ্ছিল। ওর মা আরো রেগে গিয়ে বললেন, “কাঁচের টুকরাগুলো কে পরিষ্কার করবে? আমি?”
দীপা বলল, “না, না আমিই করছি।”
ও দৌড়ে এসে কাঁচের টুকরোগুলো তুলে ঝুড়িতে ফেলল। তারপর ঝাড়ু হাতে নিয়ে মেঝে পরিষ্কার করতে শুরু করতেই কলিংবেল বেজে উঠল। চোখের পলকে দীপা হাতের ঝাড়ু ফেলে বলল, “মা, কাদিন এসে গেছে। এখন আমার হাতে ঝাড়ু দেখলে অগণিতবার হাত ধুয়াবে আমায়। বাকিটা তুমি করো। কোথায় বিয়ে দিয়েছ আমায়? কী যন্ত্রণা!” বলতে বলতে দীপা গিয়ে দরজা খুলল। কাদিনকে দেখে মিষ্টি করে হাসল। কাদিন ইশারায় কি যেন বুঝাল দীপা বুঝল না। সে বিরক্ত হয়ে বলল, “মুখে বলুন না। কিসব ইশারামশারা শুরু করেন।”
কাদিন অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে বুঝতে পেরে দীপার মা’ই সরে গেলেন। কাদিন খুব নীচু লয়ে বলল, “আমার সাথে ঘরে আসতে বলছিলাম।”
দীপা বলল, “তো জোরে বলেন না। এত ফিসফিসের কি আছে?”
কাদিন মিনমিন করে বলল, “আল্লাহ আমায় ধৈর্য্য দাও।”
নিঃশব্দে চলে এল সে ভেতরে। দীপাও এল পেছন পেছন। কাদিন পকেট থেকে কালো রঙা ছোট একটা ভেলভেট রিং বক্স বের করে বলল, “এটা তোমার জন্য।”
দীপা অবাক চাহনি নিয়ে হেসে বলল, “আপনি না বললেন বাসায় যাচ্ছেন?”
কাদিন বক্স খুলে আংটি বের করতে করতে বলল, “হ্যাঁ, বাসায় গিয়েছিলাম। বিয়ে ঠিক হওয়ার পরপর’ই প্রথম রাতে উপহার দিব বলে কিনেছিলাম।”
দীপা উশখুশ করতে করতে জিজ্ঞাসা করেই ফেলল, “দিননি কেন?”
কাদিন দীপার হাত ধরে আঙুলে রিংটা পরিয়ে বলল, “তখন প্রয়োজন মনে করিনি। আজ প্রয়োজন মনে হলো তাই মনে পড়ার সাথে সাথে যাঁরটা তাকে বুঝিয়ে দিলাম।”
“এখন কিসের প্রয়োজন? লাগবে না যান।”
কাদিন হালকা হাসল, “রেগে ছিলাম।”
হুহ রাগ খালি উনার সম্পত্তি। আর আমার রাগ হয়না, না?” মুখে এক ছটাক কালো মেঘের বসতি নিয়ে দীপা সরে আসছিল।
কাদিন দীপার ওড়না টেনে ধরল, “তাহলে এসো রাগ ভাঙিয়ে দিই।”
দীপা রেগে বলল, “আমি এখনি এটা খুলে ফেলব। লাগবে না আমার।”
কাদিন বলল, “আচ্ছা ওড়না তুমি খুলবে? খুলো।”
দীপা থতমত খেয়ে গেল। বলল, “আমি আংটির কথা বলেছি।”
কাদিন বলল, “কে জানে তুমি কোনটার কথা বলেছ?”
দীপা টান দিয়ে কাদিনের হাত থেকে ওড়না ছাড়িয়ে ঝাঁজাল কণ্ঠে বলল, “শয়তান লোক একটা!”
ছাড়িয়ে নিলে কি হবে? কাদিন আবারো ওড়না টেনে ধরল, সাথে দীপাকেও।
.
এই ভর দুপুরে দরজা খুলে শিল্পীকে দেখে ইমাদ অবাক হলেও বলল, “আসুন।”
শিল্পী বলল, “ভেতরে আসার নিয়ম আছে?”
“জি।” ইমাদের ছোট উত্তর।
শিল্পী ভেতরে এল, “কেমন আছো?” ওর কণ্ঠস্বর ক্লান্ত, হাঁটার সময় টলছেও।
ইমাদ টেবিলের পাশের চেয়ার টেনে এনে বলল, “বসুন।”
শিল্পী বসল। ইমাদ বসল চৌকিতে। শিল্পী বলল, “অসময়ে তোমায় বিরক্ত করলাম। কিছু মনে করোনি তো?”
“সমস্যা নেই।”
শিল্পী হাতের ব্যাগটা নামিয়ে রাখল, “মুবিনকে নিয়ে কথা বলতে এসেছি।”
“আচ্ছা।” ইমাদ দেখল শিল্পীর চোখ অসম্ভব রকমের লাল। সেই লাল চোখের নীচে গভীর কালি। শিল্পী কেঁদে ফেলল, “ইমাদ, আমার ছেলেটা এখন হাসপাতালে।”
“কেমন আছে?”
“আগের চেয়ে ভালো।”
“আচ্ছা।”
শিল্পী ভেবেছিল মুবিনের কি হয়েছে ইমাদ জানতে চাইবে, কিন্তু সে নিঃশব্দ। শিল্পী ওড়নায় চোখের জল মুছে বলল, “মুবিন, সুইসাইড করতে চেয়েছিল।”
ইমাদের নিশ্চল দৃষ্টি কয়েক সেকেন্ডের জন্য চঞ্চল হলো, “কেন?”
শিল্পী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “আমি আর ওর বাবা ডিভোর্স নিচ্ছি।”
“আচ্ছা।”
“মুবিনের উপর খুব বাজে ইফেক্ট পড়েছে এটার। ও বাসা থেকেও পালিয়েছিল। একা একা কাউকে না বলে কক্সবাজার চলে গিয়েছিল।”
“আচ্ছা।”
“সেখান থেকে টেকনাফ যাওয়ার পথে পুলিশ ওকে আইডেনটিফাই করতে পারে।” শিল্পী অনেক চেষ্টা করে স্বাভাবিকভাবে কথা চালিয়ে নিচ্ছে।
ইমাদ প্রশ্ন করল, “পরে?”
“বাসায় নিয়ে আসবার পরেই…” বাকিটা শেষ করতে পারল না সে। কষ্টে ওর দম বন্ধ হয়ে আসার সাথে সাথে কথাও বন্ধ হয়ে এল।
ইমাদ জানতে চাইল, “মিলা?”
শিল্পী বলল, “আল্লাহর রহমতে মিলা নিজেকে সামলে নিতে জানে। মুবিনকে নিয়ে কি করব কিছু বুঝি না। কোনো উপায় না পেয়ে তোমার এখানে এলাম।”
“আচ্ছা।”
“আমি জানি মুবিন প্রচন্ড বেয়াদব। এজন্যই তুমি আর পড়াতে যাও না। তবুও এলাম।”
ইমাদ বলল, “আমার খুব টাইট শিডিউল চলছে। নতুন টিউশনী নিয়ে ফেলেছি।”
শিল্পী বলল, “পড়াতে বলছি না, ও কথা বলবার মুখও নেই। মিলার কাছ থেকে শুনেছি ও তোমার সাথেও বেয়াদবি করেছে।”
“কি করতে পারি?”
“মুবিন আমার কিংবা ওর বাবার কারো কাছেই থাকবে না বলে দিয়েছে। ছেলেটার যে অবস্থা জোর করে ওর উপর কিছু চাপিয়ে দেয়ার মত সাহস আর আমাদের নেই। ওকে আমি তোমার কাছে দিতে চাইছি। ধরো তোমার সাথে এই মেসেই থাকল। তুমি ওকে দেখে রাখবে। ফর দ্যাট আ’ল অনার ইউ।”
ইমাদ নিঃসঙ্কোচে বলল, “মুবিন আমাকে যথেষ্ট অপছন্দ করে। ওর এখন এমন কারো কাছে থাকা উচিত যাকে ও পছন্দ করে, যাঁর কাছে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।”
শিল্পী মরিয়া হয়ে বলল, “মুবিন সবাইকেই অপছন্দ করে। এমন কেউ নেই যাঁর কাছে আমার ছেলেটা একটু শান্তিতে থাকবে।”
“তাহলে আমি হোস্টেল প্রেফার করব। এই বয়সী একটা ছেলে মেসের চাইতে হোস্টেলে ভালো থাকবে।”
“হোস্টেলের ধরাবাঁধা নিয়মের সাথে ও কখনো নিজেকে মানিয়ে নিবে না। অবস্থার আরো অবনতি হবে। ও স্বাধীনচেতা। তাছাড়া হোস্টেলে কতরকমের ছেলেপেলে থাকে। আরো বখে যাবে।”
“আমার কাছেই কেন?”
“যথেষ্ট বয়স হয়েছে আমার। মানুষ দেখলে আজকাল চিনতে পারি। মা হিসেবে বিশ্বাসযোগ্য, সৎ কোনো মানুষকে ছেলের জন্য বেছে নেয়াটাই স্বাভাবিক।”
ইমাদ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। ওকে থামিয়ে শিল্পী হাত জোড় করে বলল, “আমার জায়গা থেকে একবার ভেবে দেখো। আমি যতটা পারব তোমার জন্য করব।”
“ওর আমার সাথে থাকাটা ঠিক হবে না। আর ও হয়তো থাকতে চাইবেও না।”
“আর কোনো উপায় না দেখলে হয়তো থাকবে।”
শিল্পীর কাতর অনুনয়ে ইমাদ অনেক ভেবে বলল, “আমার ঘরে রাখতে পারব না। তবে ও যদি এই মেসে থাকে আমি নাহয় ওর উপর চোখ রাখলাম।”
শিল্পী সাথে সাথে এই প্রস্তাব লুফে নিলো। আপাতত এইটুকুই অনেক।
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here