একা_তারা_গুনতে_নেই — লামইয়া চৌধুরী। পর্বঃ ৪০

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৪০
মিলা মুবিনের দিকে তাকিয়ে আছে। মুবিনকে মা – বাবা খুঁজে নিয়ে এসেছেন। ও এখনও তার বালুমাখা পোশাক বদলায়নি। ড্রয়িংরুমে সাজিয়ে রাখা ম্যাজিকবল ভরতি কাঁচের বোতল নিয়ে খেলছে ও। মিলা ভেবেছিল মুবিন এলেই মুবিনকে জড়িয়ে ধরবে, অনেক বকবে সাথে স্যরিও বলবে। অথচ, সে ভেবে রাখা কিছুই করতে পারেনি। মুবিনও ওর দিকে একবারো তাকায়নি।
“যতদ্রুত সম্ভব ব্যবস্থা করো।” শিল্পী বলল।
শিল্পীর কণ্ঠস্বর শুনে মিলা মুবিনের উপর থেকে দৃষ্টি সরাল। মা- বাবার দিকে তাকাল এবার।
বিধ্বস্ত মঈন টাই ঢিল করতে করতে বলল, “কিসের ব্যবস্থা?”
“সেপারেশনের।”
মঈন ছোট করে বলল, “ওহ।”
শিল্পীর কথা শেষ। ও উঠে চলে যাচ্ছিল। মঈন বলল, “মুবিন অবশ্যই আমার কাছে থাকবে।”
শিল্পী থামল। ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, “আমার ছেলে কিংবা মেয়ে কাউকেই আমি তোমার মত নীচু প্রকৃতির মানুষের কাছে বড় হতে দিব না।”
“আমি মানব কেন?”
“আদালত পর্যন্ত যেতে না চাইলে মানবে।”
মঈন হা হা করে অট্টহাসি হাসতে লাগল। যখন থামল তখন বলল, “তোমাকে যেন কেস মামলায় যেতে নাহয় এজন্য এতদিন ধরে বুঝাতে চেষ্টা করলাম। মিলাকে তোমার কাছে রাখব এটাও বললাম। এসবের জন্য ডিভোর্সটাও এক এক করে অনেকগুলো দিন পেছাল। তবুও তুমি যখন মানলে না আমার আর কিছু করার নেই। আদালতেই চলো।”
শিল্পী বলল, “তুমি যা মানুষ নিজের স্বার্থের বাইরে এক পাও হাঁটো না। আদালতে গেলে শূণ্যহাতে ফিরবে বলেই এতদিন আমাকে বুঝাতে চেষ্টা করেছ। কথা বলার আগে ভেবে কথা বলবে।”
“আমি কোনো নীল নকশাকারী নই যে ভেবেচিন্তে কাজ করব, ভেবেচিন্তে কথা বলব।”
শিল্পী সরে এসে এবার সোফায় বসল। বলল, “কি বলতে চাইছ?”
“তোমার মত অত ভেবে কাজ করার মত বুদ্ধি আমার কখনো ছিলও না, আর হবেও না।”
“যা বলবার সরাসরি বলি।”
মঈন একগালে হাসল, “বাচ্চাদের সামনে তোমাকে ছোট করতে চাই না।”
শিল্পী কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। পরে বলল, “আমি আমার ছেলেমেয়েদের ছুঁয়ে বলতে পারব যে আমি জোহরার বিয়ের কার্ড সেদিন পাইনি। জোহরা আমাকে কোনো কার্ড দেয়নি। জোহরা সেদিন এসেছিল হলে, কিন্তু আমি কোনো বিয়ের কার্ড পাইনি।”
মুবিন প্রসঙ্গটা ধরতে না পারলেও মিলা জোহরার নাম শুনে চমকে উঠল। মায়ের কাছে ও শুনেছে। কিন্তু মা তো বিয়ের কার্ড নিয়ে কোনো কথা ওকে বলেননি!
মঈন হাহা করে হাসতে হাসতে বলল, “ওহ কাম অন। এইসব ছোঁয়াছুঁয়িতে আজকাল কে বিশ্বাস করে? তুমিও করো না। তাই বলতে পারছ। জাস্ট ফরগেট ইট। যা করেছ শাস্তি পাচ্ছো। সাফাই গাইবার চেষ্টা করো না।”
“আমি কিচ্ছু করিনি। করার মধ্যে তোমার কথায় তোমাকে বিয়ে করেছি, তোমার দুঃসময়ে পাশে থেকেছি। আর আজ তার প্রতিদান পাচ্ছি।”
মঈন সিগারেট ধরিয়েছে। আঙুলের ফাঁকে সিগারেট চেপে ধরল সে। ঠোঁটে দেয়নি। পায়ের উপর পা তুলে আরাম করে বসে বলল, “ওসব কীর্তন আমায় শুনিয়ো না। জাস্ট গোউ টু হেল।”
শিল্পী শক্ত জবাব, “জাহান্নামে তো তুমি যাবে। আর যাবে তোমার জোহরা। যাকে আমি লুকমা তুলে খাইয়েছি অথচ, ও আমার সংসার ভেঙেছে।”
মঈন সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে বলল, “জোহরাকে দোষ দিতে লজ্জা করছে না একটুও?”
“বেহায়াপনা করে বেরানোর পুরুষমানুষ আমাকে লজ্জার পাঠ না শেখালেই আমি খুশি হব।”
“শাট আপ, শিল্পী। ছেলেমেয়ের সামনে কি করে কথা বলতে হয় তাও জানো না। ক্লাসলেস মহিলা কোথাকার।” মঈন হুংকার দিয়ে উঠল।
শিল্পী হিসহিস করে বলল, “ওদের কি চোখ নেই? ওরা যথেষ্ট বড়। আমি ওদের সামনে না বললেও ওরা বুঝে গেছে যে ওদের বাবা বেহায়াপনা করে বেড়ায়, মেয়ে নিয়ে ফূর্তি করে। আমার মনে হয় না ওরা কেউই তোমার কাছে থাকতে চাইবে।”
মিলার এসব শুনতে একটুও ভালো লাগছিল না। ও চলে যাচ্ছিল। মঈন ডাকল, “মিলা যেও না। আমারটা যখন জেনেছ তোমার মায়েরটাও জেনে যাও। তোমার মা একজন প্রতারক, মিথ্যেবাদী, হিংসুটে মহিলা। আমি যা করেছি শুধু ওকে শাস্তি দিতে করেছি।”
শিল্পী সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করল। নিঃশব্দে হেসে শ্বাস ফেলল ধীরে ধীরে। মঈন অস্থির হয়ে বলল, “মুবিন, মিলা লিসেন টু মি। আমি যা বলতে চাইছি মনোযোগ দিয়ে শুনো। মুবিন বোতল রাখো। আমার দিকে তাকাও। কথা শুনো। তোমাদের মা আমার সাথে কি করেছে শুনলে তোমরা কখনো আমায় ছেড়ে যাবে না।”
মুবিন বোতল রাখল না। মঈন সোফা ছেড়ে উঠে এসে ছেলের মুখটা দু’হাতে তুলে ধরে বলল, “বাবা, তাকাও আমার দিকে। এটা রাখো। প্লিজ।”
মুবিন বোতলটা রেখে উঠে দাঁড়াল। তারপর খুব শান্ত অথচ কঠিন এবং দৃঢ়প্রত্যয়ী কণ্ঠে ঘোষণা করল, “আমি কারো কাছে থাকব না। একা থাকব। ”
মঈন মুবিনের কাঁধে ঝাঁকি দিয়ে বলল, “চুপ করো, মুবিন। কি বলছি শুনো আগে।”
মুবিন ওয়ালশেলফ থেকে ম্যাজিক বল ভরতি বোতলটা হাতে নিয়ে মেঝেতে ফেলে দিলো। নানা রঙের রঙিন কিছু বল রঙিন শৈশব ছেড়ে ছুটে গেল দিক্বিদিক। রঙিন শৈশব আর ধারণ করবার বোতল বাধ্য হয়ে হয়ে উঠল মরণাস্ত্র। মুবিন ঝুঁকে সেই আধভাঙা কাঁচের বোতল হাতে তুলে নিজের অন্য হাত বরাবর চালিয়ে দিলো। ফিনিক ফোঁটা লাল জোছনা গড়িয়ে পড়ল হাত থেকে। শিল্পী সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে একটা চিৎকার দিলো।
.
দীপার মা জানতে চাইলেন, “কিরে জামাই এই দুপুরে কোথায় গেল? খাওয়ার সময় যে চলে যাচ্ছে।”
দীপা মুখ ভরতি বার্গার নিয়ে কথা বলতে পারছে না, তবুও কোনোমতে বলল, “বাসায় নাকি কি কাজ আছে তাই গেল।”
“কি এমন কাজ যে অত পাগল পাগল হয়ে গেল?”
দীপা বলল, “আমাকেও কিছু বলেনি যে, মা।”
“উমাহ তুই জানতে চাইবি না?”
“জানতে চাইবার সুযোগই হয়নি। বসে বসে টিভি দেখছিল। আচমকা উঠে দাঁড়াল। বলল, আমি একটু বাসায় যাচ্ছি।”
দীপার মা চিন্তিত হয়ে বিড়বিড় করলেন, “জামাই তো ফিটফাট না হয়ে নীচের দোকানটায়ও যায় না, ছাদেও যায় না। কি যে হলো কোনোমতে দৌড় দিল! দীপার সাথে কিছু হয়নি তো!” একটু ভেবে তিনি বলেই ফেললেন, “সত্যি সত্যি বল তো জামাই তোর উপর রাগ করেছে? রাগ করে চলে গেছে?”
দীপা মায়ের কথা শুনে আকাশ থেকে পড়ল, “আরে না।”
“দেখ লুকাবি না। ভয়ে আমার আত্মা শুকিয়ে যাচ্ছে। তোর যা স্বভাব! যে কোনো মানুষকে দশ মিনিটে বিরক্ত করে তুলিস, রাগিয়ে দিস।”
দীপা বলল, “আরে না, মা। বিশ্বাস করো আমি কিছুই করিনি।”
“তুই যে কখন কি করিস নিজেও বুঝিস না। চুপ থাক। তুই আমার সামনে কল দে তো দেখি। আমার সামনে কাদিনের সাথে কথা বলবি।”
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here