একা_তারা_গুনতে_নেই — লামইয়া চৌধুরী। পর্বঃ ৩১

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৩১
শিল্পী বলল, “তোর বান্ধবীদের আসতে বলেছিস তো?”
মিলা চুলের কাটা খুলে, চুলে দুই ঝুঁটি করতে করতে বলল, “হু।”
শিল্পী বলল, “নীল স্কার্টটা পর না। এটা কেন?”
মিলা মায়ের দিকে তাকিয়ে জোর করে হেসে বলল, “ঠিক আছে।”
শিল্পী যেতেই দরজা আটকে মিলা পোশাক বদলে নীল স্কার্ট পরল। সুহাকে কল করল সে, “আসছিস তো?”
সুহা বলল, “না।”
“কেন?”
“তোর জন্মদিন যদি কেউ কোনোদিন পালন করে তবে সেদিন যাব।”
“আহ এমন করিস না তো।”
“আমি গেলে কিছু একটা উল্টাপাল্টা বলে ফেলব, দেখিস।”
“আয় না।”
“না।” সুহা খট করে মোবাইল রেখে দিলো।
.
মুবিন আজ এত খুশি যে ওর অপছন্দ হওয়া সত্ত্বেও মায়ের পছন্দের ডেনিম শার্ট এবং নীল জিন্স পরল। শিল্পী খুশি হয়ে মুবিনকে অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরে রাখল। মুবিন খানিক লজ্জা পেল। শেষটায় ধৈর্য্যহারা হয়ে বলল, “আর কতক্ষণ মা? ছাড়ো না।”
“না, ছাড়ব না। তোর বুকে অনেক শান্তি বাপ! কি লম্বা হয়ে গেছিস! মাশাআল্লাহ্।”
মঈন ঘরে ঢুকে মা ছেলেকে একসাথে দেখে নিজেও এগিয়ে গেল, “দেখি আমার চেয়ে লম্বা কিনা তোমার ছেলে?”
মুবিন উৎসাহে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বাবার কাঁধের সাথে কাঁধ মেলাল, “এই তো আর একটু।”
“একটু না অনেকটুকু। এখন কানের দুল খোল।” মঈন হাত বাড়িয়ে দিলো।
মুবিন বিনাবাক্যে কান থেকে দুল খুলে বাবার হাতে দিলো। আজ বাবাকে খুব ভালো লাগছে। বাবা- মা সবসময় এমন থাকতে পারেন না? একঅপরের সাথে যুদ্ধ কেন করেন? এই সুখী বাবা, মায়ের সাথে একটা ছবি তুলে ফেললে কেমন হয়? ছবিটায় ওরা হাসতে থাকবে। বাবা মুখ মেঘকালো করে রাখবেন না, মায়ের চোখ দীঘির মত কান্না টলমলে হবে না। আর মিলা? মিলা কোথায়? মুবিন বলল, “একটু দাঁড়াও, একটা ছবি তুলব আমরা। মিলাকে ডেকে নিয়ে আসি।”
মুবিন দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে গেল। মেহমানরা ধীরে ধীরে আসতে শুরু করেছে। মিলা ড্রয়িংরুমে হাসি মুখে সবাইকে অভ্যর্থনা জান্নাচ্ছে। সে হাসি উদারতার হাসি। হাসিতে কষ্ট মিশে আছে, তবে হিংসে নেই। বেদনা আছে, জ্বলন নেই। মুবিন পাশে দাঁড়িয়ে বলল, “একটা ছবি তুলব। আয় তো।”
মিলা বলল, “পরে।”
“না, এখনি।”
মুবিন ঘরে গিয়ে ছবি তুলবার উদ্দেশ্যে মা – বাবার মাঝে দাঁড়িয়ে মিলার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। মিলা বেশ সময় নিয়েই এল। ঘরের ভেতরে আসার পরিবর্তে ও ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে মোবাইল হাতে ওদের ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল, “বাবা, তোমার টাইটা বাঁকা হয়ে আছে।”
মঈন মুবিনের কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে টাই ঠিক করে দাঁড়াল। মিলা একটা ক্লিক নিয়ে নিলো। মুবিন অবাক হয়ে বলল, “তুই সহ, স্টুপিড।”
“না আমার ছবি তুলতে ইচ্ছে করে না।”
“শুধু পড়াশুনা করে বড় বড় মার্কস নিয়ে এলেই স্মার্ট হওয়া যায় না।” মুবিন রাগে শুধু এটুকুই বলতে পারল!
মিলা হাসল, “আমি অত স্মার্ট নারে।”
মুবিন বলল, “মিথ্যে কেন বলছিস? নিজের ফ্রেন্ডের সাথে ত সারাদিন’ই সেলফি তুলিস। আমার সাথে ছবি তুলবি না এটা বল।”
মিলা দেখল মুবিন রাগ করে ফেলছে। আসলে স্টুপিড ও নয়, স্টুপিড মুবিন। ওকে সাথে নিয়ে ছবি তুলবার প্রয়োজনটা কি? মা-বাবাকে তাদের ছেলের সাথেই মানায়। ওকে ক্যামেরাম্যানের চরিত্রে দেখতে তাঁদের খুব একটা খারাপ নিশ্চয়ই লাগবে না। বরং মুবিনকে মাঝে দাঁড় করিয়ে শুধু তিনজনের আকাঙ্ক্ষিত একটি ছবি খুব সহজেই তাঁরা পেয়ে যাবে। মিলা নিজের মুখকে সংবরণ করল। নাহয় সে খুব সহজেই বলতে পারত যে, “আমি সহ তুলতে গেলে যে সমস্যা হয়ে যাবে, আমার অতি প্রিয় বোকা ভাই। তোকে ছবিতে কে পাশে পাবে তা নিয়ে যে তর্কাতর্কি, রক্তারক্তি কোনো কান্ড ঘটবে না তার নিশ্চয়তা কি তুই দিতে পারবি? আমি চাই না তোর জন্মদিন ভেস্তে যাক।”
মুবিন অপেক্ষা করতে করতে স্বভাবসুলভ ধৈর্য্যহারা হয়ে উঠল এবং রেগে গিয়ে বলল, “যাহ তুই, তোর ছবি তুলতে হবে না।”
মিলা নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “উফ, মুবিন আমার মেকআপ এখনও বাকি, তাই তুলতে চাইছিলাম না।”
মুবিন সরে এসে মিলাকে ধাক্কা দিয়ে পিছনে ঠেলে দিয়ে বলল, “চুপচাপ দাঁড়া এখানে। গর্দভ একটা!”
মিলা একটুও রাগ করল না। বরং প্রশস্ত হাসি হেসে মা – বাবার মাঝে দাঁড়িয়ে তাঁদের চারজনের জীবনের একসাথের শেষ এবং চিরস্মরণীয় ছবিটি তুলল। ছবিটি তাঁদের সবচেয়ে প্রিয় ছবির দলে যোগ দিলো, কিংবা যুক্ত হলো অন্যতম কুৎসিত এক ফ্রেমেবন্দি স্মৃতি হয়ে। কারণ এর কিছুক্ষণ পর’ই এক ফরাসী নারী বিনা আমন্ত্রণে মুবিনের অভূতপূর্ব সেই জন্মদিনে অতিথি হয়ে এল। তাঁর পরিচয় সে মুবিন এবং মিলার বাবা মঈনের প্রেয়সী। সে মঈনের অসুস্থতার খবর পেয়ে সুদূর ফ্রান্স থেকে ছুটে এসেছে তাকে শুধু এক নজর দেখবার জন্য। তাঁর নাম মিশেল, মিশেল উড।
.
মিশেলকে স্বচক্ষে দেখে শিল্পী আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি। মেহমানের ভয়ে মঈনকে ছেড়েও কথা বলেনি, “এই সেই রূপসী, মঈন? আমার ধারণা তাহলে ভুল ছিল না।”
মঈন শিল্পীর হাত ধরে তাকে হলঘর থেকে নিজেদের শোবার ঘরে টেনে নিয়ে যেতে চাইল। শিল্পী হাত ছাড়িয়ে বলল, “খবরদার ছুঁবে না আমায়। এখন এত লজ্জা কিসের? জানুক লোকে!”
মঈন বলল, “আই ক্যান এক্সপ্লেন!”
“না, তুমি পারো না।”
“ঠিক আছে ঘরে চলো।”
শিল্পী যেতে চাইল না। মঈন জোর করে টেনে নিয়ে গেল। দরজা বন্ধ হয়ে গেল ওদের ঘরের, কিন্তু দাম্পত্যকলহের কোলাহল ছড়িয়ে পড়ল হলঘরের প্রতিটি কোণায় কোণায়, প্রতিটি নিমন্ত্রিত লোকের কোল্ডড্রিঙ্কসের গ্লাসে গ্লাসে, কেকের টুকরো বহনকারী নকশাকৃত পিরিচে পিরিচে। শিল্পী আর মঈনের চেঁচামেচি, ফুলদানির ভাঙন, মিশেলের উপস্থিতি ইত্যাদি চারিদিকে গুঞ্জন আর রঙতামাশা দেখা এমন কিছু চাহনির সৃষ্টি করল, যেসব চাহনি দেখে মুবিন দৌড়ে চলে গেল নিজের ঘরে। সে একা থাকতে চায়। মিলা মেহমানদের কাছে দায়িত্ব নিয়ে ক্ষমা চাইল। মুবিনের জন্য নিয়ে আসা উপহারসামগ্রী রেখে মেহমানরা চলে যেতেই মিশেল মিলাকে একা পেয়ে ইংরোজীতে বলল, “তোমার নাম মিলা?”
মিলা দাঁতে দাঁত ঘঁষে শুদ্ধ বাংলায় বলল, “আর তুমি নিশ্চয়ই কোনো ডাইনী।”
জানালা দিয়ে সব মেহমানদের চলে যেতে দেখে মুবিন নিজের ঘর থেকে বের হয়ে এল। সে বলল, “এই মহিলাকে বলে কি হবে? বলতে হলে তোর মা – বাবাকে বল।
মিশেল আবারো ইংরজীতে প্রশ্ন করল, “কি বলছ তুমি?”
মিলা এইবার ইংরেজীতে বলল, “নাথিং এন্ড প্লিজ লিভ আস এলোউন।”
মিলা নিজের ঘরে চলে গেল। মুবিন মিলার পেছন পেছন গিয়ে বলল, “দেখলি তোর মা – বাবার কাণ্ডটা? পরে কথা বলা যেত না? সবার সামনেই বলতে হবে? মার এভাবে সবার সামনে রিএক্ট করা ঠিক হয়নি। সবাই কি বলছিল? আমি কাল থেকে আর স্কুলেই যাব না। ক্লাসে গোসিপ করার নতুন খোরাক পেয়য়ে গেল ওরা।”
মিলা বলল, “যাস না। তুই স্কুলে গিয়ে করিসটাই’বা কি? পড়াশুনা ত আর করিস না।”
“তুই আমার সাথে এমন করে কেন কথা বলছিস?”
মিলা বলল, “তুই এখন এখান থেকে যা।”
মুবিনও চটে গেল, “না গেলে কি করবি? আমি যাব কেন?”
“মেহমানদের মাঝে থেকে যেভাবে পালিয়ে গিয়েছিলি এখন এমন গলাবাজি করতে লজ্জা করে না!”
মুবিন বড্ড অপমানিত বোধ করল। সে উপর নীচ মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “ওহ এখন বুঝেছি। তোর তো আনন্দ হচ্ছে। মা – বাবা আমার জন্মদিন পালন করেছে সে হিংসেই তুই জ্বলে যাচ্ছিলি। এখন সব ভেস্তে গেছে তাই খুব খুশি তাইনা?”
মিলা অবজ্ঞার হাসি হেসে বলল, “আমি জীবনেও তোর মত আর একটা স্বার্থপর ছেলে দেখিনি। মা – বাবার সংসার ভেঙে যাচ্ছে, বাড়িতে এক অপরিচিতা মহিলা আর তুই পড়েছিস কে কি বলল তা নিয়ে!”
“আমি স্বার্থপর? আমি?” মুবিন চেঁচিয়ে উঠল।
মিলা স্বাভাবিক গলাতেই বলল, “হ্যাঁ তুই স্বার্থপর। সবসময় নিজের কথাই ভাবিস। না ভাবিস মা – বাবার কথা আর না ভাবিস আমার কথা! প্রতিবার মা – বাবা যখন শুধু তোর জন্মদিন পালন করেন আর আমার বেলায় ওদের তারিখটা পর্যন্ত স্মরণ থাকে না তখন তুই তা দেখেও না দেখার ভাণ করে থাকিস। মা যখন আমার ঘরের পাখা নষ্ট হয়ে গেলে নতুন পাখাটা কিনে তোর ঘরে লাগায় আর তোর পুরোনো পাখাটা আমার ঘরে নিয়ে আসে তখনও তুই চুপ। আর আমায় এসে বলিস আমি হিংসুটে! আমি যদি হিংসুটে হয়ে থাকি তবে তুইও স্বার্থপর।”
চকিতে মিলাকে ধাক্কা দিয়ে নীচে ফেলে দিলো মুবিন। মিলা উঠে বসল, দাঁড়াল না, মেঝেতেই বসে রইল। রাগান্বিত মুবিনের চোখ লাল, জল টলমলে। পকেটে হাত রেখে ও মিলার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই আমাকে এত হিংসা করিস, রোদমিলা? এত?”
মিলা চুপ করে রইল। মুবিন ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here