একা_তারা_গুনতে_নেই — লামইয়া চৌধুরী। পর্বঃ ৩০

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৩০
বাইরে দাঁড়িয়ে ইমাদ কড়িকে কয়েকবার কল করল। কড়ি প্রতিবারই কল কেটে দিয়েছে। শেষে কোনো উপায় না পেয়ে কড়ির ঘরের পেছনের জানালায় ইমাদ ধাক্কা দিলো। জানালা ভেতর থেকে বন্ধ না থাকায় চট করে খুলে গেল। কড়ি উপুড় হয়ে বালিশে মাথা রেখে শুয়েছিল। ভড়কে উঠল সে, “আপনি? এখানে?”
ইমাদ বলল, “স্যরি আমি বুঝিনি জানালা খোলাই ছিল। কড়া নাড়তে ধাক্কা দিতেই খুলে গেছে।”
“আপনি এখানে কি করছেন?” কড়ি কঠিন করে বলল।
“কথা বলতে এসেছি। অনেকবার কল করেছিলাম। কেটে দিয়েছেন।”
“যেহেতু কল কেটে দিয়েছি আপনার বোঝা উচিত যে আমি কথা বলতে চাইছি না।”
“আচ্ছা।”
কড়ি এগিয়ে এসে জানালা বন্ধ করে দিলো। পরে রাতে খাওয়ার সময় ইমাদকে কেউ খুঁজে পেল না। সবাই হয়রান হয়ে গেল। নিলয় অনেকবার কল করার পরও ইমাদ কল ধরল না। দীপা কল করতেই রিসিভ করল সে। দীপার কল কেটে দিলে ও কেঁদেকেটে মরে যাবে। তাই বলল, “তোরা খেয়ে নে।”
দীপাকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে কল কেটে দিলো। কড়ি খাওয়া দাওয়া শেষে ঘরের দরজা আটকে জানালা খুলে দেখল ইমাদ সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। কড়ি হতাশ হয়ে বলল, “কি যে করি আপনাকে নিয়ে! শুনেননি আমার বিয়ের তারিখ ঠিক করছেন, বাবা?”
ইমাদ বলল, “শুনেছি।”
“তাহলে?”
“এজন্যই এখানে।”
“আপনি শার্টের বোতাম লাগান। এভাবে কথা বলতে অড লাগছে।”
ইমাদ শার্টের বোতাম লাগিয়ে বলল, “স্যরি।”
কড়ি তাড়া দিয়ে বলল, “তারপর?”
“আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই।”
“কথাটা আমার বাবাকে গিয়ে বলুন।”
“আপনার সাথে যার বিয়ে ঠিক হয়েছে উনি কি করেন?”
“পুলিশ অফিসার।”
“ভয় দেখাচ্ছেন?”
কড়ি মাথায় হাত রেখে বলল, “আরে না সত্যি।”
ইমাদ বিড়বিড় করে বলল, “একবার চোর, আরেকবার সোজা পুলিশ! আমার মতন সাধারণ মানুষদের কি চোখে পড়ে না?”
কড়ি সরু চোখে তাকিয়ে বলল, “কি বললেন?”
“কিছু না।”
“আমি শুনেছি।”
“আচ্ছা।”
কড়ি কিছু বলল না আর। ইমাদ প্রশ্ন করল, “আপনার বাবার কাছে আপনার রেফারেন্স দিতে পারি?”
“রেফারেন্স বলতে?”
“রেফারেন্স বলতে এরকমটা যে আপনিও আমাকে বিয়ে করতে ইচ্ছুক এই ধরনের কিছু আঙ্কেলকে বলা গেলে তিনি আমাকে সুযোগ দিলেও দিতে পারেন।”
কড়ি সাফ সাফ মানা করে বলল, “কখনো না।”
“আমার এখন যে অবস্থা যেকোনো গার্ডিয়ান লাভ ম্যারেজ হলে মেনে নিবে কিন্তু অ্যারেঞ্জ ম্যারেজে মানবে না। পড়াশুনায় ভালো, কর্মঠ বেকারকে মেয়ে পছন্দ করে ফেললে এক কথা। অন্যথায় আঙ্কেল কেন কেউ’ই মানবেন না। আমার পড়াশুনা এখনো শেষ হয়নি। চাকুরী নেই। কেন মানবেন তিনি?”
“বুঝতে যেহেতু পারছেন তাহলে আর এখানে আমার কাছে কি?”
“আপনার রেফারেন্স চাই। আমার হয়ে একটু সুপারিশ করুন।”
“মজা পেলাম। আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনি চাকুরী চাইতে যাচ্ছেন।”
“আপনার কাছে হয়তো বিষয়টা মজার হতে পারে। কিন্তু আমার কাছে এটা কোনো মজার বিষয় না।”
ইমাদের এমন বেহাল দশা দেখে কড়ির মায়া হলো। ছেলেটা নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক দেখানোর চেষ্টা করলেও ভেতরে ভেতরে খুব অসহায়বোধ করছে। কিন্তু ওর ত আসলে কিছু করার নেই।
ইমাদ’ই আবার বলল, “নাহয় ক’টা বছর অপেক্ষা করুন আমার জন্যে। আমি প্রতিষ্ঠিত হয়ে আঙ্কেলের কাছে আমি আর আমার পরিবার যাব। আঙ্কেল ফিরিয়ে দিলে আপনাকে আর কখনো বিরক্তও করব না। কিন্তু এইটুকু সুযোগ অন্তত আমাকে দিন।”
কড়ি বলল, “আপনি আমার পছন্দেরও না আবার অপছন্দেরও না। তাই আমার রেফারেন্সটুকু আপনি পাবেন না। এমনকি আমি যদি আপনাকে বিয়ে করতে ইচ্ছুকও হতাম তবুও বাবাকে বলতাম না, আর না আপনাকে বলতে দিতাম। আমি এমন একটা মেয়ে যে এই অধিকারটুকু নিজের অপরাধে হারিয়ে ফেলেছি। এখন আমার পরিবারই আমার প্রথম এবং একমাত্র প্রায়োরিটি। তবুও অবস্থা কেমন আমি দেখছি কথা বলে। এখনো আমি জানি না বাবা পাকা কথা দিয়ে তারিখ ঠিক করে ফেলেছেন কিনা। যদি করে থাকেন তাহলে আমার হাতে করার মত আর কিছুই থাকবে না।”
“আচ্ছা।”
ইমাদ সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। কড়ি বাবার ঘরে গিয়ে বাবাকে পেল না। দেখল সবাই ড্রয়িংরুমে আলোচনায় বসেছে। কড়ি ইতঃস্তত করে বলল, “আসব?”
কাইয়ূম হাতের ইশারায় নিজের কাছে ডাকল। কাইয়ূমের পাশে বসতেই কাইয়ূম এক হাতে বোনকে জড়িয়ে ধরে বলল, “কিছু বলবি?”
“না।”
“কিছু বলার থাকলে বল।”
“কি কথা হচ্ছিল?”
“ঐ তোর বিয়ের তারিখ নিয়ে। রিমার কাছে শুনেছি তোর কোনো আপত্তি নেই। ওরাও আকদ করিয়ে ফেলতে চাইছে। ওটা নিয়েই আলোচনা করছিলাম।”
“আমার একটু ঢাকা যাওয়ার কথা ছিল। তারিখ মিলে গেলে বোধহয় যেতে পারব না, তাইনা?” কড়ি ঘুরিয়ে প্রশ্নটা করল।
কাদের সাহেব কাশতে কাশতে বললেন, “কয় তারিখ যেতে চাইছিস?”
তার মানে তারিখ এখনও ঠিক হয়নি। কড়ি বাবার দিকে তাকিয়ে কি বলা যায় দ্রুত ভাবতে লাগল।
কাইয়ূম বলে উঠল, “হ্যাঁ, তারিখ তো এখনও ফিক্সড হয় নি। কয় তারিখ ঢাকা যাবি ওটা বল। ঐ তারিখ আর আশেপাশের দুই তিনদিন বাদ দেওয়ার কথা মাথায় রেখে তারিখ বসাব।
কাদিন অসহিষ্ণু গলায় বলল, “আমি যাই।”
কাদের সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, “কি হয়েছে তোর?”
“আমার কথা তো কেউ কানেই তুলছে না। আমার মনে হয়না আমার কোনো প্রয়োজন এখানে আছে।”
রিমা ধমক দিয়ে বলল, “কোথাও যেতে হবে না। বস এখানে।”
কাদিন অনিচ্ছাসত্ত্বেও বসল। বলল, “বাড়িতে একটা বিয়ের অনুষ্ঠান সবে হলো। এখনি আবার আকদ কিসের? কি দরকার অত তাড়াহুড়ো করার?”
কাইয়ূম বলল, “শুভ কাজে দেরি করতে নেই। উভয়পক্ষই যেহেতু রাজি এখানে দেরি করবার কি আছে?”
“হুট করে কিছু করতে নেই। আমাদের উচিত আরো খোঁজ খবর নেয়া।”
“খোঁজ খবর নিয়েছি। নিয়েই তো এগুচ্ছি।”
“আমার কেন যেন মন টানছে না।”
“কেন কি সমস্যা?” কাদের সাহেব প্রশ্ন করলেন।
“ছেলে পুলিশ। এইসব পেশার মানুষদের রিস্ক বেশি। জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই। কখন কি হয়!”
কায়েস বলল, “রিস্ক ভাই সবকিছুতেই। এই যে তুমি বাইকে করে অফিস করতে যাও। আল্লাহ না করুক তোমারও বাইক অ্যাক্সিডেন্ট হতে পারে। তো এটা ভেবে কি মেজো ভাবির পরিবার তোমাকে তাদের মেয়ে দেয়নি?”
“এই ছেলের মাঝে আরো সমস্যা আছে। ছেলেকে ভালো করে দেখেছিস তুই? শু পরতে হয় বেল্টের সাথে ম্যাচ করে। এটাও জানে না। এই ছেলে শু পড়েছে প্যান্টের সাথে ম্যাচ করে। পারফিউমের ঘ্রাণটাও কড়া ছিল। কেমন যেন সস্তা পারফিউম! ড্রেসিং সেন্স ভালো না। এমন ছেলের সাথে কড়ির বিয়ে আমি দিব না।”
দীপা ফ্যালফ্যাল করে কাদিনের দিকে তাকিয়ে রইল। মানুষটার মাথায় সমস্যা আছে নাকি? দীপা পাশে বসা রিমার কানে ফিসফিস করে বলল, “আপু, আপনার ভাই ছোটবেলায় কোথাও পড়েটরে গিয়ে মাথায় কোনো আঘাত পেয়েছিল?”
রিমা বলল, “এইটুকু দেখেই এ কথা বলছ তাহলে ওর বেলায় ও মেয়ে দেখে এসে কি কি বলত শুনলে কি বলবে? আমাদের ভাগ্য ভালো শেষ পর্যন্ত তোমাকে পেয়েছি। ভাগ্যিস তোমার উপর ওর কুনজর পড়েনি! কি জাদু করেছিলে ওকে বলো তো!” রিমা দুষ্টু হাসি হেসে কনুই দিয়ে ধাক্কা দিলো দীপাকে। দীপার আচমকা এত লজ্জা লাগল! কায়েস দু’হাত একসাথে জড়ো করে কপালে ঠেকিয়ে বলল, “নিজের বেলায় যে অত্যাচার করেছ! তবুও তোমার হয়নি না? আবার শুরু হয়েছে তোমার এই অত্যাচার! ক্ষ্যামা দাও না, আমাদের। আর কত জ্বালাবে?”
কাদিন দমল না। উল্টো বলল, “তোর বোধহয় বিয়ে করতে বেশি মন চাইছে। এজন্যই কড়ির বিয়ের এত তাড়া তোর! এত মন চাইলে তোর বিয়ে তুই সেড়ে ফেল। আমাদের কোনো সমস্যা নেই।”
কায়েস থতমত খেয়ে একদম চুপ হয়ে গেল। বেচারা লজ্জায় শেষ!
কাদিন কাদের সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল, “বাবা, এত তাড়া কিসের আমাদের? একটাই তো বোন, তাইনা? আমরা আরো ভাবি, আরো দেখি। একটা কেন দশটা বিয়ে দেখে এরপর বেস্টটা দিব।”
কাইয়ূম বাগড়া দিয়ে বলল, “তোর পছন্দ হওয়ার আশায় বসে থাকলে দশটা কেন দশ হাজারটা দেখার পরও কড়ির আর বিয়ে হবে না। তুই তোর উস্তাদি কলম চালাতেই থাকবি আর একেকটা বিয়ে ভাঙতেই থাকবি। তুই যেসব কারণ দর্শালি একটাও ধরার মতন না।”
কাদিন কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই কাদের সাহেব ডাকলেন, “কাদিন?”
কাদিন বিনম্র গলায় বলল, “জি, বাবা।”
“রিস্ক এর কথাটা বলে তুমি আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছ। এখনি বুক ধড়ফড় করছে। আমি এখানে আর মেয়ে দিতে পারব না। আর দিলেও দুশ্চিন্তায় আমি টিকতে পারব না। কাজটা ঠিক করোনি।” উঠে গেলেন তিনি। কড়িও উঠল। সে বুঝে গেছে এই বিয়ে ভাগ্যক্রমে বাতিল হয়ে গেছে। অবাক লাগছে তার!
কাইয়ূম দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “আহারে! কত ভালো সম্বন্ধটা ছুটে গেল !”
রিমারও মন খারাপ। কড়ির বিয়েতে কোন শাড়িটা পরবে এটাও সে ঠিক করে ফেলেছিল! কায়েস বেচারা যে লজ্জা পেয়েছে এরপর চুপচাপ ঘর ছেড়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ওর নেই। দীপা আর কাদিনও নিজেদের ঘরে চলে এল। বিয়েটা শেষ পর্যন্ত না হওয়ায় কাদিনের ভালো লাগছে। এই সম্বন্ধটা ওর মনমত হয়নি। দীপা আচমকা বলল, “আমাকে কেন বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলেন?”
কাদিন দীপার দিকে ঘুরে তাকাল, “জেনে কি করবে?”
দীপা বলল, “আমার ত দোষের শেষ নেই তাই আরকি।”
কাদিন বিছানা ঝাঁট দিতে দিতে ঠেশ দিয়ে বলল, “লুচ্চা উপাধী পেতে তোমাকে বিয়ে করেছিলাম।”
দীপা এতক্ষণে কাদিনের রেগে থাকার কারণটা ধরতে পারল। এতক্ষণ আসলে বুঝতে পারছিল না ঠিক কোন কারণটায় কাদিন ওর উপর এত ক্ষেপে আছে। দীপা মিনমিন করে নীচু গলায় বলল, “স্যরি।”
কাদিন ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, “তুমি চুমু খেতে বলেছিলে। এরপরই আমি এগিয়েছিলাম। কোন হিসেবে আমাকে লুচ্চা বললে তুমি?”
দীপা কি বলবে? কাদিন তো ঠিকই বলেছে। দীপা তাই চুপ করে রইল। কাদিন বলল, “কেন বলেছ?”
দীপা কঠিন জেরার মুখে পড়ে কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল, “স্যরি বললাম তো! এরপরেও এমন শক্ত শক্ত কথা কেন বলছেন?”
কাদিন বলল, “যাও বললাম না আর।”
শুয়ে পড়ল ও। দীপাও ওপাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। কাদিনের ধমকাধমকিতে মন খারাপ নিয়েই ঘুমের দেশে তলিয়ে গেল ও। ঘুমের ঘোরে সবসময়ের মতই পাশ উল্টে কাদিনের উপর হাত পা তুলে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল কাদিনকে। কাদিন বিরক্ত হয়ে সরিয়ে দিলো দীপাকে।
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here