আঁখির আড়ালে,পর্বঃ- ২০ (শেষ)
সাদিয়া_সৃষ্টি
রাতে মির্জা বাড়িতে ফিরতেই প্রথমে নিজের ফোন বের করে ঘাটতে লাগল সে। ফোনের নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছে না। অবশ্য সেটার নিয়ন্ত্রণও যে মকবুল মির্জা করছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। বিহান ফোনের কভার খুলে সেখানে লাগিয়ে রাখা সিম ফোনের সাথে সংযুক্ত করে নিল। কিছু সময় পর নেটওয়ার্ক পেতেই খুশিতে নাচতে ইচ্ছে হলো তার। নিজের জানালা দরজা সব ঠিক মতো লাগানো আছে কি না একবার দেখে নিল। যদিও কথা বলবে না। শুধু ম্যাসেজ পাঠাবে। তবুও সাবধানতার মার নেই। জানালার কাছে কান পাততেই শুনতে পেল চেনা আওয়াজ।
— একটা কাজও কি ঠিক করে করতে পারিস না। আমাকেই যাওয়া লাগবে? ওই দিক সামলানোর জন্য মুন্নাকে ৪ মাস হওয়ার আগেই গ্রামে আনালাম। যাতে তুই আর রবি মিলে সব সামলাতে পারিস। সেটাও ঠিক মতো করলি না। আবার কে কাকে খুন করেছে? একটা কথাও লুকাবি না। ড্রাগ দিবি ভালো কথা, বন্ধ ঘরের মধ্যে না রেখে খোলা ছেড়ে দিতে তোকে কে বলেছিল? আমি বলেছিলাম না সবার দিকে খেয়াল রাখবি। তোরা ৩ ভাই মিলেও ওসব সামলাতে পারছিস না, আর আমি যখন তোদের বয়সের ছিলাম, তখন আমি গ্রাম শহর সব চালাতাম। জন্ম দিয়েছি তিন তিনটে অকর্মার ঢেঁকিদের। এখন ভুগতে হচ্ছে আমার। তুই অপেক্ষা কর। আমি আসছি কাল।
এর মাঝেও অনেক কথা হলো। নিজের ছেলেকেও ছাড়লেন না গালি দেওয়া থেকে। বিহান বুঝতে পারল, ফোনের ওপাশে শাকিল আছে। সে চুপ করে নিজের শ্বাস আটকে রেখে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকল। নড়ল না একটুও। কারণ মকবুল মির্জা জানেন সে বিহান এখন বাড়ির সামনের চায়ের দোকানে অন্যদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে। নিজের ফোনের যেই জায়গা থেকে শব্দ বের হয়, সেটাও চেপে ধরে রাখল। যদি তাকে নেটওয়ার্ক এর ভেতরে দেখে কেউ কল করে না ম্যাসেজ দিয়ে দেয়!
মকবুল মির্জা যেতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে। দ্রুত ফোন সাইলেন্ট করে তার বন্ধু সাগরকে ম্যাসেজে সবটা লিখে জানাল। মূলত মকবুল মির্জার অপরাধ, ব্যবসা এসবই জানাল। আর সাথে বলে দিল আগামী কালের মধ্যেই তার বড় ভাই বাদলকে নিয়ে এখানে চলে আসতে। বাদল একজন সিনিয়র অফিসার। সে আসলে ব্যাপারটা সামলানো সহজ হবে। সাগর বাদলকে সব জানালেই আর কিছু করা লাগবে না বিহানের। তখন সে বসে বসে মুড়ি খাবে আর মকবুল মির্জাকে জেলে যেতে দেখবে। পাশে বসে চুলোয় মুড়ি ভাজবে দিশা। আহা! ভাবতেই মুড়ির প্রতি প্রেম চলে আসলো তার। হাতে একমুঠ মুড়ি নিয়ে তাতে চুমু খেতে ইচ্ছা করল তার। তখন পাশাপাশি বসলে নিশ্চয় তাদের মিয়া বিবির মতো লাগবে। ম্যাসেজ পাঠানোর সাথে সাথে ওপাশ থেকে উত্তর এলো ঠিক আছে। বিহান বার বার করে জানিয়ে দিল আগামীকালের মধ্যেই আসতে। বেশি দেরি হতে দিতে চায় না সে।
__________
পরের দিন সকাল সকাল বিহান উপস্থিত হল খন্দকার বাড়ি। আজ দুপুর পর্যন্ত মকবুল মির্জাকে আটকে রাখতে দিশা সহ ওদের বাচ্চা বন্ধুদের সাহায্য লাগবে তার। কুসংস্কারের জালে আটকানো যাবে ক্ষণিকের জন্য। তারপর কারখানা। খন্দকার বাড়িতে উঠোনে দিশাকে আবার আগের দিনের মতো পায়চারী করতে দেখে হেসে ফেলল। মেয়েটা তার থেকেও বেশি চিন্তা করছে। আচ্ছা, মেয়েটা যদি তার বউ হয়ে তার সাথে শহরে চলে যেত! যতই সময় যাচ্ছে, দিশাকে নিজের বউ বানানোর ইচ্ছা ততই বাড়ছে বিহানের। সাধারণত মানুষ যেই বিষয় নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা করে, সেই জিনিস বা বিষয় নিজের চোখের সামনে কিছু সময়ের জন্য হলেও দেখতে পায়। যেমন একটা মানুষ অপর একজন মানুষকে নিয়ে চিন্তা করলে তাকে হঠাৎ করেই সামনে দেখতে পায়। এই ধরণের “ভিস্যুয়াল হ্যালুসিনেশন” বিহানের ক্ষেত্রে কম ঘটেনি। দিশাকে নিয়ে কল্পনা করতে করতে দিশাকে সামনেও দেখেছে কয়েক বার। খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও দেখেছে। তাই নিজের ইচ্ছাকে “লোভ” বলেই সম্বোধন করে যেন বিহান।
দিশা তাকে দেখতেই হাত নাড়াল। বিহানকে বাড়িতে ঢুকতে বলে নিজেও ঘরের ভিতর চলে গেল। বিহান উঠোনে রাখা চৌকিতে বসে পড়ল। আকাশে মেঘের কোন খোঁজ নেই যেন। রোদের উত্তাপে সব জ্বালিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা দেখে হাসল বিহান। আজ ভাগ্যে থাকলে হয়তো আরেকটা মেঘ কেটে যাবে এই গ্রামের উপর থেকে।
দিশা ফিরে আসলো শরবত নিয়ে। বিহান সেটা শেষ করে দিশার হাতে দিতেই দিশা আবার ঘরে চলে গেল সেটা রাখতে। দিশা ফিরে আসতেই বিহান দেরি না করে বলে উঠল,
— কি ব্যাপার? আজ এতো ছোটাছুটি করছেন কেন?
— আম্মা কালকে বকেছিল, প্রতিবার আপনি আসেন, কিন্তু আপনাকে কিছুই খেতে দেই না আমি। তাই।
— আচ্ছা, এর থেকেও জরুরি কথা বলতে এখানে আসা। আজ মকবুল মির্জা আবার শহরে যাবেন। সেটা আটকাতে হবে। আজ আমার ভাই তাকে ধরে নিয়ে যেতে আসবে। আমার ভাইয়ের হাতে পড়লে সব আজই ঠিক হয়ে যাবে।
— কি করবেন ভেবেছেন?
— আপনাদের সাহায্য লাগবে আমার।
বিহান নিজের পরিকল্পনা বুঝিয়ে দিতেই দিশা জোরে জোরে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। বিহান হালকা হেসে ফিরে গেল। যদি আরেকবার ঘুরত তাহলে দিশার লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও বিহানের দিকে তাকিয়ে থাকাটা নজরে পড়ত।
__________
মকবুল মির্জা ঘর থেকে বের হচ্ছিলেন দুপুরে। ঠিক দুপুর বলা যায় না। উনি আজ সময়ের ২ ঘণ্টা আগেই খাবার খেয়ে নিয়েছেন। সেটার অপেক্ষা করছিল বিহান। আর বের হতেই তখন পিছু ডাকল বিহান।
— চাচা?
— হ্যাঁ বল বাবা।
— আমি শুনলাম, মানুষ বাইরে বের হওয়ার সময় পিছু ডাকলে নাকি তখন বের হওয়া উচিত না। অশুভ হয় সেই যাত্রা। তাই নাকি?
— না, আসলে এটা তেমন কিছু না। আমি পরে তোমাকে বলি।
— ওহ, আপনি বাইরে যাচ্ছিলেন?
— হ্যাঁ।
— তাহলে তো আমি পিছু ডেকে ফেললাম। দুঃখিত।
বলেই বিহান সেখানে রাখা কেদারায় বসে পড়ল। মকবুল মির্জা প্রথমে সেটা নিয়ে তেমন ভাবলেন না। বিহান ইশারা করতেই দিশা বাচ্চাদের সাথে খেলতে খেলতে মির্জা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েই একটা কালো বিড়াল ছেড়ে দিল। সেটা মকবুল মির্জার সামনে দিয়ে দৌড়ে চলে গেল। বিহান তখন বলে উঠল,
— চাচা, আরেকটা কথা। কালো বিড়াল পথ কাটলে নাকি যাত্রা অশুভ হয়? এখন দেখে মনে পড়ল। এটাও কি সত্যিই?
মকবুল মির্জা থেমে গেলেন। এতদিন ধরে তিনি গ্রামের মানুষদের এইসব মুখস্ত করিয়ে এসেছেন। কিন্তু নিজে কখনো বিশ্বাস করেননি। আজ হুট করে বিশ্বাস হচ্ছে। এমনিই তার মনে হচ্ছিল আজ কারখানায় কোন ঝামেলা হবে। শহরে যাওয়া ঠিক হবে না। গত রাত থেকেই এমন মনে হচ্ছিল। সাধারণত মানুষ যেই জিনিস বারবার দেখে, সেটার প্রতি দেরিতে হলেও একবারের জন্য আকৃষ্ট হবেই। সেখানে মকবুল মির্জা এতদিন ধরে নানা কুপ্রথা গ্রামবাসীকে নিজ থেকে শিখিয়েছিলেন। আজ সেগুলো নিজেরই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে। তিনি কপালে হাত দিয়ে ঘাম মুছলেন। ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই মুন্না “আব্বা” “আব্বা” বলতে বলতে ছুঁতে আসলো। বিহান এবার পায়ের উপর পা তুলে আরাম করে বসল। “মুড়ি” জিনিসটাকে সে খুব করে মিস করছে। এতদিনের গোয়েন্দাগিরির ফল পাচ্ছে আজ সে। মুন্না মকবুল মির্জার কানে কানে কিছু বলতেই মকবুল মির্জা কোন দিকে না তাকিয়ে তড়িঘড়ি করে বের হয়ে পড়লেন। তাহলে দিশা ঠিক মতো আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। আবার ভাইয়ের কথা মাথায় আসতেই উঠে দাঁড়াল সে। আজ সকালে এখানকার কোথায় কেমন লোক থাকে সে সম্পর্কে বলে দিয়েছিল ম্যাসেজে। বাকিটুকু বাদল সামলে নেবে।
কারখানার সামনে এসে দাঁড়াতেই দেখলেন রাজবাড়ী নেই। সেখানে আগুন ধরেছে। যার জন্য যন্ত্রও পুড়ে গিয়েছে। আর সেটার জন্য রাজবাড়ীর ছবি আর দেখাচ্ছে না সেগুলো। আগুন কি করে ধরল সেটা দেখতেই তিনি কারখানার ভিতরে চলে গেলেন। এক কোণে কিছু শ্রমিকদের নেশায় বুঁদ হয়ে পড়ে থাকতে দেখে রাগটা যেন আকাশ ছুঁল। তিনি সবাইকে লাঠি দিয়ে তারপর কন্ট্রোল রুমে ঢুকে পড়লেন। সবটা দেখে যখন বুঝতে পারলেন যে এসব আগুন দিশা ধরিয়েছে, সাথে সাথে রেগে গিয়ে চেয়ারটা ছুঁড়ে মারলেন মনিটরের উপর। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গিয়েছে। তার মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে মুহূর্তেই হাতে হাতকড়া পরানো হলো। মকবুল মির্জা চেঁচিয়েও বেশি কিছু করতে পারলেন না। তার আগেই তাকে টেনে নিয়ে যেতে থাকল ৩ জন কনস্টেবল। তিনি যেতে যেতে দেখলে সবাই মাটিতে পড়ে আছে। বাদল একটা যন্ত্র উঁচু করে দেখাতেই বুঝলেন সবাইকে ইলেকট্রিক শক দিয়ে অজ্ঞান করানো হয়েছে। তিনি হাত পা ছুরেও ছাড় পেলেন না। তাকেই একই ভাবে অজ্ঞান করানো হলো। বাদল মাস্ক খুলতে গেলে বিহান তাকে আটকে দেয় আর জানায় যে এখানে কারখানায় ওষুধের প্রভাবে নিজেও অজ্ঞান হয়ে পড়তে পারে। বাদল খুঁটিনাটি সব প্রমাণ সংগ্রহ করে চলল নিজ গন্তব্যে। এক এক করে সবাইকে গাড়িতে তোলা হলো। সবার হাত আর পা মোটা রশি দিয়ে বাঁধা। বাদল গাড়িতে উঠতে গেলে বিহান তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
— আবার আসিস এখানে।
— কেন? তুই কি সারাজীবন এখানে থাকবি না কি বিহান?
— না, মানে বাবা মাকে নিয়ে আসিস। একেবারে বিয়ে করে তারপর যাবো। দিশা!
দিশাকে ডাকতেই দিশা ওর সামনে এসে হাজির হলো।
— বলুন, আর কিছু লাগবে?
— না, এখন সব ঠিক আছে। আসলে এই হচ্ছে আমার বড় ভাই, বাদল আহমেদ।
দিশা সালাম দিতেই বাদল জবাব দিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লেন। বিহানের দিকে তাকিয়ে হাড় নেড়ে বললেন,
— এরপরের বার বাবা মাকে নিয়ে আসব। তৈরি থাকিস। একে বাড়ে বিয়ে দিয়েই তবে নিয়ে যাব।
দিশা কথাটা কতোটুকু বুঝল সেটা জানা নেই বিহানের। কিন্তু দিশা কথাটা বোঝার পর চোখ বড় বড় করে তাকাল। বিহান তার দিকে তাকিয়ে বলল,
— ভালোই আগুন লাগিয়েছেন আপনি। একেবারে রাজবাড়ী অদৃশ্য।
— এভার তো ওই ভূতগুলোতেও আগুন লাগাবো। এতদিন কম ভয় পায়নি আমি।
বিহান শব্দ করে হেসে উঠল। আর দিশা ব্যস্ত হয়ে পড়ল সেই হাসির দৃশ্য উপভোগ করায়।
__________
এর ২ দিন পর বাদল উপস্থিত হয়েছিল তার বাবা আর মাকে আর নিজের বউকে নিয়ে। তারা দিশার বাবা মায়ের সাথে কথা বললেন। সব কিছু ঠিক করে তারপর খন্দকার বাড়িতেই থাকবেন বিয়ের কয়দিন।
দুর্জয় ফিরে এসেছে তার পরিবারের কাছে। দুর্জয়ের কাছ থেকে জানা যায় আসল ঘটনা। স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর তেমন ঝামেলা না হলেও দিশা বড় হওয়ার পর ঝামেলা হয়। গ্রামের কিছু ছেলেরা তার দিকে খারাপ নজরে তাকানো শুরু করে। দুর্জয়ের জন্য প্রতিবার তারা ব্যর্থ হলেও হাল ছাড়েনি। দুর্জয় প্রতিবার দিশাকে বাঁচায়। কিন্তু স্কুলে থাকা দিশার জন্য মোটেও ভালো ছিল না। তাই দিশার ১০ম শ্রেণির পরীক্ষা যেদিন শেষ হলো, সেদিন দুর্জয় ঘরের সামনে আসলেও ভেতরে ঢোকে নি। দিশাকে ঘরে আটকে একটা ছেলে অসভ্যতামি করার চেষ্টা চালায়। কিন্তু দিশার সাথে পেরে ওঠেনি। দিশা নিজেকে বাঁচাতে সক্ষম হয়। অবশ্য বনের প্রতি এ বিশ্বাস তার ছিল। এরপর মকবুল মির্জার কাছে বিচার করা হলে দিশাকে আর পড়তে অনুমতি দেওয়া হয় নি। দুর্জয় পুরোটা বাবাকে জানালে খন্দকার সাহেবও দিশাকে পড়াতে রাজি হননি। দুর্জয় বাবার সাথে পরিকল্পনা করে বাড়ি থেকে এক ঝামেলা করে বের হয়ে যায়। সে মকবুল মির্জাকে নিয়ে নিজের সন্দেহের কথাও জানিয়েছিল ঠিকই। যার জন্য দিশার বাবা রাজি হয়ে যান। কোন কারণ ছাড়াই এক তুমুল ঝগড়া হয় বাবা ছেলের মধ্যে। দুর্জয় হয়ে যায় আলাদা। তারপর কারখানায় পাঠানো হয় তাকে। সেখানে সবটা দেখত সে। তাকে মাঝে মাঝে কোন ওষুধ জাতীয় কিছু দিলে সেটা খেত না তবে অভিনয় করত। এর পাশাপাশি গ্রামের কোন ছেলে দিশার ক্ষতি করার চেষ্টা করলে সে তাকে বাঁচাত। অবশ্য বাড়ি আলাদা হয়ে যাওয়ায় তার উপর কেউ সন্দেহ করত না। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে সে মকবুল মির্জার বিরুদ্ধে সব প্রমাণ জোগাড় করতে থাকে। গ্রামের পাশাপাশি শহরেরও। যার জন্য বাদলের এই কেস সমাধান করতে সুবিধা হয়।
মকবুল মির্জা সহ তার পুরো পরিবারকে আইনের আওতায় আনা হয়। এছাড়া যারা যারা এর সাথে জড়িয়ে ছিল, তাদের খুঁজে বের করা হয়। ড্রাগস পাচারের কেসে তাদের শাস্তি হয়। একেক জনের একেক শাস্তি। যারা যারা ড্রাগে আসক্ত ছিল তাদের সবাইকে শহরের রিহাবে পাঠানো হয়। গ্রামবাসীদের এখনো এসব জানানো হয়নি। বিহান সিদ্ধান্ত নিয়েছে সবাইকে প্রথমে প্রযুক্তির সাথে পরিচিত করাবে। তারপর সবটা জানাবে। নাহলে ওরা বিশ্বাস করতে চাইবে না। সবাই এই সিদ্ধান্তে সম্মতি জানিয়েছে। বিহানের দলের সকল সদস্যদের আবিষ্কৃত “সিম” নতুন মাত্রা যোগ করে প্রযুক্তিতে। যার নেটওয়ার্ক দূর দুরান্ত পর্যন্ত পাওয়া যায়। এছাড়া ড্রাগস পাচারের মতো ভয়ংকর অপরাধ সামনে নিয়ে আসায় তারা পুরষ্কার পেয়েছে।
__________
দিশা আর বিহান আবার সেই রাতের অন্ধকারে ভাঙ্গা বাড়িতে এসেছে। দিশা বিহানকে কিছু বলতে চায়। কিন্তু আসার পর থেকে কিছুই বলছে না। বিহানও তার কথা শুনতে চুপ করেই বসে রইল। হঠাৎ করে বিহান বলে উঠল,
— কিছু বলছেন না যে?
— আসলে আপনি আমার সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন। কেন আমি এমন, কেন সবাই আমায় ভয় পায়- এসব জানতে চান। আজ আমি সেটা বলতে চাই।
বিহান সোজা হয়ে বসল। কিন্তু কিছু বলল না। দিশা নিজেই কিছুক্ষণ থেমে আবার বলে উঠল,
— দুর্জয় ভাইয়ার কাছ থেকে হয়তো শুনেছেন আমি দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছি, তারপর এমন কিছু করি যার জন্য আমাকে স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হয়।
— হ্যাঁ।
— আচ্ছা, যদি কখন খুন হতে দেখেছেন?
— না, দেখিনি।
— আমি দেখেছি। খুব কাছ থেকে। কখনো যদি জানতে পারেন আমি খুনি, তাহলে কি করবেন?
— সেটা সেই কাজের পেছনের কারণের উপর নির্ভর করবে। যদি আপনি ঠিক হয়ে থাকেন, তাহলে আপনাকে আগলে রাখব, যাতে আপনার উপর আবার তেমন কোন ঘটনার আঁচ না পড়ে। আর যদি আপনি ভুল হয়ে থাকেন, তাহলে দরকার হলে তার শাস্তি আমি নিজে দেব। কিন্তু তবুও দূরে থাকতে দেব না। অনুভূতিটা কি আমার আজও আপনি বুঝতে পারেননি দিশা। মায়ায় জড়িয়ে পড়েছি তো আমি। যেই টান কারো প্রতি অনুভব করিনি, সেটা আপনার প্রতি করেছি। সেই মায়া যে আর কেটে যাবে না। সময়ের ব্যবধানে আপনার চামড়া ঝুলে পড়লে, চুলে পাক ধরলেও না। ছেলে জাত হয়ে জন্মেছি। ভুল পথেও চলে যেতে পারি হয়তো কখনো। আমি যদি ভুল পথে পা বাড়াই, তাহলে আমাকে শুধরে দিয়ে নিজের কাছে আটকে রাখতে পারবেন না? বড্ড ভালোবাসি যে আপনাকে দিশা, বড্ড!
দিশা কিছু না বলে বিহানের বুকে মুখ লুকাল। অনেকক্ষণ কান্না করার পর ফুঁপাতে লাগল সে। সেই অবস্থায় বলল,
— আমি খুনি বিহান। আমি জীবনে ১ম যে খুন দেখেছি, সেটা আমিই করেছি। সেদিন শেষ পরীক্ষা ছিল আমার। ওই ছেলেটা, আমাকে টেনে ঘরে আটকে অসভ্যতা করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তার আগেই ভয়ে হাতের সামনে যেই দা পেয়েছিলাম, সেটা দিয়েই আঘাত করেছিলাম আমি তাকে। পরে যখন হুঁশ ফিরল, তখন দেখলাম ছেলেটা আর বেঁচে নেই। এইজন্য কেউ আমাকে পছন্দ করে না। কেউ না। শুধু আব্বার জন্য সহ্য করে। আব্বা যে অনেক ভালো মানুষ, তাই। আমি না এমন ছিলাম না জানেন? এরপর আপনি আমাকে বিয়ে করতে রাজি কি না সেটা সম্পূর্ণ আপনার ব্যাপার।
❄️❄️❄️❄️❄❄️❄️❄️❄️❄️
সোফায় বসে মুড়ি মাখা খেতে খেতে টিভি দেখছে দিশা। হঠাৎ তার কানে চিৎকার ভেসে এলো।
— আর কতক্ষন পেঁয়াজ কাটবে হবে আমাকে দিশা? ছুটির দিনেও কাজ না করালে কি হয় না?
— আরও আসুন রোমান্স করতে। যখন আমি এতো কষ্ট করে পেঁয়াজ কাটছিলাম, তখন পেছন থেকে ধরে তুলতে কে বলেছিল। তুমি জানতে না আমি ভুতে আর হঠাৎ কাজ কর্মে ভয় পাই। গেল তো আমার সব কাঁটা পেঁয়াজ ময়লার ঝুড়িতে পড়ে। এখন তুমি কাটো।
— আর কত আমার মা?
— আমি তোমার মা? মা আমি?
— না তো, আমার ছোট্ট একটা বউ তুমি।
— একটা মানে কি? আর কয়টা বিয়ে করতে চাও।
— আমাকে আমার গগলস্ দিয়ে যাও না। এই পেঁয়াজ আর সহ্য হচ্ছে না।
— তুমি ওই চশমা পরবে না। তাহলে তো আর শাস্তি দেওয়াই হবে না আমার। আর যতগুলো পেঁয়াজ আছে, সব কেটে ফ্রিজে রেখে আসবে।
বলেই টিভি তে মনোযোগ দিল দিশা।
বিহান আর দিশার বিয়ে হয়েছে ৩ বছর। বিয়ের পরই তারা বিহানের ফ্ল্যাটে চলে আসে। দিশাকে সব কিছুর সাথে ভালোভাবে পরিচয় করিয়ে শিখিয়ে পড়িয়ে দেয় বিহান। বাবা মা নিজেদের বাড়িতেই থাকেন। আর বাদলের তো ঘন ঘন শহর পরিবর্তন করতে হয়। ভাবিও থাকেন বাবা মায়ের সাথে। মাঝে মাঝে বাদলের সাথে থাকেন। বিহান কাজের জন্য আলাদা-ই থাকে। সুযোগ পেলেই বাড়ি চলে যায় দিশাকে নিয়ে। দিশাকে আবার কলেজে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে বিহান। নাহলে সারাদিন বাসায় একা থাকতে তার ভালো লাগবে না এই ভেবে। শান্তিপুরের উন্নতি হয়েছে। সবাই এখন সত্যটা জানেন। মকবুল মির্জা এখনও জেলে। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে তার। সবটা স্বাভাবিক ভাবেই চলছে। হুটহাট বড় ছুটি পেলে দুইজন মিলে বাড়ি থেকে ঘুরে আসে। মাঝে মাঝে বিহান ছুটির অর্ধেক সময় ঘরজামাই হয়েই থাকে খন্দকার বাড়িতে। বিয়ের দিন ফেরার সময় দিশার সে কি কান্না! তারপর এক মাস মতো বিহানের বাবা মায়ের সাথে থাকে ওরা। কাজের জন্য ওদের আবার ফিরে যেতে হয় বিহানের ফ্ল্যাটে।
বিহান পিছন থেকে এসে মাথায় টোকা দিল দিশার।
— আরে জ্বালিয়ো না তো। সিরিয়ালটা দেখতে দেও।
— আগেই ভালো ছিল। টিভি কি সেটাই জানতে না। আর সারাদিন আমাকে সময় দিতে। হুহ!
— তোমার না পেঁয়াজ কাঁটার কথা?
— পেঁয়াজ যে শেষের দিকে ছিল, সেটা কি তুমি ভুলে গিয়েছ? এতক্ষণ তোমাকে ডাকছিলাম রান্নাঘরে রোমান্স করব বলে।
— অসভ্য।
— তাহলে কি আমি এই অসভ্যতামি অন্য কারো সামনে করব।
— যাও তো, জ্বালিয়ো না। দেখতে দেও। খুব কঠিন একটা মুহূর্ত চলছে।
বিহান দিশার মাথায় আবার বাড়ি মেরে বলল,
— তাহলে আমি যাই এখন।
— খেলে না কিছু?
— না। পরে খাব। সাগর ফোন করে ডেকেছে। কি একটা সমস্যা হয়েছে। সেটা দেখতে ল্যাবে যেতে হবে। তুমি খেয়ে নিও সময় মতো। আমি দেরি করব না।
— যা না যাও, তোমার সাথে আমার আর কথা নেই।
— তাহলে আমার বউ কি রাগ করেছে?
— আমি আর রাগ? হুহ!
— দিশা নামক মেয়েটিকে জাপটে ধরে যদি আমি কি…
— অসভ্য। অসভ্যতামির একটা সীমা আছে।
— তোমার কাছে আমি সীমাহীন।
— তোমার না কাজে আছে? যাও। দ্রুত যাও।
— তুমি তো এখন আমার সতীনকে নিয়ে থাকবা, তাই না?
— টিভির সিরিয়াল তোমার সতীন, বিহান?
— হু হু… যাচ্ছি।
বলেই দরজা খুলে চলে গেল।
— এলে যখন, দুপুরের খাবারটা খেয়ে গেলেই পারতে।
— আজ না।
বলতে বলতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল বিহান। দিশা হাসি মুখে তার দিকে তাকিয়ে থাকল। দরজা আটকাতে যাবে এমন সময় বিহান টুপ করে সামনে হাজির হলো। দিশা থেমে গেলেই বিহান দিশার কপালে টোকা দিল আস্তে করে। এতে দিশা আবার রেগে গেল। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে কিছু কড়া কথা বলতে যাবে, তার আগেই বিহান দিশার ফুলে যাওয়া নাকটা টেনে দিয়ে বলল,
— আসি।
বলেই আবার চলে যেতে লাগল। দিশা কিছুক্ষণ অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। গত ৩ বছর ধরে এমন হলেও আজও সে আগের মতই অবাক হয়। দিশা আবার দরজা লাগাতে যাবে, এমন সময় বিহান আবার সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে দিশার গালে টুপ করে ঠোঁট ছুঁইয়ে আবার চলে গেল। এবার একেবারে কাজের জায়গা। দিশা হাসতে হাসতে ঘরে ঢুকে পড়ল। দুজনের চোখের আড়ালে থাকা অনুভূতিগুলো আজকাল আর চোখের আড়ালে থাকে না। প্রকাশিত হয় প্রতিমুহূর্তে, নতুন ভাবে।
।সমাপ্ত।