আঁখির আড়ালে,পর্বঃ- ১২, ১৩ ও ১৪

আঁখির আড়ালে,পর্বঃ- ১২, ১৩ ও ১৪
সাদিয়া_সৃষ্টি

— কেমন আছিস রে দিশা?

দিশা কিছু সময়ের জন্য অবাক হয়ে গেলেও বুঝতে পারল কে বলেছে এই কথা। তাই প্রথমে কৌশলে নিজের ডান হাতের কনুই দিয়ে ছেলেটার পেট বরাবর মেরে নিজে লাফ দিয়ে নেমে পড়ল। তারপর তার দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। গুঁতা দেওয়ার জন্য ছেলেটার হাতের বাঁধন হালকা হয়ে এসেছিল। তাই আর ঘোরানো তার পক্ষে সম্ভব হলো না। সেই সুযোগে দিশা নিচে নেমে পড়ল। তারপর তার দিকে আঙুল তুলে বলে উঠল,

— তোর সাহস দেখছি এখনো কমেনি মুন্না।

সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা দাঁত বের করে হেসে বলে উঠল,

— আমার সাহসের আর কি দেখলি তুই? একদিন দেখবি না কি? সেজন্য তো আমাকে বুঝতে হবে দিশা। আমাকে তুই তো বুঝতেই চাস না।

— তোর সাহসের উদাহরণ আমাকে দেখাতে আসবি না। নির্ঘাত তোকে মেরে এমন জায়গায় মাটি চাপা দিয়ে আসব, তোর পরিবারের কেউ টের পাবে না।

— ওহ হু, ভয় পেলাম। দিশা দেখ, আমার হাত পা কাঁপছে। একটু ভালোবেসে কথা বলতে পারিস না। আমার মতো অধমের জন্য তোর কি একটুও মায়া দয়া হয় না।

— তার আগে বল আমাকে ছুঁয়েছিলি কেন? কে তোকে এতো সাহস দিয়েছে যে আমাকে তুলে ঘুরাতে গেলি তুই?

— আগেই বলেছি, আমার সাহস আমার রক্তে পরিমানের থেকে বেশি-ই আছে। চাইলে তোকে ধার দিতে পারি। তার জন্য আমাকে বিয়ে করতে হবে। করবি বিয়ে?

— দূরে গিয়ে ভাগ। আর সামনে আসবি না। যেদিন সত্যি সত্যি গেঁড়ে রেখে দেব মাটিতে, সেদিন বাপের নাম নেওয়ার সময়টুকু পাবি না।

— আবার ভয় দেখাচ্ছিস দিশা। আমি কি কোন দিন তোকে বলেছি যে আমি ভয় পাই? না তো। তাহলে কষ্ট করে ভয় দেখাস কেন?

— তুই যাবি এখান থেকে?

— এটা আমার গ্রাম। এখান থেকে তুই আমাকে তাড়াতে পারবি না।

— তোর তো এখন ফিরে আসার কথা না। তাহলে তুই ফিরে এলি কেন? এখনো তো ৪ মাস পর আসার কথা।

— আহা রে, তুই আমার কথা কত ভাবিস! ইশ! আমার আসার দিন গুনছিলি তুই এতো দিন? এতো ভালোবাসা আমি কোথায় রাখি? আয়, বুকে আয়, তোকে একবার জড়িয়ে ধরি।

— নিজের সীমার মধ্যে থাক। বেশি বাড়াবাড়ি করবি না।

— বাড়াবাড়ি করলাম আর কোথায়? আগে একটু করতে দে তো, তারপর নাহয় শাসন করিস।

— তোর কথা শুনতে আমার ইচ্ছা হচ্ছে না।

— ওহ! তুই ক্লান্ত বলে বিশ্রাম নিতে চাস। কিন্তু এতদিন পর আমি ফিরলাম বলে আমাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছা হচ্ছে না তোর দিশা। না চাওয়া সত্ত্বেও তুই আমার কথা এতক্ষণ ধরে শুনছিস? এতো আনন্দ আমি কোথায় রাখি? এবার তোকে জড়িয়ে না ধরলে বড় অন্যায় হয়ে যাবে রে দিশা। আয় তো একবার বুকে।

বলেই মুন্না দিশার দিকে এক পা এগোলেই দিশা এক ধাক্কা দেয়। তাতেই সে পুকুরে পড়ে যায়। কিছু সময়ের জন্য মুন্না নিজেও হতবাক হয়ে গিয়েছিল যে চোখের পলকে তার সাথে কি হলো। কিন্তু পানির অস্তিত্ব টের পেতেই সাঁতার কাঁটা শুরু করল। তারপর সেভাবে থেকেই বলে উঠল,

— তুই কি করে বুঝলি যে আমি এখন ক্লান্ত, আমার হাত মুখ ধোঁয়া প্রয়োজন? তাই আমাকে সরাসরি পুকুরে পাঠিয়ে দিলি? বল না, তোর অন্য মতলব আছে। আমাকে এভাবে ভিজিয়ে…

মুন্নার কথা শেষ করতে না দিয়েই দিশা বলে উঠল,

— নির্লজ্জ। চুপ করে থাক। আর একটা কথা বললে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না।

পুরোটা সময় ধরে বিহান নিরব দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে রইল। কোন কথা বলল না। দিশার মুখে মুন্না নাম শুনে আঁচ করতে পারল যে এটা হয়তো মুন্না মির্জা, মকবুল মির্জার ছোট ছেলে। কিন্তু অন্যদের কাছ থেকে জানতে পেরেছিল মকবুল মির্জা ৩ ছেলে বছরে ৪ মাস করে এই গ্রামে থাকে। সেই হিসাবে শাকিল তো কিছুদিন আগেই আসলো। তার বদলে এখন মুন্নার আসার কারণ কি হতে পারে? এটাও এই গ্রামের রহস্য পর্যন্ত নিয়ে যেতে সাহায্য কি করবে? না কি এটা একটা সাধারণ ঘটনা? হতেও পারে। আবার নাও হতে পারে।

এসব ভাবনার মাঝে দিশা আর মুন্নার কথাগুলো কানে পৌছুতেই বিহানের ইচ্ছে করল এই সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ‘মুন্না’ নামের ছেলেটাকে পুকুরে এক ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া। প্রথমে যখন দিশাকে ধরে ঘুরালো তখন-ই তার রাগে হাত মুঠ হয়ে এসেছিল। কিন্তু চুপ করে দাঁড়িয়ে সবটা বোঝার চেষ্টা করছিল। পরে ওদের কথা বাড়ার সাথে সাথে বিহানের রাগও আকাশ ছুঁতে থাকল যেন। তারপর দিশা মুন্নাকে ধাক্কা মারার পর বিহানের ভালো লাগলেও মুন্নার বলা পরবর্তী কথাগুলো শুনে রাগে তার শরীর রি রি করে উঠে। কিন্তু তবুও কিছু বলে নি। দিশা কেন এতক্ষণ ধরে কেন মুন্নার এমন লাগাম ছাড়া কথা সহ্য করছে- এই ভাবনা মাথায় আসতেই রাগে মাথা ফেটে যাওয়ার উপক্রম। কিন্তু রাগের বশে যেন ভুল কোন কাজ না করে ফেলে সেই চিন্তা থেকে আর কিছু বলে নি বিহান।

শেষে রাগ দেখিয়ে সেখান থেকে দিশাকে পাশ কাটিয়ে চলে আসলো বিহান। আপাতত সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে ওদের এই কথোপকথন দেখার বা শোনার একদম-ই ইচ্ছে নেই তার।

দিশা অবাক হয়ে বিহানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। বিহান তো কোন গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতেই ডেকেছিল তাকে। তাহলে না বলে চলে গেল কেন? হঠাৎ করে দিশার মনে হলো বিহান তার উপর রাগ করে চলে গিয়েছে। নিজের এমন অদ্ভুত চিন্তায় নিজে অবাক হলেও তার মন খুব করে বলছে যে বিহান তার উপর রাগ করেই চলে গিয়েছে। সে মন খারাপ করে তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল।

অন্যদিকে মুন্না সেই তখন থেকে পানিতে ভাসমান অবস্থায় ওদের দুজনকে দেখছিল। বিহানের চোখে দিশার জন্য অন্য রকম অনুভূতি দেখতে পেয়েই সাথে সাথে সে সতর্ক চোখে দিশার দিকে তাকাল। দিশারও মন খারাপ। এসব ভাবনা মাথায় আসতেই সাথে আসলো একরাশ ভয়। সে দিশার মন অন্যদিকে করার জন্য সরাসরি পানি ছুঁড়ে মারল দিশার দিকে। পরিমাণে বেশি হওয়ায় দিশা সাধারণ এর চেয়ে একটু বেশি ভিজে গেল। তাই রেগে গিয়ে মুন্নার দিকে আঙুল উঁচু করে কি ছু বলতে গেলে তার আগেই মুন্না আবার দাঁত কেলিয়ে হাসল। দিশা সেখানে না থেকে বাড়িতে ফেরার জন্য পা বাড়াল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সন্ধ্যা নামবে। মুন্না দিশার দিকে তাকিয়ে থেকে পুকুরের পানিতে কয়েকবার ডুব দিয়ে উঠে পড়ল নিজের বাড়ি গিয়ে কাপড় বদলানোর উদ্দেশ্যে।

__________

নিজের ওই ছোট ঘরটাতে ঢোকার পর থেকে নিজের উপর রাগ ঝাড়ছে বিহান। এই এতো বড় হয়েও কি করে বাচ্চামো করতে পারল সেই ভেবে। দিশাকে মুন্না নামের ছেলেটা জ্বালাচ্ছিল, আর দিশা বার বার সব কিছু হজম করে নিচ্ছিল। ঠিক আছে, হয়তো মকবুল মির্জার ছেলে বলেই কিছু বলতে পারছে না কিংবা কারোর বারণ আছে। তাই বলে বাচ্চাদের মতো রাগ দেখিয়ে আসার কোন মানে হয় না। তাছাড়া এর থেকে গুরুত্বপূর্ণ অনেক কথা বলার ছিল তার। এই গ্রাম সম্পর্কে ধারণা নেওয়া দরকার। এতদিন মনে জমে থাকা সব প্রশ্নের উত্তর অন্য কারো কাছ থেকে জানতে হবে। আর এই গ্রামে অন্য কেউ মানেই মকবুল মির্জার লোক। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করলেই সেটা মকবুল মির্জার কান পর্যন্ত সে নিজেই পৌঁছে দিবে। বিহানের উপর যে নজর রাখা হয়, সেটা কেউ না বুঝুক, বিহান নিজে বোঝে ঠিক-ই। তার মস্তিষ্ক তাকে জানান দেয় এই কথার। আর তাই নিজের কথা কাউকে ভরসা করে বলতেও পারছে না, একমাত্র দিশা ছাড়া। কারণ মকবুল মির্জা দিশা বাদে সবাইকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। যার জন্য মকবুল মির্জার উপর তার সন্দেহ সবার আগে। এই গ্রামে কার খানা আছে, তাও গ্রামবাসীর আড়ালে। ভুতের ভয় দেখিয়ে সেদিকে যেতে দেওয়া হয় না। আবার কয়েকজন গ্রামের যুবক সেই কারখানায় হয়তো কাজ করতে যায় রাতের অন্ধকারে। কিসের কারখানা সেটা না জানলেও ব্যাপারটা বেশ ভাবাচ্ছে বিহানকে। সেদিন সকালেই বলা মকবুল মির্জার কথাগুলো তার সন্দেহকে প্রগাঢ় করে তুলছে। তার উপর তার ঘুমের বিষয়টা সে আজ কিছুটা আন্দাজ করার চেষ্টা করবে। নিজের ঘুমের উপর যথেষ্ট বিশ্বাস তার আছে। অন্তত কিছু তো হয় রাতে তার সাথে।

__________

বেশ সকালের ঘুম ভাঙল বিহানের। নিজের সন্দেহ সঠিক হতে দেখে ভ্রূ কুঁচকে এলো বিহানের। সত্যিই এতদিন তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হচ্ছিল? নিজের ঘুমের প্রতি এতদিন সন্দেহ করছিল সে। কিন্তু সন্দেহ করা উচিত ছিল মকবুল মির্জার দেওয়া রাতের খাবারের প্রতি। সারাদিন ঠিকঠাক, আর রাত হলেই উল্টাপাল্টা। অদ্ভুত তো! কি এমন কারণ যে তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হচ্ছে। দিশার সাথে কথা বলতেই হবে। বিছানা ছেড়ে উঠতে গিয়ে খেয়াল হলো এতো সকালে ঘুম থেকে উঠলে অন্যদের সন্দেহ হবে। তাই না চাইতেও ঘাপটি মেরে শুয়ে থাকতে হবে। রেগে ফুস ফুস করে কয়েকবার নিঃশ্বাস ছেড়ে আবার শুয়ে পড়ল বিহান। ঘুম না আসা সত্ত্বেও শুয়ে থাকার মতো বিরক্তিকর কাজ বিহানের কাছে যে আর নেই। ঘুম আসবে না, তাও শুয়ে থাকবে, এদিক ওদিকে ঘুরবে বিছানায়। তারপর হাতে পায়ে ব্যথা হবে। তাও ঘুম একটুর জন্যও আসবে না। তারপর ক্লান্ত হয়ে বিছানা থেকে উঠে ঘুমের উপর রাগ ঝাড়বে কতক্ষণ। এই আর কি!

.
.

অন্যদিকে দিশার অবস্থা কিছুটা অন্যরকম। দিশা গতকাল থেকে শান্ত হতে পারেনি। বারবার অস্থিরতা তাকে গ্রাস করেছে। চিন্তারা তাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। বিহানের সাথে তার পরিচয় কিছুদিনের মাত্র। কিন্তু এর মধ্যে বিহানের হাসি দেখেছে, কথা বলার ধরণ দেখেছে, মজা করতে দেখেছে আরও অনেক কিছুই দেখেছে। আর বিহানের প্রতিটা চরিত্রে মুগ্ধ হয়েছে। তার মধ্যে থাকা স্বচ্ছতা দিশাকে আকৃষ্ট করেছে। দিশাকে বাধ্য করেছে নিজের আসল রুপ বিহানের সামনে তুলে ধরতে। তাই তো মনের কথা গান আকারে প্রকাশ করার লোভ সে সামলাতে পারে নি। গেয়ে ফেলেছিল গান। সেই কর্কশ আওয়াজে নয়। সবার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখ আওয়াজটা প্রকাশ করেছিল বিহানের সামনে। বিহানের তার দিকে তাকিয়ে থাকা যেমন তার মনে তোলপাড়ের সৃষ্টি করে, তেমনই অজানা অনুভূতির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। এটাকে ভয় বলা যায় না, তবে সে ভয় পায়। একে ভালো লাগা বলা যায় না, তবে তার ভালো লাগে। একে আসক্তি বলা যায় না, কিন্তু প্রতি মুহূর্তের প্রতিটি কাজে সে আসক্ত হয়। একে আক্রমণ বলা যায় না, কিন্তু তার প্রতি চাহনি তাকে ঘায়েল করে। এখন একে তাহলে কি বলা উচিত দিশার? এই অজানা অনুভূতি যে দিশার কাছে বড্ড নতুন!

তবে এই কয়েকদিনের পরিচয়ে বিহানের রাগটা যে তার কাছে অপরিচিত। এতদিন বিহান তাকে রাগের ছিটেফোঁটাও দেখায় নি। সেখানে আজ রাগ করে কিছু না বলেই চলে এলো। তাই চিন্তা হচ্ছে দিশার। দিশা জানে না তার চিন্তা আসলে কি নিয়ে হচ্ছে, কিন্তু হচ্ছে। মন তাকে গর্জন করে যে হ্যাঁ, সে চিন্তিত। কিন্তু কারণটা বলছে না।

তাই সকালে ঘুম ভাবগতেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে এতো চিন্তা না করে বিহানের সাথে দেখা করে সবটা জেনে নেওয়া যাবে। সে আসলেই রেগে আছে, না কি নেই। থাকলে কারণ জেনে সব ঠিক করবে। আর না থাকলে তো ভালোই। সকাল সকাল কিছু না ভেবেই মির্জা বাড়ির সামনে চলে আসলো ঠিকই। কিন্তু কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। গ্রামের কেউ-ই তাকে সহ্য করতে পারে না। তার মধ্যে মকবুল মির্জার স্ত্রী হয়তো প্রথম স্থান অধিকারী। বিশেষ করে আগে তেমন পাত্তা না দিলেও মুন্না যখন থেকে দিশার পিছনে লাগা শুরু করল, তখন থেকে তো তেলে বেগুনে জ্বলে উঠেন তিনি দিশাকে দেখা মাত্রই।

তার বিপরীত কিছু ঘটেনি এখনো। সেই একই ঘটনা। দিশা চিন্তিত হলেও সেটা প্রকাশ না করে নিজের স্বাভাবিক কণ্ঠে ডেকে ওঠে,

— চাচি, ও চাচি। মির্জা বাড়ির চাচি। মানে, মির্জা বাড়িতে থাকা আমার চাচি, তোমাদের অতিথিকে একটু ডেকে দেও তো।

মকবুল মির্জার স্ত্রী তেঁতে উঠে বলেন,

— কি হইছে ছেমড়ি? এইহানে আইছোছ ক্যান?

দিশা সালাম দিয়ে নিজের কথা বলে,

— তোমাদের অতিথিকে ডেকে দেও না।

— ক্যান? ওরে দিয়া কি হইব?

— যা বলছি তাই করো না। আমার এখানে থাকার ইচ্ছা নাই।

— তুইও কি রুমির মতন নাকি রে? ছেমড়া মানুষ দেখলে মাথা ঠিক থাহে না।

— হ্যাঁ, তাই তো তোমার ছোট ছেলেকে নিয়ে দুনিয়া ঘুরে বেড়াই, তাই না? নিজের ছেলেকে আগে সামলান, তারপর আমার চরিত্র নিয়ে কথা বলতে আসবেন। বিহান, বিহান!

জোরে চিৎকার করে ডাক দেয়। বিহান তখন জেগেই ছিল। শব্দ শুনে এক লাফে উঠে পড়ে। তারপর ওদের কথা শুনে আর না পেরে ঘর থেকে বের হয়ে আসে। দুই মেয়ের মধ্যে ঝগড়া কি পরিমাণে ভয়ংকর হতে পারে সেটা ভেবেই সে আর দেরি করে না। ঘুম ঘুম ভাব দেখিয়ে প্রথমে মকবুল মির্জার স্ত্রীকে সালাম দেয়। তারপর বলে উঠে,

— আমি কথা বলছি।

বলেই সেখান থেকে হাত ধরে এক টানে বাড়ির বাইরে নিয়ে যায়। সে আর যাই হোক না কেন, দিশার সাথে মুন্নার দেখা হতে পারে- এটা সহ্য করতে পারবে না। আর যেখানে মুন্না তখন বাড়িতেই আছে, সেখানে দিশাকে তো থাকতেই দিবে না। দিশাকে অপেক্ষা করতে বলে সে অলস পায়ে কলের পাড়ে চলে যায়। হাত মুখ ধুয়ে বের হয়ে আসতেই সামনে পড়ে মকবুল মির্জা। তাকে খন্দকার বাড়িতে যাওয়ার কথা বলতেই উনি হাসি মুখে রাজি হয়ে যান। তারপর বিহান আবার দিশার কাছে ফিরে আসে।

— এবার বলুন কি বলবেন? এতো সকালে ডাকছিলেন কেন?

— আসলে…

— জ্বি, আসলে…

— আমাদের বাড়িতে খেতে আসেন।

— কিন্তু…

— কোন কথা বলবেন না দয়া করে।

বলেই সামনের দিকে হাঁটা শুরু করল দিশা। বিহান কতক্ষণ বোকার মতো তাকিয়ে থেকে নিজেও হাঁটা ধরল দিশার পিছনে।

দিশা নিজের বাড়ি পৌঁছে বিহানকে বসতে দিয়ে মাকে বলল খাবারের ব্যবস্থা করতে। ততক্ষণে বাকি বাচ্চারাও চলে এসেছে। অন্যদিকে সকালে খন্দকার বাড়িতে বিহানকে দেখে সবাই অবাক হলেও বেশ খুশি হয়েছে। রুবিনা তো প্রথম থেকে চোখ দিয়ে গিলে খাওয়ার প্রয়াসে লেগে পড়েছে। যেদিন প্রথম দেখল, সেদিন থেকেই এক মুগ্ধতা কাজ করে “বিহান” নামক লোকটার প্রতি। সেদিন দিশাকে সেই প্রথমে বিহানের কথা বলেছিল। সামনে থেকে দেখার কোন সুযোগ-ই সে বাদ দেয় না। মাহিরা তো রুবিনাকে দেখে বার বার খোঁচা দিচ্ছে। রুবিনা চোখ রাঙ্গাতেই মাহিরা আর সাবিহা খিল খিল করে হেসে উঠছে। ওদের শব্দ করে হাসতে দেখে রুবিনার পাশাপাশি দিশার মা-ও এসে একবার চোখ রাঙ্গিয়ে যান। বাইরের লোকের সামনে, বিশেষ করে কোন ছেলের সামনে মেয়েদের শব্দ করে হাসা তিনি পছন্দ করেন না। এর মাঝে দিশাও ওদের সাথে গল্প করতে চলে আসে। যদিও তার মাথায় বিহানের সাথে কথা বলার বিষয় ঘুরছে। তবুও কি করে সব কথা শুরু করবে সেটাই বুঝতে পারছে না সে। সেজন্য নিজেকে আগে একটু সময় নিয়ে তৈরি করে নিচ্ছে। কথাগুলো ঠিক করে গুছিয়ে নিচ্ছে মনে মনে। সামনে ৩ বান্ধবীর সাথে কথা বলতে আসলেও তার মন সেদিকে নেই। সে নিজেও বুঝতে পারছে না যে গত কাল থেকে ভাবছে, পুরো রাত ভাবল। তবুও এখনো বিহানকে কিভাবে কি বলবে সেটাই ঠিক করতে পারল না! বিভ্রান্তিতে মস্তিষ্ক সাধারণ চিন্তাভাবনা করতেও অনেক বেশি সময় লাগাচ্ছে।

বিহান খাওয়া শেষ করে উঠে পড়ে। উঠোনে পাটি বিছিয়ে দিয়েছেন দিশার মা। আপাতত সেখানে বাচ্চারা বসে আছে বিহানকে ঘিরে। তাদের নানান অদ্ভুত প্রশ্ন। সেসব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে বিহান। মাঝে মাঝে নিজেও প্রশ্ন করছে। বাচ্চাগুল হেসে হেসেই উত্তর দিচ্ছে। এক পর্যায়ে বিহান নিজের ডান হাত চুলকে উঠলে একটা ছোট মেয়ে বলে উঠে,

— আপনার তো ডান হাত চুলকাচ্ছে। তার মানে আপনি বিত্তবান হবেন।

বিহান হেসে ফেলল ওদের এমন কথায়। সে হাসতে হাসতেই বলে উঠল,

— আচ্ছা, কিন্তু আমার বাম হাতের তালুও তো চুলকাচ্ছে। তাহলে কি হবে?

মেয়েটা আবার বিজ্ঞের মতো বলে উঠে,

— আপনার সামনে তাহলে বিপদ।

— ওহ, তাহলে আর কি কি হলে কি কি হয়?

বিহানের এ প্রশ্নে সবাই এক এক করে উত্তর দেয়।

— রাতে পানি ফেলা ঠিক না। এতে অমঙ্গল হয়, এরূপ করলে ঘরে শয়তানের আনাগোনা বাড়ে। কারণ, কুকুর উঠানে উপস্থিত হয়। আর, কুকুর খারাপ।

— কথা বলার সময় হঠাৎ টিকটিকির আওয়াজকে ‘কথা সত্য’ এমন সাক্ষ্য হিসেবে ধরা হয়

— যাত্রা পথে পিছন থেকে ডাকলে নাকি বিপদ হয়।

— যাত্রাপথের খালি কলস কাজে ব্যর্থ হওয়ার লক্ষণ। আবার অনেকে এটাকে অভাবের আগাম সংকেত হিসেবে ধরে।

— গভীর রাতে পেঁচার ডাক হলো ঝগড়া-বিবাদের সংকেত। পেঁচা রাতে মাটি কামড়ে ঝগড়া বাড়িয়ে দিতে চায়!

— মরা গাছে কাক ডাকলে কারো মৃত্যু সংবাদ আসে।

— কিছু খেতে খেতে গলায় বেঁধে যাওয়া বা কাশি হওয়া। এই ঘটনায় বলা হয়, “কেউ হয়তো আমার নাম করছে বা গালি দিচ্ছে তাই এমনটি হলো!”।

— হঠাৎ বাম চোখ কাপলে দুখঃ আসে।

— গলায় কাটা বিঁধলে বিড়ালের পা ধরে মাপ চাইতে হবে।

— কোন ফসলের জমিতে বা ফল গাছে যাতে নযর না লাগে সে জন্য মাটির পাতিল সাদা-কালো রং করে ঝুলিয়ে রাখতে হবে।

— দাঁড়ী-পাল্লা, মাপার জিনিস পায়ে লাগলে বা হাত থেকে নিচে পড়ে গেলে সালাম করতে হবে, না হলে লক্ষ্মী চলে যাবে।

— পিপড়া বা জল পোকা খেলে সাতার শিখবে।

— সকাল বেলা দোকান খুলে যাত্রা (নগদ বিক্রি) না করে কাউকে বাকী দেয়া যাবে না। তাহলে সারা দিন বাকীই যাবে।

— পাতিলের মধ্যে খানা খেলে মেয়ে সন্তান জন্ম নিবে।

— একজন অন্য জনের মাথায় টোকা খেলে দ্বিতীয় বার টোকা দিতে হবে, একবার টোকা খাওয়া যাবে না। নতুবা মাথায় ব্যথা হবে/শিং উঠবে।

বিহান এতজনের কথা শুনে বলে উঠল,

— আরে, বাবা, থামো থামো। আমাকে শ্বাস নিতে দেও তোমরা। আমার শিক্ষা হয়ে গিয়েছে। আর জীবনে এমন কথা বলব না।

— কেন? কি হয়েছে?

— এসব এ তোমরা বিশ্বাস করো?

— হ্যাঁ। এটা তো শুধু কয়েকটা।

— কিন্তু এসব তো আসলে হয় না , এগুলো…

— আমরা সবাই বিশ্বাস করি তো এসব।

— কিন্তু…

বিহানের কিছু বলার আগেই বাঁধ সাধল দিশা।

— এই তোরা যা তো এখন। খেলতে যা। উনার সাথে আমার কথা আছে।

দিশার বলার সাথে সাথে সবাই উঠে পড়ল। বিহানও উঠে দাঁড়াল। দিশার দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাতেই দিশা আবার ওকে অনুসরণ করতে বলে হেঁটে সামনে যেতে লাগল। খন্দকার বাড়ি থেকে শান্তিপুকুর কাছেই। বেশি দূরে নয়। সেখানে গিয়েই থামল দিশা। বিহান দিশার পিছনে দাঁড়িয়ে বলে উঠল,

— আপনি কি আমাকে কিছু বলতে চান দিশা? বললে বলে ফেলুন। আমারও আপনাকে কিছু বলার আছে। গতকাল বলা হয়ে ওঠেনি।

দিশা সেখানেই হাঁটা হাঁটি শুরু করে দিল। দিশাকে পায়চারী করতে দেখে বিহানও ওর পিছনে হাঁটা শুরু করল।

— কি হলো আবার? সকাল থেকে কিছু বলতে চাচ্ছেন, কিন্তু বলছেন না। ব্যাপার কি? জলদি বলে ফেলুন।

— আসলে…

ওই সময় দিশার কিছু বলার আগেই একটা ছেলে এসে বলল,

— আরে বুবু যে! কি করেন?

— কিছু না। তুমি কোথায় যাচ্ছ কিরণ?

— এই মির্জা বাড়িতে যাচ্ছি। জানো আমি একটা জিনিস বানিয়েছি। এটা উড়ানো যায়। সেটা দেখাতে যাচ্ছি। আমি তাহলে যাই।

বলেই কিরণ যাওয়া শুরু করল। দিশা বলতে গেল,

— কিরণ যাস না। ওটা দেখাস না।

কিন্তু সে শুনলে তো। ততক্ষণে এক প্রকার দৌড়েই চলে গিয়েছে। দিশা নিজেও নিজের মাথার চুল দুই হাতে চেপে ধরে রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করল। তারপর বলে উঠল,

— এখনই মির্জা বাড়ি যেতে হবে। নাহলে অঘটন ঘটে যাবে বিহান। আপনি আমার সাথে এখন চলুন। কোন প্রশ্ন করবেন না দয়া করে।

বলেই দৌড় লাগাল দিশা। বিহান দিশার কথা শুনে আর কোন প্রশ্ন করল না। আপাতত মির্জা বাড়িতে গেলে আর কোন নতুন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে সেই চিন্তাই চলছে তার মস্তিষ্কে।

.
.

মির্জা বাড়ির উঠোনে চেয়ারে বসে নিম গাছের ডাল চিবুচ্ছিলেন মকবুল মির্জা। চেনা আওয়াজে মাথা তুলে সেদিকে তাকান তিনি। কিরণকে দেখে ভ্রূ কুঁচকে আসে তার। এই ছেলেটাকে তিনি চিনেন। শান্তিপুরের বিদ্যালয়ের সবচেয়ে ভালো ফলাফল করা ছাত্র। দিশার পরে এই ছেলে এখনো অনেক ভালো ফলাফল করে প্রতিবার শিক্ষকদের চমকে দিতে থাকে। সবাই বেশ সন্তুষ্ট তার উপর। কিন্তু ছেলেটার উপর তার বিসসাস্ন নেই একবিন্দুও। ছেলেটার দিকে নজরদারির জন্যও লোক রেখেছেন। যদিও লাগবে না। তবুও সাবধানতার মার নেই। তিনি মাথা নাড়িয়ে ভেতরে ঢোকার অনুমতি দিতেই কিরণ ভেতরে ঢুকে পড়ে। কিরণের হাস্যজ্জ্বল মুখ দেখে তার ভ্রূ দ্বিগুণ পরিমাণে কুঁচকে আসে। তিনি অপেক্ষা করতে থাকেন কিরণের কিছু বলার জন্য।

কিরণ প্রথমে সালাম দিলে মকবুল মির্জা হেসে সালামের উত্তর দেন। তারপর কিরণ কিভাবে কি বানিয়েছে আর সেটা কিভাবে কাজ করে সেসব দেখায় মকবুল মির্জাকে। বিহান আর দিশা ততক্ষণে দরজার বাইরে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে ঠিকই। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। কিরণকে আটকাতে পারেনি তারা। দিশার মুখে অসহায়ত্বের ছাপ বিহানকে ভেতর থেকে পুড়াচ্ছে। কিন্তু বিহান কি করবে? সে তো এখনো পরিস্থিতি-ই বুঝে উঠতে পারেনি। কি হচ্ছে, কি কারণে দিশার এতো উদ্বিগ্নতা- সেসব তো তার জানা নেই। যেখানে সে কিছুই জানে না, সেখানে সে করবে কি? বিহান শুধু ভেতরের সব ঘটনা দেখতে থাকল। মকবুল মির্জা সব শোনার পর তিনি বলে উঠেন,

— তুমি আরেকবার ওটা উড়িয়ে দেখাবে? আমি না বুঝতে পারিনি।

— জ্বি জ্বি চাচা, অবশ্যই।

প্রবল উৎসাহের সাথে বলে উঠল কিরণ। তার মুখে খুশির ঝলক স্পষ্ট। বোঝাই যাচ্ছে সে নিজের আবিষ্কার নিয়ে অনেক খুশি। সে আবারো সবটা বোঝানো শুরু করল। কিন্তু মাঝে মকবুল মির্জা মুন্নার দিকে কিছু ইশারা করতেই মুন্না সেই অনুযায়ী কাজ করে।

হঠাৎ কিছু একটা সেই যন্ত্রের সাথে বেঁধে সেটা মাটিতে পড়ে ভেঙে যায়। আকাশ থেকে পড়ায় কেউ বুঝতে পারল না পাথরটা উপর থেকে কি করে পড়ল। তাও মাঝারি আকারের পাথর। তবে সেসব দিকে কেউ খেয়াল করল না। কিরণ নিজের বানানো যন্ত্র ২ হাতে তুলে নিল। মকবুল মির্জা মন খারাপের ভান করে কিরণের পিঠে থাবা দিয়ে সান্ত্বনা দিলেন। তারপর তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। সুযোগ বুঝে দিশা আর বিহানও সবার চোখের আড়াল হয়ে গেল। আকাশ থেকে কি করে পাথর পড়ল সেটা কেউ বুঝতে না পারলেও বিহান আন্দাজ করতে পেরেছে। সে দিশাকে নিয়ে সেখান থেকে চলে গেল তখনই।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here