আঁখির আড়ালে,পর্বঃ- ১৮ ও ১৯

আঁখির আড়ালে,পর্বঃ- ১৮ ও ১৯
সাদিয়া_সৃষ্টি

দিশা নিচের দিকে তাকাল। সত্যিই একটা কালো ছোট বর্গাকৃতির বাক্স আর সেখান থেকেই আলো ছড়িয়ে পড়ছে উপরের দিকে। দিশার মুখ বিস্ময়ে খুলে গেল। কিছুক্ষণ সেই আলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আবার দেখল সেই নকল ভুত দুই হাত দুই দিকে তুলে সেই ভয়ংকর শব্দ করছে। দিশা এবার চুপ না থাকতে পেরে বলে উঠল,

— নকল ভুত কি আসল আত্মাদের ভয় দেখাচ্ছে?

বিহান না চাইতেও এমন গম্ভীর মুহূর্তে হেসে ফেলল। একে তো চিন্তায় আছে সে কি করে দিশাকে সব জানাবে। এখন মেয়েটা তাকে হাসাচ্ছে, এই অসময়ে। সে নিজেকে শান্ত করে জবাব দিল,

— না। একই ছবি বার বার দেখানো হচ্ছে। এরা একটা নির্দিষ্ট সময় পর পর একই চিৎকার করে উঠে। আবার এর মধ্যে আরেকটা বিষয় আছে। সাধারণত ওরা নিজের নিয়মেই চলে। যেভাবে ওদের বানানো হয়েছে সেভাবেই। কিন্তু মাঝে মাঝে কোন কিছুতে বাঁধা পেলে তারা তখনই ওই ভয়ংকর চিৎকার করে ওঠে। যাতে করে যদি কোন মানুষে বাঁধা পেয়ে থাকে তাহলে সেই মানুষের সামনে চিৎকার করবে আর মানুষটা ভয় পেয়ে যাবে। আপনি এখন নাকে কাপড় দিয়ে রেখেছে। তাই আপনি এতক্ষণ ধরে হাঁটতে পারলেন। কিন্তু আপনি যদি না দিয়ে রাখতেন, তাহলে ওই ওষুধের প্রভাবে আর এর চিৎকারে ভয় পেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়তেন।

দিশা বুঝতে পেরে মাথা নাড়ল।

— সেসব পরে বুঝবেন। এভার আসি অন্য কথায়। এখানে না দাঁড়িয়ে থেকে আমার সাথে আসুন। আর হ্যাঁ, শব্দ করবেন না। নাহলে বিপদ হবে।

বিহান দিশাকে ধরে ওই স্থান পেরিয়ে রাজবাড়ীর পাশ কাটিয়ে কারখানার কাছে এনে দাঁড় করাল। সেখানে চুপি চুপি পিছনের দরজার দিকে চলে গেল। সেখানে গিয়ে নিজের গাড়ি দেখাল তাকে। এমনকি ট্রাকগুলোও দেখানো হলো। দিশার মাথার উপর দিয়েই সব যাচ্ছিল এতক্ষণ। এসব দেখে তার নিজের মাথা ঘুরাচ্ছে বলে মনে হলো তার। সে বিহানের গাড়ি সাথে হেলান দিয়ে মাটিতে বসে পড়ল। মাটিতে হাত দিতেই মনে হলো এটা সাধারণ মাটি নয়। এতো বছরের পুরনো অভ্যাস ছেড়ে অন্য জায়গায় পা পড়তেই তার হুঁশ এলো। এই জায়গাটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাদের সচরাচর দেখার বাইরে এই দৃশ্য। নিজেকে সামলে নিল। সে সেই ছোট থেকে এখানে থাকা সত্ত্বেও এসব কেন জানতে পেল না। সেটাই বুঝতে পারছে না দিশা। অবশ্য এখন সে বুঝতে চাচ্ছেও না। একই সময়ে অতিরিক্ত চাপ নেওয়া ঠিক হবে না তার জন্য। হঠাৎ করে বিহান দিশার পাশে বসে পড়ল আর দিশার মাথাটা হাত দিয়ে নিচু করল। গাড়ির কাঁচের জানালা দিয়ে তবুও সে খেয়াল করল, সেই প্যাঁচানো সিঁড়ির ওপাশে দুর্জয়, তার ভাই। চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ। না জানি কত কাজ করিয়েছে ওকে দিয়ে, খাবারেরও হয়তো কোন ঠিক নেই। সাথে সাথে দিশার চোখের কোণ বেয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করল দিশা। কত দিন পর ভাইকে দেখতে পেল সে। অন্যদিকে দুর্জয় দরজা খুলে আবার দ্রুত দরজা বন্ধ করে দিল। সেটা দেখে বিহান উঠে দাঁড়াল। দিশার দিকে তাকাতেই বুঝতে পারল যে দিশা হয়তো তার ভাইয়ের কাছে যেতে চাচ্ছে। কিন্তু এখন সেটা সম্ভব নয় বলে সে কিছু বলল না।

বিহান সতর্ক ভাবে দিশাকে নিয়ে ওই প্যাঁচানো সিঁড়ি দিয়ে ওঠাল। তারপর দরজায় কান রেখে শব্দ শোনার চেষ্টা করতে বলল। দরজায় কান রাখতেই তার কানে কেউ জোরে জোরে শব্দ করছে বলে মনে হল। হঠাৎ একটা পরিচিত আওয়াজে গালির শব্দ ভেসে আসতেই ছিটকে সরে গেল সে। বিহান পেছনে হাত রাখল যাতে দিশা পরে না যায়। তবে দিশা নিজেকে সামলে নিল।

— কি হয়েছে?

— মকবুল মির্জার আওয়াজ।

— গালি দিতে শুনেছেন নিশ্চয়?

— আপনি কি করে জানলেন?

— উনার বাড়িতে থাকি, আর উনাকে চিনব না?

— কিন্তু এখন…

— চিন্তা করবেন না। উনি এই কারখানার শ্রমিকদের বলছেন এসব। চলুন। যাওয়া যাক। এখানে করার আর কিছু নেই।

দিশাকে নিয়ে সেখান থেকে বের হয়ে আসলো ওরা। ফেরার পথে বিহান আবার দিশাকে রাজবাড়ীর দিকে নিয়ে যেতে গেলে দিশা হাত ধরে আটকায়। দিশার অসম্মতি দেখেও সে জোর করে দিশাকে সেখানে নিয়ে যায়। তারপর তাকে বাড়ির দেওয়ালে হাত দিতে বলে। দিশা হাত দিয়ে ছোঁয়ার চেষ্টা করেও পারল না। ২-৩ বার চেষ্টা করার পর সে হাল ছেড়ে দিল।

— এই বাড়ির মধ্যেও কি ভুত আছে?

— না।

— এটাও ওই যন্ত্রের কারসাজি?

— হ্যাঁ।

— কিসব ভূতুড়ে যন্ত্র রে বাবা!

— এর ব্যাখ্যাও কি দেওয়া লাগবে?

— না, এমনিই মাথা ব্যথা করতে শুরু করেছে। আর শুনলে পাগল হয়ে যেতে হবে আমাকে।

— তাহলে এবার ফিরে যাই।

বিহান ফিরে যাই ঠিকই বলল, কিন্তু সেই প্রাচীরের কাছের গাছের আড়ালে দিশাকে নিয়ে লুকিয়ে পড়ল। দিশা ওখানে বসে থেকেই ক্লান্ত হয়ে পড়ল যেন। অনেকক্ষণ বসে থাকার পরও যখন বিহান উঠল না, তখন দিশা নিজের অজান্তে নিজের মাথা বিহানের কাঁধে রেখে ঘুমিয়ে পড়ল।

দিশার ঘুম ভাঙল বিহানের ডাকে। চোখ খুলে চমকে গেলেও শব্দ করল না। বিহান আঙুল দিয়ে সেই অদৃশ্য দেওয়ালের দিকে ইশারা করতেই দেখল, সেখান থেকে এক এক করে মানুষের উদয় হচ্ছে। কোথা থেকে আসছে সেটা বুঝতে পারল না সে। হঠাৎ করে সেদিনের কথা মনে পড়ল। ওই অদৃশ্য দেওয়ালের কাছে এসে ওরা হারিয়ে যাচ্ছিল। সবটা বুঝতে পেরে দিশা আবার নিজের মাথা বিহানের কাঁধে এলিয়ে দিল।

বিহান অবাক হলেও চুপ করে বসে থাকল। এখন একটু নড়লেই শব্দ হবে। আশেপাশে গাছের আর গাছের পাতার অভাব নেই। এভাবে শব্দ করে নিজেদের অস্তিত্ব জাআতে দিতে চায় না সে তাদেরকে। ওরা নিজেদের মতো করে কারখানায় চলে যেতেই বিহান আগের মতো করে দিশাকে নিয়ে সেখান থেকে চলে গেল।

মির্জা বাড়ির কাছে পৌঁছে বিহান বলে উঠল,

— আজও কথা বলা হলো না। বলতে গেলে দেরি হয়ে যাবে। লুকিয়ে এসেছি এখন। ধরা পড়া যাবে না।

— এতো কথা বলেও বলছেন যে আপনি কথা বলেননি? আর এটা আমি বিশ্বাস করব?

— আচ্ছা, পরে বলব সব। এখন যান। গিয়ে একটু ঘুমান।

— কিন্তু কি বলবেন বলেছিলেন তখন?

— সেটা প্রেও বলা যাবে। বললাম না দেরি হয়ে যাচ্ছে। আর আজ যা যা দেখলেন সেগুলো আপাতত কাউকে বলার দরকার নেই। কেউ বুঝবেও না, উল্টো আমাদেরকে ভুল প্রমাণিত করে শাস্তি দিবে।

— আগে নিজে তো বুঝে নেই, তারপর অন্যদের বোঝাব। কিন্তু আমি আব্বাকে বলব সব।

— ঠিক আছে, বলবেন। কিন্তু এখন না। আমি সবটা বলার পর।

— আমি ঘুমাতে গেলাম। শুব সকাল।

— শুভ সকাল।

দিশা চলে যেতে লাগল। বিহান তার যাওয়ার দিকে চেয়ে থেকে বলে উঠল,

— পাগল একটা। হুট করে গম্ভীর কথার মাঝে হাসায় আমাকে। আর নিজেও বোঝে না যে কখন কি বলছে।

নিজের ঘরে আবার চলে গেল বিহান। চাদর মুড়ি দিয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবল এরপর কি করবে। দিশাকে সব জানাতে পেরে শান্তি লাগছে ঠিকই, কিন্তু বাকি সব একা একা সামলাবে কি করে? একা বিষয়টা মাথায় আসতেই বিহান চট করে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। দরজা আটকে দিয়ে নিজের ফোন বের করল। সেটা চালু করতে গিয়ে দেখল চালুই হচ্ছে না। না জানি এতদিন সবাই কি কি করেছে তার খোঁজ না পেয়ে। ফোন চালু না হওয়ায় মন খারাপ হয়ে গেল তার। আবার মকবুল মির্জার কথা মাথায় আসতেই সে লাফিয়ে উঠল আবার। মোবাইল লুকিয়ে ফেলে দরজা খুলে দিল। হালকা খুলে রাখল। বাকিটুকু বাতাসের দাপটেই সরে যাবে। তারপর নিজের বিছানায় আবার চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল।

__________

মকবুল মির্জা আর মুন্না খাবার খাওয়ার পর একই সময়ে ঘর থেকে বের হয় সকালে। তারপর বাড়ির বড় বউ আর মকবুল মির্জার স্ত্রী খাবার রাধতে চলে যান রান্না ঘরে। যেটা বাড়ির বাইরে। তখন পুরো বাড়ি ফাঁকা। এমন সময় বিহান অন্যান্য দিন বাইরে থাকলেও আজ আর বাইরে গেল না। সরাসরি মকবুল মির্জার ঘরে চলে গেল। কিন্তু সেখানে আশেপাশে তাকিয়েও কাঙ্ক্ষিত জিনিস পেল না সে। ভালো করে কয়েকবার দেখে নিল। আর মনে মনে বলল,

“এই মকবুল মির্জা একটু বেশি চালাক। এর ছেলে গুলোও তেমন। রবি ভাই আর শাকিল। কিন্তু মুন্না?”

মুন্নার নাম মনে পড়তেই এক দৌড়ে ওর ঘরে গেল। ভালোভাবে ঘরে চোখ বুলাতেই ভিছানায় লেপ দেখে ভ্রূ কুচকাল বিহান। বর্ষার মৌসুম, শীত লাগতেই পারে। কিন্তু কাঁথার বদলে একেবারে লেপ? তাও সেটার পুরুত্ব অনেক। কোন তোষকের চেয়ে কম বলে মনে হলো না। দরজা আটকে লেপটা এক টানে সরিয়ে ফেলল। যদিও লাভের লাভ কিছু হলো না। হয়তো সত্যিই মুন্নার অল্পতেই ঠাণ্ডা লেগে যায় তাই এই ব্যবস্থা। তোষকের কথা মনে পড়তে সেটাও সরাল। বিছানার বড় তোষকের উপর একটা ছোট তোষক রাখা ছিল। সেটা সরাতেই এয়ারফোন, ফোনের চার্জার সহ কয়েকটা জিনিস সামনে এলো। বিহান দেরি না করে ফোনের চার্জার হাতে নিয়ে নিল। চারদিকের দেওয়ালে তাকিয়ে দেখল। দেওয়ালে কোন আশানুরূপ জিনিস না পেয়ে নিচে বসে পড়ল। বিহান ভালো করে চার্জারের দিকে তাকাল। তারপর সেটা বিছানায় রেখে দিল। মুন্নাকে দেখে তার যতটুকু মনে হয়েছে তার প্রথম কথা হলো- মুন্না অলস। সে নিজে কিছু করতে চায় না। একটু পানি পান করতেও মাকে দিয়ে পানি আনিয়ে নেয়। সেখানে এসব চার্জার লুকাল তোষকের নিচে। তাহলে তার ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গেলে হয়তো দূরে কোথাও যাবে না। কাছেই চার্জার লাগিয়ে আবার ফোন চালাবে। বিহান বিছানায় রেখে দেখল চার্জারের তার ছোট। শুধু মাটি পর্যন্ত। সে মাটিতে হাঁটিয়ে দেখল। বিছানার চার দিকেই খোঁজ চালাতেই হাতে বাঁধল কোন কিছু। সেটা ধরে তোলার চেষ্টা চালাতেই সেটা উঠল না। বিহান নিচু হয়ে সেটা ধরে উল্টো দিকে টান দিল। সাথে সাথে খুলে গেল। বিহান দেরি না করে চারজার লাগিয়ে নিজের ফোনে চার্জ দিয়ে নিল। দেড় ঘণ্টা পর সে সাধারণভাবে হেঁটে মির্জা বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। যদিও বারবার মনে হচ্ছে কোন কিছু আবার সে ওলটপালট করে রেখে এলো কি না। সোজা গেল দিশার বাড়ি অর্থাৎ খন্দকার বাড়ি।

__________

দিশা সেই সকাল থেকে খন্দকার বাড়ির উঠোনে পায়চারী করছে আর বিহানের আসার অপেক্ষা করছে। বাড়ি ফেরার পর সে ঘুমানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু অতিরিক্ত উত্তেজনায় তার ঘুম যেন ছুটে পালিয়ে গিয়েছিল। বারবার সে রাতের ঘটে যাওয়া ঘটনা চোখের সামনে ভাসছিল। তার ভাইয়ের চেহারা, ভুতের রহস্য, এমনকি রাজবাড়ী বলে জানত যেই ভবন, সেই ভবন নাকি আসলে নেই। শুধু ছবি ছিল ওটা। সব কিছু নিজের পুরনো পড়ার সাথে মিলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল দিশা। নিজের বইয়ে অনেক বছর আগে পড়েছিল, মানুষ আকাশে উড়তে পারবে। সেটা যদি সম্ভব হয়ে থাকে, তাহলে এসব অদ্ভুত ঘটনাও হয়তো অন্যদের কাছে স্বাভাবিক। কিরণটাও তো কি সুন্দর একটা যন্ত্র বানিয়ে সেটা উড়িয়ে দেখালো। সেসব এখন ছাই হয়ে গিয়েছে। আগুনের পুড়ে এখন সেই ছাইও অবশিষ্ট হিসেবে রেখে দিয়েছেন কি না ওরা- সেটা দিশার জানা নেই। দিশার মনে আরেকটি নাম আসলো। ফজলু নামের ছেলেটাও একই কারণে মারা গেল। কিন্তু সে তখন ছোট ছিল। আর এখন বড় হয়েও দিশা কিরণকে বাঁচাতে পারল না ভেবেই নিজের উপর রাগ হচ্ছে তার। বার বার গত ১ দিনে ঘটে যাওয়া ঘটনা সামনে ভেসে উঠছিল। কত কিছু হয়ে গেল সেই ভর থেকে। অদ্ভুত সব ঘটনা!

শেষে ফিরে আসার আগে বিহান যে বলল তাকে আরও কিছু বলবে, সেই চিন্তায় আর ঘুম এলো না। সকাল থেকে পায়চারী করছে। দিশার মা এসে দেখে গেলেন কয়েকবার। প্রশ্নও করলেন কি হয়েছে। সেটার কোন রকম জবাব দিয়ে বাড়ির ভেতর মাকে পাঠিয়ে দিল দিশা। সে আপাতত এখনো সেই পুরনো সমীকরণ মিলাতে ব্যস্ত। ভূত, বাড়ি, কারখানা, সেই অজ্ঞান করিয়ে দেওয়ার ওষুধ- সব কিছুই বিহান তাকে পরিষ্কার করে বললেও তার কাছে ঘোলাটে ঠেকছে। তাছাড়া বিহানকেও সে এই গ্রাম সম্পর্কে বলবে। এতদিন যা যা জেনে এসেছে, সব বলবে। যদি ভাইকে ফিরিয়ে আনা যায়!

বিহান এসে দিশার পায়চারী দূর থেকে দেখেই থেমে গেল। ঘুমায়নি সেটা বোঝাই যাচ্ছে না। কিন্তু বিহানের মনে হলো তেমন। ঘুম থেকে উঠেও চোখে কাজল দিতে ভুলেনি। দিশার পায়চারী দেখে তার মাথায় আসলো,

“দিশা যদি এভাবেই তাদের বিয়ের পর তার জন্য অপেক্ষা করত! কিংবা তার সাথে ঝগড়া করার জন্য তার ছোট ফ্ল্যাটের সারা ঘর জুড়ে সেটা বেড়াত!”

কিন্তু সেটা আসলে সম্ভব নয়- ভাবতেই মন খারাপ হয়ে গেল বিহানের। দিশার মনের কথা আজও বুঝতে পারেনি বিহান। সব সময় দোটানায় থেকেছে। একবার মনে হয়েছে, হ্যাঁ, দিশা তাকে পছন্দ করে। তো পরে অকারণেই সে মতামত পাল্টে গিয়েছে। চোখের আড়ালে মানুষ অনেক সত্য লুকিয়ে রাখতে পারে। মন খারাপ হলেও হাসি মুখে অন্য কাউকে বুঝতে দেয় না। আবার নিজের গোপন লুকিয়ে রাখে। আর ধরা পড়ার মুহূর্তে মিথ্যা বলে সব ঠিক করে নেয়। কেউ সেই চোখের দিকে তাকিয়েও তার কথার গভীরতা ধরতে পারে না। এমন বৈশিষ্ট্য দিশার মধ্যেও আছে। তাই তো বিহান আজও দিশাকে বুঝতে পারল না। জানা নেই তার, আর কতদিন একসাথে থাকা হবে।

দেরি করল না বিহান। সরাসরি দিশার কাছে চলে গেল। দিশাও বিহানকে দেখতে পেয়ে খুশি হলো। দুজনের ভাবনা-ই আজকাল মাত্রা ছাড়িয়েছে। নিজেদের অজান্তে অনেক সময় কাটিয়ে ফেলে এইসব চিন্তা করে। দিশা বিহানকে নিয়ে তাদের বাড়ির কাছের পুকুরে নিয়ে গেল। গাছের ছায়ায় বসে নিরব থাক দুজনেই। সেই নিরবতার সুতো ছিঁড়ে প্রথম কথা বিহান-ই বলল।

— আপনাদের এই গ্রামটা এমন কেন?

— কেমন?

— মানে, বাইরের শহর কিংবা অন্য কারো সাথে আপনাদের দেখা হয় না কেন? আমিও তো চলে এসেছিলাম রাস্তা ভুলে। নাহলে তো আর কেউ আসতো না।

— মির্জা পরিবার প্রতিবার এই গ্রামের মানুষের মাথায় একটা কথা ঢুকিয়ে দেয়। অনেক বছর আগে এখানে গ্রামের বাইরের লোকেরা আক্রমণ করেছিল। অনেক কষ্টে তারা সবাই বেঁচে যায়। তারপর নির্দিষ্ট সংখ্যক গ্রাম একত্রিত হয়ে চারপাশে সুরক্ষার ব্যবস্থা করে। এতে করে বাইরের জগতের সাথে আমাদের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এই গ্রামের মানুষরা গ্রামের বাইরের মানুষ মানেই ভয়ংকর প্রাণী বলে মনে করে আর নিজেদের সন্তানদের মাথাও সেই একই কথা ঢোকানোর চেষ্টা করে সব সময়।

— তাহলে আমাকে কিছু বলল না কেন?

— গ্রাম প্রধানের জন্য। মকবুল মির্জার আর তার পরিবারের প্রতি এই গ্রামের মানুষদের অগাধ বিশ্বাস। চোখ বন্ধ করে তার কথায় ওরা উঠে আর বসে। কোন প্রশ্ন না করেই। মানুষ মারার মতো জঘন্য কাজেও তাদের মন সায় দেয়। আপনি যেদিন আসলেই সেই রাতেই তো ওরা আরেকটা খুন করতে যাচ্ছিল। মকবুল মির্জা সেদিন ভোরে সবাইকে জানিয়ে দিল যে আপনার কাছ থেকে আমাদের কোন ক্ষতি হবে না। তাই সবাই আপনার সাথে ভালো ব্যবহার করেছে।

— কিন্তু চাইলেই তো আমাকে মার খাওয়াতে পারতেন তিনি। সেদিন তো বেশ আহত হতে হয়েছিল আমাকে ওদের কাছ থেকে মার খেয়ে।

— ভালো সাজার অভিনয়। আপনাকে সাহায্য করে উনি গ্রামবাসীর সবার কাছ থেকে হাজার বছর বেঁচে থাকার দোয়া বিনা মূল্যে নিয়েছেন। আর মার খাওয়ার কথা বললেন যে। সেটা তো আপনাকে আগে জিজ্ঞেস করাই হয়নি। কি হয়েছিল?

— ওই তো গ্রামে ঢোকার পর-ই ওদের কাছে গিয়েছিলাম সাহায্য চাইতে। কিন্তু উল্টা আমাকে আঘাত করল।

— ওরা গ্রামের রক্ষা কাজে নিয়োজিত। বাইরের শত্রুদের হাত থেকে গ্রামের মানুষদের বাঁচানোর জন্য তারা আছে। বলতে গেলে এই গ্রামে বাইরে থেকে এই প্রথম আপনিই এসেছেন। এর আগে যে বা যারা আসার চেষ্টা করেছে, তাদের সবাইকে হয়তো মেরে ফেলা হয়েছে। ওইদিন যে ঘোরার সময় জঙ্গলের মধ্যে থেকে চিৎকার শুনতে পেলেন, ওটা মানুষের চিৎকার ছিল।

— তাহলে ওরকম বললেন কেন? আমরা যদি ওখানে গিয়ে ওকে বাঁচাতে…

— পারতেন না। ও তো ততক্ষণে মারাও গিয়েছিল। আমরা গেলে আমাদেরও মেরে ফেলত। আচ্ছা, আমি ভাবছি আরেক কথা। আপনাকে তো এমনি এমনি এই গ্রাম থেকে যেতে দিবে না ওরা। এতদিন আটকে রেখেছে।

— গাড়ি ঠিক হয়নি তাই।

— সত্যিই কি তাই?

— মানে কি?

— হতেও পারে, আপনাকে আর কোন দিন এই গ্রাম থেকেই যেতে দিবে না ভেবেছে ওরা। আপনি তো এই গ্রাম সম্পর্কে এখন অনেক জানেন।

— তাহলে আপনাকে বিয়ে করে খন্দকার বাড়িতে ঘর জামাই হয়ে থাকব।

— কি?

বিহান এতক্ষণে খেয়াল করল দিশাকে। লজ্জায় কিংবা রাগে তার মুখ লাল হয়ে গিয়েছে। বিহানের ইচ্ছা করল দিশার লাল হয়ে যাওয়া কান ছুঁয়ে দিতে। নিজের এক হাত দিয়ে আরেক হাত শক্ত করে ধরে ফেলল সে। একেই তো মুখ ফসকে মনের কথা বলে ফেলেছে। এখন যদি দিশা সত্যিই লজ্জা না পেয়ে রাগ করে বসে?

— আমার মনে হয় আপনাকে দিয়ে ওই কারখানায় কাজ করাবে।

— হতেও পারে।

এরপর কথা হলো বিহান কিভাবে সবটা জানতে পেরেছে সেই নিয়ে। তার রাতের ঘুম, খাবারে ওষুধ মেলানো, ওদের ঘরের সানে দিয়ে হাঁটার সময় হুট করে মকবুল মির্জা কথা আর গালি শোনা, কারখানা- সব।

— আমার আপনার সাহায্য লাগবে। আমি কিছুদিনের মধ্যেই সব ঠিক করার চেষ্টা করব। আজ তাহলে আসি।

— চলে যাবেন?

— হ্যাঁ, এখন তো যেতেই হবে। কারো সাথে যোগাযোগ করা দরকার।

— মানে, সব ঠিক করে তারপর চলে যাবেন?

— আমার কথা ভেবে দেখতে পারেন দিশা। আমি ঘর জামাই হয়ে না থাকলেও আমার বু হয়ে আমার সাথে কিন্তু আপনি যেতে পারেন।

— ধুর!

দিশা দৌড়ে চলে গেল নিজের বাড়ি। বিহান সেখানেই দাঁড়িয়ে থেকে বোকা হাসি দিল। দিশার তার কথার প্রতি অনুভূতি রাগ না কি লজ্জা- সেটা যে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে তার কাছে।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here