আঁখির আড়ালে,পর্বঃ- ১৫, ১৬ ও ১৭

আঁখির আড়ালে,পর্বঃ- ১৫, ১৬ ও ১৭
সাদিয়া_সৃষ্টি

বিহান রাত হওয়ার অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়েই পড়েছিল। ওর ঘুম ভাঙল অনেক দেরিতে। খাবার না খাওয়ার ফলে ক্ষুধা প্রচুর লেগে থাকলেও কিছু করার নেই। এখন খাবার খেলে সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়বে। বিহান ভেবে পায় না যে কি করে এতো কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ এই গ্রামে থাকতে পারে। তবুও বেশি ভাবাভাবির দিকে গেল না। ভাবতে গেলে রাত পার হয়ে যাবে। কিছু সময়ের জন্য বিহানের মনে হয়েছিল যে নিজের দারোগা হয়ে যাক। তাহলে যেকোনো সময় যেকোনো স্থানে তার অবাধ বিচরণে কেউ কিছু বলবে না। একটা বন্দুক মাথায় ঠেকালেই সব সত্য বিনা কষ্টে বের হয়ে যাবে। তারপর সে নিজের বাড়িতে ফিরে যাবে। কৌতূহল নামক অনুভূতিকে দমাতে পারে না বিধায় সব কিছু জানার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালায় সব সময়। আজকাল সে বাড়ি যাওয়ার কথাও ভাবে না। সেই কথা চিন্তা করলেই দিশাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা মাথায় আসে, যেটা বিহানকে দুর্বল করে দেয়। আচ্ছা, দিশাকে বিয়ে করে এখানে ঘর জামাই হয়ে থাকলে কেমন হয়?

ভেবেছিল রান্না ঘরে গিয়ে কিছু খাবার নিয়ে আসবে। কিন্তু ঘুটঘুটে অন্ধকার দেখে সেই চিন্তা বাদ দিল বিহান। আর নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দিল যে রান্না ঘরের সব খাবারেও ঘুমের ওষুধ থাকতে পারে। দেওয়াল হাতড়ে হাতড়ে কোন মতে মির্জা বাড়ি থেকে বের হয়ে সোজা পথে হাঁটল বিহান। তারপর হাতে থাকা প্রদীপ জ্বালালো। যেখানে নিজের বাড়িতে আলোর অভাবে এক ঘর থেকে পাশের ঘরে পর্যন্ত যেতে পারে না, সেখানে এতো দূর কি করে আসলো- বিষয়টা ভাবাচ্ছে বিহানকে। অন্ধকার ভীতি আছে, এমন নয়। কিন্তু অভ্যাস কোন কালেই ছিল না তার। পাঁচ কদম এগোতেও নয়-দশ বার পড়ে যাওয়ার স্বভাব তার। তাই তো রাতেই আলো জ্বালিয়ে রাখার স্বভাব। এই গ্রামের আসার পর সেটাও সম্ভব হয়নি। অবশ্য এই পর্যন্ত এতো কিছু দেখে যে পাগল হয়ে যায়নি বিহান, সেটাই অনেক।

বিহানের এখনো মনে পড়ে, সেদিনের মকবুল মির্জার বলা সব কথা।

“আসলে বিহান বাবা, দেখো, আমাদের এই গ্রাম অন্য সব গ্রামের মতো না। এটা তার থেকে বেশ ভিন্ন। এখানে মানুষের চালচলন, কথা-বার্তা, আচার-আচরণ, সব কিছুই। এখানে তুমি বেশ কয়েক যুগ পুরনো সংস্কৃতির প্রভাব দেখতে পারবে। বাইরের জগত থেকে আলাদা। তবে এখানে যে আধুনিকতার ছোঁয়া পৌছায়নি- এমন নয়। সবাই সবটা জানে, কিন্তু তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, পুরনো সংস্কৃতিকে ধরে রাখবে। সবার একই সিদ্ধান্ত হওয়ায় আমি এভাবেই গ্রাম পরিচালনা করে চলেছি এতকাল ধরে। আমার পূর্ববর্তী প্রজন্মও এই প্রথাকে প্রাধান্য দিয়ে এসেছেন। আর এই প্রজন্মেও তাদের মতামত একই। তাই হঠাৎ করে শহুরে অদ্ভুত কথা বললে তারা ভড়কে যাবে, তোমার সাথে স্বাভাবিক হতে পারবে না। তুমি সেদিকে খেয়াল রেখো। আর বেশি কথা বল না দরকার পড়লে। অতিথি হিসেবে ওরা তোমার সব সুযোগ সুবিধার দিকে খেয়াল রাখবে। তবে তোমার কোন কথা বা কাজের দ্বারা ওদের স্বাভাবিক জীবন ধারায় বিঘ্ন ঘটলে ওদের কষ্ট হবে। তাই ভাবলাম সবটা বলে রাখি তোমাকে। তোমার গাড়ি ঠিক করার সুযোগ পেলে অবশ্যই করিয়ে দেব। গ্রাম বলে একটু দেরি হতে পারে। তবে ততদিন যদি মানিয়ে নিতে, তাহলে ভালো হত।”

এক বিশাল ভাষণের মাধ্যমে তাদের প্রথম কথোপকথন। সেদিন খাবারের পর আলাদা ভাবে নিজের ঘরে ডেকে সবটা বোঝান বিহানকে। আর বিহানও সেভাবেই সবটা বুঝে নেয়। মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণের মতো অদ্ভুত কাজও তিনি করতে পারেন যেন। তিনি যেন কোন মনরোগ বিশেষজ্ঞ। বিহানও তারপর থেকে নিজের সব কথা এবং কাজে খেয়াল রাখত। যেন গ্রামবাসীর সাথে মানিয়ে নিতে পারে। কিন্তু যদি মানিয়ে না নিত, তাহলে বেশি ভালো হত বলেই এখন মনে হচ্ছে তার। অন্তত এতো অপেক্ষা করতে হত না তাকে। অনেক আগেই সবটা জানতে পারতো সে।

নিজের জামাকাপড়ের দিকে খেয়াল করে নিল বিহান। আজ ও একটা কঠিন পদক্ষেপ অবলম্বনের কথা ভাবছে। সেদিনের মতো ওদের সারিতে যদি কোন ভাবে ঢুকে যেতে পারে, তাহলে ওই দেওয়ালের রহস্য বের করতে পারে হয়তো। যেই ভাবা, সেই কাজ। সময় মতো ওই নদীর কাছের বনের মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে রইল। আগুনও নিভিয়ে দিয়েছে। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলেও যখন দেখা পেল না ওদের, তখন চরম হতাশ হলো। নিজের উপর-ই তার রাগ হচ্ছে। যদি সে ঘুমিয়ে না পড়ত, তাহলে হয়তো ওই দলকে হাতছাড়া করতে হত না তাকে। স্বভাবমতো নিজের মাথায় দুই হাত চলে গেল। আর সেই হাত দুটো খামচে ধরল চুল। হঠাৎ চুলের কথা মনে পড়তেই হাত ছাড়িয়ে নিল সেখান থেকে। এমনিই অতিরিক্ত চিন্তা করার ফলে চুলের অবস্থা বেহাল। কিছুদিন পর যেন সে দেখবে যে মাথায় একটাও চুল নেই। ভাবতেই কেঁপে উঠল বিহান। আজকাল বিহানের কাপাকাপি স্বভাবও রীতিমত বেড়ে চলেছে। আগে দিশাকে দেখলেই কাপাকাপি শুরু হত। এখন আবার কাঁপছে। তার চিন্তার সুতো ছিঁড়ল আলোর রেখার সন্ধান পেয়ে। আবার আরেক দল মানুষ হেঁটে হেঁটে আসছে। আগের মতই সেই প্রথম আর শেষ মানুষটি মশাল ধরে আছে। আর মাঝে সারি দিয়ে মানুষ হাঁটছে। সবাই ছেলে। এর মধ্যে কোন মেয়ে নেই। তবে আগের বারের মতো এদের সাথে দিশার ভাই নেই। সেটা দেখে নিল একবার। কিন্তু এখন চিন্তা হলো অনেক বড় মুখ করে তো ভেবেছিল যে ওদের মধ্যে ঢুকে পড়বে। এখন সেটা কি করে করবে?

বিহান মাটিতে হাতড়ে হাতড়ে একটা মাঝারি আকারের পাথর পেল। সেটা অন্ধকারে ছুঁড়ে মারল অপর পাশে। বেশি শক্তি ব্যবহার করায় পাথরটা পড়ল বেশ দূরে। তবে শব্দ হলো না। মশাল হাতে ব্যক্তির মাথার উপর দিয়ে যেতেই সে থেমে দাঁড়াল আর ২য় ব্যক্তিকে কিছু একটা বলল। এতে ওই দুইজন মিলে যখন আশেপাশে খোঁজাখুঁজি শুরু করল, তখন বিহান ফট করে ওদের মধ্যে ঢুকে দাঁড়িয়ে পড়ল আর ওদের মতো করে আশেপাশে মাথা ঘোরানো শুরু করল। তারপর ওরা দুজন কিছু না পেয়ে থেমে যেতেই আবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সবাই। হাঁটা শুরু করে সেই অদৃশ্য দেওয়ালের কাছে পৌছালো। একে একে সবাই যখন দেওয়াল ভেদ করে ওপারে যেতে থাকল, তখন বিহান কিছুটা চমকে গেলেও সেটা প্রকাশ করল না। মানুষকে অদৃশ্য হতে দেখে যে কেউ-ই ধরে নিবে যে সে অন্য কোন জগতে চলে যাচ্ছে যেন। বিহানের পালা আসতেই সামনে থাকা ব্যক্তি তাকে আটকাল।

— এভাবে নিজের মুখ কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে রেখেছিস কেন?

বিহান নিজের পরিকল্পনা মতো হাঁচি আর কাশি দেওয়া শুরু করল একের পর এক। তার কাশির বেগ দেখে লোকটা কোন মতে তাকে ধরে ভেতরে ঢুকিয়ে দিল। অদ্ভুতভাবে বিহান ঢুকেও পড়ল। আগের বারের মতো ধাক্কা পেল না এবার। বিহান চুপচাপ তাদের সাথে ভেতরে চলে গেল। আজ আর কোন ভাবনা নয়। শুধু দেখবে ওরা কি কি করে। এক এক করে ওদেরকে রাজবাড়ী পার করে সেই কারখানায় নিয়ে যাওয়া হলো। ওদেরকে কাজ বুঝিয়ে দিতেই সবাই যে যার কাজে লেগে পড়ল। বিহানের দায়িত্বে পড়ল মালামাল গাড়িতে ওঠানোর দায়িত্ব। সে সেই কাজ শুরু করে দিল। গাড়ি পর্যন্ত যেতে যেতে সবটা দেখে নিল ঠিক মতো। এক কোণে কিছু মানুষ বিশ্রাম নিচ্ছে। যদিও তাদের দেখে বিশ্রাম নিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। নেশায় পড়ে আছে বলেই বেশি মনে হচ্ছে। একটু খেয়াল করল তাদের। হৃদস্পন্দন, হাত- পায়ের নড়াচড়া, তাদের কথা বলার ধরণ দেখে বুঝতে পারল সকাল থেকে তারা কলুর বলদের মতো খেটেছে। আর এখন বিশ্রাম নিচ্ছে। তবে নেশা জাতীয় দ্রব্যের ব্যবহার করছে। বিহান প্রথম বার গাড়িতে জিনিস রেখে এসে পানি পান করার নাম করে সেদিকে গেল। সেখানে পানির কলস রাখা। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, মালিক পক্ষ শুধু কারখানার উন্নয়নেই খরচ করেন। বাকিদের কিছুই দেখেন না। তাই তো পানির কলস খালি পেয়ে দাঁড়িয়ে থাকল বিহান। আড়চোখে সবটা পরখ করে নিল। সেখানে তাদের হাতে মুখে সাদা কোন বস্তু লেগে থাকতে দেখে বুঝতে পারল এগুলো হয়তো নেশা জাতীয় দ্রব্যই। হাতের দিকে খেয়াল করল, সুচের অসংখ্য ছাপ। আর উটকো গন্ধ অনুভব করতেই সেখানেই বমি করে দেওয়ার মতো চরম করুণ অবস্থা হলো তার। নিজেকে সামলে আরেকটা কার্টুন উঠিয়ে নিল হাতে। সেটা গাড়িতে রেখে খোলা বাতাসে শ্বাস নিল। তার আগে যেই দুজন কাজ করছিল, তারাও বিশ্রাম নিতে চলে গিয়েছে দেখতেই সে নিজের গাড়ির কাছে চলে আসলো। বিহান ভেবেছিল এটা হয়তো ঘুমের ওষুধ তৈরির কারখানা। কিন্তু সারা কারখানা জুড়ে উটকো গন্ধ পেয়ে তার ধারণা পরিষ্কার হয়ে গেল। এটা ড্রাগস তৈরির কারখানা। এখানে হয়তো এমন কোন কিছুর উৎপাদন হয়, যেটার সাহায্যে দামি ও কম সময়ে কার্যকরী ড্রাগস পাওয়া যায়। তারপর নিজের ঘুমের কথা মনে পড়তেই সে শিউরে উঠল। মকবুল মির্জা কি তাকেও এইরকমের ড্রাগ দিয়ে আসছে? রাতের খাবারের কথা ভুলে গেল সে। দরকার পড়লে অন্য বাড়ি থেকে খেয়ে ঘুমের ভান ধরে থাকবে সারা রাত, তাও রাতের খাবার সেখান থেকে খাবে না। দরকার পড়লে ৩ বেলাই খন্দকার বাড়িতে খাবে সে।

এরপর নিজের কাজে লেগে পড়ল। নিজের গাড়ির ভিতরে ঢুকে ড্রাইভিং সিটে বসে পড়ল। চাবি তার কাছে ছিল বলে এই গাড়ি কেউ লক করতে পারেনি। শুধু দরজা আটকেই রেখেছিল এতদিন। নিচের দিকে ঝুঁকে একটা বোতামে চাপ দিতেই কট করে শব্দ হলো। অত্যন্ত ক্ষীণ স্বরে হওয়ায় শুধু বিহান-ই শুনতে পেল সেটা। হাতটা একেবারে সিটের নিচে নিয়ে গেল সে। এই জায়গাটা সে নিজেই বানিয়েছে। গাড়ির সিটের সাথে লাগোয়া ড্রয়ার যেন একটা। সেখান থেকে নিজের মোবাইল বের করে জামার ভেতর লুকিয়ে নিল। গাড়ি থেকে বের হয়ে আশেপাশে দেখে নিল একবার। সেই প্যাঁচানো সিঁড়ির দিকে তাকাতেই দেখল এক জোড়া চোখ তাকে দেখছে। ঘাবড়ে গেল বিহান। কিন্তু ঠিক করে দেখতেই যখন ঘুমে ঢলতে থাকা দুর্জয়কে দেখল তখন সে সতর্ক হয়ে দাঁড়াল। দুর্জয় সাথে সাথে দরজা বন্ধ করে দিল। বিহান এতক্ষনের আটকে রাখা শ্বাস ছাড়ল। সতর্ক হয়ে সেখান থেকে নিঃশব্দে বের হয়ে গেল। রাজবাড়ী পার হয়ে এসে থমকে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ভাবল। আশেপাশে তাকাল। চুপ করে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর সেই এক সশরীরীর সাথে কোলাকুলি করতে গেল কিন্তু পারল না। তাই আবার আগের মতো অদৃশ্য দেওয়ালের ওপারে যাওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু বাঁধা পেল। নদীর পার দিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত-ই ঠিক মনে হলো তার।

__________

কান্নার আওয়াজে ছেয়ে গিয়েছে শান্তিপুর গ্রাম। বিহান শুরুতে বেশ অবাক হলো। গত রাতেও তো সব ঠিকঠাক ছিল। তাহলে এক রাতের ব্যবধানে কি হলো?

চাইলেও বিহান সেখানে যেতে পারল না। কারণ তাকে তখন আগে নিজের ঘরে পৌঁছাতে হবে। সকালে মকবুল মির্জা নিজে বিহানের উপর নজর রাখেন। যদিও ঘরের মধ্যে এসে দেখে যান কি না সেই নিয়ে বিহান কিছু যাবে না। বিহান চুপিচুপি নিজের ঘরে চলে গেল সবার চোখের আড়ালে। আশেপাশে ভালোভাবেই পরখ করে নিয়েছিল সে। কেউ ছিল না তখন। তারপর স্বভাব মতো দেরি করে ঘর থেকে বের হলো। নিজের হাত মুখ ধুয়ে খাবার জায়গায় আসলো। ততক্ষণে কান্নার স্বর কমে এসেছে। কিন্তু বিহান সেসব নিয়ে কিছু বলল না তখনই। হঠাৎ করে মুন্নাকে দৌড়ে ঘরে আসতে দেখে মকবুল মির্জা উঠে গেলেন। তারপর তার সাথে কথা বললেন। পুরোটা সময় বিহান চুপ থাকলেও আর চুপ করে থাকতে পারল না। সে সরাসরি মকবুল মির্জাকে জিজ্ঞেস করল,

— চাচা, কিছু কি হয়েছে? চিন্তিত দেখাচ্ছে আপনাকে।

— আসলে কিরণকে তো চেনো হয়তো। ও মারা গিয়েছে। গত রাতে ওর বাড়িতে আগুন লেগেছে। অনেকে বলছে তার আবিষ্কার ভেঙে যাওয়ায় সে নিজেই নিজের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল রেগে গিয়ে। তারপর নিজেরই মরে গেল।

মকবুল মির্জার পুরো কথা শোনা হলো না বিহানের। কিরণ আর বেঁচে নেই কথাটা মস্তিষ্কে আঘাত হানতেই তার গলায় খাবার আটকে গেল। কোনোমতে খাবার শেষ করে মকবুল মির্জাকে বলে সে সোজা দিশার কাছে চলে গেল। দিশা তখন কোন এক কারণে খন্দকার বাড়িতে এসেছিল। সবটা দিশার কাছে জিজ্ঞেস করলে দিশা শুধু কিরণের বাড়িতে নিয়ে গেল বিহানকে। কিরণের জানাজা হলো যোহরের নামাজের পর। তাকে দাফন করা শেষ হলে সবাই আবার নিজ নিজ বাড়ি ফিরে যায়। বিহান যায় দিশার সাথে। খন্দকার বাড়িতে দুপুরের খাবার খাওয়ার কথা বললে বিহান হ্যাঁ বলে দেয়। সে শুধু দিশার সাথে কথা বলার সুযোগ খুঁজছিল। কিন্তু পেল না। তার আগেই দিশা গিয়ে ঘরের দরজা আটকে দিল। বিহান আর কোন উপায় না পেয়ে দিশার ঘরের পেছনের দিকে চলে গেল।

খন্দকার বাড়ির পেছনের অংশে দিশার বাবা বাগান করেছেন। বেশ কিছু জায়গা জুড়ে বাগান। একেবারে বাড়ির কাছ ঘেঁষে বড় আর মাঝারি আকারের গাছ। তারপর অন্যান্য ছোট গাছ। আর একেবারে প্রাচীরের কাছের জায়গায় বড় গাছ। বিহান বাগান দেখার নাম করে একাই চলে আসলো সেখানে। তারপর দাঁড়াল দিশার জানালা ঘেঁষে।

— দিশা আপনি কি এখানে আছেন?

বিহানের কণ্ঠ শুনে সে জালানা বন্ধ করে দিতে গেলে বিহান সেটা ধরে আটকাল।

— আপনাকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে আমি গত ২ দিন ধরে চেষ্টা করছি। আজ না বললে চলবেই না। দয়া করে বোঝার চেষ্টা করুন।

দিশা আবার জোর করে জানালা বন্ধ করে দিতে গেলে বিহান বলে উঠল,

— এটা আপনার ভাইয়ের কথাও।

দিশা থেমে গেল। বিহান সুযোগ বুঝে বলল,

— আপনি দয়া করে বাইরে আসুন। এভাবে কথা বলা যাবে না। অন্য কেউ চলে আসতে পারে। আমরা হাঁটতে হাঁটতে কথা বললে অন্যরা ভাববে যে আপনি আমাকে আপনাদের বাগান দেখাচ্ছেন। তখন আর আসবে না।

দিশার যুক্তিটি পছন্দ হলো। সে কিছু না বলেই বাড়ির পেছনে চলে আসলো। বিহান হাঁটা শুরু করে বলল,

— কিরণের কি হয়েছিল?

— আপনাদের প্রাণের প্রিয় মকবুল মির্জা ওকে মেরে ফেলেছে, যদি বলি, বিশ্বাস করবেন? করবেন না তো। তাহলে আমার সাথে আর কোন কথা বলতে আসবেন না।

— করি, বিশ্বাস করি।

দিশা অবাক চোখে বিহানের দিকে তাকাল। তারপর বিহান বলল,

— আমি আপনাকে অনেক কিছুই জানাব, এই গ্রাম নিয়ে, এই গ্রামের মানুষ নিয়ে আর আপনার ভাইকে নিয়ে। কিন্তু আমার কথা হয়তো প্রথমে বিশ্বাস করবেন না। তাই আজ রাতে আপনাকে আমি সেখানে নিয়ে যাবো। তৈরি থাকবেন। একটু ভরসা করুন। আমি সব ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করব। এখন আসি। আজ আর বাইরে যাবেন না। রাতে বের হবো আমরা।

বলেই বিহান সেখান থেকে চলে গেল দিশাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে।

__________

বিহানকে খুঁজে পেল না দিশা। অমাবশ্যা আসতে চলেছে হয়তো। তাই আকাশের চাঁদের অস্তিত্ব ক্ষীণ। আলোর পরিমাণ নেই বললেও চলে। অন্ধকারে বিহান কেন তাকে যাওয়ার আগে সেই আগের জায়গায় আসতে বলল সেটা বুঝতে পারল না দিশা। সেই ভাঙ্গা বাড়ি, সেই একই জায়গা। কিছুদিন আগেই তো এখানে এসেছিল তারা। অবশ্য তখনও সব ঠিক ছিল। আর আজ একজন মারা গিয়েছে। পার্থক্য এটুকুই। সেদিনও বিহানকে গান গেয়ে শোনাল, আর আজ এসেছে বিহানের কাছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা শুনতে। অনেকটা সময় অপেক্ষা করার পর বিহানের দেখা মিলল। বিহান এসেই কোন রকম অন্য আলোচনায় না গিয়ে বলল,

— আজ আমরা রাজবাড়ীতে যাবো।

— কেন?

— প্রশ্ন করবেন না। গতকাল আপনাদের তথাকথিত ওই ভুতেদের দেখা পেয়েছি আমি। তাদের সাথে কথাও বলে এসেছি। আজ ওরা বলেছে আপনার সাথে কথা বলবে।

— পাগল না কি?

— এর মাঝে একটা কথাও বলবেন না আপনি। নাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।

বলেই দিশাকে কিছু বলতে না দিয়ে বিহান তার হাত ধরে নিয়ে যেতে লাগল মাঠের শেষ প্রান্তে ওই প্রাচীরের দিকে। একেবারে থামল অদৃশ্য দেওয়ালের সামনে। দিশার হাত ধরে সেখানে ছুঁইয়ে দিতেই দিশা চমকে উঠল। ভয়ে কাপাকাপি করলেও কিছু বলল না। বিহান ওর ভয় কমাতে বলে উঠল,

— আমি আপনার কিছু হতে দিব না দিশা। আপনি শুধু চুপ থেকে আমার সাথে চলুন। আপনার সব প্রশ্নের উত্তর আমি দেব আজ। অনেক কিছু আছে, যেগুলো আপনি জানেন না দিশা।

দিশার কাঁপুনি কমল। সে নিজের সাহস জুগিয়ে বিহানের হাত ধরেই হাঁটা শুরু করল। বিহান দিশার হাত দিয়ে ওই দৃশ্য দেওয়াল ছুঁইয়ে হাঁটা শুরু করল। দেওয়ালের এক পর্যায়ে এসে আর কোন বাঁধা হাতে অনুভব করল না দিশা। বিহান ওর চোখে বিস্ময় দেখে বলে উঠল,

— এটা অদৃশ্য দেওয়াল। মানুষ তৈরি করেছে এই দেওয়াল। বাকিটা পরে বোঝাবো আপনাকে। শুধু এটুকু জেনে রাখুন যে এটা কোন আত্মা বা অশরীরীর কাজ নয়। এবার আমি যেভাবে জায়গাটা পার হচ্ছে, সেভাবেই আপনিও হবেন।

বলেই আগের মতো বিহান নিয়ের ভারসাম্য বজায় রেখে অদৃশ্য দেওয়াল হালকা ভাবে ছুঁইয়ে সেখান থেকে গায়েব হয়ে গেল। দিশা অবাক হলো। বিহানের চলে যেতেই জায়গাটা অন্ধকার হয়ে গেল। বিহানের হাতে ছোট মশাল ছিল। সেটাও আর দেখা যাচ্ছে না। দিশা আশেপাশে তাকাতেই তার নজর পড়ল পানিতে। সেখানে আলোর প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে। তখনই বিহান দেওয়ালের ওপাশ থেকে নিজের হাত বের করে বলল,

— আমি এখানে আছি দিশা। আপনি আমার হাত ধরে চলে আসুন সাবধানে। এটা শুধুই একটা দেওয়াল।

দিশা ওর কথামতই কাজ করল। আর দেখল, সত্যিই ও দেওয়ালের অপাশে চলে এসেছে। সামনে মাঠের বাকি অংশ। অন্ধকার হলেও জোনাকিদের টিমটিমে আলোয় আবছা ভাবে বোঝা যাচ্ছে সব। বিহান দিশার হাত ধরে সেখান থেকে সামনে হাঁটা ধরল। দিশা আর কোন কথা বলল না। সেও হাঁটতে থাকল বিহানের সাথে সাথে। বিহান থামল সরাসরি রাজবাড়ীর সামনে। সেখানে আসতেই দিশার কাপাকাপি আবার শুরু হয়ে গেল। বিহান নিজের নাক কাপড় দিয়ে ঢেকে নিল। দিশাকে ও বলল,

— এখানে একটু ঘ্রাণ নিয়ে দেখুন তো। বেশিক্ষণ না।

দিশা তাই করল। সাথে সাথে নাক চেপে ধরল।

— কিছু পেলেন?

— হ্যাঁ, লাশের গন্ধ।

— না, এটা মনে হচ্ছে লাশের মতো। কিন্তু এটা আসলে মানুষকে অজ্ঞান করিয়ে দিতে সক্ষম। আপনাদের গ্রামে বনে জঙ্গলে হাঁটার সময় কিছু উদ্ভিদ থেকে আমি এমন ঘ্রাম পেয়েছি। ঘ্রাণটা ভালো না হলেও এই ঘ্রাণ কম সময়ে মানুষকে অজ্ঞান করতে সক্ষম।

বলেই দিশার দিকে তাকাল। দিশাকে দেখতে পেল না সে ভালোভাবে। তবে দিশার মনের অবস্থা বুঝে বলল,

— মনে হতে পারে এটা কিভাবে সম্ভব। কিন্তু এটা আসলেই সম্ভব। যেমন ধরুন, আমরা অসুস্থ হয়ে পড়লে সেটার চিকিৎসা হিসেবে কবিরাজের কাছে যাই। তারা আমাদের বিভিন্ন গাছের নির্যাস প্রয়োজনমতো দেয় কিংবা সেগুলো কোন কিছুর সাথে মিশিয়ে ওষুধ তৈরি করে। এটাকে মানুষ খেয়ে সুস্থ হয়ে ওঠে। তবে কিছু ক্ষেত্রে এই ওষুধের ঘ্রাণও ওষুধ হিসেবে কাজ করে। শুধু মাত্র ঘ্রাণ নিয়েই কোনটা পছন্দের আর কোনটা বাজে, সেটা যেমন সম্ভব, তেমনই এই ঘ্রাণ আমাদের ভেতরে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে আমাদের শরীরের উপর প্রভাব ফেলে। সেই কারণে অনেকে ঘুমিয়ে পড়ে। আমাদের শহরে শুধু মাত্র ঘ্রানের ব্যবহার করে মানুষকে অজ্ঞান করে দেওয়া হয়, তারপর তাকে ধরে নিয়ে যায়। তাকে আটকে রেখে তাদের পরিবারের কাছে অর্থ চায়। সহজে নিজেরা ধনী হতে এর একটা কারণ। যাই হোক। নিজের নাক ভালোভাবে চেপে ধরুন নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে।

দিশার কাছে পুরো বিষয়টা পরিষ্কার না হলেও তার মনে হলো সে সবটা বুঝতে পেরেছে। তাই নিজের নাক কাপড় দিয়ে চেপে ধরল। কিছু সময়ের মধ্যে আগমন হলো অদ্ভুত মুখশ্রীর মানুষের। সবগুলোই ভয়ংকর। দিশা চিৎকার করতে গিয়েও করল না। ততক্ষণে বিহান আলো নিভিয়েও দিয়েছে। কখন করেছে সেটা দিশা খেয়াল করেনি। তবে সেই অদ্ভুত এবং ভয়ংকর মুখশ্রীর মানুষদের দেখে বেশ ভয় পেল। কিন্তু বিহানের কথা মনে পড়তেই দেখল বিহান তাদের একজনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ওদের অন্ধকারেও দেখতে পাওয়ার কারণ ওদের ভেতর থেকে আলো ছড়িয়ে পড়ছে। বিহান একজনকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করল ঠিকই। কিন্তু সফল হল না। সেই মানুষটা বিহানের মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করে সোজা চলতে থাকল। আর বেশ কিছুদূর গিয়ে তারপর দুই হাত দুই দিকে তুলে চিৎকার করে উঠল। দিশা ভয় পেল না এবার অদ্ভুত কারণে। ভুত যদি হয়েই থাকে, আর বিহানকে যদি ভয় দেখিয়েই থাকে, তাহলে সে বিহানকে অতিক্রম করে গিয়ে তারপর চিৎকার করল কেন? প্রশ্নটা খেলে গেল তার মাথায়। করার হলে আগেই করত। সমস্যা কি?

বিহান দিশার চিন্তা মাখা মুখটা কল্পনা করে হাসল। ভ্রূ কুঁচকে রেখে দিবে, মাঝে মাঝে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরবে। হাত দিয়ে মাথা চুলকানোর ভান ধরবে। পুরনো অভ্যাস হয়তো। বিহান নিজেই অবশ্য সঠিক সময় সে মানুষের সামনে গিয়েছিল। সেটা আসলে ভুত বা আত্মা নয়। সেটা শুধু একটা ছবি। নিচে যন্ত্র আছে, সেটা থেকে ছবির নিঃসরণ ঘটছে। অন্ধকারে হওয়ায় ছবিটা খুব ভালো ভাবেই দেখা যায়। আগের দিন বিহান দূরে থেকেই এদের খেয়াল করেছিল। একটা নির্দিষ্ট সময় পর পর এটা চিৎকার করে ওঠে। তবে সবগুলোর সময় একই। স্বাভাবিক ভাবে ১ থেকে ঠিক ৪৪ পর্যন্ত গুণতেই প্রতিটা যন্ত্র শব্দ করে ওঠে। দিশাকে যখন ঘ্রানের বিষয়টা বোঝাচ্ছিল, তখন তার চোখে পড়ে ওই যন্ত্রের আগমন। তাকে চিৎকার করে দেখেছিল দূর থেকেই। আর শব্দ করলে সাথে সাথে দুই হাতও তুলে ফেলার মতো করেই ইমেজ তৈরি করা হয়েছে। বলা যায়, প্রজেক্টরে যেমন ভিডিও দেখানো হয়, ঠিক তেমন ঘটনা ঘটেছে। শুধু পার্থক্য এই যে ওটা একটা সাদা পর্দায় দেখানে হয় আর এই যন্ত্রে কোন পর্দার প্রয়োজন নেই। সেভাবেই বিহান ১ থেকে ৪৪ পর্যন্ত গুনে ফেলে। হিসাব করে সময়ের সাথে মিলিয়ে ৩৮ কি ৩৯ এ ভুতের ছবিটা তাকে পার করে যায়। আর সময় হতেই সে যন্ত্র থেকে শব্দ বের হয়ে আসে আর ছবির পরিবর্তন ঘটে ভিডিও চালু হয়।

বিহান এবার ভাবছে দিশাকে এসব কি করে বোঝাবে। সে নিজের কথা শুরু করল যেহেতু দিশাকে প্রশ্ন করতে আগেই মানা করে দিয়েছিল, তাই দিশা তো প্রশ্ন করবে না।

— দিশা, এটা হত আপনাদের নকল প্রেতাত্মা। এর ঠিক ছবি ধরেই নিচের দিকে খেয়াল করেন। একটা ছোট বাক্স ধরণের কিছু দেখতে পারবেন। কালো রং হওয়ায় দেখা সম্ভব নয়। তবে নিচে ঠিক করে দেখুন। সেখান থেকে আলো নির্গত হচ্ছে আর সেই আলোয় ছবিটা ভেসে উঠছে।

দিশা নিচের দিকে তাকাল। সত্যিই একটা কালো ছোট বর্গাকৃতির বাক্স আর সেখান থেকেই আলো ছড়িয়ে পড়ছে উপরের দিকে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here