আঁখির আড়ালে,পর্বঃ- ০৭ ও ০৮

আঁখির আড়ালে,পর্বঃ- ০৭ ও ০৮
সাদিয়া_সৃষ্টি

— সাবধানে কাজ কর। সব যেন ঠিকঠাক থাকে। কম বেশি না হয় যেন। আগের বার তোরা কয়েকজন নিজেই গিলেছিলি। কাজে মন দিস নি। পরে ফল আমাকে ভুগতে হয়েছে। এখন আর ভুল করবি না। আগের বার কিন্তু আমি ছাড় দেইনি একটাকেও। ওগুলোর কথা মনে রাখবি। আমাকে ফাঁকি দেওয়ার আগে ভালো করে বুঝে নিবি। ভেবে দেখবি ১০০ বার। আরে আরে, এতো দেরি হয় কেন? তাড়াতাড়ি কর। হাত চালা জলদি। সব যেন সময়ের মধ্যে ঠিক থাকে। এমনিই এবার সময় খুব কম। দেরি করা যাবে না। ওই ওই… পড়ে গেল তো। আমার সব জিনিস কি তোর বাপ এনে দেবে? ঠিক করে কাজ কর। একটাও যেন নষ্ট না হয়। নাহলে টাকা পাবি না। হাত চালা, জলদি।

বলেই বেশ কয়েকটা বাজে বাজে গালি দিলেন কর্মচারীদের। তারপর নিজ চেয়ারে আবার আয়েশ করে বসলেন মকবুল মির্জা। হঠাৎ করে গতকাল শুনেছিলেন কাজের ক্ষেত্রে কিছু সমস্যার কথা। তারপর থেকেই মাথা গরম হয়ে আছে তার। তাই আজকাল দেরি করে বাড়ি ফিরছেন তিনি। কয়েক দিন কাজে ঠিকমতো আসেন নি। তাকে শহরে যেতে হয়েছিল। তারপর আবার রাতে ফিরতে হয়। এসে গ্রামের শোন খোঁজ নিতে হয়। হঠাৎ করে যখন কাজে কিছু সমস্যা শুনতে পারলেন, অমনি রেগে আগুন হয়ে গেলেন। কাজের ক্ষেত্রে হেরফের পছন্দ করেন না তিনি। তার পূর্বপুরুষরাও কাজের ক্ষেত্রে বেশ সচেতন। তাদের বংশে যেন এই গুণ বজায় রয়েছে যুগ যুগ ধরে। শুধু মকবুল মির্জার ছোট ছেলে একটু বেশি অন্যরকম। তবুও তাকে মেরে সিধে করেছেন তিনি। নিজের ৩ ছেলেকেই নিজের মতো বানিয়ে নিয়েছেন নিজ দায়িত্বে। নিজ হাতে তাদের বড় করেছেন। ছেলেদের দিয়ে সব ভাগ করে সামলানো হলেও নিজে যতদিন পারেন, খেয়াল রাখবেন। কোন কর্মচারীর উপর তার বিশ্বাস নেই। সবার চোখে চোখে রাখেন তিনি। বয়স বাড়লেও তার শকুনের চোখ। তার সেই নজর থেকে কারো রেহাই নেই। কেউ ঠিকমতো কাজ না করলে শাস্তিও পায় ভালোমতো। আর সেই একজনের শাস্তির ভয়ে বেশ কয়েক মাস কিংবা কয়েক বছর অন্যদের মধ্যে গেঁথে যায়। যার জন্য বেশি কষ্ট করতে হয় না মকবুল মির্জাকে। তবুও নিজেই সব সামলান। মকবুল মির্জার ৩ ছেলে, বছরে ৪ মাস করে গ্রামে থাকে। আর বাকি ২ ছেলে শহরে থাকে। নিজেদের পালা আসলে আবার গ্রামে চলে আসে আর এদিকের সব সামলায়। যাতে করে মকবুল মির্জা সহজে গ্রামের সকলের খবর রাখতে পারেন আর নিজের সম্মান সকলের মনে সজাগ রাখতে পারেন। সব সামলানোর জন্য পরিকল্পনা তার নিজের করা। এর আগেও তার পূর্বপুরুষ যে গ্রাম সামলে আসছেন, পাশাপাশি তাদের কাজ। সেখান থেকেই অভিজ্ঞতা নিয়ে নির্ভুলভাবেই সব পরিচালনা করে চলেছেন মকবুল মির্জা।

__________

বিহান আর দিশার এভাবে ঘুরে বেড়ানো কেউ ভালোভাবে না নিলেও কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না। দিশার অগোচরে অনেক কথা বললেও সেটা কোন না কোন ভাবে দিশার কাছে পৌঁছে যাবে। বিশেষ করে নিজেদের ছোট ছেলে মেয়েরাই এই বাহকের কাজ করে থাকে। এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে। তাই সবাই সব কথা, গালাগাল সব নিজের মনে মনে দিয়ে ক্ষান্ত থাকছে। একবার এক মহিলার কথা তার ছেলে যখন দিশাকে বলেছিল, তখন সেই মহিলা নিজের ছেলেকে শুধু কয়েকটা থাপ্পড় মেরেছিল। ফল স্বরূপ দিশা সেই মহিলাকে বাঁশ দিয়ে পিটিয়েছিল। তারপর থেকে বাচ্চাদের মারার সাহস আর ওদের নেই। যেহেতু কিছুই করতে পারবে না, তাই শুধু মনে মনে গালি দিয়েই শান্ত থাকতে হয় সবাইকে। তবুও মাঝে মাঝে গোপনে কারো না কারো সাথে এই নিয়ে কথা তোলে-ই কেউ না কেউ। তাদের ব্যাপারে দিশা মাথা ঘামায় না। নিজের নিয়ে কোন চিন্তা তার নেই। কিন্তু তার জন্য অন্য কেউ কিছু শুনবে বা মার খাবে, এটা সে মানতে পারে না।

বিহান এর দৃষ্টি সামনের বিস্তীর্ণ মাঠে আটকে আছে। খুব বেশি বড় না হলেও খুন বেশি ছোটও না এটা। আর এক পর্যায়ে গিয়ে এক বিশাল প্রাচীর। দৈর্ঘ্য ও প্রস্ত উভয় দিক থেকেই বিশাল সেটা। বিহান সেদিকে নিজের ডান হাতের শাহাদাত আঙুল দিয়ে ইশারা করে বলল,

— ওই প্রাচীরের ওখানে তো গ্রাম শেষ, তাই না দিশা?

— না, ওখানে শেষ হবে কেন? আমাদের শান্তিপুরের এই মাঠ আশেপাশে ৪০ গ্রামে সবচেয়ে বড় মাঠ।

— সবচেয়ে বড় মাঠ মানে? এইটা সবচেয়ে বড় মাঠ? এর থেকেও তো বেশ বড় মাঠ আমি পাশের গ্রামে দেখেছি।

— আরে, ওই যে ওই প্রাচীর দেখছেন, ওখানেই তো গ্রাম শেষ হয়ে যায়নি। ওই পরে যে বিশাল মাঠ আছে, সেটাও এই গ্রামের।

— তাহলে ওখানে প্রাচীর দেওয়া কেন?

— আসলে ওই মাঠের একেবারে শেষ প্রান্তে এক বিশাল রাজবাড়ি আছে। সেখানে মানুষ যাওয়া আসা করে না।

— কেন করে না?

— করে না কারণ ওখানে ভুতের বসবাস আছে।

— তাই নাকি?

— হ্যাঁ তাই।

— হাসাবেন না দিশা।

— বিশ্বাস না হলে অন্যদের জিজ্ঞেস করুন। যে জীবনে একবারও ভুত দেখেনি, সেও ওখানে গিয়ে ভুত দেখতে পায়।

— আমি ভেবেছিলাম, আপনি ভুতে ভয় পান না কিংবা বিশ্বাস করেন না।

— করতাম না।

— তার মানে এখন করেন।

— অর্ধেক অর্ধেক।

— অর্ধেক?

— হ্যাঁ, বিশ্বাস করি আবার করি না। জানেন, কখনো ভুত সম্পর্কে আমার বিশ্বাস ছিল না। কিন্তু ওই রাজ বাড়িতে যাওয়ার পর নিজের জানা সব জ্ঞান অর্থ হীন লাগে।

— তার মানে আপনি অশরীরীতে ভয় পান।

— এটাও অর্ধেক অর্ধেক।

— মানে ভয় পান আবার পান না কখনো।

— হ্যাঁ।

— ওই একই কথা, ভয় তো পান-ই।

— হাসবেন না বিহান। আপনি গেলেও ভয় পাবেন।

— ওহ! তাহলে আপনি ভুতেদের সাথে এক দফা গল্পও করে এসেছেন?

— হ্যাঁ, মানে না। গল্প করিনি।

— তাহলে?

— ওখানে গিয়েছিলাম। তারপর কি অদ্ভুত সব ঘটনা হলো।

— যেমন? একটু খুলে বলবেন দিশা?

— ওখানে আমি যখন বাড়ির কিছুটা কাছে পৌছায় তখন মৃত মানুষের লাশে গন্ধ নাকে এসে বাড়ি খায়। প্রথমেই ভড়কে যাই। কিন্তু ভয় পাইনি। পরে এগিয়ে যেতে যেতে আরও অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটে। জানেন, ওখানে গত কয়েক যুগ ধরে কেউ যায়নি। বিশেষ করে ওখানে মৃত কেন, কোন জীবিত মানুষ-ই যায় নি। কি করে লাশের ঘ্রাণ পাওয়া যেতে পারে সেটাই কেউ জানে না। তারপর অদ্ভুত সব আওয়াজ, কোন কিছুর অস্তিত্ব অনুভব করা সব কিছু মিলিয়ে ভয় নিয়েই এগিয়ে চলেছিলাম। আশেপাশে দিকে কেউ কেউ দৌড়ে যাচ্ছিল, তাও অগ্রাহ্য করি। সাহস ততক্ষণে একেবারে নাই হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বেশিদুর আগাতে পারি নি। তার আগেই জ্ঞান হারাই। পরের দিন যখন জ্ঞান ফেরে আমার, তখন জানতে পারি প্রাচীরের এপারে অন্যরা আমাকে কুড়িয়ে পেয়েছে। তারপর থেকেই আমি এক প্রকার দোটানায় আছি। তবে এর পর আর কেউ যাওয়ার চেষ্টা করে নি। অনেকে তো ভেবেই নিয়েছে আমার মধ্যে অন্য কেউ প্রবেশ করেছে। এতদিন আমার সাথে ঘুরছেন, আপনার মনে হয় নি যে আমি ভয়ংকর?

বলেই হু হা করে হেসে উঠল দিশা। বিহানের মস্তিষ্ক কিছু সময়ের জন্য খালি হয়ে গেল। শুধু ঝংকার তুলল সেই হাসির শব্দ। যেন কোন সুর মেনে সেই তালে তালে হেসে চলেছে দিশা। দিশার হাসির ফলে চোখ আরও প্রসারিত হলো। কাজল সেই চোখে বেশ মানায়। এমন কোন দিন নেই যেদিন দিশা কাজল দেয় না। মেয়েটার যেমন কাজল পছন্দের, তেমনই মেয়েটা কি জানে, কেউ একজন তার এই কাজল দেওয়া চোখের উপর প্রতি মুহূর্তে খুন হয়? জানে না। নাহলে এতক্ষণ হাসতে পারতো না সে।

মনে মনে কথাগুলো বলে বিহান নিজের মনে জেগে ওঠে কিছু ইচ্ছাকে দমন করল সময় থাকতেই।

— কি হলো? বললেন না যে, আমাকে ভয় পান কি না?

— না, পাই না।

এর থেকে বেশি কিছু বলার সামর্থ্য আপাতত বিহানের নেই। আর থাকলেও সে বলবে না। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা যে বড্ড প্রয়োজন। শান্ত মস্তিষ্কের বিহান যে অশান্ত হয়ে পড়ছে।

“নাহ! নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতেই হবে!”

ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল বিহান দিশার অগোচরে। নিজের চোখে আড়ালে দিশার প্রতি থাকা মুগ্ধতা আপাতত আড়াল করতেই হবে। যেখানে নিজের এই গ্রামে থাকার কোন নিশ্চয়তা নেই, সেখানে নিজে মায়ায় পড়লেও অন্য কাউকে মায়ায় ফেলার মতো ঘোর অন্যায় কাজ সে করতেই পারবে না। দিশা তার মায়ায় না পড়ুক, তবুও অন্য কোন অনুভূতির সম্মুখীন সে দিশাকে করতে চায় না। শুধু একটা ছোট অনুভুতিই পারে অনেক বিশাল অনুভূতির জন্ম দিয়ে মানুষকে তিলে তিলে শেষ করে দিতে। নিজের কল্পনা যদি সঠিক হয়, তাহলে দিশাও সেই মায়াজালে আটকে পড়বে। সেটা কিছুতেই চায় না বিহান। কিন্তু জীবনে প্রথমবার কোন কিছুর প্রতি লোভ হলো। ‘দিশাকে জানার প্রতি’। এই লোভটা আর সহজে দমন করতে পারল না সে।

— আপনি মনে হয় রাতটা ঘুমিয়েই কাটান?

— হ্যাঁ, তাছাড়া কি করব?

— আমাদের রাতের গ্রাম দেখবেন। এই যে, এখান থেকে ২০-৩০ হাত দূরে যেই ভাঙ্গা বাড়িটা দেখতে পারছেন, সেখানে দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে আকাশ দেখবেন। প্রাচীরের দিকটা দেখার চেষ্টা করবেন। আকাশে পূর্ণিমার সময় চাঁদ আর অমাবশ্যায় তারা দেখার সুযোগ পেলে কখনই সেটা হারাবেন না। ওই প্রাচীরের ওদিকে যে ছোট ঝোপ মতো আছে, ওখানে জোনাকিদের মেলা দেখবেন। জীবনে এই দেখাটা বাদ দিবেন না।

— অন্ধকারে এই পর্যন্ত আসব কি করে? আপনাদের গ্রামে তো সন্ধ্যার পর আর আলো পাওয়া যায় না।

— আমার মতো করে, আন্দাজে।

— আপনি এখানে ছোট থেকে বড় হয়েছেন। চোখ বেঁধে দিলেও হয়তো না দেখে চিনতে পারবেন। কিন্তু আমি মাত্র কয়েক দিনের অতিথি। আমি কি আর পারব?

“কয়েক দিনের অথিথি” কথাটায় থেমে গেল দিশা। আবার নিজেকে স্বাভাবিক করে জবাব দিল,

— তাহলে একটা প্রদীপ নিয়ে আসবেন।

— সেটাও সম্ভব না। ঝামেলা আছে। আগুন নিভে গেলে জ্বালানোর সুযোগ থাকবে না।

— ওহ!

কিছুক্ষণ ভেবে দিশা জবাব দিল,

— তাহলে আমি আপনাকে দেখাব।

— ঠিক আছে। তাহলে আজ রাতে?

— এই না না।

— কেন না?

— আজ রাতে আসতে পারব না। আগামী কাল রাতে আসব।

— কেন? আজ কি হবে?

— আজ হবে না। অনুমতি নেই।

— আপনি আবার অনুমতিও নেন নাকি?

— অবশ্যই। অনুমতি ছাড়া কিছু করলে এতক্ষণে আমার আম্মা আমার হাড় ভেঙে গুড়ো করে দিত। তারপর আব্বা সেটা পানিতে ভাসিয়ে দিত।

–কেন?

— সারাদিন রাত বাইরে থাকা যাবে না। দিলে বাইরে থাকলে রাতে থাকা যাবে না। আর রাতে গেলে দিনে বাড়িতে থাকতে হবে।

— ওহ! তাহলে তো ভালোই অনুমতি আছে।

— সে আছে।

— তাহলে এখন ফিরে যাই, একেবারে কাল রাতে দেখা হচ্ছে। রাতের আকাশ দেখাবেন বলছেন।

— সেটা দেখাব।

— ঠিক আছে। এখন আসি।

দিশা সালাম দিয়ে বিদায় নিল। বিহান সেদিকে তাকিয়ে থাকল। দিশার এভাবে চলে যেতে দেখা তার ভেতর চিনচিনে ব্যথার উপক্রম ঘটানো শুরু করেছে আজ কয়েক দিন ধরে।

__________

পরের সিন সকালটা প্রতি সকালের মতই কাটল। মকবুল মির্জার সাথে বসে খাওয়া। কিছুক্ষণ কথা বলা। আজকাল আবার বিহানের মনে সন্দেহের সৃষ্টি হচ্ছে। তার মনে হচ্ছে মকবুল মির্জা যে হাসি দিয়ে কথা বলেন, সেটা আসল হাসি না। কিন্তু এই বিষয়টা কি শুধুই তার কল্পনা, নাকি বাস্তব- সেটা সে জানে না। জানার চেষ্টাও করেনি কখনো। বার বার দোটানায় পড়েছে। এভাবে যার বাড়িতে থাকছে তার উপর গোয়েন্দাগিরি করাটা ঠিক মনে হচ্ছে না বিহানের। কিন্তু মস্তিষ্ক বার বার বলছে যে নাহ, এখানে থাকা সুবিধার কি না সেটা জানতে হলেও একবার গোয়েন্দা হোক। এতে কোন ক্ষতি নেই! আর যদি সত্যিই পরে মনে হয় যে সে ভালো মানুষ, তাহলে তো হয়েই গেল। কোন চিন্তা নেই। তাছাড়া আজকাল তার ঘুম পরিমানের থেকে বেশি-ই হচ্ছে। তার মতো পাতলা ঘুমের অধিকারী যদি এমন জায়গায় এসে সারা সকাল পড়ে পড়ে ঘুমায়, এটা ভাল দেখায় না। নিজের ঘুমের প্রতিও নিজের সন্দেহ হচ্ছে। তবুও কিছু করছে না বিহান।

কথার মাঝে বিহান প্রাচীরের কথাটা তুলল।

— আচ্ছা, কাকা, এখানে যেই প্রাচীরটা আছে, ওটা-ই তো গ্রামের সীমানা, তাই না? ওই যে মাঠের দিকে প্রাচীর।

— গ্রামের শেষ প্রান্তে যে মাঠ আছে ওটা?

— জ্বি কাকা।

— হ্যাঁ, ওখানেই শেষ। ওর পর আরেক গ্রাম। সেই গ্রামের মাঠের শুরু ওই প্রাচীর থেকে।

ব্যস! এই কথাটাই যথেষ্ট ছিল তার মনে সন্দেহ ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্য। বিহান বেশি কথা বলল না। মাঠ থেকে কথা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে গেল। এখানকার জন জীবন, খাবার- এসবে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। শুনেছে সামনে মেলা বসবে। সেই নিয়েই কিছু সময় আলোচনা চলল তাদের মাঝে। শাকিল সেখানে ছিল না। সে কাজে চলে গিয়েছে সকাল সকাল।

তবে মকবুল মির্জা ঘর থেকে বের হওয়ার পর বিহানের মনে গতকালের কথা উঁকি দেয়। দিশা তাকে প্রাচীরের অপার নিয়ে যেই কথা বলেছে আর মকবুল মির্জা তাকে যেই কথা বলেছে সেটার কোনটাই ফেলতে পারছে না। আবার দিশা আর মকবুল মির্জা দুজনেই বিহানের কাছে রহস্যের ঝুড়ি নিয়ে বসে আছে। কাকে রেখে কারে সে বিশ্বাস করবে সেটাই বুঝতে পারছে না। মকবুল মির্জার পক্ষে যুক্তি দাঁড় করাচ্ছে একবার, তো একবার দিশার পক্ষে। দিশাকে যখন ঠিক মনে হচ্ছে তখন মকবুল মির্জা দোষী। কিন্তু মকবুল মির্জা হয়তো বাইরের মানুষকে কিছু জানিয়ে ভয় পাওয়াতে চান না সেই ভেবেই মিথ্যা কথা বলেছেন। কিন্তু তার মতো মানুষ কি মিথ্যা কথা বলতে পারে? বিহানকে এমন ভাবে সব বললেন যেন যা যা বললেন সব শতভাগ সত্য। কি সুন্দর গুছিয়ে বলে দিলেন। বিহানের কিছু সময়ের জন্য মনেই হয়নি যে তিনি মিথ্যা কথা বলছেন। নিজের জন্য বরাদ্দ ছোট ঘরটায় এসে নিজের চুলের মুঠি চেপে ধরল বিহান। অন্য কাউকেও জিজ্ঞেস করতে পারবে না সে। তাকেই সন্দেহ করা হবে। এখানকার সব কথা মকবুল মির্জার কানে যায়। তিনি রাতে কিংবা দিনে যখন সমস্য পান, তখনই সবার খবর নেন। যতই ব্যস্ত হন না কেন? সেই ক্ষেত্রে তার বার বার এক প্রশ্ন করা যে কোন ঝামেলার সৃষ্টি করবে না সেটার কোন গ্যারান্টি নেই। তাই চুপ করে থাকাই শ্রেয়। যদি সত্যিই কোন ঝামেলা থাকে তাহলে সেটা নিজে থেকেই ঠিক করতে হবে।

শান্ত হয়ে বিছানায় বসে পড়ল বিহান।

__________

আকাশে চাঁদের অস্তিত্ব বেশ ভালোভাবেই বোঝা যাচ্ছে। তবুও যেন অন্ধকারের রাজত্ব। অমাবশ্যা তো না-ই, তবে পূর্ণিমাও না। বলতে গেলে মাঝামাঝি সময়। চাঁদের আকার এরপর থেকে কমতে শুরু করবে, না বাড়তে শুরু করবে সেটাই যেন বোঝা যাচ্ছে না। অবশ্য অনেক দিন পর রাতের আকাশ দেখলে এমনটা হওয়ার কথা। গত কয়েক রাত ধরে বিহান শুধু ঘুমিয়েই যাচ্ছে। চাঁদের সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগ নে একদম-ই পায় নি। দিশার কথা-ই ঠিক ছিল। শহুরে জীবনে তো ব্যস্ততায় প্রকৃতির কথা এক প্রকার ভুলেই যায় মানুষ। কিন্তু বিহানের তো গ্রামে কোন ব্যস্ততা নেই। তাও এতগুলো দিন লাগিয়ে দিল সে এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে। নিজের উপর রাগ হচ্ছে তার। পরিবেশ বদলের পর যে কোন মানুষ এতো ঘুম কাতুরে হতে পারে, সেটা তার জানা ছিল না। তবুও দিশা যে গতকাল সেই কথাটা তুলেছিল সেজন্যই দিশাকে একবার জড়িয়ে ধরে ধন্যবাদ জানাতে ইচ্ছা করছে। আশেপাশে অন্ধকার কিন্তু আকাশে চাঁদ ঠিক-ই আলো দিচ্ছে। বিহানের কাছে অদ্ভুত লাগছে বিষয়টা। চাঁদের আলো ঠিকই পৌছাচ্ছে তাদের কাছে, কিন্তু তাতে আলোকিত মনে হচ্ছে না জায়গাটা। বরং চাঁদের আলো যেন সেই কুঁড়েঘরের অন্ধকার কে ফুটিয়ে তুলছে শুধু-ই। নিজের এমন চিন্তায় নিজেই অবাক হচ্ছে। ২৬ বছরের জীবনে আগে এভাবে কখনো প্রকৃতিকে এতোটা বিশ্লেষণ করে দেখেনি সে। এতে বেশ ভালো লাগছে বিহানের কাছে। দিশা বিহানকে শান্ত থাকতে বলে সামনে মাঠের দিকে তাকানোর ইশারা করল। সামনে খোলা মাঠে থেকে থেকে আলো জ্বলছে, নিভছে। আলোর খেলা খেলছে যেন জোনাকির দল। আলোর মেলা বসেছে , বিশেষ করে প্রাচীরের কাছের ঝোপে। সেখানে গেলে মনে হয় কৃত্রিম আলোর আর প্রয়োজন হবে না। মনে মনে হাসল বিহান। এই ছোট ছোট বিষয়গুলো তাকে অজানা আনন্দ দিচ্ছে। জীবনের নির্ধারিত নিয়ম থেকে বের হওয়ার আনন্দ, নতুন কিছু জানতে পারার আনন্দ। বিশেষ করে, নিজের চোখে দেখা প্রথম এমন সুন্দর মুহূর্তে দিশার পাশে থাকার আনন্দ। মাটিতে হাত পা ছড়িয়ে বসতে ইচ্ছা করল তার। দিশাকে কোলে তুলে গোল গোল ঘোরার ইচ্ছেও বাদ যায়নি।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here