অজান্তে_আগমন,পর্বঃ- ১৪,১৫

অজান্তে_আগমন,পর্বঃ- ১৪,১৫
সাদিয়া_সৃষ্টি
পর্বঃ- ১৪

— এই রিখি, এখনো ঘুমাতে যাসনি?

দ্রোহের আওয়াজে ঘোর কাটল রেখার। পাশে তাকিয়ে দেখল পাশের বারান্দায় দ্রোহ এসে দাঁড়িয়েছে। রেখা কিছুক্ষণ চুপ থেকে জবাব দিল,

— না, ঘুমানোর চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ঘুম আসেনি।

— তুই কি কোনোভাবে আমার বলা কথাটা নিয়ে চিন্তিত? দেখ, আমি অতো ভেবে বলিনি কথাটা। শুধু মনে আসলো, তাই বলে দিয়েছিলাম ওই…

— না, একদম না। আজ শুধু বাবা মায়ের কথা মনে পড়ছিল। আর কিছু না।

রেখার উত্তরে দ্রোহও চুপ করে গেল। এমন সময় কি করা উচিত, তার জানা নেই। কিছুসময় সামনের রাস্তায় তাকিয়ে থেকে হঠাৎ সে বলে উঠল,

— রিখি, ঘুরতে যাবি?

— ঘুরতে? কখন?

— হ্যাঁ, ঘুরতে, এখনই।

— না। এতো রাতে কি করে যাব?

— আমার সাথে যাবি।

— কিন্তু…

— কোন কিন্তু না। তুই এক কাজ কর। রেডি হয়ে বসে থাক। আমি ফোন দিলে চুপচাপ ঘরের দরজা লাগিয়ে দিবি। লাগানোর আগে ভেতর থেকে লক করে দিবি। আমি নামছি।

বলেই রেখাকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সেখান থেকে চলে গেল। রেখা বোকার মতো চেয়ে রইল শুধু। কি করবে সে?

___

মাঝরাতে ফোন বাজতে থাকায় বিরক্ত হলো ইমন। বাজতে বাজতে এতক্ষণে ২ বার কেটেও গিয়েছে। তাও আবার বাজছে। ইমন হতাশ হয়ে বিরক্তি নিয়ে ফোনটা রিসিভ করে কানে লাগালো। ওপাশ থেকে চিৎকার ভেসে এলো,

— ফোন তুলতে এতক্ষণ লাগে তোর?

— চুপ কর। তোর জন্য আমি বিয়ে করতে পারলাম না।

— আমি কি করলাম?

— জানিস? কিছুক্ষণ আগে, এই তো কয়েক সেকেন্ড আগেই আমাকে নিয়ে আমার বউ এর পাশে বসালো। আমি লজ্জায় পাশে তাকাতে পারছিলাম না। কাজী কবুল বলতে বলল। আমি বললাম “ক” তারপর তুই আমার ঘুমটা ভেঙে দিলি। না দেখতে পারলাম বউ, না করতে পারলাম বিয়ে। তোর জন্য স্বপ্নেও বিয়ে করে শান্তি নেই। এখন বল শালা কি হইছে?

— এই, তুই ঘুমের মধ্যে আমার ছোট্ট বোনটাকে বিয়ে করার কথা ভাবছিলি না কি? তুই নিশ্চিন্তে থাক। তোর মতো বুড়ার সাথে আমি আমার ছোট বোনের বিয়ে জীবনেও দিব না।

— ধুর, ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিলি, কোথায় আমি তোরে গালি দিমু, ভদ্র ভাষায় কথা বলছি বলে বেশি ভাব নিস না, কালকে তোকে গালির গোডাউনে ফেলমু আমি।

— বেশি কথা না বলে দরজা খোল আর তোর চাবি দে।

— চাবি দিয়া কি করবি?

— তোর মোটর সাইকেল নিয়ে গিয়ে সব পার্টস খুলে খুলে বিক্রি করব।

— দিব না তাহলে।

— ইমন দেখ, রাগ উঠাবি না এখন আমার। নাহলে তোর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছি, দরজায় লাথি দেওয়া শুরু করব।

— দে। তবে এতো রাতে তুই বাইক নিয়ে কি করবি? তুই কি সত্যি সত্যি লুকিয়ে বিয়ে করবি ভাই?

বলতে বলতেই এক লাফে উঠে বিছানায় বসে পড়ল ইমন। খুব আগ্রহ নিয়ে দ্রোহের কথা বলার অপেক্ষা করছে সে। দ্রোহ তাকে বেশি অপেক্ষা না করিয়ে বলে উঠল,

— তোর বউ আনতে যাচ্ছি ছাগল। তুই যে লুকিয়ে বিয়ে করেছিলি, ভুলে গিয়েছিস?

ইমনের ঘুম ঘুম ভাবটা তখনও ছিল। দ্রোহের কথা আরেক লাফ দিতে গিয়ে বিছানা থেকে পড়ে গেল।

— ভাই, আমি বিয়ে করছিলাম? আমার মনে পড়ে না কেন? আচ্ছা, আমার বউ দেখতে কেমন? তুই এক কাজ কর। তোর যাওয়ার দরকার নাই। আমি-ই যাচ্ছি। তুই আমাকে ঠিকানা দে। লুকিয়ে করছিলাম না? এবার বাড়ি এনে সোজা বলে দিব যেন তার সাথে আমার বিয়ে দেয়। আমার মা-টাও তোর বিয়ের আগে আমার বিয়ে দিবে না বলে দিয়েছে।

— ছাগলের নাতি, তোরে আমি এই কইলাম? রাতে ঘুরে বেড়ানোর শখ আমার কবেকার? আর তুই ভুলে গিয়ে নিজের বিয়ে নিয়ে পড়লি? এখনই যদি তুই চাবি নিয়ে ঘর থেকে না বের হোস, তবে দেখ আমি কি করি।

— ধুর শালা, এরকম মজা করবি না।

— আর আমার বোনের সাথেও তোর বিয়ে দিব না। তুই চাবি দে।

বলেই ফোন কেটে দিল দ্রোহ। ইমন এখন ঘুমের ঘোরে আছে। তাকে যা যা বলা হবে, সে তাই তাই সত্য হিসেবে ধরে নিবে। এই কথাটা মাথা থেকেই বের হয়ে গিয়েছিল দ্রোহের। বাইকের চাবি নেওয়ার এক্সাইটমেন্টে এই কথাটা মাথা থেকেই বের হয়ে গিয়েছিল তার। ইমনের বাড়ি দ্রোহের বাড়ির পাশে হওয়ায় এই এক সুবিধা সে দিনে রাতে যেকোনো সময় নিতে পারে।

কয়েক মিনিটের মাথায় ইমন দরজা খুলে চাবিটা দ্রোহের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

— দেখবি, তোর বোনকেই ভাগিয়ে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করব একদিন। বার বার খালি আমার ঘুম মাঝরাতে নষ্ট করতে আসে।

দ্রোহ তার কথায় মনোযোগ দিল না। এক হাতের আঙুলে চাবির রিং ঢুকিয়ে সেটা ঘুরাতে ঘুরাতে রেখাকে কল করল। রেখা ফোন হাতে নিয়েই বসে ছিল। চায়ের কাপ সে ধুয়ে জায়গা মতো রেখে দিয়েছে। দ্রোহের কথা মতো ঘর থেকে বের হওয়া আদৌ ঠিক হবে কি না সেই নিয়ে বেশ দোটানায় আছে সে। আগের বারও একবার খারাপ পরিস্থিতিতে পড়েছে সে। জেনেশুনে আর হয়তো এমন করতে চাইবেও না সে। তবুও দ্রোহ তো তার কথাই শুনল না। আবার দ্রোহের ফোন আসতেই দেরি না করে সাথে সাথে রিসিভ করল সে। আবারো একই কাজ।

“নিচে নামো।”

এটুকু বলেই কল কেটে দিল দ্রোহ। রেখা সুতির ওড়নাটা আরও ভালো করে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে দ্রোহের কথামতো ভেতর থেকে লক করে বাইরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিল। তারপর ধীরে ধীরে সিঁড়ি দিয়ে নেমে সোজা নিচে চলে গেল। বিল্ডিং এর গেট এ লাগানো লাইটের আলোয় সামনের কিছু জায়গা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সেখানে দ্রোহকে ভালোভাবেই দেখা যাচ্ছে। একটা মোটরসাইকেলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রেখার দিকে তাকিয়ে আছে। রেখা একটু একটু করে সামনে এগিয়ে গেলে দ্রোহ বিনা বাক্য ব্যয়ে রেখার মাথায় হেলমেট পরিয়ে দিল। তারপর নিজে পরে নিয়ে বাইকে চড়ে বসল। রেখাকেও ইশারা করল বাইকে বসার জন্য। রেখা ভয় নিয়ে বলে উঠল,

— পড়ে যাবো তো।

দ্রোহ হাত দিয়ে পিছনের দিকা ইশারা করে বলল, ওকে ধরে বসতে।
রেখা আপত্তি জানাতে গেলে বলল,

— একটাও কথা বলবি না। এই বাইকের চাবি নিয়ে আসতে গিয়ে অনেক কথা বলতে হয়েছে। আর মুখে জোর নেই। চুপচাপ বসে পড়।

রেখা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বাইকে বসে পড়ল। তারপর দ্রোহের কাঁধে হাত রাখল। দ্রোহের কাছে প্রায় সময় তার মন খারাপ সারানোর ওষুধ থাকে। আজ হয়তো এই ওষুধ। দেখা যাক, কোথায় ঘুরতে নিয়ে যায়। এমনিও ঘরে বসে থাকলে মাথা ব্যথা ছাড়া কিছুই হবে না। দেখা যাবে পরীক্ষার খাতা সময় মতো দেখে না দিলে চাকরি চলে যাবে।

ধীরে ধীরে বাইক চালাতে লাগল দ্রোহ। রাত হওয়ায় ঠাণ্ডা বাতাস শুরুতে বেশ উপভোগ করতে পেরেছে ওরা। কিন্তু কিছু সময় পরই ঠাণ্ডা লাগতে শুরু করেছে। সামনের রাস্তা পুরো অন্ধকার। আশেপাশে লাইট অবধি নেই অনেকখানি রাস্তা। আরও সানে গিয়ে মোড়ে আলোর সন্ধান পাওয়া যাবে। এই রাস্তাটুকুতে হয় অন্ধকারেই যেতে হয়, নয়তো যাদের অভ্যাস নেই, তারা লাইট জ্বালিয়ে পার হয়। রাস্তাটা চিনে রেখা। এই রাস্তা দিয়েই রোজ ১৫-২০ মিনিট হাঁটার পর স্কুলে পৌছায় সে। কিন্তু প্রতিবার দিনের বেলায় এসেছে এখানে। রাতে একবারও আসা হয়নি। তাই ভয়টা বেশি। কিছু সময় পার হতেই আন্দাজ করল এখানে ডানদিকে হয়তো ক্রিস্নচুরার গাছটা রয়েছে। আর তার পাশেই একটা ফ্যাক্টরি। আরও সামনে যেতেই আলোর দেখা মিলল মোড় এ পৌঁছাতেই। কিন্তু তারপর আবার অন্ধকার। রেখা খেয়াল করল। দ্রোহ তাকে সরাসরি রাস্তা দিয়ে না নিয়ে যেতে মাঠের মধ্যে দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বড় খেলার মাঠটা পার করে আবার রাস্তায় এসে পড়ল ওরা। চাইলেই পিচ রোড দিয়ে যেতেও পারলেও দ্রোহ মাঠের মধ্যে দিয়েই নিয়ে গেল। এতক্ষণে রেখার মনটাও বেশ ভালো হয়ে গিয়েছে। ঠাণ্ডায় কেঁপে কেঁপে উঠলেও এই একটা মুহূর্তও মিস করতে চাচ্ছে না সে। বাইকের সামনের আলোয় শুধু রাস্তার কিছু অংশ-ই দৃশ্যমান হচ্ছে। সেটাও ভালো লাগছে। এক পর্যায়ে সে আবিষ্কার করল তারা তুরাগ নদীর পাশের মূল সড়কে চলছে। বাধ্য হয়ে ওড়নাটা নাকে চেপে ধরল রেখা। দ্রোহ বেশ দূর থেকে চালালেও তেমন লাভ হচ্ছে না। বহু বছর ধরে তুরাগ নদীর পাড়ে ময়লা ফেলা হচ্ছে। যার কারণে আবর্জনার স্তুপ থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। দ্রোহ হতাশ হলো। সামনে চলতে চলতে অভ্যাস বশত মূল সড়কের কাছে এসেই ডানে মোড় নিয়ে নিয়েছে সে। এখন পিছনে ঘুরালে রেখা কি মনে করবে সেটা নিয়ে চিন্তায় পড়েছে। পুরো পরিবেশটাই বদলে গেল। দ্রোহ আর না পেরে রেখাকে বলল,

— রিখি, তোর ওড়নার এক কোণা আমার নাকে চেপে ধর তো।

— এখানে এনেছেন কেন অভি? আপনার আগে থেকেই খেয়াল রাখা উচিত ছিল।

— আমি তো ভাবছিলাম অন্য দিকে যাবো। কিন্তু এতদিনের অভ্যাস থেকে ডান দিকে মোড় নিয়ে নিয়েছি। তুই বেশি বকবক না করে ওড়না ধর। আর বেশি চেপে ধরিস না। শ্বাস না নিতে পেরে এক্সিডেন্ট করে বসব। দেখিস?

রেখা লম্বা ওড়নার এক প্রান্ত নিজের দুই কানের সাথে ভালো করে ঝুলিয়ে দিয়ে আরেক প্রান্ত নিয়ে বাম হাত সামনে এগিয়ে দিল। দ্রোহের নাক বরাবর রাখতে গিয়ে দ্রোহের মুখে ওড়নাটা চেপে ধরল। দ্রোহ কথা বলতে না পেরে রেখার হাতে কামড় বসিয়ে দিল।

— আপনি কামড় দিলেন কেন?

— তাহলে তুই ভাব, তুই আমার নাকে কাপড় ধরেছিলি আর আমি আমার নাক দিয়ে তোর হাতে কামড় দিয়েছি।

— নাক দিয়ে কামড় দিলেন কি করে?

— সেটা তুই ভাব।

— ওটা দাঁত ছিল।

— তাহলে তুই ভাব, তুই আমার মুখ কে নাক ভেবে চেপে ধরেছিলি।

— আচ্ছা, আমার ভুল। এবার ঠিক করে ধরছি। এরপর থেকে মাস্ক আনবেন।

বলেই রেখা দ্রোহের ডান কাঁধে রাখা হাতটা আরেকটু চেপে ধরে বাম হাত দিয়ে দ্রোহের মুখে ওড়নাটা ঠিক করে ধরল। দ্রোহ বাইকটা থামাল একটা ছোট ব্রিজের ওপর। এর দৈর্ঘ্য গুনে গুনে ২০-২৫ কদম। এখানে ওই ঘ্রাণটা তেমন আসছে না। বাতাসের খেলায় কেঁপে কেঁপে উঠছে দুজনেই। দ্রোহ বাইক থেকে নেমে কিনারে গিয়ে দাঁড়াল। রেখাও তার দেখাদেখি তাই করল। রেখা খেয়াল করল দ্রোহ অন্ধকারেও পানির অস্তিত্ব খুঁজে চলেছে। রাস্তার লাইটটা আলো দিচ্ছে। মাঝে মাঝে বড় গাড়ি, ট্রাক ছুঁতে চলেছে দুরন্ত বেগে। দ্রোহ নিরবতা ভেঙে বলে উঠল,

— এখন ভালো লাগছে?

— হুম।

— আর মন খারাপ হচ্ছে?

— না।

— তাহলে ফেরা যাক?

রেখা ফেরার কথা শুনে থেমে গেল। কোন উত্তর দিল না। দ্রোহ আন্দাজ করে আরও কিছুক্ষণ দাঁড়াল সেখানে। তারপর বাইকে করে ফিরে আসা ধরল। ফেরার পথে রেখা প্রশ্ন করল,

— তখন যে বললেন বাইক আনতে অনেক কথা বলতে হয়েছে। কেন?

— বাইকটা ইমনের। আমার বন্ধুর। তার ঘুম ভাঙিয়ে চাবি আনতে হয়েছে।

— এমনটা না করলেও পারতেন।

— হ্যাঁ, তো। ম্যাডামের এখন মন ভালো হয়ে গিয়েছে। এখন অন্যর কথা ভাবছেন উনি।

— এভাবে বলবেন না।

— আবার চুপ থাক।

আরও কিছুক্ষণ পর বাইক থামাল দ্রোহ। তারপর নেমে হাঁটতে হাঁটতে সামনের অন্ধকারে হারিয়ে গেল সে। রেখা ভয় পেলেও চুপ করে বসে থাকল। তার কয়েক মিনিট পর দ্রোহকে আসতে দেখা গেল। দ্রোহ এসেই কোন কথা না বলে রেখার হাতে কিছু গুঁজে দিল। রেখা প্রশ্ন করার আগেই নিজের ফোনের টর্চ চালু করে রেখার হাতের কাছে ধরল। রেখার হাতে গাছের পাতা। সে বলল,

— এগুলো কেন?

— তুই একটা ছাগল। তাই ভাবলাম এতক্ষণ তোকে খালি পেতে রাখা উচিত হবে না। ছাগল হিসেবে তোর প্রিয় খাবার পাতা হওয়া উচিত। তাই স্ন্যাক্স হিসেবে গাছের পাতা দিলাম। এবার খা।

— সব সময় মজা ভালো লাগে না। হুট করে এভাবে অন্ধকারে চলে যাওয়ার মানে কি?

— ভয় পেয়েছিলি বুঝি?

— আমি ভয় পাই না।

— তাহলে এখানে থাক বাকি রাতটুকু। আমি গেলাম। ভুতেদের সাথে আজ তুই তোর দুঃখের গল্প কর।

— আমি ভয় পাই না। শুধু ওই অন্ধকারে অদ্ভুত আওয়াজ শুনলে কেমন কেমন লাগে অভি। এবার ঠিক আছে?

— ঠিক করে বস। এবার বাড়ি ফিরে সরাসরি ঘুম দিবি।

বাড়ি ফিরতেই চাবি দিয়ে দরজা খুলে রেখাকে আগে ঘরে পাঠিয়ে দিল। তারপর আশেপাশে ভালো করে দেখে নিল দ্রোহ। মায়ের হাতে পড়লে সর্বনাশ। যদিও ওরা জানে যে রাতে দ্রোহের বাইরে ঘোরার বাতিক আছে। কিন্তু তবুও বলা যায় না, কোনদিন ওকেই চোর ভেবে বসে। আর যদি আজই চোর ভেবে সামনে আসে আর ওর সাথে দেখাকে দেখে তাহলে হয়েই গেল!

চলবে।

#অজান্তে_আগমন
#সাদিয়া_সৃষ্টি
পর্বঃ- ১৫

খাবার টেবিলে মুখোমুখি বসে আছে দ্রোহ আর রেখা। সকাল থেকেই কাজের প্রতি রেখার উদাসীনতা লক্ষণীয় হতে হতেও হয়নি। তবে কিসের এতো অমনোযোগ, উদাসীনতা সেটাও জানা নেই। রেখা বারবার উশখুশ করছে। আশেপাশে তাকাচ্ছে। খাবার এর টেবিলে বসে আছে আর দ্রোহের মাকে বারবার জিজ্ঞেস করছে যদি কোন সাহায্য লাগে। দ্রোহের মা প্রতিবারের মতো মানা করে দিয়েছেন। সকালের খাবার রেখা আর মা দুজনে মিলেই বানায়। অন্তত মাসের প্রথম কয়েক দিন একসাথেই বানিয়েছে। তারপর শুরু হয়েছে রোজা। তারপর আর কোন কাজ থাকে না রেখার রোজার মাসটায়। সে স্কুলে চলে যায় সাধারণত। রোজার মাস শেষ হতেই আবার একই রুটিন শুরু করেছিল। আজও সেই অনুযায়ীই কাজ করেছে। বলতে গেলে একটা নির্দিষ্ট রুটিন মেনেই তার এই আড়াই মাস চলেছে। সকালে বাসার কাজে সাহায্য করে খাবার খেয়ে স্কুলে যাওয়া। আগের মতই ৯ টা থেকে ৪ টা স্কুল। তারপর বাসায় ফিরে আসে। এর মধ্যে রাতের দিকে ৪ টা টিউশনি জোগাড় করেছে সে। সপ্তাহে তিন দিন করে পড়ায় সবাইকে। একই বিল্ডিং এ হওয়ায় আরও বেশি সুবিধা হয়েছে তার। বাড়িতে এসেই পড়ে যায় ওরা। তারপর রাতে খাবার খেয়ে আবার ঘুম। পরের দিন একই কাজ।

দ্রোহের মাকে সাহায্য করছেন রিনা খালা। কিন্তু রেখার চিন্তা অন্য জায়গায়। গত রাতে বের হওয়ার বিষয়টা ধরতে পেরেছে কি না কেউ- সেই চিন্তায় মাথা ব্যথা হওয়ার উপক্রম। না পাচ্ছে কোন তথ্য আর না পাচ্ছে কোন সূত্র। সেজন্য চিন্তা চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়েই চলেছে। সে আরেক চিন্তা। রেখার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে দ্রোহের মা প্রশ্ন করেন,

— কি রে বাবু, গত রাতেও বের হয়েছিলি?

— হ্যাঁ, বের হয়েছিলাম।

দ্রোহের সোজা উত্তর। দ্রোহের এমন নিশ্চিন্ত থাকা আরও ভাবালো রেখাকে। দ্রোহের মা বললেন,

— তা আমাকে ডাকলেই পারতি তুই। শুধু শুধু চাবি দিয়ে দরজা খুলতে গেলি কেন? শব্দ শুনেই বুঝতে পারলাম।

— চিন্তা কত না মা। কোন মেয়ের সাথে ভেগে যাইনি।

— একটা সত্যি কথা বলি বাবু?

— বলো।

— তুই যদি এখন পালিয়ে গিয়েও বিয়ে করে ফেলিস, তাহলে আমি কিচ্ছু বলব না। একদম খাঁটি কথা। তোর বাবাও কিছু বলবে না। পরিবারের কেউ কিছু বলবে না। তুই শুধু একবার বল পালানোর কথা। আমি নিজের তোকে বাসের টিকেট কেটে দিব।

— বাবা, মাকে একটু সামলাও। তোমার বউ এর মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।

ড্রয়িং রুমে সোফায় বসে খবর এর কাগজের পাতা উল্টাচ্ছিলেন দ্রোহের বাবা। তিনি সেটা না নামিয়েই বললেন,

— তোমাদের যা ইচ্ছা করো। আমাকে কিছু বলবে না।

দ্রোহের মা তখন বলে উঠলেন,

— আচ্ছা রেখা, আমার ছেলেকে তোমার কেমন লাগে?

রেখা মাত্র মুখে খাবার তোলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। মায়ের এমন কথা শুনে বিষম খেলো সে। এমন সময় বাড়ির কলিং বেল বেজে ওঠায় রেখা সাথে সাথে উঠে দরজা খুলতে চলে গেল। দরজার ওপাশে পরিচিত মুখ দেখে অবাক হলো সে। সাথে সাথে প্রশ্ন করল,

— কে আপনি?

— আমি তোমার আরেক অভি।

— মানে কি? আমার আরেক অভি?

— শুনেছি দ্রোহকে তুমি অভি বলে ডাক। ও তো অভিনব, আর আমি অভিরূপ।

— কিন্তু রিহান স্যার…

— অভিরূপ আহমেদ রিহান। পুরো নাম হয়তো জানতে না। তাই বুঝতে পারো নি। বয়সে আমি বড় বলে তোমাকে তুমি করেই বললাম। আর আমি দ্রোহের মামাতো ভাই।

ওই সময় পিছন থেকে আরও তিন জন মানুষ এগিয়ে এলো। ততক্ষণে দ্রোহের পুরো পরিবার দরজার সামনে। রেখা পাশে গিয়ে দাঁড়াল। ওদের কথা শুনে বুঝতে পারল হয়তো কোন আত্মীয় হবে। ওর পাশ থেকে দ্রোহ বলে উঠল,

— আমার মামা, মামি আর দুই মামাতো ভাই। তুই আগে যেখানে থাকতি, সেই এলাকায় ওদের বাড়ি।

রেখা দ্রোহের হঠাৎ মন্তব্যে চমকে উঠলেও কিছু বলল না। তাদের সাথে পরিচিত হয়ে নিজের ঘরে চলে গেল সে। দ্রোহকে রিহান টেনে নিয়ে চলে গেল দ্রোহের রুমে।

— ভাই, তুই কালও নাকি আরেক কাহিনী করেছিস?

— আমি না, ঘটক করেছে। সে পাত্রীর ছবি কয়টা এনেছে, সেটাই ভুলে গিয়েছিল। তারপর ঘটল যত কাণ্ড। রিখির ছোট কালের ছবি ভুল করে টেবিলে পড়ে গিয়েছিল। মা ধরে নিয়েছে সেটাও আরেকটা পাত্রীর ছবি।

— আমি বলে রাখলাম তোকে। একদিন দেখবি হঠাৎ করে তোকে ফোন করে ডেকে আনবে। বাসায় এসে দেখবি ঘরে কাজী আর পাত্রী বসে আছে। টি ঘরে ঢুকতেই ফুফু বলবেন, “বাবু, বল আলহামদুলিল্লাহ কবুল”।

— হ্যাঁ, আর আমি নাচতে নাচতে বলে দিব।

— চিন্তা করিস না। তোদের বাড়ির সামনে আজও একটা কাজী অফিসের পোস্টার দেখে আসলাম। একদিন ঠিকই ঠুস করে ফোন করে ঢুস করে কাজী ডেকে আনবে। তারপর তোকে এনে টুস করে কবুল বলিয়ে দেবে। দেখে নিস। তাই বলছি রিস্ক নিস না। বিয়েটা করে ফেল।

— কিন্তু আমি সামলাতে পারব না।

— বাবার এতো বড় বিজনেস সামলাও তুমি আর একটা বউ সামলাতে পারবে না। এমন মাথা জ্বলা কথা বলবি না তো নব।

— তুই কথা বাড়াবি না। আজ হঠাৎ করে কেন এলি? কাল তো আমিই যেতাম।

— হ্যাঁ, একেবারে ব্যাগ গুছিয়ে পুরো পরিবার নিয়ে আসবি। তোর অন্য আমার পাশের বাড়ির মেয়েটাকে পছন্দ করতে যাবো।

— ওহ, তোর বিয়ে। ভালো। তো নিজের জায়গায় আমার নাম লাগানোর মানে কি?

— কথা ঘোরাস কেন ভাই? লাইফে একবার তো সিরিয়াস হ্যে দেখ তুই। বিয়ে নিয়ে কি এতো সমস্যা।

— এই “বিয়ে” নামক জিনিসটা প্যারার ভাই। তুই বুঝবি না।

— তোর জন্য অপেক্ষা করতে করতে আমি বুড়ো হয়ে যাবো। তাই ভাবছি মা যেই মেয়ে ধরবে এবার, তাকেই বিয়ে করে ফেলব। আর ভালো লাগে না এসব। তারপর দেখব আমার দেখাদেখি তুইও বিয়ে করে নিবি।

— কথা না বলে খেতে চল। আমি নিশ্চিত, কালকের পুরো ঘটনা ব্যাখ্যা করে মামাকে মা বলেছিল। আর আমাকে বোঝানোর জন্য পুরো পরিবার নিয়ে আসতে বলেছে তোদের। কিন্তু ভাই দেখ, আমার বিয়ে করার ইচ্ছা নাই। কত মানুষ তো বিয়ে না করেই জীবন পার করে দিচ্ছে। আমি তাদের মতো আরও একজন না হয় থাকলাম।

— তোর বিয়ে না করার কারণ কি ভাই?

— কোন কারণ নেই। সময়ের সাথে সাথে এই বিষয়টার প্রতি বিশ্বাস উঠে গিয়েছে। ভালো লাগে না আর। যেই সমাজে থাকছি, সেখানেই এতো ঘটনা ঘটে রোজ, খবরের পাতায়ও থাকে কত বাস্তবতা। তারপর আর ভালো লাগে না। এর থেকে বেশি কোন কারণ নেই।

— কাউকে ভালোবেসে দেখেছিস?

রিহানের প্রতিটা কথার জবাব সাথে সাথে দিলেও এই কথায় থেমে গেল দ্রোহ। নিজের অনুভূতিগুলো নিয়ে কি কখনো ভাবা হয়েছে তার? বাস্তবতার তিক্ত স্বাদ পেতে পেতে কি ভুলে যায়নি সে এসব ভাবতে? না, পুরোপুরি ভুলেনি। রাতের অন্ধকারে ঘুমেরা যেদিন তার চোখে ভর করে না, তখন নিজেকে ভাবনার জগতে এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে দিয়ে খোঁজ চালিয়েছে। কিন্তু সত্যিই উত্তর পায়নি। কিংবা এমন বলা যায়, উত্তর পেলেও পাত্তা দেয়নি। আজকাল সেই কৈশোরের শেষ দিকের অনুভূতিগুলো বড্ড হানা দেয়। সেই ষোড়শী মেয়ের খিলখিল করে হাসির জায়গায় তার পরবর্তী যুবতী রূপ ভেসে উঠলে পুরনো অনুভূতি মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। সাথে ভাবনায় আসে আরও অনেক কথা। সেসব কথা কাউকে বলতেও পারে না সে। একান্ত ব্যক্তিগত কথা কি কাউকে বলা চলে? সাহস আগের মতই কমে আসে। তখন সে প্রকাশ করেনি কারণ তার সাথে থাকার কোন সুযোগ ছিল না। এমনকি দেখা হবে কি না সেটাও জানা ছিল না। তাই অযথা মায়া বাড়ানোর মতো কোন কাজ করেনি সে। মেয়েটার তো বিয়েও হয়নি। তবুও নিজের সেই লুকোনো অনুভূতি যদি রেখা না বুঝে, তখন কি মেনে নিতে পারবে দ্রোহ। যদি ছেড়ে চলে যায়? সেটা আরেক অত্যাচারের থেকে কম কিছু না। বড্ড পোড়ায় দ্রোহকে ভাবনাতা। আবার বিয়ে নিয়েও সময়ের ব্যবধানে অনেক ঋণাত্মক চিন্তা মাথায় বীজ বুনেছিল বহু আগে। এখন তার পরিপক্ক গাছে পরিণত হয়েছে। শুধু বাবা-মা আর কিছু হাতে গোনা আত্মীয়ের দিকটাই তার কাছে ভালো। অন্য কারো ক্ষেত্রে বিয়ের পরবর্তী পরিনতি তার কাছে ভালো লাগেনি। সেসব অনেক ঘটনা। এই আটাশ বছরের জীবনে তো আর কম অভিজ্ঞতা হয়না।

রিহানের কথায় ধ্যান ভাঙল তার। নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাসের অভাব কিংবা বিপরীতে মানুষের প্রতি হারানোর তীব্র চিন্তা- এসব তাকে শেষ পর্যন্ত কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে দেয়নি। আজও পারল না। সে কথা গুরিয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল। জানতে পারল মামা-মামিরা এখানেই থাকবেন কয়েক দিনের জন্য। তাতে বেশ খুশি হলো দ্রোহ।

_____

দ্রোহ বিয়ের জন্য রাজি হয়েছে।

এটা সম্পূর্ণই দ্রোহের মায়ের মতামত। কিন্তু আসলে ব্যাপারটা তেমন না। দ্রোহ মেয়ে দেখতে যাওয়ার জন্য রাজি হয়েছে। বিয়ে করবে কি না সেটা বলেনি। তবুও মায়ের মন, কখন কোন কথাকে কি ধরে নেয়ে সেটা বলা যায় না। প্রায় কয়েক বছরের পর ছেলে রাজি হয়েছে, এই খুশিতেই যেন তিনি সারা পারা মিষ্টি বিলি করেন। কিন্তু তার এই পাগলামিতে সায় দেননি কেউ। তাই এই ইচ্ছা পূরণ হলো না। তবে বিয়েতে দ্বিগুণ মিষ্টি জোরে করে খাওয়ানোর কথা ভেবে রাখলেন মনে মনে।

এদিকে দ্রোহের নাজেহাল অবস্থা। বছরের পুরো সময় কাজের ব্যস্ততা থাকে তার। কিন্তু এই কয়েক দিন কাজে যেতে দেওয়া হয়নি তাকে। তার বাবা সবটা সামলে রেখেছেন। দ্রোহের মা পুরো বাহিনী নিয়ে দ্রোহের কানের সামনে “বাবু, বিয়ে কর” এই উক্তি দিন রাত হাজার বার করে বলেছেন। সাধারণত রাস্তায় একটা ভ্যানের দোকানে রোজ একই টি-শার্ট দেখলেই সেটা কেনার ইচ্ছা জাগে। সেখানে এতবার করে “বাবু বিয়ে কর” উক্তি বললে কেমন লাগার কথা? ছোট ভাই রাহাত পর্যন্ত পড়া মুখস্ত করার বদলে এই ডায়ালগ মুখস্ত করে বসেছে। সে খাবার খাওয়ার জন্য “খাবার দেও” বলার পরিবর্তে বলে, “বাবু, বিয়ে কর।” বাইরে ঘুরতে যাওয়ার সময় যেখানে প্রতিবার বলত, “আমি বাইরে যাচ্ছি” সেখানে এখন সে ভুল করে বলে ফেলে- “বাবু, বিয়ে কর।” কি এক ঝামেলা! দুই দিন আগেও তো বাথরুমে দ্রোহ ঢুকেছিল। হয়তো বাথরুমে ঢুকে ঘুমিয়েও পড়েছিল। অবশ্য কি করেছে সেটা তার ব্যাপার। মূল ব্যাপারটা ভিন্ন। অন্য বাথরুম গুলোর মধ্যে একটায় রিনা অ্যান্টি কাপড় ধুতে গিয়েছেন আর রেখার রুমে বাথরুমে ঢুকতে তার লজ্জা করে। তাই দ্রোহের বাথরুমের সামনে দাঁড়িয়ে নক করতে করতে বলে ওঠে,

— বাবু, বিয়ে করো।

— রাহাত, তুই কি আমাকে এখানেও শান্তিতে থাকতে দিবি না? তোদের জন্য তো বাথরুমে লুকিয়েও শান্তি নেই।

— আরে ভাইয়া, অন্য বাথরুম ফাঁকা নেই। তাই এখানে এসেছি। তুমি বের হও। আমি ওই কথা বলতে চাইনি। আমি বলতে চেয়েছিলাম তোমার কাজ হলে বাথরুম থেকে বের হও তো।

— তোর বাবু বিয়ে কর এর অভ্যাস না ছাড়ালে এরপর কানের নিচে গুনে গুনে ৫ টা লাগিয়ে দিব বলে রাখলাম।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here