অজান্তে_আগমন,পর্বঃ- ১২,১৩

অজান্তে_আগমন,পর্বঃ- ১২,১৩
সাদিয়া_সৃষ্টি
পর্বঃ- ১২

রেখা নতুন জায়গায় নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় ব্যস্ত। কয়েকদিন হলো দ্রোহের বাড়িতে এসেছে। আসার পরের দিন থেকেই নতুন স্কুলে কাজ শুরু করেছে। যদিও শুরুতেই টিউশনি পায়নি। তবে খোঁজার চেষ্টায় আছে। বলতে গেলে আগের মতো ব্যস্ততা নেই। স্কুল থেকে ফিরে বাকি সময় দ্রোহের মা আর বোনের সাথেই কাটানো হয়। মাঝে মাঝে দ্রোহের বাবার সাথে কথা হয়। তিনি প্রায় সময় বাড়িতেই থাকেন। আর নাহলে বাইরে ঘুরে বেড়ান, চায়ের দোকানে বসে নানান গল্পে মেতে ওঠেন অন্যদের সাথে। অফিসে খুব কম-ই যেতে দেখা যায় তাকে। খাবার টেবিলে দ্রোহের সাথে দেখা হলেও কথা হয় না তেমন। খুব কম। দেখা যায় দ্রোহ নিজ থেকেই তাকে কিছু জিজ্ঞেস করলেই সে জবাব দেয়। নাহলে মুখ পর্যন্ত খুলে না। আগের শক এখনো কাটাতে পারেনি হয়তো। দ্রোহ যে তাদের বাড়িতে থাকত- সেটা সে কল্পনাও করেনি। তাই তো দ্রোহের সামনে পড়লেই পালাই পালাই চিন্তা কাজ করে রেখার মধ্যে। তাছাড়া সব স্বাভাবিক।

___

রাত তখন এগারোটা কি তার একটু বেশি। বিশাল আকাশের বুকে চাঁদটা জ্বলজ্বল করছে। বহুদুর পর পর একটা করে তারা জ্বলতে দেখা যাচ্ছে। চাঁদের আলোয় তার আশেপাশের মেঘেদের ভেসে বেড়ানো স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আর বাকি আকাশ অন্ধকার। কালো চাদরে মোড়া যেন। অফিসের কাজ শেষ করে সব বন্ধুদের ডেকে এনেছে দ্রোহ। চেনা পরিচিত চায়ের ছোট্ট দোকানটায় আগের মতো ভিড়। কাজের চাপে তো মানুষগুলোর নামও ভুলে যাওয়ার উপক্রম। তবে একটুর জন্য হয়তো ভুলেনি কেউ। রাতের আঁধারে ধোঁয়া ওঠা চায়ের সাথে পুরনো দিনের বন্ধুগুলো পুরনো মুহূর্তগুলো সতেজ করে তোলে। বহুদিন দেখা না হওয়া বন্ধুগুলোর সাথে দেখা করার জন্যই এই আয়োজন। জোর করে দোকানদার মামাকে আজ অনেক রাত পর্যন্ত দোকান খুলে রাখার অনুরোধ করেছে দ্রোহ। সময়ের সাথে সাথে সম্পর্কগুলো মুছে যায় না, কিন্তু বহুদিন না দেখা হওয়ায় যেন ধুলো জমে সেখানে। জং ধরে যায়। চেনা মানুষগুলোর সাথে কথা বলতেও অস্বস্তি ঘিরে ধরে। শুধু ফোনে ‘হাই’ ‘হ্যালো’ ‘কেমন আছিস’ এতেই থেমে যায় সকলে। কিছু কিছু পর্যায়ে আসার পর তো কল করেও কথা বলা হয় না। বড়জোর কয়েক মাসে হুট করে মনে পড়লে একটা ম্যাসেজ। সেই ধুলো পরিষ্কার করতে দ্রোহ নিজ থেকেই পদক্ষেপ নিয়েছে। কয়েকজন বন্ধু মিলে আড্ডা জমাবে রাতে। এতে সারাদিনের কাজের ক্ষেত্রেও কোন ক্ষতি হবে না। আবার অনেকদিন পর দেখা করাও হয়ে যাবে।

বন্ধুদের সাথে আড্ডার মাঝেই হুট করে দ্রোহ বলে ওঠে,

— জানিস, রেখা বাবা মায়ের সাথে ৩ বছর আগে কক্সবাজারে ঘুরতে গিয়েছিল। সাথে আরেকটা চেনা পরিচিত পরিবার ছিল। সেখানে সমুদ্র সৈকতে গিয়ে সেখানে বাবা আর মাকে হারায় রেখা। দুর্ভাগ্যবশত সেদিন হঠাৎ বড় ঢেউ এসে অনেক মানুষকে সমুদ্র গর্ভে টেনে নিয়ে যায়। তাদের মধ্যে রেখার বাবা মাও ছিল। রেখার সাথে যেই পরিবার গিয়েছিল, তারা শুধু রেখার খালাকে চিনত বিধায় তার সাথেই যোগাযোগ করে। পরের দিন রেখার খালামনি গিয়ে রেখাকে সামলায়। এমনকি আজ পর্যন্ত সামলে আসছেন। সেখানে তারা এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ছিল। কিন্তু ভাগ্যের লেখা বদলানো সম্ভব নয়। তাই হয়তো মৃতদেহও খুঁজে পেল না তারা। আজ যখন দুপুরে বাড়ি থেকে বের হচ্ছিলাম। তখন এক কারণে মায়ের রুমে যাচ্ছিলাম। তখন শুনতে পারলাম। আমার শুনেই কেমন লাগছিল সেটা আমি বুঝাতে পারব না। মানুষ দুটোর সাথে আমি দুই বছর ছিলাম। সেখানে ওরা রেখার বাবা-মা। একা মেয়েটা কিকরে নিজেকে সামলেছে – কে জানে! আমার তো ভাবতেই ইচ্ছা করছে না। একা নিজেকে যেন সামলাতে পারছিলাম না। তাই তোদেরকেই বললাম।

দ্রোহের কথা বলার পুরোটা সময় সবাই চুপ করে ছিল। দ্রোহের সামনের বেঞ্চে বসে থাকা সিয়াম, রাফি আর অর্পণ তো চায়ে চুমুক দিতেই ভুলে গিয়েছে। দ্রোহের দুই পাশ থেকে ইমন আর তামিম দ্রোহের ঘাড়ে হাত রাখল। ইমন নিরবতা ভেঙে বলে উঠল,

— রেখা তো এখন তোদের সাথেই আছে, তাই না?

— হুম।

— তাহলে এসব কথা আর তুলিস না ওর সামনে। কিছু কিছু কথা প্রতিবার সমানভাবে আঘাত দেয় মানুষকে। দেখা যায় আমরা তাকে সেই কথা বলছি, যাতে সে ভাবতে পারে যে আমরা তার পাশে আছি। আমরাও তার কষ্টে কষ্ট পাচ্ছি। কিন্তু কিছু কিছু মানুষের ক্ষেত্রে দেখা যায় সে আঘাত পায় উল্টো। যেমনটা ভাবা হয়, তেমনটা ঘটে না আসলে। তাই না বলাই ভালো।

— ঠিক বলেছিস।

অর্পণ মন অন্যদিকে নেওয়ার জন্য বলে উঠল,

— তো কেমন লাগছে বল?

দ্রোহ না বুঝতে পেরে প্রশ্ন করল,

— কেমন লাগবে?

পাশ থেকে রাফি বুঝতে পেরে বলে উঠল,

— মামা, চাইল্ডহুড ক্রাশ এখন নিজের বাড়িতেই থাকছে। তো কেমন লাগছে সেটা বলবি না?

দ্রোহ হালকা হেসে ফেলল। তার এই শয়তানের দল তাকে ভালো করে দুঃখ প্রকাশ করতেও দিবে না কখনো। সে কপট রাগ দেখিয়ে বলল,

— উল্টাপাল্টা বলবি না তোরা। আমি জাস্ট কলেজে পড়ার জন্য ওদের বাড়িতে থাকতাম।

— দুই বছর থাকলি, আর বলছিস কি না ক্রাশ খাস নি তুই? আর আমরা নাচতে নাচতে বিশ্বাস করে নিব?

ফোঁড়ন কেটে বলে উঠল তামিম। দ্রোহ রেগে বলে উঠল,

— আমি জাস্ট পড়ার জন্যই ছিলাম ওখানে। বুঝলি?

সিয়াম বিজ্ঞের মতো প্রতিবারের মতো সিরিয়াস ভাবটা মুখে এনে বলে উঠল,

— না, বুঝিনি। ব্যাখ্যা করে বল।

— আমার ওই রেখাদের বাড়ির অইদিকের একটা কলেজে চান্স পেয়েছিলাম। সেখানে পড়ার জিদ থেকেই হোস্টেলে থাকার কথা তুলি। বিদেহে দেখা যায় ছেলে মেয়েরা বড় হলে তারা নিজেরাই নিজেদের দায়িত্ব নেয়। আমারও ইচ্ছা ছিল তেমন। কিন্তু বাবার রাজি হননি। রেখার বাবার সাথে আমার বাবার পরিচিতি আগে থেকেই ছিল। তবে অতো ভালো ভাবে পরিচয় ছিল না। শুধু চিনত একে অপরকে। তখন বাবা। ওখানে আমার থাকার ব্যবস্থা করে। দুই বছর পর আমি আবার নিজের বাড়ি ফিরে আসি।

— এই দুই বছরে তুই কিছুই করিসনি?

— না। শুধু রিখিকে পড়াতে যেতাম। আর কি…

— ওওও… রিখি…

সবাই একসাথে বলে উঠল। দ্রোহ বুঝতে পেরে দাঁত দিয়ে জিহ্বা চিপে ধরল। তারপর প্রসঙ্গ পাল্টে একেবারে অন্য কথায় চলে গেল।

___

স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে মাত্রই নিজের ঘরে ঢুকেছিস। অভ্যাসমত সেভাবেই নিজেকে বিছানায় এলিয়ে দিল ক্লান্তি দূর করার জন্য। হঠাৎ করে কোন কিছুর শব্দ শুনল রেখা। বিছানা থেকে নেমে পড়ল সাথে সাথেই। আশেপাশে দেখার চেষ্টা করতেই লাফিয়ে উঠে চিৎকার করল,

— আম্মু।

দ্রোহ তখন বাড়িতেই ছিল। নিজের মোবাইল রেখে গিয়েই চলে গিয়েছিল অফিসে। সেটা ফেরত নিতেই আসা মূলত। দ্রোহের মা পাশের বাড়ির অ্যান্টির সাথে নাটকের পর্ব নিয়ে কথা বলায় ব্যস্ত। কোন এক মহিলার বুড়ো বয়সে এসে বিয়ে করা ঠিক কিনা, তাও নিজের প্রাক্তন স্বামীর উপস্থিতিতে আর নিজের সন্তানদের উপস্থিতিতে- এমন কিছু নিয়েই তর্ক চলছে তাদের মধ্যে। দরজা খুলে রাখায় বাইরে থেকেও তাদের আলোচনা শোনা যাচ্ছে। দিবা পড়ায় ফাঁকি দেওয়ার জন্য মায়ের পিছু পিছু চলে গিয়েছে। আর এখন দুই জন বিশ্লেষকের ভারী আলোচনা হা করে গিলছে। দ্রোহ রেখার চিৎকার শুনে সোজা তার রুমের সামনে এসে দাঁড়িয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল,

— কি হয়েছে?

— ই… ইঁদুর।

— ওহ। এতে চিৎকার করার কি আছে?

— চিৎকার করব না মানে? আপনি জানেন না ইঁদুর কতটা ভয়ংকর?

— ইঁদুর ই তো। আচ্ছা বল, কোন সাইজের ইঁদুর? ছোট, মাঝারি না কি বড়?

— আবার সাইজ জিজ্ঞেস করছেন কেন? সাইজ দিয়ে কি করবেন।

— আগে বল না রিখি।

তারপর দ্রোহ হাত দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করল যে ইঁদুরের আকার কেমন দেখেছে রেখা। রেখা জবাব বলল,

— না না, ওই সাইজের না। ওর থেকে বড়।

— তাহলে ওটা ইঁদুর না।

— ইঁদুর না?

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলে উঠল রেখা। দ্রোহ এক গাল হেসে বলল,

— ওটা রাক্ষস।

— অভি!

— আরে, তুই যেই সাইজের বলছিস, ওই সাইজের ইঁদুর জীবনে হয় নাকি রে রিখি?

— আমি জানি না, বিছানার নিচে কিছু একটা আছে।

— তুই কি ভীতু রে রিখি!

— আমি ভীতু না।

— আমাকে শোনাচ্ছিস? তোকে আমি হারে হাড়ে চিনি। তুই একটা ছোট তেলাপোকা দেখেও ভয় পাস। আর বাঘ দেখেও ভয় পাস। তাও খাঁচায় বন্দী বাঘ।

— আমি তেলাপোকায় ভয় পাই না।

— ঠিক বলছিস তো?

— হ্যাঁ।

— তাহলে আমি তোর ঘর থেকে ইঁদুর তাড়াচ্ছি না। তুই ওর সাথে আজ সারা রাত গল্প কর। সুখ দুঃখের গল্প।

— আরে, তেলাপোকা উড়লে ভয় পাই। তাছাড়া পাই না। এবার তাড়ান না ওটা।

দ্রোহ নিজের ফোনের টর্চ চালু করে নিচু হয়ে বিছানার নিচে খোঁজ চালাল। কিছু সময় পর অদ্ভুত আওয়াজ করা শুরু করল দ্রোহ। তারপর সেই জিনিসটাকে এক হাতে আগলে উঠে দাঁড়াল। রেখা দেখে অজ্ঞান হওয়ার উপক্রম।

— অভি, প্লিজ, ওটা এখান থেকে নিয়ে যান। প্লিজ।

— আরে রিখি, তুই ভয় পাচ্ছিস কেন? দেখ, কি কিউট বিড়ালটা। তোর দিকে কিরকম ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। আমার মনে হয় ও তোকে পছন্দ করেছে।

— ও এই ঘরে ঢুকল কি করে?

— সিঁড়ি দিয়ে। ঘরের দরজা তো এমনিই খোলা। ঢুকে গিয়েছে।

— ওকে প্লিজ এখান থেকে নিয়ে যান। প্লিজ অভি।

দ্রোহ মজা করে সেটাকে নিয়ে রেখার আরও কাছে এসে দাঁড়াতেই রেখা ছিটকে সরে গেল সেখান থেকে। তারপর ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দিল। দ্রোহ রেখাকে কাঁদতে দেখে আর কথা না বাড়িয়ে সেখান থেকে বিড়ালটা নিয়ে চলে গেল। ঘর থেকে বের হতেই রেখা দ্রুত দরজা লাগিয়ে দিল। তারপর আবার আশেপাশে দেখে নিল আর কিছু আছে কি না।

চলবে।

#অজান্তে_আগমন
#সাদিয়া_সৃষ্টি
পর্বঃ- ১৩

দ্রোহের বাড়িতে উৎসবমুখর পরিবেশ। তাদের বাড়ির সামনে মানুষের ভিড়। শুরুতে একটা কারণে মানুষ জড়ো হওয়া শুরু করলেও পরবর্তীতে ভিড় দেখে অনেক কৌতূহলী প্রাণ সেই ভিড়ের কাছে এসে ঘটনা জানার চেষ্টা করছে। রেখা মাত্র বিল্ডিং এর কাছে এসে সিঁড়িতে ওঠা শুরু করেছিল। স্কুলের কাজ শেষে ক্লান্তি ভর করা যেন দৈনন্দিনের রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অল্প কাজ করে বাড়ি ফিরলেও মনে হয় অনেক কাজ করেছে সে। সেই ক্লান্তির চোটে সিঁড়ি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যে কখন গন্তব্য পেরিয়ে আরও এক তলা উপরে উঠেছে সেদিকে খেয়াল নেই রেখার। অনেক মানুষের কথার আওয়াজে তার হুঁশ ফিরল। সিঁড়ির মাঝে না থেকে একেবারে উঠে সামনে তাকাল। সে আরও ২ তলা উপরে উঠে গিয়েছে। হুড়মুড় করে নিচে নামতেই দরজার সামনে মানুষের জটলা দেখতে পেল। আশেপাশে ঠিক করে তাকিয়ে দেখল। ওটাই দ্রোহের বাসা। চিনতে ভুল করেনি সে। মানুষের ভিড় দেখতেই মনে ভয় ঢুকে গেল। এর আগেও একবার এমন মানুষের ভিড় দেখেছে সে। খুব বাজে একটা দিন ছিল তার জন্য সেদিন। বাবা মায়ের মৃত্যুর খবর ছড়ানোর পর কিছু কিছু মন খারাপ করে আর কিছু কিছু মানুষ “দেখতে আসা উচিত” এই কথা মেনে সান্ত্বনা দিতে এসেছিল রেখাকে। তারপর বাড়ির সামনে আর কখনো এমন অবস্থার সম্মুখীন হয়নি সে। তাই ভয়টা আসা স্বাভাবিক। সে ভিড় ঠেলে কোনমতে ভিতরে ঢুকতেই ড্রয়িং রুমের সোফায় একজন বয়স্ক লোককে দেখতে পেল। পরনে পাঞ্জাবী আর লুঙ্গি। সাথে ব্যাগও আছে। সেটা তার পাশেই রাখা। সোফার সামনে থাকা টি-টেবিল এ অনেকগুলো কাগজ রাখা। তার মুখোমুখি সোফায় দ্রোহের বাবা-মা আর দিবাকে বসে থাকতে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর দ্রোহের কথা মনে পড়তেই দেখল কেউ তার পাশে দৌড়ে এসে দাঁড়াল। পাশে তাকাতেই দ্রোহকে দেখে শান্ত হল রেখা। কিন্তু বাড়ির পরিস্থিতিটা তখনও তার বোধগম্য হলো না। দ্রোহ এসেই হাঁপাতে হাঁপাতে থেমে থেমে বলে উঠল,

— আমাকে ডাকলে কেন এভাবে? কি হয়েছে?

দ্রোহের বাবা গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন,

— শান্ত হও। প্রথমে বসে পানি পান করো। তোমার বিয়ের জন্য তোমার মা মেয়ের ছবি দেখাতেই তোমায় এভাবে ডেকেছে। নাহলে তো তুমি আর আসতে চাইতে না। সরাসরি বাস ধরে মামা বাড়ি চলে যেতে। তাই এভাবে বলেছেন। আর কিছু না।

— ওহ, এই কথা। মায়ের আওয়াজ শুনে ভাবলাম কি না কি হয়েছে।

তারপর একটু থেমে জোরে জোরে শ্বাস নিল। মাথায় বাবার কথাটা পুরোপুরি ঢুকতেই বলে উঠল,

— কি? এই সামান্য কারণে আমাকে আবার ডাকলে তোমরা? আর মা, এসব কি? বাড়ির সামনে এতো ভিড় কেন? শুধু মেয়ে দেখানোর জন্য তো ডেকেছ আমায়। নাকি পুরো এলাকাকে দেখিয়ে তারপর মেয়ে পছন্দ করবে।

দ্রোহের মা খুশিতে গদগদ হয়ে বলে উঠলেন,

— বাবু, একটা ভালো কথা বলেছিস তো। পুরো এলাকার কথা তো আমি ভাবি-ই নি। এই সুযোগটা কাজে লাগানো যাবে। তুই এক কাজ কর, সামনের হোটেল থেকে তোর পছন্দের মুরগি পোড়া কিনে আন। টাকা তোর বাবা দিবে। যা।

— মা… ওটা গ্রিল চিকেন। আর কিসব বলছ তুমি এখন?

— ওই মুরগির গ্রিল আর মুরগি পোড়া একই হলো। তুই যা। বাবুর বাবা, যাও তো, বাবুর সাথে দোকানে যাও। গিয়ে টাকাটা দিয়ে এসো।

পুরোটা বিষয় রেখার মাথার উপর দিয়ে গেল। শুধু উপর দিয়ে না, এতো উপর দিয়ে গেল যে কোন কথার মানেই ধরতে পারল না রেখা। নিজে তাই আর চুপ না থেকে বলে উঠল,

— অ্যান্টি, এখানে এতো ভিড় কেন?

— আসলে এই যে, এই লুঙ্গি পরা লোকটাকে দেখছ না?

প্রশ্নের উত্তরে রেখা জোরে জোরে উপর নিচ মাথা নাড়ল। দ্রোহের মা আবার বলা শুরু করলেন,

— এই লোকটা হল ঘটক। আমি আজ বিকালে একে আসতে বলেছিলা ৫০ টা কিংবা তার উপরে বিবাহযোগ্য মেয়ের ছবি আর খবরাখবর আনতে। এনেছে ভালো কথা। কিন্তু একটা মেয়ের স্কুল ড্রেস পরা ছবি এনেছে। তাও দেখে মনে হচ্ছে ক্লাস থ্রি ফোরে পড়া মেয়ে। আমি বলেই দিয়েছি বিবাহযোগ্য মেয়ে। এখন কি আমি আমার ৩০ বছরের দামড়া ছেলের সাথে ১০ বছরের মেয়ের বিয়ে দেব বলো?

সবটা শুনে রেখা হু হা করে হেসে উঠল। তার সাথে তাল মেলাল দ্রোহ আর দিবাও। দ্রোহের বাবা মুচকি হাসলেন। ঘটকের দিকে তাকিয়ে দেখল ঘটক মুখ নিচু করে বসে আছেন। দ্রোহের হাসতে হাসতে ফ্লোরে গড়াগড়ি খাওয়ার অবস্থা। নিজেকে সামলে প্রথমে ভিড় ঠিক করে দরজা লাগিয়ে দিল। তারপর মায়ের হাত থেকে ছবিটা এক প্রকার ছিনিয়ে নিতে নিতে বলল,

— মা, আমার বয়স এখনো ২৮ ও হয় নি। এবছর হবে। আর তুমি কি না সরাসরি ৩০ বলে দিলে? মান সম্মান আর রাখলে না এলাকার মানুষগুলোর সামনে আমার।

তারপর ছবির দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,

— এই রিখি, এটা তো তোর ছবি।

— কি?

সমস্বরে চিৎকার করে উঠলেন দিবা, দ্রোহের বাবা মা আর রেখা। দ্রোহ কি বলেছে সেটা বুঝতে পাড়ার পর নিজেও বলে উঠল,

— তুই কি আমাকে বিয়ে করবি রিখি?

এই কথা বলার পর বাকি ৪ জন আবার চিৎকার করে উঠলেন।

— কি?

দ্রোহ পর পর দুই বার কি বলেছে সেটা নিজে পুরোপুরি ভাবে বুঝতে পারার পর মাথা চুলকে বোকা বোকা হাসি দিল দ্রোহ। তারপর বলল,

— মানে তোর ছবি এইগুলোর মধ্যে আসলো কি করে? এটাই বলতে চেয়েছিলাম।

সবাই এই নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলে দ্রোহ চোখের ইশারায় ঘটককে সব ছবি নিয়ে চলে যেতে বলল। উনিও চলে গেলেন সেখান থেকে নিঃশব্দে। রেখা নিজের কাপড়ের ব্যাগ হাতড়ে কিছুক্ষণ খোঁজ চালিয়ে যখন কাঙ্ক্ষিত জিনিসটি পেল না, তখন হতাশ হয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে বলল,

— মনে হয় সকালে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় ব্যাগ হাতড়ে হাতড়ে যাচ্ছিলাম। তখন ছবিটা পড়ে গিয়েছে। ওরা সবসময় আমার ব্যাগের থাকে। বের করা হয়নি কখনো। আর হয়তো টি-টেবিলে পড়ার পর কেউ দেখেনি সেভাবে। ঘটক এসেও টেবিলের উপর সব ছবি ছড়িয়ে রেখেছিল। তাই মিশে গিয়েছে।

রেখার পুরো কথা শোনার পর সবাই শান্ত হলো। দ্রোহ রেখার হাতে ছবিটা ধরিয়ে দিয়ে বলল,

— নিজের ব্যাগে সামলে রাখ। আর আমাকে বিয়ে করতে চাইলে সরাসরি মাকে বলে দিবি। এভাবে ছবি ফেলে রাখবি না।

রেখা সাথে সাথে মাথা নিচু করে ফেলল। দ্রোহ প্রতিবার হুটহাট কথা বলে রেখাকে নিজের অজান্তেই লজ্জায় ফেলে দেয়। ৮ বছর আগেও ফেলত, এখনো তাই করে।

“শুধরালো না ছেলেটা।”

মনে মনে বলল রেখা। দ্রোহের বাবা মা আর ছোট বোনের সামনে দাঁড়াতেই এখন তার অদ্ভুত লাগছে। দ্রোহ যখন নিজের বলা কথাটা আবার মনে মনে বলল, তখন আবার মাথা চুলকে নিজের ঘরের দিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। রেখার সামনে আবার অদ্ভুত কথা বলে ফেলেছে সে। প্রতিবার তো শুধু রেখার সামনেই বলত। কিন্তু এবার বাবা মা এমনকি দিবাও শুনে ফেলেছে। নিজের দাঁত দিয়ে জিভ কাটল। বড্ড ভুল হয়ে গিয়েছে। এমনিই দিবা সামনে পেলেই রেখার সাথে কি সম্পর্ক- এ নিয়ে প্রচুর জ্বালায়। এখন সে নিজেই আরেকটা সুযোগ করে দিল।

— বাবু, ঘটক কোথায় গেল?

দ্রোহের ঘরে ঢোকার আগেই প্রশ্ন করে বসলেন দ্রোহের মা। সে পিছনে না ঘুরেই বলল,

— সে তো তোমাদের অবস্থা দেখে চলে গিয়েছেন মনে হয়।

কোনোমতে কথাটা বলে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিল। রেখা দরজা লাগানোর শব্দে নিজের এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজের রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিল। দ্রোহের বাবা খবর পড়ায় মনোযোগী হলেন। তার আগে দিবাকে এক কাপ চা করে দিতে বললেন। দিবা চা বানানোর জন্য রান্নাঘরে চলে গেল। দ্রোহের মা আরেক চিন্তায় মগ্ন হলেন। দ্রোহের বিয়ে বিষয়ক চিন্তায়।

“দ্রোহের বলা কথাটা কিন্তু একেবারে ফেলে দেওয়া যায় না।”

_____

রাতের অন্ধকারে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা চা নিয়ে বারান্দায় এসেছে রেখা। বহুদিন পর রাতে আবার চা নিয়ে বসল সে। ঘুম আসছিল না তার। অনেক চেস্তার পরও যখন ঘুম আসলো না, তখন সর্বপ্রথম চায়ের কথাই মনে পড়ল। তাই সরাসরি রান্নাঘরে গিয়ে অন্ধকারেই কোনমতে চা বানিয়ে নিল। অবশ্য পুরোপুরি অন্ধকার বলা যায় না। বাইরের আলো ঘরের জানালা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করেছিল। সেই আলোতেই পানি গরম করল। তারপর অল্প সময়ের জন্য লাইট জ্বালিয়ে চা বানিয়ে সাথে সাথে লাইট বন্ধ করে দিল। তারপর সরাসরি নিজের রুমে। আশেপাশে তাকাল সে। পুরো রাস্তায় মানুষের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। থাকার কথাও না। গাছপালার প্রাচুর্য থাকায় আলোর পরিমাণ কম। কিছু কিছু দোকানে সারারাত আলো জ্বললেও সেটার ক্ষীণ রেখার দেখা মিলে মাত্র। দ্রোহের বাড়িটা চৌরাস্তার মোড়ে। সামনের দিক দিয়ে ৪ দিকে ৪ টা রাস্তা চলে গিয়েছে। কিন্তু তার দেখা বেশি দূর পর্যন্ত মিলে না। গাছপালায় ঢেকে গিয়েছে রাস্তা। চাঁদের আলোয় প্রতিবারের মতো শুধু আশেপাশের মেঘের আনাগোনা-ই দেখা যাচ্ছে। পৃথিবীতে তার আলোয় আবছা হয়ে উঠেছে পরিবেশ। আজ রেখার মনটা ভীষণ খারাপ। নিজেকে সব সময় কাজে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা চালায় সে। যাতে নিজের অনুভূতিগুলো লুকিয়ে রাখতে পারে। কিন্তু আজ আবার বাবা-মায়ের কথা ঘটা করে মনে পড়ল। আর এমনভাবে মনে পড়ল যে বাকি দিনটা সেই কথাই মাথায় এলো বারবার। কোন কাজে মন দিতে পারেনি সে। শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার খাতা দেখা বাকি। তবুও খাতার প্রতিটা শব্দ পড়ার পর সেই শব্দের মানে তার মাথায় ঢুকছিল না। কয়েক বার পড়তে হচ্ছিল বোঝার জন্য। কিন্তু এরকম কত খাতা কয়েক মিনিটেই শেষ করে ফেলার অভ্যাস আছে তার। রাতেও ঘুম আসল না বিধায় চায়ের সাহায্য নেওয়ার চেষ্টা করছে। তার বারান্দার পাশে আরেকটা বারান্দা আছে। কিন্তু এটা কার, সেটা এখনো জানে না সে। জানার ইচ্ছাও জাগে নি কখনো। আজ জাগছে। অকারণেই জানতে ইচ্ছা করছে এটা কার বারান্দা। কিছু একটা মনে করার চেষ্টা করতেই বুঝতে পারল এটা দ্রোহের ঘরের বারান্দা। এতদিন হয়ে গেল এ বাড়িতে আছে, কিন্তু এই ছোট জিনিসটাও ভেবে দেখেনি সে। নিজের কাজে নিজেই অবাক হলো। বাবা- মায়ের চিন্তা থেকে বের হওয়ার জন্যই এসব করছে সে। কিছুটা সফল হলো? হয়তো হ্যাঁ, আবার হয়তো না। সেইতো আবার কক্সবাজারে যাওয়ার কথা মনে পড়ে গেল। সকালেই কত খুশি ছিল। কিন্তু তাদের সাথে থাকা গাইডের একটা ভুল ছিল। তিনি বলেছিলেন জায়গাটা নিরাপদ আর সেই সময়ে কোন ঝুঁকি নেই। মা-ও খুশি হয়ে চলে গেল সামনে। মাকে ফেরাতে বাবাও গেল পিছনে। যাওয়ার আগে রেখাকে খুব করে মানা করে গেলেন যাতে সেদিকে না যায়। আশেপাশে মানুষ কম ছিল। কিংবা ছিল কি না তাও মনে নেই। যারা ছিল, তারাও হয়তো চলে যাচ্ছিল। রেখা আর সামনে গেল না। মুহূর্তেই একটা বড় ঢেউ এলো আর সবটা খুশি সমুদ্র গর্ভে নিয়ে গেল। তারপর থেকে রেখার একা চলা। পুরনো বাড়িতে থাকতে ইচ্ছা করছিল না। বারবার বাবা মায়ের কথা মনে পড়ত। তাছাড়া পরিচিতরা বারবার এসে সান্ত্বনা দিত। কোন ভাবেই ভুলতে পারতো না। তাই খালাকে বলে বাসা বদলে নেয়। নিজের পায়েই দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। অন্য কারো সাহায্য নেয়নি। প্রথমে যখন একটা বড় সমস্যায় পড়ল, তখন একবার সাহায্য চেয়েছিল। কিন্তু যার কাছে চেয়েছিল সে দিবে বলে আর কোনদিন যোগাযোগ অবধি করল না। মনোয়ারা ছিলেন বিধায় সব সামলে নিলেন। তারপর সেই বাড়িটাও ছেড়ে চলে আসে। বাড়ি সম্পর্কিত সব ব্যবস্থা মনোয়ারার উপর চাপিয়ে দিয়ে নিজের মতো করে থাকা শুরু করে। তিনটা বছর কম সময় নয়। কখনোই কম সময় হতে পারে না। তবুও “আমার থেকেও আরও সমস্যায় জড়িত মানুষ বেঁচে আছে”- কথাটা ভেবে নিজেকে প্রতিবার সামলে নেয় রেখা।

“আমার সমস্যাই বড় সমস্যা নয়। এর থেকে হাজার গুণ বড় সমস্যায় মানুষ পড়ে। তারাও কিন্তু বেঁচে থাকে। শুধু নিজেকে শক্ত রাখতে হয়। মৃত্যু তার নির্দিষ্ট সময়ে আসবেই। তার আগে নিজের ক্ষতি করার অধিকার আমাদের নেই।”

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here