অগত্যা_তুলকালাম,পর্ব ৪৬

#অগত্যা_তুলকালাম,পর্ব ৪৬
নাফীছাহ ইফফাত

দুপুরবেলা অলস সময় কাটাচ্ছি। সময় কাটছে না একাকী। ডায়েরিটা পড়া যায় এই সময়ে। আর অল্প কয়েকটা পৃষ্ঠা বাকি আছে। না জানি কি আছে ঐ শেষপাতাগুলোয়। ডায়েরি খুলতেই চোখে পড়লো শেষ অধ্যায়ের নাম। ”ডিপ্রেশন, এক্সিডেন্ট, সর্বশেষ…”

“প্রেয়সীর সাথে কথা বলা শেষে সিদ্ধান্ত নিলাম যে মাদরাসায় ফিরে যাবো৷ চারপাশটা অসহ্য লাগছিলো। ফোন হাতে নিলেই শুধু ওর প্রোফাইল ঘাঁটতে ইচ্ছে করে। অথচ ওকে আমার ভুলতে হবে। ও আগের মতো নেই, চায় না আমার সাথে কথা বলতে। আমি অনেক বেশি ডিপ্রেশনে ভুগছি। এরমধ্যেও পরিবারের সবার কাজ করে দিচ্ছি। একদিন ওর কথা ভাবতে ভাবতে বাইক চালিয়ে আসছিলাম হাইওয়েতে। হঠাৎ এক্সিডেন্ট হয়ে গেল। একটা সিএনজির সাথে ধাক্কা লেগে বাইক থেকে পড়ে ভয়াবহ চোট পেলাম। নাক ফেটে গলগল করে রক্ত বেরুতে লাগলো। কপাল কেটে গেল, হাত ছিঁড়ে গেল। কে যেন আমাকে হাসপাতালে নিয়ে আসে। হাসপাতাল থেকে তখনও বেরোইনি। এরমধ্যেই ছোট আপ্পি ফোন করে বললো তার জন্য বেলীফুলের মালা এনে দিতে। আমি তখন সেই সিচুয়েশনে ছিলাম না। কথাই বলতে পারছিলাম না। তাই কাজটাও করতে পারলাম না। মিনিট দশেক পর ফোন দিয়ে ছোট আপ্পি আবার ঝারলো আমায়। আমি কিছু না বলে ফোন রেখে দিলাম। ছেলেরা খুব সহজে চোখের জল লুকাতে পারে তো তাই তাদের ভেতরের কষ্টটা কেউ বোঝে না। বোঝার চেষ্টাও করে না। ছোটাপ্পি একটাবারও জানতে চাইলো না আমার কি হয়েছে? ভয়েস শুনেও কি কিছুই বুঝলো না? যাইহোক, আপ্পির কাজটা করে দিলাম কোনো কথা ছাড়া। বন্ধুকে দিয়ে পাঠিয়ে দিলাম বেলীফুলের মালা। এরপর বাবা ফোন করে আরেক ধমক দিলেন। ‘কান্ডজ্ঞান নেই কোনো? বাইরে বাইরে টইটই করা আর মোবাইলে বুঁদ হওয়া ছাড়া? সে আবার বিয়েও করতে চায়। বউকে তোর মোবাইল দেখাবি? খাওয়াতে হবে না?” উহ! মহা যন্ত্রণা! শরীরে ভয়াবহ চোট পেয়ে এসব তেঁতো কথা হজম করা কারো পক্ষেই সম্ভব না। আমার পক্ষে তো না-ই। আমি এমনিতেই কারো তেঁতো কথা শুনতে পারি না৷

ফোন রেখে বাসায় এলাম। বাসায় এসে এক মাসের বেডরেস্ট। উফ! কি ভয়াবহ ছিল সেই একটা মাস। প্রতিক্ষণে ওকে মনে পড়তে লাগলো। একটা মুহুর্ত নেই যেখানে ওকে মনে পড়ছে না। হাসপাতাল থেকে ফিরে ঘুমিয়ে পড়লাম। হঠাৎ মাঝরাতে ঘুম ভাঙতেই বুকে চিনচিন ব্যাথা হতে লাগলো। মনে হলো ওকে একটা কল দিই। আচ্ছা, কল দিলে কি রিসিভ করবে? আমার কন্ঠ শুনে কি কিছু আঁচ করতে পারবে? নাকি ছোটাপ্পির মতো ও আমাকে বুঝবে না? ফোন করার জন্য কি বকাবকি করবে খুব? এসব আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে আর ফোন করা হলো না। পরদিন গা কাঁপিয়ে জ্বর এলো। মা বলছিলো, জ্বরের ঘোরে নাকি বারবার ‘আরর, আরর’ করে গোঙ্গাচ্ছিলাম। আমার বুঝতে বাকি রইলো না যে ওর নামটাই নিচ্ছিলাম। সেই অসুস্থতায় মায়ের কোলে মুখ লুকিয়ে আমার দিন কেটে যাচ্ছিলো। মুখ লুকিয়ে কাঁদি। ছেলেদের প্রকাশ্যে কাঁদতে নেই। আমি আর পারছিলাম না সইতে। একদিন কাঁদতে কাঁদতে মাকে বললাম, “মা, আমি মাদরাসায় ফিরে যেতে চাই। আমি আর পারছি না এই বাসায় থাকতে।”
মা-ও কাঁদেন আমার সাথে। ততদিনে মাকে ওর কথা জানিয়ে দিয়েছি। জানিয়েছি আমার অপারগতার কথা। বাবার ভয়ে বাবাকে কিছু বলতে পারে না মা। মা আমাকে আশ্বাস দিলেন, “যদি তোদের দুজনকে আল্লাহ একে-অপরের জন্য সৃষ্টি করে থাকেন তবে তোদের মিল কেউ আটকাতে পারবে না। সাত সাগর তেরো নদী পার হয়ে হলেও তোরা এক হবি।”

মা সেদিন একটা ঘটনা বলেছিলেন। সুলায়মান (আঃ) এর দরবারে একদিন আজরাইল (আঃ) এলেন একটা কাজে। দরবারে দাঁড়ানো এক ব্যক্তির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভাবলেন, আল্লাহ বলেছিলেন একটু পর লোকটার প্রাণ অমুক জায়গা থেকে হরণ করতে অথচ লোকটা তো এখানে। আজরাইল (আঃ) চলে গেলেন কাজ শেষে। লোকটা সুলায়মান (আঃ) কে জিজ্ঞেস করলো, আমার দিকে তীক্ষ্ণ নজরে তাকিয়েছিলো, সেই লোকটি কে ছিল? তিনি বললেন, “আজরাইল।” লোকটি তখন আজরাইলের হাত থেকে বাঁচতে সেই জায়গায় পালিয়ে গেল যেখানে আল্লাহ লোকটার প্রাণ নিতে বলেছিলেন। আজরাইলও (আঃ) যথারীতি প্রাণ নিতে সেখানে হাজির হয় এবং লোকটা যথাসময়ে, যথাস্থানেই মৃত্যুবরণ করে। তাই কখনো ভাববি না। সবসময় আল্লাহর ওপর ভরসা রাখবি। তুই শুধু দোয়া করে যা। তোর তাকদীরে যা লেখা আছে তা-ই ঘটবে তোর জীবনে। আর যা নেই তা তুই শত চেষ্টা করেও আটকে রাখতে পারবি না। যেটা তোর সেটা তোর কাছে অবশ্যই আসবে, আসবেই। আর একমাত্র দোয়া-ই পারে ভাগ্য বদলাতে। তুই সবসময় তোর জন্য কল্যাণটা চাইবি আল্লাহর কাছে। এরপর বাকীটা আল্লাহ ভরসা।”

কয়েকদিন পর সুস্থ হলাম খানিকটা। সুস্থ হতেই শেষবারের মতো কাশবনে আসলাম। কয়েকদিনের মধ্যে মাদরাসায় ফিরে যাবো। সব বন্দোবস্ত হয়ে গেছে৷ সাথে ডায়েরিটা নিয়ে এসেছি লিখবো বলে।

আজ কি লিখবো ভেবে পাচ্ছি না৷ চোখগুলো ঝাপসা হয়ে আসছে৷ আমি সুস্থ হতেই মায়ের অসুস্থতা বেড়ে গেল। মাকে অসুস্থ দেখতে একদম ভালো লাগছে না। কাশবনের চারপাশটা ঘুরে ঘুরে দেখছি আজ। একটা কবিতা মনে পড়েছে।
“তোমার নামে বিকেল কেনার গল্প ছিল জমা,
মেঘ কিনেছি, জল কিনেছি, বাকি বৃষ্টি নামা
তোমার নামে’ই চিঠির শুরু প্রিয় মুগ্ধতমা।” [১]

চিঠি তো শুরুই করতে পারলাম না। যদি ভাগ্য সহায় হয় একদিন তোমার নামেই চিঠির শুরু হবে প্রিয়তমা, ইন শা আল্লাহ।

উঁহ! বড় আপ্পি ফোন করছে কেন আবার? মাত্রই এলাম, কি হলো এরমধ্যে? রিসিভ করেই লিখছি ডায়েরি৷ বড়আপ্পি বলছে, মা… মা ”

অসম্পূর্ণ অবস্থায় ডায়েরি শেষ। মা লেখার শেষে আকারটা লম্বা হয়ে খাতার পেইজ ছিঁড়ে গেছে নিচের দিকটায়৷ কি লিখতে চেয়েছিলো এখানে? খুব ভয়াবহ কিছু কি? আমার বুকের ভেতর ধড়ফড় করছে। কি হয়েছিল সেদিন? সেদিনই কি ও ডায়েরিটা কাশবনে ফেলে যায়? মনে একগাদা প্রশ্ন নিয়ে যখন হাবুডুবু খাচ্ছিলাম তখনই বাইরে থেকে হাসির শব্দ এলো। এই হাসি আমার চেনা, খুব চেনা। আমার মনে যে প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে চাইলেই সেগুলো এখনই ওর কাছে জেনে নিতে পারি। আমার বুকের ভেতর অজানা আশঙ্কায় ধ্বক করে কেঁপে উঠলো।

আমি রুমের দরজার কাছে গেলাম। ওদের আলাপ শোনা যাচ্ছে। রাফিন তানভীর ভাইয়ার ছোট হয়েও নাম ধরে ডাকে সেটা নিয়ে হাসাহাসি করছে ওরা।

রাফিনের হাসিটা আমাকে খুঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছে। ও এভাবে হাসছে কেন? আমার মনে কোথা থেকে যেন একরাশ অভিমান উড়ে এলো। মনে মনে বললাম,
এতই যদি ভালোবাসো তাহলে কেন ভালোবাসাটা দেখালে না? না দেখালে আমি কিভাবে বুঝবো? আমি যে বড্ড বোকা। তোমার মতো চোখে চোখ রাখলেই আমি সবটা বুঝে যাই না। তোমার মতো করে আমি চোখের ভাষা পড়তে জানি না। সবাইকে কেন নিজের মতো ভাবো? এই ভাবনাটাই তো মস্ত বড় ভুল। এখন বুঝতে পারছি, কেন রিলেশন শেষ হওয়ার পরও তুমি আমায় ফোন দিয়েছিলে। কেন নিজের কথাগুলো আমায় বলছিলে। অথচ আমি? আমি কতটা বোকা। তুমি দায় থেকে এসব করছো ভেবে তোমাকে পাত্তাই দেইনি।

এরপর আমার মনে হতে লাগলো, আমিই গোড়া থেকে অনেক বড় একটা ভুল করে ফেলেছি। রাফিনকে ভুল বুঝেছি আমি৷ এই যে বিয়ের প্রস্তাব দিতে বলা, বাবার টাকার অহংকারের কথা বলা, কোনো জব করতে বলা এসবই ভুল ছিল, সবটা। রাফিন নিশ্চয়ই সবদিক ভেবেছিল অথচ আমি বুঝতে ভুল করেছি। এতবড় ভুল আমি কিভাবে করলাম? কিভাবে? নিজের ভুলের জন্য কি করা উচিত আমি কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না।

মনের ভেতর থেকে কেউ যেন চিৎকার করে বলছে,
“তুমি ভুল করেছো হৃদিতা! অনেক বড় ভুল। তুমি রাফিনের সাথে অন্যায় করেছো। রাফিন তোমাকে দিল উজাড় করে ভালোবাসতো। তুমিই বোঝনি ওর ভালোবাসা। এটা তোমার অপরাধ। তোমার অপরাধের শাস্তি রাফিন কেন পাবে? ও কেন কষ্ট পাবে? সব দোষ ওকে দিয়ে তো দিব্যি ভালো ছিলে তুমি। অথচ একটাবারও ওর খোঁজ নিয়েছো? জানতে চেয়েছো, এতদিন কে ছিল ওর পাশে? চেয়েছো জানতে? তুমি অপরাধী, অনেক বড় অপরাধী!”

ভেতর থেকেই তারচেয়েও আরও জোরে আরেকজন বলছে,
“তুমি ভুল করোনি আরোহী। একদমই ভুল করোনি। তুমি আল্লাহর জন্য ওকে ছেড়েছো। একদম সঠিক কাজটাই তুমি করেছো। আল্লাহর পথে চলতে গিয়ে যদি হাজারটা মানুষকে ছুঁড়ে ফেলতে হয়, ঘৃণা করতে হয়, মন ভাঙতে হয় তবে তাই তোমার জন্য ফরজ। তিনি তোমার স্রষ্টা। তাঁর অবাধ্য হওয়া মানেই ঘোর বিপদ। এতদিন যে পথে তুমি চলেছো সেটাই সঠিক পথ। সেই পথ থেকে কোনো অবস্থাতেই সরে এসো না। তাহলে তোমার এতদিনকার সাধনা ধ্বংস হয়ে যাবে আরোহী, ধ্বংস হয়ে যাবে। তুমি তোমার লক্ষ্যে অটুট থাকো। আল্লাহকে ছেড়ো না। যার আল্লাহ আছে তার আর কাকে প্রয়োজন হতে পারে বলো? বলো তুমি? দ্বীনে ফেরা অনেক কঠিন, সাধনার কাজ। ধরে রাখাটা তারচেয়েও কঠিন। কিন্তু এর থেকে বিচ্যুত হওয়া ক্ষনিকের ব্যাপার। তুমি এতদিন ধরে রেখেছো তোমার দ্বীনকে, সামান্য ওকে বুঝতে না পারার অপরাধে নিজেকে শাস্তি দিও না৷ তাহলে হয়তো রাফিনের সাথে সহজ সম্পর্কটাও আজীবনের জন্য হারাবে তুমি সাথে আল্লাহকেও। একূল-অকূল দুকূল-ই যাবে তোমার। দুকূল হারিয়ে পুরোপুরি নিঃস হয়ে যাবে তুমি। সাবধান হও।”

আমি কান চেপে ধরলাম। বিড়বিড় করে বলতে থাকলাম, আমার কি করা উচিত? কি করবো আমি? আমি যে ভুল করেছি, রাফিনকে চিনতে ভুল করেছি সেটা ঠিক। কিন্তু কি করবো আমি? কে দিবে এর সমাধান? আমি নিজেকে শান্ত করলাম প্রথমে।

তারপর একটু আগে নিজের ভেতর থেকে আসা কথাগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে ভাবলাম। প্রথমজন, যে আমাকে বোঝাতে চাইলো রাফিনকে ভুল বুঝে আমি ভুল করেছি নিঃসন্দেহে সে আমার বেপরোয়া, অবাধ্য নফস। শয়তানেরই কাজ এটা। দ্বিতীয়ত, যে আমাকে বলছিলো আমি ভুল করিনি সে আমার রূহ। যে আমার ভালো চায়। আরও লক্ষ্য করলাম, নফসের বলা কথাগুলো ভাবার সময় আমি নিজেকে ‘হৃদিতা’ বলে ডেকেছি আর রূহের কথার সময় ‘আরোহী’ বলে। একমাত্র রাফিন-ই আমাকে আরোহী বলে ডাকে। তারমানে রাফিনের দিক থেকে আমি পুরোপুরি ঠিক। রূহ আমাকে বারবার বলছে আল্লাহকে না ছাড়তে। রূহের স্রষ্টাকে না ছাড়তে। অবশ্যই আমি আমার রূহের স্রষ্টাকে ছাড়তে পারবো না। আমি আমার রবকে ভালোবাসি। আমরা তো সুন্দর আলোচনার মাধ্যমেই সম্পর্ক শেষ করেছিলাম। এমন নয় যে, হুট করে কষ্ট দিয়ে, ওকে না বুঝে চলে এসেছি। যদি সেরকমও আসতে হতো আমি আসতাম। সুতরাং, নফসের ধোঁকা আমার কাছে দু’পয়সারও পাত্তা পেল না। দূর্বল হয়ে গেল নফস, জিতে গেল রূহ। আলহামদুলিল্লাহ।

আমার রুমের দরজাটা হঠাৎ খুলে যেতে লাগলো। ঠেলেও ধরে রাখতে পারছি না। ওপাশ থেকে মা চেঁচালেন,
“কিরে হৃদি! দরজা ঠেলছিস কেন? আরে বাবা! ওরা এখানে এমনিই দাঁড়িয়ে আছে। তোর ঘরে আসবে না কেউ।”

আমি ঝট করে সরে দাঁড়ালাম। মায়ের কথায় বেকুব হয়ে ঠাই দাঁড়িয়ে রইলাম। ওপাশে ওদের কথাও থেমে গেছে। উফ! মা’টা না? সবখানে ব্লান্ডার করে। ওদের সামনে এভাবে বলার কি ছিল? আমি কি ইচ্ছে করে ঠেলেছি নাকি?

মা এসে বসে খাটে। মায়ের সাথে আমার কথা খুব বেশি এগোয় না কখনো৷ একটা না একটা তুলকালাম লেগেই যায়৷ মা বললেন, “কিরে বস।” আমি ভয়ে ভয়ে বসলাম।

মা সরাসরি বললেন, “তোর তো এখন যথেষ্ট বয়স হয়েছে তাই না? তোকে তো সেই দু’বছর আগে বিয়ের কথা বলেছিলাম। তুই তখন দ্বীনদার পাত্র চেয়েছিলি। তখন খোঁজ মিলেনি তাই বিয়েও হয়নি। তোর কি এখনও একই মত?”
“হ্যাঁ মা, এখনও একই মত৷ তোমরা পাত্র দেখতে পারো। দ্বীনদার হলে, চরিত্র ঠিক থাকলে আমার দ্বিমত থাকবে না। এমনকি আমি পাত্রকে দেখতেও চাইবো না। তবে নাকীবকে একবার জিজ্ঞেস করে নিও পাত্র ঠিক আছে কিনা।”
“দেখবি না কি বলছিস রে! দেখেই তো যাচ্ছিস রোজ।”

আমি প্রসঙ্গ পাল্টালাম। “আচ্ছা মা, ছেলেটা কে? এখানে এসেছে কেন?”
“কোন ছেলেটা?”
“রা…”
“ফাইয়াজের কথা বলছিস?”
“হু হুম ফাইয়াজ-ই।”
“আরে ও তো এই বাড়িরই ছেলে। ভাইজানের ছেলে আর কি!”
“ওহ আচ্ছা। আগে কখনো দেখিনি এই বাড়িতে।”
”দেখবি কোত্থেকে? ও আসতো নাকি এখানে? সে-ই ছোটবেলায় ভাইজান নিয়ে গিয়েছিল ওদেরকে। আর আসতে দেয়নি। ভাইজান আগে খুব বদমেজাজি ছিলেন শুনলাম। ফাইয়াজ মাঝেমধ্যে এসে দেখে যেত বুবুকে। ছেলেটা বড়দের খুব সম্মান করে। আর বুবুকে তো মায়ের সমতুল্য মনে করে। অবশ্য বুবু তো ওর মা-ই।”
“হুম শুনলাম খালামণির কাছে। খালামণি ওর দুধ মা।”
“এখন দুধ মা, আসল মা সব হয়ে গেছে। আহারে! মা মরা ছেলেটা!”

আমি চমকাই ভীষণভাবে। মা বলতে থাকে,
“ওরা নাকি আমাদের এলাকাতেই থাকতো। ভাগ্যের খেল দেখ। পাশাপাশি থাকতাম অথচ কখনো দেখা হলো না। একই এলাকায় থেকে এই এত দূরে এসে দেখা হলো। ওর মা মারা যাওয়ার পর ওরা সেখান থেকে একেবারের জন্য চলে গেছে। জমিটা ওর মায়ের ছিল। মা মারা যাওয়ার পর সেই জমি বিক্রি করে দেয় ওর বাবা।”

মা ফিসফিস করে বললেন, “ফাইয়াজ ওর বাবাকে একদম পছন্দ করে না বুবু বললো। ওর মতে, ওর মায়ের মৃত্যুর জন্য ভাইজান দায়ী। ভাইজান এখন অনেক ভালো হয়ে গেছে তবুও ফাইয়াজ তেমন কথা বলে না ভাইজানের সাথে। খুব দরকার ছাড়া সে ভাইজানের মুখোমুখি হয় না। ভাবীর মৃত্যুর পর আর কি ও মাদরাসায় চলে যায়। তারপর এত বছর পর ফিরলো।”
“এত বছর কই? মাত্র দু’বছর।” বলেই জিব কাটলাম।

মা বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে বললেন,
“তুই কিভাবে জানলি?”
“মনে হলো।”
“যাইহোক, ফিরেই নাকি বাবার ওখানে থাকেনি। আমাদের এলাকাতেই উঠেছে। ও নাকি আমাদের এলাকায় একটা সমাজ কল্যাণ পরিষদ গঠন করেছে। আমাদের এলাকার সমাজসেবক হয়ে কাজ করছে ও। সেখানেই বসতি গড়বে। দেখছিস না, কিছুদিন ধরে এলাকায় কেমন শৃঙ্খলা বজায় থাকছে?”
“তাই? খেয়াল করিনি, বের হই না তো।”

ডায়েরির অজানা কথাগুলো মা কি সুন্দর অবলীলায় বলে গেলেন। যাক, মনটা একটু শান্ত হলো।

“বিয়ে করবে তো, বউয়ের জন্য বাড়িও বানাচ্ছে শুনলাম।”
“হুম।” বুকের ভেতর হালকা একটা ধাক্কা লাগলো। যতই কঠিন হই না কেন রাফিনের বিয়ে কি চোখের সামনে দেখতে পারবো আমি? তাহলে হয়তো সামলাতে পারবো না নিজেকে। ও দূরে আছে সেটা মেনে নিতে পারি কিন্তু আমার চোখের সামনে ও অন্যকারো হবে… এটা মেনে নেওয়া হয়তো কারো পক্ষে সম্ভব না। আমিও যত দ্রুত সম্ভব বিয়ে করে ফেলবো ইন শা আল্লাহ। তাহলে এই অদৃশ্য কিঞ্চিৎ দোটানাও আর কাজ করবে না আমার ভেতর। হৃদপিণ্ডটা অনবরত লাফাতেই থাকলো।

হয়েছে এবার এই টপিক চেঞ্জ করলে ভালো হয়। নাহয় মা থামবে না। রাফিনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ মা। বলতে এসেছিলো আমার বিয়ের ব্যাপারে, চলে গেল রাফিনের বিয়েতে। আজব ক্যারেক্টার!

মা আমাকে ওর লম্বা গল্প শোনায়। শোনাতেই থাকে। আমি বিরক্ত হয়ে বলি,
“এতসব আমাকে কেন বলছো মা? এসব আমি জানি।”
“তুই জানিস? তোকে ও বলেছে?”
“উনি কেন বলতে যাবেন? আমি ওনার সাথে কথা বলি নাকি?”
“তাও ঠিক। ছেলেটাও তোর মতো জানিস? গায়রে মাহরাম মানে খুব। আমার সাথে তো একটা কথাও বললো না। সেই প্রথমে একটু সালাম দিলো শুধু। তোর সাথে মিলবে খুব।”
“আশ্চর্য! আমার সাথে মিলাচ্ছো কেন?”
“বললাম আর কি! ছেলেটা ভালো খুব।”
“আচ্ছা বুঝলাম তো ভালো। আমাকে এত শোনাচ্ছো কেন?”
“ওমা! যে বাড়িতে বিয়ে করে আসবি সে বাড়ির সদস্যদের সম্পর্কে জানবি না?”
“বিয়ের পর জানবো মা। আমার অতোকিছু জানার ইচ্ছে নেই। যাকে বিয়ে করবো সে দ্বীনদার হলেই চলবে। সে যদি পাশে থাকে তাহলে সব ঠিক হবে ইন শা আল্লাহ।”
“সে তো অবশ্যই দ্বীনদার। এবার একদম তোর পছন্দমতো, কথামতো ছেলে খুঁজে পেয়েছি। না সে তোর ছবি দেখতে চেয়েছে, না তোকে দেখতে চেয়েছে। এককথায় সে রাজি হয়ে গেছে তোকে বিয়ে করতে। এবার আর না করার কোনো উপায় নেই তোর।”
“সে দেখতে চাইবে কোত্থেকে? সে তো আমাকে দেখেই নিয়েছে৷ ছোটবেলা থেকেই তো দেখছে।”
“আচ্ছা বল তুই রাজি তো?”
“আমি রাজি। তবে একটু সময় দাও, ইস্তেখারা করে জানাচ্ছি।”
“সে তোর যা ইচ্ছে কর, রাজি বলেছিস এতেই চলবে।”

মা খুশিমনে চলে গেলেন। আমি স্বস্তির নিশ্বাস নিলাম।

#Be_Continued_In_Sha_Allah 🥀

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here