অগত্যা_তুলকালাম,পর্ব ৪৭,৪৮

#অগত্যা_তুলকালাম,পর্ব ৪৭,৪৮
নাফীছাহ ইফফাত
পর্ব ৪৭

রাফিন এসেছে দুদিন হয়ে গেছে। এরমধ্যেই তারা হুলস্থুল ঘোরাঘুরি শুরু করেছে। নাকীবকে আজকাল পাওয়া-ই যাচ্ছে না। মায়ের কাছ থেকে রাফিনের ব্যাপারে সব শুনে শাওনের সাথে যোগাযোগ করলাম।
শাওন বলে, ‘কবেই তোকে মেসেজ করেছি দেখ।’
দীর্ঘদিন পর মেসেঞ্জারে ঢুকলাম। অসংখ্য মেসেজ জমা। রিয়াদের ম্যাসেজও আছে। সে বিয়ে করে নিয়েছে সেই দুই বছর আগে। বাব্বাহ! শাওনও বিয়ে করেছে জানলাম। ও আমাকে দাওয়াত করেছিলো অবশ্য। আমি যাইনি।

আরেকটু স্ক্রল করতেই রাফিনের মেসেজও পাই।
“আর যাবে না রাখা তোমায় এখানে
রাখতে হবে তোমায় খুবই যতনে।”

এটা অনেক আগের মেসেজ। তখন রিলেশন শেষ হয়নি বোধহয়। এরপর লাস্ট মেসেজটা আনরিড।
‘জানি না কত কথা ছিল বলার আরও
হয়নি আমার বলা, হয়নি বলা তারও,
চলে যাচ্ছি, হয়তো হবে না আর ফেরা
করেছি জ্বালাতন, করবো না আর জেরা।”

আবার অফলাইনে চলে এলাম। শাওনের সাথে যা কথা বলার বলা হয়েছে। রুমের বাইরে এলাম। ড্রইংরুমে আলাপ হচ্ছে বিয়ের। কার বিয়ের? আমার নাকি রাফিনের?

খালামনি বেশ জোরেশোরে বললেন, “আমরা অবশ্যই তোর বাসায় থাকবো না। আমরা হচ্ছি ছেলেপক্ষ। ভাইজানের বাসায় থেকে ওদের বিয়ে হবে। আমরা ছেলে নিয়ে তোর বাসায় গিয়ে মেয়ে নিয়ে আসবো।”
”বুবু, এখন থেকেই পর বানিয়ে দিচ্ছো?”
“আপন-পর বুঝি না। তোর মেয়ের বিয়েটা বিয়ে আমার ছেলের বিয়ে বিয়ে না? আমার ছেলেকে ঠিক আমি নিয়ে যাবো। গিয়ে তোর মেয়েকে নিয়ে আসবো।”
“আচ্ছা আচ্ছা তাই করো।”
“কোনো ধুমধাম হচ্ছে না সেটা তো ফাইনাল তাই না?” বাবা বললেন।
“হ্যাঁ, সে তো অবশ্যই। ছেলে আমার যা কড়া। ইসলামের বিধানের এদিক-ওদিক হওয়া যাবে না। সে তুলকালাম বাঁধিয়ে ফেলবে।”
“তা তো বটেই। আমাদের মেয়েও কি কম? সে তো আগে থেকেই বলে রেখেছে, সুন্নত পদ্ধতিতে বিয়ে না হলে সে বিয়ে করবে না। জাঁকজমকপূর্ণ হলে বিয়ে ভাঙতেও পিছপা হবে না।” মা বললেন।
“উঁ বাবা! আমাদের ছেলেও তাই। দুটোতে মিলবে ভালো।”
রাফিনের বাবা বললেন,
“দেখো, মেয়েটাকে আমার বড্ড পছন্দ হয়েছে। নদীর পাড়ে একা বসেছিলো। আনমনে বই পড়ছে। আমি গিয়ে পাশ থেকে ঘুরে এলাম অথচ তার কোনো হেলদোল হলো না। একাকী থাকে সবসময়, পরপুরুষের সামনে যায় না। খুব ভালো লাগে ওর এই ব্যাপারগুলো। আমাদের ছেলের সাথে মিলবে ভালো।”

কথাগুলো শুনে বেশ ভালো লাগলো। যাক! দ্বীনি কেউ আমার জীবনসঙ্গী হতে চলেছে অবশেষে। আলহামদুলিল্লাহ। করিডোর ধরে খানিকটা সামনে এগিয়ে গেলাম। নাকীবকে কোথায় পাই এই মুহুর্তে? উহু, পাওয়া গেল না ওকে। রুমে এসে দাদুকে ফোন দিলাম। ওদের খবরাখবর নিলাম। জাফর আর ডিস্টার্ব করেনি শুনলাম। সিকিউরিটি গার্ড দুজন নাকি ভালোই পাহারা দিচ্ছে। দিবেই তো, কালপ্রিট তো এখানে বসে অর্ডার করছে ওদের৷ ডিনারে ডাকায় চলে গেলাম। কবে বাড়ি ফিরবো কে জানে? খুব অস্থির লাগছে। আর কতদিন বাচ্চাগুলো একাকী থাকবে?

পরদিন ভোরে নামাজ-দোয়া শেষে করিডোর ধরে হাঁটতে হাঁটতে করিডোরের শেষপ্রান্তে চলে গেলাম৷ সূর্য উঁকি দিচ্ছে গাছের ফাঁকে। ভোরের সময়টা একমাত্র সময়, যখন পুরো বাড়িটায় আমি একাকী মনের আনন্দে ঘোরাঘুরি করি। পুরো বাড়ির সবাই ঘুম থাকে আর আমি মহানন্দে ঘোরাফেরা করি। আজও পূব দিকের করিডোরের জানালার ধারে গেলাম। গিয়ে দেখি জানালার পাশে একটা টুল রাখা। বাহ! আজ এই আয়োজন কে করলো? এতদিন দাঁড়িয়ে দেখেছি সূর্যোদয়, আজ বসে বসে দেখবো। ভাবতে ভাবতে রাজকীয় ভঙ্গিতে বসে পড়লাম টুলে। কিছুক্ষণ বসে থাকার পর হঠাৎ সর্বশেষ রুমটার দরজা মটমট আওয়াজ তুলে খুলে গেল। আমি ভয়ে মৃদু চিৎকার করে উঠি। এই দরজা জীবনে খোলা দেখিনি আমি। আজ হঠাৎ ভেতর থেকে দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে লাফিয়ে ওঠাটাই স্বাভাবিক।

আমি লাফিয়ে ওঠায় টুল পড়ে গেল। বিকট শব্দ হলো। ভেতরের মানুষটা বেরিয়ে এলো। রাফিন! ওকে দেখে আরও একটা চিৎকার বেরিয়ে এলো অনায়াসে। ও বিস্ফোরিত চোখে তাকালো আমার দিকে। মুহুর্তেই “স্যরি, স্যরি, স্যরি, স্যরি” বলতে বলতে ভেতরে ঢুকে দরজা আটকে দিলো। আমি প্রাণ হাতে নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে রুমে ফিরে এলাম। ধুত্তুরি! ওর সাথে দেখা হলেই কেন একটা না একটা তুলকালাম ঘটে যায়। সেই প্রথমদিন থেকে। সাক্ষাৎটাই তো হয়েছিল তুলকালাম দিয়ে৷

নাকীবকে সকাল আটটায় খুঁজতে গিয়েও পাওয়া গেল না। সে এরমধ্যেই বেরিয়ে গেছে। আমার রাগ হলো ভীষণ। আমাকে ফেৎনার জালে আটকে রেখে নিজেরা ইচ্ছেমতো ঘুরছে। আজ আসুক!

নাকীবকে ফোন দিয়ে ইচ্ছেমতো গালমন্দ করলাম। সামনে আসলে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়ার হুমকি দিলাম। এরপর আমি তৈরি হয়ে একাকী চলে গেলাম নৌকার কাছে। নৌকাটা খালি পরে আছে। সেটা খুলে অনেক কষ্টে টেনেটুনে সিঁড়ির কাছে আনলাম। এবার সাবধানে নৌকায় উঠে বৈঠা হাতে নিয়ে বাইতে শুরু করলাম। প্রচন্ড রেগে থাকায় বৈঠা বাইতে আমাকে কোনো বেগ পোহাতে হচ্ছে না। রাগই সবটা সামলে নিচ্ছে। কিছুদূর যেতেই আগেরদিনের সেই খেয়া পারাপারের মাঝির সাথে দেখা হয়ে গেল। তিনি ডাক দিয়ে বললেন,
“আফা, একাকী কই যান?”
আমি চুপ করে থাকলাম। তিনি আবার বললেন,
“মাঝি নিয়া যাইতেন৷ মাঝনদীত যাইয়া আবার শক্তি থাকবো না, ফিরতি পথে আইতে পারবেন না।”

আমি কিছু না বলে সামনে যেতে থাকলাম। মাঝ নদীতে গিয়ে বৈঠা রেখে দিয়ে শুয়ে থাকি। নৌকা যেদিকে নিয়ে যায় সেদিকেই যেতে থাকি। একসময় ঘুমিয়ে পড়ি নৌকায়৷ যখন ঘুম ভাঙ্গে তখন সন্ধ্যা নেমে গেছে। প্রথমে ঘাবড়ে যাই খুব। কি করবো ভেবে পাই না। বৈঠা হাতে নিয়ে দেখি চালাতে পারছি না। রাগ কমে গেছে সাথে শক্তিও। তাও কষ্ট করে চালানোর চেষ্টা করলাম। চালালামও খানিকক্ষণ। হঠাৎ খেয়াল হলো আমি কোনদিক থেকে এসেছি সেটা আমার মনে নেই। ঘুমিয়ে পড়ায় নৌকা কোথা থেকে কোথায় এসেছে তাও জানি না। এদিকে সন্ধ্যা নামছে। ভয়ে আমার আত্মা শুকিয়ে এলো। কি হবে যদি নির্জন এই নদীতে হারিয়ে যাই? যদি ডুবে যাই? অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠে দোয়া-ইউনুছ পড়তে থাকলাম অনর্গল। ইউনুস (আঃ) মাছের পেটের ভিতর থেকেও যদি আল্লাহর ওপর ভরসা করতে পারেন, আল্লাহর সাহায্য আশা করতে পারেন তবে আমি মাঝ নদীতে কেন আল্লাহর সাহায্যের আশা করবো না? আমি হাঁটুতে মুখ গুঁজে আল্লাহকে ডাকতে লাগলাম। আমার মোটেও উচিত হয়নি এত রাগ করা, রাগ করে এখানে চলে আসা। রাগ শয়তানের কাছ থেকে আসে সেটা আমি বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমাদের মধ্যকার কোন ব্যক্তিকে তোমরা বড় বীর মনে করো?’ সাহাবীগণ বললেন, ‘যাকে কেউ যুদ্ধে হারাতে পারে না।’রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘না, বরং প্রকৃত বীর হলো সেই ব্যক্তি যে রাগের সময় নিজেকে সংযত রাখতে পারে। [১]

একসময় সূর্য পুরোপুরি ডুবে গেল। আমার ভয় আরও গাঢ় হয়। অন্ধকার নামছে। আসরের নামাজ বোধহয় কাযা হয়ে গেছে। আমি নদীর পানিতে ওযু করলাম। নামাজ পড়ে নেয়া যাক। নৌকাতেই নিয়ত বাঁধলাম। মহানবী (ﷺ) বলেন, “আর সারা পৃথিবীকে আমার জন্য মসজিদ (নামাযের জায়গা) এবং পবিত্রতার উপকরণ বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং আমার উম্মতের মধ্যে যে ব্যক্তির নিকট যে কোন স্থানে নামাযের সময় এসে উপস্থিত হবে , সে যেন সেখানেই নামায পড়ে নেয়।” [২]

আসর ও মাগরিব একসাথে আদায় করলাম। সূর্যাস্তের সময় নিষিদ্ধ ওয়াক্ত হওয়ায় নামাজ পড়তে পারিনি। নামাজ শেষ হতেই দেখি পাশে মিটিমিটি আলো জ্বলছে। মৃদু আলোয় একটা নৌকা দেখা যাচ্ছে। আলো দেখে সাহস ফিরে পাই৷ ধীরে ধীরে নৌকাটা এদিকেই আসছে। কাছে আসতেই আবছা আলোয় রাফিনের মুখ দেখতে পাই। ওকে দেখে মনে সাহস বেড়ে গেল। পরক্ষণেই আবার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। ও আমাকে ফলো করেছে নাকি? আমাকে কেন ফলো করতে হবে? আমি কে তার? এত ঢং আসে কোত্থেকে? আমার ধর্মে পরপুরুষের সাথে এত ঢং নেই। উফ! আবার রেগে যাচ্ছি আমি৷ আবার ওকে ভুল বুঝছি। ও মোটেও আমাকে ফলো করছে না। ও এখন আর সেই আগের মতো নেই। আর আগে হলেও ওর স্বভাবে কোনো মেয়েকে ফলো করার মতো মানসিকতা অন্তত নেই। এমনকি কোনোকালেই ছিল না৷ উল্টাপাল্টা ভাবনার জন্য নিজেকে নিজে ধিক্কার দিলাম।

রাফিন গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,
“পথ হারিয়েছেন?”
ও বোধহয় আমাকে চিনতে পারেনি। আমি কি বলবো ভেবে পেলাম না। ওকে দেখে আমার হঠাৎ কান্না চলে আসছে। কেমন যেন আনন্দ আর দুঃখ একসাথে হচ্ছে। আমি মৃদুস্বরে বললাম,
“পথ ভুলে গিয়েছি।”
আমার কন্ঠ শুনে রাফিন চমকে উঠলো। খানিকক্ষণ সময় নিয়ে বললো,
“তুমি অনেক দূর চলে এসেছো। একা ফিরতে পারবে না।”

হঠাৎ মনে হলো আমি আবার ফেতনায় জড়িয়ে যাচ্ছি। রাফিনের সাথে কথা বলতে গিয়ে আমার ভেতরটা কাঁপছে। আমি আমার মধ্যে নেই। আমার মধ্যে অন্য এক আমি’র আস্তরণ পড়ে গেছে। আমি যা করছি আলাদাভাবে করছি। এটা আমার স্বভাব না।

আচমকা ঝাঁজালো কন্ঠ বেরিয়ে এলো কন্ঠনালি দিয়ে,
”একা যখন এসেছি একাই যেতে পারবো। আজীবন তো একাই চলেছি। এখন আবার কারো সাহায্য লাগবে কেন?”
রাফিন আবার চমকালো। আমতা আমতা করে বললো,
“ভালোর জন্য বলছিলাম…”
“আমার ভালো আমি দেখতে জানি৷ যান নিজের রাস্তায় যান।”
“আমার সাথে মিসবিহেইভ করছো কেন? আমি কি করেছি?”
“সীমালঙ্ঘন করেছেন। আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীকে পছন্দ করেন না। আপনি নিজের রাস্তায় যান। আমি পথ চিনে যেতে পারবো৷ আপনার ভাবতে হবে না আমাকে নিয়ে। যত্তসব!”

বৈঠা হাতে নিয়ে নৌকা বাইতে লাগলাম। কষ্ট হচ্ছে তবুও হাল ছাড়লাম না। রাফিন চেঁচিয়ে বললো,
“আমার ঠ্যাকা পড়েনি একজন নন-মাহরামের সাথে কথা বলতে৷ শুনুন, ঐদিকে না বাড়ি এদিকে।”
“ধুৎ জ্বালা।”

নৌকা ঘুরিয়ে ঐদিকে যাওয়া শুরু করলাম। রাফিন আসছে পিছুপিছু। রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে আমার। কাল সকালেই আমি বাড়ি ফিরবো। এখানে আর একমুহূর্তও থাকবো না। একা হলে একাই ফিরে যাবো। রাগের চোটে বৈঠা বাইতে কষ্ট হচ্ছে না আমার। দাঁতে দাঁত চেপে রাগ হজম করলাম। ইচ্ছে করছে ইট দিয়ে নিজের মাথা ফাটিয়ে দিই। আজব তো! ওর উপর হঠাৎ এত রাগ হচ্ছে কেন আমার? ওর সাথে রাগ করার তো কোনো কারণ নেই। রাগ করতে হলে তাকে নিয়ে ভাবতে হবে, তার সাথে মনোমালিন্য হতে হবে। রাফিনের সাথে আমার সেরকম কেনোকিছুই হয়নি। ইভেন, সে তো আমার ভাবনারও বাইরের কেউ। তার ওপর রাগ দেখানোর মাধ্যমে আমি অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করছি যেটা আমার একদমই উচিত হচ্ছে না। ও আমাকে সাহায্য করতে এসেছিলো উল্টো আমি ওকে… আমার থাকতে হবে একদম স্বাভাবিক। ইনফ্যাক্ট, আমার রাগ করারই তো কোনো কারণ নেই। একজন প্রকৃত মুমিন কখনো রাগে না। মুমিনের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো, সে নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

রাগের মাধ্যমে শরীরে দ্বিগুণ শক্তি পাচ্ছিলাম এতক্ষণ। হুট করে রাগের হাদীসটা আবার মনে পড়লো। আর চোখের সামনে ভেসে উঠলো আমার নিজের নৌকা চালানোর দৃশ্য। একজন পরপুরুষ আমাকে দেখছে আমি শরীর দুলিয়ে নৌকা চালাচ্ছি। ছি! যদিও অন্ধকার… এটা ভাবতেই আমার হাত থেকে বৈঠা পড়ে গেল পানিতে। আমি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লাম। খুব কান্না পাচ্ছে আমার। সবকিছুতে এত বাড়াবাড়ি কেন করি আমি? সময়ের কথা সময়ে বুঝি না কেন? আল্লাহ! আমি কি করবো এখন? আল্লাহর কাছে সাহায্য চেয়েছিলাম, আল্লাহ-ই তো সাহায্য পাঠালেন। অথচ আমি হেয় করলাম। ওহ আল্লাহ! তুমি আমাকে রক্ষা করো। আমাকে বুদ্ধি দাও। আমি আর পারছি না। এত বোকা কেন আমি?

আমি পেছনে ফিরে তাকালাম। রাফিন মুখ ফিরিয়ে নিলো। আমার খুব কান্না পাচ্ছে। আমি আল্লাহর অবাধ্যতা করেছি। রাফিনকেও অযথা রাগিয়ে দিয়েছি। আমাদের স্বাভাবিক পথ চলাকে অস্বাভাবিক করেছি। রাফিনের সাথে কথা বলে আমি মোটেই বাড়াবাড়ি করিনি বরং বাড়াবাড়ি করেছি ওর সাথে রাগারাগি করে। প্রয়োজনে পরপুরুষের সাথে অবশ্যই কথা বলা যায়৷ শয়তানের ধোঁকায় পড়ে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি আমি। আল্লাহ, এখন আমার কি করা উচিত? হতাশায়, দুঃখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম আমি৷

রেফারেন্স:
[১] সুনানে আবু দাউদ, মুসলিম
[২] বুখারী ৪৩৮নং, মুসলিম

#Be_Continued_In_Sha_Allah ❣️

#অগত্যা_তুলকালাম
নাফীছাহ ইফফাত

পর্ব ৪৮

রাফিনের নৌকা আমার নৌকা ছাড়িয়ে চলে গেছে। ও আমার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। ওর ভুলটা আমাকে ভাঙ্গাতেই হবে। আর ওর সাথেই আমার ফিরতে হবে। আমি আর পারবো না নৌকা বাইতে। রাফিন অনেক দূরে চলে যাচ্ছে। আমার ইচ্ছে হলো চিৎকার করি। কিন্তু পারছি না। গলায় কান্নারা দলা পাকিয়ে জমা হচ্ছে। অনেক কষ্টে শরীরের সমস্ত শক্তি এক করে ডাকলাম,
“রাফিন, প্লিজ হেল্প মি!”

আমার ঠোঁট ভেঙ্গে কান্না এলো। ডাক দিয়েই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে নৌকায় বসে পড়লাম। জীবনে কখনো রাফিনকে নাম ধরে ডাকিনি আমি। আমার ডাক শুনেই ওর নৌকা থেমে গেছে। আমি জানি ও এদিকেই আসছে। আমি চোখ বন্ধ করে বসে রইলাম। রাফিনের নৌকা আমার নৌকার সামনে এসে থামলো। আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“উঠে এসো।”
নৌকায় পা দিতেই নৌকা দুলে উঠলো। চোখ ঝাপসা থাকায় খেই হারিয়ে পড়েই যাচ্ছিলাম। তার আগেই রাফিন হাত ধরে হ্যাঁচকা টানে নৌকায় উঠিয়ে নিলো আমাকে। তারপর বিরক্তি নিয়ে বললো,
“স্যরি!”
বিড়বিড় করে বললো, ”একটা কাজ যদি ঠিকঠাক মতো পারতো।”

আমি গোমড়া মুখে এককোণায় গিয়ে বসলাম। রাফিন যেখানটায় ধরেছে সেখানে হাত দিয়ে ডলতে ডলতে লাল করে ফেলেছি। হাত গরম হয়ে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাড় দেখা গেল। ঘাটের সামনে এসে রাফিন একাই নেমে গেল। আমি নৌকা থেকে নেমেই সিঁড়িতে বসে পড়ি। শক্তি সব শেষ আমার। রাফিন মাঝিকে ভাড়া মিটিয়ে উপরে উঠতে উঠতে আবার বিড়বিড় করে বললো, “কি সীমাহীন জেদ!”

সিঁড়ি পার হয়ে বললো, “আমার সাথে যাবে নাকি বিপদ আরও কিছু বাড়ানো বাকি আছে?”
রাত নেমেছে অনেকক্ষণ আগেই। ঘাটে হলদে বাতি জ্বলছে। রাস্তায়ও হলুদ বাতি। আমি উঠে এসে ওর পেছনে হাঁটতে লাগলাম চুপচাপ। নিজেকে শক্ত করে বললাম,
“তোমাকে কিছু বলার আছে আমার।”
“নন-মাহরামের সাথে আমার কথা নেই।”

আমি চুপ হয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ পর ও নিজেই আবার বললো, “বলো কি বলবে।”
“আমি খুবই দুঃখিত ঐ সময়ের ব্যবহারের জন্য। তোমার সাথে কখনোই ঐরকম ব্যবহার করতে চাইনি আমি। হঠাৎ যে কি হলো…”
“নন-মাহরামের সাথে কথা বলা যাবে না ভাবানো ঐ ভুতটা চেপে বসেছিলো মাথায়। ব্যাপার না। আমি কিছু মনে করিনি। এত লেইম বিষয় নিয়ে চিন্তা করার টাইম নেই আমার।”
আমি আবার চুপ করে থাকলাম। ও বললো,
“দুটো কথা শোনো। ফার্স্টলি, নন-মাহরামের সাথে কথা বলো না ঠিক আছে বাট প্রয়োজনে কথা বলা যায়৷ তুমি সীমাহীন একটা বিপদে ছিলে। ঐ বিপদ থেকে নিশ্চয়ই তোমাকে কোনো মেয়ে গিয়ে বাঁচিয়ে আনতে পারতো না। আর এখানে তোমার বাবা আর নাকীব ছাড়া তোমার কোনো মাহরাম নেই। তোমাকে মাঝনদীতে গিয়ে বিপদ থেকে উদ্ধার করতে কোনো মাহরাম পৌঁছানোর পসিবলিটি জিরো পার্সেন্ট। মাহরামের আশা করলে ওখানে আজীবন থাকতে পারতে। সবসময় যুক্তি খাঁটে না, বুদ্ধিও কাজে লাগাতে হয়।”
“হু, বুঝতে ভুল হয়েছিলো আমার।”
“সেকেন্ডলি, রাগ কখনোই সুফল বয়ে আনে না। তুমি রাগ করেই মাঝনদীতে গিয়েছো। তারপর এই লম্বা ঘটনা ঘটলো। আমার সাথে মিসবিহেইভ করলে। ফল হলো খারাপ। আমি চাইলে তোমাকে না নিয়ে ফিরতে পারতাম। আফটারঅল, ইউ আর নোবডি টু মি, একদমই কেউ নও। তুমি নদীর মাঝখানে মরে পড়ে থাকলেও আমার কিচ্ছু যায়-আসতো না। ইউ আর নাথিং টু মি, নাথিং!” শেষ কথাগুলো বলার সময় রাফিন দাঁড়িয়ে পড়েছিলো আর আমিও এবং সে সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বললো। রাগে ওর চোখ জ্বলজ্বল করছিলো। কথাগুলো বলে একমুহূর্তও দাঁড়ালো না ও। দ্রুত হেঁটে নিমেষেই আমার চোখের সামনে থেকে মিলিয়ে গেল।

কথাগুলো আমার বুক ফুঁড়ে হৃদয়ের গহীনে গিয়ে লাগলো। ও এভাবে বলতে পারলো আমায়? একটু নাহয় মিসবিহেইভ করেছি, ভুল বুঝেছি ওকে। তার জন্য তো স্যরিও বলেছি। আচ্ছা, আমি যদি তার কেউই না হই তাহলে সে এত কড়া কথা আমাকে শোনালো কেন? একদমই অপরিচিত কাউকে কি সরাসরি চোখের দিকে তাকিয়ে ‘ইউ আর নোবডি টু মি’ বলে থ্রেট করা যায়? ‘ইউ আর নোবডি টু মি!’ তোর বডি নিয়ে তুই থাক। আমার কি? হুহ! একটা ভেংচি দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। বাড়ির সামনে আসতেই দেখি গাছগাছালির ফাঁকে রাখা দোলনাটায় বসে দুলতে দুলতে রাফিন ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছে আর হি হি করে হাসছে। নিশ্চয়ই তার হবু বউয়ের সাথে কথা বলছে। আমাকে ধমকিয়ে এখন আবার হেসে হেসে বউয়ের সাথে কথা বলা হচ্ছে। লজ্জা শরমের বালাই নেই। যত ধমকাধমকি সব আমার জন্য, বাকীদের জন্য তার কি সুমিষ্ট ব্যবহার। আমি যাকে বিয়ে করবো সে আমাকে কখনোই ধমকাবে না। সে যথেষ্ট নরম মনের মানুষ। অবশ্য যে আমার সে আমাকে ধমকালেও আমি মেনে নিবো কারণ সে তো আমারই। অন্য কেউ কেন আমাকে ধমকাবে? তার ধমক শোনার জন্য আমার জীবন যেন থেমে আছে। এখনও আমাকে ধমকাধমকি করছে। আমি তার কেউ না অথচ ধমকাচ্ছে যেন কাছের কেউ। বিরক্তিকর লোক একটা। একদম তাকালাম না তার দিকে। আবার মনে মনে দশটা ভেংচি দিয়ে বাসায় চলে এলাম।

বাসায় আসতেই মায়ের জেরার মুখে পড়লাম।
“কোথায় গিয়েছিস তুই একা? তোকে খুঁজতে খুঁজতে পাগল হয়ে যাচ্ছি আমরা।”
“নদীতে গিয়েছিলাম। আমরা কবে ফিরবো?”
“তোর শুধু ফেরার কথা। বিয়ে ঠিক হয়েছে কোথায় শ্বশুরবাড়ি চিনে নিবি তা’না আছে শুধু ফেরার তালে।”
“শ্বশুরবাড়ি বউ হয়ে এলে তখন চেনা যাবে। বউ হওয়ার আগে এখানে আর থাকবো না।”
“ছেলেটা মাত্র কাল এলো। ও তো আমাদের সাথেই ফিরবে বললো। আর ক’টা দিন থেকে যাই।”
“আজব তো! ছেলেটার সাথে আমাদের কি? সারাক্ষণ ছেলেটা ছেলেটা করো কেন? ও ছাড়া আর কেউ নেই তোমাদের ভাবনায়?”

মা দরজার দিকে তাকিয়ে আমাকে থামাতে চাইলেন ইশারায়। আমি থামলাম না। মা মুচকি হেসে দুষ্টুমির সুরে বললেন,
“উনি ‘ও’ হয়ে গেল কবে?”
রাগে চোখ বন্ধ করে ফেললাম আমি। এই সময়ে মজা করছে আমার সাথে।
“আমি কি মজার পাত্র? সবাই মিলে মজা করছো আমার সাথে?”
নাকীব দু’হাত পকেটে ঢুকিয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
“পাত্র না, তুমি হলে পাত্রী।”
আমি ঠাঁটিয়ে ওর গালে একটা চড় মারলাম। এতক্ষণের জমানো রাগ। ও গালে হাত দিয়ে বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে চলে গেল। আমার দিকে হা করে তাকিয়ে রইলো। দাঁত কিড়মিড় করে বললাম,
“তোর জন্য সব হয়েছে।”
চেঁচামেচি শুনে খালামণি চলে এলেন। মা রেগে গিয়ে বললেন, “তুই অযথা আমার ছেলেকে মারলি কেন?”
“তোমার ছেলেকে আমি মারিনি, আমি আমার ভাইকে মেরেছি।”
বলে পেছনে ফিরতেই দেখি দরজায় রাফিন দাঁড়িয়ে। সাথে সাথেই মুখ ফিরিয়ে নিয়ে উপরে উঠতে লাগলাম। রাফিন এসে নাকীবের হাত ধরে বললো,
“চলো, বিষয়টা বোঝাচ্ছি।”
আমি আবার উল্টো ফিরে এসে নাকীবের অন্য হাত ধরে টেনে আমার সাথে নিয়ে এলাম। রাফিন ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে রইলো আমাদের দিকে।
“আমার ভাইকে আমি বোঝাবো, কাউকে কিচ্ছু বোঝাতে হবে না।”

আসতে আসতে শুনলাম রাফিন খালামণিকে বলছে,
“তোমার ভাগ্নীটা এমন পাগলাটে কেন মা?”
“আমিও তো বুঝতে পারছি না কিছু। শান্তশিষ্ট মেয়েটা হঠাৎ এমন কেন করছে?”

রুমে এসে দরজা বন্ধ করে ধপ করে বসলাম বিছানায়। নাকীব তখনও গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিজেকে শান্ত করে নাকীবকে বললাম,
“কোথায় ছিলি সারাদিন?”
”আগে বলো আমাকে মারলে কেন?”
“তুই সারাদিন কোথায় ছিলি?”
“তুমি এমন পাগলাটে আচরণ করছো কেন?”
“প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন করবি না। আগে আমার কথার জবাব দে।”
“বাইরে ছিলাম।”
“তুই জানিস আমি এখানে একা একা আছি। তুই ছাড়া কথা বলার মতো কেউ নেই। তাহলে তুই আমাকে একা রেখে সারাদিন টইটই করছিস কেন? কাল সারাদিনে কি আমাদের একবারও দেখা হয়েছিল?”
“তুমি তো একা থাকতেই পছন্দ করছো। আর তোমার ডায়েরিটা আছে না?”
“নেই, ডায়েরি শেষ।”
“সেটা কি আমি জানি? রাফিন ভাইয়া এলো এতদিন পর তাই একটু ঘোরাঘুরি করছি আর কি। ওকে একটু টাইম দিচ্ছি।”
“রাফিন ভাইয়ার সাথে তোমার ভাব যে কতটা গভীর সেটা বুঝতে আমার আর বাকী নেই। তোমার যা খুশি করো রাফিন ভাইয়ার নাম আমার সামনে উচ্চারণ করবে না একদম।”
“আমি বুঝতে পারছি রাফিন ভাইয়ার সাথেই কোনো ঘটনা ঘটেছে। কি ঘটেছে সেটা ঝটপট বলে ফেলো। নয়তো চড়ের বোমা আমি আর সহ্য করবো না। আমিও লাগিয়ে দিবো টপাটপ।”
“বলবো না আমি৷ ওর কাছ থেকে শুনে নে।”
“ওর কাছ থেকে শুনবো কেন? তুমি না তোমার ভাইকে ওর সামনে থেকে টেনে এনেছো?”
“ও আমাকে ধমকাবে কেন? ও কে হয় আমার? নিজের বউয়ের সাথে যত হাসাহাসি আর আমাকে ধমকানো না? আমি কি ওর রাগ মিটানোর যন্ত্র? এখন আর সেসব চলবে না বলে দিবি ওকে।”
“বউ? কার বউ? কে বউয়ের সাথে কথা বলছে?”
“তোর রাফিন ভাইয়া। আর কে?”
“ওহ আল্লাহ! কি বলছো এসব? রাফিন ভাইয়ার বউ মানে?”
“আমি কি জানি!”
“অকে, যা জানো তা নিয়েই চুপ করে থাকো। আর রাগারাগি করো না। তোমার ইমেজ খারাপ হচ্ছে সবার কাছে। আমি চেষ্টা করবো কালই ফেরার ব্যবস্থা করার।”

নদী থেকে ফেরার পর থেকে না চাইতেও বারবার মনে রাফিনের ভাবনা চলে আসছে৷ রাগ, অভিমান, কষ্ট, দুঃখ কত ভাবনা যে আমার মনে আসছে। রাতে শুয়ে ভাবতে ভাবতে মনে হলো, ওর কথায় আমি যেমন আঘাত পেয়েছি, কষ্ট হয়েছে তেমনই আমার কথায়ও হয়তো ও কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু আমি তো স্যরি বলেছি, ও তো আবার রাগ দেখালো। হুট করে মনে হলো, রাফিনের এই ব্যবহারের পেছনেও হয়তো কোনো আড়াল গল্প আছে। ও কি সেটা কোনো ডায়েরিতে লিখে রাখছে? ডায়েরিটা কোথায়? সেটা কি ওর কাছেই আছে? এখন তো আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। ও কি এখন আর আমায় নিয়ে ডায়েরি লিখবে? কখনোই না। এই গল্পের আড়াল গল্পও হয়তো নেই। এখন আমি ওর কেউ না। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ওর ভাবনা বাদ দেওয়ার চেষ্টা করলাম।

আমি আবার তওবার নামাজ পড়ে কাঁদলাম। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে কেন যেন। আমার কষ্ট লাঘব করার জন্য একজনই আছেন, আমার রব। সারারাত রবের সাথে কথা বলে মনকে শান্ত করলাম। শেষরাতের দিকে ঘুমিয়ে পড়লাম। স্বপ্নও দেখলাম একটা রাফিনকে নিয়ে।

#Be_continued_In_Sha_Allah ❣️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here