অগত্যা_তুলকালাম,পর্ব ৪৪,৪৫

#অগত্যা_তুলকালাম,পর্ব ৪৪,৪৫
নাফীছাহ ইফফাত
পর্ব ৪৪

অন্ধকার ঘরে বসে আছি। মা এসে বাতি জ্বালালেন৷ চেহারায় একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললেন,
“সারাদিন অন্ধকারে কি করিস তুই?”
“কবর তো অন্ধকার হবে। তাই প্র্যাকটিস করছি।”
“ফাজলামি করিস না।”
“আচ্ছা। তুমি কি বলতে এসেছো বলে ফেলো?”
“বলতে এসেছি মানে হলো, বাইরে একটু ঘুরে-টুরে দেখতে তো পারিস৷ এভাবে বন্দী হয়ে থাকবি জানলে তোকে আনতাম না।”
“আমি তো এমনই, না জানার কি ছিল। তাছাড়া আমি তো আসতেই চাইনি তাও এনেছো। তোমায় কিছু কঠিন কথা শোনাই মা৷ আমাদের ধর্মের কিছু মানুষ প্রচন্ড রকমের স্বার্থলোভী, স্বার্থপর। এরা নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ধর্মকে তার নিজের মতো সাজিয়ে নেয়। যেমন– তুমি বলছো আমাকে ঘুরতে যেতে। আমি বললাম, গায়রে মাহরামের সামনে যাওয়া ইসলামে হারাম। তুমি বললে, ঘোরাঘুরি করতে তো নিষেধ করেনি ইসলাম। তাই বলে কি ইসলাম বলেছিলো, গায়রে মাহরামের সাথে ঘুরতে? বলো, বলেছিলো?”
বলতে বলতে আমার চোখ জ্বালা শুরু হয়ে লাল হয়ে এলো। মা আমার চোখের দিকে তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিলেন।

“তোমরা এখানে আসতে বাধ্য করেছো আমায়। আমি আসতে চাইনি। কেন আসতে চাইনি জানো? আমি জানতাম যে, এখানে আসলেই ফেৎনার জালে আটকা পড়বো৷ তোমার ধারণা, আমি সমাজের সবার সাথে মিলে চলতে জানি না। আসলে আমি মিলতে চাইও না। যে সমাজ ইসলাম মানে না সে সমাজের সাথে আমি মিলতে চাইও না৷ খালু আর খালুর ভাই তো তোমারও নন-মাহরাম। ওদের সামনে যাও কেন তুমি? বাবা বারণ করেছে একবারও? না তুমি ইসলামের বিধান মেনেছো, আর না মেনেছে বাবা। বাবা তোমায় বারণ করেনি, তিনি দাইয়্যুসের অন্তর্ভুক্ত হবেন। দাইয়্যুস কারা জানো?”

“আমি তোর খালুর ভাইয়ের সাথে কথা বলি না। একঘরে থাকলে তো একটু-আধটু দেখা হবেই।”
“আমাকে দেখেছে একবারও? হ্যাঁ, দু’একবার দেখেছে তাও তোমাদের দু’বোনের বাড়াবাড়িতে। তোমরা দু’বোন সবার সামনে যেতে বাধ্য করেছো আমায়।”
“তোর মতো ঘরকুণো হয়ে আমরা চলতে পারি না।”
“এজন্যই তো বাবা দাইয়্যুসের অন্তর্ভুক্ত হবেন। আর তোমার জবাব তো তুমিই দিবে আল্লাহর কাছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “তিন প্রকার মানুষের দিকে মহান আল্লাহ তা’আলা পুনুরুত্থান দিবসের দিন রহমতের দৃষ্টি দিবেন না। যে মাতা-পিতার অবাধ্য, যেই নারী তাঁর সাজ-সজ্জায় পুরুষের অনুকরণ করে এবং আদ-দাইয়ুস। [১]
আবার অন্যত্র প্রিয় হাবীব সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তিন ব্যক্তির জন্য মহান আল্লাহ তা’আলা জান্নাত হারাম করেছেন, যে মদ তৈরী করে, যে মাতা-পিতার নাফরমানী করে এবং ঐ চরিত্রহীন ব্যক্তি (আদ-দাইয়ুস) যে নিজ স্ত্রীকে অশ্লীলতা ও ব্যভিচার করতে সুযোগ দেয়।” [২]

“আমি অশ্লীলতা, ব্যভিচার করছি? আর তের বাবা আমাকে সাহায্য করছে? এতবড় কথাগুলো তুই বলতে পারলি? তুই বাবা-মায়ের অবাধ্য, বেয়াদব সন্তান। তুই জীবনে জান্নাতে যাবি না। বেয়াদব কোথাকার!”

মা আমার গালে এমন থাপ্পড় দিলেন যে আমি কিছুক্ষণ কানেই শুনতে পেলাম না৷ মিনিট কয়েকের জন্য গাল পুরো অবশ হয়ে গেল৷ গর্জাতে গর্জাতে মা চলে গেলেন৷ যতটা না শরীরে আঘাত লেগেছে তারচেয়ে বেশি আঘাত লেগেছে মনে, মায়ের কথায়। মা আমাকে রীতিমতো বদদোয়া করে গেলেন। আমার কানে বারবার প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো মায়ের বলা কথাটা, “তুই জীবনে জান্নাতে যাবি না।” আমার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। যদি জান্নাতেই না যেতে পারি তাহলে এই জীবনের মানে কি? বেঁচে থাকারই বা কি মানে? ব্যর্থ জীবন। বাবা-মায়ের দোয়া সর্বাবস্থায় ফলে যায়। এখন আমার কি হবে?

আমি দৌড়ে মায়ের কাছে গেলাম। মা তখনও রাগে রি রি করে কাঁপছেন। আমি মায়ের পায়ের কাছ বসে বললাম,
“মা, তুমি আমাকে ভুল বুঝছো। আমি একদমই তোমাকে সেসব বলিনি। আমি শুধু বোঝাতে চেয়েছি। ও মা!”

মা অন্যদিকে ফিরে গেলেন। বাবা খাটে শুয়েছিলেন। সেখান থেকে উঠে এসে আমাকে তুলে দাঁড় করালেন।
“কি হয়েছে মা?”
“বাবা, আমি মাকে শুধু বোঝাতে চেয়েছি যে গায়রে মাহরামদের সামনে যাওয়ার শাস্তি কতটা ভয়াবহ। মা আমাকে ভুল বুঝে অভিশাপ দিয়ে দিলেন।”
বাবা ক্রোধান্বিত হয়ে মায়ের দিকে তাকালেন।
“কি অভিশাপ দিয়েছো তুমি?”
“বাবা, আমি মায়ের নামে বিচার দিতে আসিনি। আমি শুধু বলতে এসেছি, মা যেন অভিশাপটা তুলে নেয়। নাহয় আমার দুই জীবনই ব্যর্থ হয়ে যাবে। মা বলেছে, আমি কখনো জান্নাতে যাবো না।”

মায়ের রাগ গলে গেল। আচমকা আমার সামনে এসে মাথায় হাত রেখে বললেন,
“ওসব তো রাগের কথা। রাগের কথা ফলে না।”
“রাগের কথাই সবচেয়ে বেশি ফলে মা। বাবা-মা রেগে বা খুশি হয়ে যা-ই বলুক না কেন সবই কবুল হয়ে যায়।”
“আচ্ছা আমি দোয়া করে দিলাম, তুই যেন সপরিবারে জান্নাতুল ফেরদৌসের উচ্চ মাকামে স্থান পাস।”

“এই দোয়াটা তুমি দোয়া কবুলের মুহুর্তে করবে আমার জন্য।”
“মা-বাবার দোয়া তো প্রতিমুহুর্তেই কবুল হয়।”
“তাও। যেমন; ধরো, বৃষ্টি পড়ার মুহুর্তে, তাহাজ্জুদের নামাজে, সিজদাহয়, আযান ও ইকামতের মাঝামাঝি সময়ে। এই সময়গুলোয় বেশি দোয়া করবে। এসময়ে করা দোয়াগুলো ফেরানো হয় না। সরাসরি আরশে আযীমে গিয়ে লাগে। তাছাড়া দু’হাত তুলে দোয়া করলে আল্লাহ তায়া’লা সেই হাত খালি ফিরিয়ে দিতে লজ্জাবোধ করেন।”
“আচ্ছা দোয়া করে দিবো ভালোমতো। যা এখন।”

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে চলে এলাম রুমে। এই রুমটায় এলে আমার অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করে, হয়তো জানালাগুলোর জন্য৷ আমার বাসার রুমে মাত্র একটা জানালা। সেই জানালা দিয়ে রাস্তা দেখা যায় শুধু। অথচ এখানকার তিন জানালা দিয়ে তিনরকম প্রকৃতি উপভোগ করা যায়। খেয়েদেয়ে আজ তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম।

পরদিন সকালে উঠে নাস্তা করার পর সবাই বেরিয়ে গেল। বাসায় আমি আর কাজের আন্টি। সকাল দশটা নাগাদ চাশতের নামাজ পড়ে রুমে শুয়ে আছি। কানো কলিংবেলের শব্দ বাজছে অনর্গল। আশ্চর্য! কেউ খুলছে না কেন দরজা? আমি রুমের বাইরে গেলাম। কলিংবেলটা ঠিক আমার রুমের সামনে করিডোরের রেলিংয়ের একটু নিচে লাগানো। কলিংবেল বলতে এটা মূলত পুরোনো আমলের কড়া নাড়ার মতো মরচেপড়া লোহার একটা বেল। দরজার বাইরে চাকার মতো লোহার একটা রিং আছে। কেউ ওটা ধরে ঘোরালেই মোটা শেকলে টান পড়ে। আর টান এসে লাগে ঘরের ভেতরে দোতলার উপরে রাখা বিশাল লোহার বেলটাতে। বেলটা তখন বিকট আওয়াজে ক্যাটক্যাট করে।

রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে দেখি বুয়া নেই। আমি নিজেই এগিয়ে গেলাম দরজা খুলতে। বড় হিজাব পরে আছি। হিজাবের সামনের দিকের কিছু অংশ নিয়ে নিকাব করে দরজা খুলে দিলাম। দরজা খুলে দেখলাম একজন পুরুষ হাত ঘড়িতে টাইম দেখছেন ভীষণ বিরক্তি নিয়ে। দরজা খুলতেই তাকালেন আমার দিকে। সেই তাকানোতেই আমার সারা শরীর কাঁপতে লাগলো থরথর করে। সামনের মানুষটাও তখন বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে। তার হাত থেকে ব্যাগ ছুটে গেল আর আমার হাত থেকে পড়ে গেল তালা। বিচ্ছিরি একটা শব্দ হলো। বুয়া হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো। আমি আর একমুহূর্ত না দাঁড়িয়ে ছুটে উপরে উঠতে লাগলাম। জানি, পেছনের মানুষটা তখনও বিস্ময় নিয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। কারণ সে বুয়ার একটা কথারও জবাব দিচ্ছিলো না। আমি রুমে ঢুকে ধড়াম করে দরজা আটকে দিলাম। আল্লাহ তায়া’লা এ কোন পরীক্ষায় ফেললো আমাকে? আমি কিভাবে উত্তীর্ণ হবো এই পরীক্ষায়?

মিনিট বিশেক পর খালামণি এলেন আমার ঘরে। দরজায় করাঘাত করার অনেকক্ষণ পর খুলে দিলাম। আমি বিধ্বস্ত, হতবিহ্বল হয়ে খালামণির দিকে তাকালাম। খালামণি বললেন,
“হৃদি, তুই নাকি দরজা খুলেছিস? আহ! কতদিন ধরে অপেক্ষায় ছিলাম ছেলেটার। আজ এত বছর পর এলো। আমি নিজে দরজা খুলে তাকে রিসিভ করতে পারলাম না। স্টেশনে একটু আনতেও যেতে পারলাম না। যাক, আমি খুশি হয়েছি দরজাটা তুই খুলেছিস।”
আমি কিছু বললাম না।
“আচ্ছা শোন না, এই রুমটা না ছেলেটার। ও অনেক বছর আসে না তাই তোকে এখানে থাকতে বলেছিলাম। ও আসবে জানলে কত গোছগাছ করে রাখতাম। ও আগেও অনেকবার আসবে বলে আসেনি। ভেবেছিলাম এবারও আসবে না। কিন্তু আমাদেরকে চমকে আমার বাপটা চলে এলো। তুই কি কষ্ট করে অন্য ঘরে চলে যাবি?” খালামণির চোখেমুখে আনন্দ।
“আমি পারবো না খালামণি। আমি তোমাদের বাড়িতে মেহমান হয়ে এসেছি। তোমরা এখানে থাকতে দিয়েছো আমি এখানেই থাকবো। কারো জন্য আমি একচুল পরিমাণও নড়তে পারবো না।”

কিন্তু নাহ! কথাটা মনে মনে বলেছি। মুখে বললাম,
“আচ্ছা আমি গোছগাছ করে বেরিয়ে যাচ্ছি।”

[১] [সুনানে আন-নাসা’ঈঃ অধ্যায় ২৩, হাদীস ২৫৬৩]
[২] [মুসনাদে আহমাদঃ হাদীস ৫৮৩৯। সহীহুল জামে’ আস সাগীরঃ হাদীস ৩০৪৭]

#Be_Continued_In_Sha_Allah 🥀

#অগত্যা_তুলকালাম
নাফীছাহ ইফফাত

পর্ব ৪৫

জিনিসপত্র গোছাতে গিয়ে ডায়েরিটায় চোখ পড়লো। ওটা ব্যাগে ঢুকাতে গিয়ে কি ভেবে যেন খুললাম। খুলতেই প্রথম চোখে পড়লো একটা কবিতা।

“তার ডাকের অপেক্ষায়
অলিন্দে চোখ রাখা বন্ধ করেছি,
বন্ধ করেছি স্মৃতির আরশিতে দেখা
প্রেয়সীর মলিন মুখ।

তবুও সন্ধ্যা নামার কালে কিংবা
আচমকা মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে
মনে হয়; কেউ একজন—
প্রিয় নামে আমাকেই ডাকুক।” [১]

আমারও তো তা-ই মনে হয়। আদৌ কি যার মুখে ‘প্রিয়’ ডাক শুনতে চেয়েছিলাম তার মুখে ডাক শোনা হবে? নাহ! আল্লাহ যার মুখে প্রিয় ডাক শোনাতে চান তার মুখেই যেন শুনতে পারি। হে পরওয়ারদিগার! তোমার ইচ্ছে যেন সফল হয়, আমার ভুল ইচ্ছেকে তুমি কবুল করো না। তুমি তো সঠিকটা জানো। আমি যা জানি না তা তুমি জানো। তোমার দৃষ্টিতে যা সঠিক, যা কল্যাণকর তুমি তা-ই রেখো আমার জীবনে। আমার অকল্যাণ, ভুল ইচ্ছে তুমি পূরণ করো না প্রভু। বুক ফুঁড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। রুমের বাইরে আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ডায়েরি বন্ধ করে ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেললাম। সাথে সাথে রুমের দরজা খুলে গেল এবং আমাদের আবার চোখাচোখি হয়ে গেল। আমাকে দেখেই ‘স্যরি, স্যরি‘ বলে সে দরজা আটকে দিলো। আমি থমকে দাঁড়িয়ে রইলাম। সাথে সাথেই দরজার ওপাশে খালামণির আওয়াজ পেলাম। খালামণি বললেন,
“বাবা! তুই একটু দাঁড়া। ও এক্ষুনি গোছগাছ করে অন্যরুমে শিফট করে যাবে।”
“ইট’স ওকে মা। কাউকে শিফট করতে হবে না৷ অনেক রুম তো আছে। আমি নাহয় অন্য একটা পছন্দমতো রুম বেছে নিবো”
“এতবছর পর এলি নিজের রুমে থাকবি না?”

আমি খানিকটা শিউরে উঠলাম। বেছে নেছে ওর রুমেই থাকছি আমি? বাই দ্যা ওয়ে, ও খালামণিকে মা ডাকলো কেন?
সে বললো, “নো মা, এবার অন্য রুমে থেকে দেখি। প্রয়োজন হলে শিফট করবো।”
বলেই হাঁটা শুরু করলো, বুটের আওয়াজ পাচ্ছি।

খালামণি এসে বললেন, “থাক হৃদি, তোর আর শিফট করতে হবে না। ছেলেটা নিজেই অন্য রুমে চলে গেল।”
“খালামণি, আপনি বারবার ছেলেটা, ছেলেটা বলছেন কেন? কে হয় উনি আপনার?”
“ভাইজানের ছেলে, ফাইয়াজ। তবে আমারও ছেলে। ছোটবেলায় দুধ খাইয়েছি আমি। আমি ওর দুধ মা। বড্ড আদুরে ছেলেটা। নাম ধরে ডাকতে ইচ্ছে করে না।”

আমার খালামণি রাফিনের দুধ মা? বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে উঠতে উঠতে বোধহয় আর জায়গা নেই। আর কত অবাক হতে হবে আমায়? আল্লাহর কি সুন্দর নিয়ম! কে কোথাকার বাসিন্দা আমরা আর দেখা হলো কিনা কোথা থেকে কোথায় গিয়ে, কাশবনে আমাদের শহরে। কতদিনের সম্পর্ক ছিল আমাদের অথচ আমরা যে এত লতানো প্যাঁচানো আত্মীয় জানতামই না। আজ আবার আমরা এক জায়গায়, এক ছাদের নিচে। অথচ এমনটা কখনোই হওয়ার কথা ছিলো না। যদি আমাদের সম্পর্কটা টিকে যেত হয়তো আমাদের সম্পর্কের কথা জানার পর কেউই কখনো মেনে নিতো না। আর আমারও এখানে আসা হতো না। মাঝখান থেকে খালামণির সাথে সম্পর্কটা খারাপ হয়ে যেত আমাদের। আল্লাহর প্ল্যান বোঝা আমাদের পক্ষে কখনোই সম্ভব না। তিনি এমন কিছুই করেন যাতে আমাদের জন্য কল্যাণ নিহিত রয়েছে।

অস্ফুট স্বরে খালামণির কথার জবাব দিলাম,
“ওহ আচ্ছা।”
“আচ্ছা, খেতে আয়।”
“নাকীব এসেছে?”
“দেখলাম না তো। তাের মা’রাও তো এলো না। আমি আর ভাইজান চলে আসলাম শুধু। আমি গিয়েছিলাম একটু পাশের পাড়ায়। পুকুরে মাছ উঠেছিলো অনেক। ফাইয়াজের জন্য আনতে গিয়েছিলাম। পথে ভাইজানের সাথে দেখা হয়ে গেল। ভাইজান গিয়েছিলো বাজারে। তারপর দুজনে চলে এলাম।” খালামণির চোখমুখ বেয়ে খুশি উপচে পড়ছে।

“হৃদি, তুই যাবি একটু আমার সাথে? রান্নায় একটু সাহায্য করলি। আমি একা ছেলেটার জন্য রান্না করে সামলাতে পারবো না। আবেগে কান্না ধরে রাখতে পারছি না রে। আমার ঘরের ছেলেটা কতদিন বাদে ঘরে ফিরলো। তুই রান্নাঘরে যা, আমি দেখি ছেলেটা কোথায় গেল।” বলতে বলতে খালামণির চোখে আনন্দাশ্রু টলমল করতে লাগলো।
“আচ্ছা আপনি যান, আমি আসছি।’’
“বাবা গো! কোথায় তুই?” চোখের কোণ মুছতে মুছতে চলে গেলেন খালামণি।

দুপুরে নাকীব দৌড়ে আসে আমার রুমে। নামাজে ছিলাম। দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে প্রায় ভেঙ্গে ফেলার যোগাড়। দরজা খুলতেই হুমড়ি খেয়ে ঢুকলো। হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
“আপু, রাফিন ভাইয়া এসেছে দেখেছো?”
“রাফিন? ও এখানে কোত্থেকে আসবে?” স্বাভাবিক কন্ঠে বললাম।
“তুমিই না দরজা খুললে?” বিস্ফোরিত স্বরে বলে নাকীব।
“জানিস যখন এত হড়বড় করছিস কেন?”
“বাট উনি কিভাবে এখানে জানো?”
“জানি না। আমার অতো জানতে ইচ্ছে করে না।”
“আপু, উনি তানভীর ভাইয়ার কাজিন। ভাবতে পারো?”
“বললাম তো ভাবতে ইচ্ছে করে না। তুই কি এখন ওর গুণগান গাইতে এসেছিস এখানে?”
“নাহ! আমি একটু ঘুমাই।” বলে নাকীব শুয়ে পড়লো।

আমি নামাজ শেষ করলাম। কুরআন পড়লাম। তারপর জানালার কাছে এসে দাঁড়ালাম। প্লেনের আওয়াজ আসছে। কোনদিক থেকে আসছে ঠাহর করতে পারলাম না। এদিক-ওদিক উঁকি দিয়ে দেখতে পেলাম বিমানটা।
“নাকীব, নাকীব তাড়াতাড়ি এদিকে আয়। তাড়াতাড়ি, চলে গেল তো…”

নাকীব ধড়ফড় করে উঠে এলো। আমি প্লেন দেখিয়ে অজান্তেই লাফাতে লাগলাম, “ঐ দেখ, ঐ দেখ।”
নাকীব ফিক করে হেসে বললো, “দেখেছি তো। একদম নিচে ছিল।”
“হু, কি সুন্দর!”
“চলো সবাই লাঞ্চ করে ফেলছে বোধহয়।”

আমরা দুজনে রুমের বাইরে এলাম। করিডোর থেকেই ডাইনিং স্পেস দেখা যায়। নিচে ছেলেরা সবাই লাঞ্চ করছে। আমি ও নাকীব উপরে রেলিংয়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি সবার খাওয়া। নাকীবকে বললাম,
“আমি যা দেখছি তুইও কি তাই দেখছিস?”
“হুম।”
“ভাগ্যের খেল দেখলি?”
“সবই তাকদীরের লিখন আপু। আল্লাহ যা লিখে রেখেছেন তাই হচ্ছে।”
“হু।”

রাফিন খেতে খেতে হুট করে উপরে তাকালো। আমি সাথে সাথে ঘুরে দাঁড়ালাম। নাকীবকে ইশারায় ডাকলো খেতে যেতে। নাকীব স্মিত হেসে হাত নেড়ে বোঝালো, আসছি।
“আপু, সবাই খেয়ে নিচ্ছে। আমি যাই।”
“আচ্ছা।”

ছেলেদের খাওয়া হলে আমরা খেতে বসলাম। খেতে বসে মূলত সবাই রাফিনের গুণগানই গাইলো শুধু। আমিই চুপচাপ খেয়ে উঠে পড়লাম। খাওয়া শেষে মা রান্নাঘরে ডাকলেন ফ্রুটস কেটে দিতে। কাটার পর নাকীব এসে নিয়ে গেল সেগুলো। নাকীব যাওয়ার পর আমিও হাত ধুয়ে বের হয়ে আসি রান্নাঘর থেকে।

রাফিন সোফায় বসেছিলো বাবার সাথে। রান্নাঘর থেকে বেরুতেই অনিচ্ছায় চোখাচোখি হয়ে গেল। ওকে দেখামাত্র বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠলো। সাথে সাথে দৃষ্টি ফিরিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। আমাকে রান্নাঘর থেকে বেরুতে দেখে বাবা বললেন,
“হৃদি, আমার পাঞ্জাবিটা একটু আইরন করিয়ে দে না।”
“আচ্ছা বাবা, দিও আমাকে।”

বাবার দিকে না ঘুরেই বলে চলে আসছিলাম। বাবা রাফিনকে বললেন,
“বুঝলে বাবা, মেয়েটাকে ছোটবেলায় আইরন করা শিখিয়েছিলাম। সেই থেকে ও আমার সব পোশাক সবসময় আইরন করে দেয়। আমার নিজের আইরনও আর ভালো লাগে না।”
“এবার আমি করে দিবো আঙ্কেল? সামথিং নিউ…” রাফিন হাসলো৷
বাবা সাথে সাথেই আমাকে পিছু ডাকলেন। আমি না ফিরেই বললাম, “বলো বাবা।”
“পাঞ্জাবীটা নাকীবকে দিয়ে পাঠিয়ে দিস৷ ফাইয়াজ আইরন করে দিবে।”
“আচ্ছা।”

কথা না বাড়িয়ে রুমে চলে এলাম। রুমে এসে পুরোনো স্মৃতি মনে পড়লো৷ একবার রাফিন আমার সাথে কথা বলতে বলতে ইস্ত্রি করছিলো। তখন ও বলেছিলো, ওর ইস্ত্রি করার হাত এত ভালো যে বাসার সবাই ওকে ইস্ত্রি করাতে দেয়। তখন আমিও বলেছিলাম, “আমারও ইস্ত্রি করার হাত খুব ভালো। বাবা ছোটবেলায় শিখিয়েছিলেন সেই কৌশল। তারপর থেকে আমিই ইস্ত্রি করি। তোমার বাসায় গেলে তখন তুমি সবারগুলো করবে আর আমি শুধু তোমারটা করবো।”
ও বলেছিলো, “বাট আমার তো অন্যের হাতের আইরন করা পছন্দ না।”
“তাহলে করবো না।” অভিমানী কন্ঠে বলেছিলাম। রাফিনও বলেছিলো, “করো না।”
খুব রাগ হয়েছিল সেদিন। রাফিনেরও হয়তো এখন সেই ঘটনাটা মনে পড়ছে। হয়তো পড়ছে না!

ইস্ত্রি করা শেষে পাঞ্জাবি রাখতে নাকীব এলো আমার ঘরে। আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম,
“বাবার পাঞ্জাবি আমার ঘরে আনলি কেন?”

পাঞ্জাবিটা খাটে বিছিয়ে রেখে সে আবার শুরু করলো তার দুষ্টামি। বললো, “এটা তোমার ঘর নাকি? বাহ! জানতাম না তো।”
“তো কার ঘর? এসে থেকে তো এখানেই থাকছি।”
“কারো ঘরে তুমি থাকলেই ঘরটা তোমার হয়ে যাবে? তুমি রাফিন ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড থাকা অবস্থায় যদি তার জীবনে অন্য একটা মেয়ে আসতো তাহলে কি সে তার গার্লফ্রেন্ড হয়ে যেত?”

দাঁতে দাঁত লাগিয়ে কিড়মিড় করে তাকালাম ওর দিকে।
“তুই আমার অতীতের পাপের একটা অধ্যায় জানিস তাই বলে সেটা নিয়ে এখনও আমাকে খুঁচিয়ে যাবি?”
”না মানে তোমার তো আজকাল ভাইয়ার প্রতি কোনো ফিলিংস নেই। খোঁচালেও বা কি? তুমি তো ঐ ডায়েরি নিয়েই আছো। অন্যের ঘর, অন্যের ডায়েরি।”
“যার ঘর তার ডায়েরি।” অন্যদিকে তাকিয়ে বললাম।
“ওহ ইউ মিন, ডায়েরিটা তোমার? বাট এই ঘরটা কিন্তু রাফিন ভাইয়ার।”
“তো আমি কি করবো? বের হ তুই আমার সামনে থেকে।”
নাকীবকে ঠেলে রুম থেকে বের করে দিলাম। বের হতে হতে ও বললো,
”রাফিন ভাইয়াও তোমার মতো ইস্ত্রি করতে পারে ভালো। তুমি ওর স্ত্রী হয়ে গেলে ভালো হবে।”
নিচে একটা খালি বোতল পরে থাকতে দেখে সেটা উঠিয়ে নাকীবের দিকে ছুঁড়ে মারলাম।
“ফাযিল কোথাকার! অসভ্য, ইতর। আর আসিস তুই।”
“জেলাসি গার্ল! লুক বিহাইন্ড।”

নাকীব ধুপধাপ আওয়াজ করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে চলে গেল। পেছনে তাকিয়ে দেখি রাফিন আসছে। আমি ঝট করে রুমে ডুকে দরজা লাগিয়ে দিলাম। উহ! শব্দটা বেশ জোরেই হলো।

#Be_Continued_In_Sha_Allah 🥀

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here