অগত্যা_তুলকালাম,পর্ব ১৯,২০

#অগত্যা_তুলকালাম,পর্ব ১৯,২০
নাফীছাহ ইফফাত
পর্ব ১৯

ভালো করে বোরকা-নিক্বাব করে সকাল সকাল আমি ঠিকই কাশবনে গেলাম। রাফিন শুয়ে আছে ঘাসের ওপর। হাতে মোবাইল নেই, তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। আকাশে মেঘ জমেছে। বৃষ্টি নামবে হয়তো।

আমি ওর পাশে বসতে বসতে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললাম,
“আজকাল আকাশটা সময়ে অসময়ে অভিমানী হয়ে ওঠে। যখন তখন ঢেকে যায় অভিমানের কালো মেঘের আড়ালে। আর হুটহাট ঝরে পড়ে বৃষ্টি। ঠিক আমার মনের মতো অবস্থা।”

আমার উপস্থিতি টের পেয়ে উঠে বসলো রাফিন। হাতের ধুলো ঝাঁড়তে ঝাঁড়তে আমার দিকে তাকালো। আমি তখনো আকাশপানে চেয়ে আছি। দৃষ্টি আকাশে নিবদ্ধ রেখেই বললাম,
“আচ্ছা আকাশ, তােমারও কি কষ্ট দেওয়ার মানুষ আছে? মানুষ না হোক প্রিয়জন হলেই হয়৷ কে তোমার প্রিয়জন, এত কাঁদায়? কিসের এত অভিমান? হারিয়ে যাচ্ছে বুঝি কেউ?”

রাফিন শীতল কণ্ঠে বললো, “আকাশের না, রাফিনের কেউ হারিয়ে যাচ্ছে।”

এতক্ষণে রাফিনের দিকে তাকালাম আমি। ওর চোখে চোখ পড়তেই আমার দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল। রক্তবর্ণ রাগী চোখজোড়ার ভাষা কখনো বুঝতে পারিনি আমি। অথচ রাফিন কি অনয়াসে আমার চোখের ভাষা পড়ে নিতে পারে। তবে আজ আমি রাফিনের চোখের ভাষা বুঝেছি। ওর চোখ আজও লাল তবে রাগে নয়, অভিমানে। চোখগুলো কেমন ভেজা ভেজা। কেঁদেছে নাকি রাতে? আজব! কাঁদলো কেন? আমার জন্য? অসম্ভব!

রাফিনের হয়তো খুব মন খারাপ। ও দিশেহারা হয়ে কিছুক্ষণ পায়চারী করলো। আমি গিয়ে জানতে চাইলাম,
“কিছু হয়েছে?”

ও অন্যদিনের মতো রেগে না গিয়ে হঠাৎ আমার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে। ভেজা চোখজোড়া নিচের দিকে আড়াল করে রাখে যাতে আমি না দেখি। আমি হতভম্ব। রাতারাতি কি এমন হয়েছে ওর? রাতেও তো ধমকাচ্ছিলো।

আমার মনে ভয় জমতে শুরু করেছে। আমি রাফিনের সামনে ওর মতো করে বসে বললাম,
‘কি হয়েছে তোমার?’
‘আরোহী!’ ভেজা চোখে তাকায় ও।

ওর দৃষ্টি তো আমাকে পুড়িয়ে মারছে। ওর এমন কান্নাভেজা দৃষ্টি এর আগে কোনোদিন দেখিনি। ওর চাহনিতে তো আমারই চোখে পানি চলে আসছে। রাফিন হঠৎ আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরে কেঁদে ফেলে। আমি স্পষ্ট দেখলাম ওর চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। কাঁদতে কাঁদতেই বলে,
‘আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না আরোহী। সবকিছু বিষন্ন লাগছে। তুমি বলোনা তোমার মন খারাপ হলে তুমি কি করো? আমার এত কষ্ট হচ্ছে কেন?’

আমিও ভেজা গলায় বললাম, “কেন কষ্ট হচ্ছে সেটা তো বলো।”
রাফিন মোলায়েম কন্ঠে বললো,
“তোমাকে ঐ মুহুর্তে ওখানে দেখে আমার নিঃশ্বাস কয়েক সেকেন্ডের জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, ট্রাস্ট মি! ভাগ্যিস বিয়েটা ভেঙে গেছে।”

উফ! এই ব্যাপার? হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। মনে মনে বললাম, “এখন কেমন লাগে? এমনি বললে তো শোনো না।”

আমি মুচকি হেসে বললাম, ”চোখ মুছে শান্ত হয়ে বসো। তোমাকে এভাবে মানাচ্ছে না৷ রুক্ষ রূপ ধারণ করলে ভালো দেখায়৷”

রাফিন চট করে ঘাসে বসে পড়লো। চোখ মুছে স্বাভাবিক হওয়া চেষ্টা করে আমার দিকে তাকালো। ওকে আজকে একদম বাচ্চা বাচ্চা লাগছে ৷ হাওয়ায় উড়ন্ত গতিতে ওর দূরন্ত চুলগুলো উড়ে বেড়াচ্ছে। দু’হাতে চোখের পানি মুছছে। ঠিক যেন অভিমানী বাচ্চা ছেলে। বাচ্চাদের কাছ থেকে বেলুন কেড়ে নিয়ে আবার ফিরিয়ে দিলে যেভাবে কান্না বন্ধ করে চোখ মুছে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে রাফিনও এখন তেমনটাই করছে। এতে চেহারাটা আরও মায়াবী দেখাচ্ছে।

আমি বললাম,
‘আমার মন খারাপ হলে কি করি জানো?’

রাফিন প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাতেই আমি মাটি থেকে একমুঠো ধুলো হাতে নিয়ে রাফিনের হাতে দিলাম। তারপর হাতটা মুষ্টিবদ্ধ করে দিয়ে বললাম,
“এবার মুঠিটাকে ধীরে ধীরে শক্ত করতে থাকো।”

রাফিন কিছু না বুঝেই ওর হাতের মুঠি শক্ত করতে থাকে আর হাত থেকে ধুলোগুলো ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসতে থাকে। সব ধুলো বেরিয়ে আসার পর রাফিনের হাত ঝেড়ে দিতে দিতে বললাম,
“এই যে মুঠোর ভেতর ধুলো ছিল এগুলো হলো আমাদের মন খারাপ, রাগ যা-ই বলো না কেন। আমরা মন খারাপটাকে যত প্রশ্রয় দিবো সে তত আমাদের মনে জেঁকে বসবে। মুঠো চাপতেই যেমন ধুলোগুলো বেরিয়ে মুঠোটা ফাঁকা হয়ে গেল ঠিক তেমনি মনকে শক্ত করে চারপাশটা উপলব্ধি করলে, মন খারাপটাকে পাত্তা না দিলে দেখবে মন খারাপটাও হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।”

ততক্ষনে রাফিনের চোখের জল, মন খারাপ সব উধাও হয়ে গেছে। ও মুগ্ধ হয়ে দেখছে আমাকে। মনে মনে যেন ভাবছে, মেয়েটাকে কখনো ভালোভাবে খেয়ালই করা হয়নি। সারাক্ষণ কষ্ট দিয়ে কথা বলা, সারাক্ষণ ধমকের ওপরই রাখা। এমন কোনো দিন নেই যেদিন রাফিন ওকে ধমকায়নি। অথচ মেয়েটা ওকে পাগলের মতো ভালোবাসে। এত এত ধমকানোর পরও কখনো ওর সাথে উচ্চস্বরে একটাও কথা বলেনি।

রাফিন গালে হাত ঠেকিয়ে আমরা দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলে,
‘তুমি কোথায় শিখলে এত সুন্দর মন ভালো করার টেকনিক?’

আমি রহস্যময় হাসি দিয়ে চুপ করে থাকলাম। রাফিন বললো,
‘হাসলে চলবে না, বলো কোথায় শিখলে?’
‘শিখতে হবে কেন? আমি নিজে কি কিছুই পারি না?’
‘এটা তোমার বানানো টেকনিক?’
‘হুম।’
‘কিভাবে মাথায় আসলো বলতো?’
‘সত্যি বলবো না মিথ্যে?’

‘এই একদম…’ রেগে উঠতে গিয়েও রাগলো না রাফিন। মুহুর্তেই শান্ত হয়ে বললো,
‘সত্যিটাই বলো।’

‘আমার তো প্রায়ই মন খারাপ থাকে। প্রায়ই না বলতে গেলে প্রতিদিন দু’চারবার করে মন খারাপ হয়। ওরকম মন খারাপের…’
কথা শেষ করার আগেই রাফিন নাকমুখ কুঁচকে বললো,
“এত ঘন ঘন মন খারাপ হয় কেন?”

রাফিনের চোখের দিকে এক পলক তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলাম। মৃদু কন্ঠে বললাম,
‘এমনিই।’
‘আমি খুব ধমকাই না তোমায়?’
‘সমস্যা নেই, আমার অভ্যাস হয়ে গেছে।’

অত্যন্ত মোলায়েম কন্ঠে রাফিন বললো,
‘আ’ম স্যরি!’

সেটা এড়িয়ে গিয়ে আমি বললাম,
‘তারপরের কাহিনি আর বলবো না?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ বলো, তারপর?’
‘ওরকম মন খারাপের কোনো একটা দিনে ঐ দূরে মাটিতে বসে কাঁদছিলাম আমি। সেদিন অনেক বকেছিলে আমাকে। অনেক বেশি…’

রাফিন আবার গাঢ় স্বরে বললো, ‘স্যরি তো!’
‘ইট’স অকে। বাদ দাও।’

গলার স্বর পরিষ্কার করে আবার বলতে লাগলাম,
‘মাটিতে বসে কাঁদছিলাম। তখন মনে হচ্ছিল আমার পুরো দুনিয়া ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে। আমার আঁকড়ে ধরার মতো কিছু নেই। আমি কোনোরকমে মাটিগুলো আঁকড়ে ধরতে চাইছিলাম। ঐ আঁকড়ে ধরতে গিয়ে হঠাৎ খেয়াল করলাম মাটিগুলো আমার হাতে থাকছে না। হাত ফসকে বেরিয়ে যাচ্ছে। তখন কান্না-টান্না ভুলে আমি মাটি নিয়ে মেতে থাকলাম। বিকেল গড়িয়ে কবে যে সন্ধ্যা নামলো টেরই পাইনি। খেলেই চলেছি ঐ খেলা। তারপর নাকীব আমাকে খুঁজতে খুঁজতে ওখানে চলে আসে। তখন আমার হুঁশ আসে আমি কোথায়, কি করছি সব মনে পড়ে। ধ্যান ভেঙ্গে খেয়াল করলাম আমার মন খারাপ পুরোপুরি উধাও হয়ে গেছে৷ এরপর থেকে মন খারাপ হলেই এটা করি।’

‘মন খারাপ উধাও হয়ে যায় তোমার?’
‘যায় তবে পুরোপুরি না। ভেতরে ভেতরে তো অনেককিছুই জমে থাকে।’
‘কি জমে থাকে?’
‘অভিমান।’

অল্প সময় নিয়ে রাফিন বললো,
“অভিমান কিভাবে দূর করো?”
আমি হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর মতো করে বললাম,
“হাহ! ওটা তো তুমি কথা বলার সাথে সাথেই উধাও।”

রাফিন মুচকি হাসলো। এরপর বললো,
“আর কি কি করো মন খারাপ হলে?”
“ডায়েরীতে মনের কথা লিখে রাখি। দুঃখের সময় সুখের স্মৃতিচারণ করি। তবে সবচেয়ে সঠিক ফর্মূলা আমাকে দিয়েছে ছোটফুফি। কি জানো?”

রাফিন আগ্রহভরে জানতে চাইলো। আমি বললাম,
“একাগ্রচিত্তে আল্লাহর সাথে কথা বলা। নামাজ পড়লেই মন খারাপ সাথে সাথে উধাও হয়ে যায়। ক’দিন ধরে লক্ষ্য করছি আমি।”
“এটা আমি আগে থেকেই জানি।”
“জানলে মানো না কেন?”
“এমনিই। চলো উঠি।”
“আমার সাথে ফিরবে নাকি?”
“একসাথেই যাই নাহয় আজ।”
“চলো।”

আকাশে মেঘ আরও ঘন হয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যেই বৃষ্টি নামবে। হাঁটতে হাঁটতে বেশ কয়েকবার চোখাচোখি হলো আমাদের। দুজনই হাসি বিনিময় করে আবার রাস্তায় চোখ রেখেছি। বাসার কাছাকাছি যখন আসলাম তখন রাফিনের দিকে তাকিয়ে বললাম,
“তোমার ব্যাপারে একটা সত্যি কথা বলবো?”
“বলো।”
“আসলে কথা না ঠিক, কবিতার মতো। দু’লাইনের ছোট্ট কবিতা।”
“বলো শুনি?”
“ভেতরটা তোমার মিষ্টি দিয়ে গড়া,
অথচ বাহিরের রূপটা কি ভীষণ কড়া।”

রাফিন হাসলো একটু। তারপর বললো,
“আজ হাঁটতে অনেক ভালো লেগেছে।”
ওর কথার জবাবে আমি স্মিত হাসলাম। বাসার সামনে চলে এসেছি। এবার বিদায় নেওয়ার পালা। একদিন হয়তো ওর কাছ থেকে চিরবিদায় নিতে হবে। আর কখনো হয়তো দেখাও হবে না, হয়তো দেখা হবে অচেনা কারো হাত ধরে। সেদিন আর কথা বলা হবে না, শুধু দৃষ্টি বিনিময় হবে। সেই সময়ও খুব বেশি দূরে নয়, অতি নিকটে। আমি নিজেকে সেভাবেই তৈরী করছি ভেতরে ভেতরে। বুকভাঙ্গা কষ্ট নিয়ে নিজেকে বোঝাচ্ছি। নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছি নিজের নফসকে। পারবো তো শেষমেশ?

#Be_Continued__In_Sha_Allah ❣️

#অগত্যা_তুলকালাম
নাফীছাহ ইফফাত

পর্ব ২০

অনেকদিন যাবৎ ফ্রেন্ডদের খোঁজ খবর নেয়া হয়নি। এমনকি শাওনের সাথে পর্যন্ত কথা হয়নি আমার। শাওনকে টেক্সট করলাম। ঘন্টাখানেক পর ওর রিপ্লাই এলো। কিছুক্ষণ টেক্সট করে ফোন দিলাম। টেক্সটে ও বলেছে ওর নাকি অনেক কথা বলার আছে৷ এরমধ্যেই নাকি অনেক ঘটনা ঘটে গেছে। তাই ফোন করা।

“হুম বল এবার কি ঘটনা ঘটেছে?” আমি বললাম।
“অনেক ঘটনা৷ আগে মৌকে দিয়ে শুরু করি। মৌ-এর ফ্যামিলি ওর রিলেশনের কথা জেনে গেছে।”
“তো এখন?”
“এখন ওর বাসা থেকে বেরুনো বারণ।”
“কি বলিস? কবে থেকে?”

“এই ধর আমরা যখন লাস্ট মিট করলাম না? তারপর অসুখ-বিসুখ হলো সবার। এর পরপরই একদিন। তুই তো কারো খোঁজ-খবরও নিস না।”

“আমি আছি আমার প্যারায়। অন্যের প্যারা কি সামলাবো?”
“কেন? তোর আবার কি হয়েছে?”
“সে অনেক কথা।” লম্বা করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম।
“তো কাল আমাদের বাড়িতে আয়। তোর কথা সব বললি, আমারগুলোও বললাম।”

“আচ্ছা দেখি।”
“আচ্ছা দেখি বললে হবে না। আসছিস ফাইনাল।”
“অকে।”
“ওহ হ্যাঁ, রিয়াদ তোর সাথে কথা বলতে চায়। ও নাকি তোকে ফোনে পাচ্ছে না। বেশ কয়েকবার ট্রাই করেছে ক’দিন আগে। সুইচড অফ পেয়েছে নাকি!”

“হুম ক’দিন আগে ফোন অফ রেখেছিলাম। বাই দ্যা ওয়ে, ও আমাকে কেন খুঁজছে?”
“তোকে নাকি খুব দরকার। জানি না ভাই, তোরে ক্যান সবার এত দরকার পড়ে? আমাদেরকে নাকি বলাই যাবে না। খালি তোরেই বলবে।”

“কি এমন কথা যে খালি আমাকেই বলবে?”
“জানি না। তুই নাকি ওর ম্যাসেজও সিন করিস না?”
“আমি কারও মেসেজই সিন করি না। অত কথা বলতে আমার ভালো লাগে না।”
“ভাব সব, বুঝিনা যেন!”
“আচ্ছা মারিয়ার কি খবর?”
“সামনের মাসে বিয়ে?”
“হোয়াট?”

“আকাশ থেকে পড়েছিস মনে হচ্ছে? আমাদের মেসেঞ্জার গ্রুপে তো সেই কবেই জানিয়েছে ও।”
“বললামই তো মেসেজ সিন করি না। তো কার সাথে বিয়ে? লাভ না এরেঞ্জ?”
“লাভ বাট এরেঞ্জ!”
“মানে?”
”কাল বাসায় আয়, সব বলবো।”
“আচ্ছা আসবো ইন শা আল্লাহ।”
“বান্ধবী শোন, তুই ভাই রিয়াদের সাথে কথা বল আগে। ছেলে হার্টফেল করবো নয়তো। আর্জেন্ট ফোন লাগা ওকে।”
“আচ্ছা, আচ্ছা।”

ফোন রেখে ভাবছি, রিয়াদের কি এমন দরকার আমার সাথে? বিজনেসের কিছু? কিন্তু সেসব তো তখনই মিটে গিয়েছিল। হার্টফেল করবে কেন আমার জন্য? আজব! কি এমন কথা?

রিয়াদের ইনবক্সে ঢুকলাম প্রথমে। ও কি টেক্সট করেছে দেখা উচিত। 103 আনরিড মেসেজ! ওহ মাই আল্লাহ!

মেসেজ পড়তে থাকলাম। প্রায় মেসেজই একইরকম।
“দোস্ত, মেসেজ সিন কর।”
“আল্লাহর দোহাই লাগে।”
“কি হইছে তোর?”
“কবে থেকে টেক্সট করছি। কই তুই?”
“আমি তোর বাসার নীচে।”

হোয়াট? এটা পড়ে কতক্ষণ তাকিয়েই রইলাম। আমার বাসার নীচে মানে? মেসেজটা প্রায় পনেরো দিন আগের। পরের মেসেজে গেলাম আবার?

“তোর কি হয়েছে বলতো?”
“আমার অনেক দরকার তোকে।”
“তোকে কথাটা না বলতে পারলে আমি শ্বাসরোধ করে মারা যাবো।”
“তোর ফোন বন্ধ কেন? কল ঢোকে না কেন?”
“আমাকে ব্ল্যাকলিস্টে দিয়েছিস?”
“দোস্তওওওওওওওওও!”

ওহ আল্লাহ! ছেলেটা কি পাগল হয়ে গেল? এমন করে কেন? আমি রাফিনের কাছ থেকেই সরে আসতে চাইছি গুনাহের জন্য। আবার এই ছেলে নাকি আমার সাথে কথা না বলতে পারলে শ্বাসরোধ করে মারা যাবে। আল্লাহ! কি একটা অবস্থা? এখন আবার এর সাথে কথা বলো আর গুনাহ কুড়াও। কি যে করি? কথা না বললেও তো মরে যাবে মনে হয়। ধুরর!

পরদিন শাওনের বাসায় যাওয়ার জন্য বের হলাম। মাঝপথে কোঁকড়া চুলের রাফিনের সাথে দেখা। খানিক ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। এরপর ও-ই আগ বাড়িয়ে আমার সামনে এসে বললো,
“কই যাচ্ছো?”
“ফ্রেন্ডের বাসায়।”
”ওহ আচ্ছা।”

আমি ওর আপাদমস্তক তাকিয়ে বললাম,
“তোমার কোঁকড়া চুল পছন্দ?”
“খুবব.. না মানে না৷ পছন্দ না, একেবারেই পছন্দ না।”

আমি বেশ কয়েকবার লক্ষ্য করেছি রাফিনের সাথে এই ছেলেটার বিস্তর ফারাক। রাফিনের সম্পূর্ণ বিপরীত কোঁকড়া চুলের ছেলেটা৷ রাফিনের পছন্দ-অপছন্দ বিষয়ক প্রশ্ন করলেই ছেলেটা থতমত খেয়ে যায়। তোতলাতে থাকে। কে এটা? হুবুহু রাফিনের মতো দেখতে? রাফিনের তো কোনো জমজ ভাই নেই। বড় একজন ভাই আছে তাকে আমি চিনি। সে ম্যারিড, একটা মেয়েও আছে। এই ছেলেটার সাথে কি রাফিনের কোনো সম্পর্ক আছে? হুবুহু মিল দুজন মানুষ কি করে হয়?”

আমি বললাম, “আচ্ছা বলতো, আমি তোমার সাথে ফোনে কথা বলতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করি নাকি সরাসরি কথা বলতে?”
“সরাসরি।” কিছুটা সন্দেহ নিয়ে বললো।

আমি উৎফুল্ল হওয়ার ভান করে বললাম,
“এক্স্যাক্টলি! ইউ আর এবসোলিউটলি রাইট।”
ওকে বেশ খুশি খুশি দেখালো। আমি বললাম,
“এখন তাহলে আসি, হুম?”
“শিউর, শিউর।”

আমি সামনে পা বাড়ালাম। ও বললো,
“বিকেলে যাবে কাশবনে?”
আমি দু’পাশে মাথা নাড়ালাম। ছেলেটার মনে হয় হালকা মন খারাপ হলো।

আমি যেতে যেতে রাস্তাতেই রাফিনকে টেক্সট করলাম। সেই সেইম কুয়েশ্চন।
“আচ্ছা বলতো, আমি তোমার সাথে ফোনে কথা বলতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করি নাকি সরাসরি কথা বলতে?”

রাফিন অনলাইনেই ছিল। সাথে সাথে টেক্সট করলো।
“কোনোটাই না। তুমি টেক্সটে বেশি সাচ্ছন্দ্যবোধ করো।”

আমি মুচকি হেসে মাথা দোলালাম৷ আগেই বলেছি, এই ছেলের সাথে রাফিনের কোনো মিল নেই। ছেলেটা সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকাতে পারে না। ওর দৃষ্টি এলোমেলো হয়ে যায়। অথচ রাফিন তাকালে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আমার চোখের দিকে। একবারও চোখের পলক অব্দি পড়ে না।

রাফিন আবার টেক্সট করলো, “হঠাৎ এটা কেন জানতে চাইছো?”
“এমনিই। আচ্ছা বলতো, আমি এখন কোথায়?”
“আমি কি ভবিষ্যত জানি নাকি তোমার মনে বাস করি যে যখন যা জিজ্ঞেস করবে বলে দিতে পারবো?”

“আমি ফ্রেন্ডের বাসায় যাচ্ছি।”
“কোন ফ্রেন্ড?”
“শাওন।”
“ওহ অকে। যাও।”

শাওনের বাসায় চলে এলাম। ও আমার গেটআপ দেখে বেশ অবাক হলো।
“এই ক’দিনেই এত চেঞ্জ?”
“চেষ্টা করছি।” মুচকি হেসে বললাম।

সারাদিন ধরে ওর সাথে কথা বললাম। রিয়াদের বিষয়টা ওকে জানালাম না। মারিয়ার ব্যাপারে ও বললো,
“মারিয়ার বয়ফ্রেন্ড প্রপোজাল পাঠিয়েছে মারিয়ার বাসায়। ওরা কেউই আগে জানায়নি যে ওরা একে-অপরকে ভালোবাসে। মারিয়ার একজন কাজিন দুজনের পরিবারকে ভালো ছেলে কিংবা ভালো মেয়ে আছে বলে ওদের সন্ধান দেয়। এরপর দেখা-সাক্ষাৎ করে দুই পরিবারেরই পছন্দ হয়৷ এখন সব ঠিকঠাক। আকদ হয়ে গেছে অলরেডি।”

“মা শা আল্লাহ! হারাম রিলেশন থেকে মুক্তি পেল। অবৈধ সম্পর্কের অবসান ঘটালো।” বেশ খুশি হয়ে বললাম।

বিড়বিড় করে বললাম, “রাফিন যদি একটু বুঝতো!”

শাওনের হাত ধরে বিশেষভাবে বললাম,
“শোন মারিয়াকে বলবি ও যেন আগের অবৈধ সম্পর্কটার জন্য তাওবা করে নেয়।”
“কেন এখন তো ওরা ম্যারিড। এখন আর তওবা করা লাগবে কেন?”
“এখন ম্যারিড, এখনকার সম্পর্কটা হালাল। বাট এর আগে যা ছিল তা তো গুনাহ-ই। ঐ গুনাহ তওবা না করলে মাফ হবে না।”

“আচ্ছা বলবো। কিন্তু তোরও তো হারাম সম্পর্ক আছে। সব জেনেও মানছিস না যে?”
“কে বললো মানছি না? ক’দিনের ভেতর ইন শা আল্লাহ সব হারাম রিলেশন থেকে বেরিয়ে আসবো আমি।” উদাস গলায় বললাম।

“সব রিলেশন বলতে? কয়টা রিলেশন তোর?”
“অনেক।”
“কিহ?”
“হারাম রিলেশন বলতে শুধু বয়ফ্রেন্ডকে-ই বোঝায় না রে পাগলী। ছেলেবন্ধু, ছেলে কাজিন, যেকোনো গায়রে মাহরামের সাথে সুমধুর সম্পর্ক, মিষ্টি মধুর কথা বলা, চলাফেরা করা মানেই হারাম সম্পর্ক। যেমন রাফিন ছাড়াও আমার আর কার সাথে হারাম সম্পর্ক জানিস? রিয়াদের সাথে। ওর সাথে কথা বলে সব মিটমাট করতে হবে। ও কি বলতে চায় শুনতে হবে। তারপর সব শেষ।”

“তুই এখনো কথা বলিসনি ওর সাথে?”
“পরে বলবো।”
“কথা বলার পর তারমানে সব শেষ? সত্যিই?”
“হুম। শতভাগ!”
“আর কখনো কথা বলবি না ওর সাথে?”
“নাহ! হারাম ইজ হারাম। পারলে তুইও বলিস না।”

“ও তো মরেই যাবে।” অন্যদিকে ফিরে বললো শাওন। আমি বললাম, “কিহ?”
“কিছু না। বস, নাস্তা নিয়ে আসি। বিকেল হয়ে গেছে।”
“হুম।”

শাওনের রুমটা মাঝামাঝি ধরণের। খাটের দু’পাশে দুটো জানালা। আমি খাটের ওপর বসে ডানের জানালায় চোখ রাখলাম। আকাশ মেঘে ঢেকে আছে। কিছুক্ষণের মাঝেই বৃষ্টি নামবে। মেঘ ডাকছে গুড়ুম গুড়ুম শব্দে। উঠানে কিছু ছেলেমেয়ে বাড়ি থেকে চেয়ার টেনে টেনে নিয়ে আসছে। হয়তো বসে কোনো খেলা খেলবে। আমিও মনোযোগ দিয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইলাম।

হঠাৎ দেখি রাফিন বেরুচ্ছে একটা বাড়ি থেকে। বেরিয়েই হাঁক ছাড়লো, “সবাই গোল হয়ে বসো। এখনই খেলা শুরু হবে।”

আমি বিস্ময়ে হতবাক। এটা রাফিনের বাসা? সত্যিই রাফিন তো! নাকি আমার দৃষ্টভ্রম? চোখ কচলে দেখলাম, হ্যাঁ, রাফিনই তো। শাওনের বাসার এত কাছে ওর বাসা? ওহ মাই আল্লাহ!

#Be_Continued__In_Sha_Allah ❣️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here