অগত্যা_তুলকালাম,পর্ব ১১,১২

#অগত্যা_তুলকালাম,পর্ব ১১,১২
নাফীছাহ ইফফাত
পর্ব ১১

আমি ধীরপায়ে বারান্দার দরজার সামনে গিয়ে উঁকি দিতেই দেখি একটা লম্বা ছায়া জানালা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে।
রুমে এসে নাকীবকে বললাম, “কাউকে জাগাবি না, কেনো শব্দ করবি না। চুপচাপ কিচেনে গিয়ে ঘর ঝাড়ুটা নিয়ে আয়।”

ও ফিসফিস করে বললো, “ঝাড়ু দিয়ে কি হবে?”
“তোর মুন্ডু হবে। যেটা বললাম সেটা কর, প্রশ্ন করবি না একদম।”

নাকীব ছুটে গিয়ে ঝাড়ু নিয়ে এলো। আমি বললাম,
“তুই দরজার কাছেই থাক, আমি বারান্দায় যাচ্ছি। কিছু ঘটলে তারপর ভেতরে গিয়ে বেদম কেলাবি তুই, ঠিক আছে?”

এরপর নাকীবকে বড়সড় একটা লাঠি দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিলাম। আমি ভেতরে ঢুকতেই ছায়াটা হালকা নড়ে উঠলো। আমি যে-ই ঝাড়ুটা তুললাম মারবো বলে অমনি ছায়াটা “করছো কি, করছো কি” বলে আমার মুখ চেপে ধরলো। কন্ঠ শুনে আমার সারা শরীর হিম হয়ে গেল। আমার হাত ফসকে ঝাড়ুটা পড়ে গিয়ে সামান্য আওয়াজ হলো। নির্জন রাতে সেই আওয়াজ নাকীবের কানে লাগলো ভীষন। ও একলাফে বারান্দায় এসে লাঠি চালালো রাফিনের কাঁধ বরাবর। আমার মুখ বন্ধ থাকায় বাঁধা দেওয়ার সুযোগটাও পেলাম না, তার আগেই রাফিন আর্তনাদ করে ফ্লোরে বসে পড়লো। নাকীব আরও মারতে যাচ্ছিলো তার আগেই ওকে ধাক্কা দিয়ে বললাম,
“গাধা, বেকুব! তোরে বলছিলাম কিছু ঘটলে তারপর আসবি৷ ঝাড়ু পড়তেই হামলে পড়লি?”

ও ফিসফিস করে বললো, “কে ওটা?”
“তোর দুলাভাই। বের হ তুই। যা!” রেগেমেগে বললাম।

আমি রাফিনের সামনে বসে বললাম, “খুব লাগলো না?”
ও আর্তনাদ করে কাঁধ চেপে ধরে ফ্যাকাশে মুখে বললো, “একদম না। প্রথমবার ফিউচার বউয়ের বাড়িতে দেয়াল টপকে, হাত ছিঁলে, পা ছিঁলে এসে ফিউচার বউয়ের ঝাড়ুর আঘাত, ফিউচার শ্যালকের হাতে ফিউচার লাঠির ধুর লাঠির আঘাত খেয়েছি। আহা! কি মধুর স্বাদ! এই জামাই আদর ভোলা যায়?”

নাকীব কাঁচুমাচু করে বললো, “স্যরি ভাইয়া, আমি বুঝতে পারিনি।”
“তোমার হাতে জোর খুব বেশি, বাচ্চা হলে কি হবে? আহহ!” ব্যাথায় কঁকিয়ে উঠে রাফিন।

নাকীবকে বললাম, “বরফ নিয়ে আয়!”

ও বরফ আনতে চলে গেলে রাফিন বললো,
“এজন্যই অতি রোমান্টিকতা দেখাতে নেই বুঝলে? এবার বুঝতে পারছো তো আমি কেন কাটখোট্টা, আনরোমান্টিক? রোমান্টিক হলেই ঝামেলা। হুহহ!”

আমি আস্তে করে বললাম, “তুমি কেন এসেছো এত রাতে?”
রাফিন কটমট করে তাকালো আমার দিকে।
“হ্যাঁ, ভুল করেছি এসে, মস্ত ভুল। এই যে ঠোঁট কেটে গিয়েছে, (আমার ঠোঁটের দিকে নির্দেশ করে ) কপালে ব্যান্ডেজ করেছো, বিছানায় পড়ে আছো তাই লুকিয়ে দেখতে এসেছিলাম। এসেই তো লাঠির আঘাত খেলাম! আহ! কি ব্যাথা! ভুল হয়ে গেছে আমার। চলে যাচ্ছি।”

বলতে বলতে কাঁধ ধরে উঠে দাঁড়ালো রাফিন। আমার মুখে আপনাআপনি মুচকি হাসি চলে এলো। লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতে এসেছিলো আমাকে? এটাও কি সম্ভব রাফিনের দ্বারা? আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছি না।

নাকীবের ডাকে ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসি।
“আপু, বরফ নাও। আরে ভাইয়া আপনি কোথায় যাচ্ছেন?”

রাফিন রেগে আমার দিকে তাকালো। অথচ নাকীবকে শান্তস্বরে বললো, “কেন ভাইয়া, আরেকটা দিবে লাঠির আঘাত?”

নাকীব মাথা নিচু করে বললো, “ভুল হয়ে গেছে ভাইয়া। স্যরি!” বলে বরফের ঢাকনাটা নিচে রেখে চলে গেল।

আমি খানিকটা রেগে বললাম, “তুমি ওকে এভাবে বললা কেন? ও কষ্ট পেয়েছে না?”
“আমি কষ্ট পাইনি? তাছাড়া আমি স্বাভাবিকভাবেই বলেছি। ও বুঝেছে তুমি বোঝনি।”

“কি বুঝিনি আমি?”
“কিছু না।”
এরপর বিড়বিড় করে বললো, “তুমি একটা গাধী এটা বোঝনি।
আমি চেঁচিয়ে বললাম, “কিহ?”
“আস্তে কথা বলো। বাড়িসুদ্ধ সবাইকে জাগিয়ে তুলবে নাকি?”

আমি চুপ করে গেলাম। রাফিন রেলিংয়ের হাতলে হাত রেখে পার হতে গিয়ে পারলো না। ওর ডান হাতে প্রচুর ব্যাথা। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখলাম। ধরবো না আমিও, আমাকে গাধী বলা? ওকে ধরতে ঠ্যাকা পড়েছে আমার।
রাফিন রেলিং থেকে সরে এসে বললো,
“যাও, ঘুমাতে যাও।”
“যাবো না, এটা আমার রুম, আমার বারান্দা। আমি যেখানে খুশি থাকবো।”

“কি বললা? একটা থাপ্পড় দিয়ে সবগুলো দাঁত ফেলে দিবো একদম।”

আমি রাগী চেহারায় ওর দিকে তাকাতেই বললো,
“আমাকে ভয় দেখাতে এসো না। রুমে যেতে বলেছি, রুমে যাও।”
“যাবো না বলেছি মানে যাবোই না।”
“যাবে না তো?”
“না।” দু’হাত বুকের ওপর ভাঁজ করে রেখে ভেংচি দিয়ে বললাম।

“ওকে ফাইন, আমিও সারারাত এখানে বসে থাকবো।”
রাফিন সত্যি সত্যি ফ্লোরে বসে পড়লো।

আমিও তেজ দেখিয়ে ওর অন্যপাশে ফ্লোরে বসে পড়লাম। বললাম, “আমিও যাবো না।”

বেশ খানিকক্ষণ চুপ থাকার পর রাফিন হালকা সরে এসে আমার পাশে বসলো। আমি নড়লাম না একটুও।

আরও খানিক চুপ থাকার পর বললো,
“আরোহী, জানো আমার বুকের ভেতর খুব কষ্ট হচ্ছে, খুব। তোমাকে যখন জাফর ছুঁয়ে দিতে যাচ্ছিলো তখন আমার মনে হয়েছে আমার পৃথিবীটা কেউ দুমড়ে মুচড়ে ভেঙ্গে দিচ্ছে। আমার যত্নে রাখা কাঁচের দেওয়ালের ওপারে পরিষ্কার দামী ডায়মন্ডটা কেউ তার নোংরা হাতে ছুঁয়ে অপবিত্র করে দিচ্ছে। আমি যদি শেষমুহুর্তে ওকে কাবু করতে না পারতাম আমি নিজেকে কখনোই ক্ষমা করতে পারতাম না। যেই তোমার হাতটা পর্যন্ত অকারণে কখনো আমি ধরিনি, যেই তোমার কাছ থেকে সবসময় দূরত্ব বজায় রেখে চলেছি, বারবার দেখতে ইচ্ছে করা সত্ত্বেও ফিরে তাকাইনি শুধুমাত্র অবৈধ, পাপ হবে বলে সেই তোমাকে কিনা নোংরা শয়তানটা…ছি!”

আমার হঠাৎ করেই রাফিনের ওপর থেকে সারাজীবনের সমস্ত রাগ, অভিমান উঠে যেতে লাগলো। ওর কাটখোট্টা আচরণের এই তাহলে কারণ? যেখানে সমাজে চলছে গার্লফ্রেন্ড-বয়ফ্রেন্ডের দোহাই দিয়ে ছোঁয়াছুঁয়ির খেলা সেখানে রাফিন…? ও এত ভালো কেন?

রাফিন আবার বলতে শুরু করলো,
“আমি জানি তুমি মনে মনে আমাকে কি ভাবো। ভাবো আমি এমন রোবটের মতো কেন, কোনো ফিলিংস নেই কেন আমার মাঝে? সবসময় রেগে থাকি তোমার ওপর। কথায় কথায় রেগে যাই, তোমার সাথে কথা বলি না, ঠিকমতো দেখা করি না, কেয়ার করি না তোমার। এককথায় আমাদের সম্পর্কটা অন্য সম্পর্কগুলোর মতো না কেন এটাই তো তোমার আফসোস তাই না? তুমি কি জানো, আমার এই রাগটা শুধুমাত্র তোমার ওপর? আমি পৃথিবীর আর কারও ওপর রাগ দেখাই না। শুধু তুমি আর মায়ের ওপর খুব বেশি রাগ দেখাই আমি। কারণ আমি যাদেরকে ভালোবাসি তাদের ওপর রাগ দেখানোর অধিকারবোধটা নিজ থেকেই জন্ম দিই। রাগ দেখাই বলে তোমার খুব আফসোস হয় তাই না?”

আমি মনে মনে বললাম, “আমার কোনো আফসোস নেই। তুমি যেমন তেমনই ভালোবাসি আমি।”

রাফিন জবাবের অপেক্ষা না করে বললো,
“আজ সব খুলেই বলি। তোমাকে দেখার খুব লোভ আমার জানো? তোমার সুন্দর ঘন কালো চোখ, তোমার মিষ্টি মুখ আর সবচেয়ে বেশি লোভ তোমার কালো চুলের ওপর। এত লোভ থাকা সত্ত্বেও কখনো ভালোভাবে দেখিনি জানো? সে-ই প্রথমদিন একবার শুধু তোমার চোখের দিকে ভালোভাবে তাকিয়েছিলাম, চুল তো তুমি সবসময় হিজাবের আড়ালেই রাখো। তাই কখনো নজর দেইনি। আমার মনে হতো যদি তুমি আমার না হও তখন কি হবে? আমার না হলে তো আল্লাহর কাছে আমাকেই জবাবদিহি করতে হবে, কেন আমি অন্যের হকের দিকে নজর দিয়েছি? আর আমি যদি তোমার সাথে অন্যদের মতো সারাক্ষণ ফোনালাপ, চ্যাটিং করতাম তুমি আমার কাছে আরও বেশি কিছু এক্সপেক্ট করতে। কারন মানুষ যত পায় তত চায়। এন্ড মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট থিং ইজ, আমাদের সম্পর্কটা অন্যদের মতো হলে আমরা আজ এত রাতে এত দূরে দূরে বসে থাকতাম না আরোহী। তুমি কি বুঝতে পারছো, হোয়াট আই মিন?”

আমি সজোরে উপর-নীচ মাথা নাড়ালাম। ও উঠে দাঁড়িয়ে বললো, “নিজেকে আরও অনেক বেশি শক্ত করো আরোহী। আমি ছাড়াও তোমার জীবনে আরও মানুষ আছে। আমাকে পাওয়াটাই তোমার এইম না, আমি না থাকলেও যাতে জীবনটা নির্বিঘ্নে কাটাতে পারো সেভাবেই তৈরী করো নিজেকে। আমি চাই না কেউ আমার জন্য কষ্ট পাক। একফোটা চোখের জল ফেলুক।”

“তুমি যেমন আমি তোমাকে তেমনই ভালোবাসি।”
“আমি জানি। বারবার ভালোবাসি কথাটা বলে ভালোবাসা প্রমাণ করতে হবে না। কারো বিহেভিয়ার দেখে বোঝা যায়। তুমি জানো, আমার লাইফে আরও কত্ত মেয়ে এসেছিলো?…”
“কত্ত মেয়ে?” চোখ বড় করে বললাম আমি।

“অনেক মেয়ে। ওদের কাউকে আমি বলিনি আমার লাইফে আসতে, বলিনি থাকতে, যেতেও বলিনি। এত কথাও বলিনি কাউকে। আমার কাটখোট্টা বিহেইভ দেখে দু’তিন মাসেই ওরা চলে যেত। অথচ তোমাকে কি দেখে আমার ভালো লেগেছিলো আজও জানি না। বরাবরের মতো আমার চয়েজটাই সেরা ছিলো। যারা আমাকে চুজ করেছে তারা আমাকে ছেড়ে চলে গেল অথচ আমি যাকে চুজ করলাম তার সাথে সেইম বিহেভিয়ার করা সত্ত্বেও সে রয়ে গেল।” একটা বাঁকা হাসি দিয়ে বলে রাফিন।

আমি মৃদুস্বরে বললাম, “ওদের কাউকে প্রপোজ করেছিলে?”
“না, বললাম তো ওরা আমাকে চুজ করেছে, আমি না। এখন এটা নিয়ে ভাবতে বসো না যেন। তোমাকে ওদের চেয়ে আলাদা ভাবি বলেই কিন্তু এত কথা শোনাই, এত রাগ দেখাই আর এত অধিকার ফলাই।”

“আচ্ছা, ভাববো না।”

“আরেকটা কথা…”
“কি?” আমি আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলাম।
“নাহ থাক। আগে নিজেকে শক্ত করে গড়ে তোলো তারপর বলবো। এখন বললে সইতে পারবে না।”

“আচ্ছা।”
“ভোর হতে চললো। আমি গেলাম। সাবধানে থেকো, টেক কেয়ার। আল্লাহ হাফেজ।” রাফিন রেলিং বেয়ে নেমে গেল।
রাতের আঁধার কেটে ভোর হয়ে আসছে। ভোরের মৃদু আলো এবং ল্যাম্পপোস্টের আবছা হলুদ আলোয় দেখলাম রাফিন হেঁটে গিয়ে বাইক স্টার্ট দিলো। সাথে সাথে টেক্সট করলাম ওকে, “ফজরের নামাজ পড়ো কিন্তু।”

ও ফোন বের করে টেক্সট পড়ে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। এরপর হাত নেড়ে চলে গেল।

ফজরের নামাজ পড়ে শুয়েছি। চোখ লেগে এসেছে সবেমাত্র তখনই নাকীব এসে হাজির। ‘আপু, আপু’ বলে চেঁচাতে চেঁচাতে আমার কোলবালিশটা টেনে নিয়ে ঘোরাতে লাগলো। হঠাৎ ঘুম ভেঙে ওর নাচ দেখে ভ্যাবাচেকা খেয়ে বললাম,
“কি হয়েছে?”
“ছোটফুফি, ছোটফুফি এসেছে।”

আমার ঘুম সাথে সাথে উধাও। “কিহ?” বলে লাফিয়ে ছুটে গেলাম লিভিংরুমে। ছোটফুফি সবেমাত্র এসেছে, বোরকা খুলছে। বোরকা খোলার সময় দিলাম না আমি তার আগেই ‘ছোটফুফি’ বলে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। ফুফি কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন,
“আস্তে, আস্তে!”
“আসসালামু আলাইকুম।” উত্তেজিত গলায়ই বললাম।
“ওয়া আলাইকুম আসসালাম। কেমন আছিস?”
“ভালো। আপনি কেমন আছেন?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো।”
“আঙ্কেল আসেনি?”
“না, নিতে আসবে পরে। এখন তুই কি আমাকে বোরকা খুলতে দিবি নাকি এভাবেই দাঁড় করিয়ে রাখবি?”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ।” বলে আমি চট করে সরে দাঁড়ালাম।

দুপুরে খেয়েদেয়ে ছোটফুফি আমাকে ডেকে বললেন,
“দেখি সমস্ত ঘটনা খুলে বল।”
আমিও বিস্তারিত বলা শুরু করলাম। সব শুনে ছোটফুফি বললেন,
“তুই নিজেও পুরোপুরি নির্দোষ না। বরং তোর দোষ সবার আগে।”

আমি অবাক হয়ে শুধু বললাম, “আমার দোষ?”

#Be_Continued__In_Sha_Allah ❣️

#অগত্যা_তুলকালাম
নাফীছাহ ইফফাত

পর্ব ১২

ছোটফুফি জবাব না দিয়ে ফোন চার্জে লাগাতে চলে গেলেন। এরপর এসে বললেন, “হুম প্রথমত তোরই দোষ।”

ছোটফুফি অকারণে কথা বলেন না। তাই আমি স্বাভাবিকভাবে জিজ্ঞেস করলাম,
“কিভাবে আমার দোষ?”
“প্রথমত, তুই কাউকে না বলে ও-বাড়িতে গিয়েছিস, যে বাড়িটা আমাদের জন্য নিষিদ্ধ। দ্বিতীয়ত, তুই একটা ছেলের সাথে গিয়েছিস। তারওপর তুই জনসমাগমে গিয়ে ক্রিকেট খেলিস? একজন মেয়ে হয়ে, পর্দার ধার না ধারে? আচ্ছা সে বিষয়ে পরে আসি। আগে প্রথম দুটো বিষয় ফয়সালা করি।”

ফুফি হালকা থেমে বললেন, “ঐবাড়িতে কেন গিয়েছিস?”

“ফুফি দাদুর ওপর খুব নির্যাতন করে তাই মাঝেমধ্যে আমি দাদুকে দেখতে যাই। আর ছেলেটা আমার ক্লোজ ফ্রেন্ড। আমার ভালো চায় সে। তাই জোর করে আমার সাথে গিয়েছে।” কাঁচুমাচু করে বললাম।

“ছেলেটা তোর ক্লোজফ্রেন্ড? সে পরপুরুষ না? পরপুরুষের সামনে যাওয়া, কথা বলা কি জায়েজ? তুই বল, আমি কিছু বলবো না।”
“জায়েজ না জানি। বাট…”
“বাট? বাট বলে কিছু নেই আর। ছেলে-মেয়ে কখনো বন্ধু হতে পারে না। বর্তমান সমাজে যে জাস্ট ফ্রেন্ড, বেস্টফ্রেন্ড, ক্লোজ ফ্রেন্ড নামক ছেলেমেয়ের মধ্যে বন্ধুত্ব শুরু হয়েছে এসব কিছুই ইসলাম সমর্থন করে না। ইসলাম মাহরাম-নন মাহরাম ভাগ করে দিয়েছে। কার সামনে যাওয়া যাবে, কার সামনে যাওয়া যাবে না সব ঠিক করে দিয়েছে ইসলাম। সেসব মানতে না পারলে নিজেকে একজন মুসলিম হিসেবে পরিচয় দিবি কি করে?” একটানে বলে থামলেন ফুফি।

আমি মাথা নিচু করে রইলাম। কথাগুলো সত্যি জানি। তবুও কেন যেন মানতে পারি না। আমি আমতা আমতা করে বললাম,
“ফুফি, আমরা তো কেউ কাউকে টাচ করি না, করিনি কখনো। একে-অপরের দিকে ভালো করে তাকাইও না।”

“শোনো পাগলী মেয়ের কথা।” ফুফি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
“শোন হৃদিতা, কেবল বন্ধুত্বের দোহাই দিয়ে যার সাথে তুই ঘুরে বেড়াচ্ছিস তার সাথে ঘোরার অনুমতি তো মহান রব তোকে দেননি। আমাদের কাউকেই দেননি। আজ যাকে তুই কেবল বন্ধু ভাবছিস কিছুদিন পর হয়তো সে তোর ভালোবাসার মানুষেও পরিণত হতে পারে। মন কারো কন্ট্রোলে থাকে না রে মা। কখন কাকে ভালো লেগে যায় বোঝা দায়। তাই আমাদেরই উচিত মনটা অবাধ্য হওয়ার আগেই দৃষ্টি ও নফসকে নিয়ন্ত্রণে রাখা।”

ছোটফুফির সব কথাই ঠিক। ফুফি আদৌ জানেন না, রাফিনকে আমি কতটা ভালোবাসি। না জেনেই যা বলছেন সব খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে। কিন্তু তারপরও রাফিনকে ছাড়ার কথা আমি ভাবতে পারছি না।

ফুফি আবার বলতে লাগলেন, “আল্লাহ আমাদের ভাগ্য বহুবছর আগে লিখে রেখেছেন। কার সাথে আমাদের বিয়ে হবে তা-ও ঠিক করে রেখেছেন। যেখানে আল্লাহই সব ঠিক করে রেখেছেন সেখানে আমাদের সে ব্যাপারে মাথা ঘামানোর কি দরকার? আমরা শুধু দোয়ায় চাইবো, যেন একজন নেককার, উত্তম জীবনসঙ্গী আমরা জীবনে পাই। ব্যস! আল্লাহ বলেননি, তোমরা নিজেরাই জীবনসঙ্গীর খোঁজ করো। অথচ বর্তমানে বয়ফ্রেন্ড থাকাটা একটা ট্রেন্ডে পরিণত হয়েছে। ওর আছে কেন, আমারও থাকতে হবে।” ফুফি ঠোঁট বাঁকা করে মাথা নাড়লেন।

এরপর বললেন, “এই অন্তর সৃষ্টি হয়েছে রবকে ভালোবাসতে। রবকে ভালো না বেসে দুনিয়ার নন মাহরাম পুরুষকে ভালোবেসে কোনো ফায়দা জীবনে হবে না। ধর তুই কাউকে ভালোবাসিস। তুই কি আদৌ নিশ্চিত যে, তার সাথেই তোর বিয়ে হবে? যদি বিয়ে না হয় তবে এতদিন মেলামেশা করায় যে পরিমাণ গুনাহ তোর হয়েছে তার কি হবে? তুই আল্লাহকে কি জবাব দিবি? আচ্ছা ধর, তুই তওবা করেছিস। তাওবা করলে আল্লাহ সব গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন। কিন্তু সেটা তাওবা করার পর অবশ্যই। কিন্তু তুই যে এতদিন তোর স্বামী মানে যার সাথে তোর বিয়ে হবে তার হক নষ্ট করলি তার কি হবে? অন্যের হক নষ্ট করার অধিকার তো তোর নেই।”

আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, গতকাল রাতে রাফিনের বলা কথাগুলোই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলছে ছোটফুফি। অথচ ছোটফুফি এই ছেলেটাকেই ছেড়ে যেতে বলছে। আমি কিভাবে ওকে ছেড়ে থাকবো? এরকম ছেলে কোটিতে একটা মিলে কিনা সন্দেহ।

এতক্ষণে আমি বললাম, “তার হক নষ্ট হয়ে যাবে? তাকে তো আমি কখনো দেখিনি। আর যদি সে-ও আমার মতোই মেয়েদের সাথে ঘোরাঘুরি করে তখন?”
“তখন তার কৈফিয়ত সে আল্লাহকে দিবে। কিন্তু তোর নিজেরটা তোকে ভাবতে হবে। আল্লাহর হক, বান্দার হক কোনো হকই নষ্ট না করে দৃষ্টি ও নফসকে নিয়ন্ত্রণ করে জীবন চালিয়ে যেতে হবে। রবকে ভালোবেসে জীবন কাটাতে হবে। দুনিয়াটা ক্ষনিকের আবাসস্থল মাত্র। এখানে তুই অনন্তকাল থাকবি না। অনন্তকাল থাকবি আখিরাতে। তাই আখেরাতের কথা ভাব। দুনিয়ায় কি পেলি না পেলি সেসব না ভেবে আখেরাতে কি পাবি, কিভাবে সুখে থাকবি সেই চিন্তা কর। যে আল্লাহকে পাওয়ার জন্য দুনিয়া ত্যাগ করে আল্লাহ দুনিয়াকে তার পায়ের কাছে এনে ফেলেন। এটা একটা হাদীস বুঝলি?”

আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, “সব বুঝলাম।”
“এবার বল, ক্রিকেট খেলার ব্যাপারটা কি? তুই অত লোকের সামনে গিয়ে ক্রিকেট খেলিস এটা তো জানতাম না? ভাইয়া কিছু বলে না তোকে?”
“আব্বু জানে না এসব। তাছাড়া আমি বাচ্চাদের সাথে খেলি। হিজাব করে বের হই তো।”
“আর তোর হিজাব! হিজাব করা মানেই পর্দা না। তুই মুখ দেখিয়ে হিজাব করলি, ছেলেদের সাথে ঘুরলি-ফিরলি এটাকে তো পর্দা বলে না। এতক্ষন কি বোঝালাম তোকে?”
আমি মাথা নিচু করে বললাম, “তাহলে কি করতে হবে?”
“প্রোপার পর্দা করতে হবে। ইসলাম যেভাবে বলেছে সেভাবে। হাত-মুখ, পা কিছুই দেখা যাবে না, জাস্ট চোখ ছাড়া। কোনো পরপুরুষের সাথে কথা বলা যাবে না। আচ্ছা এসব আস্তেধীরে হবে। এখনই তোকে এসব করতে বলছি না। প্রথমে অল্প অল্প চেষ্টা কর, ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে যাবি।”

ফুফি উঠে চলে যাচ্ছিলেন। আমি বললাম,
“তারমানে সব দোষ এখন আমার? ফুফির কোনো দোষ ছিল না? জাফরের কোনো দোষ ছিল না?”

“তোর ফুফির দোষ তো অহরহ, যা শুধরানো মুশকিল। সে তো সেই ৩০ বছরযাবৎ দোষ করেই চলেছে। তাকে শুধরানোর ক্ষমতা আমাদের নেই। আমাদের সাধ্যের মধ্যে আছিস তুই। তোকে পরিপূর্ণ শিক্ষা দেওয়াটাই এখন আমাদের দায়িত্ব। যাতে তুই-ও ওর মতো ভুল না করিস। যদিও তুই করবি না জানি। তবুও বলা তো যায় না, মানুষের মন কখন কি করে বসে! এছাড়াও, আমাদের সবসময় আগে নিজের দোষ দেখা উচিত। নিজে ভালো তো জগৎ ভালো। বুঝলি?”

আমি মাথা নাড়ালাম, “বুঝেছি।”

ছোটফুফি চলে গেলেন। এরপর আমি ছোটফুফির কথাগুলো নিয়ে ভাবতে বসলাম। সবকিছু মানতে পারলেও রাফিনকে ছাড়ার কথা একবারও ভাবতে পারলাম না। কিভাবে ওকে না ছেড়ে ইসলামের পথে চলা যায় তাই ভাবতে লাগলাম। ছোটফুফি আমাকে সালাহউদ্দিন জাহাঙ্গীর এর “প্রিয়তমা” বইটি পড়তে দিলেন। রাসূল (সাঃ) এর স্ত্রীদের জীবনী নিয়ে লিখিত বইটি। কিভাবে নবীপত্নীরা দিন কাটাতেন আর আমরা কিভাবে কাটাচ্ছি সেই ফারাক ধরতে পারার জন্য এবং সঠিক জীবন কাটানোর জন্য এই বই নাকি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

ছোটফুফি চলে যাওয়ার পরপরই রাফিন কল করে। রিসিভ করবো না করবো না করেও কলটা রিসিভ করে ফেললাম। বিকেলে দেখা করতে বলে রাফিন।

দেখা করবো কি করবো না এটা নিয়েও দোটানায় পড়ে গেলাম। মন বলছে, রাফিন তো কোনো অন্যায় করেনি। ওর সাথে হুট করে কথা বন্ধ করা মানে তো ওকে ঠকানো হচ্ছে। তাছাড়া যদি ছোটফুফির ভাষ্যমতে সম্পর্কটা শেষই করতে হয় তাহলেও তো শেষবার আমাকে রাফিনের সাথে কথা বলতে হবে। কিন্তু শেষবার কথা বলবো এটাও আমি ভাবতে পারছি না। মূল কথা, আমি রাফিনকে ছাড়া অন্যকিছু ভাবতেই পারছি না। যে ছেলেটা গতকালও আমাকে চরম বিপদ থেকে উদ্ধার করে এনেছে, নিজের জীবনের তোয়াক্কা না করে অপরাধীকে ধরিয়ে দিয়েছে তাকে ছাড়ার কথা আমি কিভাবে ভাববো? এটা তো অসম্ভব!

বিকেলে কাশবনে গেলাম। ছোটফুফির কথামতো প্রোপার পর্দা না করলেও আজ মুখ ঢেকে নেকাব করে এসেছি। নিকাব করে সাইকেল চালাতে বেখাপ্পা লাগছিলো বটে, কিন্তু কি আর করা। ছোটফুফির নির্দেশ।

কাশবনে এসে দেখি রাফিন আগে থেকেই বেঞ্চিতে বসে আছে। ওর হাতে মোবাইলের বদলে গিটার। ওকে দেখামাত্রই আমার প্রথমে কেমন যেন লাগলো। প্রথমত, ও কখনো বেঞ্চিতে বসে না কারণ জায়গাটা রাস্তার পাশে। লোকজন আসা-যাওয়ার সময় বেঞ্চিতেই আগে চোখ পড়ে। দ্বিতীয়ত, ওর হাতে মোবাইল নেই। ও গেইমস না খেলে গিটার বাজাচ্ছে। তৃতীয়ত, গিটারটাও আমার কাছে পরিচিত না। এবং সর্বশেষ, ওর গেটআপটাও আমার কাছে অদ্ভুত ঠেকছে। সবই ঠিক আছে তবুও কি যেন একটা ব্যতিক্রম। সে-ই ব্যাতিক্রম ব্যাপারটা আমি সহসা ধরতে পারলাম না।

আমি এলোমেলো পায়ে গিয়ে ওর পাশে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে বসলাম। ও প্রথমে আমার দিকে ফিরেও তাকালো না। পরক্ষণে তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিলো। আমি গলা খাঁকারি দিতেই কিছুক্ষণ পলকহীন তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। এবার চতূর্থবারের মতো খটকা লাগলো আমার। ওর চোখজোড়া ঘোলাটে। অথচ রাফিনের চোখ স্বচ্ছ, গভীর কালো। তাকালেই আমার দৃষ্টি এলোমেলো হয়ে যায়। অথচ এই চোখের দিকে আমি স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি।

কিছুক্ষণ পর রাফিন বললো, “আরোহী..”
কথাটা পুরোপুরি শেষ না করে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। ও আমার নামটা এমনভাবে নিয়েছে সেটাকে আমি ডাক হিসেবেও ধরতে পারি আবার কুয়েশ্চন হিসেবেও নিতে পারি। আমি মৃদুস্বরে বললাম,
“চিনতেই পারছো না দেখছি।”
“না মানে, তোমাকে নিয়েই ভাবছিলাম। হঠাৎ সামনে দেখে আর কি চমকে গিয়েছি।”

”আমাকে নিয়ে ভাবছিলে? তুমি? রিয়েলি?” পঞ্চমবারের মতো খটকা লাগলো। আমি আরও ভালো করে ওর দিকে তাকালাম। রাফিন-ই তো। ধুরর! ছোটফুফির কথায় হয়তো আমার সাব-কনশাস মাইন্ড আমাকে ওর বিরুদ্ধে যাওয়ার জন্য উল্টাপাল্টা ভাবাচ্ছে। আমি ভাবনা বাদ দিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলাম।

“কেন আমি তোমাকে নিয়ে ভাবতে পারি না?”
“কখনো বলো না তো এজন্য বললাম।”

“কখনো বলি না বলে কি কখনোই বলবো না তা তো না।”

“হুম আচ্ছা।”

মৃদু বাতাস বইছে। কাশফুলগুলো দুলছে। আকাশে হালকা মেঘ। মেঘের ভেসে যাওয়া দেখতে দেখতে উদাস গলায় বললাম,
“আচ্ছা, জাফর তো পালিয়েছে, শুনেছো?”

আমার কথা শুনে মনে হলো রাফিন বেশ চমকে গেছে। কিছুক্ষণ নিরব থেকে বললো,
“হুম হুম শুনলাম।”
“গতরাতেই পালিয়েছে। অথচ গতরাতে আমাদের এসব নিয়ে কোনো কথাই হয়নি।”
“ঐ যে একটু ব্যস্ত ছিলাম তো আমি…”

আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম ওর দিকে। ব্যস্ত ছিলো মানে কি? ও তো কাল রাতে আমার বাসাতেই ছিল। কি আজব! ওর কি ব্রেইনে কোনো প্রবলেম হলো নাকি?

একপর্যায়ে রাফিন বললো, “আচ্ছা আমরা এসব নিয়ে এখন কথা না বলি। সুন্দর ওয়েদারটা এনজয় করি।”
বলে ও আমার হাতটা শক্ত করে ধরলো। ওর হাত ধরাটা আমার মোটেও সুবিধার ঠেকলো না। আমি টান দিয়ে সরিয়ে নিলাম হাত। গতরাতেই যে ছেলে আমাকে এতকিছু বোঝালো একরাতের ব্যবধানে সে কিছুতেই এতোটা পাল্টে যেতে পারে না।

আমি বললাম, “আচ্ছা আমি আজকে উঠি। বাসায় ছোটফুফি এসেছে তো। বেশিক্ষণ বাইরে থাকলে বকবে।”
“মাত্রই তো এলে আরেকটু থাকো।”

আমি চোখ বড় বড় করে একপলক তাকিয়ে মুহুর্তেই বাড়ির পথ ধরলাম। আমার মাথায় আসছে না, রাফিনের আচরণ এরকম কিভাবে হয়ে গেল? অন্যসময় হলে, জরুরি কথা থাকলে ও আমাকে ধমকে বসিয়ে দিতো আর নাহয় বিনাবাক্যে আমাকে বাড়ি ফিরতে দিতো। আমাদের এতদিনকার সম্পর্কে রাফিন কখনো আমাকে বলেনি,
“মাত্রই তো এলে, আরেকটু থেকে যাও।”
এসব আদিখ্যেতা ওর একদমই পছন্দ না। আর আজ ও-ই এসব বললো! কি আশ্চর্য!

কিছুদূর গিয়ে লক্ষ্য করলাম, রাফিনও আমার পিছু পিছু আসছে। তখনই অবাক হয়ে দেখলাম, রাফিনের চুলগুলো ভীষণ কোঁকড়া। অথচ রাফিনের চুল গতরাতেও স্ট্রেইট ছিল। ইভেন, ওর তো কোঁকড়া চুল পছন্দই না। এজন্যই ওকে এতক্ষণ কেমন যেন বেখাপ্পা দেখাচ্ছিলো।

#Be_Continued__In_Sha_Allah ❣️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here