#স্বর্ণাভ সুখানুভূতি।
#দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।, পর্ব- ২৭ (শেষাংশ)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা।
রজনীর প্রথমভাগ। আলো ছায়ার লুকোচুরি খেলা শেষে আঁধার নেমেছে সবেই। মাগরিবের নামাজ শেষে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে জাওয়াদ। সারাদিনে বেশ ধকল গেছে, ক্লান্তি এসে ভর করেছে শরীরে। কিয়ৎক্ষণেই ঘুম নামল চোখে। ঘনত্ব পাবার আগেই ব্যাঘাত ঘটল। কানের কাছে বিকট শব্দে বাজছে ফোন। বিরক্তির ভাজ ফেললো কপালে। ঘুমজড়ানো চোখ মেলে চাইল পাশে। স্ক্রিনে নামহীন একটা নাম্বার ভাসছে। ভ্রু কুঁচকে চাইল সে। খেয়াল করে দেখল এটা তারিফের নাম্বার। জাওয়াদ স্মিত হাসল। মেয়েটা তার কথা রেখেছে, শর্ত দেবার আগে চুপিচুপি মুশরাফা ভাইয়ের নাম্বারে কল দিতো, শর্ত দেবার পর তা বন্ধ করে দিয়েছে। জাওয়াদ মুশরাফার পরিবারের সবার নাম্বার ব্লক করেছে মুশরাফার ফোন থেকে। জাওয়াদের কথায় অচেনা নাম্বার তোলা ও বন্ধ করে দিয়েছে। সেভ করা নাম্বার আনসেভ করেছে। তারিফের মূল নাম্বার এখনো ব্লক লিস্টে। সন্ধি হলেও আনব্লক হয়নি, মুশরাফা জানেও না যে জাওয়াদ ব্লক করেছে, তার ধারণা ওরা ফোন দেয়না। প্রথমবার বেজে কেটে গেল। জাওয়াদ তারিফের নাম্বার আনব্লক করল। কল আসা নাম্বার ‘ভাইয়া ‘ লিখে সেভ করল। মুশরাফার জীবনে তারিফ ছাড়া দ্বিতীয় ভাই নেই। ভাসুর, দেবরের সাথে তার সখ্যতা নেই। সেই সুবাধে ‘ভাইয়া’ নামধারী কারো নাম্বার থেকে কল আসে না। । কতকাল এমন একটা ফোন আসেনা মেয়েটার। আজই প্রথম এলো। মেয়েটা দেখলে চমকাবে বেশ। আবার ফোন বাজল। জাওয়াদ ফোনটা নিজের ফোনের সাথে রেখে আবার চোখ বুজল। বিকট শব্দে বেজে গেল ফোনটা।
রান্নাঘর থেকে মায়মুনার কথা ভেসে আসছে, মুশরাফাও বোধহয় সেখানে। তার জীবনের শ্রেষ্ঠ ইদের দিনের গুনগান করছে শ্বাশুড়ি কাছে। বিয়ের পর প্রথম ইদ। দুপুরের খাবার মামীর বাসায় করলেও রাতের খাবারে শ্বশুরালয়ে উপস্থিত থাকবার জন্য বিকেলে এসে পড়েছে। ইদটা সবার সাথেই ভাগ হোক। কাকন বিকেলে চলে গেছে বাবার বাসায়। বউ শ্বাশুড়ি মিলে রাতের খাবারের আয়োজন করছে। ফোনের আওয়াজ পেলে কথার ইতি টেনে রুমের দরজায় এসে দাঁড়াল মুশরাফা। দুজনের ফোন মডেল এবং রিংটোন এক হওয়ায় দ্বিধায় পড়ল মুশরাফা। ভেবে নিল জাওয়াদের ফোন বাজছে। আনমনে বলল,
‘ফোন বাজছে সেই কখন থেকে। তুলুন ফোনটা!’
জাওয়াদ জবাব দিল না। মুশরাফা নিজেই এগিয়ে এলো। একই দেখতে ফোন দুটোর একটার পর্দায় ‘ভাইয়া ‘নামটা ভাসছে।
মুশরাফার স্মরণে তৎক্ষনাৎ ভাসুরের কথাই এলো। সে জাওয়াদকে মৃদু ঝাকিয়ে বলল,
‘ এ্যাই, ভাইয়া ফোন দিচ্ছে তো!’
‘ ধরে কথা বলো।’ ঘুমজড়ানো স্বরে বলল জাওয়াদ।
মুশরাফা কপাল কুঁচকাল। বিস্ময়ের ভাব নিয়ে বলল,
‘আপনার ফোনে কল করেছে , আমি ধরব কেন? ‘
জাওয়াদ বলল, ‘আমার ফোন না তোমার ফোনে কল এসেছে।’
কাভারে থাকা পমপম খেয়াল হলো মুশরাফার। আশ্চর্যান্বিত হয়ে বলল, ‘আমার ফোনে আপনার ভাই কল দিবে কেন? আমি তো উনার সাথে কালেভদ্রে ও কথা বলি না। আপনিই ধরে দেখুন। কোন বিপদ টিপদ হলো না কি আবার!’
এই ক্ষণে চোখ মেলল জাওয়াদ। হেসে বলল, ‘ তোমার মনে রাখা উচিত, তোমার জীবনেও এখন একটা ভাই আছে।’
কিছু মানুষের দূরত্ব এতটাই হয় যে, তারা এলেও আমরা ভুলে যাই তাদের অস্তিত্ব। হুটহাট তাদের স্মরণে আনতে পারিনা। মুশরাফার হয়েছে সেই দশা। এই ক্ষণে এসে তার মনে পড়ল, ফোন দেবার মতো তারও একটা ভাই আছে। সে অবিশ্বাস্য সুরে বলল, ‘ভাইয়া আমাকে কল দিয়েছে!’
জাওয়াদ আবার হাসল, ‘ভাই এবং ফোন, দুটোই তোমার। নাও কথা বলো।’
আবেগে আপ্লূত হলো মুশরাফা। তার জীবনে ভাইয়ের উপস্থিতি যেন জানান দিল আবারও। আজকের দিনটা এত সুন্দর আর অবিশ্বাস্য কেন? সব অপূর্নতা গুলো পূর্ণতা পেয়ে যাচ্ছে। মুশরাফা হেসে ফোন রিসিভ করল, ‘আসসালামু আলাইকুম, ভাইয়া। ‘
চমৎকার সুরে সালাম দিল। তারিফ হাসল। বলল, ‘ঠিকঠাক ভাবে পৌঁছাইছিস? কোন অসুবিধা হয়নি তো?’
‘নাহ, আলহামদুলিল্লাহ ঠিকঠাক পৌঁছেছি। তুমি বাসায় গেছো?’
‘হ্যাঁ, মাত্র এলাম। আচ্ছা শুন?’
‘হ্যাঁ, বলো। ‘ আগ্রহী হলো মুশরাফা। তারিফ ধীরেই বলল, ‘কাল সকাল সকাল জাওয়াদকে নিয়ে চলে আসবি।’
মুশরাফার জাওয়াদের কথা ভেবে আমতা-আমতা করল, ‘ আমি…
তারিফ ভুল ভাঙাল,
‘হ্যাঁ, তুই আর জাওয়াদ। দুজনেই কাল আমার বাসায় ইনভাইটেড।’
মুশরাফা অবাক হলো, ‘তোমার বাসায়! কিসের দাওয়াত?’
‘ ইদের দিন বা ইদের পরদিন বাবার বাসায় মেয়ে, মেয়ে জামাইর দাওয়াত পড়ে না? তোর খুব মন খারাপ হয় নিশ্চয়ই? পাপার বাসায় তো…
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল তারিফ। মুশরাফা কিয়ৎক্ষণ চুপ রইল। তারপর ক্ষীণ স্বরে বলল, ‘আজ মামার বাসায় থেকে বেড়িয়ে এলাম না? বাবার পক্ষ থেকে এক বাসায় গেলেই হলো। আমার মন খারাপ হয়নি। ‘
তারিফ বলল, ‘ মামারটা দায়িত্ব মামা পালন করেছে। আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে তো কেউ করেনি। বিয়ের পর প্রথম ইদ। শ্বশুরবাড়ির জামাই আদর পাওয়া জাওয়াদের অধিকার। সাফার বিয়ের পর প্রথম ইদে মমকে দেখেছি বিশাল আয়োজন করতে। আমি চাইছি না, তোর বেলায় তার কিছু কম হোক। তুই জাওয়াদকে নিয়ে আমার বাসায় এসে বেড়িয়ে যা। আমি জাওয়াদকে ও বলব। মুশি, তুই আসবি না?’
মুশরাফা ছোটোবেলা থেকে দেখে এসেছে। চাঁদ রাতে বা ইদের রাতে তার সব মামা ফোন দিয়ে তার মাকে নানুবাসায় যাবার দাওয়াত দিতো। মা হাসতেন। আনন্দে সবাইকে বলতেন, আমার ভাই দাওয়াত দিয়েছে। ইদের পরের দিনই সবাইকে নিয়ে বাবার বাসায় যেতেন মা। বিয়ের পর মুশরাফার মনে হয়েছিল, তার মায়ের মতো তার ফোনে ভাইয়ের কল আসবে না। কিন্তু সময়ের পালাবদলে তার জীবনটা তার মায়ের মতোই হলো। তারিফের কথায় স্পষ্ট অধিকারবোধ, দায়িত্ববোধ ফুটে উঠেছে। মামা মামীর পর বাবার পক্ষ থেকে একটা যত্নবান মানুষ এলো অবশেষে! ভাইয়ের কথায় মুশরাফা হাসল ভীষণ। বলল,
‘ আমার পক্ষ থেকে কোন নিষেধ নেই। কিন্তু…
তারিফ বোনের দ্বিধা ধরতে পেরে বলল, ‘ আজ সকালে কথা হয়েছে জাওয়াদের সাথে, আমার বাসার আসার ব্যাপারে ও নিষেধ করবে না। তা ছাড়া এখানে শুধু তোরাই, আর কেউ থাকবে না।’
‘ তাহলে তো হলোই। আসব তবে।’
ভাইবোনের কথা চলল অনেকক্ষণ। কথা শেষ করে মুশরাফা এসে বসল জাওয়াদের পাশে। জাওয়াদ কপালে হাতে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। এই অবেলায় শুয়ে থাকতে দেখে মুশরাফা ভ্রু কুঁচকাল। হাত সরিয়ে কপালে হাত রাখল। চিন্তিত স্বরে বলল,
‘জ্বর তো নেই। এখন শুয়ে আছেন কেন? খারাপ লাগছে?’
জাওয়াদ ওর হাত নিয়ে মাথায় রাখল, ‘ টায়ার্ড লাগছে। কিছুক্ষণ ঘুমালে ঠিক হয়ে যাবে। হাত বুলিয়ে দাও তো।’
মুশরাফা হাফ ছাড়ল। মাথায় বিলি কে/ টে বলল, ‘ মাগরিরের পর থেকে এশারের আগ অবধি সময়ে ঘুমানো মাকরূহ। আজান হয়ে গেলে নামাজ পড়ে একবারে ঘুমিয়ে পড়বেন। এখন উঠুন। ‘
জাওয়াদ চোখ খুলল, ‘জানতাম না তো। আমি শুধু জানতাম , ফজরের পর আর আসরের পর না ঘুমানোর কথা বলা হয়েছে। এই সময়ের কথা শুনি নি। ‘
‘এখন তো শুনলেন, উঠুন তবে!’
জাওয়াদ বালিশ থেকে মাথা উঠিয়ে মুশরাফার কোলে মাথা রাখল। কোমল স্বরে বলল, ঘুমাব না। এমনিই মাথায় বিলি কাটো, আরাম লাগছে।’
মুশরাফা হাসল। ধীরে বলল, ‘ শুনুন না!’
‘ বলুন দেখি।’
‘ভাইয়া দাওয়াত দিয়েছে।’
‘কোথায়?’
‘তার বাসায়। বলতেছে, বিয়ের পর মেয়েরা বাবার বাসায় যায়, আমার তো বাবার বাসা নেই, তাই যেন ভাইয়ার বাসা থেকে বেড়িয়ে আসি। ‘ বলতে গিয়ে কী প্রাণবন্ত দেখাল মুশরাফাকে।
জাওয়াদ দেখল তা। নব সুখ কড়া নাড়লে বুঝি মানুষ এমনই খুশি হয়! সে স্মিত হেসে বলল, ‘ ভালো তো, যাও ঘুরে আসো ভাইয়ের বাসা থেকে।’
নিঃসঙ্কোচ জাওয়াদের স্বর। মুশরাফা বিড়বিড় করল, ‘এমন করে যদি আমার বাসায় যাবার অনুমতি ও দিতেন!’ জাওয়াদ ওর গাল টেনে বলল, ‘একদিন এটাও দিব ইনশা আল্লাহ।’ মুশরাফা চমকৃত স্বরে বলল, ‘সত্যিই দিবেন!’
‘ আল্লাহ যদি চান, তবে আমি না দেবার কে? ‘
মুশরাফা মনে মনে দোয়া করল। সেই দিনের অপেক্ষায় তার মন ব্যাকুল হলো। সে হাসল, প্রাণবন্ত। তারপর বলল,
‘ভাইয়া চাইছেন তার বোনজামাই ও যেন সাথে যায়। শ্বশুরালয়ে জামাই আদর উপভোগ করে আসে।’
‘ভাইয়ার বোন কী চায়?’
‘ভাইয়ের যা চাওয়া বোনেরও তাই চাওয়া।’
থেমে বলল, ‘যাবেন না আপনি?’
জাওয়াদ রহস্যময় হাসল। সেইক্ষণেই জাওয়াদের ফোন বাজল। তারিফের ফোন। সেও দাওয়াত দিল। বোনজামাইকে দাওয়াত দেবার সময় তার পরিবারকেও বলতে চাইল তারিফ। তাদের পরিবারের পক্ষ থেকে যেহেতু কোন আপ্যায়ন হয়নি। জাওয়াদ নিষেধ করল। বলল, ‘আপনাদের পারিবারিক ইতিহাস কেবল আমার মা জানেন, বাদবাকি কেউ জানেন না। আপনার বাসায় গেলে আপনার পেরেন্ট না দেখলে সন্দেহ করবেন, প্রশ্ন তুলবেন। তারচেয়ে থাকুক এখন। আমি রাফাকে দিয়ে আসব কাল।’
তারপর বলল, ‘কালকের দিনটা আপনাদের ভাইবোনের। নিজেদের মতো কাটান। আমার বোন আসবে, আমি আমার বোনকে সময় দিই।’
তারিফ জোর করল, জাওয়াদ লাঞ্চের জন্য রাজি হলো না। ফোন রাখতেই মুশরাফা বলল, ‘আপনি যাবেন না কেন?’
জাওয়াদ কোমল স্বরে বলল, ‘ আমি চাই তোমাদের ভাইবোনের কিছু স্মৃতি হোক, স্মৃতির পুনরাবৃত্তি হোক। আমি হলে আমাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে, তোমাদের সময় কাটানো হবে না। কালকের দিন শুধু তোমাদের ভাইবোনের। ‘
•
রোদ্দুরে প্রজ্জ্বলিত বেলা। ঘড়ির কাটায় সকাল দশটা। তারিফ ব্যস্ত হাতে বাসা গোছাচ্ছে। স্বভাবগতভাবে খুব একটা গোছালো নয় সে। বুয়ার সুবাধে ঘর গোছানো থাকে। ইদের ছুটিতে বুয়া গ্রামের বাড়িতে গেছে। ঘরদোর সব অপরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। এই প্রথম বোন আসবে তার বাসায়, বাসাটা সুন্দর না থাকলেই নেই। কোন কিছুর যাতে কমতি না হয়। জীবনে না করা কাজ আজ করছে। বেডশিট, পর্দা, কুশন কাভার সব চেঞ্জ করেছে। ঘর ঝাড়ু দিয়েছে, মুছেছে। জায়ফা ও কাজ করল। ঘর সাজিয়েছে, টেবিল সব মেয়ালি কাজ সে করেছে। বোনের আসবার খবর শুনে সে বায়না ধরেছে সেও আসবে। তারিফ বিনাবাক্যে রাজি হয়ে গেল। কড়া স্বরে বলল, ‘ তোর যাবার কথা কাউকে বলবি না। মুশিকে সারপ্রাইজ দিব। ‘
বাসায় জানলে ঝামেলা হতে পারে ভেবে সবার অগোচরে এসেছে। তারিফ রুম স্প্রে করতে করতে ফরিদাকে কল করল। ধরতেই বলল,
‘মামী, ইদের পরদিন মেয়ে,মেয়ে জামাই বাবার বাড়ি এলে কী কী আয়োজন করতে হয়?’
ফরিদা হাসলেন, ‘রাফা যাচ্ছে?’
‘হ্যাঁ। ওর পছন্দের খাবার লিস্ট বলুন, আমি অর্ডার দিচ্ছি।’
ফরিদা মনে করে করে বলে দিলেন। তারিফ অর্ডার দিয়ে দিলো। কাজ শেষ হতে হতে এগারোটা বাজল। সব শেষ করে ক্লান্ত শরীর ডিভানে এলিয়ে দিল। জায়ফা টেবিলে ম্যাট বিছাতে বিছাতে বলল,
‘ অনেক কঠিন কাজ করে ফেলেছো, ভাইয়া। মম শুনলে জ্ঞান হারাবে।’
তারিফ চাপা শ্বাস ফেলল, ‘ সবচেয়ে কঠিন কাজ হলো সম্পর্ক রক্ষা করা, আপনজনকে আগলে রাখা। যা আমি কিংবা মম, কেউ পারিনি। এবার আমাকে পারতে হবে। ভাই হওয়া খুব কঠিন কাজ। এর মতো সেই কাজ ও সেরে উঠতে হবে আমার। আমাকে মুশির ভাই হতে হবে। আই প্রমিজড হার। জ্ঞান হারানোর পর যদি মমের মাঝে মায়ের সংজ্ঞা ফিরে আসে, তবে হারাক জ্ঞান। ‘
জায়ফা থেমে গেল। আকস্মিক মলিন মুখে বলল, ‘আমি ও আপির সাথে খুব রাফ বিহেভ করেছি।’
তারিফ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বাড়ির ছোটো সদস্য থেকেও অবহেলা পেয়েছে মেয়েটা। কিছুই পায়নি তার বোনটা। সে বলল, ‘স্যরি বলে নিস আজ।’
•
‘আপনার পরিবারের কেউ নেই তো?’ গাড়ি থেকে নেমেই ধীর স্বরে শ্যালককে প্রশ্ন করল জাওয়াদ। তারিফ হেসে বলল, ‘ জায়ফা আছে শুধু। আর কেউ নেই। আসবে ও না।’
‘আসবে না শিওর?’
তারিফ জাওয়াদের কাধ চাপড়াল, ‘আমি আছি আজ। তোমার চিন্তার প্রয়োজন নেই। চলো বাসায়।’
ওরা একসাথেই বাসায় এলো। দরজা বন্ধ ছিল। খুলল জায়ফা। বোনকে দেখে মুশরাফা চমকে উঠল। বিস্ময়ের মাত্রা বাড়ল যখন জায়ফা ওকে জড়িয়ে ধরে উৎফুল্ল স্বরে বলল,
‘আপি! কেমন আছো? কতদিন পর দেখছি তোমায়!’
মুশরাফা আবেগে আপ্লুত হয়ে গেল। আকস্মিক হেসে ফেলল। আগলে নিয়ে বলল, ‘ জায়ফু! ‘
মুখে হাত বুলাল। তারপর ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ওর কথা বলো নি যে?’
জায়ফা হেসে বলল, ‘আমরা সারপ্রাইজ দিতে চাইছিলাম। তুমি সারপ্রাইজ হয়েছো না? বলো?’
কাল থেকে একে একে পরিবারের সবাইকে ফিরে পাচ্ছি। এরচেয়ে বড়ো সারপ্রাইজ কী হতে পারে। মুশরাফা প্রাণবন্ত হেসে বলল, ‘ভীষণ।’
জায়ফার সাথে জাওয়াদের পরিচয় হয়নি আগে। আজই তারিফ করাল। জাওয়ার সৌজন্যবোধে ধীরে বলল, ‘কেমন আছো ভাইয়া? ‘
ভগ্নিপতির স্নেহমাখা কথায় জায়ফা প্রাণবন্ত হাসল। তারপর বলল, ‘ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন?’
আলাপ দীর্ঘ করবার আগে মুশরাফা ওকে টেনে ভেতরে নিয়ে গেল। জিলবাব খুলবার পর বোনকে দেখে চমকাল জায়ফা। কী স্মার্ট দেখায় ওর বোনকে। মাথা থেকে পা অবধি ফ্যাশনে গড়া। সাইনিং হেয়ার, গ্লো স্কিন, মেক-আপ, ড্রেসাপ সব কিছুতে স্মার্টনেস। অথচ চালচলনহীনতার অপবাদে এককালে এই বোনকে সে অপছন্দ করতো। সে জিজ্ঞেস করেই ফেলল, ‘আপি বিয়ের পর অনেক চেঞ্জ হয়ে গেছো তুমি। আগে তো এমন সাজতে না।’
মুশরাফা হাসল, ‘আমি আগের মতোই আছি। আগে ও এমন সাজতাম, তোরাই খেয়াল করতি না।’
প্রফুল্ল কথাটায় ও যেন বিষাদ খুঁজে পেল জায়ফা। চাপা শ্বাস ফেলে প্রসঙ্গ বদলাল, ‘ আপি, তোমার লিপস্টিক কালারটা জোশ। কত নাম্বার শেড?’
‘থারটি ওয়ান। ‘ বলে ব্যাগ হাতড়ে লিপস্টিক বের করল। বোনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘ এই যে এটা। লাগিয়ে দ্যাখ।’
জায়ফা একটু লাগিয়ে ফেরত দিতে গেল। মুশরাফা নিল না। বোনের হাতে দিয়ে বলল, ‘মানিয়েছে তোকে। আমার কাছে ডাবল ছিল। একটা রেখে এসেছি । এটা একদম ফ্রেশ। তুই রেখে দে।’
‘লাগবে না, আমি পরে নিয়ে নিব।’
‘আমার কাছে থাকতে নিবি কেন? রাখ। ও হ্যাঁ, আমি ঘুরতে গিয়ে তোর জন্য কিছু জিনিস কিনেছি। তুই আসবি জানলে নিয়ে আসতাম।’ আফসোসের সুরে বলল মুশরাফা।
তার অমায়িক ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে গেল জায়ফা। বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইল। এই বোনটাকে কত হেলা করেছে, অথচ তার ব্যবহারে ক্ষোভের লেশ মাত্র নেই। বরং তার ব্যবহারে প্রকাশ পাচ্ছে আন্তরিকতা। যেন বাকি সব বোনের মতোই আপন তারা। মাঝে কত পতন হয়েছে, তা যেন ভুলে গিয়েছে আপি।
কেবল বোরকা দেখেই তারা জাজ করে ফেলেছে, মানুষের কাছে যায়নি। কিছুক্ষণ বোনের সাথে থাকবার পর তার বিস্ময় মুগ্ধতায় রূপ নিল, কী অমায়িক ব্যবহার তার! বোনের এই সুন্দর ব্যক্তিত্ব ইতঃপূর্বে তার চোখেই পড়েনি। সময় গড়াবার সাথে সাথে কেবল একটা কথাই মনে হলো, আপিকে আমি শুধু শুধুই অপছন্দ করতাম। সে তো চমৎকার মানুষ। একটা মানুষকে ভুল জানার মতো অনুতপ্ততা দুটি নেই।
•
তারিফ আর জাওয়াদ বসে আছে বসার ঘরে। চায়ের কাপে আলাপ চলছে ভগ্নিপতি শ্যালকের। কিচেনে দুই বোন টুকটাক কাজ করছে। চাপা হাসির শব্দ ভেসে আসছে সেখান থেকে। সেই হাসি সুরে কানে তুলে হাসল তারিফ। জাওয়াদের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘মম-পাপা তোমার বাসায় গিয়ে মুশিকে তোমার ওয়েতে ইনভাইটেশন দিয়ে এলে, তুমি কি মুশিকে নিয়ে বিয়েতে এটেন্ট করবে?’
জাওয়াদ চায়ের চুমুক নিয়ে ভ্রু কুঁচকাল। খানিক ভাবল তারপর বলল, ‘ লম্বা প্রসেস এত কম সময়ে হবে বলে তো মনে হচ্ছে না।’
‘বিয়ে পিছিয়েছে।’ গম্ভীরমুখে বলল তারিফ। জাওয়াদ প্রশ্নবিদ্ধ করল, ‘কেন?’
তারিফ কোমল স্বরে বলল, ‘ মুশিকে একটা হ্যাপি লাইফ দেয়াই এখন আমার মূল কাজ। বাকি সব পরে। ‘ বলে তাকাল রান্নাঘরে হাস্যজ্বল বোনের দিকে। জাওয়াদ বেশ বুঝতে পারল তারিফ বোনের জন্য বিয়ে পিছিয়েছে। জাওয়াদ চমৎকার হাসল। তারিফ নিজ থেকেই বলল,
‘মুশি আমার খুব আদরের বোন। আমার সব বোনের মধ্যে আমি ওকে বেশি ভালোবাসতাম। আমাদের বন্ডিং অন্যরকম ছিল। মাঝে কীভাবে যে সব এলোমেলো হয়ে গেল! কাল যখন ওর হাতের দাগ দেখেছি তখন আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছিল। ভাগ্যিস, ওর অতীত নিয়ে তুমি কোন কথা শুনাওনি, বা অশান্তি করো না। ও যদি তোমার কাছে সুখে না থাকত, অতীত যদি ওকে ভোগান্তিতে ফেলত তবে আমি এতক্ষণে বোধহয় মরেই যেতাম। কখনো মাফ করতে পারতাম। ও হ্যাপি ম্যারিড লাইফ লিড করছে দেখে শান্তি লাগছে। থ্যাঙ্কিউ আমার বোনটাকে আগলে রাখবার জন্য। এভাবে আগলে রেখো ওকে। ‘
তারিফ ভগ্নিপতির পিঠ চাপড়াল। জাওয়াদ হেসে বলল, ‘ অতীত ভেবে কষ্ট পাবেন না। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। আর আমি রাফাকে সবসময় আগলে রাখব।’
তারিফ আবার বলল, ‘ তুমি জাস্ট আমাকে একমাস সময় দাও, আমি মম পাপাকে তোমার বাসায় নিব। মুশিকে মেয়ের মর্যাদা দেবার ব্যবস্থা করব আমি। তুমি জাস্ট এটা বলো, মম পাপা তোমার বাসায় গিয়ে মুশিকে নিবেদন করে মানাতে পারলে তুমি মুশিকে নিয়ে বিয়েতে এটেন্ড করবে কি না?’
জাওয়াদ অবিশ্বাস্য সুরে বলল, ‘আপনি পারবেন?’
‘ আমি যদি তোমাদের জন্য যদি গোটা বিয়ে আটকে দিতে পারি, তবে এটা পারব না? ফ্যামিলি ম্যানেজের দায়িত্ব আমার। তুমি জাস্ট তোমার কথা বলো, ফারুক সিদ্দিকীর সান ইন ল হিসেবে আমার বিয়েতে এটেন্ড করবে তুমি? ‘
তারিফের ভাতৃত্ব চমৎকার লাগল জাওয়াদের। বোনের জন্য গোটা একটা বিয়ের আটকে দিল। হল বুকিং থেকে শুরু করে অনেক এরেঞ্জমেন্ট হয়ে গেছে। এখন বিয়ে ভন্ডুল করা মানে লাখ লাখ টাকার ক্ষতি। কিন্তু তারিফ সেসব পরোয়া করছেনা। তার পরোয়া কেবল তার বোনকে নিয়ে, বোনটা তার বিয়েতে থাকা চাই, বোনকে একটা পরিবার দেয়া চাই। ভাই বোধহয় একেই বলে। তবে তারিফ বোনের সাথে ওকে ও মর্যাদা দিয়েছে। শেষ কথাটায় কত সম্মান জড়িয়ে ছিল ওর!
জাওয়াদ ধীর স্বরে বলল,
‘আপনার পরিবার আমাকে মানাতে পারলে, আমি অবশ্যই সস্ত্রীক উপস্থিত থাকব আপনার বিয়েতে। ‘
তারিফ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল, ‘তুমি এখন আমার পরিবারের সদস্য। তোমাকে তো থাকতেই হবে। তোমাদের আঞ্জুমান ভিলায় না আনা অবধি আমার শান্তি হবে না।’
জাওয়াদ প্রসন্ন হাসল, ‘কোন হেল্প লাগলে আমাকে বলবেন।’
শ্যালক-ভগ্নিপতির সম্পর্ক এই কথোপকথনে যেন আরও গাঢ় হলো। আলাপ চলল কিছুক্ষণ। এক পর্যায়ে তারিফ বলল,
‘ তুমি কখন আসবে আবার?’
‘ বিকেলে রাফাকে নিতে আসব।’
‘ও থাকুক দু’দিন এখানে। ‘
জাওয়াদ ভেবেচিন্তে বলল, ‘রাফা যদি থাকতে চায়, আমার সমস্যা নেই। এখানে ওর সমস্যা না হলেই হয়।’
‘হবে না।’ জোর গলায় বলল তারিফ। পরপরেই বলল, ‘ আমি ট্যুরের প্ল্যান করতে চাইছি। মুশি পছন্দ করে এসব?’
জাওয়াদ হাসল, ‘ বাংলাদেশের সব পর্যটন এরিয়া ঘুরা হয়ে গেছে আপনার বোনের। পছন্দ না ক্রেজিনেস আছে ওর।’
তারিফ অবিশ্বাস্য নজরে তাকাল জাওয়াদের দিকে, ‘সিরিয়াসলি?’
জাওয়াদ মনে মনে বলল, ‘আগে অবাক হওয়ার দায় আমার ছিল, এবার আপনার। পদে পদে অবাক হবেন। সবে তো শুরু। ‘ সে মুখে বলল, ‘ সি ইজ আ ওয়ান্ডার ওমেন। ইসলামের বিধান মেনে ও সব করে। আপনি ওকে ট্যুরে নিতে চাইলে না করবে, আপনি ওকে রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেলে ও না করবে না। হাজার লোকের ভীড়ে খেয়ে উঠবে। পর্দা সরবে না, খাবার ও পড়বে না। সো, আপনি নির্দ্বিধায় যে কোন ট্রিপের ব্যবস্থা করতে পারেন। জাস্ট একটু প্রাইভেসি রাখার চেষ্টা করবেন, তাহলেই হবে।’
তারিফ চকিত তাকিয়ে রইল। বোনটাকে যেন নতুন করে আবিষ্কার করছে। তারিফ বলল, ‘তাহলে আজ বাইরে ডিনারের প্ল্যান করি। তুমি জয়েন করবে।’
এই প্রস্তাব নিমিষেই লুফে নিল জাওয়াদ। নাস্তা শেষেই বিদায় নিল। যাবার কালে জাওয়াদ মুশরাফাকে বলল,
‘ভাইয়া বলল তুমি না কি দুইদিন থাকবে এখানে? আমি তো ভেবেছিলাম ডিনার করে তোমাকে নিয়ে ফিরব।’
জাওয়াদের মুখ কিছুটা মলিন হয়েছে। মুশরাফা মুখ চেপে হাসল, ‘হ্যাঁ। এই প্রথম এলাম। নাইওর করে যাই। আপনি ও থাকুন।’
‘নাহ, কারো বাসায় আমার ঘুম হয়না।’
‘তাহলে আর কি, যেখানে ঘুম হয় সেখানেই ঘুমান গিয়ে। আমি ভাই বোনের সাথে থাকব এখানে। ভাইয়া সাধলে দু’দিনের বদলে এক সপ্তাহ ও থেকে যাব।’ দায়সারাভাবে বলল মুশরাফা। জাওয়াদ নাক ফুলাল কেবল। বিড়বিড় করল, ‘ঘুম আমার বউকে ছাড়াও হয়না। তোমার বোঝা উচিত।’
সে অভিমানী সুরে বলল,
‘ এক সপ্তাহ থাকো বা এক বছর সেটা তোমার ব্যাপার। আমি কিছু বলব না। ‘
মুশরাফা হাসি চেপে রাখা চেষ্টা চালাল। হাসি গিলে বলল, ‘ আপনি তো দেখি বউকে চোখে হারান। চোখের আড়াল হবে শুনলেই বুক কাঁপে।’
জাওয়াদ প্রতিবাদ করল, ‘তোমার মত নিষ্ঠুর মহিলার জন্য আমার বুক ও কাঁপে না।’
মুশরাফা এবার হেসে ফেলল। বলল, ‘আপনার বুক না কাঁপলেও আমার বুক কাঁপছে আমার ভালোবাসা দেখে, মিস করার নিশ্চয়তা দেখে। ভালোবাসা পাচ্ছে। আমি আপনার চেয়েও বেশি মিস করব।’
‘তো থাকো আরও এক সপ্তাহ।’
মুশরাফা জাওয়াদের চোখে চোখ রাখল। প্রগাঢ় স্বরে বলল, ‘আপনার মনে হয়, আমি আপনার থেকে এতদিন দূরে থাকতে পারব?’
জাওয়াদ স্ত্রীর চোখে তাকিয়ে রইল কিয়ৎক্ষণ। তাকিয়ে থাকার মাখেই হেসে ফেলল। আজ আবারও হেরে গেছে এই নারীর চলনায়। তার মুখ থেকে অভিমান সরে গেল। প্রসন্নতা দেখা দিল। স্ত্রীর কপালে অধর পরশ দিয়ে বলল,
‘তুমি যাবার কথা না বলা অবধি আমি তোমাকে যেতে বলব না। ফোন সাথে রেখো, কল এটেন্ট করো। আর ডিনারে দেখা হবে।’
জাওয়াদ চলে গেল। তখন মধ্যবেলা। মুশরাফা বাসা ঘুরে দেখবার সময় তারিফের ঘরে গেল। রুমে চোখ ঘুরাবার সময় নজর আটকাল দেয়ালে আটকানো ফ্যামিলি ফটোর দিকে। ও, ছাড়া ওর পরিবারের সবাই ফ্রেমবন্দী। ভীষণ হাস্যজ্বল একটা মুহুর্তে ক্যাপচার করা। মুশরাফা ছবিটার কাছে গেল। বাবা মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। চোখ জল জমল। আলতোভাবে হাত বুলাল বাবা মা বোনের উপর। ওর কাতর চাহনির আক্ষেপটা ক্যামরায় ধারণ করল জায়ফা। মুশরাফার অগোচরে পাঠিয়ে দিল বাবা মায়ের কাছে। নিচে লিখল, ‘আপি, তোমাদের মিস করছে।’
পাঠিয়ে মম পাপার প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষায় রইল।
চলবে…
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা