টুয়েন্টি মিনিটস (চ্যাপ্টার-০৩),১৯,২০ (শেষ পর্ব)

টুয়েন্টি মিনিটস (চ্যাপ্টার-০৩),১৯,২০ (শেষ পর্ব)
লেখা: ShoheL Rana শামী
পর্ব:-১৯

বাহির থেকে ইউসুফ এলো ঘর্মাক্ত শরীরে। হাতে একটা প্লেকার্ড। প্লেকার্ডে লেখা- ‘আমাদের গুলি করেই মারুন। অনাহারে তিলে তিলে মারবেন না।’ একটা আন্দোলনে শরিক হতে গিয়েছিল রিহান। ওখান থেকেই ফিরছে সে। প্লেকার্ডটা রেখে সে সুফিয়ার উদ্দেশ্যে বললো, ‘মা, খিদে লাগছে প্রচুর। খাবার বাড়তে বলো।’

‘ঠিক আছে। আমি রিতুকে খাবার বাড়তে বলি। আগে তুই গোসল করে আয়। কীভাবে ঘেমে গেছিস দেখ।’

পাশ থেকে রিহান প্রশ্ন করলো, ‘আজ পুলিশ বা মিলিটারির হামলা হয়নি?’

‘না বাবা, আজ হামলা হয়নি। কাল রংপুরে শেখ মুজিবের সমাবেশে আপনি যাবেন?’

‘হ্যাঁ, যাবো ভাবছিলাম। কিন্তু তোমার মায়ের এ অবস্থায় পাশে তো একজনকে থাকতে হবে। ছোটো একটা বাচ্চা নিয়ে সে কি সবকিছু সামলাতে পারবে?’

‘তাহলে আপনি থাকেন। আমি আর আমার বেশ কয়েকজন বন্ধু আজ রাতেই রওনা দেবো রংপুরের উদ্দেশ্যে।’

‘বেশ! সাবধানে যেয়ো। এখন একটু গোসল করে ফ্রেশ হয়ে আসো তো। যাও বাবা।’

‘আচ্ছা।’ বলেই ইউসুফ বের হয়ে গেল গোসল করতে। সে ফিরতে ফিরতে সুফিয়া তার জন্য রিতুকে দিয়ে খাবার সাজাতে লাগলো। রিতু এ বাড়ির কাজের মেয়ে। রান্নাবান্না, ঘর-ঝাড়ু, কাপড় কাচা এরকম প্রায় সব কাজ সে করে। এই বাড়িতেই কাজ করে, আর এই বাড়িতেই খায়, ঘুমায়। রিতুকে জগে করে পানি আনতে পাঠিয়ে সুফিয়া খাবারগুলো প্লেইট দিয়ে ঢেকে দিতে লাগলো। রিহান তার কোল থেকে ইকবালকে নিয়ে বাইরে বের হলো। ইকবালকে বুকের সাথে জড়িয়ে নিয়েছে সে। ইকবালও শান্তভাবে তার কাঁধে মাথা রেখে আছে। একদম চুপচাপ সে। বাপ-ছেলে দুজন হাঁটতে হাঁটতে গ্রাম দেখতে লাগলো। কৃষকরা জমিতে পাকা ধানগুলো কেটে আঁটি বাঁধছে। এখানে বেশিরভাগ জমি সুফিয়ার। জমিগুলো বর্গাচাষিদের দিয়েছে সে ফসল ফলাতে। বিনিময়ে ফসলের অর্ধেক সুফিয়াকে দিতে হবে। রিহান দাঁড়িয়ে ওদের ফসল কাটা দেখতে লাগলো। একজন কৃষক ধান কাটা থামিয়ে রিহান রোদে দাড়াতে দেখে বললো, ‘বাবু, রোদে দাঁড়ায় আছেন? ওইহানে ছাতা আছে, ছাতাডা মেইলা দাঁড়ান।’

রিহান কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ছাতাটা নিয়ে মাথায় মেলে ধরলো। হরেশ নাথকে দেখা গেল শার্ট প্যান্ট পরে, একটা ব্যাগ নিয়ে ঘর থেকে বের হতে। সাধারণত লুঙ্গি পরেই থাকেন তিনি। হয়তো আজ কোথাও যাচ্ছেন। কাছে আসলে রিহান তাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী কাকা, কোথাও যাচ্ছেন না-কি?’

‘হ্যাঁ বাবা, কলকাতায় যাচ্ছি। পরিবারের কথা মনে পড়ছে। বেশ কয়দিন থাকবো ওখানে, তাই৷ কাপড়চোপড় নিয়ে যাচ্ছি কিছু।’ নিজের ব্যাগটা তুলে দেখালেন হরেশ নাথ।

‘আচ্ছা, যান তবে। মাসখানেক থাকবেন না-কি?’

‘মাস দুয়েক ওখানে কাটাবো। তোমার কাকি বারবার চিঠি পাঠাচ্ছে যেতে। তাই ভাবলাম ঘুরে আসি।’

‘সাবধানে যাবেন।’

‘আচ্ছা, চলি তবে বাবা। ফিরে এসে কলকাতার গল্প করবো তোমার সাথে।’

মৃদু হাসলো রিহান। হরেশ নাথ ভারি ব্যাগটা নিয়ে কিছুদূর হেঁটে গিয়ে একটা গরুর গাড়িতে উঠলেন। ফিরে এসে কলকাতার গল্প করবে বললেও, রিহান জানে সেই গল্প শোনার জন্য সে আর থাকবে না। হরেশ বাবু ফেরার আগেই রিহান তার বর্তমানে ফিরে যাবে। উনার সাথে এটাই হয়তো শেষ দেখা, শেষ কথা।

রাতের বেলায় বাড়ির উঠানে গরু দিয়ে ধান মাড়াইয়ের কাজ চলছিল। উঠানে ধানের আঁটিগুলো ছড়িয়ে দিয়ে, মাঝখানে একটা খুঁটি গাড়া হয়েছে। খুঁটির সাথে দুটো গরু বেঁধে পাক খাইয়ে মাড়াইয়ের কাজ চলছে। আকাশে উজ্জ্বল চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলোতে অনেক রাত পর্যন্ত চলবে এ কাজ। আশেপাশের বাচ্চারা এসে উঠানে হৈ-হুল্লোড় করতে লাগলো। খড়ের স্তুপে ডিগবাজি খেতে লাগলো। সাধারণত সুফিয়াদের এই উঠোনটা চর আলগী গ্রামের সেই উঠোনটার মতো বাচ্চাদের খেলাধুলায় মেতে থাকে না। কারণ, সামনের গেইটটা বন্ধ থাকে। আজ মাড়াইয়ের কাজ চলছে বলে গেইটটা খোলা রাখা হয়েছে। এরকম মাড়াইয়ের সময় খড়ের স্তুপ পেলে বাচ্চা ছেলেমেয়েদের আটকে রাখা যায় না।

জানালার পাশে বসে উঠানের কাজগুলো দেখতে লাগলো রিহান আর সুফিয়া। ইকবালকে ঘুম পাড়ানো হয়েছে। ইউসুফ রংপুরের উদ্দেশ্যে অনেক আগে বের হয়ে গেছে। আর রহিম মিয়া উঠানের এক কোণে কৃষকদের সাথে বসে আড্ডা দিচ্ছে। ওইদিকে তাকিয়ে রিহান সুফিয়াকে বললো, ‘রহিম মিয়াকে একটা বিয়ে করাতে হবে। বেচারা আর কত একা থাকবে?’

‘পাত্রী তো দেখতে হবে আগে। তাই না?’

‘হুমম… পাত্রী তো একটা আছেই। রিতুর সাথেই ওর বিয়েটা দিয়ে দিলে কেমন হয়?’

‘বেশ ভালো হয়। কিন্তু ওদের মতেরও তো একটা ব্যাপার-স্যাপার আছে।’

‘হ্যাঁ, দুজনের সাথে কথা বলে দেখো। বিয়েটা এই মাসের মধ্যেই করাতে পারলে ভালো হয়। অন্তত রহিম মিয়ার বিয়েটা খেয়ে যেতে পারবো।’

‘মানে? আপনি কি কোনো কিছু ইঙ্গিত করছেন?’ সরাসরি রিহানের মুখের দিকে তাকালো সুফিয়া। রিহান কিছুটা সময় নিয়ে বললো, ‘সুফিয়া, তোমাকে কিছু বলার আছে আমার?’

‘হ্যাঁ, বলুন… কিন্তু এভাবে বলছেন কেন? আমার ভয় হচ্ছে।’

‘শান্ত হও সুফিয়া।’ সুফিয়াকে একহাতে জড়িয়ে ধরলো রিহান। ‘শান্ত হয়ে আমার কথা শুনো। আমার বিদায়ের সময় এসে গেছে।’

রিহান অনুভব করলো, কথাটা শুনেই সুফিয়া কেঁপে উঠেছে। গোঁৎ করে ঢোক গিললো। কোনো কথা বের হলো না তার মুখে দিয়ে। হঠাৎ যেন অসাড় হয়ে গেল সে। চোখ বেয়ে তার ঝরঝর করে জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো রিহানের হাতের উপর। রিহান তার চোখ মোছার ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে নরম কণ্ঠে ডাকলো, ‘সুফিয়া… সুফিয়া…’

সুফিয়া হঠাৎ রিহান জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠে বললো, ‘আমাকে ছেড়ে যাইয়েন না। একবার কষ্ট পেয়েছি আপনাকে হারিয়ে, আরেকবার কষ্ট পেলে খুবই ভেঙে পড়বো আমি। যাইয়েন না আপনি আমাকে ছেড়ে।’ গলা জড়িয়ে এলো সুফিয়ার। রিহানের চোখ দুটোও ভিজে এলো। কী সুন্দর কোলাহলে জমে উঠেছে বাইরেটা। যে যার মতো ব্যস্ত। কেউ জানতেও পারছে এ দুটো মনের ভেতর কী এক বিষাদ সাগরের ঢেউ বয়ে চলেছে। সুফিয়ার কান্না কিছুতেই থামছে না। রিহানের চোখ বেয়েও নীরবে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো সুফিয়ার ঘাড়ে। সুফিয়া চমকে উঠে নিজেও কাঁদতে কাঁদতে বললো, ‘আপনি কাঁদছেন কেন? না, না,৷ আপনি কাঁদবেন না। আপনি কাঁদলে আমিও আরও ভেঙে পড়বো।’

রিহান নিজের চোখ মুছে বললো, ‘আমি ঠিক আছি। তুমি শান্ত হও। আমাদের ভাগ্যকে মেনে নিতে হবে।’

বেশ কিছুক্ষণ পর সুফিয়া নিজেকে কন্ট্রোল করলো। আরও কয়েক মুহূর্ত সময় নিয়ে সে নরম স্বরে জিজ্ঞেস করলো, ‘কবে চলে যাবেন?’

সুফিয়ার প্রশ্ন তীরের মতো বিধলো রিহানের বুকে। সে জবাব দিলো, ‘ইউসুফের কাছেই শুনেছি, আমি এই বছরের পহেলা মে পুনরায় ফিরে যাই। তারমানে আরও বিশ দিনের মতো আছি।’

কথাটা শুনেই সুফিয়া আবারও মুখটা চেপে ধরে ‘হু-হু’ করে কেঁদে চললো কয়েক মুহূর্ত। তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে রিহান বললো, ‘কথাটা তোমাকে প্রথমে বলতে চাইনি। পরে ভাবলাম বলে দিই। হুট করে যদি জানতে পারো আমি ফিরে গেছি, তখন অনেক বেশি কষ্ট পাবে। এখন আগে থেকেই বলে দিছি, যাতে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারো।’

সুফিয়া নিজেকে সামলালো। তারপর জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনি চলে গিয়ে কী করবেন?’

‘জানি না। চলে গিয়ে কী করবো। হয়তো একটা টং দোকানে দাঁড়িয়ে চা খাবো। গিয়ে দেখবো, যেইদিন আমি অতীতে এসেছি, সেই দিনটাও এখনও কাটেনি আমার সময় থেকে। ০২জুন, ২০২২, ঐদিন বিকেলেই আমি অতীতে আসি। ফিরে গিয়ে হয়তো দেখবো, আমার জীবন থেকে কেবল বিশ মিনিটের একটা সময় হারিয়ে গেছে। ওই বিশ মিনিটে আমি আমার পৃথিবীটাকেও হারিয়ে ফেলবো। কারণ, তুমিই আমার পৃথিবী। আর আমার পৃথিবীটাকে আমি ৫৬ বছর পেছনে রেখে যাবো।’

‘আমায় একটা সত্যি কথা বলবেন?’ দম নিয়ে প্রশ্ন করলো সুফিয়া।

‘হ্যাঁ, বলো?’

‘প্রশ্নটা একটু অবান্তর হয়ে যাবে, তবুও করছি। আপনার ওই সময়ে কি আমাদের এই স্বামী-স্ত্রীর পরিচয়টা থাকবে? জানি থাকবে না। আমি বুড়ি হয়ে যাবো, আর আপনি থাকবেন টগবগে এক জোয়ান।’

সুফিয়ার এই প্রশ্নের জবাবে কী বলবে ভেবে পেল না রিহান। তাকে চুপ থাকতে দেখে সুফিয়া পুনরায় বললো, ‘হয়তো থাকবে না। এটাই হয়তো শেষবারের মতো একসাথে বেঁচে থাকা স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে।’

রিহান চুপ থেকে বুঝিয়ে দিলো সুফিয়ার ধারণাটাই ঠিক। কয়েক মুহূর্ত নীরবে কেটে গেল। বাইরে তখনও বাচ্চাদের কোলাহল থামেনি, থামেনি মাড়াইয়ের কাজ। রহিম মিয়াকে দেখা গেল, কথা বলতে বলতে জোরে হেসে উঠতে। ওর মতো করে যদি একটু হাসা যেত এখন! একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সুফিয়া, তারপর প্রশ্ন করলো, ‘ওই সময়ে কি আপনি একটি বারের জন্যও আমার পরিচয় পান না?’

‘পাই। তবে অনেক দেরিতে।’

‘দেরিতে বলতে?’

রিহান প্রথমে বলতে চাইলো না। পরে ভাবলো, যা ঘটার তা তো ঘটেছেই তার চোখের সামনে। গোপন রেখে আর কী হবে? তাই সে বলেই ফেললো, ‘যেদিন তোমার সামনে স্বামীর পরিচয় নিয়ে যাই, সেদিন তোমার মৃত্যু হয়।’

‘আমার মৃত্যু? কোনদিন ওটা?’

‘৯ই জুলাই, ২০১৮। ওইদিন সন্ধ্যার মুহূর্তে ৬টা ২০মিনিটে তোমার চোখ দুটো বন্ধ হয়ে যায়। নিশ্বাসটা থেমে যায়।’

[[চলবে…]]

টুয়েন্টি মিনিটস (চ্যাপ্টার-০৩)
লেখা: ShoheL Rana শামী
পর্ব:-২০ (শেষ পর্ব)

নিজের মৃত্যুর তারিখ শুনে বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকলো সুফিয়া। মৃত্যু হবে এজন্য তার আফসোস নেই। আফসোসটা তার ওই জায়গায়, রিহানের সাথে তার স্বামী-স্ত্রী হিসেবে থাকা হবে না আর। স্বামী হিসেবে আর কয়েকটা দিন শুধু কাছে পাবে। এবার যেন পাথর হয়ে গেল সুফিয়া। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে, আর ঝরঝর করে চোখ বেয়ে পানি পড়ছে তার। বাইরে কত কোলাহল, চিৎকার চেঁচামেচি, হৈ-হুল্লোড়, অথচ ভেতরে থমথমে এক পরিবেশ। রিহানের ভেতরটাও কষ্টে ফেটে যাচ্ছে, কিন্তু নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলো। সুফিয়ার ঘাড়ে হাত রেখে আলতো স্বরে ডাকলো, ‘সুফিয়া… সুফিয়া…’

সুফিয়া নীরবে অশ্রুপাত করে গেল আরও কিছুক্ষণ। পরে চোখ মুছে তার মৃত্যু কীভাবে হয় জিজ্ঞেস করলে, রিহান সব খুলে বললো, কীভাবে নিজের নাতি ওকে তুলে নিয়ে যায়, আর ওখানে গুরুতর আঘাত পেয়ে কীভাবে মৃত্যু হয়। সুফিয়া কেবল শুনে গেল, কোনো প্রশ্ন তুললো না। রাত বাড়তে লাগলো। বাইরে ধান মাড়াইয়ের কাজ শেষ করে ওরা সবকিছু গোছগাছ করতে লাগলো। গরু দুইটা খুঁটি থেকে খুলে নিলো। বাচ্চাগুলোকে অনেক আগেই তাদের মা এসে বকতে বকতে ডেকে নিয়ে গেল খড়ের উপর ডিগবাজি খাচ্ছিল বলে। রহিম মিয়াও উঠে দাঁড়ালো সবাইকে বিদায় করে গেইটটা বন্ধ করে দেবে বলে। রিহান সুফিয়ার পাশে নরম কণ্ঠে বললো, ‘চলো সুফিয়া, অনেক রাত হয়েছে। ঘুমাতে হবে।’

‘আপনি ঘুমান। আমার ঘুম চলে গেছে।’

‘ঘুমাবে না?’

‘না, আবারও তো নির্ঘুম রাত কাটাতে হবে। এখন থেকেই অভ্যেস করি নিই?’

‘আগেও রাত জেগে ছিলে আমার জন্য?’

‘অনেক। অনেক রাত জেগে কাটিয়েছি সে সময় আপনি চলে যাওয়ার পর। ঘুম ধরা-ই দিতো না চোখে। চোখের নিচে কালি জমে গিয়েছিল। আর চোখ দুটো অনেকটা ভেতরে ঢুকে গেছিল। চেহারাটা শুকিয়ে গিয়েছিল খুব। চেনায় যেতো না আমাকে। সবাই খালি বলতো, এভাবে চিন্তা করে আর কী হবে? ওরা তো আর জানতো না, আপনি আমার সারা অস্তিত্বে মিশে গিয়েছিলেন, আর যাবার বেলায় আমার সেই অস্তিত্বটাকে মেরে গিয়েছিলেন।’ বলতে বলতে দম নিলো সুফিয়া। তারপর বললো, ‘ইউসুফ যখন হয়, তখন ওকে আঁকড়ে ধরেই নতুন করে বাঁচতে শিখি আমি। আপনি নেই, অন্তত আপনার মাধ্যমে পাওয়া শ্রেষ্ঠ উপহারটা আমার কাছে আছে, আমার ইউসুফ। এটুকুই ছিল সান্ত্বনা।’ কয়েকমুহূর্ত দম নিয়ে সুফিয়া পুনরায় বললো, ‘এখন আবার চলে যাবেন আপনি আমার অস্তিত্বটাকে দ্বিতীয়বার মেরে।’

রিহান কীভাবে সুফিয়াকে সান্ত্বনা দেবে বুঝতে পারলো না। শক্ত করে সে জড়িয়ে ধরলো তাকে। সারারাত ওরা ওভাবে নির্ঘুম কাটিয়ে দিলো জানালার পাশে।

দুদিন পর ফিরে এলো ইউসুফ রংপুর থেকে। তারপর সে গল্প করলো শেখ মুজিবের। কীভাবে এক দীর্ঘদেহী সাহসী লোক সারাদেশের মানুষের বুকে সাহস যোগায় এক বজ্র কণ্ঠে। কীভাবে তাঁর এক একটা কথায় কয়েক বেলা না খাওয়া লোকটাও বেঁচে থাকার শক্তি পায়। রিহানের খুব ইচ্ছে হলো, যে লোকটার নেতৃত্বে বাংলাদেশের সৃষ্টি হবে, তাঁকে একবার সরাসরি দেখার। সেই সুযোগটা হয়তো আর আসবে না। এবার রংপুরে ইউসুফের সাথে গিয়ে দেখার সুযোগ ছিল, কিন্তু সুফিয়া কোলের বাচ্চা নিয়ে সব সামলে উঠতে পারবে না বলে রিহান থেকে গিয়েছিল। অতীতে এসে হয়তো রিহানের একটা আফসোস রয়েই যাবে বঙ্গবন্ধুকে সরাসরি দেখার।

রহিম মিয়াকে ইদানীং একটু ফিটফাট লাগে। সুফিয়া রিতুর সাথে তার বিয়ে ঠিক করেছে। তাই নিজেকে সে আরেকটু মডার্ন করার চেষ্টা করছে। নতুন লুঙ্গি আর জামা কিনে এনেছে সে। সারাক্ষণ নতুন জামা পরেই বাড়িতে ঘোরাঘুরি করে। মাথায় তেল মেখে, চুলগুলো উল্টো দিকে আঁচড়ায়। আর মাঝেমধ্যে উঁকিঝুঁকি মেরে রিতুকে দেখার চেষ্টা করে। একবার রিতুকে দেখার জন্য রান্নাঘরে উঁকি মারছিল। তখন রিহান দেখে ফেলে। তাকে ডেকে রিহান একটু ইয়ার্কি শুরু করলো, ‘কী রে রহিম সাব, তোর কি উঁকিঝুঁকি মারা ছাড়া আর কোনো কাজ কাম নাই?’

‘আরে স্যার, কই উঁকিঝুঁকি মারলাম। একটু পানি খাইবার লাইগা রান্নাঘরে আইছি, গলাডা শুকাই গ্যাছে তেষ্টায়।’ বলেই রহিম মিয়া রান্নাঘরের চৌকাঠে গিয়ে দাঁড়ালো। রিতু ওখানে কাজ করছিল। রহিম মিয়াকে হঠাৎ দেখে তারও চেহারার পরিবর্তন হতে লাগলো। কেমন যেন লজ্জা পাচ্ছে দুজন। লজ্জালজ্জা ভাব নিয়ে রহিম মিয়া বলে উঠলো, ‘রিতু, এক গেলাস পানি পামু?’

রিতু লজ্জামাখা হাসি দিয়ে মাথা নিচু করে বললো, ‘খাড়ান একটু, দিতাছি।’ বলেই এক গ্লাস পানি নিয়ে রহিম মিয়ার দিকে বাড়িয়ে দিলো রিতু। কয়েকদিন আগেও দুজন দুজনের সাথে স্বাভাবিকভাবে কথা৷ বলতো। কেউ কাউকে লজ্জা পেত না। হঠাৎ করে বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকে তাদের এই পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। রিতুর হাত থেকে গ্লাসটা নেয়ার সময় রহিম মিয়া ইচ্ছে করেই তার হাতটা ছুঁয়ে দিলো। তখনই রিহান রহিম মিয়ার নাম ধরে ডাক দিলো। কিছুটা বেজার হয়ে রহিম মিয়া দ্রুত পানি পান করে গ্লাসটা রিতুর হাত ফিরিয়ে দিয়ে রিহানের সামনে এসে বিরক্ত-মুখে বললো, ‘কন স্যার, কী কইবেন?’

‘পানি চাওয়ার আড়ালে অন্য কিছু হচ্ছে মনে হচ্ছে?’

‘কী কন স্যার? অন্য কিছু কী হইবো?’

‘হাত ছোঁয়াছুঁয়ি হচ্ছে দেখলাম।’

‘ওই, একটু অসাবধানে লাইগা গ্যাছে।’

‘অসাবধানে তাই না? ঠিক আছে। চল, আমার সাথে যাবি?’

‘কোথায় যামু স্যার?’

‘গফরগাঁওয়ে। ওখানে কিছু আত্মীয় আছে। শেষবারের মতো৷ একটু দেখে আসি?’

‘ক্যান৷ স্যার? শেষবারের মতো ক্যান?’

‘আরে দেশের যে পরিস্থিতি। যেকোনো মুহূর্তে তো দুর্ঘটনা হয়ে যেতে পারে।

‘কিচ্ছু হইবো না স্যার। অলক্ষুণে কথা কইতে নাই।’ উপদেশটা দিয়েই রহিম মিয়া এমন ভাব করলো যেন বিরাট জ্ঞানগর্ব কোনো কথা বলে ফেলেছে।

‘ঠিক আছে। যাবি? গেলে আয়। একা যেতে ইচ্ছে করছে না। ইউসুফ থাকলে ওরেই নিয়ে যেতাম।’

‘চলেন স্যার। আমিই যাইতাছি।’

গফরগাঁওয়ে গরুরগাড়ি থেকে নামতেই রিহান তার দাদা ইউসুফকে দেখতে পেল। রিহান হাসিমুখে তার সামনে গেল। ইউসুফ তাকে দেখে বিরক্ত হলো না, আগের মতো রূঢ় ব্যবহারও করলো না। হাসিমুখেই আপন-সুরে বললো, ‘আরে রিহান ভাই যে?’

‘হ্যাঁ, কেমন আছ ইউসুফ দাদা?’ ইউসুফের সাথে গলা মিলালো রিহান।

‘এই তো ভালো আছি। তুমি দেখি আর পালটালে না। আচ্ছা, আমাকে কেন দাদা বলো, বলো তো? আমি কি বুড়ো?’ হাসলো ইউসুফ।

‘একটা কারণ তো আছেই। বলবোনে পরে।’

‘আচ্ছা, আচ্ছা। সাথে এটা কাকে নিয়ে এসেছ?’ রহিম মিয়াকে ইশারায় দেখাল ইউসুফ।

‘ওহ্, এটা? রহিম মিয়া ওর নাম। আমাদের সাথে থাকে।’

‘সালাম ভাই। আমি রহিম মিয়া। সবাই রহিম বইলাই ডাকে।’ ইউসুফের সাথে হ্যান্ডশেক করলো রহিম মিয়া। রিহান বললো, ‘ওর কিন্তু বিয়ে সামনে। দাদিকে নিয়ে বিয়েতে যেয়ো।’

‘আমি দুঃখিত যেতে পারবো না বলে। ঘরে খেতের জন্য লোক লাগাইছে। এদিকটা সামলাতে হবে।’

‘আচ্ছা। রহমান কেমন আছে?’

‘ও ভালো আছে। ওর নাম যে রহমান হবে, তুমি আগে থেকেই কেমনে জানতে?’

‘জানতাম আরকি। রহমানকে একটু দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে, তাই এলাম।’

‘ও ঘরে আছে। চলো, ঘরে চলো।’

ইউসুফের সাথে ঘরে এলো ওরা। সাহারা ওদেরকে কয়েক জাতের কিছু ফল কেটে দিলো। ওগুলো খাচ্ছিল ওরা। তখন ছোটো ছোটো পায়ে হেঁটে এলো রহমান। এখনও ঠিকমতো হাঁটতে পারে না। কিছুদূর হেঁটেই পড়ে যায়। রিহান ওকে কোলে তুলে নিলো। দুগালে আদর করলো তার। রহমান ড্যাবড্যাব চোখে চেয়ে থাকলো রিহানের দিকে। রিহান তার শিশু বয়সের বাবাকে কোলে নিয়ে খেলতে লাগলো। ইউসুফের উদ্দেশ্যে বললো, ‘দাদি কোথায় গেল ফল কতগুলো দিয়ে? দাদিকে ডাকো।’

সাহারা দরজার আড়াল থেকে হেসে উঠলো ফিক করে। ইউসুফ বললো, ‘ওকে দাদি বলে ডাকলে সামনে আসবে না।’

‘আচ্ছা ভাই সাহেব, আমরা আপনার কোন কালের দাদা-দাদি বলেন তো?’ আড়াল থেকেই প্রশ্ন করলো সাহারা।

‘ভবিষ্যত কালের। ভবিষ্যতে আপনাদের যে নাতিটা হবে। ওটা আমি।’ মজার ছলে বললো রিহান কথাটা। বলেই হাসলো। সাহারাও হেসে উঠলো। আরও বেশ কিছুক্ষণ রিহান সবার সাথে গল্প করলো। চলে আসার মুহূর্তে ইউসুফ যখন তাদের রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এলো তখন রিহান বললো, ‘এটাই হয়তো শেষ দেখা তোমার সাথে।’

ইউসুফ মুখটা বিবর্ণ করে বললো, ‘মানে?’

কয়েক মুহূর্ত দম নিয়ে রিহান বললো, ‘যেটা তোমাকে পরে বলবো বলোছিলাম, কেন তোমাদেরকে দাদা-দাদি বলে ডাকি জানো?’

‘কেন?’

‘তার আগে বলো তো তুমি ছোটো কালে যেমনটা দেখেছিলে, এখনও কি ওরকম দেখতে?’

রিহানকে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে ইউসুফ বললো, ‘হ্যাঁ, কয়েক বছর বেড়েছে এরকম মনে হচ্ছে। কিন্তু, বিশ-পঁচিশ বছর বাড়েনি। আমার বাবার সমবয়সী ছিলে তখন। বাবার চুলে পাক ধরেছে এখন, তুমি এখনও আগের মতো কী করে আছো বলো তো?’

‘কারণ, আমি তোমাদের সময়ের কেউ না? সেই সময়ও বলেছিলাম তোমাদের কথাটা। তুমি তো ছোটো ছিলে, মনে আছে আমি ভবিষ্যত থেকে এসেছি বলেছিলাম? তোমাদের কেউ আমার কথা বিশ্বাস করোনি তখন। আমি বলেছিলাম, তোমাদের ভবিষ্যত বংশধর আমি। রহমানের নামটা আমি আগে থেকেই কী করে জানি, জানো?’

‘কীভাবে?’

‘জানি, কারণ সে আমার বাবা। আর তুমি আমার দাদা।’

ইউসুফ কী বলবে বুঝতে পারলো না। রিহান পুনরায় বললো, ‘আমার জন্ম এখনও হয়নি। ভবিষ্যতে হবে। আমি ভবিষ্যত থেকে বিয়াল্লিশ সালে একবার অতীতে এসে চলে গিয়েছিলাম, চৌষট্টি সালে আবার আসি।’

ইউসুফ চুপচাপ শুনতে লাগলো, চেহারা দেখে মনে হলো, কিছুই যেন সে বিশ্বাস করতে পারছে না। রিহান তার কাঁধে হাত রেখে বললো, ‘দাদা, তুমি কি আমার কথা বিশ্বাস করছো?’

‘না, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।’

‘এ পর্যন্ত ঘটা সব ঘটনা নিয়ে একবার ভাবো। তবেই বুঝতে পারবা। আমি আসলেই ভবিষ্যত থেকে আসা তোমারই এক বংশধর। আমি আবারও ফিরে যাবো ভবিষ্যতে আগামী মাসের ১তারিখে। তাই এটাই আমাদের শেষ দেখা।’

‘তুমি আমার সাথে মজা করছো তাই না?’

‘না, সত্যি। ভালো থেকো তোমরা। আর দাদিকে বেশি করে সময় দাও। কেমন?’ বলেই ইউসুফের কাঁধে হাত চাপড়ে একটা গুরুর গাড়িতে উঠে পড়লো রিহান আর রহিম মিয়া। ইউসুফ ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো ওখানে। হয়তো ভাবছে রিহানের কথাগুলো। গরুরগাড়িটা দূরে সরে আসতে লাগলো। রহিম মিয়া দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ইউসুফের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে মন্তব্য করলো, ‘স্যার কেমন বোকা বানাইয়া দিলেন লোকটারে। হা হা হা।’

‘বোকা বানাইনি। যেটা সত্য, ওটাই বলছি রে রহিম।’

‘মানে? কী কন স্যার? আমারেও বোকা বানাইতাছেন তাই না?’

‘না রে। আমি যখন সত্যি সত্যি চলে যাবো, তখন বিশ্বাস করবি। কিন্তু, খবরদার এসব কথা কাউকে বলিস না।’

রহিম মিয়াও থ মেরে গেল এবার।

কয়েকদিন পর রহিম মিয়ার সাথে রিতুর বিয়ে হয়ে গেল। রহিম মিয়ার এখন খুশি হওয়ার কথা। এই বিয়েটা নিয়ে সে বেশ উত্তেজিত ছিল। একটা বিয়ে করিয়ে দেয়ার জন্য সে রিহানকে৷ কতবার যে বলেছিল! কিন্তু, এখন যখন বিয়েটা হয়েই গেল, রহিম মিয়ার সেই উত্তেজনাটুকু আর নেই। কেমন যেন মন খারাপ তার কয়েকদিন ধরেই। বিয়ের রাতেও৷ মন খারাপ করে সে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকলো। রিহান এসে তার পাশে৷ দাঁড়িয়ে বললো, ‘নতুন বরের কাজ কি আজ বাইরে? ভেতরে যে বঁধু বেশে একজন অপেক্ষা করছে সেই খেয়াল৷ আছে?’

‘স্যার, আপনার কথা ভাবতাছি। আপনি কি সত্যি চইলা যাইবেন স্যার? এইভাবে কি ভবিষ্যত থেইকা আওন যায়?’

‘এই যে আমি আসলাম। বিশ্বাস হচ্ছে না? আমার চালচলন, আমার পোশাক পরিচ্ছদ কি তোদের মতো?’

‘না, একটু ব্যতিক্রম আপনে।’

‘একটু না, অনেকটা।’

‘আপনের কথা বিশ্বাস করতে মন চায়, তয় কষ্ট হয় আপনের চলে যাবার কথা মনে হইলে।’

ম্লান হেসে রিহান রহিম মিয়ার গালে আলতো করে হাত বুলিয়ে বললো, ‘নিয়তি রে রিহম, আমার নিয়তিটাই এমন।’

‘আর দুইদিন। দুইদিন কই? মাঝখানে কাইল একদিন আছে। তারপর আপনে চইলা যাইবেন স্যার?’

‘হ্যাঁ রে। আমি থাকতে চাইলেও পারবো না। যেভাবে এখানে এসেছি, ওরকম কোনো একভাবে নিজের সময়ে চলে যাবো।’

রহিম মিয়া হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে রিহানকে জড়িয়ে ধরলো, ‘আপনের কথা খুব মনে পড়বো স্যার।’

‘আরে কাঁদে না। কাঁদে না পাগল। শান্ত হও তো।’

আরও কিছুক্ষণ কেঁদে শান্ত হলো রহিম মিয়া। রিহান তাকে বললো, ‘রহিম, ৭১সালে পাকিস্তানের সাথে মুক্তিযুদ্ধ হবে। যুদ্ধে যাবি তো? আমাদের দেশটা কিন্তু স্বাধীন হবে তখন।’

‘হ, যামু না মানে? আমিও যুদ্ধ করুম শালা গো লগে।’

‘তোর পাছায় বাড়ি মারছিল যে ওরে খুঁজে প্রতিশোধ নিস তখন।’

‘হ, নিমু। তার পেছনডায় গুলি করুম আমি।’ বলেই চোখে জল নিয়ে হেসে উঠলো রহিম মিয়া। রিহানও হেসে উঠলো। তারপর হাসি থামিয়ে রহিম মিয়ার কাঁধে আলতো করে চাপড় মেরে বললো, ‘যা, তোর বউ অপেক্ষা করছে তোর জন্য।’

রহিম মিয়া চোখ মুছে আরেকবার জড়িয়ে ধরলো রিহানকে। রিহান তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। রিহানেরও মায়া হতে লাগলো ওর প্রতি। ভবিষ্যতে এই রহিম মিয়ার৷ সাথে তার দেখা হয় না। কেউ ওর ব্যাপারে বলেও না কখনও। হয়তো যুদ্ধের সময়-ই মারা যাবে সে। রহিম মিয়া রিহানকে ছেড়ে দিয়ে ঘরের দিকে পা বাড়ালো। রিহানও হেঁটে ঘরে ঢুকলো। সুফিয়া একধ্যানে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে কী যেন ভাবছে। রিহান তার পাশে গিয়ে বসলো। দেখলো, সুফিয়া নীরবে কান্না করছে। রিহান তাকে কোলে বসিয়ে কোমর জড়িয়ে ধরলে, সুফিয়া হু-হু করে কেঁদে উঠে রিহানের গলা জড়িয়ে ধরলো। তারপর কেঁদে চললো বেশ কিছুক্ষণ। রিহানও তাকে কাঁদতে দিলো ইচ্ছে মতো। কেঁদে একটু৷ হালকা হোক বেচারি। ওকে কাঁদতে দিয়ে নিজে শক্ত থাকার চেষ্টা করলো সে। তবুও চোখ বেয়ে একফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো তার। কান্না থামিয়ে জড়ানো কণ্ঠে সুফিয়া বললো, ‘আপনি সত্যি চলে যাবেন? নিয়তিকে কি কোনোভাবে বদলানো যায় না?’

‘সেটা সম্ভব নয় সুফিয়া। যদি বদলানো যেত, তবে আমার সময়ে যা কিছু ঘটেছে, ওটার ব্যাখ্যা কী হবে?’

‘আপনি চলে গেলে আশেপাশের লোকজন আরও কানাঘুষা করতে পারে। আমার ছেলে দুইটাকে নিয়ে লোকজন খারাপ মন্তব্য করবে। ইউসুফ তো বড়ো হয়ে গেছে। কিন্তু ইকবাল? সে কী করে লোকের এসব কথা শুনে বড়ো হবে?’

‘তুমি তো তাও একসময় আমাকে খুঁজে পাবে সুফিয়া। তোমার ভবিষ্যতে আমাকে পাবে, কিন্তু আমার ভবিষ্যতে তুমি থাকবে না। এখান থেকে ফিরে গেলেই তোমার শূন্যতা আমাকে গ্রাস করবে। আমার জন্মের পর থেকে তোমার মৃত্যু পর্যন্ত, আমার আশেপাশে থাকবা তুমি। কিন্তু, আমি তোমাকে পাবো শুধু কাল একটা দিন। কষ্টটা আমার বেশি এখানেই। তোমার শূন্যতা বুকে নিয়েই বাকি জীবন কাটাতে হবে আমার।’

সুফিয়ার মুখ দিয়ে কেবল কান্নার শব্দ বের হলো। রিহানের গলা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সে কেঁদে চললো। কান্না তার থামতেই চাইলো না আর।

পরদিন বেশ কয়েকটা জায়গায় ‘পাকিস্তান নিপাত যাক’ শ্লোগানে সরব হয়ে উঠে জনগণ। পাকিস্তান সরকারের অত্যাচার শোষণ দিনদিন বেড়ে চলেছে। ক্ষমতা ওদের হাতে, প্রশাসন ওদের হাতে, পূর্ব পাকিস্তানের মুদ্রা বাজারটাও তারা নিয়ন্ত্রণ করে। পাশাপাশি এখানকার শিক্ষা-ব্যবস্থাটাও তারা ধ্বংস করে দিচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সব পশ্চিম পাকিস্তানেই অনুমোদন পায়। এখানকার ছেলেমেয়েদের দূরদূরান্তে গিয়ে লেখাপড়া করতে হয়। বাধ্য হয়ে মাঝপথে অনেকে লেখাপড়া ছেড়ে দেয়। আর কত মানা যায় এসব পক্ষপাতদুষ্ট আইন। সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হয়ে শ্লোগান দিতে লাগলো জনগণ। প্রতিবারের মতো এবারও পুলিশ আর মিলিটারিরা তাদের মিছিলে গুলি চালিয়ে ছত্রভঙ্গ করলো। ফাউগান গ্রামে যে মিছিলটা শ্লোগান দিচ্ছিল, ওখানে রহিম মিয়া এবং ইউসুফও ছিল। মিলিটারির একটা গুলি এসে পড়ে রহিম মিয়ার পায়ে। ইউসুফ দ্রুত তাকে মিছিল থেকে টেনে বের করে আনে। প্রচুর রক্ত বের হতে লাগলো গুলিবিদ্ধ জায়গাটা থেকে। ইউসুফ নিজের জামা ছিড়ে তার পায়ের আঘাতটা বাঁধলো শক্ত করে। রিহানকে দেখে ‘বাবা’ বলে ডাক দিলো ইউসুফ। রিহানও এসে ধরলো রহিম মিয়াকে। তারপর দুজন ধরাধরি করে তাকে ঘরে নিয়ে এলো।

গুলিটা সরাসরি রহিম মিয়ার পায়ে ঢুকে যায়নি। কিছুটা মাংস নিয়ে পাশ কাটিয়ে গেছে। বেচারা এখন ঠিক মতো হাঁটতেও পারছে না। ব্যথা সারতে অনেকদিন লাগতে পারে। তার পায়ের পাশে বসে রিতু সেবা করছিল। আর রহিম মিয়া ব্যথায় চিৎকার করতে লাগলো। ঘরের বাইরে পায়চারি করতে করতে মিলিটারিদের উপর রাগ ঝাড়ছিল ইউসুফ। রিহানের উদ্দেশ্যে সে বললো, ‘বাবা, মিলিটারির নতুন ক্যাম্পটা আবার জ্বালাতে হবে। না জ্বালানো পর্যন্ত আমার শান্তি নেই।’

‘ধৈর্য ধরো বাবা একটু। রহিম মিয়াও একটু সুস্থ হোক।’

‘কিন্তু, আজ রাতেই আমি পোড়াতে চাই ওদের ক্যাম্প।’

রিহান কোনো জবাব দিলো না। সে আজ রাতটাতে কোনো ঝামেলায় জড়াতে চাই না। আজকের রাতটাই এখানে তার শেষরাত হবে। এই রাতটা সে সুফিয়ার সাথে কাটাতে চায়।

রিহানকে চুপ দেখে ইউসুফ পুনরায় জিজ্ঞেস করলো, ‘বাবা, আপনি যাবেন রাতে?’

‘দেখো বাবা, তোমার মা একটু ইদানীং অসুস্থ হয়ে পড়ছে। তাই ওর পাশে থাকতে হবে আজ। মা একটু সুস্থ হোক, কেমন?’

ইউসুফ মুখটা ভার করে আবার চলে গেল বাইরে।

রাতে ঘরে থাকার কথা ইউসুফের। কিন্তু তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। কিছুটা অস্থির হয়ে গেল সুফিয়া। এমনিতেই সে দুশ্চিন্তায় আছে রিহানের জন্য। এখন আবার ইউসুফও ঘরে নেই। রিহানের সামনে এসে অভিযোগের সুরে সুফিয়া চিৎকার করে বললো, ‘আমার কপালেই কেন সব দুঃখ লেখা আছে? সবাই মিলে কি আমাকে মেরে ফেলবেন? আমি আর নিতে পারছি না। ইউসুফ একা একা কোথায় গেল? বাইরে কোচগাড়ি একটা নেই।’

রিহান বোঝে গেল ইউসুফ কোথায় গেছে। সে কাউকে না বলেই মিলিটারি-ক্যাম্প জ্বালাতে গেছে। সুফিয়াও হয়তো বুঝতে পেরেছে, তাই এভাবে উত্তেজিত হয়ে চিল্লাচ্ছে। চিল্লাচিল্লি শুনে রহিম মিয়া খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী হইয়াছে স্যার, ইউসুফ স্যার কই গ্যাছে।’

‘রহিম, ইউসুফ একা মিলিটারি ক্যাম্প জ্বালাতে গেছে। ধরা পড়লে কিন্তু ওকে ওরা বেঁচে ফিরতে দেবে না।’

‘ইউসুফ স্যার এ কামডা ক্যান করতে গেল? একা সাহস দ্যাখাইতে গেল!’

‘সুফিয়া, তুমি থাকো, একদম চিন্তা করো না। আমি দেখছি ও কোথায়?’

‘আপনি কোথায় যাবেন এত রাতে খুঁজতে?’

‘কোচগাড়ি তো আরেকটা আছে। আমি ওটা নিয়ে বের হয়ে দেখি।’

‘যান, দেখেন। আল্লাহ সব শাস্তি আমার উপরেই দিলো।’ চিৎকার করে বললো সুফিয়া।

রিহান বের হয়ে গেল কোচগাড়ি একটা নিয়ে। অর্ধেকপথেই সে দেখতে পেল ইউসুফ তার গাড়িটা নিয়ে ছুটে আসছে। দুইটা গাড়ি মুখোমুখি থামতেই ইউসুফ বলে উঠলো, ‘বাবা, জ্বালিয়ে দিয়েছি ওদের ক্যাম্প আবারও।’

‘ওরা তোমাকে দেখেনি?’ রিহান তার গাড়িটা ঘুরিয়ে নিলো।

‘দেখেছে। কিন্তু, অন্ধকারে চিনবে কেমনে? তাড়া করেছিল কিছুদূর। আমি কোচগাড়িটা নিয়ে পালিয়ে আসি।’

‘ঘরে চলো এবার। তোমার মা কেঁদে কেঁদে অস্থির তোমার জন্য।’

‘চলেন।’

ওরা যখন ঘরে ফিরলো সুফিয়ার উত্তেজনা থামলো তখন। ‘ঠাস-ঠাস’ করে সে ইউসুফের গালে দুইটা চড় মেরে বললো, ‘খুব সাহস হয়েছে তোর তাই না? একা একা ক্যাম্প পোড়াতে গেছিস?’

‘মা, যতো পারো মেরে তোমার রাগ মিটিয়ে নাও। কিন্তু আমি শান্তি পাচ্ছিলাম না ওদের ক্যাম্পটা না পুড়িয়ে। এখন শান্তি পাচ্ছি।’

সুফিয়া আরও বকতে গেলে রিহান তাকে বাধা দিয়ে বললো, ‘সুফিয়া, যা হওয়ার হয়ে গেছে। ছেলেটাকে আর বকো না। সে তো ঠিক মতো ফিরতে পেরেছে। ইউসুফ, তুমি নিজের ঘরে যাও বাবা।’ ইউসুফকে নিজের কক্ষে পাঠিয়ে দিলো রিহান।

বিপত্তিটা ঘটে আসলে পরদিন সকালে। একটা মিলিটারির জীপ এসে থামে সুফিয়াদের গেইটের সামনে। একদল সশস্ত্র মিলিটারি জীপ থেকে নেমে গেইট খুলতে বললে, রিহান গিয়ে গেইট খুলে দিলো। তখন ওরা ভেতরে ঢুকে সোজা কোচগাড়ি দুইটা যেখানে রাখা আছে, ওখানে গেল। কিছুক্ষণ গাড়ি দুইটা দেখে নিয়ে একজন অফিসার উর্দুতে জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনাদের এগুলো?’

‘জি।’ কাঁপা স্বরে বললো রিহান। ঘর থেকে বাইরে এলো সুফিয়া আর ইউসুফ। রহিম মিয়া দরজার চৌকাঠে একপায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো। তারপাশে রিতু। সুফিয়া রিহানের পাশে এসে দাঁড়ালো। রিহানের হাত শক্ত করে ধরে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী জানতে চায় এরা?’

‘গাড়ি দুইটা আমাদের কি না৷ জিজ্ঞেস করছে।’

সুফিয়া সরাসরি ইউসুফের দিকে তাকালো। ইউসুফ চোখ নামিয়ে নিলো।

‘এই এলাকায় এরকম কোচগাড়ি আর কারও বাড়িতে নেই। আশেপাশের কয়েকগ্রামেও নেই, আমরা খোঁজ নিয়েছি।’ অফিসার লোকটা পুনরায় বললো।

‘জি স্যার।’ নরম স্বরে উচ্চারণ করলো রিহান।

‘গতকাল একটা লোক আমাদের ক্যাম্পে আগুন দিয়ে, একটা কোচগাড়ি নিয়ে পালিয়ে আসে। নিশ্চয়ই এ বাড়ির কেউ।

‘না স্যার। এ বাড়ির কেউ এই কাজ করেনি।’ উর্দুতে জবাব দিলো সুফিয়া।

‘এ বাড়ির একজন করেছে সেটা আমরা নিশ্চিত। যে করেছে সে আমাদের সামনে আসো। নয়তো সবাইকে মেরে ফেলবো আমরা।’

রিহান, সুফিয়া আর ইউসুফ তিনজন পরস্পরের দিকে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলো। ইউসুফ সামনে এগিয়ে যেতে চাইলে রিহান তার হাত ধরে আটকিয়ে ফেলে। তারপর নিজেই এগিয়ে গিয়ে বলে, ‘আমি পুড়িয়েছি ক্যাম্প। আগেরবারও আমি পুড়িয়েছি।’

সাথে সাথে একজন বন্দুকের বাট দিয়ে বাড়ি মারলো রিহানের মুখে। ঠোঁট কেটে রক্ত বের হলো। সুফিয়া দৌড়ে গিয়ে তাকে ধরে, মিলিটারিদের উদ্দেশ্য কেঁদে কেঁদে বললো, ‘স্যার, ও করেনি। আমাদের কেউ করেনি। প্লিজ স্যার, ওকে মারবেন না।’

রিহান সুফিয়ার কাঁধে হাত রেখে হাসলো। তারপর বললো, ‘এটাই আমাদের নিয়তি। যা ঘটার ঘটবেই। আজ সেই দিন। তুমি আটকাতে পারবে না কোনোকিছু। আর কুকুরদের কাছে বৃথা অনুরোধ করো না।’

সুফিয়া রিহানকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো, ‘আমাদের ছেড়ে যাবেন না প্লিজ।’

ইউসুফ বাবার হাত ধরে বললো, ‘বাবা, আমার অপরাধটা নিজের ঘাড়ে নেবেন না। ওদেরকে বলুন, আমিই করেছি সব।’

‘না বাপ। আমাদের ভবিষ্যতটা এভাবেই লেখা। ওরা আমাকে গুলি করলে আমি মরবো না। আমার সময়ে ফিরে যাবো কেবল।’

আরেকটা বন্দুকের নলের বাড়ি এসে পড়লো রিহানের মাথায়। রিহান নিচে পড়ে গেল। বাইরের রাস্তায় লোকজনের ভিড় বাড়তে লাগলো। ঘটনা দেখতে এসেছে ওরা। মিলিটারিরা রিহানকে ভারী বুট দিয়ে লাথি মারতে লাগলো। তা দেখে সুফিয়া ইউসুফকে ধরে কাঁদতে লাগলো। মার খেতে খেতে রিহান সুফিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘সুফিয়া, কেঁদো না। এই দিনটা যে আসবে, তা তুমি জানতে। এ দিনটার মুখোমুখি হতে তোমাকে বেশ কয়েকদিন ধরে প্রস্তুত করিয়েছি। শক্ত হও সুফিয়া, শক্ত হও। তুমি জানো যে, ওরা আমাকে মারতে পারবে না। কেবল সময়টা পরিবর্তন করতে পারবে। তুমি ভবিষ্যতে আমার সাথে দেখা করবা। আবার দেখতে পাবে আমাকে।’

‘কিন্তু, আপনি তো আর আমাকে দেখতে পাবেন না কখনও। এটাই শেষ দেখা।’ দৌড়ে গিয়ে রিহানের পাশে বসে পড়লো সুফিয়া। মিলিটারিরা ওকে সরিয়ে দিলো। তারপর রিহানকে হাঁটুগেড়ে বসিয়ে বন্দুক তাক করলো কপালে। রিহান ভয় পেল না। হাসলো। ওর হাসি দেখে বন্দুক তাক করা মিলিটারিটা রেগে গিয়ে বুকে জোরে লাথি মারলো। রিহান পড়ে গেল। বুক ঝাড়তে ঝাড়তে আবার হাটুঁগেড়ে বসে হাসলো। উর্দুতে বললো, ‘তোদের মতো কুকুর আমাকে মারতে পারবি না। শুধু আমার ভালোবাসার কাছ থেকে আলাদা করতে পারবি।’

সুফিয়ার দিকে তাকালো রিহান। সুফিয়া তার দিকে তাকিয়ে অবিরাম কেঁদে চলেছে। রিহান মাথা নেড়ে তাকে কাঁদতে নিষেধ করলো। একটু পর মিলিটারির হাতের বন্দুকটা গর্জে উঠলো। সাথে সাথে জোরে চিৎকার দিয়ে উঠলো সুফিয়াও। রিহান ঢলে পড়লো মাটিতে। ইউসুফ আর সুফিয়া দৌড়ে গেল রিহানের পাশে। রিহান পড়ে গিয়ে শক্ত করে ধরলো সুফিয়ার হাত। তারপর চোখ বুজে গেল তার। সুফিয়ার কান্নায় আকাশ-বাতাসটাও কেঁপে উঠতে লাগলো তখন।

একটা পুলিশ-ভ্যান এলো লাশ নিতে। লাশটা কয়েকজন মিলে ওরা ভ্যানে তুললো। তারপর ভ্যান থেকে যখন নেম ভেতরে তাকলো, চমকে উঠলো ওরা। লাশ নেই। জোরে চিৎকার দিয়ে উঠলো একজন উর্দুতে, ‘স্যার, লাশ গায়ের হয়ে গেছে।’

চিৎকারটা শুনে সবাই দৌড় দিলো ওদিকে। সুফিয়া কান্না থামিয়ে মাথা তুলে তাকালো। কিছুটা স্বস্তি ফিরে পেল সে। সামনে রিহানের শরীরের রক্তগুলো মাটিতে জমে ছিল। অদ্ভুতভাবে রক্তগুলো তার চোখের সামনে থেকে মুছে যেতে লাগলো। মনে মনে সে বললো, ‘রিহান, যেখানে থাকো, ভালো থাকো।’

‘কী ভাই একটা চা খাইতে এতক্ষণ লাগে? আর ওদিকে ওইভাবে তাহায় আছেন ক্যান? ওইহানে কোনো গাড়ি নাই কইলাম তো। মাথাডা গ্যাছে নাহি আপনের? দিনে-দুপুরে আর কী কী দ্যাহেন কে জানে?’

‘এ্যাঁ…’ টংয়ের দোকানদারের কথায় ঘুরে তাকালো রিহান। হাতে একটা চায়ের কাপ। কাপটা তো সে অতীতে যাওয়ার আগে ফিরিয়ে দিয়েছিল মনে হয়, এখন আবার হাতে এলো কেমনে? তারমানে তখন ফিরিয়ে দেয়নি। এখন কাপটা ফিরিয়ে দিয়ে সে ঘড়িতে টাইম দেখলো। ঠিক বিশ মিনিট পার করেছে সে এতক্ষণে। দোকানদারকে চায়ের দামটা দিয়ে ঘরের দিকে হাঁটলো রিহান। সুফিয়ার কথা ভাবলো সে। সুফিয়া হয়তো এখন তাকে হারিয়ে উঠোনে হাত চাপড়াতে চাপড়াতে কান্না করছে। ইউসুফ আর রহিম মিয়াও হয়তো কান্না করছে তার জন্য। ইউসুফের কারণেই যে সে পুনরায় অতীত থেকে ফিরে আসে, সেটা ইউসুফ কখনও বেঁচে থাকতে বলেনি তাকে। কেন বলেনি সেটা সে জানে না। হয়তো অপরাধবোধ থেকে বলেনি। ওরা এখন অতীতে তাকে হারিয়ে কান্না করছে। আর এদিকে রিহান তাদের শূন্যতায় মানিয়ে নিতে চেষ্টা করবে বাকিটা জীবন। যদি জীবনে আরেকটা মিরাকল ঘটে। যদি কোনোভাবে সুফিয়ার সাথে আবারও দেখা হয়ে যায় তার! এমনটা হয়তো হবে না আর কখনও। সুফিয়া তার পুরো অস্তিত্বে মিশে গেছে, এখন সুফিয়া আর নেই। আনমনে ওর কথা ভাবতে ভাবতে হাঁটতে লাগলো রিহান। সুফিয়ার জন্য খুব কষ্ট হতে লাগলো তার।

[[সমাপ্ত]]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here