টুয়েন্টি মিনিটস (চ্যাপ্টার-০৩),১৫,১৬

টুয়েন্টি মিনিটস (চ্যাপ্টার-০৩),১৫,১৬
লেখা: ShoheL Rana
পর্ব:-১৫

১৯৬৫ সালের ২০ই জুলাই। রিহানের অতীতে আসার প্রায় একবছর দুইমাস হতে চললো। এই একবছর দুইমাসে সে ভালোই সময় কাটিয়েছে অতীতে। সুফিয়াকে নিয়ে ঘনঘন এদিক-ওদিক যাওয়া হলেও, এখন তেমন যেতে পারে না। কারণ, সুফিয়া এখন প্রেগন্যান্ট। তাদের ইকবাল খুব শীঘ্রই আসতে চলেছে।

সুফিয়ার কক্ষে ঢুকলো রিহান। সুফিয়া বিছানায় শোয়া অবস্থায় ছিল। রিহানকে দেখে উঠে বসে জিজ্ঞেস করলো, ‘কোথাও যাচ্ছেন না-কি?’

‘হ্যাঁ, বের হতে চাচ্ছি একটু। গফরগাঁও যাবো। ইউসুফকেও সাথে নিতে চাচ্ছি।’

‘কিন্তু, আমার এ অবস্থায় আপনারা দুজন ওদিকে চলে গেলে এদিকটা কে দেখবে?’

‘চলে আসবো তো সন্ধ্যা হতে হতে। কেন যাচ্ছি জানো?’

‘কেন?’ মৃদু হেসে আগ্রহ প্রকাশ করলো সুফিয়া।

‘শুনলে তো তোমারও যেতে ইচ্ছে করবে। এ অবস্থায় তো যেতে পারবে না। থাক, না বলি তোমাকে।’ বলেই উঠে চলে যেতে চাইলে সুফিয়া তার হাত ধরে বলে, ‘না, না, বলুন আপনি…’

রিহান বুঝলো সুফিয়া কথাটা বের না করে তাকে যেতে দেবে না, তাই ওর উত্তেজনাটা আরেকটু বাড়াতে রিহান বললো, ‘থাকগে বাদ দাও, শুনতে হবে না। শুনলে মন খারাপ হবে তোমার, যেতে পারবে না বলে।’

সুফিয়া রিহানের হাতটা আরও শক্ত করে ধরে হেসে হেসে বললো, ‘মজা করবেন না। বলতে বলছি?’

‘না, শুনে মন খারাপ হবে। আমার পাখিটার মন খারাপ হোক, আমি চাই না।’ বলেই আলতো করে সুফিয়ার গাল টেনে দিলো রিহান। সুফিয়া এবার বাচ্চাদের মতো হাত-পা ছুড়ে বায়না ধরলো, ‘ইইই, বলতে বলছি। খুব খারাপ হবে কিন্তু না বললে।’

রিহান তার অবস্থা দেখে হাসতে হাসতে বললো, ‘হয়েছে হয়েছে। আমার বাচ্চা একটা বউ।’ সুফিয়ার থুতনি ধরে আলতো করে নাড়া দিলো রিহান।

‘বলেন এবার…’

‘আজকে কয় তারিখ জানো? ২০ই জুলাই। শুনেছি, এই দিনে রহমান সাহেবের জন্ম হয়েছে।’

‘কোন রহমান?’ ভ্রু কুঁচকালো সুফিয়া। ঠিক যেন মনে করতে পারছে না সে নামটা।

‘আরে তোমার শ্বশুর। আমার বাবা রহমান সাহেব।’

এবার সুফিয়ার মুখটা হা হয়ে গেল। তারপর আবার বায়না ধরে বললো, ‘এই না, না, আমিও যাবো। দেখবো, আমার পিচ্চি শ্বশুর সাহেবকে।’

‘তুমি আপাতত আমাদের ইকবালের যত্ন নাও, কেমন?’ সুফিয়ার পেটে শাড়ির উপর আলতো করে চুমু খেলো রিহান। সুফিয়া ‘এ্যা এ্যা’ করতে লাগলো। তারপর মিষ্টিসুরে শাসিয়ে বললো, ‘তাড়াতাড়ি ফিরবেন কিন্তু। আমাকে ছাড়া অতো ঘোরাঘুরি করতে হবে না। দেখেই চলে আসবেন।’

‘সন্ধ্যায় ফিরবো আমরা বাপ-ছেলে মিলে।’

‘ইউসুফ কই? ও তো নাই মনে হয়?’

‘ও হয়তো বাইরে আছে। স্টেশনে পাবো ওকে।’ বলেই দরজার দিকে এগোলো রিহান। পেছন থেকে সুফিয়া বললো, ‘সাবধানে যাবেন। ওখানে গিয়ে আবার ওদের সাথে ঝগড়া কইরেন না। কেমন?’

‘ধুর না, কী বলো? ওরা আমার পূর্বপুরুষ। ওদের সাথে কি ঝগড়া করতে পারি? একটু মজা করি আরকি।’ ফিরে তাকিয়ে বললো রিহান।

‘ওরা তো আর জানে না আপনি ওদের বংশধর। আপনি মজা করতে গিয়ে ওরা যদি আপনাকে মারতে আসে তখন?’

‘তার চেয়েও তো বেশি করেছিল। আমাকে ব্রিটিশদের হাতে ধরিয়ে দিতে চেয়েছিল, ভুলে গেছ? আমি পরে তোমাদের ওখানে পালিয়ে গিয়েছিলাম রাতে।’

‘হুমম, তাই বলছি বুঝেশুনে কথা বলবেন ওদের সাথে।’

‘ঠিক আছে, সাবধান করার জন্য ধন্যবাদ।’ বলেই রিহান বেরিয়ে গেল।

গেইট থেকে বের হওয়ার সময় রহিম মিয়া জিজ্ঞেস করলো, ‘স্যার, কোনোহানে যাইতাছেন?’

‘হ্যাঁ, তোর জন্য বউ দেখতে যাচ্ছি একটা। যাবি সাথে?’

‘যাহ্, কী যে কন না স্যার? আমারে বউ দিবো কেডা?’

‘আরেকজনের বউ তোরে দিবো কেন? বিবাহিত মেয়েদের দিকে চোখ দিস না-কি?’

‘তওবা! তওবা! দাঁত দিয়ে জিভ কামড়ে দুগালে আলতো করে চড় খেলো রহিম মিয়া। ‘আপনে স্যার খালি মজা করেন আমার লগে।’

‘মজা করবো কেন? এত বয়স হচ্ছে তুই বিয়ে করছিস না কেন বলতো? কিছুদিন পর আমার ছেলেকে বিয়ে করাবো।’

‘আপ্নেরা যদি একটু নজর দিতেন তয় আমার বিয়াডা হইয়া যাইতো এত্তদিনে। আপ্নেরা তো নজর দ্যান না?’

‘তোর গ্রামের বাড়ি যেন কই রে? ওখানে বাবা-মা কেউ নেই?’

‘মুন্সিগঞ্জে গ্রামের বাড়ি। মা বাবা কেউ বাঁইচ্চা নাই স্যার। আমার ছোডোকালে মইরা গেছে। এক চাচা আছিলো, উনার কাছে থাকতাম, তয় আমারে তেমন পছন্দ করতো না ওরা। একদিন সব থুইয়া এইহানে চইলা আসি। এক গেরস্তের বাড়িত থাকতাম, ওদের গরু-মহিষ দ্যাহাশোনা করতাম, ওরা তিনবেলা খাওন দিতো। ওইহান থেকে সুফিয়া ম্যাডাম একদিন লইয়া আসে আমারে। আইজ দশ বছর ধইরা এই বাড়িতে থাহি। ম্যাডাম আমারে খাইতে পরতে দেয়, ট্যাহাও দেয়।’

‘কত টাকা জমাইছিস? বিয়ে করার মতো টাকা হয়ছে তো?’

‘হয়ছে। আপ্নেরা একটা মাইয়া দ্যাহেন।’ রহিম মিয়া এবার লজ্জা পেল।

‘ওরে বিয়ের কথা বলিস, আবার লজ্জাও পাস? তা কেমন মেয়ে পছন্দ তোর?’

‘আপ্নেরা যেমন আইনা দিবেন।’ মাথা নিচু করে বললো রহিম মিয়া।

গেইট দিয়ে তখন ভেতরে ঢুকলো ইউসুফ। সে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী নিয়ে কথা হচ্ছে? রহিম ভাই কী এনে দেয়ার কথা বলছে?’

‘রহিম মিয়া বিয়ে করতে চায়। দেখো… দেখো… কীভাবে লজ্জা পাচ্ছে সে… হা হা হা।’ হেসে ওঠলো রিহান। রহিম মিয়া লজ্জায় আর মুখ উপরে তুলতে পারলো না। ইউসুফ বললো, ‘হ্যাঁ, রহিম ভাইয়ের বয়স বেড়ে যাচ্ছে, একটা বিয়ে করা উচিত তার।’

রহিম মিয়া এবার আরও বেশি লজ্জা পেল। রিহান তার মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বললো, ‘ওরে বাবা, লজ্জায় মুখ তুলতে পারছে না৷ একেবারে। আমরা পরে তোমার জন্য পাত্রী দেখতে যাবো। এখন আপাতত আমি আর আমার ছেলে একটু ঘুরতে যাবো।’

‘কই যাবো বাবা?’ প্রশ্ন করলো ইউসুফ।

‘গফরগাঁও যাবো। রেডি হয়ে আসো। তোমার মা বলেছে সন্ধ্যার আগে ফিরতে হবে।’

আচ্ছা, আমি এখনই আসছি।’ বলে ইউসুফ ভেতরে গেল দ্রুত।

মিষ্টির দোকান থেকে তিনকেজি মিষ্টি নিয়ে রিহান তার দাদা বাড়িতে এলো ছেলেকে নিয়ে। দুপুর হয়ে গেছে ততক্ষণে। দাদা বাড়িতে এসেই রিহান প্রথমে দেখলো ইউনুস সাহেবকে। তাকে দেখেই সে নিজে নিজে বলে উঠলো, ‘এই লোকটার কি কোনো কাজকাম নেই। সারাক্ষণ দেখি ঘরেই থাকে।’

‘লোকটা কে বাবা?’ প্রশ্ন করলো ইউসুফ।

‘তুমি আজকে তোমার দাদাকে দেখতে আসছো না? যে আজকে জন্মগ্রহণ করেছে? উনি হচ্ছেন তোমার সেই দাদার দাদা। সবসময় দেখি ঘরেই থাকে লোকটা।’

ইউসুফ বললো, ‘বাবা, আজ ওদের বাড়িতে নতুন মেহমান এসেছে, এই খুশির সময়ে তো লোকটা ঘরেই থাকবে। তাই না?’

‘হ্যাঁ, তাই তো! চলো, গিয়ে কথা বলি।’

রিহান মিষ্টির প্যাকেট হাতে নিয়ে এগিয়ে গেল ইউনুস সাহেবের দিকে। কাছাকাছি এসে সে ইউনুস সাহেবের উদ্দেশ্যে বললো, ‘আংকেল, চলে আসছি আমরা। এই নিন, এটা ধরুন।’

‘তুমি! তুমি কোথা থেকে? আর এসব কী?’ রিহানকে দেখে অবাক হলেন ইউনুস সাহেব। রিহান বললো, ‘মিষ্টি। মিষ্টি এনেছি আপনাদের জন্য।’ বলেই একটা প্যাকেট খুলে হাতে একটা মিষ্টি নিয়ে জোর করে ইউনুস সাহেবের মুখে ঢুকিয়ে দিলো। উনি সেই মিষ্টিটা চাবাতে চাবাতে আর কথা-ই বলতে পারলেন না। রিহান প্যাকেট থেকে আরেকটা মিষ্টি নিয়ে ইউসুফকে দিয়ে বললো, ‘তুমি একটা খাও।’

ইউসুফ খেতে শুরু করলো। রিহান আরও একটা মিষ্টি তুলতে তুলতে বললো, ‘আমিও একটা খাই।’ বলেই একটা মিষ্টি মুখে পুরে দিলো সে। ততক্ষণে ইউনুস সাহেবের মুখের মিষ্টিটা খাওয়া শেষ। তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি হঠাৎ মিষ্টি-তিষ্টি নিয়ে কোথা থেকে এলে?’

রিহান হাত-মুখের ইশারায় বুঝিয়ে দিলো, আগে সে মিষ্টি খাওয়াটা শেষ করুক, তারপর বলবে। মিষ্টি খাওয়া শেষ হলে সে বললো, ‘আজ আপনার প্রথম নাতির জন্ম হয়েছে। তাই মিষ্টি এনেছি।’

‘কিন্তু এখনও তো বাচ্চা হয়নি।’

রিহান এবং ইউসুফ পরস্পরের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করলো। আজকেই তো হওয়ার কথা। হয়নি কেন? কোথাও কি ভুল হলো? রিহান বুঝে উঠতে পারলো না। ইউনুস সাহেব বললেন, ‘এখনও হয়নি। আমার ছেলে ইউসুফ ধাই আনতে গেছে।’

হাসলো রিহান, ‘ওহ, তারমানে ঠিক সময়েই এসে গেছি আমরা। তাহলে আপনার ছেলে ইউসুফ ধাই ডেকে আনুক। আমি আর আমার ছেলে ইউসুফ অপেক্ষা করি। বাচ্চার মুখ দেখেই আজকে যাবো। আর মিষ্টিটা কিছুসময় আগেই খেয়ে ফেলেছি, সমস্যা নেই। রহমানের জন্ম হলে আরেকটা করে খাবো।’

‘রহমান কে আবার?’ প্রশ্ন করলেন ইউনুস সাহেব।

‘আপনার নাতি। আপনার নাতির নাম রাখা হবে রহমান।

‘এই তুমি এসব আগাম কথা কী করে বলো, একটু বলো তো? সাহারার জন্মের সময়ও তুমি এমন কথা বলেছিলে, আজ যখন সাহারার বাচ্চা হবে তখনও এরকম কথা বলছ, আর তোমার কথা সত্যিও হয়ে যায়। কীভাবে?’

‘আমি সেই সময় বলেছিলাম মনে হয় আমি ভবিষ্যত থেকে এসেছি? এখনও বিশ্বাস হয় না তাই না?’

‘ধুর! তুমি না আসলেই পাগল। যাদু-টাদু জানো মনে হয়।’

‘না, ওসব যাদু-টাদু জানি। আংকেল, আমাদের বাপছেলের খুব খিদে লাগছে। কিছু খাইতে দিবেন’

ইউনুস সাহেব রেগে গিয়ে ইউসুফকে দেখিয়ে বললেন, ‘এত বড়ো একটা দামড়া ছেলে আছে তোমার, আর তুমি আমাকে আংকেল ডাকতেছ? ধরো, তোমাদের মিষ্টি তোমরা খেয়ে খিদে মিটাও।’

‘মিষ্টি খেয়ে কি খিদে মেটানো যায়? আর এতগুলো মিষ্টি খেলে ভেতরটা জ্বলবে। তাই একটু ভাতের ব্যবস্থা করেন।’

সেই মুহূর্তে ইউনুস সাহেবের ছোটো ভাই খিজির সাহেব এসে বললেন, ‘কারা এরা? এই লোকটাকে তো চেনা চেনা লাগে। কে ইনি?’ রিহানকে ইশারায় দেখালেন খিজির সাহেব। ইউনুস সাহেব বললেন, ‘আরে ইনি ওই লোকটা আমাদের ঘরে যে থাকতো বিশ-বাইশ বছর আগে, ভবিষ্যত থেকে এসেছে বলেছিল যে সে।’

‘ওহ হ্যাঁ, সে সে… আমাদের সাহারার জন্মের সময় ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল, সেটা সত্যি হয়েছিল। তা আজকেও ওরকম কিছু বলেছে না-কি?’

‘বলেছে মানে? বাচ্চার নামসুদ্ধ বলে দিয়েছে, রহমান।’

‘সত্যি? কী আশ্চর্য! এই নামটা তো আমি মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম, যদি ছেলে হয় তবে তার নাম হবে রহমান।’

‘সত্যি তুই এই নামটা ভেবেছিস?’ নরম স্বরে প্রশ্ন করলেন ইউনুস সাহেব।

‘হ্যাঁ। কিন্তু এই লোকটা এসব জানলো কী করে? গণক না-কি?’

‘না, না, আমি গণক নই। কিছু খেতে দিলে উপকৃত হবো। আমাদের বাপ-ছেলের খিদে লাগছে।’

‘বেশ! চলো, আমার ঘরে চলো খেতে।’ খিজির সাহেব ওদেরকে নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন। পাশের ঘরে মহিলাদের চিৎকার চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে। সাহারা চিল্লাচ্ছে। তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে সবাই। একটু পর একজনকে বলতে শোনা গেল, ‘ধাইমা এসেছে, সবাই সরো সরো…’

[[চলবে…]]

টুয়েন্টি মিনিটস (চ্যাপ্টার-০৩)
লেখা: ShoheL Rana শামী
পর্ব:-১৬

খাওয়া শেষ করে রিহান ও ইউসুফ যখন বের হলো, তখন অন্য ইউসুফের ঘর থেকে বাচ্চার আওয়াজ শোনা গেল। রিহান তার ছেলে ইউসুফকে নিয়ে ওদিকে এগিয়ে গেলে, আবারও ইউনুস সাহেব সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি কি আসলেই জ্যোতিষী? আমার ইউসুফের ছেলে হয়েছে।’

রিহান বললো, ‘তাহলে চলুন মিষ্টিমুখ করি আবার। মিষ্টির প্যাকেটগুলো কই?’

‘অদ্ভুত লোক তুমি। শুনো, আজকে আমার ঘরে একটা খুশির উৎসব চলছে আমার নাতির আগমন উপলক্ষে। তুমিও থাকো, কিন্তু বেশি উলটাপালটা কথা বলো না।’

‘আমাকে একটু দেখতে দেবেন না আপনার নাতিকে?’

‘হ্যাঁ, দেখতে পারবা, ওই ঘরে তো এখন পুরুষ লোক যেতে পারবে না, একটু অপেক্ষা করো।’

‘ঠিক আছে আংকেল।’

ইউনুস সাহেব চোখ রাঙিয়ে বললেন, ‘তুমি আর শোধরাবে না।’

রিহান মৃদু হাসলো। পাশে খেয়াল করে দেখলো, ইউসুফ নেই। সে হয়তো ভেতরে গিয়ে বাচ্চার চেহারা দেখতে চাইছে। রিহান তার নাম ধরে ডাকলো, ‘তখন একসাথে ভেতর থেকে দুই ইউসুফ বের হয়ে এলো।

‘কী ব্যাপার, তুমি এখানে? এখানে কী করছো? আর আমাকে ডাকলে কেন?’ রিহানকে জিজ্ঞেস করলো তার ইউসুফ দাদা।

‘আমি তোমাকে ডাকিনি তো, আমার ছেলেকে ডেকেছি। আমার ছেলের নামও ইউসুফ, বলেছিলাম মনে হয়? ওই যে তোমার পেছনে আমার ছেলে ইউসুফ।’ রিহান তার ছেলেকে দেখিয়ে দিলো পেছনে। তারপর বললো, ‘ইশ! এখন যেহেতু দুইটা ইউসুফ হয়ে গেল, তাই বয়স হিসেবে তুমি ইউসুফ-১, আর আমার ছেলেকে ইউসুফ-২ বলি। তাহলে আর সমস্যা হবে না। কী বলো ইউসুফ-২?’

বাবার কথা শুনে হাসলো ইউসুফ-২। তারপর বললো, ‘বাবা, উনাদেরকে আর জ্বালিয়েন না। চলেন, বাচ্চার চেহারাটা দেখে আমরা চলে যাই।’

‘তা তো দেখবো বাবা। তার আগে বাচ্চার বাবা থেকে জিজ্ঞেস করি, উনি খুশি কি না।’

ইউসুফ-১ বললো, ‘হ্যাঁ, আমি খুশি। কিন্তু তোমরা এখানে কেন হঠাৎ। কী কারণে এলে?’

‘আরে, খালি হাতে আসিনি। তিনকেজি মিষ্টি নিয়ে এসেছি বাচ্চার চেহারা দেখবো বলে। মিষ্টিগুলো তোমার বাবার হাতে দিয়েছিলাম, এই যে ইউনুস আঙ্কেলের হাতে। কিন্তু উনি সব খেয়ে বসে আছেন। এখন বাচ্চার চেহারা দেখে যে একটু মিষ্টিমুখ করবো, একটা মিষ্টিও পাচ্ছি না।’

পাশে ইউনুস সাহেব দাঁড়িয়েছিল। রিহানের কথা গায়ে লেগেছে তার। তাই বললো, ‘সব মিষ্টি আমি খাইছি মানে। বাচ্চা-কাচ্চারা ছিল ওদিকে, তাদেরকে দিয়ে দিয়েছি।’

‘হয়ছে, আর বলতে হবে না। ওদিকে কোনো বাচ্চা-কাচ্চা ছিল না, আমি দেখেছি। তিন..তিনকেজি মিষ্টি, কীভাবে একা সাবাড় করতে পারলেন উনি আমার বোঝে আসছে না।’

রাগে ইউনুস সাহেবের মুখ দিয়ে কথা-ই বের হলো না। কয়েক মুহূর্ত পর নিজেকে সামলিয়ে ছেলের উদ্দেশ্যে বললো, ‘ইউসুফ, যা তো, এই দুই লোককে তোর বাচ্চাটা দেখিয়ে আয়, তারপর বিদায় কর।’

রিহান বললো, ‘এখন তো বিদায় করতে পারলেই বাঁচেন। একসময় তো আমার খুব খোঁজ করেছিলেন।’

‘কখন তোমার খোঁজ করলাম আমরা?’

‘ওই যে, আপনাদের এক আত্মীয়ের বদলে যখন আমাকে ব্রিটিশদের হাতে ধরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করছিলেন, সেই রাতে আমি পালিয়ে গিয়েছিলাম, তখন আমাকে খুঁজে না পেয়ে কী যে চিন্তা হয়েছিল আপনাদের সবার। চিন্তা হয়নি?’

‘কী যা-তা বলছো?’ ইউনুস সাহেব মুখ ঘুরিয়ে চলে গেলেন।

এবার ইউসুফ-১ কৌতুহল হয়ে বললো, ‘এই দাঁড়াও, দাঁড়াও, তুমি সে না? ছোটোবেলায় দেখেছিলাম।’ বলেই রিহানকে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। তারপর বললো, ‘হ্যাঁ, মনে পড়েছে, তুমিই সে।’

‘হ্যাঁ, আমিই সে,৷ তোমাকে এক পয়সা দেবো বলে দিতে পারিনি। তখন পয়সা ছিল না, এখন আছে। দাঁড়াও, এক পয়সাটা এখন শোধ করি।’ বলেই পকেট থেকে এক পয়সা বের করে ইউসুফ-১-এর দিকে বাড়িয়ে দিলে, সে বললো- আমাকে কি দেখে এক পয়সার লোক মনে হয়?’

‘আরে আমি তো তোমার পাওনা পয়সাটা শোধ করতে চাইছি। তখন করতে পারিনি, এখন করছি।’

‘লাগবে না। আসো, বাচ্চা দেখতে চাইছিলা না, দেখে চলে যাও।’

‘ঠিক আছে, চলো দেখে আসি। ইউসুফ চলো।’ ছেলেকেও ডাকলো রিহান। ওই সময় মসজিদের হুজুর এলো নবাগত বাচ্চার কানে আজান দিতে। বাচ্চাকে আতুড়ঘর থেকে অন্য ঘরে আনা হলো। হুজুর বাচ্চাকে কোলে নিয়ে ডান কানে আজান ও বাম কানে ইকামত দিয়ে দোয়া পাঠ করলো, তারপর বাচ্চাটা ফিরিয়ে দিলো বাবার কাছে। বাড়ির অন্যান্য পুরুষরাও এবার বাচ্চার মুখ দেখতে এলো। ইউনুস সাহেবও এলেন। তিনি ছেলে ইউসুফের কোল থেকে বাচ্চাটা কোলে নিয়ে আদর করতে লাগলেন। তখন রিহান বললো, ‘হয়ছে, একজনে এতক্ষণ আদর করলে আমরা কখন করবো? দেন, আমার কোলে দেন একটু।’ বলেই রিহান কোলে নিলো। এক অকল্পনীয় ঘটনার সাক্ষী হলো সে। ছেলের কোলে বাচ্চা বয়সী বাবা। এই বাচ্চাটা একদিন বড়ো হবে, বিয়ে করবে, তারপর তারও একটা বাচ্চা হবে, সেই বাচ্চাটাই এখন তাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কী অদ্ভুত! মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলো রিহান তার বাচ্চা বয়সী বাবার দিকে। এমনভাবে চেয়ে রইলো, যেন তার হুঁশ নেই। যখন তার ছেলে ইউসুফ গা ধরে নাড়া দিয়ে ‘বাবা’ বলে ডাকলো, তখন সজ্ঞানে ফিরে এলো সে। রিহান ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললো, ‘তুমি কোলে নিবা একটু তোমার দাদাকে?’

‘না বাবা, হাত ফসকে পড়ে যেতে পারে।’

পাশ থেকে ইউসুফ-১ রেগে বললো, ‘এই এই, দাদা মানে কী? আমার বাচ্চা ছেলেকে তোমার দামড়া ছেলের দাদা বানিয়ে দিলে?’

‘আরে, ওটা আদর করে বলেছি। নাও, তোমার ছেলেকে। মাশা-আল্লাহ অনেক সুন্দর। আমিও বাচ্চা বয়সে এমন ছিলাম।’ বলেই বাচ্চাটা বাবার কোলে ফিরিয়ে দিলো রিহান। তারপর ঘরের সব পুরুষকে একবার দেখে নিয়ে বললো, ‘আহ্, মিষ্টিমুখ না করেই সবাই বাচ্চার মুখ দেখছে। আমি এতগুলো মিষ্টি আনছিলাম। কিন্তু একজনে সব খেয়ে ফেলছে। কী করে পারলেন তিনি এতগুলো লোকের হক খেতে?’ যার উদ্দেশ্যে রিহান কথাটা বললো, সে ঠিকই বুঝে গেছে। ইউনুস সাহেবের মুখটা হা হয়ে গেল। রিহানের উপর রাগ বেড়ে গেল তার আরও। কিন্তু কিছুই বললো না। বললে হয়তো রিহান আরও যা নয় তা বলবে। দরকার নেই কথা বাড়ানোর। রিহান ইউনুস সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘এভাবে হা করে আছেন কেন আংকেল? নাতি পেয়েছেন, খুশি হোন, আনন্দ করেন। আর আমরা তাহলে আজকে যাই। কেমন?’

‘যাও।’ ইউনুস সাহেব যেন এতক্ষণে হাফ ছেড়ে বাঁচলেন।

‘ইউসুফ, চলো। আমরা চলে যাই।’ বলেই ছেলেকে নিয়ে বের হয়ে এলো রিহান।

ফাউগান গ্রামের কাছাকাছি আসতে আসতে বিকেলের শেষ প্রায়। মাঝপথে রাস্তা অবরোধ, গাড়ি আর ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে না মিলিটারিরা। তাই অনেকটা পথ আগেই নেমে যেতে হলো গাড়ি থেকে। বাকিটা পথ হেঁটেই যেতে হবে। একজনের কাছে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, আজকে বিশাল একটা মিছিল বের হয়েছিল কয়েকগ্রাম মিলে। পাকিস্তান সরকারের যত অনিয়মের বিরুদ্ধে মিছিল। সেই মিছিলে মিলিটারিরা গুলি করে এলোপাতাড়ি। এখন পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যস্ত ওরা।

রিহান ও ইউসুফ কিছুদূরে হেঁটে গেলে দুজন মিলিটারি তাদের বাঁধা দেয়। সামনে আর যাওয়া যাবে না। আরও বেশ কয়েকজন মিলিটারি হাতে লাঠি হাতে উত্তেজিত জনতাকে সামাল দিচ্ছে। জনতার মাঝে কথা ছড়িয়ে গেল, মিলিটারির গুলিতে তিনজন নিহত হয়েছে। আরও ছয়জন গুরুতর আহত। কিছু লোক দূর থেকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, আর কিছু লোক উত্তেজিত হয়ে মিলিটারিদের গালাগালি করছে। ঝাঁপিয়ে পড়ার চেষ্টা করছে ওদের উপর। একটা মিলিটারির গাড়ি এসে থামলো। আরও কয়েকজন মিলিটারি মিলে ধরে ধরে লাশ তুলতে লাগলো সেই গাড়িতে। তিনটা নয়, চার-চারটা লাশ। লাশ গাড়িতে তোলার সময় উত্তেজিত লোকগুলো গাড়ির দিকে তেড়ে এলো। তখন লাঠিহাতে মিলিটারিরা ইচ্ছেমতো লাঠি চালাতে লাগলো ওদের উপর। রাগে ফুঁসতে লাগলো রিহান। তারপাশে ইউসুফও যেন সুযোগ খুঁজছে কিছু একটা করার। একটা পাথর খুঁজে নিয়ে সে একটা মিলিটারিকে লক্ষ্যবস্তু করলো। তারপর জোরে ছুঁড়ে মারলো পাথরটা। পাথরটা গিয়ে পড়লো ওই মিলিটারির মাথার পেছনের অংশে। সাথে সাথে সে হাতের লাঠিটা ফেলে দিয়ে মাথা চেপে ধরলো চিৎকার করে। উর্দুতে কী যেন একটা গালি দিয়ে ঘুরে তাকালো পেছনে। রিহান ইউসুফকে নিজের আড়ালে করে ফেললো সাথে সাথে।

[[চলবে…]]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here