টুয়েন্টি মিনিটস (চ্যাপ্টার-০৩),১৩,১৪

টুয়েন্টি মিনিটস (চ্যাপ্টার-০৩),১৩,১৪
লেখা: ShoheL Rana
পর্ব:-১৩

ভোরের কোমল আলোয় হাঁটতে বের হলো দুজন। একটা কোমল হাওয়া বয়ে চলেছে পরিবেশে। সড়কের দুপাশের গাছগুলো হালকা বাতাসে নড়ছে। পাখিরা ডাকাডাকি করছে সুমিষ্ট সুরে। দুপাশের খেতগুলোতে কৃষকরা হালচাষে ব্যস্ত গরু আর লাঙল নিয়ে। অনেক ভোরে উঠেই এরা তাদের কাজ শুরু করে। সুফিয়াকে দেখে হাতনেড়ে সালাম দিয়ে নমনীয়তা দেখালো কৃষকরা। সুফিয়া তাদের উদ্দেশ্যে হাসিমুখে বললো, ‘খিদে লাগছে আপনাদের? রহিম এসে আপনাদের খাবার দিয়ে যাবে কিছুক্ষণ পর।’

ওরাও হেসে সৌজন্য দেখালো, ‘সমস্যা নাই। খাবার যহনি আইবো, আমরা খাইয়া নিমু।’

ধীরে ধীরে কোমল হাওয়ায় হাঁটতে লাগলো ওরা৷ পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় কয়েকজন জেলে সালাম টুকলো। রিহান প্রশ্ন করলো, ‘এরা তোমাকে খুব সম্মান করে তাই না?’

‘হ্যাঁ, এখানে এসে আমি অনেক সম্মান পেয়েছি। এদের ভালোবাসা পেয়েই হয়তো আমি কিছুটা স্বস্তি পেয়েছি আপনার শূন্যতার কষ্ট থেকে। দাদা মারা যাওয়ার আগে আমার বাবার ভাগের সম্পদগুলো আমার নামেই লিখে দেন। আমি চেয়েছিলাম আমাকে যেন ওখানেই জমি দেয়া হয়, কিন্তু আমার চাচা সেটা মানতে পারেননি, এখানের জমিগুলোই আমাকেই দেয়া হয়। দাদার মৃত্যুর পর এখানে আমি বাড়ি করি, তারপর একদিন চলে আসি। প্রথম প্রথম কষ্ট হলেও, এখন ভালোবেসে ফেলেছি জায়গাটাকে।’

‘চাচার ওখানে আর যাওনি তাই না?’

‘নাহ্, ওখানে আর যাওয়া হয়নি। কেন জানি সম্পত্তি ভাগের পর থেকে চাচা আর আমাকে খুব একটা পছন্দ করতেন না।’

‘এখানে আসার আগে আমি প্রথমে চাচার ওখানেই গিয়েছিলাম। চাচা তোমাকে মৃত মনে করেন এখন। তোমার কথা জিজ্ঞেস করলে উনি প্রথমে বলতে চাননি। পরে বলেছেন, তুমি মারা গেছ।’

সুফিয়া কিছু বললো না। কী বলবে আসলে ভেবে পেল না। চাপা কষ্টে শুধু ক্ষীণ একটা হাসলো। রিহান পুনরায় বললো, ‘এখন তো আমি এসেছি। আমার শূন্যতাটুকু তো এখন নেই। যতদিন আছি, হাসি-খুশিতে জীবন কাটাও।’

‘তারপর?’ গতি থামিয়ে রিহানের দিকে তাকালো সুফিয়া। রিহানও থামলো। সুফিয়ার প্রশ্নের জবাব নেই তার কাছে৷ সুফিয়া-ই জবাবটা দিয়ে দিলো, ‘তারপর আপনি চলে যাবেন, দ্বিগুণ শূন্যতা উপহার দিয়ে।’

‘ওই যে বললাম, নিয়তিই হয়তো এমনটা চাচ্ছে।’

‘হুমম… নিয়তি, আমার নিয়তিটাই খালি এমন।’ সামনে হাঁটতে লাগলো সুফিয়া। ‘আপনি চলে যাবেন, আমার কোলে ইকবাল আসবে। ইকবাল বড়ো হয়ে যখন জানতে চাইবে তার বাবা কোথায়, আমি কী জবাব দেবো?’

রিহান চুপ হয়ে রইলো। সুফিয়া তার একটা বাহু শক্ত করে ধরে হাঁটতে হাঁটতে বললো, ‘ইউসুফও প্রথম প্রথম জিজ্ঞেস করতো ওর বাবা কোথায়। বলতাম, মারা গেছে। পরে যখন আস্তে আস্তে ওর বুদ্ধি হতে লাগলো, ওকে সব খুলে বলি। ছেলেটা আমার সবকিছু বুঝেছিল। পরে সে-ই আমাকে সান্ত্বনা দিতো, আপনার অভাবটা বুঝতে দিতো না।’

রিহান চুপ করে শুনতে লাগলো সুফিয়ার কথা। সুফিয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে পুনরায় বললো, ‘আপনি যখন থাকবেন না, তখন আপনার দেয়া দুটি উপহারকেই আঁকড়ে ধরে কাটাবো বাকি জীবনটা। আর অপেক্ষা করবো ভবিষ্যতে গিয়ে আপনার দেখা পাওয়ার। আচ্ছা, ভবিষ্যতে কি আপনার সাথে আমার সময় কাটে?’

‘হ্যাঁ, আমরা একসাথে অনেক সময় কাটাই।’

‘স্বামী-স্ত্রী হয়ে কি থাকতে পারি আমরা?’

রিহান চুপ করে থাকে। সুফিয়া বুদ্ধিমতি, তাই বুঝে ফেলে। সে বলে, ‘কীভাবে স্বামী-স্ত্রী হয়ে থাকবো আমরা? আপনি তখন এইরকম তাগড়া জোয়ান থাকবেন, আর আমি হয়ে যাবো বুড়ি, গায়ের চামড়ায় ভাজ পড়বে, চুল পেকে যাবে, হয়তো কুঁজো হয়ে হাঁটবো৷ কী করে সম্ভব স্বামী-স্ত্রী হয়ে থাকার।’

রিহান সুফিয়ার শেষের কথাটা কাটিয়ে মাঝখানের কথাটার জবাব দিলো, ‘তুমি কখনও কুঁজো হয়ে হাঁটবে না। বয়স বাড়লেও তোমাকে এতটা বয়স্ক বলে মনে হবে না। চুল পেকে যাবে, কিন্তু শক্ত-সামর্থ্য থাকবে৷’

‘তাই?’

‘হুমম… তাই।’ মাথা ঝাঁকালো রিহান। রোদ উঠে গেছে ততক্ষণে। ওরা হাঁটতে হাঁটতে অনেকদূর চলে এসেছে। পরে ঘরের দিকে হাঁটা ধরলো। ঘরের কাছাকাছি এসেই এক লোককে দেখিয়ে সুফিয়া বললো, ‘আপনাকে একটা হিন্দু লোকের কথা বলেছিলাম না? যার পরিবারের সবাই কলকাতা চলে গেছেন। ইনিই সেই লোক।’

‘চলো, লোকটাকে ঘরে নিয়ে যাই। আমাদের সাথে খাবার খাবে আজ।’

তখন সুফিয়া লোকটার উদ্দেশ্যে ডাক দিলো, ‘কাকা, কেমন আছেন? চলেন আজকে আমাদের সাথে খাবেন।’

‘না, না, মা। আমি খেয়ে নিবো।’ হেসে সৌজন্য দেখালেন লোকটা। সুফিয়া রিহানকে দেখিয়ে বললো, ‘কাকা, আপনার ছেলে একটু পরিচিত হতে চায় আপনার সাথে। আসেন না, আপনার ছেলের সাথে বসে একবেলা খাবার খাবেন।’

‘ঠিক আছে মা, তোমরা যাও। আমি আসতেছি।’

‘আসবেন কিন্তু।’

লোকটা মাথা কাত করে সায় দিলো। সুফিয়া রিহানকে নিয়ে ঘরে ঢুকলো। হাতমুখ ধুয়ে সামনের কক্ষে বসলো রিহান। সুফিয়া খাবার সাজাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর ওই লোকটা এলো। রিহান তাঁকে চেয়ার দেখিয়ে বললো, ‘কাকা বসেন এখানে।’ একটা খাবারের প্লেট এগিয়ে দিলো রিহান। লোকটা হেসে বসলো। রিহান তাঁর নাম জিজ্ঞেস করলে, লোকটা তাঁর নাম বললো ‘হরেশ নাথ।’ রিহানও নিজের নাম বললে উনি তখন হেসে বললেন, ‘আমি আপনার সম্পর্কে প্রথমদিনই জানছি। আমাদের সুফিয়ার পতি আপনি।’

‘আমাকে দয়া করে ‘তুমি’ করেই বলুন। আপনার ছেলের মতোই তো আমি। নিন খাবার নিন।’ বলে নিজেই উনার প্লেটে খাবার বেড়ে দিলো রিহান। পরে দুজনে খেতে খেতে কথা বলতে লাগলো। রিহান কথাটা তুললো, ‘শুনলাম আপনার পরিবার কলকাতায় চলে গেছে কাকা?’

‘হ্যাঁ, বাবা। ওরা ওখানেই থাকে এখন।’

‘আসলে কী হয়েছিল কাকা?’

‘ওই কাশ্মীরে তোমাদের নবীর মাথার একটা চুল মসজিদ থেকে চুরি হয়ে গেছিল। চুরির দোষটা হিন্দুদের উপর চাপিয়ে দাঙা বাঁধায়। পরে চুলটা পাওয়া যায়। কোনো হিন্দু এ কাজ করেনি।’

‘হতে পারে কোনো একটা স্বার্থান্বেষী পক্ষ চেয়েছিল হিন্দু মুসলিমের দাঙা বাঁধাতে। আপনাদের উপর আক্রমণ হয়েছিল না-কি?’

‘হ্যাঁ, আমাদের ঘরবাড়ি ভেঙে দেয়। আমাদেরকে মারধর করে। আমার বৃদ্ধা ওয়াইফ ছিল অসুস্থ। তাকে লাথি মারে। আমার বড়ো ছেলেটাও রেগে গিয়ে উলটো মারতে গেলে তাকে সবাই মিলে মারতে মারতে বেহুশ করে ফেলে। আর্মি সেনারা এসে তখন ওদের কাউকে কিছু বলেনি। আমাদের ঘরের সব পুরুষ লোককে ধরে নিয়ে যায়। একমাস আটকে রেখে ছেড়ে দেয়। ট্রেট দেয় আমাদেরকে দেশ ছেড়ে চলে যেতে। পরে পরিবারের সবাই কলকাতায় চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আমাকেও যেতে বলে। কিন্তু আমি যাইনি।’

‘শুনলাম, আপনার ওয়াইফকে খুব ভালোবাসতেন আপনি?’

‘হ্যাঁ। সবাই-ই তো নিজের ওয়াইফকে ভালোবাসে।’ হেসে কষ্ট ঢাকার চেষ্টা করেন হরেশ নাথ। রিহান কণ্ঠটা নরম করে প্রশ্ন করে, ‘তাহলে আপনিও যাননি কেন ওদের সাথে? ওদের ছাড়া কষ্ট হয় না?’

‘কষ্ট তো হয় বাবা। আমি আমার পরিবারকে যেমন ভালোবাসি, তেমনি ভালোবাসি এখানকার মাটিকে। এখানে আমার জন্ম। এখানেই শেষ নিশ্বাসটা ফেলতে চাই।’

রিহান আর প্রশ্ন করলো না। সে বুঝলো, জাতিভেদে দেশকে ভাগ করা গেলেও, মন থেকে কখনও জন্মভূমির প্রতি ভালোবাসা মোছা যায় না। হরেশ নাথকে সান্ত্বনা দিয়ে সে বললো, ‘দুঃখিত কাকা। পরিবারের কথা মনে করিয়ে আপনাকে কষ্ট দিলাম।’

‘পরিবারের কথা তো সবসময় মনেই থাকে বাবা। নতুন করে মনে করিয়ে দেয়ার কী আছে?’ বলতে বলতে মাথাটা নিচু করে একগ্রাস খাবার তুললেন মুখে হরেশ নাথ। চোখ বেয়ে টুপ করে একফোঁটা অশ্রু মিশে গেল তার খাবারের সাথে। রিহান দেখেও না দেখার ভান করে চুপচাপ খেতে লাগলো।

রিহান খাবার শেষ করে হাত মুছতে মুছতে বললো, ‘কাকা, মুসলমানদের উপর হয়তো আপনার রাগ থাকতে পারে। কিন্তু, এতে মুসলমানদের কোনো দোষ নেই। কিছু উগ্রলোক সবখানেই থাকে। মুসলমান, হিন্দু সব জাতিতেই এরকম উগ্রলোক থাকে। আমি একটা ঘটনা জানি, ১৯৪৪ সালের ঘটনা ওটা, হয়তো আপনিও শুনেছিলেন তখন। কাদের মিয়া নামের এক মুসলিম দিনমজুর ছিল। খুবই দরিদ্র লোক। একদিন কাজে বের না হলে পরিবারকে উপোস থাকতে হয়। তো ওইসময় হিন্দু-মুসলিমের দাঙা বাঁধে। কাদের মিয়াকে কাজে যেতে হবে কলকাতার একটা হিন্দু পাড়ায়, বেশিরভাগ লোক ওখানে হিন্দু। তার স্ত্রী তাকে নিষেধ করে যেতে। কিন্তু ছেলেমেয়ের শুকনো চেহারার দিকে তাকিয়ে সে কাজে বের হয়। হিন্দু পাড়ায় যখন সে যায়, অনেক হিন্দুরা তাকে মারতে আসে। তার পেটে এবং পিঠে ছুরি চালাই। কাদের মিয়া রক্তাক্ত হয়ে পড়ে গিয়ে পানি খেতে চায়, কেউ তাকে পানি খেতে দেয়নি, বাঁচার জন্য সবার সাহায্য চায়, কিন্তু কেউ তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি। তখন ওখানকার স্থানীয় একটা এগারো বছরের মুসলিম বাচ্চা তাকে একগ্লাস পানি এনে দেয়। সে পানি খায়। ওই ছেলেটার বাবা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। হাসপাতালেই কাদের মিয়ার মৃত্যু হয়। কিন্তু তার মৃত্যুর দায়টা আমি সকল হিন্দুদের দিচ্ছি না। যারা এই মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী, তারা হলো উগ্র কিছু লোক। এসব উগ্র লোকের কোনো ধর্ম নেই। এরা সুযোগ সন্ধানী। এরকম লোক ভবিষ্যতেও অনেক দেখা যাবে, সাম্প্রদায়িক দাঙা বাঁধাতে থাকবে ওরা। আপনি তাই মুসলিমদের উপর চাপিয়ে দিয়েন না দোষটা।’

‘না, না, বাবা। আমি মুসলিমদের উপর চাপাইনি দোষটা। মুসলিমদের দোষ দিলে কি আজ এখানে খেতে আসতাম আমি? ঠিক আছে বাবা, আজ তাহলে ওঠি।’

‘আচ্ছা।’

হরেশ নাথ উঠে চলে গেলেন। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ সুফিয়া তাদের কথপোকথন শুনছিল। হরেশ নাথ চলে যেতেই সুফিয়া এঁটো বাসনগুলো নিতে এলো। এঁটো জল সব একটা বাটিতে ঢালতে ঢালতে সে রিহানের উদ্দেশ্যে বললো, ‘আপনি তো ১৯৪৪ সালে এখানে ছিলেন না। তবে কাদের মিয়ার ঘটনাটা কীভাবে জানেন?’

রিহান জবাব দিলো, ‘২০২১ সালের একটা আর্টিকেলে ঘটনাটা জেনেছিলাম।’

‘এত বছর পরও কাদের মিয়ার ঘটনাটা আলোচনা করা হয়?’

‘হুমম… ইতিহাস বলে কথা।

‘আচ্ছা, শুনেন না?’

‘বলেন না?’

‘ভেঙাইলেন?’ হাসলো সুফিয়া।

‘না, বলো।’

‘বলছিলাম কী, রহিম মিয়াকে সাথে নিয়ে একটু বাজারে যান না? কিছু বাজার করতে হবে।’

‘বেশ। যাবো। একটু সাংসারিক হই।’

‘আগেও তো অনেকবার বাজার করেছিলেন চর আলগীতে। তখন সাংসারিক হোননি?’

‘হ্যাঁ। তখন তো দুজনের বাজার করতাম। এখন তো সদস্য একটু বেশি।’

‘আচ্ছা, আমি রহিমকে ডেকে পাঠাচ্ছি তাহলে।’ বলেই এঁটো বাসনগুলো নিয়ে ভেতরে চলে গেল সুফিয়া।

[[চলবে…]]

টুয়েন্টি মিনিটস (চ্যাপ্টার-০৩)
লেখা: ShoheL Rana
পর্ব:-১৪

দুয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে রহিম মিয়ার দিকে বাজারের ব্যাগটা এগিয়ে দিয়ে সুফিয়ে বললো, ‘বাজারে গিয়ে কোনো পঁচা সবজি কিনবে না। দুজন যাচ্ছ, দেখেশুনে বেছে বেছে কিনবা। তাজা দেখে মাছ নেবে।’

‘ঠিক আছে।’ মাথা কাত করলো রহিম মিয়া। সুফিয়া রিহানের হাতে বাজারের টাকাটা দিয়ে বললো, ‘দুইটা মানুষ যাচ্ছেন কিন্তু, ভালো দেখে দেখে বাজার করবেন।’

‘একবার বলছো তো কথাটা রহিমকে। আমি শুনছি।’ টাকাটা পকেটে নিতে নিতে বললো রিহান।

‘আবারও মনে করিয়ে দিলাম আরকি।’

‘ঠিক আছে। চলো রহিম।’ বলেই রহিমকে সাথে নিয়ে গেইটের দিকে এগোলো রিহান। পেছন থেকে সুফিয়া ডাক দিলো, ‘ইউসুফের বাপ…’

‘কী?’ ঘুরে তাকিয়ে মাথা নেড়ে জিজ্ঞেস করলো রিহান।

‘না, কিছু না। একটু ডাকতে মন চাইলো।’

রিহান হেসে চলে যেতে চাইলে সুফিয়া আবার ডাকলো, ‘একটু শুনেন না?’

‘কীইই? বলো?’ ঠোঁটে হাসি লেগে আছে রিহানের। সুফিয়া তাকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকলো। রিহান কাছে এলে সে বললো, ‘দুইটা মালা কি এতদিন থাকে?’

‘আচ্ছা, বুঝছি।’ রিহান ঘুরে চলে যেতে লাগলো। রহিম মিয়া ততক্ষণে গেইট পার হয়ে গেছে।

বাইরের রাস্তায় অনেকগুলো লোক দেখা যাচ্ছে। সচরাচর এতগুলো লোক দেখা যায় না রাস্তায়। আরও অনেকে এসে হাজির হচ্ছে। রিহান রহিম মিয়াকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী হচ্ছে রে এখানে? এতগুলো লোক কেন?’

‘মিছিল করার লাইগা দাঁড়াইছে স্যার। হগল জিনিসপত্রের দাম বাইড়া যাইতাছে তাই প্রতিবাদ করবো ওরা।’

‘তা তুইও করবি না-কি প্রতিবাদ?’

‘হ, আগে বাজার কইরা লই। বাজারে গিয়া জিনিসপত্রের দাম দেইখা রাগটা আরও বাড়ায় লই, প্রতিবাদের জোর পামু শরিলে।’ হাত তুলে নিজের কবজি দেখালো রহিম মিয়া। রিহান হাসলো।

বাজার করে ফিরতে ফিরতে ওরা দেখলো পুরো পথ অবরোধ করা। ক্ষিপ্ত লোকেরা শ্লোগান দিয়ে, হাতে ফেস্টুন ও প্লেকার্ড নিয়ে মিছিল করছে। সেই সময় দুইটা মিলিটারি জিপ এসে থামলো সামনে। গাড়ি থেকে নেমে ওরা হুইসল বাজিয়ে লাঠিচার্জ করতে শুরু করলো মিছিলের উপর। মুহূর্তেই ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়লো মিছিলটা। যে যেদিক পারে ছোটাছুটি করতে লাগলো। রহিমের হাতে ছিল বাজারভর্তি ব্যাগ। লোকের ধাক্কায় সব বাজার ছিটকে পড়ে যেতে পারে, তাই রিহান তাকে আগলে সাবধানে ফাঁক গলে গলে হাঁটছিল। পেছন থেকে একজন রিহানকে ধাক্কা দিলো। রিহান আরও কয়েকজনকে নিয়ে পড়ে গেল রাস্তায়। ভাগ্যিস রহিমের গায়ে লাগেনি ধাক্কাটা। রিহানের হাতে দুইটা মালা ছিল, সুফিয়ার জন্য কেনা। মালা দুইটা হাত থেকে পড়ে গেছে। একটা লোক মিলিটারির তাড়া খেয়ে পালানোর সময় মালা দুইটা মাড়িয়ে দিতে চাইলে, রিহান দ্রুত হাত বসিয়ে দেয় উপরে। লোকটা তার হাতের উপর মাড়িয়ে চলে গেল। রিহান অক্ষত মালা দুইটা নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। কনুইটা কেটে গেছে তার। আর যে হাতে পা দিয়ে মাড়িয়ে গেছে লোকটা, ওই হাতে ধীরে ধীরে ব্যথা বাড়তে লাগলো। হাড্ডি-গুড্ডি ভাঙছে মনে হয় ভেতরে। ভাঙা হাতটা অন্য হাতে ধরে সে রহিম মিয়ার পাশে এসে জিজ্ঞেস করলো, ‘বাজার ঠিক আছে তো?’

‘হ, ঠিক আছে। আপনে ব্যথা পাইছেন? দ্যাহি?’

‘একটা লোক হাতের উপর মাড়িয়ে গেছে। হাড্ডি ভাঙছে মনে হয়, ব্যথা বাড়তেছে।’ বলেই হাতটা কয়েকবার জোরে ঝাড়া দিলো রিহান। রাস্তার একপাশে একটা গাছের আড়ালে নিরাপদে দাঁড়িয়েছে ওরা। কয়েক মিনিটের মধ্যেই মিলিটারিরা রাস্তাটা ফাঁকা করে দিলো। তখন রিহান রহিম মিয়াকে বললো, ‘চলো, রহিম মিয়া। রাস্তা ফাঁকা হয়ছে।’

‘স্যার, যামু? মিলিটারি যদি জিগাই কী কমু?’

‘আমরা তো বাজার করে ফিরছি। হাতে বাজার দেখলে হয়তো কিছু বলবে না।’

‘ঠিক আছে, চলেন।’

রাস্তায় এসে ঘরের দিকে হাঁটলো দুজন বাজার নিয়ে। একটা মিলিটারি এসে সামনে দাঁড়ালো। জিজ্ঞেস করলো, ‘কন হ্যায় আপ লোক?’

রহিম মিয়া উর্দু জানে না। ভাঙা ভাঙা উর্দুতে বললো, ‘হাম বাজার লিয়া আতাহু, স্যার। বাজার… বাজার…’ বাজারের ব্যাগটা তুলে দেখালো সে। মিলিটারিটা ধমক দিয়ে বললো, ‘ঠিক হ্যায়, ফুট…’ বলেই রহিম মিয়ার পাছায় জোরে একটা লাঠির বাড়ি মারলো। বাজারের ব্যাগসহ কিছুটা দৌড়ে পালিয়ে এলো রহিম মিয়া। রিহানও সরে এসেছে। হাঁটতে হাঁটতে রহিম মিয়া বললো, ‘শালার বদমায়েশ, লাঠি মারার আর জায়গা পাইলি না না?’

যে জায়গাটায় মেরেছে, ওখানটায় বেশ চুলকাতে শুরু করলো। রহিম মিয়ার দুহাতে বাজার থাকায়, বেচারা চুলকাতেও পারছে না। রিহানকে সে বললো, ‘স্যার, আমার বাঁহাতের বাজারটা একটু লইবেন?’

‘কেন? একটা পলিথিনে কিছু মাছ, এগুলো তোমার ভারি লাগছে?’

‘স্যার একটু লন না? আমি একটু পর আবার নিমু।’

‘কী হয়ছে বলো তো রহিম মিয়া?’ রিহান আন্দাজ করতে পারলো। তাই সেও মজা করতে লাগলো।

‘স্যার, কিছু অয়নাই। একটু লইবেন?’

‘আমার হাতে ব্যথা পাইছি দেখছো না?’

‘অন্য হাতে একটু লন না?’

‘এই হাতে মালা, দেখছো না?’

এবার রহিম মিয়া আর সহ্য করতে না পেরে থমকে দাঁড়িয়ে চিল্লায় উঠলো, ‘স্যার, হয় বাজারটা একটু লন, আর না হয় আমার পেছনটা একটু চুলকায় দ্যান।’

রিহান তার অবস্থা দেখে হাসতে হাসতে নিজের হাতের ব্যথাটা ভুলে গেল। তারপর অন্যহাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘দাও, মাছের পলিথিনটা আমাকে দাও।’

রহিম মিয়া দ্রুত বাজারটা রিহানের হাতে দিয়ে পেছনটা চুলকাতে চুলকাতে হাঁটতে লাগলো। আর বিড়বিড় করে মিলিটারিদের গালি দিতে লাগলো। রিহান বললো, ‘এভাবে বিড়বিড় না করে সাহস থাকলে ওদের সামনে গিয়ে গালি দাও।’

চুলকানি থামিয়ে রহিম মিয়া বললো, ‘ওই মিলিটারির বাচ্চারে একা পাইয়া লই, আমি খাইছি ওরে।’

‘হ্যাঁ, ও তোমার মার খাওয়ার জন্য একা এসে তোমার সামনে দাঁড়াবে, তাই না? দ্রুত পা চালাও। এমনিতে দেরি হয়ে গেছে। সুফিয়া চিন্তা করতে পারে।’

রহিম মিয়া আরেকবার পেছনটা চুলকিয়ে দ্রুত হাঁটতে লাগলো।

সুফিয়া আগে থেকেই গেইটে দাঁড়িয়েছিল। মিলিটারির লাঠিচার্জের ঘটনাটা তার কানে এসেছে। তাই রিহানদের জন্য চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে৷ ঘামছে সে। শাড়ির আচল দিয়ে ঘনঘন ঘাম মুছছে। যখন দেখলো রিহানরা ফিরে আসছে, তখন যেন সে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। কাছে আসতেই সে জিজ্ঞেস করলো, ‘মিলিটারিরা আপনাদের কিছু করেনি তো?’

‘না, শুধু রহিমের পশ্চাৎদেশে একটা বাড়ি মেরেছে।’ বললো রিহান।

রহিম মিয়া নিজেরটা চাপা দিতে তাড়াতাড়ি করে বললো, ‘স্যারে হাতে ব্যথা পাইছে। পইড়া গিয়া কনুই ছিইলা গ্যাছেগা।’

‘কী হয়েছে দেখি?’ বলে রিহানের হাত থেকে বাজারটা নিয়ে অন্যহাতটা দেখতে লাগলো। হাতটা ধীরে ধীরে অনেকটা ফোলে গেছে। দেখে উত্তেজিত হয়ে বললো, ‘কী করে হলো এটা?’

‘ধাক্কা খেয়ে পড়ে গিয়ে কনুইটা ছিলে গেছে। তখন মিলিটারির ধাওয়া খেয়ে একজন পালানোর সময় আমার হাতটা মাড়িয়ে গেছে।’

‘স্যার, একটা জিনিস লুকাইতাছে।’ মন্তব্য করলো রহিম মিয়া। রিহান চোখ টিপে নিষেধ করলো তাকে, যেন কিছু না বলে। সুফিয়া চোখ রাঙিয়ে বললো, ‘রহিম মিয়া, কী হয়েছে বলো?’

রহিম মিয়া এবার সত্যিটা বলে দিলো, ‘স্যার যহন পইড়া গেছিল, তহন হাত থেইকা মালা দুইডাও পইড়া যায়। ওই মালা দুইডাতে এক লোক পলানোর সময় পা দিয়া মাড়াইবার গেছিল, ওই সময় স্যারে নিজের হাতডা মালার উপর রাইখা দেয় যাতে মালা দুইডার কিছু হইবার না পারে।’

সুফিয়া একবার রিহানের দিকে তাকালো, আরেকবার রহিম মিয়ার দিকে তাকালো। তারপর রহিম মিয়ার অন্য হাতে মাছের পলিথিনটা দিয়ে বললো, ‘বাজারগুলো রান্নাঘরে রেখে তাড়াতাড়ি রূপবান খালাকে ডেকে নিয়ে আসো। রূপবান খালা তেল দিয়ে মালিশ করে দিবে।’

‘ঠিক আছে।’ রহিম মিয়া বাজার নিয়ে ভেতরে চলে যেতে লাগলো। সুফিয়া রিহানের ভালো হাতটা ধরে টানতে টানতে বললো, ‘আপনি আমার সাথে আসেন।’

রিহানকে নিয়ে নিজের কক্ষে গেল সুফিয়া। তারপর জিজ্ঞেস করলো, ‘এমনটা করলেন কেন? এখন ভালো হয়ছে না?’

‘তোমার জন্য মালা কিনছিলাম, মালা দুইটা পিষে দিতো।’ নরম কণ্ঠে বললো রিহান। সুফিয়া ডান হতটা বাড়িয়ে বললো, ‘কই দেখি, মালা দুইটা?’

রিহান সুফিয়ার হাতে মালা দুইটা দিলে, সুফিয়া রাগে ছিঁড়ে ফেলে জানালা দিয়ে ছুঁড়ে মারলো মালা দুইটা। তারপর রিহানের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো, ‘আমার কাছে আপনিই সব। কেন দুইটা মালার জন্য নিজেকে এভাবে কষ্ট দিলেন?’

রিহানও সুফিয়াকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘আর হবে না, এমন ভুল। কাঁদতে হয় না-কি? দেখি, শান্ত হও। রহিম মিয়া লোকটার বিশ্বাস নাই, যেকোনো মুহূর্তে রুমে এসে আমাদের এভাবে দেখে ফেলতে পারে।’

রিহানের কথা শুনে কাঁদতে কাঁদতে হেসে ফেললো সুফিয়া। অশ্রুভেজা চোখ দুটো লাল হয়ে উঠলো তার। রিহান তার চোখ দুটো মুছে দিলো।

[[চলবে…]]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here